ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের ব্যার্থতা:
১। পশ্চিমের ধর্মনিরপেক্ষ বাদীরা প্রায়ই বলে থাকে, “keep your religion to yourself, don’t bring it into politics” একই সুর ধরে আমাদের দেশের কেউ কেউ বলে, “ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার” কিন্তু এই ধারণাটা যৌক্তিক কিনা তা সমাজের সর্বোচ্চ সংগঠনটির (রাষ্ট্র) দিকে তাকালে দেখতে পাই। আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে যত ধর্ম ও ধর্ম প্রচারক এসেছে সকলেই সমাজ সংস্কারের কাজ করেছেন। কিন্তু রাজনীতি ছাড়া সমাজের পরিবর্তন কখনো সম্ভব নয়। সকল ধর্ম প্রচারকরাই রাষ্ট্র ও সমাজ পরিচালনার নীতি গুলোকে পরিবর্তিত ও প্রভাবিত করেছিলেন এবং বিধিবিধান প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাই বলা যায় সমাজে মতাদর্শ প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়াই এক ধরনের রাজনৈতিক প্রচেষ্টা। যে সমাজে ধর্ম বিদ্যমান সেখানে ধর্মের চিরায়ত প্রবনতা হলো সমাজ সংস্কার করা। অর্থাৎ ধর্মের প্রবনতা থেকেই ধর্ম ও রাজনীতির সুগভীর সম্পর্ক প্রতীয়মান। উদাহরন হিসেবে বলা যায় আরবে ইসলাম প্রতিষ্ঠা হবার পর সেখানকার সমাজ ব্যাবস্থা ও রাষ্ট্রীয় কাঠামো পরিবর্তিত হয়ে যায়।
২। “কেউ যেন তার ধর্মীয় বিশ্বাস কে অন্যের উপর না চাপিয়ে দিতে পারে তাই ধর্মকে রাজনীতি থেকে আলাদা রাখা উচিৎ।” এ যুক্তিটি ও একটি খোড়া যুক্তি কারণ সমাজে বসোবাসকারী এক জনের চিন্তা দ্বারা সব সময়ই অন্যে প্রভাবিত হয়। চিন্তার চরিত্রটাই এমন যে তা পূর্ববর্তী কোনো চিন্তার ভিত্তিতেই গড়ে ওঠে। এছাড়া সমাজ বা রাষ্ট্রে ধর্মের প্রভাব থাকবে না, এটাকেও আমরা একটা নতুন এক ধর্মীয় মতাদর্শ বলতে পারি। যে ধর্মের নাম ‘ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ’। কারণ ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ সৃষ্টিকর্তা ও ধর্ম সম্পর্কে নতুন চিন্তা সহকারে এক নতুন মতাদর্শ সমাজে নিয়ে এসেছে। যা অন্যান্য ধর্মীয় বিশ্বাসের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। যেমন কোন কর্তৃপক্ষ যদি বলে ‘এখানে কোন আইন থাকবে না’। এটাও একটা নতুন আইন সৃষ্টি করে। উদাহরন স্বরুপ ইসলাম রাষ্ট্রে সুদ ভিত্তিক অর্থনীতির অনুমোদন দেয় না। ফলে ধর্মনিরপেক্ষ পুজিবাদী রাষ্ট্রে সৃষ্টিকর্তার দেওয়া আইন মান্য করা বা ধর্ম পালন করা সম্ভব নয়। বরং ধর্মনিরপেক্ষতাবাদই অন্য ধর্মের স্বাধীনতা দেয় না।
৩। কেউ কেউ বলে, “ এই আধুনিক যুগে সৃষ্টিকর্তার আইন বা ধর্মীয় আইন অচল। ধর্মীয় আইন এখন সেকেলে”। কিন্তু বাস্তবতা হলো মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি (instinct) সব সময় স্থির ও অপরিবর্তনশীল। সব কালেই মানুষের শারীরিক ও মানসিক ক্ষুধা ছিল, আছে ও থাকবে। তাই মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি অপরিবর্তনশীল হওয়ায় অতীতে যা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি ও মনুষ্য সমাজের জন্য ক্ষতিকর ছিল ভবিষ্যতেও তা একই রকম থাকবে। অতীতেও নারী-পুরুষের মধ্যে জৈবিক ক্ষুধা, সন্তান উৎপাদন ও সম্পদের মালিকানার আকাঙ্ক্ষা, আধ্যাত্মিক ক্ষুধা (Spiritual instinct)/বড় শক্তির আনুগত্য করা/সৃষ্টিকর্তার উপাসনা করার বিষয়গুলো বিদ্যমান ছিল, বর্তমানেও আছে ভবিষ্যতেও থাকবে। আর এ সকল চাহিদাগুলো সুষ্ঠুভাবে পূরণের মধ্যেই সামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বিদ্যমান। তাই এ চাহিদাগুলো পূরণের জন্য একটি সার্বজনীন সর্বযুগ উপযোগী নীতি ও আইন থাকাটাই ব্যাঞ্জনীয় ও যৌক্তিক। যেহেতু সৃষ্টিকর্তা মানুষের এসকল প্রবৃত্তির স্রষ্টা, তাই সব যুগের উপযোগী,সব জাতি, বর্ণের মানুষের সবচেয়ে সুন্দর ভাবে এগুলো পূরণ করার বিধান তিনিই (আল্লাহ তায়ালা) শুধু ঠিক ভাবে দিতে সক্ষম। সুতরাং সৃষ্টিকর্তার আইনের ক্ষেত্রে একাল-সেকাল বা আধুনিক-অনাধুনিক বলা অযৌক্তিক। তাছাড়া আমাদের সুখ-দুঃখের অনুভুতি, হাসি-কান্না, ছোটদের স্নেহকরা, সত্যবাদীকে পছন্দ করার মত বিষয়গুলো তো সৃষ্টির শুরু থেকেই চলে আসছে। পুরাতন বলে কি এগুলো আমরা পরিহার করি? অথবা নতুন রোগ বলে কেউ কি এইডসকে স্বাগতম জানায়? তাই পুরাতন কোন কিছু বর্তমান যুগের জন্য ভাল নয় এবং নতুন বলে কোন কিছু ভালো হবে এরও কোন যৌক্তিক ভিত্তি নেই।
এবার আসা যাক আরো কিছু বাস্তবিক যুক্তির আলোচনায়। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের উদ্ভব হয়েছিল চার্চের শোষণ নির্যাতনের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার (Negative Reaction) ফল স্বরুপ। কিন্তু কোনো ঠিক বা শুদ্ধ মতবাদ কখনো পরিবেশের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া থেকে জন্ম নিতে পারে না। কারন ঐ পরিবেশ-পরিস্থিতি যদি সরিয়ে ফেলা হয় বা ভিন্ন রকম হয় তাহলে ঐ মতবাদের সমস্ত ধারনা (Concept) অগ্রহনযোগ্য বা বাতিল হয়ে যাবে। অর্থাৎ ধরা যাক চার্চের শাসনে যদি ইউরোপে শান্তি বিরাজ করতো তাহলে ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণা সেখানকার মানুষের কাছে থাকত সম্পূর্ণ অগ্রহনযোগ্য। অর্থাৎ ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ কোন বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠেনি।
সর্বজন স্বীকৃত ও প্রমানিত ঈসা (আঃ) এর উর্ধ্ব আরোহণের পর ঈঞ্জিলের বার বার সংস্করণ করা হয়। ফলে এর মধ্যে খ্রিস্টান যাজকেরা তাদের মনগড়া মতবাদ, চিন্তা-ভাবনা ঢুকিয়ে এর মৌলিকত্ব নষ্ট করে ফেলে। ফলে এটি হয়ে ওঠে আরেকটি মানুষের তৈরি রাষ্ট্র বা সমাজ পরিচালনার দলিল। তাই ধর্মনিরপেক্ষবাদী বিপ্লবের পর আরেকটি মানুষের তৈরি ব্যাবস্থাই গ্রহন করা হয়। নতুন উৎসও সেই মানব সৃষ্ট মতবাদ। যার মধ্যে ভুল ও সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তাই ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় ইউরোপে মূলতঃ কোন পরিবর্তন আসেনি। কারণ একটি মানুষের তৈরি ব্যাবস্থা পরিবর্তিত হয়ে আর একটি মানুষের তৈরি ব্যাবস্থা এসেছে। এছাড়া খ্রিষ্টান ধর্মের অভিজ্ঞতা দিয়ে সব ধর্মকে বিচার করা যৌক্তিক নয়। এবং বাকি সব ধর্মে সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত বাণী বিকৃত হয়েছে এ ধারণাও ঠিক নয়। কারণ ইসলাম ধর্মের কুরআনই তার বাস্তব প্রমাণ। কুরআনের আদর্শ বাস্তবায়নের ফলে ইউরোপের মতো অন্ধকারাচ্ছন্ন আরব ঐ সমকালীন সময়েই ১৪০০ বছরের এক স্বর্ণালী সভ্যতার নিদর্শন হয়ে আছে। খিলাফতের শাসনামলে এ রাষ্ট্র জ্ঞান-বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতা এবং সামাজিক স্থিতিশীলতা ও সাংস্কৃতিক উতকর্ষতার অনবদ্য এক উদাহরণ। কিন্তু আজকের মুসলিম বিশ্বের দিকে তাকালে দেখা যায় কুরআন-সুন্নাহর আদর্শ ভিত্তিক সেই রাষ্ট্র ব্যাবস্থার অনুপস্থিতিতে পর্যাপ্ত সম্পদ হাতে থাকা সত্ত্বেও মুসলিমরা আজ দরিদ্র পীড়িত, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি-অর্থনীতির দিক থেকে পিছিয়ে পরা এক জাতি। তাই আবারো সারা বিশ্বের মুসলিমরা ইসলামী আদর্শিক রাষ্ট্র ব্যাবস্থা ফিরিয়ে আনতে সোচ্চার।
আমেরিকা বা ব্রিটেনে প্রথম সংবিধান প্রণয়ন ও গ্রহণকালে সেখানকার সমাজে সমকামিতা প্রচন্ডভাবে ঘৃনা করা হতো, আর পর্ণগ্রাফির কথা তো কল্পনাই করা যেত না। কিন্তু সে সময়ের সংবিধান প্রনেতারা যদি আজকে দেখতেন, তাদের সংবিধান অনুসরণ করে সমকামীরাই আজ সহজে পার্লামেন্ট সদস্য হচ্ছে। পর্ণগ্রাফি বিস্তরভাবে ছড়ানো হচ্ছে সমাজে। এবং ব্রিটেনে দশ লক্ষেরও বেশি নাগরিক বিভিন্ন অপরাধে জেলের মধ্যে রয়েছে। এসব অনুধাবন করার ক্ষমতা তাদের থাকলে তারা এ সংবিধান ভিন্নভাবেই লিখতেন। অর্থাৎ এ থেকে স্পষ্টভাবে বোঝা যায় মানুষের সীমিত জ্ঞানের পরিধি দিয়ে এবং ভবিষ্যৎ বাস্তবতা বিশদ ও ঠিক ভাবে বুঝতে পারার অক্ষমতার কারণে মানুষের তৈরী জীবন বিধান দিয়ে সমাজ কখনো সর্বযুগোপযোগী ব্যাবস্থা সহকারে শান্তিপূর্ণভাবে চলতে পারে না।
ধর্মনিরপেক্ষতা মানুষের সহজাত প্রকৃতি বা স্বভাব বুঝতেও ব্যার্থ হয়েছে। একটু লক্ষ করলেই বোঝা যায় পৃথিবীর যে কোন প্রান্তের যে কোন মানুষ বড় কোন শক্তি বা তার চেয়ে চিন্তা-ভাবনার দিক থেকে অধিকতর শ্রেষ্ঠ মনে করে তার আনুগত্য প্রকাশ করতে চায় যেমন- কেউ সূর্য, চন্দ্র, বৃহৎ গাছ, আগুন। আবার কেউ কেউ তার চেয়ে উন্নত কোন মানুষের চিন্তার পুজারী যেমন মার্কস ও লেলিনবাদীরা। কিন্তু সমস্যাটি ঘটে তখন, যখন বস্তু ও মহাজগতের প্রকৃত সৃষ্টিকর্তার উপাসনা না করে মানুষ কোন সৃষ্ট বস্তুর আনুগত্য করে। সৃষ্টিকর্তার উপাসনা করার তার সহজাত প্রবৃত্তিকে ভুলভাবে নিবৃত করতে চায়। কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ মানুষের কাছে সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব ও তার উপাসনা করা বা না-করার ব্যাপারে কোন ঠিক ও সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত দিতে পারেনি। পশ্চিমের মানুষের আধ্যাত্মিক চিন্তার খোরাক যোগাতে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ চুড়ান্তভাবে ব্যর্থ। তাই দেখা যায় অনেক অর্থ-বিত্তের মাঝেও বিষণ্নতা ও মানসিক রোগ পশ্চিমে মহামারি আকার ধারন করছে। সর্বোপরি সবচেয়ে বড় শক্তিধর সৃষ্টিকর্তার উপর মানুষের যে নির্ভরতা বা তার সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করার মানুষের যে সহজাত আকাঙ্ক্ষা তা মূলতঃ সৃষ্টিকর্তার হুকুম বা সামগ্রীক জীবন বিধান মান্য করারই নির্ভরতা বা মনস্ত্বাত্ত্বিক ক্ষুধা। তাই মানুষ সহজাতভাবেই সৃষ্টিকর্তার জীবন ব্যাবস্থা ব্যাক্তিগত জীবন থেকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ও মানতে চায়। এবং তা মান্য করেই প্রশান্তি লাভ করতে পারে। কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ মানুষের জীবনের এই সকল মৌলিক চাহিদার যোগান দিতে সম্পূর্ণরুপে ব্যার্থ হয়েছে।
ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের বিপ্লবে সৃষ্টিকর্তার ধর্মকে অস্বীকারকারী গোষ্টির সঙ্গে ধর্মকে বা সৃষ্টিকর্তাকে বিশ্বাসকারী চিন্তাবিদদের যে কম্প্রমাইজ বা আপোষ হয়েছিল সেটিও ছিল ভিত্তিহীন ও অযৌক্তি। কেননা দুটি সাংঘর্ষিক বা বিপরীতমূখী বিষয়ের মধ্যে কখনো আপোষ হওয়া অসম্ভব। উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। যেমন এক দল লোক বলল, ঢাকা নামে একটি শহর আছে। আরেক দল লোক বলল, ঢাকা নামে কোন শহর নাই। তখন তাদের মধ্যে কম্প্রমাইজ হয়ে এর মাঝামাঝি কোন মতে পৌছান হয়, তাহলে সে সমাধান হবে সত্য বিবর্জিত। তাই সৃষ্টিকর্তা আছে, না সৃষ্টিকর্তা নেই এ দুটির মাঝে কম্প্রমাইজও কোন ঠিক সিদ্ধান্ত দিতে পারে না। কারণ এ দুটোর যে কোন একটি বাস্তবতা সত্য ধারণ করে। তাই ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ মহাজগতের সাথে সম্পৃক্ত, মানুষ ও সমাজের সাথে সম্পৃক্ত এই সত্যকে বা এই বিষয়টিকে যখন মানুষের দৈনন্দিন জীবন ও রাষ্ট্র থেকে আলাদা রাখতে চায় অযৌক্তিকভাবে। সৃষ্টিকর্তা কি শুধু মানুষের ব্যাক্তিগত জীবনের সমস্যা সমাধান দিতে পারেন, তিনি কি সমষ্টিগত জীবনের সমাধান দিতে পারেন না? প্রত্যেকটি মানুষকে সৃষ্টিকর্তার বিষয়ক এ মৌলিক প্রশ্নের ঠিক উত্তর না দিলে, তা মানুষের জীবনে ও সমাজে অসঙ্গতি, অসামঞ্জস্যতা, স্ব-বিরোধীতা ও অনিয়ম ছাড়া কিছুই দিতে পারেনা। কারণ ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা মানুষ এবং সমাজের ব্যাপারে কোনটি ভালো কোনটি খারাপ চুড়ান্তভাবে বলতে পারেনা। সুখ, প্রশান্তি ও তৃপ্তির ধারণায় থাকেনা কোন ঐক্য। ফলে সৃষ্টি হয় দিধা-দ্বন্দ্ব (confusion) ও অসামঞ্জস্যতা (contradiction)। সত্য ও মিথ্যার কম্প্রমাইজ তাদের জীবনে নিয়ে আসে চুড়ান্ত বিভ্রান্তি। এর প্রতিফলন আমরা ধর্মনিরপেক্ষ জাতিগুলোর নীতি প্রণয়ন ও জীবন পদ্ধতি (life style) এর মধ্যেও স্পষ্ট দেখতে পাই। পাশাপাশি আমরা দেখতে পাই মানুষের স্বভাবের সঙ্গে মানানসই ব্যাক্তিগত জীবন থেকে রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সৃষ্টিকর্তার আদেশ নিষেধ মেনে জীবন যাপনের ব্যাবস্থা (System) শুধু ইসলামই দেয়। এখানে ভালো-মন্দ শরিয়া আইনের মাধ্যমে স্থায়ী ভাবে নির্দিষ্ট, সুস্পষ্ট এবং যা বাস্তবায়ন যোগ্য। এর প্রমাণ হলো ইসলামী খিলাফতের ১৪০০ বছরের ইতিহাস।
রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে আলাদা করার পরই সেখানে বিপ্লব (Industrial Revolution) ঘটার পর অর্থনৈতিক ও টেকনোলজির উন্নয়ন ঘটেছে। এই উদাহরন পশ্চিমারা অনেক মুসলিমকে বোঝানোর চেষ্টা করছে এখনো। কেউ কেউ ভুল করে এ মতবাদের দিকে ধাবিত হচ্ছে। কিন্তু আসল কথা হলো যে সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার স্লোগান নিয়ে যে উন্নয়নের কথা তারা বলেছিল তার বাস্তবায়ন কি আজও ঘটেছে? যতটুকু ঘটেছে সে বস্তুবাদী উন্নয়ন তাদের আজ কোথায় এনে দাঁড় করিয়েছে? ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ধারণ করার পর যে পুঁজিবাদী ও ভোগবাদী জীবন যাপনের দিকে তারা ধাবিত হয়েছে সে কারণে সারা বিশ্ব থেকে অন্যান্য জাতির সম্পদ ছিনিয়ে নেওয়ার কৌশল তারা অবলম্বন করেছে। সৃষ্ট হয়েছে উপনিবেশবাদ, নব্য উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের। অন্যান্য জাতিগুলোকে অসাম্য ও পরাধীনতার মধ্যে ঠেলে দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা কি নিজেদের সমাজে সাম্য প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে? পৃথিবীর অধিকাংশ পুঁজির মালিক এখন গুটি কয়েক মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানী। সম্পদশালী পুজীর মালিকরাই তাদের স্বার্থরক্ষাকারীদের তাদের শাসন ক্ষমতায় বসায়। চার্চের শাসনামলের মতো ইউরোপের মানুষ এখনো প্রচন্ড রক্ষণশীল। অভিজাত শ্রেণীর সামাজিক কাঠামোর (Aristocratic Social Class Structure) কারণে এখনো এ অভিজাত শ্রেণীর মানুষেরা জনগণের কোন ম্যানডেট ছাড়াই বৃটেনের লর্ডসভার সদস্য পদ লাভ করে। শ্রমিক শ্রেণীর মানুষেরা এখনো প্রচন্ড ভোগান্তি ও বৈষম্যের স্বীকার হচ্ছে। ধর্মনিরপেক্ষবাদী এই বিপ্লব সংখ্যা গরিষ্ট মনুষের এই দুর্ভোগ কোন উল্লেখযোগ্য হারে কমাতে পারেনি। এখনো সংখ্যা গরিষ্ট মানুষ অর্থনৈতিক দাসত্বের মধ্যেই রয়েছে। এর উদাহরন হলো- ২০০৭ সালে ও আমেরিকাতে আড়াই (2.5) কোটি ভাসমান মানুষ বসবাস করে।
অপর পক্ষে পশ্চিমের মানুষের সামগ্রীক জীবনের চিন্তা চেতনা ও সংস্কৃতিক কাঠামো আজ সত্য-মিথ্যার দ্বন্দ্বে জর্জরিত। ধর্মনিরপেক্ষবাদ তাদের সমাজে সীমাহীন বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে। শুধু বস্তুর মাঝে সুখ তথা ভোগের মাঝে সুখ এই মিথ্যা ধারণা, হতাশা ও বিভ্রান্তি ছাড়া কিছু দেয়নি। তাই আমরা যখন দেখি পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার ৪% এর ও কম আমেরিকায় বাস করে কিন্তু তারা পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার ৩৫% এর ও বেশী সম্পদ ভোগ কর। এমনকি আমেরিকার মধ্যেও সেখানকার ১০% মানুষ সে দেশের ৯০% এরও বেশি সম্পদের মালিক। এবং সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষই দারিদ্র সীমার নিচে বাস করে। আর সে দেশেরই পুঁজিবাদী শাসকগোষ্ঠি শুধু সম্পদ লুটের নেশায় পৃথিবীর সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মতামতের প্রতি বৃদ্ধা আঙ্গুলি উচিয়ে গুচ্ছ বোমার আঘাতে হত্যা করে আফগানিস্তান ও ইরাকের লক্ষ লক্ষ আবাল বৃদ্ধ-বনিতাকে। এ দৃশ্য দেখে সচেতন মানুষেরা সত্যিই বিষ্ময়াভিভূত হয় না। দুঃখ ও শোকে এ ভ্রান্ত চিন্তা বহনকারীদের নিবারণের জন্য ফেটে পড়ে রাজপথে। যখন দেখা যায় যুক্তরাষ্ট্রে তরুণ রবার্ট হক্সিন্স বিখ্যাত হবার আশায় ৮ জনকে গুলি করে আত্মহত্যা করে, তখন সুস্পষ্ট জীবন ব্যাবস্থা পাওয়া জনগোষ্টি মোটেই অবাক হয়না। যখন দেখা যায় ব্যাক্তি স্বাধীনতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতার কথা বলে তারা মুখে ফেনা তুলে ফেলে অথচ ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদের সুতিকাগার রাষ্ট্রে (ফ্রান্স) ‘হিজাব’ নিষিদ্ধ করা হয় আইন করে; তখনও মোটেও আশ্চার্যান্বিত হওয়ার কিছু থাকেনা। যখন দেখা যায় ইউরোপ আমেরিকার নারীরা নিজের বাচ্চা ও স্বামীর চেয়ে পোষা কুকুরের প্রতি যত্নশীল তখন হতবাক হবার কিছুই নেই। কারন বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে ভিত্তিহীন ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদী অযৌক্তিক চিন্তাই তাদের চিন্তা-ভাবনা ও জীবন পরিচালনার ভিত্তি। এই ভুল মতবাদের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠা চিন্তা, ধারণা ও জীবন দর্শনই আজ তাদের পতনের শেষ প্রান্তে নিয়ে এসেছে।
খান শরীফুজ্জামান সোহেল