[নিম্নোক্ত প্রবন্ধটি প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ ও গবেষক শাইখ তাকী উদ্দীন আন-নাবহানি (রাহিমাহুল্লাহ) কর্তৃক লিখিত ‘আদ-দাওলাতুল ইসলামীয়্যাহ’ (ইসলামী রাষ্ট্র) বইটির খসড়া অনুবাদ-এর একাংশ হতে নেয়া হয়েছে]
শুরুর কথাঃ
রাসূল হিসাবে দায়িত্ব প্রাপ্ত হবার পর মুহাম্মদ (সা) সর্বপ্রথম আহবান জানালেন তার সহধর্মিনী খাদিজা (রা)কে এবং তিনি তাঁর উপর বিশ্বাস স্থাপন করলেন। তারপর তিনি তাঁর চাচাতো ভাই আলী (রা) কে ইসলামের দাওয়াত দেন এবং তিনিও তাঁর উপর বিশ্বাস আনেন। এরপর তিনি তাঁর ক্রীতদাস যায়েদ (রা) কে আহবান করলে যায়েদ (রা)ও তাঁর উপর ঈমান আনেন। তারপর তিনি তাঁর বন্ধু আবু বকর (রা) কে আহবান জানান এবং তিনিও বিশ্বাস স্থাপন করেন। এরপর তিনি জনসাধারনকে ইসলামের দিকে আহবান করতে থাকেন, এদের মধ্যে কিছু মানুষ ঈমান আনে আর বাকীরা তা গ্রহণ করতে অস্বীকার করে।
আবু বকর (রা) ইসলাম গ্রহন করার পর তার কাছের মানুষদেরকে তার বিশ্বাসের কথা জানান এবং তাদের আল্লাহতায়ালা ও তাঁর রাসুলের (সা) দিকে আহবান করেন। আবু বকর ছিলেন তার আপন লোকদের মধ্যে উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন। লোকেরা তার সাহচার্য উপভোগ করত এবং বিভিন্ন বিষয়ে তার সাথে পরামর্শ করত। সমাজে তার এ সমস্ত প্রভাব কাজে লাগিয়ে তিনি উসমান ইবনে ‘আফফান (রা)কে ইসলামের ছায়াতলে নিয়ে আসেন। এভাবে পরবর্তীতে যুবাইর ইবন আল-‘আওওয়াম (রা), ‘আবদুর রহমান ইবন ‘আওফ (রা), সা’দ ইবন আবি ওয়াক্কাস (রা), তালহা ইবন ‘উবাইদুল্লাহ ইসলাম গ্রহন করেন। এদের সকলকে তিনি মুহাম্মদ (সা) এর কাছে নিয়ে আসেন, তারা সকলে তাদের ঈমান আনার ঘোষনা দেন এবং নামাজ আদায় করেন। এরপর, ‘আমির ইবন আল-যাররাহ্ (আবু উবাইদাহ নামে পরিচিত) ইসলাম গ্রহণ করেন এবং ‘আব্দুলাহ্ ইবন ‘আবদ আল-আসাদ (আবু সালামাহ্ নামে পরিচিত) ও তার সাথে আল-আরকাম ইবন আবি আল-আরকাম, ‘উসমান ইবন মাজ’য়ুন এবং আরও অনেকে ইসলাম গ্রহণ করেন। এভাবে একের পর এক বহুসংখ্যক মানুষ ইসলামের ছায়াতলে চলে আসে যে পর্যন্ত না এ বিষয়টি কুরাইশ সম্প্রদায়ের মাঝে আলোচনার বস্তুতে পরিণত হয়।
প্রথম দিকে মুহাম্মদ (সা) বাড়ি বাড়ি গিয়ে মানুষকে ইসলামের দাওয়াত দিতেন। তাদের বলতেন যে, আল্লাহতায়ালা তাদের তাঁর ইবাদত করতে এবং তাঁর সাথে কাউকে শরীক না করার জন্য আদেশ দিয়েছেন। এরপর তিনি কুরআনের নিম্নোক্ত আয়াতের পরিপ্রেক্ষিতে মক্কার মানুষকে প্রকাশ্যে ইসলামের দিকে আহবান করতে শুরু করেন, যেখানে আল্লাহ আদেশ করছেন,
“হে বস্ত্রাবৃত! উঠো এবং সতর্ক করো।” [সুরা আল-মুদ্দাছির: ১-২]
পরবর্তীতে আল্লাহর রাসুল (সা) দ্বীন ইসলামের দলভুক্ত মানুষেদের নিয়ে গোপনে একত্রিত হতেন এবং তাদের দ্বীন শিক্ষা দিতেন। প্রথমদিকে রাসুল (সা) এর সাহাবীরা কুরাইশদের আড়ালে মক্কার প্রান্তসীমায় অবস্থিত পাহাড়ে নামাজ আদায় করতেন। যখনই নতুন কেউ ইসলাম গ্রহণ করতো, আলাহর রাসুল (সা) তাকে কুরআন শেখানোর জন্য পূর্বে ইসলাম গ্রহনকারী একজনকে পাঠাতেন। তিনি (সা) ফাতিমা বিনত আল-খাত্তাব ও তার স্বামী সা’ঈদ কে কুরআন শেখানোর কাজে খাব্বাব ইবনে আল-আরাতকে নিযুক্ত করেছিলেন। একদিন যখন তারা দু’জন এভাবে খাব্বাব (রা) এর কাছে কুরআন শিখছিলেন, তখন সেখানে ওমর ইবন আল-খাত্তাব আকষ্মিক ভাবে উপস্থিত হন এবং সাথে সাথে ইসলাম গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে আল্লাহর রাসুল (সা) অনুভব করেন এভাবে শিক্ষা দান যথেষ্ঠ নয়, তাই তিনি আরকাম ইবনে আল আরকামের বাসগৃহকে তাঁর দাওয়াতের কেন্দ্র হিসাবে মনোনীত করেন এবং এখান থেকেই তিনি মুসলিমদের কুরআন শিক্ষা দিতেন, ইসলাম সম্মন্ধে আলোচনা করতেন, তাদেরকে কুরআন তিলওয়াত ও কুরআন নিয়ে চিন্তা করার জন্য উৎসাহ দিতেন। যখন কেউ ইসলাম গ্রহন করতো, আলাহর রাসুল (সা) তার সাথে দার-উল-আরকামে সাক্ষাৎ করতেন। তিন বছর পর্যন্ত তিনি এভাবে মুসলিমদের শিক্ষা দেন, নামাজে ইমামতি করেন, শেষ রাত্রে তাদেও সাথে তাহাজ্জুদ আদায় করেন, তাদের চিন্তা চেতনাকে উদ্দীপ্ত করেন, নামাজ এবং কুরআন তিলওয়াতের মাধ্যমে তাদের ঈমানকে আরও মজবুত করেন। কুরআনের আয়াত ও আল্লাহর সৃষ্টিকে গভীর ভাবে পর্যালোচনার মাধ্যমে নও মুসলিমদের চিন্তাধারাকে আলোকিত করেন। এছাড়াও তিনি তাদেরকে আল্লাহর কাছে নিজেকে পরিপূর্ণ ভাবে সর্মপনের মাধ্যমে সকল কষ্ট ও বাধাঁ অতিক্রমের উপায় শেখান।
মুহাম্মদ (সা) তাঁর দলভুক্ত মুসলিমদের সাথে এভাবে দার-উল-আরকামে সময় অতিবাহিত করতে থাকেন যে পর্যন্ত না আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা নিম্নোক্ত আয়াত নাযিল করেন,
“অতএব তোমাকে যে বিষয়ে আদেশ করা হয়েছে, তা প্রকাশ্যে ঘোষণা কর এবং মুশরিকদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নাও।” [সুরা হিজরঃ ৯৪]