(নিম্নোক্ত প্রবন্ধটি আদনান খান রচিত “Geopolitical Myths” বইটির বাংলা অনুবাদের একাংশ হতে গৃহীত)
১৯৬০ এবং ১৯৭০ এর দশকে দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, হংকং এরং তাইওয়ানের ব্যাপক ও দ্রুত শিল্পায়নকে বুঝানোর জন্য ‘টাইগার’ অর্থনীতি শব্দটি ব্যবহার করা হয়। এই চার টাইগার অন্যান্য এশীয় অর্থনীতি-চীন এবং জাপানের সাথে অনেকক্ষেত্রে সাদৃশ্যপূর্ণ। যারা এশীয় ধাচের রপ্তানীমুখী অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথিকৃৎ। এই দেশসমূহ পশ্চিমা শিল্পোন্নত দেশগুলোকে লক্ষ্য করে পণ্য উৎপাদন শুরু করে এবং সরকারী নীতি গ্রহণের মাধ্যমে আভ্যন্তরীণ ব্যবহারকে নিরুৎসাহিত করে।
এ জাতিগুলোর দিকে ভালভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, তাদের উন্নয়ন ছিল সম্পূর্ণ কেন্দ্র নিয়ন্ত্রিত, সরকারী ভতুর্কি এবং রক্ষণশীল নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত।
১৯৬৫ সালে স্বাধীনতা লাভের পর সিঙ্গাপুর ছোট আভ্যন্তরীণ বাজার ও সম্পদের অপ্রতুলতা অনুভব করে। ফলশ্রুতিতে ১৯৬৮ সালে সিঙ্গাপুর ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট বোর্ড গঠন করে। এর দায়িত্ব ছিল সিঙ্গাপুরের উৎপাদিত পণ্যকে উৎসাহিত করবার জন্য অর্থনৈতিক পরিকল্পনা প্রণয়ন। সিঙ্গাপুরের প্রশাসন বেকারত্বকে কমিয়ে নিয়ে আসে, জীবনমান উন্নয়নের জন্য গণগৃহায়ন প্রকল্প চালু করে। সাথে সাথে ব্যবসাবান্ধব, বিদেশী বিনিয়োগ নির্ভর, রপ্তানীমুখী ব্যবসায়ী নীতি প্রণয়ন ও জাতীয় করপোরেশনগুলোতে সরাসরি সরকারী বিনিয়োগ করা হয়। সরকারী হস্তক্ষেপের কারণে সিঙ্গাপুরের অর্থনীতি অনেক উন্নত হয়, বিশেষত: ইলেকট্রনিক্স, কেমিক্যাল এবং সেবাশিল্পে। সিঙ্গাপুর সরকার তার অর্থনীতিকে তেমাসে-লিংকড্ কোম্পানীর (টি.এল.সি) দিকে পরিচালিত করতে থাকে। এই কোম্পানীসমূহের রয়েছে সার্বভৌম সম্পদের তহবিল। টি.এল.সি গুলো বিশেষত উৎপাদনখাতে কাজ করে এবং এরা বাণিজ্যিক সত্ত্বা হিসেবে পরিগণিত হয়। জিডিপির শতকরা ৬০ ভাগের অবদান ছিল এ কোম্পানীসমূহের।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর তাইওয়ানের প্রথম নেতা কমিটঙের শাসনামলে ক্ষুদ্র দ্বীপ দেশটির উন্নয়ন শুরু হয়। তখন কিছু অর্থনৈতিক নীতি ও পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়। নতুন মুদ্রানীতি প্রণয়ন করা হয় এবং যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা প্রচুর অর্থনৈতিক সাহায্য উন্নয়নের গতিকে ত্বরান্বিত করে। সরকার প্রতিস্থাপন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অর্থনীতিতে সরাসরি হস্তক্ষেপ করে। কৃষিখাতের মাধ্যমে অর্জিত সম্পদকে কাজে লাগানো হত শিল্পখাতে। শিল্পখাতকে উন্নয়ন করবার জন্য শস্য রপ্তানীর মাধ্যমে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করা হত কলকারখানার মেশিনারী ক্রয়ের জন্য। সরকার আমদানি শুল্ক বাড়িয়ে দেয়, বিদেশের সাথে ব্যবসাকে নিয়ন্ত্রন করে এবং দেশীয় শিল্পকে রক্ষার জন্য আমদানিকে নিরুৎসাহিত করে। ১৯৬০ এর মধ্যে তাইওয়ানের শিল্পসমূহ অনুধাবন করতে পারল ইতোমধ্যে আভ্যন্তরীণ বাজার সম্পৃক্ত হয়ে গেছে। তখন দেশটি অর্থনৈতিক নীতির মাধ্যমে রপ্তানি বাড়ানোর দিকে মনোনিবেশ করে। চিয়াং চিং কুয়ু’র ১০ টি প্রধান অবকাঠামোগত প্রকল্প এবং বিশ্বের সর্বপ্রথম রপ্তানী প্রক্রিয়াকরন অঞ্চলের মাধ্যমে তাইওয়ানে ব্যাপক শিল্পায়নের ভিত্তি রচিত হয়।
দক্ষিণ কোরিয়াও কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপের মাধ্যমে একইভাবে এগিয়ে যায়। ১৯৬১ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের মাধ্যমে অনেকগুলো পঞ্চবার্ষিকী নীতির প্রথমটি প্রণীত হয়। আর এর মাধ্যমে অতি স্বল্প সময়ে যে উন্নয়ন হয়েছে তা মুক্তবাজার ব্যবস্থার মাধ্যমে করা নিতান্তই অসম্ভব ছিল। অর্থনীতিতে আধিপত্য করত কিছু ব্যক্তিমালিকানাধীন বহুজাতিক কোম্পানী যেগুলো চায়েবল নামে পরিচিত ছিল। এছাড়াও লৌহ, ইস্পাত, শক্তি, যোগাযোগ ব্যবস্থা, সার, কেমিক্যাল এবং অন্যান্য ভারী শিল্পের কিছু সরকারী কোম্পানী ছিল। সরকার ঋণের সুবিধা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ব্যক্তিখাতের শিল্পসমূহকে রপ্তানী লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দিত, পরোক্ষভাবে চাপ প্রয়োগ করত এবং গতানুগতিক মুদ্রানীতি ও আর্থিক কৌশল প্রণয়ন করত।
১৯৬৫ সালে সরকার ব্যাংকসমূহকে জাতীয়করণের মাধ্যমে আরও নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠা করে এবং কৃষিভিত্তিক সমবায়কে কৃষি ব্যাংকের সাথে সমন্বিত করে ফেলে। সকল ঋণপ্রদানকারী সংস্থাসমূহের উপর নিয়ন্ত্রন আরোপের মাধ্যমে অন্যান্য ব্যবসায়িক সম্প্রদায়ের উপরও সরকার কতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হয়। ১৯৬১ সালে একজন ডেপুটি প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে ইকোনমিক প্ল্যানিং বোর্ড গঠিত হয়-যা সম্পদ বন্টন, ঋণের প্রবাহকে সুনিশ্চিতকরণ এবং দক্ষিণ কোরিয়ার সব ধরণের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পরিকল্পনা প্রণয়ন করে।
এশিয়ান টাইগারদের উন্নয়ন ব্যাপকভাবে সরকারী হস্তক্ষেপের মাধ্যমে অর্জিত হয়েছিল। আর এটাই ছিল তাদের উন্নয়নের মেরুদন্ড। তাইওয়ান, সিঙ্গাপুর, হংকং একই প্রক্রিয়া অনুসরণ করেছে। আর তাদের বর্তমান অবস্থার জন্য কেন্দ্রীয় বা সরকারী হস্তক্ষেপ ব্যাপক ভূমিকা পালন করেছে-এর জন্য কোনক্রমেই গতানুগতিক ধারার পুঁজিবাদী মুক্তবাজার ব্যবস্থা অনুসৃত হয়নি। এই টাইগারদের অর্থনীতি মূলত ভোক্তাদের অর্থনীতি যেখানে রপ্তানী হল মূল চালিকাশক্তি।