ইসলামের সাংস্কৃতিক জ্ঞান অথবা বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত জ্ঞান– উভয়দিক থেকেই মুসলিম বিশ্ব বর্তমানে অনেক পিছিয়ে আছে। এমনকি কিছু মুসলিম দেশে যেমন: বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং আফ্রিকার কিছু দেশের অশিক্ষিতের বিস্ময়কর রকমের উচ্চহার এসব দেশকে বিপদগ্রস্ত করে তুলেছে। মুসলিম ভূখণ্ডসমূহের অবস্থা এতটা করুণ হওয়ার পেছনে অনেক ‘তথাকথিত আধুনিক মুসলিম’ ইসলামকে দায়ী করার চেষ্টা করে। ইসলামে শিক্ষার গুরুত্ব এবং শিক্ষাক্ষেত্রে মুসলিমদের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস সম্পর্কে অজ্ঞতাই মূলত এর জন্য দায়ী। এ প্রবন্ধে মূলত ইসলামে শিক্ষার গুরুত্ব, শিক্ষাক্ষেত্রে মুসলিমদের ইতিহাস, শিক্ষা ও শিক্ষাব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা এবং ভবিষ্যৎ খিলাফত রাষ্ট্রের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা করা হবে।
ইসলামে জীবনসম্পর্কে যে সমস্ত ধ্যান-ধারণা উপস্থাপন করে সেগুলো আমাদের পছন্দ, অপছন্দ এবং কাজকর্মকে নির্ধারণ করে। ইসলামে উপস্থাপিত ধ্যান-ধারণাসমূহকে জানা এবং এগুলো নিয়ে চিন্তাভাবনা করার মাধ্যমেই মূলত আমাদের মাসসিকতা এবং স্বভাব গড়ে উঠে এবং এ দুটোর সমন্বয়ে আমরা ইসলামী ব্যক্তিত্বে পরিণত হই। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন-
“বলুন, যারা জানে এবং যারা জানে না; তারা কি সমান হতে পারে? [আল-যুমার:৯]
রসুল (সা) বলেন, “জ্ঞান অন্বেষণ করা প্রত্যেক মুসলিমের জন্য ফরয।” [বায়হাকী]।
আবার শিক্ষালব্ধ জ্ঞান নিয়ে চিন্তাভাবনা করাটাকেও ইসলাম যথেষ্ট গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করেছে। যেমন রাসূল (সা) বলেন- “এক ঘণ্টা চিন্তাভাবনা করা সারারাত ইবাদত করার চেয়ে উত্তম।” [আবু আনাস এবং আবু দারদা কর্তৃক বর্ণিত]
রাসূল (সা) মুসিলমদের শিক্ষাদানে বিষয়টিকে যথেষ্ট গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করতেন। যেমন তিনি প্রতি দশজন মুসলিমকে পড়তে শেখানোর বিনিময়ে একজন করে বদরের যুদ্ধবন্দীকে মুক্ত করেছিলেন।
প্রকৃতপক্ষে যে সমস্ত চিন্তাভাবনার উপর ভিত্তি করে কোন একটা সভ্যতা প্রতিষ্ঠিত হয় সে সভ্যতার লোকজনকে ঐ নির্দিষ্ট চিন্তাভাবনায় উদ্বুদ্ধ করার প্রধান উপায় হচ্ছে শিক্ষাব্যবস্থা। শত শত বছর জুড়ে পৃথিবীর বিভিন্ন জাতি তাদের তরুণদেরকে শিক্ষাদানের লক্ষ্যে শিক্ষাদান পদ্ধতির রূপরেখা নির্ধারিত করেছে এবং সিলেবাস প্রণয়ন করেছে। ইতিহাস থেকে দেখা যায়, যখন কোন জাতির উপর আধিপত্য বিস্তারের প্রক্রিয়া চলে তখন তার শিক্ষাব্যবস্থা বা সিলেবাস (পাঠ্যসূচি) পরিবর্তন করে নতুন শিক্ষাব্যবস্থা বা সিলেবাস নির্ধারণ করা হয় যাতে সে জাতির লোকজনের ভূমি বা সম্পদের পাশাপাশি তাদের মনস্তত্বের উপরও বুদ্ধিবৃত্তিক আধিপত্য আরোপ করা সম্ভব হয়। এ ঐতিহাসিক বাস্তবতা বর্তমান পৃথিবীতেও চোখে পড়ে যখন দেখা যায় যে নিজেদের আদর্শিক দৃষ্টিভঙ্গির সাথে সামঞ্জ্যতা বিধানের লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্র মুসলিম বিশ্বের উপর চাপ প্রয়োগ করছে মুসলিমদের শিক্ষাব্যবস্থা পরিবর্তন করার জন্য। যুক্তরাষ্ট্রের এ চাপের কাছে বশ্যতা স্বীকার করে বিশেষত মুসলিম বিশ্বের আরব রাষ্ট্রসমূহ যেমন সৌদিআরব, কুয়েত, জর্দান এবং মিসর প্রভৃতি দেশ “উন্নয়ন এবং যুগের সাথে সামঞ্জস্যতা বিধান” এর অজুহাত দেখিয়ে নিজ নিজ দেশসমূহের শিক্ষার সিলেবাস নতুনভাবে বিন্যস্ত করেছে। এ তথাকথিত আধুনিকায়নের নামে ইসলামী জীবন ব্যবস্থার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহের অন্তর্ভুক্ত একটি বিষয় “আনুগত্য এবং সম্পর্কচ্ছেদ” কে সৌদিআরব বিকৃতভাবে উপস্থাপন করেছে তার স্কুলসমূহের পাঠ্যপুস্তকে; অন্যদিকে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় “জিহাদ” সম্পর্কিত বিষয়সমূহকে জর্দান, মিসর এবং কুয়েত বিকৃত করেছে।
প্রাতিষ্ঠানিক হোক অথবা অপ্রাতিষ্ঠানিক- শিক্ষা হচ্ছে এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে উম্মাহর (জাতির) সন্তানদের অন্তরে তাদের সংস্কৃতিকে সংরক্ষণ করা যায়। শিক্ষা কারিকুলাম বা পাঠ্যসূচি বলতে বোঝায় সে শিক্ষা যেটা রাষ্ট্রকর্তৃক পরিচালিত এবং যা বাস্তবায়নের দায়িত্ব রাষ্ট্রের অর্থাৎ রাষ্ট্র এ শিক্ষা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে শিক্ষাদান শুরুর বয়স, শিক্ষার বিষয় এবং শিক্ষাদান পদ্ধতি নির্ধারণ করে। অন্যদিকে অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা হচ্ছে সেটা যেটা রাষ্ট্র কর্তৃক সরাসরি নির্ধারিত নয় বরং এক্ষেত্রে বাড়িতে, মসজিদে, প্রচার মাধ্যমের (মিডিয়া) সাহায্যে বা সাময়িক কোন প্রকাশনার মাধ্যমে শিক্ষাদান করাটা মুসলিমদের উপর ছেড়ে দেয়া হয়। উভয়ক্ষেত্রেই রাষ্ট্রের দায়িত্ব হচ্ছে এমনসব চিন্তাভাবনা এবং জ্ঞানের শিক্ষাদান নিশ্চিত করা যেগুলো ইসলামী মতাদর্শ থেকে উৎসারিত অথবা এর উপর প্রতিষ্ঠিত।
শিক্ষাদান সংস্কৃতির মূল লক্ষ্য থাকবে উম্মাহ্র তরুণদের যথাযথ উন্নয়ন ঘটানো এবং সঠিক ব্যক্তিত্বের বিকাশ নিশ্চিত করা। যে কোন জাতির প্রতিষ্ঠালাভ এবং টিকে থাকার জন্য সংস্কৃতির ভূমিকা হচ্ছে মেরুদণ্ডের মত। এ সংস্কৃতির উপর ভিত্তি করেই উম্মাহ্র সভ্যতা গড়ে উঠে এবং জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নির্ধারিত হয়। সংস্কৃতির মাধ্যমে উম্মাহ নির্দিষ্ট একটা ছাঁচে গড়ে উঠে। ফলে তাকে অন্যান্য সভ্যসমূহ থেকে পৃথকভাবে চিহ্নিত করা সম্ভবপর হয়।
সংস্কৃতি হচ্ছে এমন একটা জ্ঞান যা ইসলামী আক্বীদার উপর প্রতিষ্ঠিত। এর অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে তাওহীদ (একত্ববাদ) সম্পর্কিত জ্ঞান, আইনশাস্ত্র (ফিকহ), কুরআনের তাফসীর (ব্যাখ্যা) এবং হাদীস। এছাড়া উপর্যুক্ত বিষয়সমূহ বোঝার জন্য প্রয়োজনীয় নিয়মকানুন যেমন ইজতিহাদ (গবেষণার মাধ্যমে আইন বের করার প্রক্রিয়া) সম্পর্কিত জ্ঞান, আরবি ভাষা, হাদিসের শ্রেণীবিভাগ এবং আইনশাস্ত্রের ভিত্তিসমূহ (উসূল) প্রভৃতি ও সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত। এ সমস্ত বিষয়ের সবগুলোই ইসলামী সংস্কৃতি কেননা এদের উৎস হচ্ছে ইসলামী আক্বীদা। অনুরূপভাবে ইসলামী উম্মাহ্র ইতিহাসও এই সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত। কেননা এতে রয়েছে ইসলামী সভ্যতার (হাদারাহ) সাথে জড়িত ঘটনাসমূহ, প্রসিদ্ধ ব্যক্তিবর্গ (রিজাল), নেতৃবৃন্দ এবং উলামাদের বিবরণ। ইসলামপূর্ব আরবি কবিতাসমূহ ইসলামী সংস্কৃতির অংশ কেননা এর অন্তর্গত বিষয়সমূহ আরবি ভাষার শব্দ (words) এবং বাক্যপ্রকরণ অর্থাৎ বাক্যে শব্দসমূহের পূর্বাপর অবস্থান (syntax) বুঝতে সহায়ক বলে এগুলো ইজতিহাদ, তাফসীর ও হাদীস বুঝতে সাহায্য করে।
সংস্কৃতি উম্মাহ্র সদস্যদের চরিত্র গঠন করে। এটা যেহেতু উম্মাহ্র সদস্যদের ঝোঁক বা প্রবণতাকে একটি নির্দিষ্ট ছাঁড়ে গঠনের মাধ্যমে তাদের মানসিকতা, স্বভাব এবং আচরণকে প্রভাবিত করে সেহেতু এটা মানুষের চিন্তাভাবনা এবং বিভিন্ন বিষয়, মন্তব্য এবং কাজ সম্পর্কে তার মতামত গঠন করে। এজন্য ইসলামী রাষ্ট্রের (খিলাফত) একটি অন্যতম প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে উম্মাহ্র সংস্কৃতিকে সংরক্ষণ করা এবং ছড়িয়ে দেওয়া।
ইতিহাস থেকে দেখা যায় সোভিয়েত ইউনিয়ন সেদেশের তরুণদের যেমন একদিকে সমাজতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে দীক্ষিত করেছিল তেমনি অন্যদিকে পুঁজিবাদী বা ইসলামী চিন্তাভাবনা যেন কোনভাবে তার সংস্কৃতিকে অনুপ্রবেশ করতে না পারে সে ব্যবস্থাও গ্রহণ করেছিল। এদিকে পুরো পশ্চিমাবিশ্ব সমাজজীবন থেকে ধর্মকে সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন করে রাখার যে মতবাদ তার উপর ভিত্তিশীল পুঁজিবাদী সংস্কৃতিকে দীক্ষিত করেছে তাদের সন্তানদের। এই ভিত্তির উপরই তারা তাদের জীবনকে প্রতিষ্ঠিত ও সংগঠিত করেছে এবং নিজেদের মতাদর্শ ও সংস্কৃতিকে যাতে ইসলামের অনুপ্রবেশ ঘটতে না পারে সেজন্য এমনকি যুদ্ধেও লিপ্ত হয়েছে যা আজো অব্যাহত আছে।
অনুরূপভাবে ইসলামী রাষ্ট্রও তার সন্তানদের সংস্কৃতিতে দীক্ষিত করেছে এবং ইসলামী আক্বীদা হতে উৎসারিত নয়। এমনসব চিন্তার দিকে যারা ডাকে, তাদেরকে প্রতিরোধ করেছে। ইসলামী রাষ্ট্রের দায়িত্ব হচ্ছে অন্যান্য দেশ ও জাতির কাছে নিজেদের সাংস্কৃতিক দাওয়াত পৌঁছানো এবং এটা কিয়ামতের আগ পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে।
নিজেদের সংস্কৃতিকে সংরক্ষণ করা এবং বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়ার এ প্রবণতার ফলে আমরা ইসলামের ইতিহাসের প্রায় পুরোটা জুড়েই দেখতে পাই যে, খিলাফতের প্রত্যেকটা গুরুত্বপূর্ণ শহরে পাবলিক লাইব্রেরি (গণগ্রন্থাগার) এবং প্রাইভেট লাইব্রেরি (ব্যক্তিগত পাঠাগার) ছিল। কর্ডোভা এবং বাগদাদের লাইব্রেরিসমূহে চার লক্ষাধিক বই ছিল।
এরিস্টটল, প্লেটো, পীথাগোরাস, টলেমি এবং ইউক্লিডের কাজসমূহ এবং গ্রীক জ্যোর্তিবিদ্যা প্রভৃতির অনুবাদের ফলে আরবি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিজ্ঞাসমৃদ্ধ ভাষায় পরিণত হয়েছিল। অবশ্য এসব মনীষীদের বিভিন্ন ধ্যান-ধারণাকে অনেক মুসলিম পণ্ডিত খণ্ডন করেছিলেন যেমন ইমাম গাজ্জালীর তাহাফুত আল ফালাসিফাহ (দার্শনিকদের প্রত্যাখ্যান) এবং ইবনে তাইমিয়ার কিতাবুল ইবতাল (ভ্রান্ত মত সম্পর্কিত গ্রন্থ)। গণিতশাস্ত্রে অনুপস্থিত ‘শূণ্য’ এর ব্যাপক ধারণা আবিষ্কারের মাধ্যমে মুসলিমরা এর ব্যাপক অগ্রগতি সাধন করে ফলে কয়েক শতাব্দী-যাবত বিদ্যমান অসমাধানকৃত সমস্যাসমূহের সমাধান সম্ভবপর হয়। মুসলিম গণিত-শাস্ত্র-বিদগণ বীজগণিতের উদ্ভাবন ও উন্নয়ন ঘটিয়েছিলেন, এসময় এলগরিদম নিয়ে চিন্তাভাবনা করা হয় এবং ইসলামী রাষ্ট্রের একজন বিখ্যাত মুসলিম পণ্ডিত আল-খেয়ারিজমির নামানুসারে নামকরণ করা হয়।
ইতিহাস থেকে মুসলিমদের যেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সন্ধান পাওয়া যায়, সেগুলো হল-
১. আল-কাতাতিব: এটা হচ্ছে কাত্তাব যার অর্থ হচ্ছে যেখানে কুরআন লিখা এবং পরিকল্পনায় কাজ করা হয় এর বহুবচন। ইসলামী রাষ্ট্রের সময়কাল জুড়েই শহর এবং গ্রামে কাতাতিবের উপস্থিতি ছিল।
২. মসজিদ: বিভিন্ন উলামা এবং হাদীস বিশেষজ্ঞগণ গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রীয় মসজিদসমূহে বসে ফিকহ, তাফসীর, ভাষা এবং হাদীস সংক্রান্ত বিষয়সমূহ নিয়ে বিতর্ক করতেন এবং শিক্ষাদান করতেন। এসময় তাদের শিক্ষার্থীগণ উপস্থিত থাকতেন।
৩. কুরআন সেন্টার: কুরআন শিক্ষার জন্য সর্বপ্রথম পৃথক একটি সেন্টার স্থাপিত হয়েছিল দামেস্কে হিজরি চতুর্থ শতাব্দীতে, যার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন রাশা ইবন নাসিফ আল দামেশ্কী।
৪. হাদীস সেন্টার: দামেস্কে আল-মালিক আল-আদিল নুরুদ্দিন মাহমুদ আল জানকি সর্বপ্রথম বিশেষত হাদীস প্রশিক্ষণের জন্য একটি সেন্টার প্রতিষ্ঠা করেন।
৫. স্কুল: পঞ্চম শতাব্দীতে দামেস্কে এসব স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এসব স্কুল সব ধরনের বিষয়ের জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যেমন দামেস্কে পুরকৌশল (Civil Engineering) স্কুল এবং মেডিসিন স্কুল প্রভৃতি।
৬. বিশ্বদ্যিালয়: পঞ্চম শতাব্দীর মাঝামাঝি দিকে এসমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আল হাকাম ইবনে আব্দুল রহমান কর্ডোভা ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন যেটা সে সময়কার সবচেয়ে অভিজাত শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে গণ্য হতো। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ বিভিন্ন স্থানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যেমন বাগদাদের মুসতানসিরিয়া বিশ্ববিদ্যালয়। সমগ্র ইউরোপের শিক্ষার্থীরা এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ ভর্তিও জন্য আবেদন করত।
উম্মাহ্র সংস্কৃতিকে সংরক্ষণের জন্য একটি প্রধানতম নিশ্চয়তা হচ্ছে একদিকে এটা উম্মাহ্র সদস্যদের অন্তরে ও বইয়ের পাতায় সংরক্ষণ করা এবং অন্যদিকে এ সংস্কৃতির বুদ্ধিবৃত্তিক মতবাদ থেকে উৎসারিত নিয়মকানুন এবং মতামতের সাহায্যে রাষ্ট্র পরিচালনা করা এবং এর বিভিন্ন বিষয় দেখাশুনা করা।
ইসলাম এবং ভবিষ্যৎ খিলাফত রাষ্ট্র কিভাবে তার শিক্ষাব্যবস্থা পরিচালনা করতে পারবে সে ব্যাপারে নিম্নে সংক্ষিপ্ত খসড়া উপস্থাপন করা হলো-
১) ইসলামী আক্বীদাকে ভিত্তি করে শিক্ষানীতি প্রণয়ন করতে হবে। পাঠ্যসূচি এবং শিক্ষাদান-পদ্ধতি এমনভাবে সাজাতে হবে যাতে এ ভিত্তি থেকে যে কোন ধরনের বিচ্যুতি প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে। [ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে শিক্ষা সম্পর্কিত শরিয়া নিয়মকানুন ইসলামী আক্বীদা থেকে উৎসারিত এবং এদের প্রত্যেকের শরীয়া প্রমাণাদি বিদ্যমান থাকবে। যেমন- শিক্ষার বিষয়সমূহ (subjects) এবং ছেলে বা মেয়ে শিক্ষার্থীদের পৃথক রাখা। প্রকৃতপক্ষে শিক্ষাদানের পদ্ধতি (methods) হচ্ছে সে সমস্ত উপকরণ (means) এবং ধরণ (style) সেগুলোকে শিক্ষাব্যবস্থা বাস্তবায়ন করা এবং এর উদ্দেশ্যসমূহ অর্জন করার জন্য উপযোগী বলে মনে করা হয়। এগুলো হচ্ছে কিছু পার্থিব বিষয় যেগুলো শিক্ষা এবং উম্মাহ্র মৌলিক চাহিদার সাথে সম্পর্কিত শরীয়া নিয়মকানুন বাস্তবায়নের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত বলে বিবেচিত এবং এ বিষয়সমূহ পরিবর্তনশীল বা বিবর্তনশীল। এগুলো গবেষণা বা অনুসন্ধানের মাধ্যমে অথবা কোন গবেষক বা অন্যান্য জাতির কাছ থেকে গ্রহণ করা যায়]
২) ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থার উদ্দেশ্য হবে চিন্তা এবং স্বভাবগত দিক থেকে ইসলামী ব্যক্তিত্ব গঠন করা। সুতরাং এই নীতির উপর ভিত্তি করে কারিকুলামের বিষয়সমূহ নির্ধারণ করতে হবে।
৩) শিক্ষার লক্ষ্য হবে ইসলামী ব্যক্তিত্ব তৈরি করা এবং তাদেরকে জীবনের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান সম্পর্কিত ইসলামী জ্ঞান সরবরাহ করা। এই লক্ষ্যকে সামনে রেখে শিক্ষাদান-পদ্ধতি ঠিক করতে হবে এবং এ লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করে ফেলে এমন যে কোনো পদ্ধতিকে প্রতিরোধ করতে হবে।
৪) গবেষণালব্ধ বিজ্ঞান যেমন- গণিত (বা পদার্থবিদ্যা) এবং সাংস্কৃতিক জ্ঞান (যেমন আইনশাস্ত্র, সাহিত্য, ইতিহাস)- এ দুটোর মধ্যে পার্থক্য থাকতে হবে। গবেষণালব্ধ বিজ্ঞান এবং এর সাথে সম্পর্কিত অন্যান্য বিষয়াদি প্রয়োজনের সাথে সঙ্গতি রেখে শিক্ষাদান করতে হবে এবং শিক্ষার কোন পর্যায়েই এটা বাধাগ্রস্ত করা যাবে না। অন্যদিকে সাংস্কৃতিক জ্ঞানকে প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক পর্যায়ে একটা নির্দিষ্ট নীতির মাধ্যমে শিক্ষাদান করতে হবে যাতে এটা ইসলামী চিন্তা এবং নিয়মকানুনের সাথে সাংঘর্ষিক না হয়। এছাড়া এই সাংস্কৃতিক জ্ঞানকে বিজ্ঞানের অন্যান্য বিষয়ের মতো উচ্চশিক্ষার অন্যান্য পর্যায়েও এমনভাবে শিক্ষাদানের ব্যবস্থা থাকতে হবে যাতে সেটা শিক্ষানীতির এবং শিক্ষার উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুতি প্রদর্শন না করে।
৫) ইসলামী সংস্কৃতিকে অবশ্যই শিক্ষাব্যবস্থার সমস্ত পর্যায়ে শিক্ষাদান করতে হবে। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে চিকিৎসা, প্রকৌশল বা পদার্থবিদ্যা পাশাপাশি বিভিন্ন ইসলামী জ্ঞানের জন্য ডিপার্টমেন্ট খুলতে হবে।
৬) শিল্পকলা (Arts) এবং হস্তশিল্প (crafts) যদি বাণিজ্য, নৌযানবিদ্যা বা কৃষিবিদ্যার সাথে সম্পর্কিত হয়, তবে সেগুলো কোনরকম বাধা বা শর্ত ছাড়াই শিখা হবে। কিন্তু কখনো কখনো শিল্পকলা এবং হস্তশিল্প সংস্কৃতির সাথে সম্পর্কিত হতে পারে এবং জীবন সম্পর্কে একটি নির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গিও দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে। যেমন- চিত্রকর্ম (painting) এবং ভাস্কর্যবিদ্যা (sculpture)। জীবন সম্পর্কে ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গির সাথে যদি এই দৃষ্টিভঙ্গি সাংঘর্ষিক হয়, তবে সেক্ষেত্রে এসব শিল্পকলা বা হস্তশিল্প গ্রহণ করা যাবে না।
৭) রাষ্ট্রের একটিমাত্র নির্দিষ্ট শিক্ষাসূচি (কারিকুলাম) থাকবে এবং এটি বাদে অন্যকোন কারিকুলামের শিক্ষাদান অনুমোদন করা যাবেনা।
৮) বিদেশী রাষ্ট্র কর্তৃক পরিচালিত না হলে বেসরকারি স্কুলের অনুমোদন দেওয়া হবে যদি এসব স্কুল রাষ্ট্রের কারিকুলাম গ্রহণ করে, রাষ্ট্রেও শিক্ষানীতির আওতায় প্রতিষ্ঠিত হয় এবং রাষ্ট্রের শিক্ষানীতির লক্ষ্যকে যথাযথভাবে সম্পাদন করে। এসমস্ত স্কুলসমূহে নারী এবং পুরুষ একত্রে রাখা যাবেনা- এটা শিক্ষক বা শিক্ষার্থী উভয়ের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। এসমস্ত স্কুল নির্দিষ্ট কোন ধর্ম, মাযহাব, বংশ বা বর্ণের জন্য প্রতিষ্ঠিত হতে পারবেনা।
৯) যেসমস্ত বিষয় জীবনের মূলধারার জন্য প্রয়োজনীয়, সেগুলো নারী এবং পুরুষ প্রত্যেক নাগরিককে শিক্ষাদান করা রাষ্ট্রের অত্যাবশ্যকীয় কর্তব্য। প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক স্তরে বিনামূল্যে এ শিক্ষার ব্যবস্থা করা রাষ্ট্রের জন্য বাধ্যতামূলক। রাষ্ট্র তার সাধ্যমতো সবার জন্য বিনা বেতনে উচ্চশিক্ষার সুযোগ তৈরির চেষ্টা করবে।
১০) স্কুল এবং বিশ্ববিদ্যালয় তৈরির পাশাপাশি রাষ্ট্র জ্ঞানের বিস্তার মান্নোয়নের জন্য বিভিন্ন উপকরণ; যেমন- লাইব্রেরি এবং লাইব্রেরি সরবরাহ করবে যাতে জ্ঞানের বিভিন্ন শাখা যেমন ফিকহ, হাদীস, কুরআনের তাফসীর এবং চিন্তা, চিকিৎসা, প্রকৌশল ও রসায়ন প্রভৃতি নিয়ে যারা গবেষণা করতে আগ্রহী তারা যেন উদ্ভাবন এবং আবিষ্কারে সক্ষমতা লাভ করতে পারে। এর ফলে পর্যাপ্ত পরিমাণে মুজতাহিদ, মানসম্পন্ন বৈজ্ঞানিক এবং উদ্ভাবক তৈরি হবে।
১১) শিক্ষার উদ্দেশ্যে লিখিত কোন বিষয়ের মাধ্যমে শোষণ; যেমন- কপিরাইট যেকোন পর্যায়ে সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ থাকবে। কোন বই একবার মুদ্রিত ও প্রকাশিত হবার পর গ্রন্থকারসহ অন্য কারো অধিকার থাকবে না। সেই বইটির প্রকাশনা এবং মুদ্রণের অধিকারস্বত্ব সংরক্ষণ করার। অবশ্য যদি কোন বই মুদ্রিত বা প্রকাশিত না হয়ে শুধু একটি ধারণার আকারে থাকে, তাহলে সেক্ষেত্রে শিক্ষাদানের বিনিময়ে অর্থ গ্রহণের মতোই যে কেউ এসমস্ত ধারণা বা তথ্য প্রদানের মাধ্যমে অর্থগ্রহণ করতে পারবে।
উপর্যুক্ত খসড়া নীতিমালার আলোকে যদি আমরা বিবেচনা করি, তাহলে বিদেশী সাম্রাজ্যবাদী শক্তি এবং তাদের এজেন্টদের মাধ্যমে যেসব স্কুল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং বিশ্ববিদ্যালয় ইসলামী রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং পরিচালিত হচ্ছে সেগুলো; যেমন- এ্যাচিসন কলেজ (লাহোর), সেইন্ট যোসেফ স্কুল (ঢাকা), সেইন্ট জনস ইনস্টিটিউশন (কুয়ালালামপুর) প্রভৃতি বন্ধ করে দিতে হবে। কারণ এ সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো মুসলিম তরুণদের মনে পাশ্চাত্যের অনৈসলামি ধ্যান-ধারণার প্রতি বিস্ময়, শ্রদ্ধা এবং প্রশংসাকে বদ্ধমূল করে দেওয়ার জন্য পরিকল্পিতভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
ইসলামী রাষ্ট্রের নিজস্ব মিডিয়া ডিপার্টমেন্ট থাকবে যেটা একদিকে ইসলাম এবং ইসলামী মূল্যবোধকে বিশ্বব্যাপী ছড়ানোর জন্য সম্ভাব্য সবধরনের উপকরণ ব্যবহার করবে এবং অন্যদিকে কাফেরদের মাধ্যমে প্রচারকৃত মিথ্যা এবং ভ্রান্ত-ধারণাসমূহকে খণ্ডণ করবে। যোগাযোগের জন্য অত্যাধুনিক সবরকমের প্রযুক্তিগত ও বৈজ্ঞানিক উপকরণসমূহ; যেমন- স্যাটেলাইট, ইলেকট্রনিক মেইল, টেলিকনফারেন্সিং প্রভৃতির মাধ্যমে খিলাফতের নাগরিকদের শিক্ষাদানের জন্য রাষ্ট্র কর্তৃক সাধ্যমতো এগুলো ধারণ করা হবে, ব্যবহার করা হবে এবং ছড়িয়ে দেওয়া হবে। বিদ্যমান ব্যাপক গণসংযোগ মাধ্যম; যেমন- টিভি, রেডিও, সংবাদপত্র, বই এবং সম্মেলন এসমস্ত উপকরণ ইসলামী রাষ্ট্রে ব্যবহার করা যাবে। উপর্যুক্ত মাধ্যমসমূহ যেসমস্ত অধিবেশন বা তথ্য সম্প্রচার করে সেগুলো যদি ইসলামের মধ্যে থাকে, তাহলে সেগুলো প্রতিষ্ঠিত করার জন্য কোন অনুমোদন লাগবেনা।
মুসলিম বিশ্বে বিদ্যমান বিভিন্ন বিদেশী মিডিয়া যেগুলো মুসলিমদেরকে দ্বিধান্বিত করে বা আক্রমণাত্মক তথ্য প্রচারের মাধ্যমে বিপথে পরিচালিত করে; যেমন বিবিসি, সিএনএন এবং ভয়েস অব আমেরিকা এগুলোর সম্প্রচার নিষিদ্ধ করতে হবে।