অপসংস্কৃতি আর বেহায়াপনার বিপক্ষে কথা বলতে গেলেই, উন্মাতাল অশ্লীলতা আর অনৈতিক বেলেল্লাপনার বিরুদ্ধে লিখতে গেলেই সমাজের একটি অংশ থেকে প্রতিবাদ আসে। আসে মৌলবাদের অভিযোগ। প্রগতি বিরোধী ও প্রাচীনপন্থী খেতাব পাওয়ার বিষয়টি তো খুবই পুরনো কথা।
তবে সহজ সরল সাধারণ মানুষ যখন বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারীদের বক্তব্যে দ্বিধান্বিত হয়ে সত্য জানতে চান, তখন আর নিজেকে গুটিয়ে রাখা সম্ভব হয় না। ইসলাম ও বিনোদনের মধ্যকার সম্পর্কটিও এমনই একটি প্রাসঙ্গিক বিষয়। অপসংস্কৃতির বিপক্ষে কথা বলতে গেলে প্রাসঙ্গিকভাবেই এ বিষয়টি এসে পরে যে, তাহলে ইসলামে কি বিনোদনের কোনো সুযোগ নেই?
ইসলামে বিনোদনের সুযোগ আছে কি না, সে বিষয়ে আলোচনার আগে সংস্কৃতি কাকে বলে এবং বিনোদন বিষয়টি কি, তা সুস্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন। তাহলে খুব সহজেই ইসলামের সাথে সংস্কৃতি ও বিনোদনের সম্পর্কটিও সহজভাবে অনুধাবন করা সম্ভব হবে।
প্রচলিত সহজ অর্থে সংস্কৃতি হচ্ছে এমন কিছু কর্মকান্ড, যার মাধ্যমে মানুষ সভ্যতার শিক্ষা পায়। বর্বরতা ও উগ্রতা পরিহার করে ভদ্র হয়। কারো মতে, সংস্কৃতি হচ্ছে এমন বিষয়, যা মানুষের মন ও মননকে সুসভ্য করে গড়ে তোলে।
আর বিনোদন বলতে সহজ অর্থে আমরা বুঝে থাকি এমন ক্রিয়া-কলাপ, যা মানুষকে আনন্দিত করে, প্রশান্তি এনে দেয়। অবসাদকে পেছনে ফেলে স্বচ্ছ ও প্রশান্ত হৃদয়ে নব উদ্যমে সত্য ও সুন্দরের পথে এগিয়ে যেতে বিনোদন মানুষকে সহযোগিতা করে।
উপরোক্ত অর্থের আলোকে এবার আমরা যদি সংস্কৃতি ও বিনোদনকে পাশাপাশি রেখে বিবেচনা করি তাহলে বিষয়টি এমন দাঁড়ায় যে, ‘সাংস্কৃতিক বিনোদন’ হতে হবে এমন কিছু মৌলিক কর্মকান্ড, যা কিছু সুন্দর ক্রিয়া-কলাপের মাধ্যমে মানুষের আত্মাকে প্রশান্তি দিয়ে তাকে সুসভ্য ও ভদ্র হতে সহযোগিতা করবে। ক্লান্তি আর অবসাদকে খুবই সাবলীলভাবে ব্যক্তির অজান্তেই দূরে সরিয়ে দিবে এবং শরীর ও মন উভয়কেই এক অনাবিল, অপার্থিব শান্তি এনে দিবে।
যদি সংস্কৃতি ও বিনোদনের অর্থ এটিই হয়ে থাকে, সংস্কৃতি ও বিনোদন বিষয়ে যদি আমার এই আত্ম উপলব্ধি ভুল না হয়ে থাকে তাহলে আমি সর্বোচ্চ দৃঢ়তার সাথে এবং চূড়ান্ত স্পষ্টভাবে বলতে পারি যে, সংস্কৃতি ও বিনোদনের মূল উৎসই হচ্ছে -একমাত্র ইসলাম। ইসলাম ছাড়া, ইসলাম সমর্থিত পন্থা ও পদ্ধতি ছাড়া সংস্কৃতি ও বিনোদন বলতে পৃথিবীতে আর কিছু নেই। ইসলাম অসমর্থিত ও বিরুদ্ধ যে কোনো পদ্ধতি ও প্রক্রিয়ার কার্যকলাপকেই সংস্কৃতি কিংবা বিনোদন বলে প্রচার করার চেষ্টা হোক না কেন, প্রকৃতপক্ষে তা চূড়ান্ত পর্যায়ের অসভ্যতা, অভদ্রতা আর অপসংস্কৃতির আখড়া ছাড়া কিছুই নয়।
সংস্কৃতি ও প্রগতির উৎস একমাত্র ইসলাম কেন?
তবে আসুন, এবার বিষয়টির আরেকটু গভীরে যাওয়া যাক। উপরের আলোচনায় সংস্কৃতি ও বিনোদনের সংজ্ঞা বা পরিচয়ের ক্ষেত্রে যদি কারো দ্বিমত না থাকে তাহলে একটু ভেবে বলুন তো, মানুষ সত্যিকার প্রশান্তি ও প্রকৃত আনন্দ কিভাবে, কিসের মাধ্যমে এবং কোথায় অনুভব করে?
-হ্যাঁ আত্মা। রূহ বা আত্মার মাধ্যমেই কেবল প্রকৃত প্রশান্তি আর অনাবিল স্বস্তি অর্জন করা সম্ভব।
প্রত্যেকটি মানুষের মধ্যেই দু’টি বস্তু বিদ্যমান। একটি হচ্ছে তার দেহ বা শরীর। আর অপরটি হচ্ছে তার রূহ বা আত্মা। মানব দেহ বা শরীর গঠনের মূলে রয়েছে মাটি। এজন্য মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা মানব দেহের খাদ্য বা খোরাকের ব্যবস্থাও করেছেন এই মাটি হতেই। আমরা যত প্রকার খাবারই গ্রহণ করি, একটু খেয়াল করলে দেখবো যে তার সবই এই মাটি থেকেই উৎপন্ন ও সৃষ্ট। মূলগতভাবে এই মাটির মাধ্যমেই তা আপন অস্তিস্তে এসেছে।
পক্ষান্তরে মানুষের মাঝে সদা-সর্বদা বিরাজমান রূহ বা আত্মা কিন্তু মাটি থেকে সৃষ্টি করা হয়নি। এই রূহ সম্পর্কে এর স্রষ্টা তথা মহান আল্লাহ তা‘আলা বেশি কিছুও আমাদেরকে জানান নি। কেবলমাত্র এতোটুকুই বলেছেন যে, ‘এটি হচ্ছে তার রবের একটি আদেশ।’ এর বাইরে রূহ সম্পর্কে কোনো তথ্য অবগত হওয়ার সুযোগ আমাদের নেই। হয়তো সে সম্পর্কে উপলব্ধি অর্জনের জন্য প্রয়োজনীয় ক্যাপাসিটিই আমাদের নেই। -সে যাক ভিন্ন কথা। মূল কথা ছিলো রূহ এসেছে সরাসরি মহান আল্লাহর কাছ থেকে। এর আকার আকৃতি আমাদের ধারণাতীত।
বিষয়টি সহজে বোঝার জন্য আমরা একটি মোবাইল ফোনের উদাহরণের দেখতে পারি। একটি মোবাইল ফোনেরও কিন্তু দু’টি অংশ একটি হচ্ছে সেট, অপরটি হচ্ছে সিম। মোবাইল সেটকে সচল ও কার্যকর রাখার জন্য নিয়মানুযায়ী তাকে চার্য দিতে হয়। অপরদিকে সিমকে প্রাণবন্ত রাখার জন্য তাতে রিচার্জ করতে হয়। এই রিচার্জটিও যথেচ্ছ করলে হয় না, বরং যেই কোম্পানী থেকে সিম কেনা হয়েছে, সরাসরি সেই কোম্পানীর কাছ থেকেই বা তার নির্ভরযোগ্য প্রতিনিধির মাধ্যমেই রিচার্জ করতে হয়। এর ফলে সিম যখন তার মূল প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের সাথে সংযুক্ত হতে সক্ষম হয়, তখনই কিন্তু মোবাইল ফোনটি পূর্ণরূপে ব্যবহার উপযোগী হয়ে ওঠে। এই যে মোবাইল সিম এবং তার প্রস্তুত কারক প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগাযোগের বিদ্যমানতা এটিই মোবাইলের মূল প্রাণশক্তি। কিন্তু মোবাইল সেট বা সিম তন্ন তন্ন করে খুজলেও আসলে কিছুই পাওয়া যাবে না। কেননা, মূল বিষয়টি হচ্ছে সিম কোম্পানীটির একটি নির্দেশনা বা অনুমোদন। ব্যাস্। এ পর্যন্তই।
মহান আল্লাহর সৃষ্টি হাজারো মাখলুকাতের মধ্যে একটি সৃষ্টি হচ্ছে এই মানুষ। এখন এই মানুষই যদি এমন সুক্ষ্ম বিষয়ে উদ্ভাবন ঘটাতে পারে, তাহলে এই মানুষ এবং এরকম হাজারো সৃষ্টির যিনি স্রষ্টা, তার কাজ যে কত নিখুঁত হবে, তা বলাই বাহুল্য।
যেহেতু মানুষের আত্মাকে স্বয়ং মহান আল্লাহ নিজ কুদরতে সৃষ্টি করেছেন তাই মানুষের আত্মাকে প্রশান্ত করার জন্য এবং স্বস্তিদায়ক প্রকৃত বিনোদন লাভ করার জন্য এই মানবাত্মার সৃষ্টিকারী মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার দেয়া নির্দেশনা অনুসরণের কোনো বিকল্প নেই। স্বয়ং মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার পক্ষ থেকে দেয়া মানবজাতির জন্য তার সমগ্র জীবনের যথোপযুক্ত দিক-নির্দেশনা তথা ইসলামী শারিয়া অনুযায়ী চলার মাধ্যমেই মানবাত্মা তার প্রকৃত সুখ, শান্তি আর প্রশান্তি লাভ করতে পারে। এর ব্যতিক্রম হলে সম্ভব নয়।
এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা আবশ্যক, আর তা হচ্ছে মানুষের আত্মার তিনটি দিক বা ভাব রয়েছে যথাক্রমে:
‘নফসে আম্মারাহ’, ‘লাউয়ামা’ এবং ‘মুতমাইন্না’।
‘নাফসে আম্মারা’ সাধারণত: মানুষকে যে কোনো উপায়ে কেবলমাত্র শারীরিক ও ইন্দ্রিয়গত তুষ্টি অর্জনের জন্যই প্ররোচিত করে থাকে। একারণেই কখনো কখনো মহান আল্লাহর অবাধ্যতামূলক কিছু কাজ সাময়িকের জন্য খুব মজাদার ও স্বস্তিদায়ক মনে হলেও খানিক ব্যবধানেই তার প্রকৃত স্বরূপ উন্মোচিত হয়। বীষাক্ত সাপের বাহ্যিক চাকচিক্যময়তায় প্রতারিত হয়ে ফাঁদে পড়লে পরিণামে যে কি খেসারত দিতে হয়, তা খানিক পরেই বোঝা যায়।
‘নাফসে মুতমাইন্না’ মানবাত্মাকে সর্বদা তার স্রষ্টার সাথে সংযুক্ত করতে সচেষ্ট থাকে এবং সরাসরি স্রষ্টার কাছ থেকেই প্রকৃত প্রশান্তি ও সত্যিকার স্বস্তি অর্জন হয় এর মাধ্যমেই। এ কারণে বাহ্যিকভাবে এবং প্রাথমিক দিকে এর ভূমিকা একটু কষ্টকর মনে হলেও প্রকৃত সাফল্য ও চূড়ান্ত পর্যায়ের খাঁটি প্রশান্তি একমাত্র এর মাধ্যমেই পাওয়া যায়। ‘নাফসে লাউয়ামা’ এর ভূমিকা মাঝামাঝি। সে নিজে কোনো দিকে প্রাধান্য দিতে পারে না।
উপরের সামগ্রিক আলোচনা হতে এটা পরিস্কার হয়ে গেলো যে, প্রকৃতপক্ষে সংস্কৃতি ও বিনোদনের মূল উৎসই হচ্ছে ইসলাম। এবার আমাদের সমাজে সংস্কৃতি ও বিনোদনের নামে প্রচলিত আচার-অনুষ্ঠান গুলোর দিকে একটু নজর দেয়া যাক। এক্ষেত্রে দেখা যাবে যে, অধিকাংশের সাথেই ইসলামের কোনো দূরতম সম্পর্কও নেই। নেই আত্মাসমূহের স্রষ্টা মহান আল্লাহর নির্দেশনার সম্পৃক্ততা। বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সরাসরি মহান আল্লাহর দেয়া বিধান ও দিক-নির্দেশনার বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করে অনেক ক্ষেত্রে সরাসরি মহান আল্লাহর সাথে বিদ্রোহ করে এবং তাকে অস্বীকার করে বিকৃত মস্তিস্কের কিছু লোক এমন কিছু উদ্ভট অনৈতিক ও অপসাংস্কৃতির ক্রিয়া-কলাপের আয়োজন করছে, যার অসারতা ও সীমাহীন ক্ষতিকর দিকসমূহ সুস্থ মস্তিস্কের যে কোনো ব্যক্তি মাত্রই অনুধাবন করতে সক্ষম হবেন। কিন্তু সমস্যা হলো অনেক সময়ই বাহ্যিক চাকচিক্য ও প্রচার-প্রচারণার ফলে আমাদের বিবেকের চোখের উপর পর্দা পড়ে যায়। যার কারণে তখন আমরা রঙিন আয়নার চশমা দিকে রঙিন সব মাকাল ফলকে সুন্দর দেখলেও, চশমা সরিয়ে নিতেই আসল বাস্তবতা সামনে চলে আসে।
সর্বশেষ যে বিষয়টি উল্লেখ না করলেই নয়, তা হচ্ছে শুধু কিছু গৎ বাঁধা নীতিকথার মধ্যেই ইসলাম মানুষকে সীমাবদ্ধ করে রাখে নি। আমাদের সমাজে প্রচলিত একটি ভুল ধারণা ‘ইসলামে সামাজিক অনুষ্ঠানের তেমন কোনো সুযোগ নেই।’ বরং এটি তো সত্যের পুরোপুরি অপলাপ। বরং ইসলামে যতো সামাজিক অনুষ্ঠানের সুযোগ ও সুন্দর ব্যবস্থা আছে, অন্য কোনো মতাদর্শ, মতবাদ তো বটেই, রহিত হয়ে যাওয়া পূর্ববর্তী আসমানী ধর্ম গুলোতেও তার নজীর মিলবে না।
জামাত বদ্ধ হয়ে নামায আদায়, রোযা, হজ্জ্ব, যাকাত, ঈদ, জুম‘আ ছাড়াও অসংখ্য সামাজিক অনুষ্ঠানাদির ইসলাম কেবল অনুমতিই দেয় নি, বরং ক্ষেত্র বিশেষে তার আবশ্যিক নির্দেশনাও প্রদান করেছে। শালীনতার পর্যায়ে থেকে এবং শরীয়তের নীতিমালার আলোকে যে শারিরীক নৈপূন্য এবং ক্রিয়া অনুষ্ঠানের ব্যাপারেও কোনো নিষেধ নেই। বরং অনেক ক্ষেত্রে রাসূল সা. এ ব্যাপারে উম্মতকে উদ্বুদ্ধও করেছেন।
একজন মুসলিমের জন্য সবচেয়ে আনন্দদায়ক ও প্রশান্তির বিষয় হচ্ছে অপর মুসলিম ভাইকে সহযোগিতা করা। অসহায় ও দুর্দশাগ্রস্থ ব্যক্তিদের সাহায্যে এগিয়ে যাওয়ার। অসহায়ের পাশে দাঁড়ানো এবং গরীবকে সাহায্য করার মাধ্যমে যেই নির্মল বিনোদন ও আত্মিক প্রশান্তি লাভ হয়, অন্য কোনো ভোগ-বিলাসের মাধ্যমে তা কখনো অর্জন করা সম্ভব নয়। নফল সাদাকা, উশর, যাকাত, কুরবানী ইত্যাদির মাধ্যমে ইসলাম মুসলিমদেরকে সুন্দর সংস্কৃতি আর আত্মিক প্রশান্তিদায়ক যেই বিনোদনের সন্ধান দিয়েছে, পৃথিবীর অন্য কোনো মতবাদ আর মতাদর্শ তার বিকল্প দিতে পারে নি। এমন সুন্দর ব্যবস্থাপনার পূর্ণতার জন্য ইসলাম রাষ্ট্রব্যবস্থার পরিপূর্ণ কাঠামোও প্রদান করেছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে ইসলাম বাস্তবায়িত হলে পুরো দেশের সংস্কৃতি আর সকল ক্রিয়া-কর্মই প্রশান্তিদায়ক হয়ে যায়। এজন্যই মুসলিম সমাজের প্রতিটি কাজ, প্রতিটি উপলক্ষই বিনোদন। একজন মুসলিম তার প্রতিটি কাজের মাধ্যেই তার স্রষ্টা মহান আল্লাহর নির্দেশনা অনুভব করে। এর মাধ্যমে তার দেহ দুনিয়াতে থাকলেও তার আত্মা লাভ করে জান্নাতের অনাবিল প্রশান্তি। একজন মুসলিমের দৈনন্দিন জীবনের সকল কর্মকান্ডই সংস্কৃতিময় হয়ে থাকে। সে তার প্রতিটি কাজেই স্বর্গীয় প্রশান্তি আর আনন্দ লাভ করে থাকে।
ইসলাম বাস্তবায়িত মুসলিম সমাজের এই চিত্র এবং অবস্থা বর্তমান কুফর শাসন ব্যবস্থার জুলুমের যাঁতাকলে আকণ্ঠ নিমজ্জিত, নিষ্পেষিত আশাহীন মানুষদেরকে বোঝানো সম্ভব নয়। বর্তমান কুফুরি সমাজ ব্যবস্থায় কেবলমাত্র শাসকশ্রেণী ও তাদের পদলেহনকারী গুটিকতেক ব্যক্তি সামান্য কিছু ইন্দ্রিয় তুষ্টিদায়ক সুখের সন্ধান পেলেও অবশিষ্ট জনগণ এবং পুরো দেশবাসী ভোগ করে জাহান্নামের আযাব। এই সকল আযাবে দিশেহারা ব্যক্তিরা যেনো বিদ্রোহ না করে এজন্যই মানবরচিত জীবন ব্যবস্থা ও এর উদ্যোক্তারা মাঝে মধ্যে কিছু দিবস পূজার আয়োজন করে, উপলক্ষ্য সৃষ্টি করে কিছু উন্মত্ত অনুষ্ঠানের। যাতে করে এই সকল অপসংস্কৃতিতে অসহায় মানুষ গুলো সামান্য হলেও বিকৃত সুখ আস্বাদন করে সন্তুষ্ট থাকে।
পাশাপাশি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানী গুলোও এই সুযোগে জনসাধারণের আবেগকে নিজেদের ব্যবসায়িক স্বার্থে ব্যবহার করে লাভের অংক চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়িয়ে নিতে তৎপর হয়ে ওঠে। যেহেতু পুঁজিবাদের দৃষ্টিতে সব কিছুই সম্পদ এবং মুনাফা অর্জনের উপলক্ষ মাত্র, তাই পুঁজিবাদী আদর্শে গড়ে ওঠা বেনিয়াগোষ্ঠী গুলোও অন্যান্য জড়পদার্থের মতো মানুষকেও তাদের পণ্য হিসেবে বিবেচনা করে থাকে। তাদের দৃষ্টিতে মানুষের আবেগ এবং অনুভূতি বিশেষত: প্রাকৃতিকভাবে মানুষের মাঝে বিদ্যমান ‘যৌনতা’ হচ্ছে তাদের ব্যবসার জন্য সবচেয়ে ‘প্রফিটেবল’ বিষয়। যৌন সূরসূরি দিয়ে কিংবা অন্য যে কোনোভাবে মানুষের মধ্যকার এই আদিমতাকে উজ্জীবিত করে নিজেদের ব্যবসায়িক রথের সাথে জুড়ে দিতে পারলে আর কি লাগে! এবার পাগলা ঘোড়ার চাইতেও দ্রুতবেগে তাদের ব্যবসা ছুটতে থাকবে সামনের দিকে।
এই মূলনীতির আলোকেই সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের দেশে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানী গুলো তাদের ব্যবসা পরিচালনা ও ব্যবসা সম্প্রসারণ করে আসছে। আর তাদের এই নিকৃষ্ট কর্মতৎপরতার প্রথম এবং প্রধান শিকার হচ্ছে আমাদের দেশের মুসলিম যুব-তরুণ সমাজ। এজন্যই আজ আমরা একটি ছোটো চকলেট থেকে এক বোতল পানীয় পর্যন্ত, মাথার চুলের তেল থেকে নিয়ে পায়ের নখের নেল পলিস পর্যন্ত ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র যে কোনো পণ্যের বিজ্ঞাপনেই নগ্ন, অর্ধনগ্ন নারীর যথেচ্ছ ব্যবহার প্রত্যক্ষ করছি। দেখতে বাধ্য হচ্ছি। নারী-পুরুষের অশ্লীল ঢলা-ঢলি আর উদ্ভট লম্ফ-ঝম্ফ ছাড়া কোনো বিজ্ঞাপনই যেনো পূর্ণতা পায় না। আর এসব ক্ষেত্রে মোবাইল ফোন ও নেটওয়ার্ক সার্ভিস প্রদানকারীদের বাড়াবাড়ি তো সীমা অতিক্রম করেছে অনেক আগেই। যুব তরুণদেরকে অবৈধ প্রেম-পরকিয়ায় আসক্ত করে তাদের দিয়ে রাতদিন কানে ফোন গুঁজে গ্যাজানোর যেই বদভ্যাস রপ্ত করানো হচ্ছে, এর ফাঁকে শত-সহস্র কোটি ডলারের মুনাফা কিন্তু অপচক্রটি নিমিশেই হাতিয়ে নিচ্ছে।
এসকল ক্ষেত্রেই ইসলামের চরম আপত্তি। বিবাহ বহির্ভুতভাবে এবং বেগানা নারী-পুরুষের অনৈতিক দেখা-সাক্ষাত ও অবাধ মেলা-মেশার গর্হিত সুযোগ ইসলাম নিষিদ্ধ করেছে। কেননা এই সকল ক্রিয়া-কলাপে শারীরিক কিছু অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ উত্তেজিত হলে, এর মাধ্যমে কখনই আত্মিক প্রশান্তি অর্জন করা যায় না। খুজলী-ঘামাচির চুলকানোর সময় সামান্য সুখ অনুভূত হলেও খানিক পরেই যেমন জ্বালাপোড়া শুরু হয়, তেমনি ঐসকল ঢলাঢলির ফলশ্র“তিতে যেই জ্বালাপোড়া শুরু হয়, ঘর থেকে সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে যেই বীষবাষ্প ছড়িয়ে পরে, তার রেশ থেকে যায় যুগ যুগ ধরে অনন্তকাল।
এজন্যই সামান্য ছুতা-নাতায় নারী-পুরুষের ঢলা-ঢলির আয়োজন, যৌন সূরসূরি উৎপাদক ক্রিয়া কলাপ থেকে ইসলাম তার অনুসারীদেরকে কেবল বিরত থাকতে বলেই ক্ষ্যান্ত হয় নি, বরং একে শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে ঘোষণা করেছে। আর এটিই হচ্ছে বর্তমানের প্রগতির ধ্বজাধারী, ইসলাম বিরোধী অপশক্তির আক্রোশের মূল উৎস। সহজে ও কম খরচে অবাধ যৌনাচারের পথ রুদ্ধ হওয়া এবং অশ্লীলতার মাধ্যমে নাফসে আম্মারাকে তুষ্ট করার অপপ্রয়াস বাঁধাপ্রাপ্ত হওয়ার ফলেই আমাদের সুশিল সমাজ আজ ইসলামের এই নীতিমালা ও সুন্দর বিধানের উপর এতো ক্ষুব্ধ, ক্রুদ্ধ।
কিন্তু তারা বিষয়টিকে লোক সম্মুখে তার আপন স্বরূপে বলতে লজ্জাপান বিধায় এটাকেই সংস্কৃতি ও বিনোদনের মোড়কে তুলে ধরার ব্যর্থ প্রয়াস চালান এবং অনৈতিক ও অশ্লীলতার বিপক্ষে ইসলামের অবস্থানকে সংস্কৃতি ও বিনোদনের বিপক্ষে বিভ্রান্তি ছড়ানোর কৌশল হাতে নিয়ে উঠে পড়ে মাঠে নামেন। বিষয়টি সম্পর্কে আমাদের সকলের সম্যক ধারণা না থাকার কারণে আমরাও অনেক সময় দো’টানায় পড়ে যাই। বিভ্রান্ত হই।
এই পুরো আলোচনা যদি আমাদেরকে সেই বিভ্রান্তি থেকে সমাধানেরর পথ দেখাতে পারে, অন্ধকারের মাঝে সামান্য আলোরও সন্ধান দিতে সক্ষম হয়, তবেই এই প্রচেষ্টা সফল হবে ইনশাআল্লাহ। মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা আমাদের সকলকে বিষয়টি সঠিকভাবে উপলব্ধি করার তাওফীক দিন। আমীন।
ইসহাক খান