গণঅভ্যূত্থান তৈরীর উপায়

১. সূচনা

এ প্রবন্ধে আমরা রাজনৈতিক সংগ্রামের লক্ষ্যে জনগণকে সংগঠিত করার বিষয়ে আলোচনা করবো। একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় একটি সফল রাজনৈতিক সংগ্রামের অন্যতম পূর্বশর্ত হচ্ছে জালেম শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ব্যাপকভাবে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ ও সংগঠিত করা। এখানে আমরা শুধুমাত্র আমাদের সংগঠনে একজন মানুষের অন্তর্ভূক্তি, ক্রমান্বয়ে তাকে সমর্থক, কর্মী, সদস্য ইত্যাদি স্তর অতিক্রমের কথা বলছি না। হাজার হাজার সাধারণ মানুষকে সরকার বিরোধী আন্দোলন, জুলুমের বিরুদ্ধে আন্দোলন তথা খিলাফত প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে ফেলার কথা বলছি। মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরী করা, আন্দোলনের জন্যে সমাজে একটি গণভিত্তি তৈরী করা, ধারাবাহিক আন্দোলন-সংগ্রাম পরিচালনা করা ও সব শেষে গণঅভ্যূত্থানের মাধ্যমে সরকার ও সরকার ব্যবস্থার পতন ঘটানো – ধাপে ধাপে এই কাজগুলোই আমাদেরকে করতে হবে।

২. গণঅভ্যুত্থানের স্বরূপ

আমাদের মনে রাখা দরকার যে একটা ইস্যুতে একটা কর্মসূচী দেয়া মানেই আন্দোলন নয়। এটা শুধু একটি কর্মসূচী হিসেবেই সীমাবদ্ধ থাকে। যখন কোন ইস্যুতে ধারাবাহিকভাবে কর্মসূচী দেয়া হয়, তখনই তা আন্দোলনে রূপ লাভ করে। আর ইস্যুর পর ইস্যুতে ধারাবাহিকভাবে একনাগাড়ে আন্দোলন পরিচালনা করলে এবং এতে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকলে তবেই তা গণআন্দোলনে রূপ লাভ করে। এখন ধারাবাহিক গণআন্দোলনের ফসল – গণঅভ্যুত্থানের একটি চিত্র সবার সামনে তুলে ধরতে চাই। গণঅভ্যুত্থান মানেই হচ্ছে রাজপথে লক্ষ লক্ষ জনতার ঢল। এই জনতার মধ্যে সামিল থাকে পুরুষ, নারী, শিশু, বৃদ্ধসহ সকল বয়স, সকল পেশার মানুষ। এখানে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা থাকে; কৃষক, শ্রমিক, দিনমজুর, হকার, মুদির দোকানী, বস্তিবাসী, রিক্সাচালক, খেটে খাওয়া মানুষ থাকে; আলেম সমাজ, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যবসায়ী শিক্ষকসহ পেশাজীবীরা থাকে; অর্থাৎ এই বিশাল জনতার মধ্যে সমাজের সর্বস্তরের মানুষ থাকবে এবং এই বিপুল জনতা শুধু ঢাকাতে নয়; সকল বিভাগীয় শহরে, এমনকি জেলা শহরেও থাকতে হবে। বিশাল বিক্ষুব্ধ জনতার তীব্র শক্তি দিয়ে যখন একের পর এক আঘাত করে চুরমার করা হবে সরকারের মসনদ, তখন তাকে আমরা বলবো একটি সফল গণঅভ্যুত্থান।

এরকম একটি গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরকার ব্যবস্থা পরিবর্তনের স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য আমরা কাজ করছি। এটি আমাদের পথ পরিক্রমার একদম শেষ প্রান্তে, যেখানে সমাজের সর্বস্তরের মানুষ সক্রিয়ভাবে রাজপথের আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। আর আমরা আজ দাড়িয়ে আছি এই পথের শুরুতে, যেখানে আমরা সবেমাত্র আন্দোলন করা আরম্ভ করেছি । এই শুরু ও শেষের মাঝে আছে রাজনৈতিক সংগ্রাম। রাজনৈতিক সংগ্রামের তিনটি দিক আছে:

১. রাজনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনা করা
২. সরকার বিরোধী আন্দোলন
৩. গণঅভ্যূত্থানের লক্ষ্যে তথা সরকারের বিরুদ্ধে জনগণকে সংগঠিত করা।

ধারাবাহিকভাবে রাজনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনার স্বাভাবিক পরিণতি হচ্ছে সরকার বিরোধী আন্দোলন। আমরা জানি আমাদের প্রতিটি আন্দোলন – হয় দেশ ও জনগণের স্বার্থ রক্ষার্থে নতুবা সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্যবাদী শক্তির ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে। এখন দেখা যাক, কোন কোন উপাদান আন্দোলনে গণমানুষের অংশগ্রহণ বাড়ায়। নিম্নে আলোচিত প্রতিটি পয়েন্টের দুইটি দিক রয়েছে – ১. রাজনৈতিক দিক ২. সাংগঠনিক দিক। আর উদাহরণ হিসেবে সাম্প্রতিক সময়ের দুটি সফল অভ্যুত্থানের ঘটনাসমূহ আলোচনা করব: একটি ইরানের ১৯৭৯ এবং আরেকটি বাংলাদেশের ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান।

৩. গণঅভ্যূত্থানে গণমানুষের অংশগ্রহণের নিয়ামকসমূহ

১. সরকারে ব্যর্থতা- সুষ্ঠু দেশ পরিচালনায় ব্যর্থতা, জনগণের স্বার্থ সংরক্ষণে ব্যর্থতা, বিদেশীদের সাথে আঁতাত ও তাদের বশ্যতা স্বীকার ইত্যাদি গণআন্দোলনের অন্যতম ইস্যু। সরকার ও সরকার ব্যবস্থার প্রতি মানুষ যত বেশী বিরক্ত ও ক্ষুদ্ধ হবে, প্রচলিত ব্যবস্থা পরিবর্তনের আন্দোলনে মানুষ তত বেশী আকৃষ্ট হবে। এখানে ইস্যু নির্বাচন, আমাদের বক্তব্য বা মেসেজ ইত্যাদি হচ্ছে রাজনৈতিক দিক।

আর সাংগঠনিক দিক থেকে আমাদের চিন্তা করতে হবে কিভাবে মানুষের ক্ষোভকে আরো উস্কে দেয়া যায়। সংগঠন সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকবে প্রচলিত ব্যবস্থার প্রতি মানুষের হতাশা বাড়িয়ে তোলার কাজে, মানুষের বঞ্চনার অনুভূতিকে তীক্ষ্ন করার কাজে। এ কাজ সংগঠন যত দক্ষতার সাথে করতে পারবে, আন্দোলনের গতি, তীব্রতা এবং জনগণের অংশগ্রহণ তত বাড়বে।

(উদাহরণ – বাংলাদেশের দুইটি ঐতিহাসিক ঘটনা – শেখ মুজিব কর্তৃক ১৯৬৫ এর যুদ্ধ-পরবর্তী পরিস্থিতির সুযোগ গ্রহণ এবং ‘৭০ এর ঘূর্ণিঝড়ের পর শেখ মুজিব ও মাওলানা ভাসানীর ভূমিকা বনাম তৎকালীন পাকিস্তানের শাসক জে. ইয়াহিয়ার ভূমিকা

সাম্প্রতিক কিছু উদাহরণ – ২০০১-২০০৬ বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে কানসাট, ফুলবাড়ী ও শনির আখড়ার ঘটনাসমূহ। বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলের্ র‌্যাংগস ভবন দূর্ঘটনা এরকম একটি আন্দোলনের ইস্যু হতে পারত।

ইরান – ১৯৬৪ সালের অপমানজনক ইরান-মার্কিন চুক্তির সুযোগ গ্রহণ করেছিল খোমেনি, গণঅভ্যুত্থানের পূর্বে ভূমিকম্প-পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকারের ব্যর্থতা যার সুযোগ আন্দোলনকারীরা নিয়েছিল)

২. নেতৃত্ব – নেতৃত্ব গণআন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। আমরা ভাল করেই উপলব্ধি করছি যে সাধারণ মানুষ শুধুমাত্র উন্নত চিন্তার বদৌলতে আন্দোলনে শরীক হয়না। তারা বাস্তবতায় এই উন্নত চিন্তার ধারককে দেখতে চায়। আর এক্ষেত্রে তারা যতটা না কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে কাছে পায়, তার চেয়ে বেশী প্রতিদিন দেখতে পায় স্থানীয় নেতৃবৃন্দকে। আর স্বাভাবিকভাবেই তারা দেখতে চায় সাহসী ও উন্নত চরিত্রের ব্যক্তিত্বদেরকে, যাদের উপর উম্মাহ্‌ আস্থা রাখতে পারে। উম্মাহ্‌র আস্থা অর্জন করার ফল হচ্ছে সরকার ও সাম্রাজ্যবাদীদের অনুগত মিডিয়া যত অপপ্রচার করুক না কেন, জনগণ বিশ্বাসযোগ্য নেতৃত্বের কাছেই ছুটে আসবে।

সাংগঠনিক দিক থেকে আমাদের সর্বদা খেয়াল রাখতে হবে যেন আমরা আন্দোলনের জন্য সঠিক ব্যক্তিত্বকে চিহ্নিত করতে পারি এবং তাদেরকে জয় করে আমাদের সাথী করে নিতে পারি। গণমানষের দৈনন্দিন হাজারো সমস্যার সমাধান বা সঠিক পরামর্শ প্রদান স্থানীয় নেতৃত্ব গঠনের চাবিকাঠি। আমাদের নিজেদের ব্যক্তিত্ব এভাবে গড়ে তুলতে হবে এবং পাশাপাশি যারা এই ব্যক্তিত্বের অধিকারী তাদেরকে আমাদের সাথে জড়াতে হবে। এরা এমন ধরনের ব্যক্তিত্ব যারা শত শত বা ক্ষেত্র বিশেষে হাজার হাজার মানুষকে মবিলাইজ করার ক্ষমতা রাখে।

(উদাহরণ- বাংলাদেশ – ১৯৬৭-৬৯ সময়ে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা এবং আওয়ামী লীগের শত শত কর্মী গ্রেফতার সত্ত্বেও ছয় দফার আন্দোলনের দেশব্যাপী বিস্তার লাভ।

ইরান- খোমেনির নির্বাসন সত্ত্বেও সমগ্র ইরানে আন্দোলন বিস্তার লাভ, রেজা শাহের বাহিনী কর্তৃক সিনেমা হল পুড়িয়ে তার দায় আন্দোলনকারীদের উপর চাপানো সত্ত্বেও ব্যাপক গণসম্পৃক্ততা থাকার ফলে সকল অপপ্রচার ব্যর্থ)

৩. সমাজের সকল পর্যায়ে বিস্তৃত নেটওয়ার্ক: সমাজের সকল পর্যায়ে আমাদের নেটওয়ার্ক থাকা খুবই জরুরী। সমাজের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে যদি আমাদের নেটওয়ার্ক না থাকে, তাহলে আন্দোলনের সময় সমাজের বৃহত্তর অংশকে আমরা আমাদের সাথে পাব না। আমাদের স্মরণ রাখা দরকার যে কোন আন্দোলনে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করে ১. ছাত্র ২. শ্রমিক ৩. কৃষক।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে ছাত্রদের ভূমিকা সম্পর্কে নতুন করে বলার কিছু নেই। শুধু একটা কথা বলাই যথেষ্ট যে গত একশ বছরে যে কোন আন্দোলন বা রাজনৈতিক কর্মকান্ডের দিকে আমরা তাকাই না কেন, আমরা ছাত্রদেরকে সর্বত্র মূল চালিকা শক্তি হিসেবে দেখতে পাব। সুতরাং সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা যেখানেই ছাত্ররা থাকে, সেখানেই আমাদের নেটওয়ার্ক থাকতে হবে। আর কৃষক ও শ্রমিকদেরকে মধ্যে আমাদের নেটওয়ার্ক তৈরীর বিষয়টি গভীরভাবে ভাবতে হবে। আমাদের দেশের দুই তৃতীয়াংশ মানুষ কৃষিকাজ করে এবং আরও একটি বিরাট অংশ শ্রমিক। মাওলানা ভাসানি শুধু কৃষকদেরকে সংগঠিত করে এত বড় নেতা হয়েছিলেন। আর শিল্প এলাকায় আমাদের অবস্থান দৃঢ় হলে স্বাভাবিকভাবেই রাজনীতিতে আমাদের প্রভাব অনেক বেড়ে যাবে। অতীতে আমরা দেখেছি দেশের রাজনীতিতে পাট শিল্প শ্রমিকদের গুরুত্ব। বর্তমানে আমরা দেখছি গার্মেন্টস্‌ ও পরিবহন শ্রমিকদের গুরুত্ব। সার্বিকভাবে এটাই বলতে চাই ছাত্র-কৃষক-শ্রমিক-ইমামসহ সমাজের সর্বস্তরে বিস্তৃত নেটওয়ার্ক তৈরীতে আমাদেরকে আরও সৃজনশীল হতে হবে, নতুন নতুন চিন্তা ও পদ্ধতি বের করতে হবে ও কাজে লাগাতে হবে।

(উদাহরণ – বাংলাদেশ – ‘৫২-‘৫৪ দুই বছরের মধ্যে আওয়ামী লীগের ব্যাপক বিস্তৃতি ও জনগণের সমর্থন লাভ, ১৯৬৯ আন্দোলনে ছাত্র ও শ্রমিকদের ভূমিকা ও গণমানুষের সমর্থন লাভ, মাওলানা ভাসানীর কৃষকদের নিয়ে আন্দোলন, বামপন্থিদের গ্রামে গ্রামে লাল টুপি বিতরণ ও গ্রামবাসীদের খুব সাধারণ কাজ দিয়ে সম্পৃক্ত করা, শ্রমিক ও নিম্ন শ্রেণীর কর্মচারী হিসেবে বামপন্থি ছাত্রদের যোগদান।

ইরান – সামগ্রিক গণঅভ্যুত্থানে ছাত্র ও শ্রমিকদের ব্যপক অংশগ্রহণ ও জোরালো ভূমিকা, খোমেনির বক্তব্য সম্বলিত ক্যাসেট বিতরণে সমাজের প্রায় সবাইকে সম্পৃক্ত করে ফেলা, দেশের মসজিদগুলো আন্দোলনের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল এবং সব জায়গায় মসজিদের ইমামরা স্বতঃস্ফুর্তভাবে আন্দোলনে শরীক হয়েছিল, গণঅভ্যুত্থানের সময় ইরানের তেল শিল্প শ্রমিকদের ধর্মঘটের ফলে অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে রেজা শাহ তেল কারখানাগুলো সীমিত আকারে চালু রাখার জন্য খোমেনিকে অনুরোধ করতে বাধ্য হয়)

৪. সরকারের দমননীতি – সরকারের সাথে সংঘর্ষের সময় আত্মরক্ষার্থে সরকারের একটি স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া হচ্ছে ব্যাপক নিপীড়নের মাধ্যমে প্রতিবাদী কন্ঠকে স্তব্ধ করে দেয়া। এভাবে দমননীতি অবলম্বনের মাধ্যমে সরকার নিজের দুর্বলতারই বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। নিজের দুর্বলতা ঢাকার জন্যই সরকার পেশিশক্তির আশ্রয় নেয়, সকল আইন-কানুন-মানবতার বুলি উপেক্ষা করে জুলুম নির্যাতনের আশ্রয় নেয়। আন্দোলন যে সঠিক পথে আছে, এই দমননীতি শুধু তাই প্রমাণ করে। সকল নবী-রাসূলকে এই পথ অতিক্রম করতে হয়েছে।

সাংগঠনিকভাবে আমাদের কাজ সবসময়ই এই দমন নিপীড়নের খবর জনগণের কাছে যথাসম্ভব অত্যন্ত দ্রুত তুলে ধরা। শুধুমাত্র দেশের জন্য, জনগণের জন্য বা ইসলামের পক্ষাবলম্বনের জন্য আমাদেরকে এই নির্যাতনের সম্মুখীন হতে হচ্ছে – এই বিষয়টি যত মানুষের কাছে আমরা নিয়ে যেতে পারবো, তত বেশী মানুষের সমবেদনা এবং আন্দোলনে মানুষের শরীক হবার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়।

(উদাহারণ- বাংলাদেশ – ১৯৬৯-এ ২০শে জানুয়ারী আসাদ হত্যাকান্ড, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামী সার্জেন্ট জহুরুল হক হত্যাকান্ড, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. শামসুজ্জোহা হত্যাকান্ড।
ইরান – প্রতিটি শোক সভা ও বিক্ষোভ মিছিলে গুলির রেকর্ড ও প্রচার)

৫. আন্দোলনের সময়কাল- আন্দোলনের সময় একটা বিতর্ক আমাদেরকে প্রায়শই করতে হয় যে একটা ইস্যু আমরা কম সময় বা বেশী সময় ধরে আঁকড়ে আছি। যেমন: ডেনিশ কার্টুন ইস্যুর সময়কাল অল্প আর তার তুলনায় প্রথম আলো ইস্যু অনেক বেশী সময় ধরে করা হয়েছে। একটা ইস্যুকে যত বেশী সময় ধরে আমরা রাজপথে রাখবো, ততবেশী উক্ত ইস্যুর মাধ্যমে জনগণের কাছে যাওয়া যাবে। এতে অনেকে মনে করে যে মানুষ ক্লান্ত হয়ে যাবে বা জনমত আমাদের বিপক্ষে চলে যেতে পারে। আমাদের মনে রাখা দরকার ব্যাপক ও মৌলিক ইস্যু দীর্ঘমেয়াদে রাজপথে রাখার মাধ্যমেই সমাজ ও রাষ্ট্রে তার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া গভীরতর হয়।

একটা ইস্যুতে আন্দোলন চলাকালে সাংগঠনিক দিক থেকে আমাদের সর্বাত্মকভাবে উক্ত ইস্যুকে জনগণের কাছে নিয়ে যাওয়া জরুরী। আগেই বলেছি যেকোন ইস্যু নির্বাচনে আমরা দেশের/জনগণের স্বার্থ বা দেশ/জনগণ নিয়ে সাম্রাজ্যবাদীদের ষড়যন্ত্রকে অগ্রাধিকার দেই। সুতরাং, আমাদের কাজ হচ্ছে এমনভাবে জনগণকে সংগঠিত করা যেন এক আন্দোলন থেকে অন্য আন্দোলনে মানুষের অংশগ্রহণ বাড়তে থাকে। এটা আমরা যখন করতে পারব তখনই প্রকৃত অর্থে আমাদের আন্দোলন গণআন্দোলনে পরিণত হবে।

এবার আমরা বাংলাদেশের ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান ও ইরানের ১৯৭৯ এর গণঅভ্যুত্থানের দিকে তাকাই। এই দুইটি গণঅভ্যুত্থানের সংক্ষিপ্ত চিত্র থেকে উপরোক্ত আলোচনার সত্যতা উপলব্ধি করা যায়।

৪. বাংলাদেশে ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান

১৯৪৮শেখ মুজিব ভাষা আন্দোলনে গ্রেফতার ও মুক্তি আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী ধর্মঘটে গ্রেফতার
১৯৪৯আওয়ামী মুসলিম লীগের জন্ম, শেখ মুজিবের যুগ্ম সম্পাদক পদ লাভ, কারাগার থেকে মুক্তি, ঢাবি থেকে বহিষ্কার, ভুখা মিছিলে নেতৃত্ব দেয়ার অপরাধে আবার গ্রেফতার।
১৯৫২কারাগার থেকে মুক্তি – দলের অস্থায়ী সাধারণ সম্পাদক
১৯৫৩যুক্তফ্রন্ট গঠন
১৯৫৪যুক্তফ্রন্টের কাছে মুসলিম লীগের শোচনীয় পরাজয়
১৯৫৫যুক্তফ্রন্টের কাছে মুসলিম লীগের শোচনীয় পরাজয়
১৯৫৭কাগমারী সম্মেলন
১৯৫৮আইয়ুব খানের ক্ষমতা দখল, ইস্কান্দার মির্জার পলায়ন, সামরিক শাসন জারি, শেখ মুজিব আটক
১৯৫৯কারাগার থেকে মুক্তি
১৯৬২সামরিক শাসন অবসান, শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন
১৯৬৪আওয়ামী লীগের পুনরায় রাজনীতি শুরু
১৯৬৬ছয় দফা প্রস্তাব পেশ, পাঁচ সপ্তাহ্‌ দেশব্যাপী গণসংযোগ, গ্রেফতার
১৯৬৭প্রায় ৮০০ বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা কর্মী গ্রেফতার
১৯৬৮আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা
১৯৬৯২০শে জানুয়ারী – ছাত্র ধর্মঘট (আসাদ হত্যাকান্ড)
২১ শে ফেব্রুয়ারী ১৯৬৯ – মুক্তি
২৩ শে ফেব্রুয়ারী ১৯৬৯ – বিশাল গণজমায়েত
২৪ শে মার্চ – আইউব খানের পদত্যাগ
১৯৭০নির্বাচন, ঘূর্ণিঝড়ের সময়ে নির্বাচনী প্রচারনা ছেড়ে উপদ্রুত এলাকায় ত্রাণ বিতরণে ঝাপিয়ে পড়া

শিক্ষা:
১. গণভিত্তি প্রতিষ্ঠার সময়কাল – প্রথম দফা ১৯৫২ – ১৯৫৪, দ্বিতীয় দফা – ১৯৬৪ – ১৯৬৬
২. স্বউদ্যোগে ১৯৬৬ এ ছয় দফা পেশ, যা গণঅভ্যুত্থানের ভিত রচনা করে (অনেকে ছয় দফাকে সি.আই.এর দলিল বলেছিল)
৩. সকল নেতা-কর্মী গ্রেফতার সত্ত্বেও সারাদেশে আন্দোলন বিস্তার লাভ করে, তিন বছর স্থায়ী আন্দোলন
৪. ২০শে ফেব্রুয়ারী পাঁচ লক্ষ মানুষের জমায়েতের সম্ভাবনা দেখে শেখ মুজিবকে মুক্তি প্রদান
৫. ১৯৬৯-৭০ এক বছরের মধ্যে সারা দেশে সফর, নির্বাচনে নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা
৬. ব্যাপক জনগণের অংশগ্রহণ – ছাত্র, শিক্ষক, শ্রমিক, কৃষক, চাকুরীজীবি

৫. ইরানের ১৯৭৯ এর গণঅভ্যুত্থান

১৯৬১থেকে শুরু
১৯৬২সরকারী বিলের সফল প্রতিবাদ
১৯৬৩২৬ জানুয়ারী – ৬ দফার ভিত্তিতে গণভোট, খোমেনির গণভোট বর্জন
২১শে মার্চ নববর্ষের দিন নওরোজ – আনন্দের বদলে শোক পালন
পরের দিন খোমেনির মাদ্রাসায় সরকারী হামলা ও হত্যাকান্ড
আশুরা – ব্যাপক জনসমাগম ও সরকারবিরোধী বক্তব্য
৫ই জুন খোমেনি গ্রেফতার – সারা দেশে ব্যাপক বিক্ষোভ সমাবেশ
সমাবেশগুলোতে ব্যপক গুলি বর্ষণ – শুধু তেহরানেই ১৫,০০০ নিহত
এক বছর পর মুক্তি
১৯৬৪পার্লামেন্টে বিল পাশ- মার্কিন সৈন্যদের ইরানী আদালতে বিচার করা যাবে না
ব্যাপক লিফলেট বিতরণ – উদাহরণ দশ মিনিটে তেহরানে ৪০,০০০ বিতরণ
৪ নভেম্বর দেশ থেকে নির্বাসন
১৯৬৪খোমেনির বক্তব্য ধারণকৃত ক্যাসেট ব্যাপকভাবে বিলি
১৯৭৬মার্কিন সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে প্রকাশ্য রাজনীতি ধীরে ধীরে শুরু
১৯৭৭খোমেনির পুত্র হত্যা
১৯৭৮৭ই জানুয়ারী – পত্র-পত্রিকায় খোমেনি বিরোধী আপত্তিকর প্রবন্ধ
শহরে শহরে ব্যাপক বিক্ষোভ – ২০০ জনের মৃত্যু
৪০ দিনের শোক – শহরে শহরে
শোক সভা – বক্তৃতা – গুলি- রেকর্ড করে জনগণের মধ্যে বিলি
৪ই সেপ্টেম্বর – ঈদুল ফিতর, নামাজ শেষে লক্ষ লক্ষ মানুষের সমাবেশ
৮ই সেপ্টেম্বর – শুক্রবার, আবারো লক্ষ লক্ষ মানুষের সমাবেশ
৯/১০ই মহর্র‌ম, ১০/১১ই ডিসেম্বর – আবারও বিশাল গণজমায়েত
১৯৭৯১৬ই জানুয়ারী – রেজা শাহ্‌ এর দেশত্যাগ
ফেব্রুয়ারী – খোমেনির দেশে প্রত্যাবর্তন

শিক্ষা:
১. আন্দোলনের সময়কাল – প্রথম দফা ১৯৬১ – ১৯৬৩, দ্বিতীয় দফা – ১৯৭৮- ১৯৭৯
২. গণঅভ্যুত্থানের ট্রিগার – খোমেনির পুত্রকে হত্যা ও ১৯৭৮ এ সরকারের খোমেনি বিরোধী বক্তব্য প্রচার
৩. হাজার হাজার নেতা কর্মী গ্রেফতার, নির্যাতন, হত্যা সত্ত্বেও সারাদেশে আন্দোলন বিস্তার লাভ ১৯৬৪-৭৬
৪. শেষের দিকের সমাবেশে ৩০ লক্ষাধিক জনসমাগম, ব্যাপক নারী-শিশুর অংশগ্রহণ
৫. মসজিদভিত্তিক ব্যপক কাজ, সর্বত্র ইমামদেরকে সম্পৃক্ত করে ফেলা হয়েছিল

৬. উপসংহার

আমাদের জাতীয় নেতৃবৃন্দের জীবনী, জাতির সংগ্রামের ইতিহাস ইত্যাদি সম্পর্কে পরিস্কার ধারণা থাকতে হবে। অতীতে এই নেতৃবৃন্দ লক্ষ লক্ষ মানুষকে মবিলাইজ করতে সক্ষম হয়েছিল। একই সাথে আমাদেরকে জনগণের সাথে ভালভাবে মিশতে হবে। জনগণ যেন তাদের সকল দুঃখ-কষ্টের সময় আমাদেরকে পাশে পায়। আমরা শুধূ আমাদের রাজনৈতিক বক্তব্য নিয়ে তাদের কাছে যাব আর তাদের দৈনন্দিন আনন্দ-বেদনার অংশীদার হব না – এটা হতে পারে না। এখন থেকে আমাদের প্রত্যেকের গ্রামে নিজের ভিত্তি তৈরী করতে হবে। মসজিদে মসজিদে আমাদের অবস্থান দৃঢ় করতে হবে। আমাদের নিজস্ব ইসলামিক জ্ঞান বাড়াতে হবে এবং দাওয়ার ক্ষেত্রে কুর’আন-হাদীসের ব্যবহার বাড়াতে হবে। এটা আমাদের ব্যক্তিত্ব গঠনে যেমন সাহায্য করবে তেমনি মানুষের উপর নেতৃত্ব প্রদানের যোগ্যতাও বৃদ্ধি করবে। আমরা সহজেই মানুষের গ্রহণযোগ্যতা পাব। আমাদের মনে রাখতে হবে যে শেষ পর্যন্ত জনগণ খিলাফত প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে শরীক হবে এবং সর্বোচ্চ আত্নত্যাগ করতেু প্রস্তুত হবে শুধুমাত্র ইসলামের ভিত্তিতে। আমরা এভাবে সমাজের সর্বস্তরে আমাদের নেটওয়ার্কের বিস্তার ঘটাতে পারি তবে খুব শীঘ্রই ঢাকা শহরে লক্ষাধিক জনসমাগম ঘটানো সম্ভব হবে, ইনশাআল্লাহ্‌। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদের সকলকে কবুল করুন। আমিন।

আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেছেন,

যারা ঈমান এনেছে ও নেক আমল করেছে তাদেরকে আল্লাহ্‌ তা’আলা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, তিনি অবশ্যই তাদেরকে যমীনে খিলাফত দান করবেন, যেমনিভাবে তাদের পূর্ববর্তীদেরকে খিলাফত দান করেছেন। [সূরা : আন নূর-৫৫]

মহিউদ্দীন আহমেদ
ডিসেম্বর, ২০০৭, ঢাকা

Leave a Reply