আশুরা শুধুমাত্র শোক আর বিশ্লেষণের জন্য নয়
:: আশুরা শুধুমাত্র শোক আর বিশ্লেষণের জন্য নয়; বরং নব্য ফিরাউন (আমেরিকা) ও মুসলিম ভূমিসমূহে তার সহকারী হামান আর কারুনদের উৎখাত করে খিলাফত প্রতিষ্ঠার মধ্যেই নিহিত রয়েছে এই দিনের মূল শিক্ষা ::
মহররম মাস এবং বিশেষ করে আশুরার দিনটি মুসলিম উম্মাহর জন্য খুবই পবিত্র এবং পাশাপাশি ঐতিহাসিকভাবে তাৎপর্যপুর্ন। বেশ গুরুত্বপূর্ণ অনেক ঘটনার অবতারনা এই মাসেই হয়েছিল যা চিরকাল মুসলিম উম্মাহর জন্য শিক্ষণীয় হয়ে থাকবে। আশুরা বলতে আমরা অনেকেই শুধু কারবালার মর্মান্তিক ঘটনাকেই স্মরণ করি কিন্তু এই ঘটনা সম্পর্কে অবগত নই যে এই মহররমেই আল্লাহ সুবহানাওয়াতা’লা মুসা (আ) কে বিজয় দান করেছিলেন অত্যাচারী যালেম ফিরাউনের বিরুদ্ধে। তাই এটি শুধু শোকের মাস নয়, বরং যুলুমের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সংকল্পবদ্ধ হওয়ার মাস। ঐতিহাসিক কারণ ছাড়াও কুরআন এবং সুন্নাহতে এই মাসকে আলাদাভাবে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা) বলেছেন:
“১২ মাস এর বছরের ভেতর ৪টি হল পবিত্র। ধারাবাহিক তিনটি মাস – যু’ল কা’দা, যু’ল হিজ্জা এবং মহররম, এবং রজব মুদার যেটি জুমাদিল আখির এবং শা’বান এর মাঝখানে অবস্থান করে” [বুখারি # ২৯৫৮]
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা কুরআনে মহররম সহ উপরোক্ত মাসগুলোকে গুরুত্বের সাথে উল্লেখ করে বলেন:
“অতএব তোমরা এই মাসগুলোতে (দ্বীনের বিরুদ্ধাচরণ ও এই মাসগুলোর সম্মানহানি করে এমন কাজ করে) নিজেদের ক্ষতিসাধন করো না” [সুরা তওবাহ: ৩৬]
ইবনে আব্বাস (রা) এই “নিজেদের ক্ষতিসাধন করো না” আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন এই চারটি মাসকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা পবিত্র ঘোষণা করেছেন। তাই এই মাসগুলোতে নিজেদের (আল্লাহর বিরুদ্ধাচার করার মাধ্যমে) ক্ষতি করা হবে খুবই গুরুতর অপরাধ এবং অন্যদিকে ন্যায়ের কাজের সাওয়াবও হবে অনেক বেশী। তাই এই আশুরার দিনে যেমন আমরা রোজা রেখে সাওয়াব হাসিল করার চেষ্টা করছি, ঠিক তেমনি খিলাফত পুনঃপ্রতিষ্ঠার মতো গুরুত্বপূর্ণ ফরয কাজে গাফিলতি করে আমরা নিজেদের ক্ষতিসাধন করছি।
আমরা যখন কারবালা প্রান্তরে ইমাম হুসেইন (রা) এর করুণ ঘটনা নিয়ে মর্মাহত হই, আমাদের এই চিন্তা করা উচিৎ কী কারণে আল্লাহর রাসুলের (সা) কলিজার টুকরা হুসেইন (রা) নিজের জীবন বিলিয়ে দিলেন। যেখানে শুধুমাত্র ভুলভাবে খলীফা নিয়োগ দেয়ার কারণে প্রিয় হুসাইন নিজের জীবন আল্লাহর রাস্তায় উৎসর্গ করে দিলেন সেখানে আমরা আজ ৯০ বছর পার করে দিয়েছি খিলাফত বিহীন অবস্থায়; ভুলভাবে খলীফা নিয়োগ তো পরের বিষয়! খিলাফত যে প্রকৃতপক্ষে মুসলিম উম্মাহর জন্য জীবনমরণ (Life and Death) একটি বিষয় সেটির শিক্ষা আমরা আশুরার দিনে ইমাম হুসেনের আত্মত্যাগ থেকে পাই। খিলাফত যাতে কলুষিত না হতে পারে তার জন্য তিনি শুধু নিজের নয় বরং তার সন্তানকেও আল্লাহর রাস্তায় উৎসর্গ করেছিলেন কিন্তু তারপরও পিছপা হননি। তাই কারবালা আমাদের শিক্ষা দেয় যালিমের শাসনের বিরুদ্ধে দৃঢ়তার সাথে খিলাফতের পক্ষে লড়তে এবং প্রয়োজনে নিজেদের সর্বস্ব উৎসর্গ করতে।
মহররমের এই মাস আমাদের আরও স্মরণ করিয়ে দেয় মুসা (আ) এর সংগ্রাম ফিরাউন ও তার সহকারী হামান-কারুনদের বিরুদ্ধে। তাদের যুলুমের মাত্রা যখন বেড়ে গিয়েছিল এবং তারা যখন নিজেদের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী ভাবা শুরু করেছিল, ঠিক তখনি মুসা (আ) বনি ইসরায়েলিদের নিয়ে ফিরাউনের শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিলেন। ফিরাউন যেভাবে নিজেকে খোদা ভাবতো ঠিক সেভাবে আজকের নব্য-ফেরাউন আমেরিকাও আবির্ভূত হয়েছে যুলুমের খড়গ নিয়ে। আর আমেরিকার হামান-কারুনদের ভেতর রয়েছে মুসলিম ভূমিসমূহের শাসকরা। বাংলাদেশের দিকে যদি তাকাই তাহলে দেখবো খুনি হাসিনাও আজ দেশকে ধ্বংসের মুখে এনে দাঁড় করিয়েছে এবং তার খোদা আমেরিকার বলে বলীয়ান হয়ে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। তাই মহররম ও আশুরার শিক্ষা এই হওয়া উচিৎ যে আমরা সেই একই পথে হাঁটবো যে পথে মুসা (আ) হেঁটেছিলেন এবং বনী ইসরায়েলকে জুলুমের নাগপাশ থেকে মুক্ত করেছিলেন। নব্য-ফেরাউনি শাসনব্যবস্থা তথা পুঁজিবাদী গণতন্ত্রকে উৎখাত করে খিলাফত প্রতিষ্ঠার মধ্যেই রয়েছে মহররমের শিক্ষার বাস্তব প্রতিফলন।
অনুন্নত দেশের প্রযুক্তিগত উন্নয়ন, মেধা পাচার ও ভবিষ্যৎ রূপরেখা
খবর:
বিএসসি প্রকৌশলীদের প্রতি বৈষম্য নিরসনের তিন দফা দাবিতে চট্টগ্রামে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছেন চুয়েট, চবি, আইআইইউসি সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। শনিবার (৫ জুলাই) বিকাল ৪টায় নগরীর ২ নং গেইট এলাকায় তারা এই প্রতিবাদ সমাবেশ পালন করেন।
এ সময় বিক্ষোভ মিছিলে হাজারো শিক্ষার্থীদের ‘আমার সোনার বাংলায়, বৈষম্যের ঠাঁই নাই’; ‘কোটা না মেধা, মেধা, মেধা’; ‘কোটার নামে বৈষম্য, চলবে না, চলবে না’; ‘এই মুহূর্তে দরকার, কোটাপ্রথার সংস্কার’ প্রভৃতি স্লোগান দিতে দেখা যায়।
২ নং গেইট থেকে শুরু হয়ে জিইসি মোড় ঘুরে আবার উৎপত্তিস্থলে ফেরত আসে মিছিলটি। এরপর অনুষ্ঠিত সমাবেশে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন দাবিতে বক্তব্য দেয়া শুরু করেন। এ সময় তারা তাদের পূর্বে উত্থাপিত তিন দফা দাবি তুলে ধরেন— প্রকৌশল নবম গ্রেডে সহকারী প্রকৌশলী বা সমমান পদে প্রবেশের জন্য সবাইকে পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হওয়া এবং বিএসসি ডিগ্রিধারী হওয়া, কারিগরি দশম গ্রেডে উপ-সহকারী প্রকৌশলী বা সমমান পদ সবার জন্য উন্মুক্ত করা এবং বিএসসি ডিগ্রীধারী ব্যতীত অন্য কেউ ‘প্রকৌশলী’ পদবি ব্যবহার করতে পারবে না মর্মে আইন পাশ করে গেজেট প্রকাশ করা। এই তিন দফা দাবি দ্রুত কার্যকর করার দাবি জানান শিক্ষার্থীরা।
তাদের মতে, ডিপ্লোমা ডিগ্রিধারীদের প্রভাবশালী গোষ্ঠীর কারণে প্রকৌশল পেশায় বিএসসি ডিগ্রিধারীরা পদোন্নতি ও নিয়োগে ন্যায্যতা থেকে অনেকদিন ধরেই বঞ্চিত হয়ে আসছেন। দীর্ঘ ৪ বছর কঠিন পাঠ্যক্রম, ল্যাব, থিসিস ও প্রজেক্টের মধ্য দিয়ে পাস করা বিএসসি ডিগ্রিধারী প্রকৌশলীরা চাকরির বাজারে চরম বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। সরকারি চাকরির দশম গ্রেডে একচেটিয়া শতভাগ ডিপ্লোমা ডিগ্রিধারীদের নিয়োগ এবং নবম গ্রেডে পদোন্নতিতে ৩৩.৩ শতাংশ কোটা বরাদ্দ করা আছে ডিপ্লোমা ডিগ্রিধারীদের জন্য। অধিকন্তু নবম গ্রেডে পদোন্নতির ক্ষেত্রে কোটার ব্যবস্থা ৫০ শতাংশ করার অন্যায্য দাবিও জানিয়ে আসছিলেন তারা।
এ সময় প্রকৌশলী অধিকার আন্দোলন এর যুগ্ম আহ্বায়ক শাকিল আহমাদ ইকবাল বলেন, ‘যেই কোটার জন্য আমাদের গত জুলাইয়ে আন্দোলন করতে হয়েছে, সেই কোটার জন্য এক বছর পর আবার আন্দোলনে নামতে হচ্ছে। ডিপ্লোমারা ১০ম গ্রেড সরাসরি নিজেদের করে নিয়েছে, এখন ৯ম গ্রেডে ৩৩% কোটার নামে অনেক জায়গায় ১০০% প্রমোশন নিয়ে নিচ্ছে। এভাবে কোটার মাধ্যমে কেউ বিশেষ সুবিধা পেতে পারে না।’
এই আন্দোলনের মুখ্য সংগঠক শাকিবুল হক লিপু বলেন, ‘ডিপ্লোমাদের বিএসসি সার্টিফিকেট নেই। এভাবে প্রকৌশলী না হয়েও তারা প্রকৌশলীদের জন্য বরাদ্দকৃত চাকরির পোস্টসমূহ নিয়ে নিচ্ছে। চার বছর কষ্ট করে, পরিশ্রম করে বিএসসি ডিগ্রী অর্জন করতে হয়। এরপর এমন বৈষম্য মেনে নেয়া যায় না। এভাবে চলতে পারে না। আমরা তাই আমাদের নিজেদের দাবি আদায়ে মাঠে নেমেছি।’
বিক্ষোভকারী চুয়েট শিক্ষার্থী আমিনুল ইসলাম তার বক্তব্যে বলেন, ‘সমবাহু ত্রিভূজের ক্ষেত্রফল নির্ণয় শিখে এসে ডিপ্লোমারা প্রকৌশলের জন্য বরাদ্দকৃত পদ নিচ্ছে। এদিকে চার বছরে কঠিন কঠিন কোর্স শেষ করে আমরা চাকরিই পাচ্ছি না। আমাদেরকে আবেদন করা থেকেই বঞ্চিত করা হচ্ছে। বিসিএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণ না করে সমমর্যাদার পদ বাগিয়ে নিচ্ছে। স্বাধীন বাংলায় এমন বৈষম্য মেনে নেয়া যায় না।’
একই বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষার্থী মাহফুজুর রহমান মোহাব্বত বলেন, ‘পেশিশক্তি ও লবিংয়ের মাধ্যমে অবৈধ পদোন্নতি পাচ্ছে ডিপ্লোমারা। নিয়ম ভেঙে পদ সৃষ্টি করা হচ্ছে। চরম মাত্রার অনিয়ম চলছে। এগুলোর প্রমাণও রয়েছে। এরকম করেও তারা পার পেয়ে যাচ্ছে। এমনটা হতে পারে না। সরকারের উচিত দ্রুত উপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়া। বৈষম্য দূর করা। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সমাবেশ হচ্ছে। সবাই প্রকৌশলীই এই দাবির পক্ষে সোচ্চার।’
মন্তব্য:
দেশে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারদের প্রতি বৈষম্য যে হচ্ছে, সেটা অবশ্যই সত্য। কিন্তু প্রশ্ন হলো,এই বৈষম্য দূর হলেই কি তারা তাদের প্রাপ্য সম্মান ও মূল্য পাবে? এই রাষ্ট্র কি এমন কোনো ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট করেছে, যেখানে এই উচ্চশিক্ষিত ইঞ্জিনিয়াররা দেশের নিজস্ব ইন্ডাস্ট্রিতে দক্ষতা ও মেধা কাজে লাগাতে পারবে? আসলে, এই দেশে এমন কোনো শক্তিশালী শিল্পখাতই নেই, যেখানে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারদের নলেজ বা স্কিল প্রপারলি কাজে লাগবে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেই কাজ ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার বা টেকনিশিয়ান দিয়েই চালানো সম্ভব।
বাংলাদেশের ছাত্রছাত্রীরা বিশ্বের নানা প্রান্তে গিয়েও বিশ্বমানের কাজ করছে গুগল, মাইক্রোসফট, আমাজন, স্পেসএক্স থেকে শুরু করে ইউরোপের বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান পর্যন্ত। আমাদের ইঞ্জিনিয়াররা, সফটওয়্যার ডেভেলপাররা, ডাক্তাররা বিশ্বের বাজারে highly valued।
তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে এই সক্ষমতা আমরা নিজের দেশে ব্যবহার করতে পারছি না কেন? এই সক্ষমতাকে কাজে লাগানোর মতো কোনো ভিশন আমাদের রাষ্ট্র দেয় না।
এখানে আসল সমস্যা ডিপ্লোমা বনাম বিএসসি নয়, আসল সমস্যা হচ্ছে এই রাষ্ট্রীয় কাঠামো নিজেই একটা ভাঙা কাঠামো, যা কোনো বাস্তব ভিত্তির ওপর গড়ে ওঠেনি।
এই কাঠামোটি গড়ে তোলা হয়েছে পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থার (Capitalism) শর্ত ও নির্দেশনা অনুযায়ী। পুঁজিবাদ এর প্রধান ধারক-বাহক পশ্চিমা দেশগুলা আমাদের শিক্ষিত, মেধাবী জনগোষ্ঠীকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করছে। তারা আমাদের জন্য উন্নয়নের আশ্বাস দেয়, কিন্তু আসলে এমন একটি কাঠামো তৈরি করে রেখেছে যেখানে আমরা চিরকাল পরনির্ভরশীলই থেকে যাই।
এই সমস্যাগুলোর গোড়ায় আছে রাষ্ট্রীয়ভাবে অনুসৃত দাসসুলভ পলিসি, যা আমাদের শিক্ষা, শিল্প, গবেষণা সব কিছুকে নিয়ন্ত্রণ করে পশ্চিমা কর্পোরেট ও সংস্থাগুলোর স্বার্থ অনুযায়ী। যেমন বিশ্বব্যাংক, IMF, WTO এরা আমাদের দেশের পলিসিতে এমন সব শর্ত দিয়ে থাকে, যাতে আমরা নিজস্ব শিল্প, প্রযুক্তি বা উৎপাদনব্যবস্থা গড়ে তুলতে না পারি। স্থানীয় প্রোডাকশন ও রিসার্চ বন্ধ হয়ে যায়, আর আমাদের ইঞ্জিনিয়াররা হয় কাঁচামাল ও সস্তা শ্রমের যোগানদাতা। এর ফলে আমাদের দেশ থেকে প্রতিবছর হাজার হাজার মেধাবী শিক্ষার্থী বিদেশে পাড়ি জমায় উচ্চশিক্ষা, ভালো চাকরি কিংবা স্থায়ীভাবে বসবাসের আশায়। পাবলিক ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা দেশের জনগনের ট্যাক্স এর টাকায় পড়ে ৭০-৮০% বিদেশি কোম্পানির শ্রমিকে পরিণত হয়।
আমরা যারা এই সিস্টেমের ভুক্তভোগী, তারা নিজেদের মধ্যেই একে অপরকে প্রতিদ্বন্দ্বী বানিয়ে ফেলেছি, বিএসসি বনাম ডিপ্লোমা, পাবলিক বনাম প্রাইভেট, গ্রেড-ভিত্তিক দ্বন্দ্ব। অথচ, এই বিভক্তি তৈরি করেছে সেই সিস্টেম, যারা চায় আমরা বিভক্ত থাকি, যেন মূল শত্রুর দিকে কেউ আঙুল না তোলে।
এই কাঠামো আমাদের দারিদ্র্য থেকে মুক্ত করে না, বরং আমাদের দারিদ্র্যই টিকিয়ে রাখে, যাতে পশ্চিমা কোম্পানিগুলো সস্তায় পণ্য তৈরি ও মেধা ব্যবহার করতে পারে। এটা শুধু অর্থনৈতিক শোষণ নয়, এটা আদর্শিক, কাঠামোগত ও সাংস্কৃতিক দাসত্ব।
এই বাস্তবতা বদলাতে হলে প্রয়োজন এই পুজিবাদী সিস্টেমকে চ্যালেঞ্জ করা। একটা দুইটা আইন পরিবর্তন করলেই হবে না। প্রয়োজন এমন একটি কাঠামো যা আমাদের স্বার্থ, আমাদের মেধা, আমাদের সম্পদকে দেশেই কাজে লাগাবে। প্রয়োজন এমন এক আদর্শিক ব্যবস্থা, যা ন্যায়ভিত্তিক হবে এবং ১৩০০ বছর এই ব্যবস্থা পুরো বিশ্বে ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করে গেছে। যেখানে ইঞ্জিনিয়ার, চিকিৎসক, বিজ্ঞানী, শ্রমিক – সবার কাজই ছিল সম্মানিত ও রাষ্ট্রের কল্যাণে নিবেদিত।
ইসলামই একমাত্র আদর্শ যা প্রকৃত সমাধান দেয়
ইসলাম শুধু একটা ধর্ম নয়, বরং একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা, যার মধ্যে আছে রাষ্ট্র, সমাজ, শিক্ষা, অর্থনীতি, প্রযুক্তি ও জ্ঞানচর্চার সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা। এই আদর্শব্যবস্থায় মেধা কখনোই অবহেলিত ছিল না। বরং ইসলামি রাষ্ট্র মেধাকে সম্মান দিয়ে কাজে লাগিয়েছে, এবং সেটি শুধু থিওরিতে নয়, বাস্তবে ১৩০০ বছর ধরে বাস্তবায়িত হয়েছে।
কুরআনের নির্দেশনাই ছিল জ্ঞান, গবেষণা ও ইনসাফভিত্তিক রাষ্ট্রের ভিত্তি:
“আল্লাহ তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে এবং যাদের জ্ঞান দান করা হয়েছে, তাদের মর্যাদা বহু গুণে উন্নীত করেন।” সূরা আল-মুজাদিলা (৫৮:১১)
“যারা জানে এবং যারা জানে না, তারা কি সমান?” সূরা আয-যুমার (৩৯:৯)
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা সরাসরি জ্ঞানীদের মর্যাদা তুলে ধরেছেন, যা ইসলামি সভ্যতায় গবেষণা, শিক্ষাব্যবস্থা ও প্রযুক্তির উন্নয়নের ভিত্তি তৈরি করে।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন- “প্রত্যেক মুসলমানের উপর জ্ঞান অর্জন করা ফরজ।” [সুনান ইবনে মাজাহ, হাদিস: ২২৪]
মুসলিম বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলীদের ইসলামি রাষ্ট্রে অবদান:
ইবনে সিনা (Avicenna): মেডিক্যাল সায়েন্স ও দর্শনের পথিকৃৎ। খিলাফতের পৃষ্ঠপোষকতায় গবেষণা, হাসপাতাল ও শিক্ষা প্রশাসনে যুক্ত ছিলেন।
আল-খোয়ারিজমি: অ্যালজেব্রা ও অ্যালগরিদমের জনক। তার কাজ Bayt al-Hikmah (জ্ঞানাগার)-এ রাষ্ট্রীয় অর্থায়নে পরিচালিত হয়েছিল।
আল-জাজারি: মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং ও রোবোটিক্সের প্রবর্তক। পানির মেশিন, স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র বানিয়ে রাষ্ট্রীয় কাজে লাগিয়েছেন।
আল-রাযী ও আল-জাবির ইবনে হাইয়ান: রসায়ন ও চিকিৎসায় বিপ্লব এনেছেন। তাদের গবেষণাগার পরিচালিত হতো সরকারি তত্ত্বাবধানে।
আল-বাতানি ও মারিয়া আল-আস্ট্রোলাবি: জ্যোতির্বিদ্যা ও নেভিগেশন টেকনোলজিতে নেতৃত্ব দিয়েছেন। নারীদের জন্যও জ্ঞানচর্চার পরিবেশ তৈরি হয়েছিল খিলাফতের অধীনে।
ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থা মেধাকে সংরক্ষণ করত, বিকাশ ঘটাত এবং বাস্তবে কাজে লাগাত – একটি আদর্শ রাষ্ট্র গঠনের জন্য। আজ যেখানে মেধা পাচার হয়, সেখানে ইসলামি আদর্শ মেধাকে সম্মান দেয়, রক্ষা করে এবং সমাজ-রাষ্ট্রে বাস্তব ভূমিকা রাখতে দেয়।
ইরান সরকারটি কেমন?
ইরানের যেকোনো ইস্যু আসা মাত্রই এক শ্রেণির মানুষ ইরানিদের শিয়া মতবাদ নিয়ে এমনভাবে আলোচনা তোলেন যেন ইরানকে নিয়ে যাবতীয় সমস্যার কারণ তাদের শিয়া মতবাদ। কারো কারো আক্বীদাগত উত্তেজনা এই সময়গুলোতে এতই বৃদ্ধি পায় যে, মনে হয় ইস*রা*য়ে*লই হয়ত আহলে সুন্নাহ ও সুন্নি মাজহাবগুলোর ভ্যানগার্ড হিসেবে ইরানের কুফরী আক্বীদাগুলোকে গুড়িয়ে দিচ্ছে!
আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক রাজনীতির সকল হিসাব-নিকাশ ছাপিয়ে কেবল শিয়া মতবাদ নিয়ে তারা মেতে থাকে।
তাই ইরানি শাসকদেরকে রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে মূল্যায়নের আগে এই আক্বীদাগত বিষয়টি সম্বন্ধে প্রকৃত কিছু সত্য তুলে ধরা প্রয়োজন মনে করছি।
বাস্তবতা হলো, শিয়া মতবাদ শুরুতে রাজনৈতিক বিরোধই ছিল। এই রাজনৈতিক বিরোধ পরবর্তীতে বৃহত্তর ফিকহী বিরোধে রূপান্তরিত হয়। গত ১০০ বছরে এই বিরোধটিকে অনেকটা আলাদা সম্প্রদায়গত বিরোধ হিসেবে রূপ দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।
ঐতিহাসিকভাবে সুন্নি স্কলাররা কখনোই শিয়াদেরকে ঢালাওভাবে কাফের বা অমুসলিম বলেননি। বরং সুনির্দিষ্ট আক্বীদাগত ভ্রষ্টতার শিকার ব্যক্তিদের কুফরের ফতোয়া দিয়েছেন। যেমন, ইমাম আল-গাজ্জালী (রহ.) তাঁর “ফাদায়িহ আল-বাতিনিয়্যাহ” বইতে বলেছেন:
“أما الإمامية الاثنا عشرية فليسوا كفارًا ولا مرتدين، وإنما هم فساق مبتدعون”
অর্থ: “ইমামিয়া ইসনা আশারিয়া [বর্তমান ইরানের সংখ্যাগরিষ্ঠ শিয়া] কাফের বা মুরতাদ নয়; বরং তারা বিদআতী ফাসিক।”
অর্থাৎ গাজ্জালী (রহ.) ইসনা আশারিয়া [ইরানের এরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ] শিয়া বিদআতী আখ্যা দিলেও কুফরির অভিযোগ করেননি, তাদেরকে বিদআতী ও পাপাচারী বলেছেন।
শিয়াদের বিষয়ে অন্যতম কঠোর ইমাম ইবনে তাইমিয়াহ (রহ.) তাঁর “মাজমু’ আল-ফাতাওয়া”-তে বলেছেন:
“التشيع ليس كفرًا مطلقًا، بل فيه تفصيل: فمن غلا في الأئمة وجعلهم مثل الأنبياء أو فوقهم، أو كفر الصحابة، فهو كافر”
অর্থ: “শিয়াবাদ সর্বদা কুফর নয়; এতে পার্থক্য আছে: যে ইমামদের নবীদের সমকক্ষ বা ঊর্ধ্বে স্থান দেয় অথবা সাহাবাদের কাফের বলে, সেই কাফের।”
ইমাম ইবনে হাজার আল-হাইতামী (রহ.) তাঁর “আস-সাওয়াইক আল-মুহরিকা” তে বলেছেন:
“الرافضة إذا سبّوا الصحابة أو كفّروهم فهم كفار”
অর্থ: “রাফিজি (চরমপন্থী শিয়া) যদি সাহাবাদের গালি দেয় বা কাফের বলে, তাহলে তারা কাফের।”
বর্তমানকালের সুন্নি স্কলার বা প্রতিষ্ঠানগুলোর ফতোয়াও প্রায় একই ধরনের। যেমন, দারুল ইফতা আল-মিসরিয়্যাহ (আল-আজহার)-এর ফতোয়া: “আহলুস সুন্নাহ ওয়া আল-জামা’আহ ইসনা আশারিয়া শিয়াদেরকে ‘কাফের’ বলে না, যতক্ষণ তারা ইসলামের মূল স্তম্ভে বিশ্বাসী।” (ফতোয়া নং ২৩৪১, ২০১২)।
সৌদি আরবের গ্র্যান্ড মুফতি শেখ আবদুল আজিজ বিন বাজ (রহ.) বলেছেন: “কোনো শিয়া যদি সাহাবীগণকে ভালোবাসে ও কুরআন অপরিবর্তিত বলে বিশ্বাস করে, তার সাথে ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখা জায়েজ।” [মাজমু’ ফাতাওয়া, ২/৩০৪]
ক্লাসিকাল স্কলারগণের ও বর্তমান কালের এসব ফতোয়া বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়:
#কখন_শিয়াকে_“কাফের”_বলা_হয়েছে?
১. কুরআন বিকৃতির বিশ্বাস:
– যে বলে কুরআন অসম্পূর্ণ বা বিকৃত হয়েছে [ইবনে তাইমিয়াহ, দার আল-তা’আরুদ, ১/৩৫৬।]
২. সাহাবিদের (রা.) প্রতি চরম শত্রুতা:
– আবু বকর, উমর (রা.)-কে কাফের বলা বা তাদের প্রতি অভিশাপ দেওয়া [ইবনে তাইমিয়াহ, মিনহাজ আল-সুন্নাহ, ৪/৫৯০]।
৩. ইমামদের অতি ভক্তিবাদ:
– ইমামদের নবুওয়ত বা ইলাহী গুণাবলি দেওয়া [আল-শাহরাস্তানি, আল-মিলাল ওয়া আল-নিহাল, ১/১৯৩]।
#যাদের_“কাফের”_বলা_হয়নি
– সাধারণ ইসনা আশারিয়া শিয়া: যারা সাহাবিদের সমালোচনা করে না বা কুরআন বিকৃতি বিশ্বাস করে না [ইবনে আবিদিন, রাদ্দ আল-মুহতার, ৪/২৬৩]
– জাফরি ফিকহ অনুসারী: যারা শুধু ফিকহি পার্থক্য রাখে [আল-আজহারের ফতোয়া, ১৯৫৯]।
অর্থাৎ বাংলাদেশের ফেসবুক স্কলারদের মতো করে কোনো কালেই সুন্নি স্কলারগণ শিয়াদেরকে ঢালাওভাবে কাফের বলেননি; বরং সুনির্দিষ্ট আক্বীদাগত ভ্রষ্টতা (কুরআন বিকৃতি, সাহাবিদের প্রতি শত্রুতা, ইমামদের অতিমানবীকরণ)-কে কুফরের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
এবং এই দৃষ্টিভঙ্গিই কুরআন-সুন্নাহর আলোকে ন্যায়সঙ্গত ও সুপ্রতিষ্ঠিত।
শিয়া আসলে কারা?
ইতোমধ্যে ১ম পর্বে আলোচিত হয়েছে যে, ক্ল্যাসিকাল সুন্নি স্কলাররা কখনোই শিয়াদেরকে ঢালাওভাবে “কাফের” বলেননি।
শিয়া ও সুন্নি বিভেদের বিস্তারিত আলোচনা করার সুযোগ এই পোস্টের সীমিত পরিসরে নেই। এ বিষয়ে ভবিষ্যতে অন্য কোথাও বিস্তারিত আলোচনার ইচ্ছা রইলো ইন’শা’আল্লাহ।
তবে বর্তমান ইসরায়েল ও ইরান যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে শিয়াদের সম্বন্ধে ন্যূনতম যেটুকু আলোচনা এখন করা খুবই প্রয়োজন, সেটুকুই শুধু এখানে সংক্ষিপ্তভাবে তুলে ধরছি।
আরবিতে “শিয়া” শব্দের অর্থ অনুসারী, সমর্থক বা কোনো দলের সদস্য। “শিয়া” শব্দটি এ ধরনের অর্থেই পবিত্র কুরআনে মোট ১১ বার ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন, আল্লাহ বলেছেন:
{وَاِنَّ مِنۡ شِيۡعَتِهٖ لَاِبۡرٰهِيۡمَۘ}
এবং অবশ্যই ইবরাহীম ছিল তারই অন্যতম শিয়া (অনুসারী/দলের লোক)। [আল কুরআন ৩৭:৮৩]
একইভাবে, সূরা আনআম: ৬৫; সূরা সাফফাত : ৮৩; সূরা কাসাস : ১৫ ইত্যাদি আয়াতেও শিয়া শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে।
তবে পারিভাষিক অর্থে শিয়া শব্দটি “শিয়াতু-আলী” (রা.) অর্থাৎ মহান সাহাবী আলী (রা.)-এর অনুসারী/সমর্থক হিসেবে পরবর্তীতে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। হযরত আলী (রা.) ছিলেন অত্যন্ত উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন সাহাবী। ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রা.) বলেছেন,
{مَا جَاءَ لِأَحَدٍ مِنَ الصَّحَابَةِ مِنَ الْفَضَائِلِ مَا جَاءَ لِعَلِيٍّ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ}
[সূত্র: “مَنَاقِبُ الإِمَام أَحْمَد بن حَنبَل” لابن الجوزي, ص ١٦٣]
অর্থ: “সাহাবীদের মধ্যে কারও সম্পর্কে আলী (রাদিয়াল্লাহু আনহু)-এর ন্যায় এত অধিক ফজিলত (মর্যাদা) বর্ণিত হয়নি।”
এমনকি, আলী (রা.)-এর সমর্থক বা তাঁর প্রতি ভালোবাসা পোষণকারীদের ফজিলতও বিভিন্ন হাদীসে এসেছে। যেমন, আলী (রা.) বলেন, সেই মহান সত্তার কসম, যিনি বীজ থেকে অঙ্কুরোদগম করেন এবং জীবকুল সৃষ্টি করেন, মহানবী (সা.) আমাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, মুমিন ব্যক্তিই আমাকে ভালোবাসবে, আর মুনাফিক ব্যক্তি আমার সঙ্গে শত্রুতা পোষণ করবে। [সহীহ মুসলিম, হাদীস: ৭৮]
রাসূল (সা.) বলেছেন,
{من أحبّ عليّا فقدْ أحبّنِي ، ومن أحبّنِي فقد أحبّ اللهَ عز وجلَ ، ومن أبغضَ عليّا فقد أبغضَني ، ومن أبغضَني فقد أبغضَ اللهَ عز وجل}
যে ব্যক্তি আলীকে ভালোবাসে, সে আমাকেই ভালোবাসে; আর যে আমাকে ভালোবাসে, সে সর্বশক্তিমান আল্লাহকে ভালোবাসে। যে ব্যক্তি আলীকে ঘৃণা করলো, সে আমাকে ঘৃণা করে; আর যে আমাকে ঘৃণা করে, সে সর্বশক্তিমান আল্লাহকে ঘৃণা করে। [আলবানী, সিলসিলা সহীহাহ ১২৯৯]
রাসূল (সা.) বলেন,
{يا علي أبشر فإنك و أصحابك و شيعتك في الجنَّة}
অর্থ: “হে আলী, তোমার জন্য সুসংবাদ! নিশ্চয়ই তুমি, তোমার সঙ্গীরা এবং তোমার শিয়া (সমর্থক/অনুসারী)-রা জান্নাতে থাকবে।” [সূত্রসমূহ: আহমদ ইবন হাম্বল (فضائل الصحابة, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ৬৫৫); হিল্যাতুল আওলিয়া, খণ্ড ৪, পৃ. ৩২৯; মু’জাম আল-আওসাত, তাবারানী; মাজমাউ’জ যাওয়ায়েদ, খণ্ড ১০, পৃ. ২১-২২; আল-দারকুতনি, বিভিন্ন সনদে; আল-সাওয়ায়িক আল-মুহরিকাহ, ইবনে হাজার আল হাইতামী, অধ্যায় ১১, পৃ. ২৪৭; হাদীসটি বিপুল সংখ্যক সনদে বর্ণিত হলেও প্রতিটি সনদেই দুর্বলতা আছে। তবে হাদীসটি ফজিলত সংক্রান্ত হওয়ায় এবং অন্যান্য সহীহ হাদীসের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়ায় বহু সংখ্যক ক্ল্যাসিকাল সুন্নি স্কলার এই হাদীসটি উদ্ধৃত করেছেন। আহলে সুন্নাহর সর্বসম্মত মত হলো, ফজিলতের ক্ষেত্রে “দুর্বল” সনদে বর্ণিত হাদীস গ্রহণযোগ্য, যদি না সেই হাদীসটি অন্যান্য সহীহ হাদীসের বিপরীত হয়।]
রাসূল (সা.) বলেছেন,
{“شيعة علي هم الفائزون يوم القيامة}
অর্থ: “আলীর শিয়ারাই কিয়ামতের দিন প্রকৃত সফলকাম।” [সূত্রসমূহ: আল-মানাকিব (المناقب), আহমদ ইবনে হাম্বল; তারিখ দিমাশক (تاريخ دمشق), ইবনে আসাকির, খণ্ড ৪২, পৃষ্ঠা ৩৩১-৩৩২; তাফসীরে তাবারী, সূরা আল-বাইয়িনাহ (৯৮:৭) এর তাফসীরে উল্লেখিত; তাফসীর আল-দুররুল মানসুর, জালালুদ্দিন আল-সুয়ূতী, সূরা আল-বাইয়িনাহ (৯৮:৭); এই হাদীসটির সনদেও দুর্বলতা আছে। তবে হাদীসটি ফজিলত সংক্রান্ত হওয়ায় ক্ল্যাসিকাল সুন্নি স্কলারগণ এই হাদীসটি উদ্ধৃত করেছেন।]
দেখা যাচ্ছে, এই হাদীসটি সূরা আল-বাইয়িনা (৯৮:৭)-এর তাফসীরে সুন্নি মুফাসসীরগণ উল্লেখ করেছেন। বিশিষ্ট সুন্নি স্কলার ইমাম ইবনে হাজার আল-হাইতামী (রহ.) বলেন,
رَوَى ابْنُ عَبَّاسٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُمَا قَالَ: لَمَّا نَزَلَتْ: {إِنَّ الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ أُولَٰئِكَ هُمْ خَيْرُ الْبَرِيَّةِ} (البينة: ٧)، قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لِعَلِيٍّ: “هُم أَنْتَ وَشِيعَتُكَ”. وَقَالَ: “يَا عَلِيُّ، أَنْتَ وَشِيعَتُكَ تَأْتُونَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ رَاضِينَ مَرْضِيِّينَ، وَيَأْتِي عَدُوُّكُمْ غِضَابًا مُقْمَحِينَ”. قَالَ عَلِيٌّ: “مَنْ عَدُوِّي؟” قَالَ: “مَنْ تَبَرَّأَ مِنْكَ وَلَعَنَكَ، وَبَشَّرَى لِلسَّابِقِينَ إِلَى ظِلِّ الْعَرْشِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ”. قَالَ عَلِيٌّ: “مَنْ هُمْ يَا رَسُولَ اللهِ؟” قَالَ: “شِيعَتُكَ يَا عَلِيُّ، وَمُحِبُّوكَ”.
ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণনা করেছেন: যখন আয়াত “নিশ্চয় যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে, তারাই সৃষ্টির সেরা” (সূরা আল-বাইয়িনাহ ৯৮:৭) নাযিল হলো, রাসূল (সা.) তখন আলী (রা.)-কে বললেন: “তারা হলেন তুমি ও তোমার শিয়া”।
রাসূল (সা.) আরও বললেন: “হে আলী, কিয়ামতের দিন তুমি ও তোমার শিয়ারা সন্তুষ্ট ও আল্লাহর সন্তুষ্টি নিয়ে উপস্থিত হবে, আর তোমাদের শত্রুরা ক্রোধান্বিত অবস্থায় ঘাড় বাঁকা করে আসবে।”
আলী (রা.) জিজ্ঞাসা করলেন: “আমার শত্রু কারা?”
রাসূল (সা.) উত্তর দিলেন: “যারা তোমার থেকে বিচ্ছিন্ন হয় এবং তোমাকে অভিশাপ দেয়। আর কিয়ামতের দিন ‘আরশের ছায়ায় আগে পৌঁছানোদের জন্য সুসংবাদ!”
আলী (রা.) বললেন: “হে আল্লাহর রাসূল, তারা কারা?”
রাসূল (সা.) বললেন: “হে আলী! তোমার শিয়া ও তোমার ভালোবাসার লোকেরা।”
[আল-সাওয়ায়িক আল-মুহরিকাহ, অধ্যায় ১১, অনুচ্ছেদ ১, পৃ. ২৪৬-২৪৭]
এই হাদীসের ব্যাখ্যায় ইবনে হাজার আল-হাইতামী (রহ.) বলেন, “আলী (রা.)-এর শিয়ারা হলেন আহলে সুন্নত (সুন্নি), কারণ তারা শরিয়তের নির্দেশিত সীমার মধ্যে আহলে বাইতকে ভালোবাসেন। অন্যরা (সুন্নি ছাড়া অন্যান্য গোষ্ঠী) প্রকৃতপক্ষে আহলে বাইতের শত্রু; কারণ শরিয়তের সীমা লঙ্ঘনকারী ভালোবাসাই মহাশত্রুতা… আর আহলে বাইতের শত্রু ছিলেন খাওয়ারিজ ও সিরিয়ার অনুরূপ গোষ্ঠীগুলো; মুয়াবিয়া (রা.) ও অন্যান্য সাহাবি নন; কেননা তারা (মুয়াবিয়া প্রমুখ) সদুদ্দেশ্যে ভুল ব্যাখ্যাকারী (مُتَأَوِّلُوْنَ) — তাদের জন্য সওয়াব রয়েছে, আর আলী (রা.) ও তাঁর শিয়াদের জন্যও সওয়াব রয়েছে।” [আল-সাওয়ায়িক আল-মুহরিকাহ, অধ্যায় ১১, অনুচ্ছেদ ১, পৃষ্ঠা ২৩৬]
মূলত “শিয়া” বলতে ক্ল্যাসিকাল সুন্নি স্কলারগণ এটাই বুঝিয়েছেন: “শিয়াতু-আলী” (রা.) বা আলী (রা.)-এর অনুসারী/সমর্থক হলো সুন্নিগণ। যেমন, ইমাম সুয়ূতী (রহ.) বলেন,
{“كَانَ السَّلَفُ يَقُولُونَ: شِيعَةُ عَلِيٍّ هُمُ السُّنِّيُّونَ لِأَنَّهُمْ عَلَى طَرِيقَةِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ”}
অর্থ: “সালাফগণ বলতেন: আলীর শিয়ারাই সুন্নি, কারণ তারা নবীজি (সা.)-এর ত্বরীক্বা/পদ্ধতির উপর প্রতিষ্ঠিত।” [তারীখুল খুলাফা, পৃ. ১৬৮]
অর্থাৎ ইসলামের প্রাথমিক যুগে “শিয়া” শব্দটি সুন্নি আলেমদের জন্যই ব্যবহৃত হতো। একইভাবে, ইবনে আবিল ইয আল-হানাফি (রহ.) বলেছেন,
{“أَهْلُ السُّنَّةِ هُمْ شِيْعَةُ عَلِيٍّ فِي الْحَقِيقَةِ؛ لِأَنَّهُمْ يَتَّبِعُونَهُ فِي الدِّينِ”}
অর্থ; “আহলে সুন্নতই প্রকৃতপক্ষে আলীর শিয়া, কারণ তারা দ্বীনে তাঁর অনুসরণ করে।” [শারহু আকীদাতিত-তাহাবিয়্যাহ, পৃ. ৪৮২]
বাংলাদেশের সোশ্যাল মিডিয়ার স্বঘোষিত “মহাজ্ঞানী” ইসলামী পণ্ডিতেরা যাঁকে তাদের শ্রদ্ধেয় ইমাম দাবি করে, সেই সম্মানিত সুন্নি স্কলার ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রহ.) স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন,
{“الشِّيعَةُ الَّذِيْنَ يُحِبُّونَ عَلِيًّا وَيُقَدِّمُونَهُ عَلَى عُثْمَانَ، وَهُمْ مِنْ أَهْلِ السُّنَّةِ إِذَا لَمْ يَكْفُرُوا أَحَدًا مِنَ الصَّحَابَةِ”}
অর্থ: “যারা আলীকে ভালোবাসে ও উসমানের উপর তাঁকে প্রাধান্য দেয়, তারাই শিয়া। তারা আহলে সুন্নতের অন্তর্ভুক্ত—যতক্ষণ না সাহাবাদের কাউকে কাফির বলে।” [মিনহাজুস সুন্নাহ ৫/১৫৬]
অর্থাৎ, শিয়া পরিচয় সত্ত্বেও সাহাবিদের প্রতি সম্মান বজায় রাখলে তারা সুন্নি বলেই গণ্য—এটাই ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রহ.)-এর মত।
আসলে এটিই ছিল মুসলিম স্কলারদের সর্বসম্মত মত: শিয়া মানে আহলে সুন্নাহ (সুন্নি) এবং সুন্নিরাই আলী (রা.)-এর শিয়া/সমর্থক। প্রথম দুই শতাব্দীতে শিয়া ও সুন্নি স্কলারগণ কোনো পার্থক্যহীনভাবে একে অন্যের কাছে শিক্ষাগ্রহণ করতেন। ইসলামী জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে দ্বিতীয় শতাব্দী থেকে কাঠামোবদ্ধ ফিকহ ও মাজহাব গড়ে উঠতে থাকে।
হিজরী দ্বিতীয় শতাব্দীর বিশিষ্ট স্কলার ইমাম জাফর আস-সাদিক (রহ.) [জন্ম: ৭০২ খ্রি. – মৃত্যু: ৭৬৫ খ্রি.] ছিলেন রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ষষ্ঠ বংশধর, যিনি ইমাম হাসান বিন আলী (রা.)-এর পুত্র জয়নুল আবেদিনের (রহ.) নাতি। তিনি ইলম, তাকওয়া ও আধ্যাত্মিকতার ক্ষেত্রে এতই খ্যাতিমান ছিলেন যে, ইমাম আবু হানিফা (রহ.) ও ইমাম মালিক (রহ.)-সহ অনেক স্কলার তাঁর নিকট জ্ঞান অর্জন করেন। তাঁর ছাত্রদের মধ্যে ইমাম আবু হানিফা (রহ.) ও ইমাম মালিক (রহ.)-এর ফিকহী উসুল ও মতামতের ভিত্তিতে হানাফী মাজহাব ও মালিকী মাজহাবের মতো বৃহৎ দুইটি ফিকহী ধারা (School of Thought) গড়ে ওঠে।
ইমাম জাফর আস-সাদিক (রহ.)-এর অনুসারীরা পরবর্তীতে “জাফরী মাজহাব” নামে আরেকটি স্বতন্ত্র ফিকহী ধারা গঠন করেন। এই “জাফরী মাজহাব”-ই বর্তমান শিয়া মতবাদের ভিত্তি। তবে ইমাম জাফর আস-সাদিক (রহ.) নিজে কোনো নতুন মাজহাব প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেননি; পরবর্তীকালে তাঁর শিক্ষাকে তার অনুসারীরা পৃথক মাজহাব (School of Thought)-এ রূপান্তরিত করে। সুন্নি ও শিয়া উভয় ফিকহী ধারাতেই ইমাম জাফর আস-সাদিক (রহ.)-এর ইলম, মর্যাদা ও বংশগত সম্মান সর্বজনবিদিত ও সর্বজনশ্রদ্ধেয়।
“জাফরী মাজহাব”-টি এখন “ইসনা আশারিয়া” বা বারো ইমাম-পন্থী শিয়া মতবাদ হিসেবে পরিচিত। ইরানের সরকার ও জনগণ মূলত এই “জাফরী মাজহাব” বা “ইসনা আশারিয়া” ফিকহী ধারা (School of Thought)-এর অনুসারী/শিয়া।
শিয়া–সুন্নি বিভক্তির কারণ
সাহাবী হিসাবে হযরত আলী (রা.)-এর উচ্চ মর্যাদার কারণে সাহাবীগণ তাঁর প্রতি গভীর ভালোবাসা পোষণ করতেন। যেমন, আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেছেন: “আল্লাহর কাছে আলীর চেয়ে প্রিয় কাউকে আমি দেখিনি।” [হিলইয়াতুল আওলিয়া, ১/৮৪]
আবু হুরায়রা (রা.) ও আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) প্রমুখ সাহাবীগণ বলতেন, “আলীর দিকে তাকানো ইবাদত।” [মুস্তাদরাকে হাকিম; মুজামউল কবীর]
রাজনৈতিক উত্তরসূরিত্বের প্রশ্নেও একদল সাহাবী মনে করতেন খিলাফতের জন্য আলী (রা.)-ই সর্বাধিক হকদার। শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী (রহ.) লিখেছেন:
“وَالْحَقُّ أَنَّ أَصْلَ الْخِلَافِ كَانَ فِي الْإِمَامَةِ”
অর্থ: “সত্য হলো, বিভেদের মূল ছিল ইমামতের (নেতৃত্বের) প্রশ্নে।” [ইযালাতুল খিফা, ১/৮৭]
এই রাজনৈতিক উত্তরাধিকার সংক্রান্ত বিরোধ ধীরে ধীরে আকিদা ও ফিকহের স্তরে প্রবেশ করে।
হিজরি ৩৬ সালে (৬৫৬ খ্রি.) জামাল যুদ্ধ ও ৩৭ হিজরিতে (৬৫৭ খ্রি.) সিফফিনের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। জামাল যুদ্ধের মূল ইস্যু ছিল উসমান (রা.)-এর হত্যার বিচার, আর সিফফিনে আলী (রা.) ও মুয়াবিয়া (রা.)-এর মধ্যে খিলাফতের আনুগত্য নিয়ে সংঘাত। এ সময় আলী (রা.)-এর সমর্থকগণ “শিয়াতু আলী” (شيعة علي) নামে পরিচিত হন। ইমাম নববী (রহ.) এর ব্যাখ্যায়:
“أَهْلُ السُّنَّةِ مُتَّفِقُونَ عَلَى أَنَّ عَلِيًّا كَانَ مُصِيبًا فِي الْقِتَالِ”
অর্থ: “আহলে সুন্নত ঐকমত্য পোষণ করেন যে আলী (রা.) যুদ্ধে সঠিক ছিলেন।” [শারহু সাহিহ মুসলিম ১২/২২৯]
মুয়াবিয়া (রা.) ও তাঁর পক্ষের সাহাবীরা ইজতিহাদি ভুল করলেও তারা “কাফির” বা “ফাসিক” ছিলেন না—এটি সুন্নি মাজহাবের ঐকমত্য। [ইবনে হাজার, ফাতহুল বারি, ১৩/৫৫; শাহ ওয়ালিউল্লাহ, ইযালাতুল খিফা, ১/৯০]
প্রথম শতাব্দীতে “শিয়াতু আলী” ছিল আলী (রা.)-এর রাজনৈতিক সমর্থকদের পরিচয়। হযরত আলী (রা.)-এর পক্ষের সাহাবা ও তাবেয়ীগণ সাধারণভাবে এই পরিচয় বহন করতেন। তখন “সুন্নি” নামে পৃথক কোনো দল-মত ছিল না।
ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ.) (মৃ. ২৪১ হি.) হিজরী তৃতীয় শতাব্দীতে “আহলে সুন্নত” / “সুন্নি জামাত” পরিভাষাটি সুপ্রতিষ্ঠিত করেন, যা দ্বারা তিনি রাজনৈতিক বিভাজনের ঊর্ধ্বে রাসূল (সা.)-এর সুন্নাহের অনুসারীদের নির্দেশ করেন। [তারীখ বাগদাদ, ৪/৪১২]
তবে তারও আগে হিজরি ১২২ সালে ইমাম হাসান (রা.)-এর নাতি, রাসূল (সা.)-এর পঞ্চম বংশধর হযরত যায়দ ইবনে আলী (রা.) উমাইয়া শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলে কুফার একদল উগ্রপন্থী তাকে আবু বকর (রা.) ও উমর (রা.)-এর নিন্দা করতে বলে। যায়দ (রা.) তা প্রত্যাখ্যান করায় সেই উগ্রপন্থীরা তাঁকে পরিত্যাগ করে। ইমাম যাহাবী (রহ.) লিখেন:
“لَمَّا خَرَجَ زَيْدُ بْنُ عَلِيٍّ… قَالُوا: تَبَرَّأْ مِنْ أَبِي بَكْرٍ وَعُمَرَ حَتَّى نَنْصُرَكَ! فَقَالَ: بَلْ أَتَوَلَّاهُمَا. قَالُوا: إِذًا نَرْفُضُكَ! فَسُمُّوا: الرَّافِضَةَ”
অর্থ: “তারা বলল: আবু বকর-উমর থেকে বিমুখ হও, তবেই আমরা তোমাকে সমর্থন করব! তিনি বললেন: বরং আমি তাদের বন্ধু। তারা বলল: তাহলে আমরা তোমাকে প্রত্যাখ্যান করলাম! তাই তারা ‘রাফেজা’ নামে আখ্যায়িত হয়।” [মীযানুল ই‘তিদাল, ১/২৬]
এরপর “রাফেজী” শব্দটি উগ্রপন্থী শিয়াদের জন্য ব্যবহৃত হতে থাকে—যারা আবু বকর, উমর (রা.)-এর খিলাফতকে অস্বীকার করে, এমনকি সাহাবীদেরকে গালাগালিও করে। মূলধারার শিয়াগণ (ইমাম যায়দ বা জাফর সাদিকের অনুসারীগণ) এই উগ্র “রাফেজী”-দের থেকে আলাদা ছিলেন এবং তাদের প্রত্যাখ্যান করতেন। কিন্তু যায়দী শিয়া ও জাফরী শিয়াদের সাথে উমাইয়া ও আব্বাসীয়দের রাজনৈতিক বিরোধের কারণে উমাইয়া ও আব্বাসীয়রা সকল শিয়াকেই “রাফিজী” ট্যাগিং করার চেষ্টা করতো।
একই সময়ে শিয়ারাও “নাসিবী” (ناصبي) শব্দের প্রচলন শুরু করে। “নাসিবী” শব্দটি এসেছে **”نَصَبَ الْعَدَاءَ”** (শত্রুতা স্থাপন করা) থেকে। ইবনে তাইমিয়া (রহ.) এর সংজ্ঞা দেন:
“النَّوَاصِبُ هُمُ الَّذِينَ يُظْهِرُونَ الْعَدَاءَ لِآلِ بَيْتِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ”
অর্থ: “নাসিবী হল যারা নবী পরিবারের প্রতি শত্রুতা প্রকাশ করে।” [মিনহাজুস সুন্নাহ, ৪/৫৩০]
খারেজি ও কিছু উমাইয়া সমর্থক গোষ্ঠীকে এই ট্যাগ দেওয়া হতো, কিন্তু সকল সুন্নি কোনো অবস্থাতেই “নাসিবী” নন।
খিলাফতের উত্তরাধিকার নিয়ে সূচিত বিভাজন উমাইয়া-আব্বাসীয় যুগে আকিদাগত রূপ নেয়। ইবনে খালদুন (রহ.) বলেছেন:
“تَعَمَّقَتِ الْفُرْقَةُ بَيْنَ الشِّيعَةِ وَالسُّنَّةِ فِي الْعَصْرِ الْعَبَّاسِيِّ حَتَّى صَارَتْ مَذَاهِبَ كَلامِيَّةً”
অর্থ: “আব্বাসীয় যুগে শিয়া-সুন্নি বিভক্তি এত গভীর হয় যে তা কালামী মতবাদে পরিণত হয়।” [মুকাদ্দিমাহ, ১/২৯৮]
আধুনিক যুগে সৌদি আরব ও ইরানের ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্ব এই পুরনো বিভাজনকে পুনরায় রাজনীতি-কেন্দ্রিক করে তুলেছে। উভয় পক্ষের উগ্র সমর্থকেরা একে অপরকে “রাফেজী” ও “নাসিবী” আখ্যায়িত করে, যদিও শিয়াদের খুবই ক্ষুদ্র একটি অংশ এখনো “রাফিজী” এবং সুন্নীদেরও খুবই ক্ষুদ্র একটি অংশ এখনো “নাসিবী”।
লক্ষ করলেই দেখবেন, বাংলাদেশেও সৌদ-পরিবারের ভক্তরা ইরানি শিয়াদেরকে “রাফিজী” হিসেবে উল্লেখ করে, অথচ সকল শিয়াকে “রাফিজী” বলাটা বাংলাদেশের সকল সুন্নি মুসলিমকে “সুরেশ্বরী” বা “দেওয়ানবাগী” বলার মতো।
বিশেষত যখনই ইরানের সাথে মধ্যপ্রাচ্যে সৌদিদের বা সৌদের মনিব আমেরিকার কোনো দ্বন্দ্ব শুরু হয়, তখনই বাংলাদেশে এক শ্রেণির শায়খরা মাথায় ঘোমটা দিয়ে, চিবিয়ে চিবিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় শিয়াদেরকে গণহারে “রাফিজী” বা “কাফের” ডাকা শুরু করে। সৌদি রাজপরিবারের হাজারো অপকর্মের বিরুদ্ধে তারা কখনো একটি শব্দও বলবে না। পারতপক্ষে তারা ইসরায়েলের বিরুদ্ধেও নিরব। কিন্তু ইরান প্রসঙ্গ আসলেই তাদের ছহিহ আক্বীদানুভূতি খুব উত্তেজিত হয়ে ওঠে!
শিয়াদের আক্বীদা কী?
“শিয়াদের আক্বীদা কী”—এই প্রশ্নটি কনসেপচুয়ালি সঠিক নয়। ইতঃপূর্বে আলোচিত হয়েছে যে, শিয়া চিন্তাধারার সূচনা সাহাবায়ে কেরামের যুগে হযরত আলী (রা.)-কে অগ্রাধিকারমূলক ভালোবাসা ও খিলাফতের জন্য সর্বাধিক যোগ্য বিবেচনার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। এটি ছিল একটি রাজনৈতিক পছন্দের বিষয়, তখন এটি ঈমান সংক্রান্ত কোনো আলোচ্য বিষয়ে পরিণত হয়নি। উল্লেখ্য, “ঈমানের বিষয়বস্তু” বোঝানোর জন্য “আক্বীদা” শব্দটির ব্যবহারও সে যুগে ছিল না। পবিত্র কুরআন বা সহীহ হাদীসে “আক্বীদা” শব্দটি ঈমানের পরিভাষা হিসেবে অনুপস্থিত। বরং হিজরী চতুর্থ শতাব্দীতে (শিয়া চিন্তাধারা শুরু হওয়ার প্রায় ৪০০ বছর পর) ইসলামী পরিভাষায় “আক্বীদা” শব্দটির ব্যবহার শুরু হয়।
ইসলামী পরিভাষায় “আক্বীদা” শব্দটি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পূর্বে “শিয়া” বলতে মূলত একটি রাজনৈতিক দল বা পক্ষকে বোঝানো হত। বিশেষ করে উমাইয়া ও আব্বাসীয় খলিফাদের বিরোধিতা করা গোষ্ঠীগুলো এই পরিচয়ে পরিচিত ছিল। উদাহরণস্বরূপ, উমাইয়া শাসকদের জুলুমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারী ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-কেও অনেক ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক শিয়া হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি সুন্নি মতবাদের বৃহত্তম ফিকহি মাযহাবের ইমাম হলেও, তাঁর রাজনৈতিক অবস্থান তাকে “শিয়া” পরিচয় দিয়েছিল—এবং সেটি কোনো আক্বীদাগত বিভক্তি ছিল না।
#সাহাবা-তাবেঈন যুগে ঈমানের ভিত্তি:
সাহাবা ও তাবেঈনদের যুগে ঈমান বলতে কুরআন-সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত ছয়টি মৌলিক বিশ্বাসকেই বোঝানো হত:
১. আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস
২. ফেরেশতাদের প্রতি বিশ্বাস
৩. আসমানী কিতাবসমূহের প্রতি বিশ্বাস
৪. নবী-রাসূলগণের প্রতি বিশ্বাস
৫. আখিরাতের (পরকাল) প্রতি বিশ্বাস
৬. তাকদীরের (ভাগ্যের) প্রতি বিশ্বাস
এই ছয়টি বিষয়ে বিশ্বাস করলেই কোনো ব্যক্তি “মুমিন” হিসেবে গণ্য হতেন। সে যুগে শিয়া ও সুন্নি—সকল মুসলিম এই মৌলিক বিশ্বাসে সম্পূর্ণ ঐক্যবদ্ধ ছিলেন এবং বর্তমানেও আছেন। অতএব, প্রাথমিক যুগে শিয়া ও সুন্নিদের মধ্যে কোনো পৃথক ‘আক্বীদা’ বিদ্যমান ছিল না।
#তাত্ত্বিক_বিতর্কের_সূচনা ও আক্বীদা শাস্ত্রের উদ্ভব:
হিজরী প্রথম শতাব্দীর শেষভাগ থেকে ধর্মতাত্ত্বিক বিতর্ক তীব্র হতে থাকে। কাদরিয়া, মুতাজিলা, জাহমিয়া প্রভৃতি দার্শনিক গোষ্ঠীগুলো ঈমানের শাখাগত বিষয় নিয়ে জটিল বিতর্ক সৃষ্টি করে। ফলশ্রুতিতে হিজরী তৃতীয়-চতুর্থ শতাব্দীতে ‘আক্বীদা’ নামে একটি স্বতন্ত্র ধর্মতাত্ত্বিক শাস্ত্রের বিকাশ ঘটে। এ সময়ই লেখ্যরূপে আক্বীদার চর্চা শুরু হয়, যেমন: আক্বীদা আত-তাহাবিয়্যা (রচনাকাল: হিজরী ৩য়/৯ম শতাব্দী, ইমাম আবু জাফর আত-তাহাবী রহ.), আল-আক্বীদা আল-ওয়াসিতিয়্যাহ (রচনাকাল: ৭০৫ হি./১৩০৬ খ্রি., শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ.) ইত্যাদি।
এভাবে ঈমানের সরল ছয়টি স্তম্ভের উপর শতাধিক শাখাগত প্রশ্নের উদ্ভব হয়। আক্বীদার চর্চা ঈমানের মৌলিক বিষয়গুলোকে এমন গভীরে নিয়ে যায় যেখানে মানবীয় ব্যাখ্যা ও দুর্বল সূত্রের হাদীসের ব্যবহার শুরু হয়। সাহাবী যুগের পর ইসলামের বিশ্বব্যাপী সম্প্রসারণের সাথে সাথে মুসলিম স্কলাররা বিভিন্ন সভ্যতা ও ধর্মের সংস্পর্শে আসেন এবং ঈমানের জটিল দিক নিয়ে আলোচনা শুরু করেন। বোঝার জন্য এই প্রচেষ্টা যুক্তিসঙ্গত ছিল, কিন্তু ক্রমে তা সীমা অতিক্রম করে। মানুষ নিজেদের সঠিকতা প্রমাণের পাশাপাশি অন্যদের ভুল প্রমাণে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ফলে আক্বীদা এতটাই বিস্তারিত ও জটিল হয়ে ওঠে যে ঈমানের মূলনীতিগুলো আর “আঙুলে গোনার” মতো সরল থাকল না—বরং ‘আক্বীদা আত-তাহাবিয়্যা’, ‘শারহুল আক্বীদাতিল ওয়াসিতিয়্যাহ’ বা ‘কিতাবুত তাওহীদ’-এর মতো বিশাল গ্রন্থরাজিতে পরিণত হলো!
এই সকল গ্রন্থে আলোচিত কিছু জটিল বিতর্কের বিষয়:
– ওহী বনাম যুক্তি: ধর্মীয় জ্ঞানে ঐশী বাণী ও মানবীয় যুক্তির মধ্যে প্রাধান্য কাকে দেওয়া হবে?
– কুরআন সৃষ্ট নাকি অ-সৃষ্ট: কুরআন আল্লাহর সৃষ্টি, নাকি তাঁর অনন্ত জ্ঞানের প্রকাশ?
– আল্লাহর সর্বত্র উপস্থিতি: আল্লাহ কি সর্বত্র বিদ্যমান (সর্বব্যাপী), নাকি তিনি স্থান-কালের ঊর্ধ্বে?
– তাকদীর বনাম ইখতিয়ার: মানুষের কর্ম কি পূর্বনির্ধারিত, নাকি তার স্বাধীন ইচ্ছা আছে?
– ইবলিসের পরিচয়: শয়তান (ইবলিস) ফেরেশতা ছিল, নাকি জিন জাতির?
– রাসূলুল্লাহ (সা.) নূর (আলো) দিয়ে সৃষ্টি, নাকি অন্যান্য মানুষের মতো মাটি দিয়ে? রাসূলুল্লাহ (সা.) কি সবার আগে সৃষ্টি হয়েছিলেন?
এসব বিস্তারিত আলোচনা ও মতবিরোধ কারও কারও কাছে গুরুত্বপূর্ণ হলেও, তা ধীরে ধীরে শিয়া-সুন্নি নির্বিশেষে সকল ফিকহি মাযহাবের মধ্যে উপদলীয় বিভাজন তৈরি করে।
#শিয়া_মাযহাবসমূহ_ও_তাদের_আক্বীদাগত_পার্থক্য:
পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে শিয়াদের মধ্যে আক্বীদাগত যে ধারণা প্রবেশ করেছে তা নিচে মোটামুটি সামারি দেওয়া হলো। তবে মনে রাখা জরুরি: একই মাযহাবের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা থাকতে পারে (যেমন, হানাফী সুন্নিদের মধ্যে দেওবন্দী-বেরেলভী)। শিয়া মাযহাবগুলোর সারাংশ:
১. ইসনা আশারিয়া (বারো ইমামী/জাফরী):
– ফাদলুল্লাহ ঘরানা (লেবানন, ইরাক; হি*জ*বুল্লা*হ গ্ৰুপের আধ্যাত্মিক অনুপ্রেরণা):
* ইমামত নেতৃত্বের ধারাবাহিকতা, কুরআনের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ।
* আলী (রা.)-এর নেতৃত্ব আল্লাহর ইচ্ছায় নির্ধারিত ছিল বলে বিশ্বাস।
* তাকিয়া (প্রতিকূল পরিস্থিতিতে মত গোপন) কৌশলগত বিষয়, ধর্মীয় ভিত্তি নয়।
* সুন্নিদের সাথে ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বে বিশ্বাস, সাহাবীদের প্রতি সম্মান।
* কারও প্রতি অভিশাপ বা গালিগালাজ হারাম।
[সূত্র: আয়াতুল্লাহ মুহাম্মাদ হুসাইন ফাদলুল্লাহ রহ.-এর ফতওয়া ও বক্তব্য]
– আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনি ঘরানা (ইরানের ক্ষমতাসীন সরকার ও অধিকাংশ শিয়া এই ঘরানার):
* ইমামত “ইলাহী নিয়োগ” (আল্লাহর ইশারায় নির্বাচন) এবং ইমামগণ মাসূম (নিষ্পাপ)।
* ইমামত ঈমানের অংশ।
* তাকিয়া ও ইমামদের অলৌকিক ক্ষমতা বিশ্বাস্য।
* ইমামদের প্রায়-নবীর মর্যাদা দেওয়া।
[সূত্র: ইমাম খোমেইনি রহ.-এর “কাশফুল আসরার”, “হুকুমাতে ইসলামী”]
২. যায়দিয়া (ইয়েমেনের সাধারণ শিয়া ও হু*তি বিদ্রোহীদের মাযহাব):
* ইমামতকে রাজনৈতিক নেতৃত্ব হিসেবে দেখা হয়, ধর্মীয় নেতৃত্ব নয়।
* ইমামগণ মাসূম (নিষ্পাপ) নন।
* সাহাবায়ে কেরামের অধিকাংশের প্রতি শ্রদ্ধাশীল।
* ফিকহে হানাফীর সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ বিধান।
* ইমাম যায়িদ বিন আলী (রহ.)-এর অনুসারী, যাঁকে ইমাম আবু হানিফা (রহ.) রাজনৈতিকভাবে সমর্থন করতেন।
[সূত্র: ইমাম যায়িদ রহ.-এর “মাজমুউল ফিকহ”, ঐতিহাসিক গ্রন্থ “তাবাকাতে ইবনে সাদ”]
৩. গুলাত (অতিরঞ্জনকারী) সম্প্রদায়:
“গুলাত” অর্থ অতিরঞ্জনকারী। এরা মূলধারার শিয়া থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। তাদের ভ্রান্ত আক্বীদার উদাহরণ:
* আলী (রা.)-কে “আল্লাহ” বা “আল্লাহর নূর” মনে করা।
* ইমামদের উপর খোদায়ী গুণ আরোপ করা (যেমন: অলৌকিক সৃষ্টি, গায়েব জানা)।
* গোপন ইমামত ও রূপক তাফসিরে বিশ্বাস।
* আলাউয়ী/নুসাইরী (সিরিয়া): আলী (রা.)-কে আল্লাহর সত্তার অংশ মনে করে।
* ইসমাইলিয়া: ইমামতকে গোপন জ্ঞানের ধারক বলে বিশ্বাস করে।
* আগাখানি: ইসমাইলিয়ার একটি শাখা, বর্তমান নেতা আগা খান।
* দাঊদী/সুলাইমানী বোহরা (ভারত-পাকিস্তান): ইসমাইলিয়ার উপশাখা।
#গুলাতদের_বিরুদ্ধে_মূলধারার_শিয়া আলেমদের কঠোর অবস্থান: শাইখ ইবনে বাবুয়াইহ আল-কুম্মী (আস-সাদূক) রহ. (মৃ. ৩৮১ হি.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি আলী (আ.)-কে ‘ইলাহ’ (খোদা) বলে বিশ্বাস করে, সে কাফির। আমরা তার থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন।” [আল-ই’তিকাদাত, পৃষ্ঠা ১০২]
আল্লামা আব্দুল্লাহ আল-মামাকানী রহ. (১৮৪৬–১৯৩২) বলেছেন, “গুলাতরা ইসলামের শত্রু। ইমামদেরকে খোদা বানানো বা দৈব গুণ দেয়া—এসব প্রকাশ্য কুফর।” [তানকীহুল মাকাল ফী ইলমির রিজাল, ২/১৮৫]
আয়াতুল্লাহ আগা বোজর্গ আত-তেহরানী রহ. (মৃ. ১৯৭০) বলেছেন, “যারা ইমামদের উপর আল্লাহর সিফাত আরোপ করে, তারা প্রকৃত শিয়া নয়।”
[আয-যারিয়াহ ইলা তাসানীফিশ শিয়া, ৪/২৮৩]
আয়াতুল্লাহ সাইয়েদ মুহাম্মাদ হুসাইন ফাদলুল্লাহ রহ. (লেবানন) বলেছেন, “আমরা এমন শিয়াবাদকে প্রত্যাখ্যান করি যাতে গালিগালাজ, অভিশাপ, ইমামদের দেবত্বকরণ বা অতিরঞ্জন থাকে। এটি আহলে বাইতের প্রকৃত শিক্ষার পরিপন্থী।” [বিবৃতি: আল-মাউসুআতুল ফিকহিয়্যাহ আল-মুয়াসিরাহ, ১/৩৪০]
আসলে “শিয়া আক্বীদা” বলতে একক, অভিন্ন কোনো মতাদর্শ নেই (জাফরী, যায়দিয়া, ইসমাইলিয়ার মধ্যে আক্বীদাগত পার্থক্য বিশাল), যেভাবে “সুন্নি আক্বীদা” বলতেও একক কিছু নেই (আশআরি, মাতুরিদি, সালাফি/আসারি ভিন্নতা বিদ্যমান)। মূলধারার জাফরী বা যায়দিয়া শিয়ারা ঈমানের ছয় মৌলিক স্তম্ভে সুন্নিদের সাথে সম্পূর্ণ একমত। তাদের মধ্যে ফিকহি মতপার্থক্য থাকলেও তা আক্বীদাগত বিভাজন নয়।
ইতঃপূর্বে রাফেজী ও নাসিবী নিয়েও আলোচনা করেছি। এখানে সেই আলোচনা আবার করা প্রাসঙ্গিক।
প্রাথমিক ইমামগণ (যেমন ইমাম যায়িদ রহ., ইমাম জাফর আস-সাদিক রহ.) সাহাবীদের গালি দেওয়া, আলী (আ.)-কে খোদা বানানো বা ইমামতকে নবুয়তের সমান দাবি করার তীব্র প্রতিবাদ করতেন। প্রকৃত রাফেজী ছিল তারা যারা:
– হযরত আবু বকর, উমর, উসমান (রা.)-কে কাফের/মুনাফিক বলত।
– আলী (আ.)-কে প্রায় নবীর মর্যাদা দিত।
– কুরআন বিকৃত হয়েছে বলে বিশ্বাস করত।
– সাহাবায়ে কেরামের অধিকাংশকে গালি দিত।
(সূত্র: ইবনে তাইমিয়ার “মিনহাজুস সুন্নাহ”, ১/৩৫; শাহরাস্তানীর “আল-মিলাল ওয়ান নিহাল”)
বর্তমান ইসনা আশারিয়া/যায়দিয়ারা কি রাফেজী?
না। আধুনিক জাফরী আলেমগণ (যেমন আয়াতুল্লাহ ফাদলুল্লাহ, আয়াতুল্লাহ সিস্তানী, আয়াতুল্লাহ ফালাহাতপিশে) রাফেজী মতবাদ প্রত্যাখ্যান করে সুন্নিদের সাথে সংলাপ ও সম্মানের আহ্বান জানিয়েছেন। যায়দিয়ারা তো সাহাবীদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই পুরো শিয়া মতবাদকে “রাফেজী” আখ্যা দেওয়া অন্যায়।
#নাসিবী (ناصبي) কারা?
‘নাসিবী’ শব্দটি ‘নাসাবা’ (বিদ্বেষ পোষণ করা) ধাতু থেকে এসেছে। ইসলামী ইতিহাসে আহলে বাইত (বিশেষত আলী (রা.) ও তাঁর বংশধর)-এর প্রতি বিদ্বেষ পোষণকারী, তাদের গালি দেওয়া বা মর্যাদা অস্বীকার করা ব্যক্তিকে নাসিবী বলা হতো।
বর্তমান সুন্নিরা কি নাসিবী?
মোটেও না। সুন্নি মাযহাবগুলো আহলে বাইতের প্রতি গভীর ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা পোষণ করে। ইমাম বুখারী (সহীহ বুখারী, “ফাদাইলু আসহাবিন নবী” অধ্যায়), ইমাম আহমাদ (ফাদাইলুস সাহাবা), ইমাম নববী (শারহু মুসলিম), জালালউদ্দিন সুয়ুতি-সহ বহু সুন্নি মনীষী আহলে বাইতের মর্যাদা নিয়ে লেখালেখি করেছেন। যেমন, বুখারী শরীফে অন্যান্য সকল সাহাবীর নামের শেষে “রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু” লেখা হলেও আহলে বাইতগণের নামের শেষে, অর্থাৎ আলী (রা.), ফাতিমা (রা.), হাসান-হুসেন (রা.) প্রমুখের নামের শেষে প্রায় ২০ বার সম্মানসূচকভাবে “আলাইহিস সালাম” লেখা হয়েছে। কোনো সুন্নি মাযহাব “নাসিবী নীতি” সমর্থন করে না।
শিয়া-সুন্নি উভয় ঘরানার কিছু উগ্রপন্থী লোক অহেতুক একে অপরকে “রাফেজী” ও “নাসিবী” আখ্যা দিয়ে উম্মাহর ঐক্য বিনষ্ট করে। ওয়েব সাইট, ব্লগ ও সোশ্যাল মিডিয়ায় এসব নোংরামি ও বিদ্বেষ খুবই পরিকল্পিতভাবে ছড়ানো হয়। ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা হলো—অন্য মুসলিমের ঈমান নিয়ে সন্দেহ না করা এবং দলিলভিত্তিক মতপার্থক্য থাকলেও সম্মান ও ন্যায়বিচার বজায় রাখা (কুরআন ৪৯:১২, সহীহ বুখারী ৬০৪৫)।
ঐতিহাসিকভাবে শিয়া-সুন্নি সম্পর্ক কেমন ছিল?
আগের পর্বগুলোতে আলোচনা হয়েছে যে, শিয়া ও সুন্নি বিভাজন মূলত রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার রাজনৈতিক সংঘাত থেকে উৎপত্তি লাভ করেছে, ঈমান-আক্বীদা বা ফিকহগত মতপার্থক্য থেকে নয়। মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাসে আব্বাসীয়-ফাতেমী কিংবা উসমানীয়-সাফাভী দ্বন্দ্ব প্রকৃতপক্ষে ছিল প্রভাব বিস্তার ও আঞ্চলিক আধিপত্যের লড়াই। এসব লড়াই শিয়া-সুন্নি পরিচয়ের আড়ালে পরিচালিত হলেও এসবের মূলে ছিল ক্ষমতার রাজনীতি। তবে লক্ষণীয় যে, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বলয় থেকে মুক্ত আলেমগণ সাধারণত উম্মাহর বৃহত্তর স্বার্থে এই ধরনের বিবাদে জড়াতেন না।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় উসমানীয় খিলাফতের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে শিয়া ও সুন্নি আলেমদের ঐতিহাসিক ঐক্য একটি উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত। ১৯১৪ সালের নভেম্বরে ব্রিটিশ বাহিনী ইরাকের আল-ফাও উপকূলে অবতরণ করলে ইরাকের শিয়া নেতাগণ, যেমন গ্র্যান্ড আয়াতুল্লাহ কাজিম আল-ইয়াযদি (রহ.) ও আয়াতুল্লাহ মির্জা মুহাম্মাদ তাকি শিরাজী (রহ.) তৎকালীন উসমানীয় খলিফার পক্ষে ফতোয়া জারি করেন। কারবালা ও নাজাফের শিয়া আলেমগণ স্থানীয় মুসলমানদেরকে উসমানীয়দের পাশে দাঁড়ানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন। [ড. আলী আল-ওয়ার্দি ,”লামাহাত ইজতিমাইয়াহ মিন তারিখ আল-ইরাক আল-হাদিস”-এ ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৫৬]
অন্যদিকে, সহীহ আক্বীদার দাবিদার আহলে সৌদ (সৌদের বংশধর ও অনুসারীরা) সে সময় ব্রিটিশদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল।
১৯১৯ সালে ইরাকের স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে শিয়া-সুন্নি নেতারা “We, being of the Muslim Arab nation and representing the Shia and Sunni communities inhabiting Baghdad and its suburbs…” – এমন বিবৃতি দিয়ে জাতীয় ঐক্যের অনন্য নজির স্থাপন করেছিলেন। এই ঐতিহাসিক দলিলটি ব্রিটিশ জাতীয় সংরক্ষণাগারে (UK National Archives, FO 371/4148) সংরক্ষিত আছে। ১৯২০ সালের ইরাকি বিপ্লবকালে মির্জা তাকি শিরাজীর নেতৃত্বে শিয়া-সুন্নি আলেমগণ ও সাধারণ মানুষ সংযুক্তভাবে ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামে অংশ নিয়েছিলেন। [ড. আব্দুল্লাহ আল-ফায়াদ, “The Iraqi Revolution of 1920”, পৃষ্ঠা ১৮৯-১৯১]
তবে ১৯২৪ সালে উসমানীয় খিলাফতের পতনের মাধ্যমে শিয়া-সুন্নির ঐক্যের প্রতীকটি ধ্বংস হয় এবং গত ১০০ বছর ধরে বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী মহল উদ্দেশ্যমূলকভাবে বিভাজনটি উস্কে দিতে সক্রিয় রয়েছে।
ভারতীয় উপমহাদেশে দিল্লি সালতানাত ও মুঘল আমলে শিয়া-সুন্নিদের মধ্যে পারস্পরিক সৌহার্দ্য ও ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী (১৭০৩-১৭৬২) তার বিখ্যাত গ্রন্থ “ইজালাতুল খিফা আন খিলাফতুল খুলাফা”-তে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন: “শিয়ারা ইসলামবিরোধী নয়”, “আলী (রা.)-এর মর্যাদা আমরা স্বীকার করি” এবং “বিভাজন মূলত রাজনৈতিক কারণে সৃষ্টি হয়েছে”। [গ্রন্থের ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ১০৩-১০৭]
বাংলা অঞ্চলে নবাব আলীবর্দী খান ও সিরাজউদ্দৌলার শিয়া পরিচয় সত্ত্বেও স্থানীয় সুন্নি আলেম ও সাধারণ মুসলিমগণ তাদেরকে সমর্থন করেছিলেন। [ড. মুহাম্মদ মোহর আলী, “History of the Muslims of Bengal”, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪৩২]
ব্রিটিশ আমলেও এই সম্প্রীতি অব্যাহত ছিল। অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের মধ্যে শিয়া-সুন্নি উভয় সম্প্রদায়ের নেতাই ছিলেন – নবাব ওয়াকার-উল-মুলক মৌলভী (সুন্নি), স্যার আদমজী পিরভয় (শিয়া) সুলতান মুহাম্মদ শাহ আগা খান (শিয়া), ঢাকার নবাব সলিমুল্লাহ (সুন্নি) এবং স্যার সৈয়দ আমির আলী (শিয়া)। পাকিস্তান আন্দোলনের সর্বজনীন নেতা মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর শিয়া পরিচয় সত্ত্বেও ভারতের সকল প্রধান সুন্নি নেতারা তার নেতৃত্ব মেনে নিয়েছিলেন।
বাংলার সাংস্কৃতিক ইতিহাসে শিয়া প্রভাব অত্যন্ত গভীর। হাজী মুহাম্মদ মহসিনের মতো শিয়া সমাজ সংস্কারক থেকে শুরু করে মহররম ও কারবালাকেন্দ্রিক বাংলা সাহিত্যের বিপুল ভাণ্ডার এই সম্প্রীতিরই স্বাক্ষর বহন করে। এখনো বাঙালি মুসলিমের নামের মধ্যে আলী, হাসান, হুসেনের বিপুল প্রাধান্য দেখা যায়, যা মূলত শিয়া সংস্কৃতি। ১৯৮০ দশকে বাংলাদেশের সবচেয়ে সম্মানিত আলেম মাহমুদুল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) ইরান সফর করেছিলেন এবং তিনি আয়াতুল্লাহ খোমেনির ইমামতিতে সালাত আদায় করেছিলেন এবং আয়াতুল্লাহ খোমেনিও হাফেজ্জী হুজুরের ইমামতিতে সালাত আদায় করেছিলেন।
১৯৭৯ সালের ইরানি বিপ্লবের পর থেকে শিয়া-সুন্নি সম্পর্কে নতুন মাত্রা যুক্ত হয়। ইতিহাসবিদ ফাউজি আল-জিয়াদ তার “The Shia-Sunni Divide: Myths and Realities” (পৃষ্ঠা ৭৮) গ্রন্থে উল্লেখ করেন যে, ইরানের শাহ পাহলভীর আমলে সৌদি আরবের সাথে সুসম্পর্ক বজায় ছিল, যদিও ইরানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ তখনও শিয়া ছিল। পশ্চিমাপন্থী শাহের সাথে পশ্চিমাপন্থী সৌদি রাজতন্ত্রের যথেষ্ট সুসম্পর্ক ছিল।
কিন্তু আয়াতুল্লাহ খোমেনির নেতৃত্বে ইসলামী বিপ্লবের মাধ্যমে পশ্চিমা দালাল শাহের উৎখাতের পর পশ্চিমা দালাল সৌদি সরকারের নীতি পরিবর্তন হয়। তারা শিয়াবিরোধী ব্যাপক প্রচারণা শুরু করে।
তবুও সৌদি আরব কখনোই সরকারিভাবে শিয়াদেরকে কাফের ঘোষণা করেনি এবং শিয়াদেরকে হজ্ব করতে অনুমতি দেয়। ২০১০ সালে লেবাননের শিয়া নেতা আয়াতুল্লাহ মুহাম্মাদ হুসাইন ফাদলুল্লাহর মৃত্যুর পর সৌদি প্রতিনিধিদল তার জানাজায় অংশ নিয়েছিল (আল-জাজিরা রিপোর্ট, ৬ জুলাই ২০১০)।
বর্তমান সময়ে মধ্যপ্রাচ্যের জটিল ভূরাজনীতিতে ইরান ও সৌদি আরবের প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে অনেকেই শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্ব হিসেবে চিহ্নিত করতে চাইলেও প্রকৃতপক্ষে এটি একটি আঞ্চলিক ক্ষমতার লড়াই। ড. ভ্যালি নাসর তার “The Shia Revival” (পৃষ্ঠা ১৫৬) গ্রন্থে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন যে, ইরাক যুদ্ধের পর থেকে এই বিভাজন কৃত্রিমভাবে বাড়ানো হয়েছে।
ইসলামের ইতিহাসের সোনালি অধ্যায়গুলো প্রমাণ করে যে, রাজনৈতিক প্রয়োজন ছাড়া শিয়া-সুন্নি সম্প্রদায় সাধারণত শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করেছে এবং উম্মাহর বৃহত্তর স্বার্থে একতাবদ্ধ থেকেছে। বর্তমানকালেও আসল সত্য হলো, মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে ইরান ও সৌদি আরবের দ্বন্দ্বের কারণেই মূলত সৌদিপন্থী আলেমরা বিশ্বব্যাপী শিয়াবিদ্বেষ প্রচার করে। বিশেষত ইস*রা*য়েল বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইরানের যে কোনো লড়াইয়ের সময় এই ধরনের অপপ্রচার বৃদ্ধি পায়।
“ইরানের সরকারটি কেমন”—এই আলোচনার আগে শিয়া-সুন্নি বিষয়ে এত আলোচনা করার কারণ হলো, ইরানসংক্রান্ত যে-কোনো আলোচনায় অনেকের একটা কমন টেনডেন্সি হলো বিষয়টাকে শুধুমাত্র শিয়া-সুন্নির দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা। সেই আলোচনায় ইরানের রাষ্ট্রীয় দর্শন, অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, পররাষ্ট্রনীতি, কূটনীতি, সামরিক নীতি, অর্থনীতি ও ভূ-রাজনীতি ইত্যাদির কোনো প্রাসঙ্গিকতা থাকে না। থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি লড়িবার শিয়া-সুন্নি!
বাস্তবতা হলো, ইরানের সরকারের কর্মকাণ্ড কোনোভাবেই শিয়া মতবাদকে প্রতিনিধিত্ব করে না, যেমন সৌদি রাজপরিবারের কর্মকাণ্ডও কোনোভাবেই সুন্নি মতবাদ বা ওহাবী মাযহাবকে প্রতিনিধিত্ব করে না। ইরানি সরকার বা সৌদি রাজপরিবার উভয়ই এক একটি রাজনৈতিক শক্তি। তারা প্রত্যেকে নিজেদের রাজনৈতিক চিন্তা, বৈদেশিক শক্তির প্রভাব, রাষ্ট্রক্ষমতা ধরে রাখার আকাঙ্ক্ষা ও আঞ্চলিক উচ্চাভিলাস দ্বারা পরিচালিত হয়। তাই শিয়া-সুন্নি, জাফরী-ওহাবী ইত্যাদি মতবাদ এড়িয়ে আসলে ফোকাস করা উচিত দেশগুলোর রাজনীতি, পররাষ্ট্রনীতি, কূটনীতি, সামরিক নীতি, অর্থনীতি ও ভূ-রাজনীতি ইত্যাদির হিসাব-নিকাশে। তবে ধর্মীয় আবেগ ও শিয়া-সুন্নি পরিচয়কে উভয় সরকারই তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যগুলো অর্জনের জন্য ব্যবহার করে।
১৯৭৯ সালের ইরানি বিপ্লবকে অনেকেই মধ্যপ্রাচ্যে একটি প্রকৃত ইসলামী সরকার প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা হিসেবে দেখেন। তবে বাস্তবতা হলো, এই বিপ্লবে অংশগ্রহণকারী গোষ্ঠীগুলোর সবাই ইসলামপন্থী ছিল না; বরং এতে কমিউনিস্ট, বুদ্ধিজীবী, বামপন্থী, ট্রেড ইউনিয়ন কর্মীসহ বিভিন্ন মতাদর্শের মানুষ অংশ নিয়েছিল, যাদের মূল লক্ষ্য ছিল মার্কিন-ব্রিটেনপন্থী বাদশাহ রেজা শাহের শাসনের অবসান ঘটানো। আয়াতুল্লাহ খোমেনি জনগণের কাছে “পরিবর্তন”-এর প্রতীক হিসেবে আবির্ভূত হন। তবে ক্ষমতায় আরোহণের পর ইসলামী নীতি বাস্তবায়নের চেয়ে রাজনৈতিক কর্তৃত্ব রক্ষাই তাঁর প্রধান অগ্রাধিকারে পরিণত হয়। খোমেনি ও তাঁর ঘনিষ্ঠ সমর্থকরা সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেন; অন্যদিকে বিপ্লব সংঘটনে সহায়তা করা অনেককেই পরবর্তীতে নির্বাসিত বা কারাবন্দি করেন। বিপ্লবের পর ইরানে একটি নতুন রাজনৈতিক ক্ষমতা-কাঠামো প্রতিষ্ঠিত হয়, যেখানে সর্বোচ্চ ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয় “সুপ্রিম লিডার”-এর হাতে। এই পদে এখন পর্যন্ত মাত্র দু’জন ব্যক্তি অধিষ্ঠিত হয়েছেন: প্রথমত আয়াতুল্লাহ খোমেনি (১৯৭৯-১৯৮৯) এবং পরবর্তীতে তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগী আয়াতুল্লাহ আলী খামেনেই (১৯৮৯-বর্তমান)।
ঐতিহাসিকভাবে ইরান মধ্যপ্রাচ্যে তার প্রভাব বিস্তারে সক্রিয় ছিল এবং বর্তমানেও এই নীতি অব্যাহত রেখেছে। ইরানের রাজনৈতিক নেতারা বারবার তাদের আঞ্চলিক পরাশক্তি হওয়ার আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেছে। সাবেক প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমাদিনেজাদ একবার বলেছিলেন, “আমরা দ্রুত একটি পরাশক্তিতে পরিণত হচ্ছি। আমাদের শক্তি সামরিক শক্তি বা অর্থনৈতিক সক্ষমতা থেকে আসে না, বরং মানুষের হৃদয় ও মননে প্রভাব বিস্তারের সামর্থ্য থেকে আসে – আর এটাই তাদের ভীত করে।” এই লক্ষ্য অর্জনে ইরান লেবাননের হিজবুল্লাহ, ফিলিস্তিনের হামাসের মতো সংগঠনগুলোকে সমর্থন দিয়েছে এবং সিরিয়ার জালিম বাশার আল-আসাদের আলাওয়ি শাসনকে সহায়তা করেছে।
ইরান তার আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী সৌদি আরবের মতোই প্রায়ই শিয়া-সুন্নি বিভেদকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। তারা নিজেদেরকে বৈশ্বিক শিয়া সম্প্রদায়ের রক্ষক হিসেবে দাবি করলেও বাস্তবে শুধুমাত্র সেই শিয়াদেরই সহায়তা করে যারা তাদের আঞ্চলিক লক্ষ্য অর্জনে সহায়ক। উদাহরণস্বরূপ, সৌদি আরবের পূর্বাঞ্চল (যেখানে অধিকাংশ শিয়া বসবাস করে এবং দেশের প্রধান তেলক্ষেত্রগুলো অবস্থিত) ও বাহরাইনে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির চেষ্টা করে ইরান। অন্যদিকে আজারবাইজান বা তাজিকিস্তানের শিয়াদের প্রতি ইরান কোনো সমর্থন দেখায় না, কারণ এগুলো তাদের কৌশলগত স্বার্থের বাইরে পড়ে।
#মার্কিন_যুক্তরাষ্ট্রের_সাথে_ইরানের_সম্পর্ক
আমেরিকার সাথে ইরানের আনুষ্ঠানিক সম্পর্কের সূচনা ১৮৫৬ সালে। ইরানের [তখন “পারস্য” নামে পরিচিত] তৎকালীন কাজার বংশীয় রাজা নাসের উদ্দিন শাহ কাজার ১৮৫৬ সালে ওয়াশিংটনে প্রথবারের মতো পারস্যের রাষ্ট্রদূত পাঠান। ঊনবিংশ শতাব্দীর ঔপনিবেশিকতার যুগে আফগানিস্তান ও ইরান অঞ্চলকে ঘিরে ব্রিটেন ও রাশিয়ার মধ্যে আধিপত্য বিস্তারের “গ্রেট গেইম” চলাকালে আমেরিকাকেই নিরাপদ মিত্র হিসেবে দেখেছিলেন ইরানের তৎকালীন রাজা নাসের উদ্দিন শাহ। কাজার বংশীয় শাহদের আমলে ইরানের সাথে আমেরিকার এতটাই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক হয় যে, পরবর্তীতে ১৯১১ সালে আমেরিকান সরকারের পরামর্শে আমেরিকান কর্মকর্তা উইলিয়াম শাসটারকে ইরানের ভঙ্গুর অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের জন্য ইরানের ট্রেজারার-জেনারেল হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। পরে আরেক আমেরিকান কর্মকর্তা আর্থার মিল্সপগকে ১৯২২-২৭ সালে ও ১৯৪২-৪৫ সালে দুই মেয়াদে একই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল!
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে পর্যন্ত আমেরিকা পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে নিরপেক্ষনীতি (Isolationism) কিংবা অন্তত অন্য দেশে হস্তক্ষেপ না-করার (Non-interventionism) নীতি অনুসরণ করতো। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ঔপনিবেশিকতার পতনের পর আমেরিকা অন্য দেশে হস্তক্ষেপ না-করার (Non-interventionism) নীতি ত্যাগ করে অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদ (Neo-colonialism) নীতি গ্রহণ করে এবং দেশে দেশে হস্তক্ষেপ শুরু করে। আমেরিকার সেই অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদী ক্ষুধার প্রথম বলি হয় দীর্ঘদিনের মিত্র ইরান।
১৯৫৩ সালে আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ ও ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা এমআইসিক্স মিলে এক অভ্যুত্থানে গণতান্ত্রিক ভোটে নির্বাচিত ইরানের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ মোসাদ্দেককে ক্ষমতাচ্যুত করে। প্রধানমন্ত্রী মোসাদ্দেকের “অপরাধ” ছিল তিনি ইরানি তেলক্ষেত্রগুলোতে ব্রিটিশ লুণ্ঠন বন্ধ করতে চেয়েছিলেন এবং ইরানি তেলক্ষেত্রগুলোকে জাতীয়করণ করেছিলেন।
মধ্যপ্রাচ্যের তেল সম্পদের অদম্য প্রেমে আমেরিকা-ব্রিটেনের সেই যুগলবন্দীই পরবর্তীতে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের ইতিহাসকে নতুন করে লিখতে শুরু করে। আমেরিকা আর ইরানের সম্পর্কও আমেরিকার সেই অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদ ও তেলপ্রেমের আঁচলে বাঁধা পড়ে।
ইরানের প্রধানমন্ত্রী মোসাদ্দেককে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে ইরানের বাদশা রেজা শাহ পাহলভীর হাতে দেশের সর্বময় ক্ষমতা প্রদান করে আমেরিকা-ব্রিটেন। স্বৈরশাসক রেজা শাহ পাহলভীকে ইরানের ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে শত শত কোটি ডলারের সাহায্য পাঠায় আমেরিকা। সিআইএ-র কর্মকর্তারা ইরানে গিয়ে পাহলভীকে গড়ে দেয় ইরানের নিষ্ঠুর নিপীড়নকারী গুপ্ত পুলিশ সংস্থা “সাভাক”।
ইতিহাসের পরিহাস হলো, আজকের রিপাবলিকান মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প হুঙ্কার দিচ্ছে ইরানকে কিছুতেই পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে দিবে না, অথচ ১৯৫০-এর দশকের রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট রিপাবলিকান আইজেনহাওয়ারই ১৯৫৭ সালে ইরানকে প্রথম পারমাণবিক চুল্লি তৈরিতে সহযোগিতা করে। আমেরিকাই ১৯৬৭ সালের পরে ইরানকে প্রথম অস্ত্র তৈরির উপযোগিতা সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম সরবরাহ করে। আমেরিকা-ব্রিটেনসহ পশ্চিমা শক্তির মিত্র পাহলভী যতদিন ক্ষমতায় ছিলেন, আমেরিকা-ইউরোপের সরকারগুলো ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে সর্বতোভাবে সহযোগিতা করে গেছে।
১৯৭৯ সালে আয়াতুল্লাহ খোমেনির নেতৃত্বে মার্কিন-ব্রিটেনপন্থী রেজা শাহ পাহলভীর পতন হলে তিনি সপরিবারে আমেরিকা পালিয়ে যান। [প্যাটার্নটি কি খুব পরিচিত মনে হচ্ছে? হ্যাঁ, রেজা শাহও পালিয়ে যাওয়ার আগে পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করার টাইম পাননি এবং রেজা শাহের উজবুক পুত্রটিও আমেরিকাতেই বসবাস করে।
]
ইরানে বিপ্লবের পর ইরাকের তৎকালীন মার্কিনপন্থী প্রেসিডেন্ট সাদ্দামকে দিয়ে ইরানের সাথে যুদ্ধ বাঁধায় আমেরিকা। ১৯৮০ থেকে শুরু হওয়া সেই যুদ্ধে ইরাককে সার্বিক সহযোগিতা করে আমেরিকা। ১৯৮৮ সালে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় দুই পক্ষের মধ্যে যুদ্ধবিরতি হয়। ১৯৯৫ সালে ক্লিনটন প্রশাসন ইরানের ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ চাপিয়ে দেয়।
ইরানের বিপ্লবের পর থেকে এখন পর্যন্ত আমেরিকার সাথে ইরানের কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়নি। আমেরিকার সাথে ইরানের অফিসিয়াল যোগাযোগ হয় পাকিস্তানের মাধ্যমে। ওয়াশিংটনের পাকিস্তান দূতাবাসের “ইরানিয়ান ইন্টারেস্টস সেকশন” ইরানের পক্ষ থেকে আমেরিকার সাথে যোগাযোগ করে। আমেরিকার পক্ষে দূতিয়ালি করে সুইজারল্যান্ড। তেহরানের সুইস দূতাবাসের “ইউএস ইন্টারেস্টস সেকশন” আমেরিকার পক্ষে ইরানের সাথে যোগাযোগ সারে।
তবে এটা মুদ্রার একপিঠের বয়ান। মুদ্রার অপর পিঠ হলো, ইরান যতই আমেরিকাকে “বড় শয়তান” আখ্যা দিয়ে তীব্র সমালোচনা করুক না কেন, বাস্তবে বেশ কিছু কৌশলগত ইস্যুতে দুটি দেশ একসাথে কাজ করে। ১৯৮৩ সালে ইরানের সরকারের বিভিন্ন স্তরে ইরানের সোভিয়েতপন্থী কমিউনিস্ট সংগঠন “তুদেহ পার্টি”-এর লোকজনের ব্যাপক অনুপ্রবেশের কথা আমেরিকাই জানিয়েছিল আয়াতুল্লাহ খোমেনির সরকারকে। আমেরিকার দেওয়া সেই তথ্য ব্যবহার করে খোমেনির সরকার তখন ইরানে কমিউনিস্ট প্রভাব নির্মূল করে।
১৯৮০-এর দশকে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যানের প্রশাসন গোপনে ইরানের কাছে অস্ত্র বিক্রি শুরু করে এবং নিকারাগুয়ার বামপন্থী সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে ইরানের মাধ্যমেই নিকারাগুয়ার ডানপন্থী কন্ট্রা বিদ্রোহীদের কাছে সাহায্য পাঠায়।
নাইন-ইলেভেনের পর আফগানিস্তানের তালিবান সরকারকে উৎখাতের ক্ষেত্রে আমেরিকাকে সহযোগিতা করে ইরান। অনুরূপভাবে, ইরাকের সাদ্দাম সরকারকে উৎখাতেও ইরান সহযোগিতা করে আমেরিকাকে, বিশেষত ইরাকের শিয়া বিদ্রোহী দলগুলোকে আমেরিকার প্রতি নমনীয় করে ইরান।
ইরানি সরকার গত ১৫ বছর ধরে তার সমস্ত সামর্থ্য – অর্থনীতি, সশস্ত্র বাহিনী, রেভোলিউশনারি গার্ড, কুদস ফোর্স এবং হি*জবু*ল্লাহ প্রোক্সি – কাজে লাগিয়ে পশ্চিমা দালাল বাশার আল-আসাদ ও তার শাসনব্যবস্থাকে রক্ষা করেছে। কিন্তু ইস*রায়ে*লকে মোকাবেলা করার জন্য কখনোই নিজস্ব সামরিক ঘাঁটি স্থাপন বা ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা মোতায়েন করেনি। ফিলিস্তিনের জনগণের উপর ইস*রায়ে*লি হামলার সময় ইরান নিষ্ক্রিয় দর্শকের ভূমিকায় ছিল। হিজ*বুল্লা*হকে ইস*রায়ে*ল-বিরোধী কোনো পদক্ষেপ নিতে ইরান নির্দেশ দেয়নি। বরং সিরিয়ার মুসলিমদেরকে ইরান হ*ত্যা ও নির্যাতন করেছে শুধু পশ্চিমাপন্থী বাশারের শাসন টিকিয়ে রাখতে। আমেরিকা যখন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের মাধ্যমে সিরিয়ায় বাশারকে সরিয়ে নতুন “জি*হা*দি*স্ট” (
) দালাল ক্ষমতায় আনল, ইরান নিশ্চিন্তে তার সেনা ফিরিয়ে নিল।
ইস*রায়ে*ল বছরের পর বছর ইরানি নেতাদের হত্যা করেছে, কিন্তু ইরান কখনোই মর্যাদা রক্ষার মতো জবাব দিতে পারেনি। ইরাক যুদ্ধের সময় গড়ে তোলা সামরিক শক্তি এবং সিরিয়ায় অর্জিত অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও ইরানের প্রতিক্রিয়া খুবই সামান্য। সম্প্রতি ইস*রায়ে*লি হামলায় ৬১০ ইরানি নিহত ও ৪,৭৪৬ আহত হয়েছে। অন্যদিকে ইস*রায়ে*লি মরেছে খুবই কম সংখ্যক।
ট্রাম্প যেভাবে ইস*রায়ে*লকে দিয়ে এই যুদ্ধ শুরু করিয়েছিল, সেভাবেই যুদ্ধবিরতিও ঘোষণা করেছে। ইরান ও ইস*রায়ে*ল দু’পক্ষই এই প্রস্তাবে সম্মত হয়েছে। ট্রাম্প বলেছে, “ইরানের পরমাণু স্থাপনা সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়েছে” এবং “ইরান কখনোই তার পরমাণু কর্মসূচি পুনর্নির্মাণ করতে পারবে না”।
বাস্তবে ইরানি সরকারটিও আমেরিকাকে সন্তুষ্ট করতে সচেষ্ট। আফগানিস্তান, ইরাক, ফিলিস্তিন, সিরিয়া সবখানে ইরানি সরকারের একই ভূমিকা। কিন্তু আমেরিকা যখন দেখেছে ইরান তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাচ্ছে, তখনই সামরিক চাপ প্রয়োগ করেছে।
এবারের যুদ্ধবিরতির পর আমেরিকা ইরানকে ৩০ বিলিয়ন ডলার দেওয়ার প্রস্তাব করেছে শুধু শান্তিপূর্ণ পরমাণু কর্মসূচির জন্য। শর্ত একটাই—ইরানকে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ সম্পূর্ণ বন্ধ করতে হবে। অবশ্য আন্তর্জাতিক পরমাণু সংস্থা (IAEA) এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের তথ্য অনুযায়ী, ইরান ইতোমধ্যে ৪০০ কেজির বেশি ৬০% সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম মজুদ করেছে। এই মাত্রার ইউরেনিয়াম সামরিক ব্যবহারের জন্য খুবই বিপজ্জনক। কারণ এখান থেকে ৯০% weapon-grade পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া প্রযুক্তিগতভাবে খুব বেশি সময়সাপেক্ষ নয়—কয়েক মাসের মধ্যেই সম্ভব।
তবে সাম্প্রতিক ইস*রায়ে*ল-ইরান সংঘর্ষ এবং সামরিক হামলার ফলে এই enrichment‑এর কাজ ১-২ বছরের মতো হয়ত বিলম্বিত হবে। কিন্তু এই বিলম্ব ইরানি পারমাণবিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা থামিয়ে রাখতে পারবে না। কেননা ইরানের সরকারটি মধ্যপ্রাচ্যের রিজিওনাল পাওয়ার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে উদ্গ্রীব। তাই ইরান নতুন করে enrichment কেন্দ্র চালু করছে এবং ৬০% পর্যায়ের ইউরেনিয়াম উৎপাদন চালিয়ে যাচ্ছে।
বর্তমান ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা ইঙ্গিত দিচ্ছে, ২০২৬-২০২৭ সালের মধ্যে ইরান তাদের পারমাণবিক কর্মসূচিতে আরও বড় অগ্রগতি অর্জন করবে। বিশেষ করে, weapon-grade ইউরেনিয়াম মজুদে উল্লেখযোগ্য সাফল্য আসতে পারে। এছাড়া ২০২৭-২০২৯ সময়ের মধ্যে ইরান অন্তত ১-২টি কার্যকর পারমাণবিক ডিভাইস তৈরির সক্ষমতা অর্জন করতে পারবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। যদিও তারা তা প্রকাশ্যে ঘোষণা করবে না, তবে সামরিক ও কূটনৈতিক মহলে এই তথ্য স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
অবশ্য অভ্যন্তরীণভাবে ইরানি সরকার নানাবিধ সংকটে জর্জরিত। দেশের অর্থনৈতিক সম্পদের বড় অংশ নিয়ন্ত্রণ করে ইসলামিক রেভোলিউশনারি গার্ডস কর্পস (IRGC) এবং ধর্মীয় নেতাদের পরিবারবর্গ। সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান ক্রমাগত অবনতির দিকে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, মদ্যপানের হার বিবেচনায় ইরান বিশ্বে ১৯তম স্থানে রয়েছে, যেখানে রাশিয়া ৩০তম এবং সৌদি আরব ১৮৪তম অবস্থানে আছে। ইরানে মাদকাসক্তির হারও বিশ্বে সর্বোচ্চ পর্যায়ে। দেশের তেল ও গ্যাস অবকাঠামোর বেশিরভাগই শত বছরের পুরনো এবং আধুনিকায়নের অভাবে জরাজীর্ণ। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো ইরানের ৮০% এরও বেশি জনসংখ্যার বয়স ৩৫ বছরের নিচে, যারা ১৯৭৯ সালের বিপ্লব প্রত্যক্ষ করেনি, কিন্তু দেশ শাসন করছে ৬০/৭০ বছর ঊর্ধ্ব একদল ধর্মীয় নেতা। এই প্রজন্মগত বিভাজন আগামী ২/৩ বছরে ইরানে আরও ব্যাপক গণঅসন্তোষের জন্ম দিতে পারে। মদত দেওয়ার জন্য মার্কিন-ইস*রায়ে*ল তো থাকছেই!
~~~~~~~~~~~~
[আল্লাহর ইচ্ছা ও সাহায্যে সমাপ্ত, আলহামদুলিল্লাহ]
আকীদা, আয়াতুল্লাহ, ইরান, কেমন, নাসিবী, বিপ্লব, মধ্যপ্রাচ্য, যুক্তরাষ্ট্র, রাফিজী, শিয়া, সম্পর্ক, সরকার, সুন্নী, হিজবুল্লাহআল্লাহ হচ্ছে সেই সত্য যার অস্তিত্বকে উপলব্ধি করা যায় এবং এটি মস্তিস্কপ্রসুত কোনো ধারণা না
অনেক মানুষই বিশেষ করে পশ্চিমা বিশ্বে আল্লাহর প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস রাখে, কিন্তু তাদের দৃঢ় বিশ্বাস এ ভিত্তি থেকে যে আল্লাহ (শুধুমাত্র) একটি চিন্তা, (সর্বজনীন) সত্য না।
এধরনের ব্যক্তিগণ কোনো সৃষ্টিকর্তার উপর বিশ্বাসকে কোনো উপাস্যের উপর বিশ্বাসের মতোই মনে করে; তারা বলে, এটি একটি সুন্দর চিন্তা। এটি এ জন্য, যতক্ষন মানুষ এটি কল্পনা করবে, এতে বিশ্বাস করবে এবং এর শক্তির কাছে সমর্পণ করবে, ততক্ষন সে এ ধারণার উদ্দীপনায় মন্দ হতে নিজেকে দুরে রাখবে এবং কল্যাণে নিকটবর্তী হবে। তাই এটি একটি অন্তর্নিহিত নিরোধক যা বাহ্যিক নিরোধক হতে বেশি প্রভাব রাখে। তাই তারা সমর্থন করে যে মানুষের অবশ্যই আল্লাহতে বিশ্বাস করা উচিত এবং তারা এই বিশ্বাসে উৎসাহ প্রদান গুরুত্বপূর্ণ মনে করে যাতে মানুষ সৎকর্মপরায়ণ ও উদ্ধুদ্ধ থাকে, যাকে তারা ‘ধর্মীয় বাঁধা’ (الوازع الديني) বলে থাকে!!
এ ধরণের ব্যক্তিদের খুব সহজেই নাস্তিকতার দিকে টানা যায়, এবং ধর্মত্যাগের কাছাকাছি নিয়ে যাওয়া যায় যখন তাদের মানসিকতা এধরনের ধারণার অস্তিত্ব নিয়ে চিন্তা-ভাবনায় নিপতিত হয়। যদি মানুষ এই উপস্থিতিকে অনুভব না করে এবং এ উপস্থিতির প্রভাবকে উপলব্ধি না করে তাহলে সে একজন উপাস্যের অস্তিত্বকে অস্বীকার করবে এবং ফলে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলাকে অবিশ্বাস করবে। উপরন্তু, আল্লাহ একটি চিন্তা মাত্র, কোনো সত্য নয়, এটি বিশ্বাস করার মাধ্যমে কল্যাণ (goodness)ও একটি সত্যহীন চিন্তায় পরিণত হয়, একইভাবে মন্দ (evil)ও একটি সত্যহীন চিন্তায় পরিণত হয়। এই ধরণের বিশ্বাস (ঈমান) এই লোকদের এই কারণেই তৈরি হয়েছিল যে তারা আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস (ঈমান) অর্জনের জন্য বুদ্ধিবৃত্তি (‘আকল) ব্যবহার করেনি, এবং, মানব, জীবন ও মহাবিশ্ব সম্পর্কে সহজাত প্রশ্ন, (তথা) পার্থিব জীবনের পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী জীবন সম্পর্কে, এবং এর পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী জীবনের সাথে এর সম্পর্কের ব্যপারে সহজাত প্রশ্নগুলোর ফলে উদ্ভূত বড় সমস্যাটির বুদ্ধিবৃত্তিক সমাধানের জন্যও তাদের পরিচালিত করা হয়নি।
বরং তাদের শিক্ষকের ইচ্ছানুযায়ী সমাধানটি তাদের শেখানো হয়েছিল, তাই তারা এই সমাধানটি গ্রহণ করেছিল এবং তারা যা বিশ্বাস করত তার অস্তিত্ব সম্পর্কে প্রকৃত ধারণা না পেয়েই এতে বিশ্বাস করতে থাকে। তাদের অনেকেই তাদের মন ব্যবহার করার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু তাদের উত্তর দেওয়া হয়েছিল যে ধর্ম মনের বাইরে এবং (তাদের) নীরব থাকতে বাধ্য করা হয়েছিল।
সঠিক কথা হলো, আল্লাহ তাআলা একটি সত্য, কোন ধারণা নয়; এবং তাঁর অস্তিত্ব (চিন্তা করে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে) স্পর্শ করা যায় এবং বোঝা যায়, যদিও তাঁর (সুবহানাহু ওয়া তা’আলার) স্বরূপ উপলব্ধি করা অসম্ভব। তুমি কি দেখতে পাও না যে মানুষ তার ঘরের ভেতরে বসে আকাশে বিমানের শব্দ না দেখেও শুনতে পারে?
তবে, সে শব্দ শুনে এর অস্তিত্ব উপলব্ধি করে, যদিও সে এটি দেখেনি এবং এর স্বরূপ অনুভব করেনি। তাই সে শব্দ শুনে আকাশে একটি বিমানের উপস্থিতিতে বিশ্বাস করে। অন্যকথায়, সে নিশ্চিতভাবে এবং সন্দেহাতীতভাবে, বিমানের অস্তিত্বে বিশ্বাস করে। সুতরাং, বিমানের অস্তিত্ব উপলব্ধি করা তার স্বরূপ বোঝার চেয়ে আলাদা বিষয়। এর স্বরূপ বোঝা যায়না কারণ স্বরূপ ইন্দ্রিয় কর্তৃক অনুভূত হয়নি; অন্যদিকে এর অস্তিত্বের উপলব্ধি তার শব্দের অনুভূতি থেকে নিশ্চিত। সুতরাং, বিমানের অস্তিত্ব একটি সত্য এবং (নিছক) কোনো ধারণা নয়।
বোধগম্য এবং অনুভূত জিনিসের ক্ষেত্রেও এটিই প্রযোজ্য। তাদের অস্তিত্ব নিশ্চিত কারণ তাদের পর্যবেক্ষন করা যায় এবং তারা অনুভূত। তাদের ব্যতীত অন্য কিছুর উপর তাদের নির্ভরশীলতাও নিশ্চিত, কারণ এটি পর্যবেক্ষণ করা যায় এবং অনুভূত। আকাশের নক্ষত্রগুলোর ব্যবস্থার প্রয়োজন; এবং যারা কোনো কিছু পোড়াতে চায় তার জন্য তাদের আগুনের প্রয়োজন। প্রতিটি বোধগম্য এবং অনুভূত জিনিসের ক্ষেত্রে এটিই হয় কারণ সে নিজের নয়, অন্যের প্রয়োজন। নির্ভরশীল জিনিস চিরন্তন হতে পারে না, কারণ যদি এটি চিরন্তন হত তবে এটি নিজের ছাড়া অন্যের প্রয়োজন হত না। এটি নির্ভরশীল হওয়ার অর্থ হল এটি চিরন্তন নয়।
অতএব, সমস্ত বোধগম্য এবং ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জিনিসের সৃষ্টির বিষয়টি নিশ্চিত। কারণ যা চিরন্তন (আজালি) নয় তার অর্থ হল এটি একজন স্রষ্টার দ্বারা সৃষ্ট। এই সৃষ্ট জিনিসগুলোর সংবেদন, সেইসাথে প্লেনের শব্দের সংবেদনও নিশ্চিত। একইভাবে, এই সৃষ্ট জিনিসগুলোর (বস্তুর) স্রষ্টার অস্তিত্ব, যেখান থেকে তারা আসে, সেই প্লেনের অস্তিত্বের মতোই যেখান থেকে শব্দ এসেছে; যা একটি সুনিশ্চিত বিষয়। সুতরাং, এই সৃষ্ট বস্তুগুলোর স্রষ্টার অস্তিত্ব একটি সুনিশ্চিত বিষয়। অতএব, মানুষ তার সংবেদন এবং চিন্তার মাধ্যমে সৃষ্ট জিনিসগুলো (বস্তুকে) উপলব্ধি করেছে; এবং সে তাদের অনুভূতি থেকে তাদের স্রষ্টার অস্তিত্বকে স্পষ্টভাবে উপলব্ধি করেছে। সুতরাং, স্রষ্টার অস্তিত্ব এমন এক সত্য যা সংবেদনের মাধ্যমে মানুষ তার অস্তিত্বকে ধরতে পেরেছে; এবং এটি নিছক কোনো ধারণা নয় যা মানুষ তার মনে কল্পনা করেছে।
Taken from the Book “Islamic Thought”
পপুলিস্ট দাওয়াহ ইসলামী পুনর্জাগরণের পথকে বাধাগ্রস্থ করে তোলে
সোশ্যাল মিডিয়ার আজ সবার জন্য জনপ্রিয় হবার দ্বার উন্মুক্ত করে দিয়েছে। আজকের যুগে যেন একটাই মন্ত্র: “জনপ্রিয়তা মানেই টাকা”। যত বেশি সাবস্ক্রাইবার বা ফলোয়ার তত বেশি সফলতা—এই ধারণা আজকের প্রজন্মের স্বপ্ন হয়ে উঠেছে। আজকের তথ্য-প্রযুক্তি নির্ভর যুগে, পপ কালচার দর্শনীয় ও মোহময় উদ্দীপনার মাধ্যমে চিত্রসংস্কৃতি ও রুচিসংস্কৃতি গঠনে বড় ভূমিকা রাখছে।
ধূসর শক্তি (Gray Power)
গত এক দশকে সোশ্যাল মিডিয়ার নতুন এক প্রভাবশালী শক্তি উঠে এসেছে— সেলেবগ্রাম বা ইউটিউবারদের মতো ইনফ্লুয়েন্সাররা, যারা ধূসর সম্প্রদায় ও তথাকথিত ‘সংবেদনশীলদের’ প্রতিনিধিত্ব করে, এবং মূলত পুঁজিবাদী শক্তির প্রতিনিধি হয়ে কাজ করে। যদিও এটা নতুন কিছু নয়, তথাপি ডিজিটালাইজেশনের যুগে এই ধূসর নৈতিক শক্তি (gray moral force) আরও পরিপক্ব হচ্ছে।
স্নায়ুযুদ্ধ (cold war) পরবর্তী যুগে, এই শক্তিকে ইচ্ছাকৃতভাবে পুঁজিবাদের বিশ্বায়নের সাথে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, যাতে করে টার্গেট করা বাজারদেশগুলোতে পুরাতন নৈতিক মূল্যবোধকে প্রশমিত করা যায়। বিশেষ করে যখন যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক বাণিজ্য জগতে এগিয়ে চলেছে, তখন তাদের পশ্চিমা নৈতিক মূল্যবোধ বিশ্বব্যাপী গ্রহণযোগ্য করে তোলা আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। যেমন দার্শনিক আয়ন র্যান্ড বলেছেন:
“The cult of moral grayness is a revolt against moral values.” অর্থাৎ, ধূসর নৈতিকতা আসলে নৈতিকতার বিরুদ্ধেই এক বিদ্রোহ।
এর ক্রমাগত রূপান্তরের মধ্যে, যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক শক্তি ২০শ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে সঙ্গীত ও চলচ্চিত্রের মাধ্যমে জনপ্রিয় সংস্কৃতি তৈরি করতে সফল হয়েছে; যা এশিয়ায় বিস্তার লাভ করেছে এবং এখন কোরিয়া তার K-POP জোয়ারের মাধ্যমে সেই ধারাবাহিকতা বজায় রাখছে। যেমনটি দেখা যাচ্ছে, চলচ্চিত্র ও শিল্প ধীরে ধীরে নৈতিকতার সাদা-কালো বিভাজন থেকে ইচ্ছাকৃতভাবে সরে আসছে, তেমনি করে সেগুলো ক্রমশ আরও বেশি ধূসর ছায়ায় বা অস্পষ্টতায় পরিণত হচ্ছে। এই মূল্যবোধগুলিকে অস্পষ্ট করার লক্ষ্য হল এগুলিকে বিশ্ববাজারে গ্রহণযোগ্য করে তোলা।
অবশেষে জনপ্রিয়তা হয়ে ওঠে নতুন এক নৈতিক মানদণ্ড, যা উদ্ভূত হয়েছে সেকুলার সাংস্কৃতিক শিল্পের হাত ধরে। পপ সংস্কৃতি যেকোনো বিষয়ের গুণগত মান ও নৈতিকতা উপেক্ষা করে শুধুমাত্র সংখ্যার ভিত্তিতে ‘চিত্র’ ও ‘রুচি’র জনপ্রিয়তাকেই গুরুত্ব দেয়। বিজ্ঞাপনগুলো এই দর্শনীয় ভিজ্যুয়াল স্টাইলের মাধ্যমে বাজারকে প্রভাবিত করে এবং ধূসর শক্তিকে (Gray Power) লালন-পালন করে। সীমাহীন সৃজনশীলতা’ স্লোগানকে ভিত্তি করে আদর্শিক বিবেচনায় দুর্বল কিছু শিল্পী ও নির্মাতাদের মধ্যে শিল্প ও সৃজনশীলতার অপব্যবহারকে উৎসাহিত করা হয়।
জনপ্রিয় সংস্কৃতিতে হিজরাহ কমিউনিটি:
সমস্যাটি হলো, এই জনপ্রিয় সংস্কৃতি শুধু সাধারণ মানুষকেই প্রভাবিত করে না, বরং তা মুসলিম সমাজের সেই অংশকেও প্রভাবিত করে যারা ইতোমধ্যে পরিবর্তনের প্রতি সচেতন – awareness to change (hijrah), যাদেরকে ইন্দোনেশিয়ায় ‘হিজরাহ কমিউনিটি’ বলা হয়ে থাকে। ইসলামী দাওয়াত ও জনপ্রিয় সংস্কৃতির এই সম্মিলন মুসলিম তরুণদের মধ্যে একটি ইসলামী পপুলিজম (জনপ্রিয়তাবাদ) তৈরি করেছে।
এর ফলে হিজরাহ কর্মীরা জনপ্রিয়তার প্রভাব (popularity syndrome) থেকে মুক্ত থাকতে পারেন না। এমনকি তারা ধূসর মনোভাব (graying attitudes) থেকেও নিরাপদ নয়। দাওয়াহ সফল কিনা—তা এখন পরিমাপ করা হয় ফলোয়ার সংখ্যা এবং কনটেন্ট ভাইরাল হওয়ার উপর, ইসলামী শিক্ষার গুণমান ও পদ্ধতির উপর নয়, যা নবী ﷺ এর উত্তরাধিকার অনুযায়ী হওয়া উচিত। এর ফলস্বরূপ, দাওয়াহ আজ জনপ্রিয়তার সংকট দ্বারা প্রভাবিত। অনেক আলেম, দাঈ, এবং ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি এই স্রোতে ভেসে যাচ্ছেন। তারা দাওয়াহকে সৃজনশীল শিল্পে রূপ দিয়েছেন এবং নিজেরাই হারিয়ে যাচ্ছেন ধূসর সংস্কৃতির প্রবাহে আড়ালে (gray wave)।
আবু ইসহাক আশ-শাতিবী (রহিমাহুল্লাহ) বলেছেন:
“الصالحين من قلوب الناس آخر ما يخرج: حب السلطة وحب الظهور”
“নেককারদের অন্তর থেকে নেতৃত্বপ্রেম ও পরিচিতির ভালোবাসা শেষ পর্যন্ত যায় না, তা কেবল মৃত্যুর সময়ই দূর হয়।” যারা হিজরাহ করে (পরিবর্তনের প্রতি সচেতন হয়েছে) হঠাৎ করে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, তাদের ঘটনা আমাদের জন্য শিক্ষা। দাওয়াহর প্রভাব ছড়ানোর বদলে তারা ধূসর মনোভাবকে জোরদার করে তোলে, যা পশ্চিমা ধারণা ‘religious moderation’-এর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ—এটি ইসলামী পরিচয়কে দুর্বল ও অস্পষ্ট করার একটি বৈশ্বিক পরিকল্পনা।
Wunderman Thompson Intelligence কর্তৃক মালয়েশিয়ার Muslim Intel Lab-এর সহযোগিতায় প্রকাশিত “The New Muslim Consumer” শীর্ষক একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ২৫ কোটি মুসলমানের মধ্যে আজকের প্রজন্ম তাদের পিতামাতার তুলনায় একেবারে ভিন্নধর্মী জীবন যাপন করছে। এই পরিবর্তনের পেছনে দুটি বিশাল প্রভাব কাজ করেছে: একটি হলো ধর্মীয় চেতনার পুনরুজ্জীবন (আস্তিকতা/ধর্মপরায়ণতা) এবং অপরটি হলো পশ্চিমা ধাঁচের ভোক্তাবাদ বা ভোগবাদের প্রসার।
এই প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে যে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মুসলিম তরুণদের মধ্যে ইসলাম এখন একটি জনপ্রিয় জীবনধারা হয়ে উঠেছে, যদিও তা মূলত বাহ্যিক এবং ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের মধ্যে সীমাবদ্ধ। তাদের ধর্মপরায়ণতা তাদেরকে পশ্চিমা বা কোরিয়ান বিনোদন সামগ্রী ভোগ করা থেকে বিরত রাখতে পারেনি।
যেমন “হিজরাহ কে-পপার” নামক একটি প্রবণতা, যেখানে একদিকে তারা ধার্মিক মুসলিম হওয়ার দাবি রাখে, কিন্তু অন্যদিকে তারা কোরিয়ান বিনোদনের ভোক্তা হিসেবেও থাকতে চায়। এই দ্ব্যর্থতা (ambiguity) এক ধরনের ধূসর মনোভাবের (gray attitude) জন্ম দেয়, যা তাদের জন্য পুঁজিবাদীদের ‘বাজার হিসেবে উপনিবেশিত’ করা সহজ করে তোলে—যাতে তারা ধর্মনিরপেক্ষ জীবনধারার পণ্যের চিরন্তন ভোক্তায় পরিণত হয়।
অন্যদিকে, জনপ্রিয় সংস্কৃতির প্রবণতা হলো—ইসলামের বার্তাকে এমনভাবে হালকা করে উপস্থাপন করা, যাতে তা সাধারণ মানুষের কাছে সহজে গ্রহণযোগ্য হয়। উদাহরণস্বরূপ, যদি আমরা কোনো বইয়ের দোকানে যাই, তাহলে দেখতে পাবো যে “হিজরাহ” শব্দটি লেখা এক সারি বই সহজেই বেস্টসেলার শেলফে প্রদর্শিত হচ্ছে। ধর্মীয় বইগুলো সাধারণত যেভাবে গম্ভীর ও আনুষ্ঠানিকভাবে লেখা হয়, তার বিপরীতে জনপ্রিয় হিজরাহ বইগুলোতে পপ-স্টাইলের প্রচ্ছদ থাকে, যেগুলো টিনএজ প্রেমের গল্প বা কমিক বইয়ের মতো চিত্রায়নে সাজানো হয় এবং ভাষাও হয় হালকা ও স্বচ্ছন্দ। একই রকম অবস্থা সোশ্যাল মিডিয়াতেও দেখা যায়। উদাহরণস্বরূপ, যখন আমরা ইনস্টাগ্রামে #hijrah হ্যাশট্যাগটি টাইপ করি, তখন প্রায় ৭ কোটি পোস্ট দেখা যায় যেগুলো হিজরাহ বিষয়ে আলোচনা করে এবং সেগুলোতে আকর্ষণীয় গ্রাফিক ডিজাইন ও হালকা ভাষার ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়।
জনপ্রিয় সংস্কৃতি ও ইসলামী দাওয়াহ—এই দুটি ধারা যখন মুসলিম যুবসমাজের মধ্যে মিলিত হয়, তখন তা সবসময় নেতিবাচক হয় না। বরং এই ঘটনাটি আসলে দুটি সংস্কৃতির মধ্যকার মতাদর্শিক দ্বন্দ্ব (সিরা‘উল ফিকর- صراع الفكر) বা চিন্তার সংঘর্ষকে প্রকাশ করে। তাই, এই পরিস্থিতির মোকাবিলা করার জন্য আমাদের প্রয়োজন এমন দাওয়াহকারীদের (প্রজ্ঞাবান দাঈদের), যারা আদর্শিকভাবে পরিপক্ব এবং মূল্যবোধ ও পরিচয়সংক্রান্ত এই ধরনের টানাপোড়েনে সচেতন। যাতে করে ইসলামই অন্য সংস্কৃতির রঙে রঞ্জিত হয়ে না যায়, বরং ইসলামী আদর্শই সমাজকে রঞ্জিত করে এবং তা সমাজে বৃহৎ পরিবর্তন আনতে পারে।
জনপ্রিয় সংস্কৃতির পরিপ্রেক্ষিতে ইসলামী দাওয়াহ পরিচালনায় সক্ষম দাওয়াহ কর্মীদের যোগ্যতা হলো—তাদের মধ্যে একটি শক্তিশালী চিন্তাগত সংবেদনশীলতা থাকতে হবে, যেন তারা ধর্মনিরপেক্ষ ও ইসলামী মূল্যবোধের পার্থক্য স্পষ্টভাবে উপলব্ধি করতে পারেন; একইসাথে জনপ্রিয় শৈলী (popular styles) ব্যবহার করে সৃজনশীল পদ্ধতি ও উপকরণের ব্যবহারে যেন কোনো ঘাটতি না থাকে। তদুপরি, দাওয়াহ কর্মীদের সবসময় স্মরণ রাখতে হবে যে, দাওয়াহর সফলতার মানদণ্ড কোনো জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব কিংবা দাওয়াহর গণগ্রহণযোগ্যতা বা মানুষের প্রশংসা নয়, বরং তা নির্ভর করে শরীয়াহর মানদণ্ড ও মূল উদ্দেশ্যের ওপর—যা হক ও বাতিলের মাঝে পার্থক্য নির্ধারণ করে। দাওয়াহ কর্মীদের উচিত ইসলাম নির্ধারিত পদ্ধতিতে প্রকৃত পরিবর্তনের পথ অবলম্বন করা, অস্পষ্টতা ও দ্ব্যর্থতা (ambiguity) পরিহার করা এবং দাওয়াহতে ধূসর মনোভাব (gray attitude) থেকে সম্পূর্ণরূপে বিরত থাকা। যেমন রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন:
«إن الحلال بيّن، وإن الحرام بيّن، وبينهما أمور مشتبهات لا يعلمهن كثير من الناس؛ فمن اتقى الشبهات فقد استبرأ لدينه وعرضه، ومن وقع في الشبهات فقد وقع في الحرام»
নিশ্চয়ই হালাল স্পষ্ট এবং হারামও স্পষ্ট। আর এদের মাঝে কিছু বিষয় আছে যা সন্দেহজনক, যা অধিকাংশ মানুষ জানে না। তাই যে ব্যক্তি সন্দেহজনক বিষয় এড়িয়ে চলে, সে তার দ্বীন ও সম্মানকে রক্ষা করে। আর যে সন্দেহজনক বিষয়ে লিপ্ত হয়, সে হারামের মধ্যেই পড়ে যায়।” (বুখারী ও মুসলিম)
কায়েস আবু মুহাম্মদ কর্তৃক অনুবাদকৃত
ইরানের উপর পরিকল্পিত হামলা – কারণ ও প্রেক্ষাপট
বিশ্বাসঘাতকতা, ভুল হিসাব, অথবা কৌশলগত কারণেই হোক না কেন, ফলাফল অনস্বীকার্য: ১৩ জুন ইরানের সামরিক ও পারমাণবিক অবকাঠামোর উপর ইসরায়েলের ভোরবেলা আক্রমণ তেহরানের জন্য কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় নিরাপত্তার উপর আঘাত। কয়েক ঘন্টা ধরে চালানো এই হামলায় ইরানের সামরিক উচ্চ কমান্ড এবং শীর্ষ পরমাণু বিজ্ঞানীদের একাংশ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
নিহতদের মধ্যে ছিলেন ইসলামিক রেভোলিউশনারি গার্ড কর্পস (আইআরজিসি) এর কমান্ডার-ইন-চিফ মেজর জেনারেল হোসেইন সালামি; সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান মেজর জেনারেল মোহাম্মদ বাঘেরি; ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন কৌশলের স্থপতি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আমির আলী হাজিজাদেহ; এবং কুদস বাহিনীর কমান্ডার জেনারেল ইসমাইল কানি। এছাড়াও নিহত হয়েছেন সর্বোচ্চ নেতার একজন সিনিয়র উপদেষ্টা অ্যাডমিরাল আলী শামখানি এবং পারমাণবিক শক্তি সংস্থার প্রাক্তন প্রধান ফেরেয়দুন আব্বাসি দাভানি সহ পারমাণবিক বিশেষজ্ঞদের একটি দল এবং ইরানের প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়গুলির বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট পারমাণবিক পদার্থবিদ।
ইসরায়েলি অভিযানের মাত্রা এবং নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত অর্থাৎ একাধিক সামরিক ও পারমাণবিক স্থাপনায় আঘাত হানা, ইরানসহ বিশ্বের অনেককেই দৃশ্যত অস্থির করে তুলেছে। তেহরান এবং ইসফাহান থেকে প্রচারিত ভিডিওগুলোতে বিমান প্রতিরক্ষা তৎপরতার স্পষ্ট অভাব দেখা যাচ্ছে – আক্রমণের তীব্রতা সত্ত্বেও ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র বা কামানের কোনও উৎক্ষেপণ হয়নি। ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষায় প্রচুর বিনিয়োগকারী একটি দেশের জন্য, আকাশ প্রতিরক্ষার এই দুর্বল রূপ ছিল দুঃর্ভাগ্যজনক।
এই হামলার তালিকাটি পরিস্কারভাবে ইরানের সামরিক-শিল্প কমপ্লেক্সের নীলনকশাকে সামনে রেখে আক্রমনের একটি প্রয়াস। লক্ষ্যবস্তুর মধ্যে ছিল নাতানজে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ স্থাপনা, ইসফাহান ও খোন্দাবের পারমাণবিক স্থাপনা এবং আরাক, ফোরদো, শিরাজ এবং তাবরিজের অতিরিক্ত গবেষণা কেন্দ্র। যদিও নাতানজে দৃশ্যমান কাঠামোগত ক্ষতি হয়েছে, তবুও তেজস্ক্রিয়তা নির্গমণের অনুপস্থিতি ইঙ্গিত দেয় যে হয় সেন্ট্রিফিউজ হলগুলি অক্ষত ছিল অথবা আগেভাগেই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। পাহাড়ের গভীরে থাকা ফোরদো সম্ভবত গুরুতর ক্ষতি থেকে রক্ষা পেয়েছে – এর দুর্গটি প্রচলিত বাঙ্কার-বাস্টারদের নাগালের বাইরে অবস্থিত।
পারমাণবিক স্থাপনা ছাড়াও, ইসরায়েল ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র উৎপাদন কেন্দ্র, রাডার স্থাপনা এবং বেশ কয়েকটি ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র (SAM) ব্যাটারিতে হামলা চালানো হয়েছে। তেহরানের জেনারেল স্টাফ সদর দপ্তর, হামাদানের নোজেহ বিমানঘাঁটি এবং রাজধানী জুড়ে আইআরজিসি স্থাপনা সহ সামরিক কমান্ড হাবগুলিতেও হামলা চালানো হয়। এমনকি আইআরজিসি কমান্ডারদের আবাসস্থল হিসেবে পরিচিত আবাসিক এলাকাগুলি – যেমন শাহরাক-ই মহল্লাতি, ঘেয়তারিয়েহ এবং নিয়াভারান -ও বাদ পড়েনি।
বস্তুগত ক্ষয়ক্ষতি যাই হোক না কেন, রাজনৈতিক প্রভাব সম্ভবত আরও তাৎপর্যপূর্ণ। লক্ষ্যবস্তুতে থাকা ব্যক্তিরা মূলত আইআরজিসির অভ্যন্তরে একটি কট্টরপন্থী গোষ্ঠীর সদস্য ছিলেন, যারা প্রয়াত জেনারেল কাসেম সোলাইমানির সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন। প্রভাবশালী কিন্তু ধর্মযাজক নন এমন এই গোষ্ঠীটি দীর্ঘদিন ধরে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের বিষয়ে যেকোনো কূটনৈতিক আপসের বিরোধিতা করে আসছিল। তাদের অপসারণের ফলে শাসনব্যবস্থার মধ্যে একটি কট্টরপন্থী অংশ দুর্বল হয়ে পড়েছে – যা অজনপ্রিয় ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সম্ভাব্য প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড়িয়েছিল। জনসাধারণের শোক প্রচুর হবে, তবে বন্ধ দরজার পিছনে, ইরানের নেতৃত্বের কেউ কেউ তাদের বিদায়কে স্বাগতও জানাতে পারেন।
যুক্তরাষ্ট্র ইরান এবং ইসরাইলের সাম্প্রতিক যে অস্থিরতা তা বোঝার জন্য আমাদের গত এক দশক ধরে এ অঞ্চলে ইরানের ভূমিকা, যুক্তরাষ্ট্র কিভাবে ইরানের সাথে সম্পর্ক রক্ষা করে চলছে এবং ইসরাইল কিভাবে এখানে প্রেক্ষাপটে এল তা বোঝাটা জরুরি।
সর্বপ্রথম আমাদের ২০১৫ সালে ইরান ও পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যে স্বাক্ষরিত পারমাণবিক চুক্তি হওয়ার সময়টি পর্যালোচনা করতে হবে। এরপর আমাদের ২০১৮ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সেই চুক্তি থেকে বের হয়ে আসার উপর আলোকপাত করতে হবে। এরপর আমরা বর্তমান পরিস্থিতিকে পর্যালোচনা করতে পারবো।
এছাড়া আমরা এরও পূর্বে ইরাক যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে দেখতে পেয়েছিলাম কিভাবে ইরানের সরকার ইরাকে তাদের প্রভাব বলয় খাটিয়ে সেখানে আমেরিকার এজেন্ডা বাস্তবায়ন করেছিল। সিরিয়া ও ইরাক সীমান্তে সুন্নি গোষ্ঠীর উত্থান এর পেছনে ইতিপূর্বে মার্কিন মদদে ইরান কর্তৃক ইরাকে শিয়া গোষ্ঠীর উত্থান যে সম্পর্কিত তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। মার্কিনিরা একটি সমস্যা সমাধান করতে যেয়ে আরেকটি সমস্যার তৈরি করে অর্থাৎ বুশের আমলের সমস্যার ঘানি শেষ পর্যন্ত ওবামাকে টানতে হয়।
২০১৫ সাল। সিরিয়া ও ইরাক সীমান্তে ইতোমধ্যে সুন্নি গোষ্ঠীর উত্থান পরিষ্কারভাবে পরিলক্ষিত এবং একটি তথাকথিত ইসলামিক খেলাফত রাষ্ট্রও প্রতিষ্ঠা হয়েছে। রাষ্ট্রটির প্রভাব বলয় যাতে সত্যিকার অর্থে বৃদ্ধি না পায় সেজন্য পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী শক্তি উঠে পড়ে লাগে এই গণআকাঙ্খাকে দমন করবার জন্য।
২০১৫ সালের ১৪ জুলাই মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ইরানের সাথে একটি পারমাণবিক চুক্তি সম্পাদন করে। এই চুক্তি সম্পাদনের আরো বেশ কয়েক সপ্তাহ আগে থেকেই তৎকালীন মার্কিন প্রশাসনের এ চুক্তির ব্যাপারে প্রচন্ড আগ্রহ ও উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয়। মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক ময়দানে ইরানের প্রভাবকে আরো উন্মুক্ত করবার জন্য যাতে ইরানের জন্য সেখানে কাজ করা আরও সহজতর হয়, আন্তর্জাতিক বিভিন্ন বিধি নিষেধ থেকে অনেকটা মুক্ত হয়ে তার কার্যক্রম এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। তবে এ চুক্তির একটি অন্যতম লক্ষ্য ছিল সিরিয়ার জনগণের ইসলাম প্রতিষ্ঠার আকাঙ্খাকে ধুলিস্যাৎ করবার জন্য ইরানকে ব্যবহার করা।
যেসব কারণে ২০১৮ সালে ট্রাম্প প্রশাসন ইরানের সাথে ২০১৫ সালের পারমাণবিক চুক্তি বাতিল করতে বাধ্য হয়েছিল:
ক. ওয়াশিংটন সৌদি আরব এবং তুরস্ককে আঞ্চলিক ক্ষেত্রে নিয়ে আসে। তুরস্ক এই অঞ্চলে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিল। ২০১৬ সালে, তুরস্ক “ইউফ্রেটিস শিল্ড” অপারেশন শুরু করে এবং ২০১৮ সালের মার্চ মাসে, তারা “অপারেশন অলিভ ব্রাঞ্চ” চালু করে। এটি সৌদি আরবের আঞ্চলিক ভূমিকার অতিরিক্ত ছিল। ফলস্বরূপ, সিরিয়ায় ইরানের আর কোনও প্রধান ভূমিকা পালনের প্রয়োজন ছিল না এবং এটি হ্রাস করতে হয়েছিল। ট্রাম্প ঠিক এটিই করেছিল; তিনি এই অঞ্চলে ইরানের ভূমিকা হ্রাস করেছিলেন, তাকে একটি প্রধান খেলোয়াড় থেকে একটি গৌণ বা পরিপূরক ভূমিকায় রূপান্তরিত করেছিল।
খ. ইউরোপীয় দেশগুলিও ২০১৫ সালের পারমাণবিক চুক্তির পক্ষ ছিল এবং এর প্রধান সুবিধাভোগী ছিল। তবে, ট্রাম্প চাননি যে ওবামা প্রশাসনের সময় স্বাক্ষরিত চুক্তি থেকে ইউরোপ উপকৃত হোক, তাই তিনি এটি বাতিল করে দেন।
এইভাবে, ট্রাম্প ইরানের সাথে পারমাণবিক চুক্তি থেকে তার প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন, কারণ এই অঞ্চলে ইরানের ভূমিকা হ্রাস করার জন্য নতুন শর্তের প্রস্তুতির জন্য চুক্তি থেকে প্রত্যাহার করা আমেরিকার স্বার্থের পক্ষে ছিল।
সাম্প্রতিক সময়ে আমরা দেখতে পেলাম ট্রাম্প প্রশাসন আবারও ইরানকে সমঝোতার টেবিলে ডাকছে এবং অনেকটা বলপ্রয়োগ করে তাদের সাথে একটি দ্বিপাক্ষিক সমঝোতায় পৌছতে চাচ্ছে এবং দ্রুত চাচ্ছে। এই সমীকরণে ইসরাঈল ঢুকে পড়ে কারণ নেতানিয়াহুর ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য নিজস্ব কিছু অভিলাষ রয়েছে। ইসরাঈল ও ইরানের যুদ্ধ যাতে আরো ছড়িয়ে না পড়ে কিংবা দীর্ঘায়িত না হয় সেজন্য ট্রাম্প অনেক জোর করেই যুদ্ধে ঢুকে পড়ে এবং ইরানের নির্দিষ্ট কিছু টার্গেট ধ্বংস করার জন্য আমেরিকার সবচেয়ে শক্তিশালী যুদ্ধবিমান বি২ বম্বার ব্যবহার করে। তবে এখানে ইরানকে আগেভাগেই জানিয়ে দেয়া হয় আমেরিকার উদ্দেশ্য কী। একইভাবে ইরানও কাতারে অবস্থিত মার্কিন ঘাটি আক্রমন করার বিষয়টি আগেভাগেই মার্কিনিদের জানিয়ে দেয়। সবশেষে ট্রাম্প অনেকটা জোর করেই যুদ্ধ সমাপ্তির ঘোষনা দেয় এবং ইরান ও ইসরাঈলের মধ্যে চিরতরে যুদ্ধবিরতিরও ঘোষণা দেয়। অপরদিকে ইরানও এই যুদ্ধবিরতি মেনে নেয়, যদিও একই সময়ে গাজার নিরীহ মুসলিমরা প্রতিনিয়ত মারা পড়ছে।
এ সবকিছু দেখে খুব সহজেই এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে আমেরকিা ও ইরান উভয়ের কেউই যুদ্ধে জড়াতে চায় না, বরং নিজেদের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি সমঝোতার সম্পর্ক চায়। ট্রাম্প তার বর্তমান মেয়াদের মধ্যেই মধ্যপ্রাচের শান্তির দূত হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে চায়, তার ছলে বলে কৌশলে যেভাবে হোক না কেন। ইরান মুখে যদিও ফিলিস্তিনিদের পক্ষে কথা বলে কিন্তু কাজে ঠিক তার উল্টোটিই করছে। এমনকি পারমানবিক শক্তি হবার ব্যপারেও ইরান পাবলিকলি কোনো ইচ্ছা প্রকাশ করে না, যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল উভয়ে তাদের পারমানবিক শক্তি টিকিয়ে রেখেছে এবং তা ধ্বংস করার কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র NPT তে স্বাক্ষর করেছে, তারপরও তার পারমানবিক শক্তি ধ্বংসাত্মক কাজে ব্যবহারের জন্য বহাল তবিয়তে রেখে দিয়েছে, আর ওদিকে অন্য কেউ সেই সক্ষমতা তৈরি করতে চাইলে তাদের লেকচার দিয়ে বেড়াচ্ছে, তাদের বিভিন্ন অর্থনৈতিক চাপ দিয়ে বেড়াচ্ছে। এসকল ঘটনা আমাদের মুসলিম উম্মাহর ঐক্য ও তার সামরিক শক্তি বৃদ্ধির গুরুত্বকেই বার বার স্মরণ করিয়ে দেয়, যেমনটি আল্লাহু সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন,
وَأَعِدُّوا لَهُم مَّا اسْتَطَعْتُم مِّن قُوَّةٍ وَمِن رِّبَاطِ الْخَيْلِ تُرْهِبُونَ بِهِ عَدُوَّ اللَّهِ وَعَدُوَّكُمْ وَآخَرِينَ مِن دُونِهِمْ لَا تَعْلَمُونَهُمُ اللَّهُ يَعْلَمُهُمْ ۚ وَمَا تُنفِقُوا مِن شَيْءٍ فِي سَبِيلِ اللَّهِ يُوَفَّ إِلَيْكُمْ وَأَنتُمْ لَا تُظْلَمُونَ
আর প্রস্তুত কর তাদের সাথে যুদ্ধের জন্য যাই কিছু সংগ্রহ করতে পার নিজের শক্তি সামর্থ্যের মধ্যে থেকে এবং পালিত ঘোড়া থেকে, যেন প্রভাব পড়ে আল্লাহর শুত্রুদের উপর এবং তোমাদের শত্রুদের উপর আর তাদেরকে ছাড়া অন্যান্যদের উপরও যাদেরকে তোমরা জান না; আল্লাহ তাদেরকে চেনেন। বস্তুতঃ যা কিছু তোমরা ব্যয় করবে আল্লাহর রাহে, তা তোমরা পরিপূর্ণভাবে ফিরে পাবে এবং তোমাদের কোন হক অপূর্ণ থাকবে না। [আনফাল: ৬০]
ইসরাইল ধ্বংস হবে এবং জেরুজালেম (বাইতুল মুকাদ্দাস) হবে খিলাফতের রাজধানী
এই কঠিন সময়ে আমাদের ভেঙে পড়া উচিত নয়; আমাদের দূরদর্শিতা থাকতে হবে এবং সেই লক্ষ্য অর্জনের জন্য কাজ করতে হবে। ভবিষ্যতে ইসরায়েল পরাজিত হবে এবং জেরুজালেম ইসলামী খিলাফতের রাজধানীতে পরিণত হবে ইনশাআল্লাহ। কুরআন ও হাদীস থেকে নিম্নলিখিত দলিলসমূহ এই বিষয়ে সাক্ষ্য দেয়:
আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) ইরশাদ করেন:
“وَقَضَيْنَا إِلَىٰ بَنِيٓ إِسْرَٰٓءِيلَ فِي ٱلْكِتَٰبِ لَتُفْسِدُنَّ فِي ٱلْأَرْضِ مَرَّتَيْنِ وَلَتَعْلُنَّ عُلُوّٗا كَبِيرٗا ٤ فَإِذَا جَآءَ وَعْدُ أُولَىٰهُمَا بَعَثْنَا عَلَيْكُمْ عِبَادٗا لَّنَآ أُوْلِي بَأْسٖ شَدِيدٖ فَجَاسُواْ خِلَٰلَ ٱلدِّيَارِۚ وَكَانَ وَعْدٗا مَّفْعُولٗا ٥ ثُمَّ رَدَدْنَا لَكُمُ ٱلْكَرَّةَ عَلَيْهِمْ وَأَمْدَدْنَٰكُم بِأَمْوَٰلٖ وَبَنِينَ وَجَعَلْنَٰكُمْ أَكْثَرَ نَفِيرًا ٦ إِنْ أَحْسَنتُمْ أَحْسَنتُمْ لِأَنفُسِكُمْۖ وَإِنْ أَسَأْتُمْ فَلَهَاۚ فَإِذَا جَآءَ وَعْدُ ٱلْءَاخِرَةِ لِيَسُۥٓـُٔواْ وُجُوهَكُمْ وَلِيَدْخُلُواْ ٱلْمَسْجِدَ كَمَا دَخَلُوهُ أَوَّلَ مَرَّةٖ وَلِيُتَبِّرُواْ مَا عَلَوْاْ تَتْبِيرًا ٧ عَسَىٰ رَبُّكُمْ أَن يَرْحَمَكُمْۚ وَإِنْ عُدتُّمْ عُدْنَاۘ وَجَعَلْنَا جَهَنَّمَ لِلْكَٰفِرِينَ حَصِيرًا ٨”
“আর আমরা বনী ইসরাঈলের প্রতি কিতাবে নির্দেশ দিয়েছিলাম: তোমরা অবশ্যই পৃথিবীতে দু’বার বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে এবং ঘোরতর অহংকারে বিভোর হবে। অতঃপর যখন প্রথম প্রতিশ্রুতির সময় আসবে, তখন আমরা তোমাদের বিরুদ্ধে আমাদের কঠিন যুদ্ধে অভ্যস্ত বান্দাদের পাঠিয়ে দেব, তারা তোমাদের ঘরবাড়ির ভেতরে পর্যন্ত ঢুকে পড়বে। আর এটা ছিল একটি পূর্ণ হওয়া ওয়াদা। তারপর আমরা তোমাদেরকে আবার তাদের ওপর বিজয় দান করলাম, ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততির দ্বারা তোমাদেরকে সাহায্য করলাম এবং তোমাদের সংখ্যাবল বৃদ্ধি করলাম। (আর বললাম): ‘তোমরা সৎকর্ম করলে তা তোমাদের নিজেদেরই মঙ্গলের জন্য, আর মন্দ করলে তা নিজেদেরই অনিষ্টের জন্য।’ অতঃপর যখন দ্বিতীয় ওয়াদার সময় আসবে, তখন (আমরা শত্রুদেরকে অনুমতি দিব) যেন তারা তোমাদের চেহারা বিমর্ষ করে দেয় এবং মসজিদে (বাইতুল মুকাদ্দাসে) প্রবেশ করে যেমন তারা প্রথমবার প্রবেশ করেছিল এবং তারা যা কিছু পাবে, সবই ধ্বংস করে ফেলবে। (আর তাওরাতে আমরা বলেছিলাম): ‘সম্ভবত তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের প্রতি রহমত করবেন, কিন্তু যদি তোমরা আবার (পাপের পথে) ফিরে যাও, তাহলে আমরাও (শাস্তি দিয়ে) ফিরে আসব।’ আর আমরা জাহান্নামকে কাফিরদের জন্য কারাগার বানিয়েছি।” [সূরা আল-ইসরা, ১৭:৪-৮]
এই আয়াতে ইঙ্গিত রয়েছে যে, আল্লাহ্ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা)’র দ্বিতীয় ওয়াদা বাস্তবায়িত হবে এবং তা হবে ইসরাইলের ধ্বংস: এই আয়াতে আল্লাহ্ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা)’র দ্বিতীয় ওয়াদা বাস্তবায়িত হওয়ার যে ইঙ্গিত রয়েছে, তা হলো:
“لِيَسُۥٓـُٔواْ وُجُوهَكُمْ وَلِيَدْخُلُواْ ٱلْمَسْجِدَ كَمَا دَخَلُوهُ أَوَّلَ مَرَّةٖ”
অর্থাৎ: “যেন তারা তোমাদের মুখমণ্ডল বিমর্ষ করে দেয় এবং তারা মসজিদে (বাইতুল মুকাদ্দাসে) প্রবেশ করে যেমন তারা প্রথমবার প্রবেশ করেছিল।” [সূরা বনী ইসরাইল: ৭]
মুসলিমরা বাইতুল মুকাদ্দাসে প্রথম প্রবেশ করে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করে দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রাদিয়াল্লাহু আনহু)-এর খেলাফতের সময়। এরপর ইসলামী খেলাফত শত শত বছর ন্যায়বিচারের সাথে জেরুজালেম শাসন করে। যদিও কিছু বছর খ্রিস্টান ক্রুসেডাররা এটি দখল করেছিল, কিন্তু ইসরাইল রাষ্ট্র গঠনের আগ পর্যন্ত কোনো সময়েই এটি ইহুদিদের দখলে যায়নি। সুতরাং, আল্লাহ্ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) ওয়াদা করেছেন যে, আমরা মসজিদুল আকসায় (বাইতুল মুকাদ্দাসে) পুনরায় প্রবেশ করব, যেমন আমরা পূর্বে বিজয়ের মাধ্যমে প্রবেশ করেছিলাম।
ইবন ‘আসাকির তাঁর সংকলনে মাসীরাহ ইবন জালিস (রহি.) থেকে বর্ণনা করেছেন, যিনি বলেন, তিনি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলতে শুনেছেন:
“هَذَا الْأَمْرُ (أي الخلافة) كَائِنٌ بَعْدِي فِي الْمَدِينَةِ، ثُمَّ فِي الشَّامِ، ثُمَّ فِي الْجَزِيرَةِ، ثُمَّ فِي الْعِرَاقِ، ثُمَّ فِي الْمَدِينَةِ، ثُمَّ فِي بَيْتِ الْمَقْدِسِ، فَإِذَا كَانَ فِي بَيْتِ الْمَقْدِسِ فَهُنَاكَ مُقَرُّهَا، وَلَا يُخْرِجُهَا قَوْمٌ فَتَعُودُ إِلَيْهِمْ أَبَدًا”
অর্থ: “এই বিষয়টি (অর্থাৎ খেলাফত) আমার পর মদীনায় থাকবে, তারপর শামে, তারপর জাযিরায়, তারপর ইরাকে, তারপর শহরে, তারপর বাইতুল মাকদিসে। আর যখন এটা বাইতুল মাকদিসে পৌঁছাবে, তখন তা তার চূড়ান্ত আবাসস্থলে পৌঁছে যাবে; এবং আর যেসব জাতি এটিকে (অর্থাৎ খেলাফতের রাজধানী) তাদের ভূমি থেকে সরিয়ে দেয়, তারা আর কখনও তা পুনরায় ফিরে পাবে না (যাতে তা তাদের রাজধানী হয়)।” উলামাগণ বলেন, তারা বিশ্বাস করেন যে, তিনি ﷺ যে ‘নগরী’-র কথা বলেছেন, তাতে তাঁর উদ্দেশ্য ছিল হিরাক্লিয়াসের শহর (কনস্টান্টিনোপল)। এই হাদীসে বলা হয়েছে, কোন কোন শহরগুলো খেলাফতের রাজধানী হয়েছিল বা হবে। এখানে যে সব শহরের নাম এসেছে, তার সবই পূর্বে খেলাফতের রাজধানী ছিল—শুধু বাইতুল মাকদিস (জেরুজালেম) এখনো হয়নি। ইনশাআল্লাহ, ভবিষ্যতের কোনো এক সময়ে এটি আমাদের খেলাফতের রাজধানী হবে।
ইবন আসাকির থেকে আরও কিছু হাদীস এসেছে, যেমন: ইবন ‘আসাকির, আব্দুর রহমান ইবন আবি উমাইরাহ আল-মুযনী (রহি:.) থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন, তিনি আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলতে শুনেছেন:
“سَتَكُونُ بَيْعَةٌ فِي بَيْتِ الْمَقْدِسِ”
অর্থ: “নিঃসন্দেহে বাইতুল মাকদিসে একটি (সঠিকভাবে পরিচালিত) বায়আহ হবে।”
আল-হাকিম কর্তৃক বর্ণিত আরও কিছু হাদীস রয়েছে, যেগুলোকে সহীহ হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়েছে। এর মধ্যে আবু শরীহ (রহি.) থেকে বর্ণিত একটি হাদীস রয়েছে:
“…سمعت من يقول: يكون تحت كل راية اثنا عشر ألفاً، فيجتمع المسلمون إلى صاحبهم ببيت المقدس.”
অর্থ: “আমি এমন লোকদের কথা শুনেছি যারা বলেন, প্রতিটি পতাকার নিচে থাকবে বারো হাজার (যোদ্ধা), এবং মুসলিমরা তাদের সাথী (বা ইমামের) নিকট একত্রিত হবে বাইতুল মাকদিসে (আল-কুদসে)।”
ইবন হিব্বান তাঁর সহীহ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন যে, শাম অঞ্চল (বর্তমান জর্ডান, সিরিয়া, ফিলিস্তিন, লেবানন এবং ইরাকের একটি অংশ) কিয়ামতের নিকটবর্তী সময়ে মু’মিনদের ভূমির কেন্দ্র হবে।
আল-নাওয়াস ইবন সামআন (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, তিনি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলতে শুনেছেন:
“…وَعُقْرُ دَارِ الْمُؤْمِنِينَ الشَّامُ“
অর্থ: “…আর মু’মিনদের ভূমির মূল কেন্দ্র (উৎপত্তিস্থল) হবে শাম।”
একই হাদীস ইমাম আহমদ (রহি.)-ও সালামা ইবন নুফাইল (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণনা করেছেন:
“…إِنَّ عُقْرَ دَارِ الْمُؤْمِنِينَ الشَّامُ“
অর্থ: “নিশ্চয়ই মু’মিনদের ভূমির কেন্দ্রস্থল হবে শাম।”
এছাড়াও, আল-তাবারানী তাঁর ‘আল-কবীর’ গ্রন্থে সালামা ইবন নুফাইল (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণনা করেছেন:
“عُقْرُ دَارِ الإِسْلَامِ بِالشَّامِ“
অর্থ: “দারুল ইসলামের মূল কেন্দ্রস্থল হবে শাম।”
হাইছামী (রহি.) বলেন, এটি আল-তাবারানী বর্ণনা করেছেন এবং তাঁর রাবিগণ নির্ভরযোগ্য।
এই হাদীসটি পাঁচজন তাবে- তাবিঈন, দুইজন তাবিঈ এবং সাহাবাদের মধ্যে দুইজন থেকে বর্ণিত হয়েছে। কারণ এই হাদীসের বর্ণনাকারী হলেন আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম), যিনি সর্বাপেক্ষা সত্যবাদী, তাই এই হাদীস দ্বারা বোঝানো হচ্ছে দ্বিতীয় দারুল ইসলামের মূল কেন্দ্রস্থল (‘উকর), প্রথমটির নয়।
“উকর” অর্থ হলো: কেন্দ্র, মূল বা ভিত্তি। প্রথম ইসলামি রাষ্ট্রের উকর ছিল আল-মাদীনা আল-মুনাওয়ারা। সুতরাং, এই হাদীসে বোঝানো হয়েছে দ্বিতীয় ইসলামি রাষ্ট্রের উকর, অর্থাৎ এর কেন্দ্রস্থল হবে শাম অঞ্চল—যার অন্তর্গত বাইতুল মাকদিস ইনশাআল্লাহ এক সময় ইসলামি খেলাফতের রাজধানী হবে।
আবু দাউদ তাঁর ‘সুনান’ গ্রন্থে আব্দুল্লাহ ইবন ‘আমর (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু) থেকে বর্ণনা করেন:
“سَتَكُونُ هِجْرَةٌ بَعْدَ هِجْرَةٍ، فَخِيَارُ أَهْلِ الْأَرْضِ أَلْزَمُهُمْ مَهَاجِرَ إِبْرَاهِيمَ“
অর্থ: “এক হিজরতের পর আরেক হিজরত হবে। অতএব, যেসব মানুষ হিজরতে ইবরাহিম (আলাইহিস সালাম)-এর ভূমিতে (অর্থাৎ শাম অঞ্চলে) অবস্থান করবে, তারাই হবে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষ।”
এই হাদীসটি আল-হাকিম-ও বর্ণনা করেছেন, এবং তিনি বলেছেন এটি সহীহ এবং দুই শাইখ (ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম)-এর শর্ত অনুযায়ী সহীহ হলেও তাঁরা এটি বর্ণনা করেননি।
মূসা ইবন আলী ইবন রাবাহ বলেন, আমি আমার পিতাকে বলতে শুনেছি:
“…আবু হুরাইরাহ (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু) বলেন, আমাকে আব্দুল্লাহ ইবন ‘আমর ইবন আল-আস (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু) বলেছিলেন, আমি আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলতে শুনেছি…” তারপর তিনি ঐ হাদীসটি উল্লেখ করেন।
এই হাদীসটি আহমদ তাঁর মুসনাদ গ্রন্থেও আব্দুল্লাহ ইবন ‘আমর (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু)-এর সূত্রে বর্ণনা করেছেন এবং তিনি বলেন: “আমি আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলতে শুনেছি…” তারপর তিনি হাদীসটি উল্লেখ করেন।
এই হাদীসটি কমপক্ষে পাঁচজন তাবে-তাবিঈন, তিনজন তাবিঈ এবং দুইজন সাহাবী থেকে বর্ণিত হয়েছে। এটি নির্দেশ করে যে, আল-মদীনা-তে হিজরতের পর একটি নতুন হিজরত হবে আল-শাম অঞ্চলে।
হিজরতের উদ্দেশ্য হলো: দারুল কুফর (কুফর দ্বারা শাসিত ভূমি) ত্যাগ করে দারুল ইসলাম (ইসলাম দ্বারা শাসিত ভূমি)-এ গমন করা।
প্রথম হিজরত ছিল আল-মাদীনায়, আর দ্বিতীয় হিজরত হবে আল-শাম-এ। এই অর্থটি “দারুল ইসলামের উকর (মূল কেন্দ্রস্থল)” সম্পর্কিত পূর্ববর্তী হাদীসগুলোর সাথেও মিলে যায়।
আবু দাউদ ইবন জুগ্ব আল-আয়াদী থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন:
আলী আবদুল্লাহ ইবন হাওয়ালাহ আল-আযদী তাঁর কাছে এসে বলেন:
“আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাদেরকে পদব্রজে (অস্ত্র সংগ্রহের জন্য) অভিযানে পাঠিয়েছিলেন। আমরা ফিরে এলাম কিন্তু কিছুই পেলাম না। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাদের ক্লান্ত চেহারা দেখে বুঝতে পারলেন। তখন তিনি দাঁড়িয়ে দুআ করলেন:
اللَّهُمَّ لَا تَكِلْهُمْ إِلَيَّ فَأَضْعَفَ عَنْهُمْ، وَلَا تَكِلْهُمْ إِلَى أَنْفُسِهِمْ فَيَعْجِزُوا عَنْهَا، وَلَا تَكِلْهُمْ إِلَى النَّاسِ فَيَسْتَأْثِرُوا عَلَيْهِمْ
অর্থ: “হে আল্লাহ! তুমি তাদের আমার উপর ছেড়ে দিয়ো না—যাতে আমি তাদের দায়িত্ব পালনে দুর্বল হয়ে পড়ি; এবং তুমি তাদের নিজেদের উপরেও ছেড়ে দিয়ো না—যাতে তারা নিজেরাই অক্ষম হয়ে পড়ে; এবং তুমি তাদের লোকজনের কাছেও ছেড়ে দিয়ো না—যাতে তারা (অন্যরা) সবকিছু নিজেদের জন্য রেখে দেয়।”
তারপর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমার মাথার উপর হাত রাখলেন (অথবা তিনি বলেন: কপালে হাত রাখলেন) এবং বললেন:
“يَا ابْنَ حَوَالَةَ، إِذَا رَأَيْتَ الْخِلَافَةَ قَدْ نَزَلَتِ الْأَرْضَ الْمُقَدَّسَةَ، فَقَدْ دَنَتِ الزَّلَازِلُ، وَالْبَلَابِلُ، وَالْأُمُورُ الْعِظَامُ، وَالسَّاعَةُ يَوْمَئِذٍ أَقْرَبُ إِلَى النَّاسِ مِنْ يَدِي هَذِهِ مِنْ رَأْسِكَ“
অর্থ: “হে ইবন হাওয়ালাহ! যখন তুমি দেখবে যে খেলাফত পবিত্র ভূমি (বাইতুল মাকদিস / আল-কুদস)-এ এসে পৌঁছেছে, তখন জানবে—ভূমিকম্প, ফিতনা ও মহাসংকট আসন্ন, এবং তখন কিয়ামতের সময় মানুষের নিকট এতটাই আসন্ন হবে, যেমন আমার এই হাত এখন তোমার মাথার উপর।”
আল-হাকিম এই হাদীসটি ইবনু-যুঘব আল-ইবাদী (رحمه الله)-এর সনদে রিওয়ায়াত করেছেন। তিনি এ হাদীসটির সনদকে সহীহ (বিশ্বস্ত বর্ণনাসূত্র) হিসেবে ঘোষণা করেছেন, যদিও এটি দুই শাইখ (ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম) রিওয়ায়াত করেননি। ইমাম আহমদও এটি আল-হাকিমের অনুরূপ সনদে রিওয়ায়াত করেছেন।
যদি ইবনু-যুঘব হন আব্দুল্লাহ, তাহলে তিনি সাহাবী ছিলেন; আর যদি তিনি আব্দুর রহমান হন, তাহলে তিনি তাবি‘ঈনদের অন্তর্ভুক্ত। অতএব, যদি তিনি প্রথমজন (আব্দুল্লাহ) হন, তাহলে এ হাদীসটি দুইজন সাহাবী রিওয়ায়াত করেছেন; আর যদি তিনি দ্বিতীয়জন (আব্দুর রহমান) হন, তাহলে এক সাহাবী এ হাদীস রিওয়ায়াত করেছেন; এবং যদি প্রথমজন হন, তাহলে একজন তাবি‘ঈ এ হাদীস রিওয়ায়াত করেছেন; আর যদি দ্বিতীয়জন হন, তাহলে দুইজন তাবি‘ঈ এ হাদীস রিওয়ায়াত করেছেন। আর উভয় ক্ষেত্রেই তিনজন তাবি‘-তাবি‘ঈ এ হাদীস রিওয়ায়াত করেছেন।
এই হাদীসটি প্রমাণ করে যে, খেলাফত আল-কুদস (বায়তুল মাকদিস)-এর ভূমিতে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে। কেউ এটা বলতে পারে না যে, খেলাফত উমর (رضي الله عنه)-এর খেলাফতের সময় সেখানে এসেছিল, কারণ সে সময় ভূমিকম্প, ফিতনা এবং বিশৃঙ্খল ঘটনাবলি দেখা দেয়নি।
এর অর্থ হলো, খেলাফতের একটি দ্বিতীয় আগমন (পুনঃপ্রতিষ্ঠা) হবে, যার পর এইসব ঘটনাবলি সংঘটিত হবে।
আবু মুহাম্মদ দ্বারা অনুবাদকৃতউত্তর আধুনিকতাবাদে ইসলামী উম্মাহ
পোস্টমডার্নিজম (তথা উত্তরাধুনিকতাবাদ)-এর আবির্ভাব ১৯৬০ ও ১৯৭০-এর দশকে ঘটে যাওয়া সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সঙ্কটের পটভূমিতে ঘটে। আধুনিকতার ব্যর্থতা—যেমন দুটি বিশ্বযুদ্ধ, ফ্যাসিবাদের উত্থান, উপনিবেশবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী সহিংসতা (যেমন আলজেরিয়া ও ভিয়েতনাম যুদ্ধ), এবং শ্রেণী বৈষম্য—এই সকল বিষয়ে হতাশা থেকেই পোস্টমডার্ন সমালোচনার উদ্ভব ঘটে। মিশেল ফুকো ও জ্যাক দেরিদার মতো চিন্তাবিদগণ আধুনিকতার রৈখিক অগ্রগতির দাবি ও যুক্তির কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করেন এবং এর পরিবর্তে সত্য ও বস্তুনিষ্ঠতার আপেক্ষিকতার উপর জোর দেন।
পোস্টমডার্নিজম প্রথমে পশ্চিমা বিশ্বের সার্বজনীন দাবিকে চ্যালেঞ্জ করার মাধ্যম হিসেবে গড়ে উঠলেও, পরবর্তী সময়ে কিছু চিন্তাধারার পক্ষ থেকে তা ইসলামি রাজনৈতিক আন্দোলনকে খাটো করার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। পরিচয় ও ঐতিহ্যকে “গঠিত” বা “আবিষ্কৃত” বলে দাবী করার মাধ্যমে, পোস্টমডার্ন চিন্তা ইসলাম ও তার চর্চাকে অবৈধ ও মনগড়া হিসেবে উপস্থাপন করতে ব্যবহৃত হয়েছে।
সালমান সাইয়্যিদ তার বই Recalling the Caliphate-এ উল্লেখ করেন, একটি সাধারণ পোস্টমডার্ন কৌশল হচ্ছে ইসলামিজম (এখানে ইসলামি রাজনীতির ধারণা বোঝানো হয়েছে)-কে একটি “কল্পিত আসল ইসলাম”-এর মনগড়া নির্মাণ হিসেবে চিত্রায়িত করা:
“Islamism is presented as being a discourse ‘conjured’ around a fantasy of an authentic essence (al-Azmeh, 1993:7) … cultural forms such as ‘Islamic dress’ or ‘Islamic way of life’ are recent inventions and not the recovery of sacral traditions (1993:21) … The effect of arguments like this is to try and discredit Islamist claims for being legitimate expressions of a Muslim desire for autonomy and deep decolonisation of the world.”
“অর্থাত, ইসলামিজমকে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয় যেন এটি একটি কল্পিত ‘প্রকৃত সত্তা’ বা ‘আসল ইসলাম’ ধারণার চারপাশে গঠিত একটি কৃত্রিম বর্ণনা (আল-আযমি, ১৯৯৩: ৭)। অর্থাৎ, ইসলামপন্থীরা যে ইসলামকে ‘প্রকৃত’ বলে দাবি করেন, তা মূলত একটি গঠিত ও রূপান্তরিত ঐতিহ্য, যা ইসলামের প্রকৃত বৈচিত্র্যকে অস্বীকার করে। একইভাবে, ‘ইসলামি পোশাক’ বা ‘ইসলামি জীবনধারা’-র মতো সাংস্কৃতিক রূপগুলোকে ঐতিহ্যবাহী মূল্যবোধের পুনর্জাগরণ না বলে বরং আধুনিক সময়ে গঠিত নতুন উদ্ভাবন হিসেবে দেখানো হয় (১৯৯৩: ২১)। এই ধরনের ধারণার উদ্দেশ্য হলো ইসলামপন্থীদের দাবিকে অগ্রহণযোগ্য প্রমাণ করা—যাতে তাদের দাবি মুসলিমদের স্বশাসনের আকাঙ্ক্ষা ও বিশ্বজুড়ে গভীর উপনিবেশমুক্তির একটি ন্যায্য ও বৈধ প্রচেষ্টা হিসেবে গণ্য না হয়।“
এই ধরনের পোস্টমডার্ন আক্রমণ মূলত ইসলামকে একটি ধর্ম হিসেবে সেক্যুলার পথে অগ্রসর না হওয়ার কারণে করা হয়েছে। সালমান সাইয়্যিদ লিখেছেন:
“As late as the last quarter of the twentieth century… Not only has Islam failed to follow the trajectory pursued by variants of Christianity… but it has, in contrast, forcefully reasserted its public presence in the world.”
অর্থ্যাৎ, বিংশ শতকের শেষ চতুর্থাংশ পর্যন্তও… ইসলাম কেবল খ্রিষ্টধর্মের বিভিন্ন ধারার অনুসৃত পথ অনুসরণে ব্যর্থই হয়নি… বরং তার বিপরীতে, বিশ্বমঞ্চে নিজের প্রকাশ্য উপস্থিতিকে দৃঢ়ভাবে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছে।“
এই “মনগড়া ঐতিহ্য” হিসেবে রাজনৈতিক ইসলামের চিত্রায়ন আরও গভীরে গিয়ে এমনকি “ইসলাম” শব্দেরই বৈধতা এবং “উম্মাহ’র মতো ধর্মীয় ধারণাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে। সালমান সাইয়্যিদের ভাষায়, এটি একটি “metaphysics of suspicion মানে, সন্দেহের অধিবিদ্যা”—যার মাধ্যমে ইসলামকে এতটাই বৈচিত্র্যময় ও খণ্ডিত বলা হয় যে, একে আর ঐক্যবদ্ধ কোনো সত্তা হিসেবে রাখা যায় না। ফলে মুসলিম উম্মাহ ধারণাটিও খণ্ডিত জাতীয়তা ও মতবাদে বিভক্ত হয়ে পড়ে।
এই প্রচেষ্টাগুলো আসলে কিসের জন্য? প্রফেসর জোসেফ জে. কামিনস্কি তার বই Islam, Liberalism, and Ontology-তে বলেন:
“The rendering of Islam as an incoherent category ultimately subjects its meaning to the whims of hostile hegemonic actors and brute force… Approaches such as El Zein’s ultimately remove agency from Muslims—they are robbed of their ability to control how their own religious discourse is defined… this is imperialism par excellence.”
অর্থাৎ, ”ইসলামকে যদি বিভ্রান্তিকর ও অস্পষ্ট একটি ধারণা হিসেবে দেখানো হয়, তাহলে এর অর্থ কী হবে—তা ঠিক করে দেয় শত্রুভাবাপন্ন ক্ষমতাধর গোষ্ঠী ও জবরদস্তি করে চলা শক্তিগুলো। এল জেইনের মতো চিন্তাধারা এমনভাবে ইসলামকে ব্যাখ্যা করে যে, এতে মুসলিমদের নিজেদের ধর্ম নিয়ে কথা বলার ও তা ব্যাখ্যা করার অধিকারটাই যেন কেড়ে নেওয়া হয়। তারা আর ঠিক করতে পারে না, তাদের ধর্মের কথা কীভাবে উপস্থাপিত হবে। এটিই হচ্ছে প্রকৃত সাম্রাজ্যবাদ।“
ইসলামকে অস্পষ্ট করে উপস্থাপন করার ফলে পশ্চিমা শক্তি বা সেক্যুলার চিন্তাবিদরা ইসলামের সংজ্ঞা নির্ধারণ করে দিতে পারে। তারা নির্ধারণ করতে পারে কোন ইসলামি চর্চা গ্রহণযোগ্য আর কোনটি চরমপন্থা।
উম্মাহ ধারণাটিকে কেবল একটি ভাষাগত নির্মাণ বলে চিহ্নিত করে, মুসলিম সংহতিকে দুর্বল করা হয়। এতে মুসলিমরা বিভক্ত হয় জাতীয়তাবাদী বা মতবাদভিত্তিক গোষ্ঠীতে, এবং খিলাফাহর মতো ঐক্যবদ্ধ রাজনৈতিক দর্শন বাস্তবায়নে অক্ষম হয়ে পড়ে।
মুসলমানদের করণীয় হচ্ছে, তাদের ধর্মকে অন্যের দ্বারা সংজ্ঞায়িত করার সুযোগ না দিয়ে, নিজেদের ঐতিহ্যের সাথে পুনরায় সম্পৃক্ত হওয়া। অধ্যাপক তালাল আসাদ তার প্রবন্ধ The Idea of an Anthropology of Islam-এ লেখেন:
“…one should begin, as Muslims do, from the concept of a discursive tradition that includes and relates itself to the founding texts of the Qur’an and the Hadith.”
“…একজনের উচিত মুসলমানদের মতো করে শুরু করা—একটি বাগ্মীয় ধারার (discursive tradition) ধারণা থেকে, যা কুরআন ও হাদীসের প্রাথমিক পাঠসমূহকে অন্তর্ভুক্ত করে এবং সেগুলোর সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করে।”
ইসলাম, নিঃসন্দেহে, আল্লাহ্ ﷻ প্রদত্ত দ্বীন এবং এটি পূর্ণতা লাভ করেছে রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর মাধ্যমে প্রেরিত চূড়ান্ত রিসালাহর মধ্য দিয়ে।
আল্লাহ্ ﷻ বলেন,
ٱلۡيَوۡمَ أَكۡمَلۡتُ لَكُمۡ دِينَكُمۡ وَأَتۡمَمۡتُ عَلَيۡكُمۡ نِعۡمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ ٱلۡإِسۡلَـٰمَ دِينٗا
“আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণ করলাম, আমার অনুগ্রহ তোমাদের ওপর সম্পন্ন করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্য দ্বীন হিসেবে পছন্দ করলাম।” [সূরা আল-মায়েদাহ ৩]
যারা আল্লাহ্ ﷻ ও তাঁর রাসূল ﷺ-এ ঈমান এনেছে, তারাই মুসলিম এবং একক উম্মাহর অন্তর্ভুক্ত।
আল্লাহ্ ﷻ বলেন,
إِنَّ هَـٰذِهِۦٓ أُمَّتُكُمۡ أُمَّةٗ وَٰحِدَةٗ وَأَنَا۠ رَبُّكُمۡ فَٱعۡبُدُونِ
“নিশ্চয়ই তোমাদের এই উম্মাহ একক উম্মাহ, আর আমি তোমাদের প্রতিপালক, সুতরাং তোমরা আমারই এবাদত কর।” [সূরা আল-আম্বিয়া ৯২]
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন:
«بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ، هَذَا كِتَابٌ مِنْ مُحَمَّدٍ النَّبِيِّ ﷺ بَيْنَ الْمُؤْمِنِينَ وَالْمُسْلِمِينَ مِنْ قُرَيْشٍ وَيَثْرِبَ، وَمَنْ تَبِعَهُمْ، وَلَحِقَ بِهِمْ، وَجَاهَدَ مَعَهُمْ، أَنَّهُمْ أُمَّةٌ وَاحِدَةٌ مِنْ دُونِ النَّاسِ»
“রহমান ও রহিম আল্লাহ্র নামে। এ দলিল মুহাম্মদ ﷺ-এর পক্ষ থেকে কুরাইশ ও ইয়াসরিবের মুসলিম ও মুমিনদের মাঝে, এবং যাঁরা তাঁদের অনুসরণ করেছেন, তাঁদের সঙ্গে একত্রিত হয়েছেন ও তাঁদের সঙ্গে জিহাদ করেছেন—তাঁরা একক উম্মাহ, অন্য সকল মানুষের থেকে পৃথক।” (আল-বাইহাকি, আস-সুনান আল-কুবরা)
একক উম্মাহর স্বীকৃতি ও ইসলামের সত্যতার উপর ভিত্তি করে, মু’মিনগণ তাদের সম্মিলিত ফর্যে কিফায়াহ আদায়ের উদ্দেশ্যে প্রচেষ্টা চালাতে পারে—একক ইমারাহ, ইমামাহ ও খিলাফাহ প্রতিষ্ঠার জন্য, যা আল্লাহ্ ﷻ অবতীর্ণ সকল বিষয় অনুযায়ী শাসন করবে।
তামিম আদ-দারি (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, যখন উমর (রা.)-এর সময় লোকে উঁচু ভবন নির্মাণে প্রতিযোগিতা শুরু করে, তখন দ্বিতীয় খলিফা উমর (রা.) বলেছিলেন:
«يا معشر العرب، تمسكوا بالأرض، فإنه لا إسلام إلا بجماعة، ولا جماعة إلا بإمارة، ولا إمارة إلا بطاعة، فمن ولي من أمر الناس شيئاً على فقه كان له ولهم، ومن ولي على غير فقه كان عليه وعليهم»
“হে আরবগণ, জমিনে দৃঢ় থাকো! কারণ, কোনো জামাআত ছাড়া ইসলাম নেই, কোনো ইমারত ছাড়া জামাআত নেই, কোনো আনুগত্য ছাড়া ইমারত নেই। যে ফিকহ (তথা পোড় খাওয়া অর্থাৎ ইসলামের অভিজ্ঞতায়) সমৃদ্ধ, তাকে নেতা বানানো হলে তা তার ও তাদের (জনগণের) জন্য কল্যাণকর; আর যে ফিকহ (তথা পোড় খাওয়া অর্থাৎ ইসলামের অভিজ্ঞতায়) সমৃদ্ধ না, তাকে দায়িত্ব দিলে তা তার ও তাদের জন্য ধ্বংসকারী।” (আল-দারিমি)
জীবন ও মৃত্যুর রহস্য
নিম্নে আল-ওয়াই ম্যাগাজিনে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধ দেওয়া হল, আরবি থেকে অনুবাদিত
জীবন একটি ছোট যাত্রা যা প্রতিটি প্রাণীর অনিবার্য মৃত্যুর সাথে শেষ হয়
১- মানুষ স্বভাবতই মৃত্যুকে ভয় পায় এবং এর আবির্ভাবের ব্যাপারে সতর্ক থাকে। এমনকি সে মৃত্যু থেকে পালাতে চায়, এর শক্তি থেকে বাঁচতে চেষ্টা করে। জীবনের অসংখ্য ঘটনা এই মানুষের এই প্রকৃতিকে প্রমাণ করে এবং মহান আল্লাহর কিতাবের অনেক আয়াতে (এ ব্যপারে) বলা হয়েছে:
أَلَمْ تَرَ إِلَى الَّذِينَ خَرَجُواْ مِن دِيَارِهِمْ وَهُمْ أُلُوفٌ حَذَرَ الْمَوْتِ فَقَالَ لَهُمُ اللّهُ مُوتُواْ ثُمَّ أَحْيَاهُمْ إِنَّ اللّهَ لَذُو فَضْلٍ عَلَى النَّاسِ وَلَكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لاَ يَشْكُرُونَ
তুমি কি তাদেরকে দেখনি, যারা মৃত্যুর ভয়ে নিজেদের ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন? অথচ তারা ছিল হাজার হাজার। তারপর আল্লাহ তাদেরকে বললেন মরে যাও। তারপর তাদেরকে জীবিত করে দিলেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ মানুষের উপর অনুগ্রহকারী। কিন্তু অধিকাংশ লোক শুকরিয়া প্রকাশ করে না [বাকারাহ: ২৪৩]
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন,
وَجَاءتْ سَكْرَةُ الْمَوْتِ بِالْحَقِّ ذَلِكَ مَا كُنتَ مِنْهُ تَحِيدُ
মৃত্যুযন্ত্রণা নিশ্চিতই আসবে, এ থেকেই তুমি টালবাহানা করতে [ক্বাফ: ১৯]
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন,
قُلْ إِنَّ الْمَوْتَ الَّذِي تَفِرُّونَ مِنْهُ فَإِنَّهُ مُلَاقِيكُمْ
বলুন, তোমরা যে মৃত্যু থেকে পলায়নপর, সেই মৃত্যু অবশ্যই তোমাদের মুখামুখি হবে [জুমু’আ: ৮]
قُل لَّن يَنفَعَكُمُ الْفِرَارُ إِن فَرَرْتُم مِّنَ الْمَوْتِ أَوِ الْقَتْلِ
বলুন! তোমরা যদি মৃত্যু অথবা হত্যা থেকে পলায়ন কর, তবে এ পলায়ন তোমাদের কাজে আসবে না। তখন তোমাদেরকে সামান্যই ভোগ করতে দেয়া হবে [আহযাব: ১৬]
এই আয়াতগুলো যেমন দেখিয়েছে যে মানুষ মৃত্যু থেকে পালানোর চেষ্টা করে, তেমনি এও দেখিয়েছে যে মৃত্যু থেকে পালানোর চেষ্টা করে কোন লাভ নেই, তা থেকে পালানোর কোন উপায় নেই, যেমনটি বলা হয়েছে, { তারপর আল্লাহ তাদেরকে বললেন ‘মরে যাও‘ } { মৃত্যুযন্ত্রণা নিশ্চিতই আসবে } { বলুন, তোমরা যে মৃত্যু থেকে পলায়নপর, সেই মৃত্যু অবশ্যই তোমাদের মুখামুখি হবে } { বলুন! তোমরা যদি মৃত্যু অথবা হত্যা থেকে পলায়ন কর, তবে এ পলায়ন তোমাদের কাজে আসবে না } { প্রত্যেককে মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করতে হবে } [আম্বিয়া: ৩৫] { অবশেষে যখন তোমাদের কারো কাছে মৃত্যু আসে তখন আমাদের দূতরা তাকে গ্রহণ করে, আর তারা (দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে) অবহেলা করে না } [আন’আম: ৬১]
প্রকৃতপক্ষে, আল্লাহ তাদেরকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছেন যে, যদি মৃত্যু তাদের কাছে আসে, তাহলে তা থেকে তারা নিজেদের রক্ষা করে দেখাক, যেমনটি তিনি সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন:
قُلْ فَادْرَءُوا عَنْ أَنفُسِكُمُ الْمَوْتَ إِن كُنتُمْ صَادِقِينَ
বলুন, “তাহলে তোমরা নিজেদের থেকে মৃত্যুকে দূরে রাখো, যদি তোমরা সত্যবাদী হও” [আলে ইমরান: ১৬৮]
তারা যদি মৃত্যু থেকে নিজেদের রক্ষা করার চেষ্টা করে অথবা তাদের সময় এসে পৌঁছালে তা থেকে পালানোর চেষ্টা করে, তবুও তারা তা থেকে পালাতে পারবে না, যেমন মহান আল্লাহর বাণী:
أَيْنَمَا تَكُونُوا يُدْرِككُّمُ الْمَوْتُ وَلَوْ كُنتُمْ فِي بُرُوجٍ مُّشَيَّدَةٍ
তোমরা যেখানেই থাক না কেন; মৃত্যু কিন্তু তোমাদেরকে পাকড়াও করবেই। যদি তোমরা সুদৃঢ় দূর্গের ভেতরেও অবস্থান কর, তবুও [আন-নিসা: ৭৮]।
যেমন নূহ (আ)-এর পুত্রও চেষ্টা করেছিল, কিন্তু সে নিজেকে রক্ষা করতে সফল হয়নি, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা তার সম্পর্কে বলেছেন:
قَالَ سَآوِي إِلَىٰ جَبَلٍ يَعْصِمُنِي مِنَ الْمَاءِ ۚ قَالَ لَا عَاصِمَ الْيَوْمَ مِنْ أَمْرِ اللَّهِ إِلَّا مَن رَّحِمَ ۚ وَحَالَ بَيْنَهُمَا الْمَوْجُ فَكَانَ مِنَ الْمُغْرَقِينَ
সে বলল, আমি অচিরেই কোন পাহাড়ে আশ্রয় নেব, যা আমাকে পানি হতে রক্ষা করবে। নূহ (আ) বল্লেন আজকের দিনে আল্লাহর হুকুম থেকে কোন রক্ষাকারী নেই। একমাত্র তিনি যাকে দয়া করবেন। এমন সময় উভয়ের মাঝে তরঙ্গ আড়াল হয়ে দাঁড়াল, ফলে সে নিমজ্জিত হল [হুদ: ৪৩]
৩- যদি মৃত্যু অনিবার্য হয়, তবে প্রতিটি প্রাণীই অনিবার্যভাবে এর তিক্ততার স্বাদ গ্রহণ করবে, বিষয়টি পবিত্র কুরআন আমাদের এমনভাবে নির্দেশনা দেয় যেমনটি চোখ আছে এমন সকলের কাছে সূর্যের অস্ত্বিত্ব একটি স্পষ্ট বিষয়, তাহলে কে মানুষকে মৃত্যুর তিক্ততার স্বাদ গ্রহণ করায় এবং কে এর মাধ্যমে প্রত্যেক প্রাণীর সমাপ্তি ঘটায়? পবিত্র কুরআন এই প্রশ্নের চূড়ান্ত উত্তর দেয় এই বলে যে, একমাত্র আল্লাহ তা’আলাই হলেন তিনি যিনি প্রতিটি প্রাণীর জন্য মৃত্যু নির্ধারণ করেছেন এবং তাদের বাধ্য করেছেন যে তারা এর পানপাত্র হতে পান করবে এবং তাঁর কর্তৃত্বের কাছে আত্মসমর্পণ করবে, যেমনটি আমরা উপরে উদ্ধৃত আয়াতগুলোতে ব্যাখ্যা করেছি।
৪- যদিও কেউ কেউ অস্বীকার করে যে তাদের সৃষ্টিকর্তা আছেন এবং তিনিই তাদের জীবন দান করেন এবং মৃত্যু ঘটান, তবুও তারা অস্বীকার করতে পারে না যে তাদের চোখের সামনে জীবন ও মৃত্যুর দুটি প্রক্রিয়া চলছে, লক্ষ লক্ষ নতুন জীবিত মানুষ, প্রাণী ও উদ্ভিদ এবং লক্ষ লক্ষ মৃত মানুষের মধ্যে। তবে, তারা এর জন্য সময় এবং অনন্তকালকে দায়ী করে, এ অস্বীকার করে যে এই পার্থিব জীবনের পরে আরেকটি জীবন আছে। এসব লোকদের বস্তুবাদী বলা হয়। পবিত্র কুরআন তাদের মিথ্যাচার লিপিবদ্ধ করেছে, যেমনটি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন:
وَقَالُوا مَا هِيَ إِلَّا حَيَاتُنَا الدُّنْيَا نَمُوتُ وَنَحْيَا وَمَا يُهْلِكُنَا إِلَّا الدَّهْرُ ۚ وَمَا لَهُم بِذَٰلِكَ مِنْ عِلْمٍ ۖ إِنْ هُمْ إِلَّا يَظُنُّونَ
তারা বলে, আমাদের পার্থিব জীবনই তো শেষ; আমরা মরি ও বাঁচি মহাকালই আমাদেরকে ধ্বংস করে। তাদের কাছে এ ব্যাপারে কোন জ্ঞান নেই। তারা কেবল অনুমান করে কথা বলে [আল-জাসিয়াহ: ২৪]
৫- আল্লাহ তাআলা কেবল প্রতিটি প্রাণীর জন্য মৃত্যু নির্ধারণ করেননি, বরং তিনি প্রতিটি প্রাণীর জন্য, পাশাপাশি প্রতিটি জাতির জন্য নিঃসন্দেহে একটি সময় নির্ধারণ করেছেন, যা বৃদ্ধি বা হ্রাস করে অতিক্রম করার ক্ষমতা কারও নেই। কুরআনের আয়াতগুলো স্পষ্টভাবে এ বিষয়টি প্রতিষ্ঠা করেছে। আল্লাহ তা’আলা বলেন:
وَمَا كَانَ لِنَفْسٍ أَن تَمُوتَ إِلَّا بِإِذْنِ اللَّهِ كِتَابًا مُّؤَجَّلًا
“আর আল্লাহর হুকুম ছাড়া কেউ মরতে পারে না-সেজন্য একটা সময় নির্ধারিত রয়েছে” [আলে ইমরান: ১৪৫], এবং তিনি সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন:
فَيُمْسِكُ الَّتِي قَضَىٰ عَلَيْهَا الْمَوْتَ وَيُرْسِلُ الْأُخْرَىٰ إِلَىٰ أَجَلٍ مُّسَمًّى
“অতঃপর যার মৃত্যু অবধারিত করেন, তার প্রাণ ছাড়েন না এবং অন্যান্যদের ছেড়ে দেন এক নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে” [আয-যুমার: ৪২] এবং তিনি সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন:
وَلَن يُؤَخِّرَ اللَّهُ نَفْسًا إِذَا جَاءَ أَجَلُهَا ۚ وَاللَّهُ خَبِيرٌ بِمَا تَعْمَلُونَ
“প্রত্যেক ব্যক্তির নির্ধারিত সময় যখন উপস্থিত হবে, তখন আল্লাহ কাউকে অবকাশ দেবেন না। তোমরা যা কর, আল্লাহ সে বিষয়ে খবর রাখেন” [আল-মুনাফিকুন: ১১] এবং তিনি সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন:
وَلِكُلِّ أُمَّةٍ أَجَلٌ ۖ فَإِذَا جَاءَ أَجَلُهُمْ لَا يَسْتَأْخِرُونَ سَاعَةً ۖ وَلَا يَسْتَقْدِمُونَ
“প্রত্যেক সম্প্রদায়ের একটি মেয়াদ রয়েছে। যখন তাদের মেয়াদ এসে যাবে, তখন তারা না এক মুহুর্ত পিছে যেতে পারবে, আর না এগিয়ে আসতে পারবে” [আল-আ’রাফ: ৩৪] তিনি সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন:
وَلَوْ يُؤَاخِذُ اللَّهُ النَّاسَ بِظُلْمِهِم مَّا تَرَكَ عَلَيْهَا مِن دَابَّةٍ وَلَٰكِن يُؤَخِّرُهُمْ إِلَىٰ أَجَلٍ مُّسَمًّى ۖ فَإِذَا جَاءَ أَجَلُهُمْ لَا يَسْتَأْخِرُونَ سَاعَةً ۖ وَلَا يَسْتَقْدِمُونَ
“যদি আল্লাহ লোকদেরকে তাদের অন্যায় কাজের কারণে পাকড়াও করতেন, তবে ভুপৃষ্ঠে চলমান কোন কিছুকেই ছাড়তেন না। কিন্তু তিনি প্রতিশ্রুতি সময় পর্যন্ত তাদেরকে অবকাশ দেন। অতঃপর নির্ধারিত সময়ে যখন তাদের মৃত্যু এসে যাবে, তখন এক মুহুর্তও বিলম্বিত কিংবা তরাম্বিত করতে পারবে না” (আন-নাহল: ৬১) আল্লাহ তা’য়ালা বলেন:
﴿قَالَ یَٰقَوۡمِ إِنِّی لَكُمۡ نَذِیرࣱ مُّبِینٌ 2 أَنِ ٱعۡبُدُوا۟ ٱللَّهَ وَٱتَّقُوهُ وَأَطِیعُونِ 3 یَغۡفِرۡ لَكُم مِّن ذُنُوبِكُمۡ وَیُؤَخِّرۡكُمۡ إِلَىٰۤ أَجَلࣲ مُّسَمًّىۚ إِنَّ أَجَلَ ٱللَّهِ إِذَا جَاۤءَ لَا یُؤَخَّرُۚ لَوۡ كُنتُمۡ تَعۡلَمُونَ﴾
“সে বলল, হে আমার সম্প্রদায়! আমি তোমাদের জন্যে স্পষ্ট সতর্ককারী। এ বিষয়ে যে, তোমরা আল্লাহ তা’আলার এবাদত কর, তাঁকে ভয় কর এবং আমার আনুগত্য কর। আল্লাহ তা’আলা তোমাদের পাপসমূহ ক্ষমা করবেন এবং নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অবকাশ দিবেন। নিশ্চয় আল্লাহ তা’আলার নির্দিষ্টকাল যখন হবে, তখন অবকাশ দেয়া হবে না, যদি তোমরা তা জানতে!” (নূহ ২-৪) সর্বশক্তিমান আল্লাহ বলেন:
أَوَلَمْ يَرَوْا أَنَّ اللَّهَ الَّذِي خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ قَادِرٌ عَلَىٰ أَن يَخْلُقَ مِثْلَهُمْ وَجَعَلَ لَهُمْ أَجَلًا لَّا رَيْبَ فِيهِ فَأَبَى الظَّالِمُونَ إِلَّا كُفُورًا
“তারা কি দেখেনি যে, যে আল্লাহ আসমান ও যমিন সৃজিত করেছেন, তিনি তাদের মত মানুষও পুনরায় সৃষ্টি করতে সক্ষম? তিনি তাদের জন্যে স্থির করেছেন একটি নির্দিষ্ট কাল, এতে কোন সন্দেহ নেই; অতঃপর জালেমরা অস্বীকার ছাড়া কিছু করেনি” [আল-ইসরা: ৯৯] সর্বশক্তিমান আল্লাহ বলেন:
ثُمَّ أَنشَأْنَا مِن بَعْدِهِمْ قُرُونًا آخَرِينَ ، مَا تَسْبِقُ مِنْ أُمَّةٍ أَجَلَهَا وَمَا يَسْتَأْخِرُونَ
এরপর তাদের পরে আমি বহু সম্প্রদায় সৃষ্টি করেছি, কোন সম্প্রদায় তার নির্দিষ্ট কালের অগ্রে যেতে পারে না এবং পশ্চাতেও থাকতে পারে না [আল-মু’মিনুন: ৪২-৪৩]
৬- যদি কিছু লোকের এই ভ্রান্ত ধারণা থাকে যে, আল্লাহ ব্যতীত অন্য কেউ এমন ব্যক্তির উপর মৃত্যু চাপিয়ে দিতে সক্ষম যার সময় এখনও আসেনি, তাহলে কুরআন এই ভ্রান্ত ধারণাকে বাতিল এবং খণ্ডন করতে এসেছে। ইব্রাহিম আলাইহিস সালামের সম্প্রদায় তাদের ধ্বংস করা মূর্তিগুলির প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য তাকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করেছিল। তারা তার জন্য আগুন জ্বালালো এবং তাকে তাতে নিক্ষেপ করলো, কিন্তু আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাকে তাদের চক্রান্ত এবং বিশ্বাসঘাতকতা থেকে রক্ষা করলেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন:
﴿قَالُوا۟ حَرِّقُوهُ وَٱنصُرُوۤا۟ ءَالِهَتَكُمۡ إِن كُنتُمۡ فَٰعِلِینَ 68 قُلۡنَا یَٰنَارُ كُونِی بَرۡدࣰا وَسَلَٰمًا عَلَىٰۤ إِبۡرَٰهِیمَ 69 وَأَرَادُوا۟ بِهِۦ كَیۡدࣰا فَجَعَلۡنَٰهُمُ ٱلۡأَخۡسَرِینَ 70 وَنَجَّیۡنَٰهُ وَلُوطًا إِلَى ٱلۡأَرۡضِ ٱلَّتِی بَٰرَكۡنَا فِیهَا لِلۡعَٰلَمِینَ﴾
“তারা বলল: একে পুড়িয়ে দাও এবং তোমাদের উপাস্যদের সাহায্য কর, যদি তোমরা কিছু করতে চাও। আমি বললাম: হে অগ্নি, তুমি ইব্রাহীমের উপর শীতল ও নিরাপদ হয়ে যাও। তারা ইব্রাহীমের বিরুদ্ধে ফন্দি আঁটতে চাইল, অতঃপর আমি তাদেরকেই সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্থ করে দিলাম। আমি তাঁকে ও লূতকে উদ্ধার করে সেই দেশে পৌঁছিয়ে দিলাম, যেখানে আমি বিশ্বের জন্যে কল্যাণ রেখেছি” (আল-আম্বিয়া: ৬৮-৭১)
যখন ইউনুস আলাইহিস সালাম রাগান্বিত হয়ে তাঁর কওম ছেড়ে একটি জাহাজের কাছে এলেন, যা তাঁকে তাঁর কওম থেকে অনেক দূরে নিয়ে যাচ্ছিল, তখন উত্তাল ঢেউয়ের কারণে জাহাজের তালমাতাল অবস্থা হয়েছিল এবং তার যাত্রীরা (কুসংস্কারবশতঃ) তাদের কাউকে (কুলক্ষনে মনে করে) সমুদ্রে ফেলে দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিল এই আশায় যে অন্যরা ডুবে যাওয়া থেকে রক্ষা পাবে। (এই প্রেক্ষাপটে) ইউনুস আলাইহিস সালামকে পানিতে নিমজ্জিত হয়েছিলেন এবং একটি তিমি তাকে গিলে নিয়েছিল, (যদিও তা) তার জন্য কবর ছিল না, বরং একটি জীবন্ত-নৌকায় পরিনত হয়েছিল যা তাকে ছায়া ও খাবার সহ নিরাপদ তীরে নিয়ে গিয়েছিল। পবিত্র কুরআন এই মহান ঘটনার কথা উল্লেখ করে:
﴿وَإِنَّ یُونُسَ لَمِنَ ٱلۡمُرۡسَلِینَ 139 إِذۡ أَبَقَ إِلَى ٱلۡفُلۡكِ ٱلۡمَشۡحُونِ 140 فَسَاهَمَ فَكَانَ مِنَ ٱلۡمُدۡحَضِینَ 141 فَٱلۡتَقَمَهُ ٱلۡحُوتُ وَهُوَ مُلِیمࣱ 142 فَلَوۡلَاۤ أَنَّهُۥ كَانَ مِنَ ٱلۡمُسَبِّحِینَ 143 لَلَبِثَ فِی بَطۡنِهِۦۤ إِلَىٰ یَوۡمِ یُبۡعَثُونَ 144 ۞ فَنَبَذۡنَٰهُ بِٱلۡعَرَاۤءِ وَهُوَ سَقِیمࣱ 145 وَأَنۢبَتۡنَا عَلَیۡهِ شَجَرَةࣰ مِّن یَقۡطِینࣲ﴾
“আর নিশ্চয়ই ইউনুস ছিলেন রসূলগণের অন্যতম। স্মরণ করো! তিনি বোঝাই করা জাহাজে গিয়ে উঠেছিলেন। তাই তিনি লটারী করেছিলেন, কিন্তু তিনিই হয়ে গেলেন নিক্ষিপ্তদের একজন। তখন একটি মাছ তাঁকে মুখে তুলে নিল, যখন তিনি নিজেকে ধিক্কার দিচ্ছিলেন। আর তিনি যদি তাসবীহকারীদের অন্তুর্ভুক্ত না হতেন — তাহলে তিনি তার পেটে রয়ে যেতেন পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত। তারপর আমরা তাঁকে এক বৃক্ষলতা শূন্য উপকূলে ফেলে দিলাম, আর তিনি ছিলেন অসুস্থ। তখন তাঁর উপরে আমরা জন্মিয়েছিলাম লাউজাতীয় গাছ” [আস-সাফফাত: ১৩৯-১৪৬]।
পবিত্র কুরআনে উল্লেখিত ষড়যন্ত্রের মধ্যে রয়েছে মক্কার মুশরিকরা যখন দারুন-নদওয়ায় আল্লাহর রাসূল (সা)-এর জীবনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছিল। অবশেষে তারা তাঁকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেয়। তারা এবং সমস্ত মানুষ বুঝতে পারেনি যে যদি সমস্ত সৃষ্টি কোনো কিছু দিয়ে কারো ক্ষতি করার জন্য একত্রিত হয় যা আল্লাহ তার জন্য নির্ধারণ করেননি, তবে তারা তা করতে সক্ষম হবে না। এবং যদি তারা সর্বসম্মতভাবে এমন ব্যক্তির জীবন শেষ করতে সম্মত হয় যার সময় এখনও আসেনি, তবে তারা তা করতে সক্ষম হবে না। অতএব, সর্বশক্তিমান আল্লাহ তাঁর নবীকে তাদের চক্রান্ত থেকে রক্ষা করেছিলেন এবং তাকে এবং তার সঙ্গী আবু বকর (রা.) কে রক্ষা করেছিলেন এবং রক্ষা করেছিলেন যতক্ষণ না তারা মদিনায় নুসরাহপ্রদাণকারীদের মাঝে সম্মানিত ও বিজয়ী হয়ে পৌঁছেছিলেন। আল্লাহু সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন:
وَإِذْ يَمْكُرُ بِكَ الَّذِينَ كَفَرُوا لِيُثْبِتُوكَ أَوْ يَقْتُلُوكَ أَوْ يُخْرِجُوكَ ۚ وَيَمْكُرُونَ وَيَمْكُرُ اللَّهُ ۖ وَاللَّهُ خَيْرُ الْمَاكِرِينَ
“আর স্মরণ করো! যারা অবিশ্বাস পোষণ করে তারা তোমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছিল যে তারা তোমাকে আটক করবে, অথবা তারা তোমাকে হত্যা করবে, অথবা তারা তোমাকে নির্বাসিত করবে। আর তারা ষড়যন্ত্র করেছিল, আর আল্লাহ্ও পরিকল্পনা করেছিলেন। আর পরিকল্পনাকারীদের মধ্যে আল্লাহ্ই শ্রেষ্ঠ” [আল-আনফাল: ৩০]।
আর তিনি সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন:
إِلَّا تَنصُرُوهُ فَقَدْ نَصَرَهُ اللَّهُ إِذْ أَخْرَجَهُ الَّذِينَ كَفَرُوا ثَانِيَ اثْنَيْنِ إِذْ هُمَا فِي الْغَارِ إِذْ يَقُولُ لِصَاحِبِهِ لَا تَحْزَنْ إِنَّ اللَّهَ مَعَنَا ۖ فَأَنزَلَ اللَّهُ سَكِينَتَهُ عَلَيْهِ وَأَيَّدَهُ بِجُنُودٍ لَّمْ تَرَوْهَا وَجَعَلَ كَلِمَةَ الَّذِينَ كَفَرُوا السُّفْلَىٰ ۗ وَكَلِمَةُ اللَّهِ هِيَ الْعُلْيَا ۗ وَاللَّهُ عَزِيزٌ حَكِيمٌ
যদি তোমরা তাকে (রসূলকে) সাহায্য না কর, তবে মনে রেখো, আল্লাহ তাঁর সাহায্য করেছিলেন, যখন তাকে কাফেররা বহিষ্কার করেছিল, তিনি ছিলেন দু’জনের একজন, যখন তারা গুহার মধ্যে ছিলেন। তখন তিনি আপন সঙ্গীকে বললেন বিষন্ন হয়ো না, আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন। অতঃপর আল্লাহ তার প্রতি স্বীয় সান্তনা নাযিল করলেন এবং তাঁর সাহায্যে এমন বাহিনী পাঠালেন, যা তোমরা দেখনি। বস্তুতঃ আল্লাহ কাফেরদের মাথা নীচু করে দিলেন আর আল্লাহর কথাই সদা সমুন্নত এবং আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময় [আত-তাওবা: ৪০]
ইহসান উল আ’মাল
কোন কাজকে হাসান (ভালো) করার জন্য ‘আল্লাহর জন্য নিয়তকে আন্তরিকভাবে বিশুদ্ধ করা এবং কাজটি শরীয়াহ (ইসলামী আইন) এর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হওয়া আবশ্যক। এই কারণে, শুরুর দিককার আলেমগণ (তাদের উপর আল্লাহর রহমত বর্ষিত হোক) এই মৌলিক নীতিগুলোকে একত্র (করে চিন্তা) করতেন।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার বাণীর ক্ষেত্রে:
الَّذِي خَلَقَ الْمَوْتَ وَالْحَيَاةَ لِيَبْلُوَكُمْ أَيُّكُمْ أَحْسَنُ عَمَلًا
যিনি মৃত্যু ও জীবন সৃষ্টি করেছেন তোমাদের যাচাই করতে যে তোমাদের মধ্যে কে কাজকর্মে শ্রেষ্ঠ। [মুলক ৬৭:২]
এই আয়াত সম্পর্কে আল-ফুদাইল বিন ‘ইয়াদ বলেন, এর অর্থ হল: আখলাসুহু (সর্বাধিক আন্তরিক) এবং আসওয়াবুহু (সর্বাধিক সঠিক)। তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল: ‘আখলাসুহু এবং আসওয়াবুহু বলতে কী বোঝায়?’ তিনি উত্তর দিয়েছিলেন: ‘যদি কর্মটি সঠিক হয় কিন্তু আন্তরিক না হয় তবে তা গৃহীত হয় না এবং যদি আন্তরিক হয় কিন্তু সঠিক না হয় তবে তা গৃহীত হবে না। যতক্ষণ না এটি আন্তরিক এবং সঠিক হয়, আন্তরিক হয় কারণ এটি সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর জন্য এবং সঠিক হয় কারণ এটি সুন্নাতের উপর নির্ভর করে’।
সাঈদ ইবনে জুবাইর বলেন: ‘কথা গ্রহণযোগ্য নয় যদি না কর্ম থাকে, নিয়তের অনুপস্থিতিতে বক্তব্য এবং কাজ গ্রহণযোগ্য হয় না, এবং বক্তব্য, কর্ম এবং নিয়ত গ্রহণযোগ্য নয় যদি না এ সবই সুন্নাহর সাথে একমত হয়’।
‘উমার ইবনুল খাত্তাব (রা.) নিম্নলিখিত দু’আ করতেন: ‘হে আল্লাহ, আমার প্রতিটি কাজকে সালিহ (সঠিক) করে দাও, এবং তা সম্পূর্ণরূপে তোমার জন্য করে দাও এবং এর কোন অংশই যেন তোমার জন্য ছাড়া না হয়’।
আর ইমাম মালিক (রহ.) সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি বলেছেন: ‘সুন্নাহ হলো নূহ (আ.)-এর নৌকা। যে এতে আরোহণ করল সে রক্ষা পেল এবং যে এ থেকে বিরত রইল সে ডুবে গেল’।
দা’ওয়াহ বাহক তার কর্মের নিখুঁততা এবং দা’ওয়াহর মাধ্যমে যাতে তার কোন পার্থিব লাভের সন্ধান না হয় সে ব্যপারটি নিশ্চিত করার জন্য সে সর্বোচ্চ মনোযোগ দেয় এবং সতর্কতার সাথে নিজেকে পাহারা দেয়। যদি সে তা না করে, তাহলে তার কর্মের কোন মূল্য থাকবে না এবং সে ক্ষতিগ্রস্তদের একজন হবে।
পবিত্র হাদিসে বলা হয়েছে:
যে ব্যক্তি জ্ঞান অর্জন করে যাতে সে পণ্ডিতদের সাথে প্রতিযোগিতা ও বিতর্ক করতে পারে, মূর্খদের সাথে তর্ক করতে পারে এবং মানুষকে তার ব্যক্তিত্বের দিকে আকৃষ্ট করতে পারে, আল্লাহ তাকে জাহান্নামে প্রবেশ করাবেন। (তিরমিযী, ইবনে হিব্বান প্রমুখ, তবে ইসনাদে দুর্বলতা রয়েছে)।
কর্মের পরিমাণের উপর নয়, কর্মকে নিখুঁত করার উপর মনোযোগ দিতে হবে। আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তায়ালা) বলেছেন,
لِيَبْلُوَكُمْ أَيُّكُمْ أَحْسَنُ عَمَلًا
যাতে তিনি তোমাদের পরীক্ষা করেন যে, তোমাদের মধ্যে কে কর্মে সর্বোত্তম [আল-মুলক ২]
তিনি (সুবহানাহু ওয়া তায়ালা) বলেননি: তোমাদের মধ্যে কে সবচেয়ে বেশি আমল করে তা দেখার জন্য।
মালিক বিন দীনার থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: ‘যারা (কাজে) সাদিক (সত্যবাদী/আন্তরিক) নয় তাদেরকে বলো, নিজেকে ক্লান্ত করো না!’ একবার আবু উমামাহ যখন একজন ব্যক্তির পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন যিনি সাজদাহ করছিলেন, তিনি বললেন: ‘কী চমৎকার সাজদাহ, যদি এটা তোমার ঘরেই করা হত’ এবং ফুদাইল বিন ইয়াদ বললেন: ‘এই ঘর (কা’বা) কতবার তাওয়াফ করা হয়েছে যখন অন্য একজন ব্যক্তি ‘দূরে অবস্থিত’ আছে যার কাছে তার (তথা তাওয়াফকারীর) চেয়ে অনেক বেশি সওয়াব রয়েছে?
এই সকল কারণে, সকল কাজ করার সময় বিশুদ্ধ আন্তরিকতা (ইখলাস) এবং ‘সর্বোত্তম নিয়ত’ পালন করা বাধ্যতামূলক। কারণ, কর্মের বৈধতা এবং বিশ্বজগতের রব (সুবহানাহু ওয়া তায়ালার) কাছে তা গ্রহণযোগ্য হওয়া নিয়তের (নিয়তের) উপর নির্ভর করে। হাদিসের ক্ষেত্রে:
إنما الأعمال بالنيّات ، وإنما لكل امريء مانوى
কর্ম কেবল নিয়তের উপর নির্ভর করে এবং প্রত্যেক ব্যক্তি তাই পাবে যা সে নিয়ত করেছে। (মুত্তাফাকুন আলাইহি)
এটা অদ্ভুত কিছু নয় যে, উলামাগণ এই হাদিসটিকে ইসলামের আবর্তিত এক-তৃতীয়াংশ হাদীসের প্রতিনিধিত্বকারী হিসেবে বিবেচনা করতেন। সালাফদের মধ্যে প্রাচীনতম উলামাগণ দ্বীনের বিষয় থেকে উদ্ভূত প্রতিটি বিষয়ে এই হাদিসটিকে প্রথমে এবং অগ্রভাগে স্থান দিতে পছন্দ করতেন, কারণ এটি সকল ধরণের বিষয়ের উপর সাধারণভাবে প্রযোজ্য।
তাদের দৃষ্টিতে ইখলাস বলতে বান্দাদের কর্মকাণ্ডকে প্রকাশ্য হোক বা গোপনে, একই রকম করে তোলা বোঝানো হয়েছে। ইমাম আল-হারিছ আল-মাহাসাবি (রহ.) বলেন: ‘সাদিক (সত্যবাদী/আন্তরিক ব্যক্তি) যদি নিজের হৃদয় সংশোধনের জন্য সৃষ্টির হৃদয় থেকে সমস্ত প্রশংসা হারিয়ে ফেলে, তাতে তার আপত্তি নেই। সে তার ভালো কাজ সম্পর্কে মানুষকে অবহিত করতে পছন্দ করে না, আর মানুষ তার খারাপ কাজ সম্পর্কে জানতে পারে তা ঘৃণা করে না।’ আর ইমাম আল-কুশাইরি (রহ.) বলেন: ‘আল-ইখলাস তার নিয়তের মাধ্যমে আল-হাক্ক (আল্লাহ) সুবহানাহু ওয়া তা’আলার আনুগত্যকে এককভাবে তুলে ধরে। এবং এভাবে তার আনুগত্যের মাধ্যমে সে কেবল আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করতে চায়, অন্য কিছু নয়, সেক্ষেত্রে তার নিয়তের লক্ষ্য সৃষ্টির দিকেই হোক যাতে সে মানুষের মধ্যে প্রশংসিত হয় অথবা সৃষ্টির কাছ থেকে ভালোবাসা ও প্রশংসা অর্জন করা হোক, অথবা অন্য যেকোনো দিক যা কেবল আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের লক্ষ্যে বাইরে পরিচালিত হয় (তা সে পরিহার করে)।
হাসান বিন আর-রাবী (রহ.) সম্মানিত ইমাম আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক (রহ.) এর জিহাদ সম্পর্কে বলেন: ‘মুসলিমদের মধ্য থেকে একজন মুখোশধারী সওয়ার যুদ্ধে বের হয়ে শত্রুদের মধ্য থেকে একজন সওয়ারকে হত্যা করে, যারা মুসলিমদের সাথে লড়াই করছিল। মুসলিমরা তখন তাকবীর (আল্লাহু আকবর) বলল এবং সে মানুষের মধ্যে প্রবেশ করল এবং কেউ জানল না যে সে কে। আমি তার পিছনে পিছনে গেলাম যতক্ষণ না তাকে বললাম যে আল্লাহর কসম, সে যেন তার মুখোশ খুলে ফেলে। এরপর আমি তাকে চিনতে পারলাম এবং বললাম: ‘আল্লাহ তোমার হাতে এত বড় বিজয় সহজ করে দিয়েছেন, তবুও তুমি কি নিজেকে লুকিয়ে রাখছো?’ তিনি উত্তর দিলেন: ‘যার জন্য আমি এটা করেছি, তার কাছ থেকে কিছুই গোপন নেই’।
ইবনে কুতাইবা তার ‘উয়ুন আল-আখবার’ গ্রন্থে বলেছেন: ‘মাসলামা বিন আব্দুল মালিক একটি দুর্গ অবরোধ করেছিলেন এবং এই দুর্গের দেয়ালে কিছু গর্ত ছিল। তাই লোকেরা চাইছিল কেউ যেন এর মধ্য দিয়ে প্রবেশ করে কিন্তু কেউ তা করেনি। তারপর সেনাবাহিনীর মধ্য থেকে একজন (অজানা) ব্যক্তি এসে তার মধ্য দিয়ে প্রবেশ করে এবং তারপর আল্লাহ তাঁর মাধ্যেম দুর্গটি উন্মুক্ত করে দেন যা বিজয়ের দিকে পরিচালিত করে। মাসলামা তখন চিৎকার করে বলেন: ‘যে ব্যক্তি গর্ত দিয়ে প্রবেশ করেছিল সে কোথায়?’ যখন কেউ তার কাছে আসেনি তখন তিনি আবার ডাকেন এবং প্রহরীকে নির্দেশ দেন যে ‘লোকটিকে যে সময়ে আসবে তখন যেন তাকে প্রবেশ করতে দেয়া হয়, কারণ তিনি তাঁর জন্য অপেক্ষা করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। পরে একজন ব্যক্তি প্রহরীটির কাছে গিয়ে আমীর (সেনাপ্রধান)-এর সাথে দেখা করার অনুমতি চায়। প্রহরী তাকে জিজ্ঞাসা করে যে সে কি গর্তের সৈনিক এবং তিনি উত্তরে বলেন: ‘আমি তোমাদের সবাইকে বলব সে কে’। এরপর প্রহরী মাসলামার কাছে যায় এবং তাকে সেই ব্যক্তির কথা জানায় যে এসেছে। মাসলামা তাকে প্রবেশের অনুমতি দিলেন এবং লোকটি তাকে বলল: ‘গর্তের সৈনিক তোমার কাছ থেকে তিনটি জিনিস দাবি করছে (অর্থাৎ শর্ত): তুমি তার নাম প্রচার করবে না, তাকে কিছু করার নির্দেশ দেবে না এবং তাকে জিজ্ঞাসা করবে না যে সে কে অর্থাৎ কোন গোত্রের ইত্যাদি।’ মাসলামা উত্তরে বলল: সে তা করতে পারে। তাই লোকটি বলল: ‘আমিই সেই ব্যক্তি’। তারপর এই ঘটনার পর থেকে মাসলামা এমন কোন নামাজ পড়তেন না কেবল এই বলে: ‘হে আল্লাহ, আমাকে গর্তের সৈনিকের সাথে উঠিয়ে নাও’।
উমর ইবনে আব্দুল আজিজ (রা.) কত সুন্দর উক্তি করেছিলেন যখন তিনি আল্লাহ তা’আলার প্রতি বিশুদ্ধ আন্তরিকতার পরিণতি সম্পর্কে কথা বলছিলেন এই বলে যে: ‘আল্লাহর তাঁর বান্দাদের প্রতি সাহায্য ও এর স্তর নিয়তের স্তরের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। সুতরাং যে তার নিয়ত পূর্ণ করেছে তার জন্য আল্লাহর সাহায্য পূর্ণ হয়েছে। যদি যে তার নিয়তে ব্যর্থ হয়, তার জন্য আল্লাহর সাহায্যও অসম্পূর্ণ হবে’।
ইখলাসের (আন্তরিকতার) লক্ষণ ও প্রকাশের মধ্যে রয়েছে সত্যের কাছে আত্মসমর্পণ করা, উপদেশ গ্রহণ করা এবং এমনকি যদি তা তার কাছে নিম্ন স্তরের বা নিচু বলয়ের বলে বিবেচিত কারো কাছ থেকেও আসে, যাতে সত্য অন্যদের দ্বারা তার কাছে প্রকাশিত হলেও তার বুকে কোনও টান বা সংকোচন অনুভব না হয়।
ইবনে হাজার (রহ.) তাঁর ‘তাহযীব আত-তাহযীব’ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন ‘উবাইদুল্লাহ বিন আল-হাসান আল-আনবারী’র কথা উল্লেখ করে, যিনি আল-বাসরার একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি ছিলেন, তাদের ‘উলামা ও বিচারকদের একজন। তিনি বর্ণনা করেছেন যে তাঁর ছাত্র ‘আব্দুর রহমান বিন মাহদী’ বলেছেন: ‘আমরা এক জানাযায় ছিলাম এবং তাকে একটি প্রশ্ন করা হয়েছিল এবং তিনি তার উত্তরে ভুল করেছিলেন। তাই আমি বললাম: আল্লাহ আপনার ব্যাপারটি সংশোধন করুন, সঠিক উত্তর হল ‘এরকম ও এরকম’। তিনি মাথা নিচু করে বললেন: তাহলে ফিরে আসুন, কারণ আমি নীচু হয়ে গেছি। হকের (সত্যের) উপর লেজ হওয়া আমার কাছে বাতিলের (মিথ্যার) উপর মাথা হওয়ার চেয়ে বেশি প্রিয়’।
ইখলাসের আরেকটি লক্ষণ হলো ফতোয়া বা আইনগত রায় প্রদানের ক্ষেত্রে অতিরঞ্জিত না হওয়া এবং এই কারণেই অনেক ‘সৎকর্মশীল পূর্বসূরী রায় প্রদানের ক্ষেত্রে অত্যন্ত সতর্ক থাকতেন এবং চাইতেন যে সেগুলো জিজ্ঞাসা করা না হোক।
‘আব্দুর রহমান বিন আবি লায়লা বলেন: ‘আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর একশ বিশ জন সাহাবীর সাথে দেখা করেছি। তাদের একজনকে একটি বিষয়ে প্রশ্ন করা হত এবং তিনি প্রশ্নটি অন্যজনের কাছে পৌঁছে দিতেন, এবং তারপর তিনি তা অন্যজনের কাছে পৌঁছে দিতেন, যতক্ষণ না বিষয়টি ‘প্রথমটি ব্যক্তির কাছে ফিরে আসে’।
অর্থাৎ, যে ব্যক্তি বৈঠকে রায় দিতে এবং তাকে ‘জিজ্ঞাসা করার’ বিষয়টি পছন্দ করে, সে এমন একজন যাকে জিজ্ঞাসা করার ‘যোগ্য’ বলে মনে করা হয় না।
বিশর বিন আল-হারিস (রহ.) ছিলেন সবচেয়ে বিশিষ্ট ‘উলামা’দের একজন এবং তিনি ‘আমি জানি না’ বলতে লজ্জা বা বিব্রত বোধ করেননি। একদিন আশ-শা’বীকে একটি বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বললেন: ‘আমি জানি না’। এরপর তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যখন তিনি ইরাকের জনগণের ফকীহ ছিলেন, তখন তিনি কি এই কথা বলতে লজ্জা পান যে তিনি জানেন না। তিনি উত্তর দিয়েছিলেন: ‘কিন্তু ফেরেশতারা লজ্জা বা বিব্রত হননি যখন তারা বলেছিলেন:
سُبْحَانَكَ لَا عِلْمَ لَنَا إِلَّا مَا عَلَّمْتَنَا
তুমি পবিত্র, তুমি আমাদের যা শিখিয়েছো তা ছাড়া আমাদের আর কোন জ্ঞান নেই (বাকারা ২:৩২)।
তাবাকাত আশ-শাফিয়াহ-তে নিম্নলিখিত বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে: আল-কাদী ‘ইজ্জউদ্দিন আল-হাকারি তাঁর একটি বইতে শেখ ‘ইজ্জউদ্দিন আব্দুস সালামের জীবনী বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন যে শেখ ‘ইজ্জউদ্দিন একবার একটি ফতোয়া (রায়) প্রদান করেছিলেন এবং তারপরে তার রায়ের ভুল তার কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এরপর তিনি মিশর ও কায়রোতে নিজের বিরুদ্ধে (জনগণকে) ডেকে বললেন: ‘যে ব্যক্তি অমুককে একটি রায় দিয়েছে, তোমরা তা অনুসারে আমল করো না, কারণ তা একটি ভুল’।
Taken from the book At-Taqarrub ilaa Allah
তাকওয়ার প্রকৃত অর্থ
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ حَقَّ تُقَاتِهِ وَلَا تَمُوتُنَّ إِلَّا وَأَنتُم مُّسْلِمُونَ
হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, যথাযথ ভয়। আর তোমরা আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পন করা ছাড়া মৃত্যুবরণ করো না। [আলে ইমরান ৩:১০৩]
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালা পবিত্র কুরআনে অসংখ্যবার তাকওয়ার ব্যপারে গুরুত্বারোপ করেছেন। তাকওয়া ইসলামে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চিন্তার মধ্যে একটি। তাকওয়ার মাধ্যমেই (মুসলিম) সমাজের মানুষ একে অপরের সাথে সম্পর্কিত হয়, তাদের কার্যাবলী সম্পাদন করার ক্ষেত্রে। তাকওয়ার বিশাল গুরুত্বের কারণে কুরআন ও সুন্নাহতে অসংখ্যবার মুসলিমদের জীবনে তাকওয়ার প্রাসঙ্গিকতা ও তাৎপর্যের প্রতি জোর দিয়ে বর্ণনা করা হয়েছে।
দুনিয়া ও আখেরাতে তাকওয়ার অবলম্বনের অসীম পুরস্কারের কথা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালা জোর দিয়ে আমাদের জানিয়েছেন। এ কারণে তাকওয়া অর্জন করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যাতে আমরা আল্লাহর সাহায্য বিজয় পেতে পারি।
দুর্ভাগ্যবশতঃ বুদ্ধিবৃত্তিক অধঃপতনের কারণে এই গুরুত্বপূর্ণ কনসেপ্টটি আমরা অবহেলা করে থাকি। কাফেররা ইসলামী আকীদা ও তাকওয়ার গুরুত্ব কত বেশি তা দূর অতীততের মত বর্তমান সময়েও বুঝতে পারে। কাফেররা বুঝে এই আকীদা ও তাকওয়াই কাফিরদের স্বার্থ আদায়ের ক্ষেত্রে মূল প্রতিবন্ধকতা। মুলত ইসলামী আকিদা ও তাকওয়াই মুসলিমদের মুল শক্তি। পশ্চিমারা তাই আগ্রাসন চালায় যাতে আমরা ইসলামী জীবন ব্যবস্থা থেকে দুনিয়াকে পৃথক করে ফেলি, তারা আগ্রাসন চালায় আমরা যাতে সেকুলারিজম কিংবা বহুত্ববাদ-এর চিন্তা দ্বারা আল্লাহর দ্বীনকে পরিবর্তন করে ফেলি। আল্লাহর দ্বীনকে অর্থনীতি, রাজনীতি ও সামাজিক সম্পর্ক থেকে পৃথক ইসলামকে শুধুমাত্র ব্যক্তিগত ইবাদত ও নৈতিকতার মাঝে সীমাবদ্ধ করে রাখি। আল্লাহর দ্বীনের বিরুদ্ধে কাফের ও তাদের দালালদের প্রতিনিয়ত ষড়যন্ত্রগুলোর ব্যাপারে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালা আমাদের সতর্ক করে বলেছেন-
يُرِيْدُوْنَ اَنْ يُّطْفِـُٔوْا نُوْرَ اللّٰهِ بِاَفْوَاهِهِمْ وَيَاْبَي اللّٰهُ اِلَّاۤ اَنْ يُّتِمَّ نُوْرَهٗ وَلَوْ كَرِهَ الْكٰفِرُوْنَ
তারা তাদের মুখের (ফুঁক) দ্বারা আল্লাহর নূরকে নির্বাপিত করতে চায়, কিন্তু আল্লাহ (সে ব্যপারে) অস্বীকৃতি জানিয়েছেন যে তিনি তাঁর নূর পরিপূর্ণ করা ছাড়া অন্য কিছু চান না, যদিও কাফিররা অপছন্দ করে। [তওবা ৯:৩২]
দুর্ভাগ্যবশত সেকুলারিজমের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে আল্লাহর দ্বীন থেকে দুনিয়াকে আলাদা করে যারা ব্যক্তিগত ইবাদত ও নৈতিকতা চর্চা করে অনেক সময় তাদেরকেই সমাজে আমরা মুত্ত্বাকী হিসেবে চিহ্নিত করি। দৃশ্যত এই সব ব্যক্তিবর্গ সালাত, রোজা, মসজিদে দান ও নিরাপদে একাকিত্ব জীবণ ধারণ করাকেই তাকওয়াবান হিসেবে মনে করে। অন্যদিকে এইসব ব্যক্তিবর্গ উম্মাহর জীবনে ইসলাম ফিরিয়ে আনার (পূণর্জাগরণ) কাজ থেকে নিজেকে আলাদা রাখে। পাশাপাশি এদের অনেকেই সুদের লেনদেন ও মিথ্যায় অভ্যস্ত এবং উম্মাহর পুনর্জাগরণে এদের কোনোই ভুমিকা দেখা যায় না।
সেকুলারিজমের প্রভাবের কারণেই ইসলামকে মানুষ অন্যান্য ধর্মগুলোর মতই মনে করে অথচ ইসলাম একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ জীবন ব্যবস্থা, ইসলাম মানুষের জীবনে প্রতিটি ক্ষেত্রেই সম্পূর্ণ সমাধান দিয়ে থাকে। বাস্তবে আমরা একজন সাধারণ মুসলিমকে সালাতের নিময়কানুনগুলো জিজ্ঞেস করলে সে সহজে উত্তর দিতে পারে। অন্যদিকে আমরা যদি ইসলামি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, চুক্তি ও কোম্পানি গঠনের শর’ঈ নিয়ম অথবা প্রতিনিয়ত মুসলিম উম্মাহর উপর কাফিরদের আগ্রাসন যেমন ইরাকে গণহত্যা, ফিলিস্তিনিতে গণহত্যার ব্যাপারে শরীয়ার হুকুম কী জিজ্ঞেস করি তাহলে তারা উত্তর দিতে ব্যর্থ হন। এগুলোর ব্যাপারে কি আল্লাহ কোন হুকুম প্রদান করেননি? আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা কি আমাদের দ্বীনকে স্বয়ংসম্পূর্ণ আকারে প্রদান করেননি? আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা কি পবিত্র কুরআনে বলেননি,
وَنَزَّلْنَا عَلَيْكَ الْكِتٰبَ تِبْيَانًا لِّكُلِّ شَيْءٍ وَّهُدًي وَّرَحْمَة لِلْمُسْلِمِيْنَ
আর আমি তোমার উপর কিতাব নাযিল করেছি প্রতিটি বিষয়ের স্পষ্ট বর্ণনাসহ, হিদায়াত, রহমত ও মুসলিমদের জন্য সুসংবাদস্বরূপ। [নাহল ১৬:৮৯]
তাকওয়া সম্পর্কে ভূল চিন্তা পরিহার করে এর মূল অর্থ আমাদের সবার অবশ্যই জানা উচিত। কুরআন ও সুন্নাহ অনুসারে তাকওয়া অর্থ আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার আদেশগুলো অনুসরণ করে এবং তিনি যা নিষেধ করেছেন তা থেকে বিরত থেকে জাহান্নামের আগুণ থেকে নিজেকে রক্ষা করা।
وَلِلّٰهِ مَا فِي السَّمٰوٰتِ وَمَا فِي الْاَرْضِ ؕ وَلَقَدْ وَصَّيْنَا الَّذِيْنَ اُوْتُوا الْكِتٰبَ مِنْ قَبْلِكُمْ وَاِيَّاكُمْ اَنِ اتَّقُوا اللّٰهَ ؕ وَاِنْ تَكْفُرُوْا فَاِنَّ لِلّٰهِ مَا فِي السَّمٰوٰتِ وَمَا فِي الْاَرْضِ ؕ وَكَانَ اللّٰهُ غَنِيًّا حَمِيْدًا
আল্লাহর জন্যই রয়েছে আসমানসমূহে যা আছে এবং যা আছে যমীনে। আর তোমাদের পূর্বে যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছে তাদেরকে এবং তোমাদেরকে আমি নির্দেশ দিয়েছি যে, তোমরা আল্লাহকে ভয় করে বেঁচে থাকো। আর যদি কুফরী কর তাহলে আসমানসমূহে যা আছে এবং যা আছে যমীনে সব আল্লাহরই। আর আল্লাহ অভাবহীন, প্রশংসিত। [নিসা ৪:১৩১]
তাকওয়া শব্দটি ওয়াকা-ইয়াকি শব্দ থেকে এসেছে এর অর্থ নিরাপত্তা তথা রক্ষা করা। অর্থাৎ আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার ক্রোধ ও শাস্তি হতে নিজেকে রক্ষা করা। তাকওয়া সেসব আমলের সাথে সম্পর্কযুক্ত যেসব আমল করলে আল্লাহ সন্তুষ্ট হন তা করা, আর যে কাজগুলো করলে তিনি অসন্তুষ্ট হন ঐ কাজগুলো থেকে নিজেকে বিরত রাখা, এর মাধ্যমেই তাকওয়া অর্জিত হয়।
আমাদের কাজ ও সম্পর্কগুলোতে আল্লাহু সুবহানাহু ওয়া তা’আলার ব্যপারে সচেতন থাকাই হচ্ছে মূলত তাকওয়া।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর শেষ খুতবায় বলেছিলেন: “আমি তোমাদের আল্লাহকে ভয় করতে বলি, তাঁর কথা শোনো ও মান্য করো।” আয়াত এবং হাদিস উভয়ই মুসলমানদের তাকওয়া অবলম্বনের নির্দেশ দিচ্ছে। একজন ব্যক্তির উচিত তাকওয়াকে নিজের এবং আল্লাহর (সুবহানাহু ওয়া তায়ালার) ক্রোধ ও অসন্তুষ্টির মধ্যে একটি পর্দা তথা প্রতিবন্ধকতা হিসেবে গ্রহণ করা। তাকওয়ার মাধ্যমে, একজন মুসলিম আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তায়ালার) আনুগত্য করার চেষ্টা করে এবং তাঁর নিষেধ থেকে বিরত থাকে।
আলী (রা:) পুত্র হাসান (রা:) বলেন,
মুত্ত্বাকী তারাই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালা যা করতে নিষেধ করেছেন তা থেকে তারা নিজেকে বিরত রাখে। আর আল্লাহ সুবাহানাহু ওয়া তা’আলা যা করতে আদেশ করেছেন তা তারা পালন করেন।
ওমর ইবনুল আব্দুল আজিজ বলেন,
দিনে রোজা রেখে এবং রাতে সালাত আদায়ের মাধ্যমে তাকওয়া অর্জন হয় না। অথবা রোজা ও সালাত একত্রে পালন করার মাধ্যমে তাকওয়া অর্জন হয় না। তাকওয়া হচ্ছে আল্লাহ সুবাহানাহু ওয়া তা’য়ালা যা হারাম করেছেন তা থেকে বিরত থাকা আর যা ফরজ করেছেন তা পালন করা। যারা তা করে তারাই কল্যাণ প্রাপ্ত হয়।
ইবনে জাওযীর তাফসীরের শুরুতে বিভিন্ন শব্দের অর্থ বলতে গিয়ে তাকওয়ার অর্থ বর্ণনা করেছেন – তাকওয়ার অর্থ আল্লাহর ভয়ে ভীত হয়ে সমস্ত কাজে আল্লাহর আনুগত্য করা এবং অবাধ্যতা থেকে নিজেকে বিরত রাখা। এতেই রয়েছে সকল কল্যাণ।
একজন সত্যিকারের মুত্তাকী আমল করার উদ্দ্যেশ্যে আল্লাহু সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালার পাঠানো কুরআন ও সুন্নাহতে বর্ণিত শর’ঈ জ্ঞানগুলোর বুঝ অর্জনের চেষ্টা করে। শরীয়াহর সঠিক জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে একজন ব্যক্তি বুঝতে পারবে তার কী করণীয়। এ কারণেই ইসলামকে সঠিক ভাবে বুঝতে হবে। যাতে সঠিক নিয়তের মাধ্যমে আমল করে আমরা আল্লাহু সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালাকে সন্তুষ্ট করতে পারি।
ইমাম আহমদ একজন সাহাবী বর্ণিত হাদিসে উল্লেখ করেন,
একজন ব্যক্তি জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল (সা), আমাকে কিছু উপদেশ দিন; রাসূল (সা) তাকে আল্লাহকে ভয় করতে উপদেশ দিলেন, কারণ এটিই সবকিছুর মূল। অন্য বর্ণনায় রাসুল (সা) বলেছেন, আল্লাহকে ভয় করো, আল্লাহভীতিতেই সকল কল্যাণ নিহিত আছে। আল্লাহু সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালা মুত্তাকিদের পাশে থাকার ওয়াদা করেছেন। আল্লাহু সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালা বলেন-
اِنَّ اللّٰهَ مَعَ الَّذِيْنَ اتَّقَوْا وَّالَّذِيْنَ هُمْ مُّحْسِنُوْنَ
নিশ্চয় আল্লাহ তাদের সাথে, যারা তাকওয়া অবলম্বন করে এবং যারা সৎকর্মশীল। [নাহল ১৬:১২৮]
তাছাড়া বিপদে তাকওয়ার কারণে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা দু:খ কষ্ট থেকে উদ্ধার করেন।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেন,
وَمَن يَتَّقِ اللَّهَ يَجْعَل لَّهُ مَخْرَجًا
আল্লাহকে যে ভয় করে তাকে আল্লাহ উত্তরণের পথ তৈরি করে দেন। [তালাক ৬৫:২]
আল্লাহ সুবাহানাহু ওয়া তা’য়ালা মুত্তাকীদের গুনাহগুলো ক্ষমা করার ওয়াদা করেছেন,
وَمَن يَتَّقِ اللَّهَ يُكَفِّرْ عَنْهُ سَيِّئَاتِهِ وَيُعْظِمْ لَهُ أَجْرًا
আর যে আল্লাহকে ভয় করে তিনি তার গুনাহসমূহ মোচন করে দেন এবং তার প্রতিদানকে মহান করে দেন। [তালাক ৬৫:৫]
আল্লাহ তাকওয়া অবলম্বনকারীদের জন্য সুসংবাদ দিয়েছেন। এই ধরণের লোকদের জন্য জান্নাতের সুসংবাদ নিশ্চিত করা হয়েছে, যারা তাদের কর্মকাণ্ডে আল্লাহকে তাদের প্রভু হিসেবে গ্রহণ করেছে তাদের জন্য বিশাল পুরস্কারের ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে।
إِنَّ الَّذِينَ اتَّقَوْا إِذَا مَسَّهُمْ طَائِفٌ مِّنَ الشَّيْطَانِ تَذَكَّرُوا فَإِذَا هُم مُّبْصِرُونَ
নিশ্চয় যারা তাকওয়া অবলম্বন করেছে যখন তাদেরকে শয়তানের পক্ষ থেকে কোন কুমন্ত্রণা স্পর্শ করে তখন তারা আল্লাহকে স্মরণ করে। তখনই তাদের দৃষ্টি খুলে যায়। [আ’রাফ ৭:২০১]
وَالَّذِي جَاءَ بِالصِّدْقِ وَصَدَّقَ بِهِ ۙ أُولَٰئِكَ هُمُ الْمُتَّقُونَ
যে সত্য নিয়ে আগমন করছে এবং যারা সত্যকে সত্য মেনে নিয়েছে; তারাই তো মুত্তাকী। [যুমার ৩৯:৩৩]
আল্লাহ সুবাহানাহু ওয়া তা’য়ালার ওয়াহি হতে স্পষ্টভাবে বোঝা যাচ্ছে ব্যক্তিগতভাবে নামাজ রোজা পালন ও ভালো আচার-ব্যবহার করলেই তাকওয়া অর্জিত হয় না। আল্লাহর দৃষ্টিতে মুত্তাকী তারাই যারা আল্লাহর অসন্তুষ্টি ও ক্রোধ থেকে রক্ষা করা জন্য আল্লাহর অবাধ্যতা থেকে নিজেকে বিরত রাখে। মুলত মুত্তাকীরাই আল্লাহর জন্য সালাত, রোজা, আল্লাহর রাস্তায় দান, মুল্যবোধ অর্জন ও ক্ষমার গুণ অর্জনের পাশাপাশি উম্মাহর কর্মকান্ডগুলোতে নিজেকে যুক্ত করে। এগুলো পালন করাই তাকওয়াবানের উদাহরণ।
আল্লাহ দ্বীনকে দুনিয়া পরিচালিত করার জন্য পাঠিয়েছেন, আলাদা করে রাখার জন্য নয়। তাছাড়া ইসলাম কোন বৈরাগ্যবাদ নেই। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, “ইসলামে কোন বৈরাগ্যবাদ নেই।
উমর ইবনুল খাত্তাব একবার নামাজরতদের দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, “তোমাদের কে কতবার মাথা উঁচু করে এবং নিচু করে, তা আমাকে ধোঁকা দেয় না। [প্রকৃত] দ্বীন হলো আল্লাহর দ্বীনের ব্যাপারে সতর্ক থাকা, আল্লাহ যা নিষিদ্ধ করেছেন তা থেকে বিরত থাকা এবং আল্লাহর অনুমতি ও নিষেধ অনুসারে কাজ করা।”
আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন,
“الدنيا سجن المؤمن وجنة الكافر”
“দুনিয়া মুমিনের জন্য কারাগার এবং কাফিরের জন্য জান্নাত।” (সহীহ মুসলিম, খণ্ড ৪,৭০৫৮)
এর অর্থ হল আমরা শরীয়তের কারাগারে বাস করছি, আমাদের প্রতিটি কাজই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার ওহীর উপর ভিত্তি করে। এর অর্থ হল আমাদের ইসলামকে সম্পূর্ণরূপে গ্রহণ করতে হবে এবং সমাজ, অর্থনীতি ও খিলাফত সম্পর্কিত নিয়মকানুনসহ এর সমস্ত নিয়মকানুন মেনে নিতে হবে। এর অর্থ এই নয় যে আমরা বিশ্বকে অস্বীকার করছি বরং শরীয়তের নিয়ম অনুসারে আমরা বস্তুগত উন্নয়ন ও অগ্রগতি অর্জনের চেষ্টা করব।
ইমাম ইবন হাজার আল আসকালানী (মৃত্যু ৮৫২ হিজরি) সহীহ আল বুখারীর ব্যখ্যা ‘ফাতহ আল বারী’তে লিখেছেন, তিনি তাঁর বিশাল দলবল নিয়ে শহরের মধ্য দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন, তখন তাদের সাথে একজন হতভাগ্য, দরিদ্র এবং হতাশ ইহুদীর সাথে দেখা হলো। ইহুদীটি যখন ইবনে হাজারকে চিনতে পারল, তখন সে তাকে ডেকে বলল, “হে ইসলামের পণ্ডিত! এটা কি সত্য নয় যে তোমাদের নবী বলেছেন যে, এই জীবন মুমিনের জন্য কারাগার এবং কাফিরের জন্য জান্নাত? তোমরা তথাকথিত মুমিন হয়েও বিশাল সম্পদে বাস করছো, অথচ আমি এই ক্ষুদ্র ও দুর্বিষহ জীবনযাপন করছি?” ইবনে হাজার উত্তরে বললেন, “তুমি নবী (সা) সম্পর্কে যা বলেছো তা সত্য। তোমার জানা উচিত যে, তুমি যে ঐশ্বর্যের মধ্যে আমাকে বাস করতে দেখছো, তা আখেরাতে আমার জন্য যা অপেক্ষা করছে তার তুলনায় এক কারাগার। আর তোমার জানা উচিত যে, তুমি যেভাবে বাস করছো তা আল্লাহ তোমার জন্য আখিরাতে যা প্রস্তুত করেছেন তার তুলনায় জান্নাত।”
আমাদের অবশ্যই বুঝতে হবে যে, প্রতিটি মুসলিমের জন্য ইসলামী শরীয়াহর উপর সম্পূর্ণ ঈমান আনা বাধ্যতামূলক, অন্যথায় আমরা কাফির হয়ে যাব। অতএব, সেকুলার বহুত্ববাদ এর চিন্তা অর্থাৎ দ্বীনকে দুনিয়া থেকে পৃথক করা একটি কুফরী ধারণা। যা আহকাম শরীয়াহকে সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করে। সামগ্রিকভাবে আহকাম শরিয়াকে অস্বীকার করা কুফরির সমান। তাছাড়া শরীয়াহর যেকোনো নিশ্চিত (ক্বাত’ঈ) বিস্তারিত হুকুমকে অস্বীকার করা কুফরী। এটি ইবাদত সংক্রান্ত আহকাম, লেনদেন (মু’আমালাত), শাস্তি (উকুবাত), খাদ্যদ্রব্য যে বিধানই হোকনা কেন, তা অস্বীকার করা কুফরি।
উল্ল্যেখিত আয়াতটি অস্বীকার করা,
وَأَقِيمُوا الصَّلَاةَ
আর তোমরা সালাত প্রতিষ্ঠা কর [বাকারাহ ২:৪৩]
নিন্মোক্ত আয়াতগুলো অস্বীকার করার সমান,
وَأَحَلَّ اللَّهُ الْبَيْعَ وَحَرَّمَ الرِّبَا
আর আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করেছেন এবং সুদকে করেছেন হারাম [বাকারাহ ২:২৭৫]
وَالسَّارِقُ وَالسَّارِقَةُ فَاقْطَعُوا أَيْدِيَهُمَا
আর চোর নারী হোক কিংবা পুরুষ, চুরি করলে তাদের হাতগুলো কেটে দাও.. [মায়েদাহ ৫:৩৮]
জাতীয়তাবাদ দ্বারা আবদ্ধ হয়ে বর্ণ ও ভাষার বৈচিত্র্য আলাদা হয়ে মুসলিমকে ভাই হিসেবে না দেখা,
নিন্মলিখিত আয়াতটি অস্বীকার করার সমান,
إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ إِخْوَةٌ
সকল বিশ্বাসীরা তো পরস্পর ভাই ভাই [হুজুরাত ৪৯:১০]
সুতরাং ইরাক, ফিলিস্তিন ও ইরাকের মুসলমানরা যেমন আমাদের ভাই একইভাবে দিল্লি, ব্যাংকক বা জাকার্তার মুসলমানরাও আমাদের ভাই।
অথবা আল্লাহ যা নাজিল করেছেন তার মাধ্যমে শাসন করার সাথে সম্পর্কিত আয়াত, যা আমরা আজ মুসলিম বিশ্বের শাসকদের উপেক্ষা করতে দেখি, যেমন,
وَمَن لَّمْ يَحْكُم بِمَا أَنزَلَ اللَّهُ فَأُولَٰئِكَ هُمُ الظَّالِمُونَ
আর আল্লাহ যা নাযিল করেছেন, তার মাধ্যমে যারা ফয়সালা করবে না, তারাই যালিম [মায়েদা ৫:৪৫]
فَاحْكُم بَيْنَهُم بِمَا أَنزَلَ اللَّهُ ۖ وَلَا تَتَّبِعْ أَهْوَاءَهُمْ عَمَّا جَاءَكَ مِنَ الْحَقِّ
আল্লাহ যা নাযিল করেছেন সে অনুযায়ী আপনি তাদের বিচার নিষ্পত্তি করুন এবং যে সত্য আপনার নিকট এসেছে তা ছেড়ে তাদের খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করবেন না [মায়েদা ৫:৪৮]
বস্তুত, আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালা) কুরআনে আমাদের স্পষ্টভাবে বলেছেন যে আমরা ইসলামের সমস্ত নিয়ম মেনে না নিলে আমরা মুমিন নই। তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালা) বলেছেন,
فَلَا وَرَبِّكَ لَا يُؤْمِنُونَ حَتَّىٰ يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لَا يَجِدُوا فِي أَنفُسِهِمْ حَرَجًا مِّمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوا تَسْلِيمًا
অতএব তোমার রবের কসম, তারা মুমিন হবে না যতক্ষণ না তাদের মধ্যে সৃষ্ট বিবাদের ব্যাপারে তোমাকে বিচারক নির্ধারণ করে, তারপর তুমি যে ফয়সালা দেবে সে ব্যাপারে নিজেদের অন্তরে কোন দ্বিধা অনুভব না করে এবং পূর্ণ সম্মতিতে মেনে নেয়। [নিসা ৪:৬৫]
আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তায়ালা) আমাদেরকে ইসলামকে আংশিকভাবে গ্রহণ করার ব্যাপারে সতর্ক করেছেন। যদি আমরা মনে করি রাজনীতি ইসলামের অংশ নয়, অর্থনীতি ইসলামের অংশ নয়, অথবা বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতি সম্পর্কে ইসলামের কিছু বলার নেই, তাহলে তিনি আমাদের শাস্তির জন্য অপেক্ষা করতে বলেছেন। আমাদের অবশ্যই ইসলামকে আকীদা এবং একটি ব্যবস্থা হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তায়ালা) বলেছেন:
أَفَتُؤْمِنُونَ بِبَعْضِ الْكِتَابِ وَتَكْفُرُونَ بِبَعْضٍ ۚ فَمَا جَزَاءُ مَن يَفْعَلُ ذَٰلِكَ مِنكُمْ إِلَّا خِزْيٌ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا ۖ وَيَوْمَ الْقِيَامَةِ يُرَدُّونَ إِلَىٰ أَشَدِّ الْعَذَابِ ۗ وَمَا اللَّهُ بِغَافِلٍ عَمَّا تَعْمَلُونَ
তবে কি তোমরা কিতাবের কিছু অংশে ঈমান আন এবং কিছু অংশে কুফরী কর? তাহলে তোমাদের যারা এরূপ করে তাদের একমাত্র প্রতিফল দুনিয়ার জীবনে লাঞ্ছনা ও অপমান এবং কেয়ামতের দিন তাদেরকে ফিরিয়ে নেয়া হবে কঠিনতম শাস্তির দিকে। আর তারা যা করে আল্লাহ সে সম্পর্কে গাফিল নন। [বাকারা ২:৮৫]
আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তায়ালা) আমাদের কাছে দুনিয়ার বিষয়গুলো পরিচালনার জন্য সর্বোত্তম ব্যবস্থা নাজিল করেছেন, তাহলে আমাদের অনেকেই কেন এটি সম্পর্কে অবগত নই?
আসুন আমরা সাহাবীগণের তাকওয়ার কিছু উদাহরণ দেখি:
আল-বুখারী ইবনে আবি আওফা (রা.) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন:
“খায়বারের রাতে আমরা প্রচণ্ড ক্ষুধায় কাতর হয়ে পড়েছিলাম। খায়বারের দিন আমরা কিছু গৃহপালিত গাধা পেয়েছিলাম, তাই আমরা সেগুলো জবাই করেছিলাম। যখন হাঁড়িগুলো ফুটতে শুরু করল, তখন আল্লাহর রাসূলের আহবানকারী আমাদের ডেকে বললেন: তোমাদের হাঁড়িগুলো উল্টে দাও এবং গাধার মাংস খেও না। ‘আবদুল্লাহ বলেন: রাসুল (সা) এগুলো নিষেধ করেছেন কারণ এগুলো হতে খুমুস (অর্থাৎ গনীমতের এক পঞ্চমাংশ) বের করা হয়নি। তিনি বলেন, অন্যরা বলেছেন যে তিনি এগুলো সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করেছেন। আমি সাঈদ বিন জুবাইরকে জিজ্ঞাসা করলাম, তিনি বলেছেন, তিনি এগুলো সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করেছেন।”
আনাস বিন মালিকের বর্ণনা: “আমি আবু তালহা আল আনসারী, উবাইদা বিন আল-জাররাহ এবং উবাই বিন কা’বকে কাঁচা খেজুর এবং তাজা খেজুর দিয়ে তৈরি পানীয় পরিবেশন করছিলাম, এমন সময় একজন দর্শনার্থী এসে বলল: অবশ্যই মদ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তখন আবু তালহা বললেন: হে আনাস! উঠে দাঁড়াও এবং এই কলসিটি ভেঙে ফেল। আমি উঠে দাঁড়িয়ে একটি সূক্ষ্ম পাথর ধরে কলসিটির নীচের অংশ দিয়ে আঘাত করলাম যতক্ষণ না এটি ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল।” আল বুখারী বর্ণনা করেছেন,
আল-বুখারীতে আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: “আমাদের আরও বলা হয়েছে যে, যখন আল্লাহ তা’আলা এই নির্দেশ নাজিল করেন যে, মুসলমানরা হিজরতকারী বিবাহিত মুসলিম মহিলাদের খরচ যেন মুশরিকদের ফেরত দেয় (ইসলাম গ্রহণের পর) মুসলমানরা যেন কাফের নারীদের তাদের স্ত্রী হিসেবে না রাখে, তখন উমর (রা.) তার দুই স্ত্রীকে তালাক দেন।
আল-বুখারীতে আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন- আল্লাহ মুহাজির নারীদের উপর রহম করুন।” যখন আল্লাহ এই আয়াতটি নাজিল করলেন:
তারা যেন তাদের ওড়না দিয়ে বক্ষদেশকে আবৃত করে রাখে [নূর ২৪:৩১]। তারা তাদের কাপড় ছিঁড়ে ফেলেন এবং সেগুলো দিয়ে নিজেদের আবৃত করেন।”
আবু দাউদ সাফিয়া বিনতে শায়বা থেকে বর্ণনা করেছেন, যিনি আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণনা করেছেন যে:
তিনি তথা ‘আয়েশা (রা.) আনসারী নারীদের কথা উল্লেখ করলেন, তাদের প্রশংসা করলেন এবং তাদের সম্পর্কে ভালো কথা বললেন। তারপর বললেন: “যখন সূরা আন-নূর নাযিল হলো, তখন তারা পর্দাগুলো নিল, সেগুলো ছিঁড়ে ফেলল এবং সেগুলো দিয়ে মাথার ওড়না তৈরি করল।”
ইবনে ইসহাক বলেন: “…আল-আশ’আছ বিন কায়স কিন্দাহ প্রতিনিধি দলের অংশ হিসেবে আল্লাহর রাসূলের কাছে এসেছিলেন। আয-যুহরি আমাকে জানিয়েছেন যে তিনি কিন্দাহ থেকে আশি জন আরোহী নিয়ে এসেছেন। তারা রাসূলের মসজিদে প্রবেশ করেছিলেন। তাদের চুল লম্বা ছিল এবং তারা (চোখে) সুরমা লাগিয়েছিলেন। তারা রেশমের আবরণযুক্ত জুব্বা পরতেন। যখন তারা আল্লাহর রাসূলের কাছে প্রবেশ করেন, তখন তিনি তাদের বলেন: তোমরা কি ইসলাম গ্রহণ করনি? তারা বলল: হ্যাঁ। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন: ‘তাহলে তোমাদের গলায় এই রেশমটি কী? তখন তারা রেশমটি ছিঁড়ে ফেলে দিল।”
হানযালাহ বিন আবি ‘আমির (রা.) যাকে ফেরেশতারা গোসল করিয়েছিলেন, তিনি উহুদের যুদ্ধের ডাক শুনতে পান। তিনি দ্রুত ডাকে সাড়া দেন। উহুদের দিনে তিনি শহীদ হন। ইবনে ইসহাক বলেন: রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
তোমাদের সাথীকে ফেরেশতারা গোসল করাচ্ছেন, তার পরিবারকে জিজ্ঞাসা করো তার কী হয়েছে?” তার স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল। সে রাতে সে বিয়ের কনে ছিল। সে বলল তিনি আহবান শুনে অপবিত্র অবস্থায় বেরিয়ে গেছেন। আল্লাহর রাসূল (সা.) বললেন, “এজন্যই ফেরেশতারা তাকে গোসল করিয়েছে।”
তাই আসুন আমরা প্রকৃত অর্থে তাকওয়া অর্জন করি। আসুন আমরা ইসলামকে সম্পূর্ণরূপে গ্রহণ করি। আসুন আমরা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালার বাণীতে মনোযোগ দিই এবং তিনি আমাদেরকে শক্তিশালী করুন যাতে আমরা তাঁর অনুসরণ করতে পারি। তিনি সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালা বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا ادْخُلُوا فِي السِّلْمِ كَافَّةً وَلَا تَتَّبِعُوا خُطُوَاتِ الشَّيْطَانِ ۚ إِنَّهُ لَكُمْ عَدُوٌّ مُّبِينٌ
হে মুমিনগণ, তোমরা ইসলামে পূর্ণরূপে প্রবেশ কর এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না । নিশ্চয় সে তোমাদের জন্য স্পষ্ট শত্রু। [বাকারা ২:২০৮]