অনুন্নত দেশের প্রযুক্তিগত উন্নয়ন, মেধা পাচার ও ভবিষ্যৎ রূপরেখা

খবর:

বিএসসি প্রকৌশলীদের প্রতি বৈষম্য নিরসনের তিন দফা দাবিতে চট্টগ্রামে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছেন চুয়েট, চবি, আইআইইউসি সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। শনিবার (৫ জুলাই) বিকাল ৪টায় নগরীর ২ নং গেইট এলাকায় তারা এই প্রতিবাদ সমাবেশ পালন করেন। 

এ সময় বিক্ষোভ মিছিলে হাজারো শিক্ষার্থীদের ‘আমার সোনার বাংলায়, বৈষম্যের ঠাঁই নাই’; ‘কোটা না মেধা, মেধা, মেধা’; ‘কোটার নামে বৈষম্য, চলবে না, চলবে না’; ‘এই মুহূর্তে দরকার, কোটাপ্রথার সংস্কার’ প্রভৃতি স্লোগান দিতে দেখা যায়।

২ নং গেইট থেকে শুরু হয়ে জিইসি মোড় ঘুরে আবার উৎপত্তিস্থলে ফেরত আসে মিছিলটি। এরপর অনুষ্ঠিত সমাবেশে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন দাবিতে বক্তব্য দেয়া শুরু করেন। এ সময় তারা তাদের পূর্বে উত্থাপিত তিন দফা দাবি তুলে ধরেন— প্রকৌশল নবম গ্রেডে সহকারী প্রকৌশলী বা সমমান পদে প্রবেশের জন্য সবাইকে পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হওয়া এবং বিএসসি ডিগ্রিধারী হওয়া, কারিগরি দশম গ্রেডে উপ-সহকারী প্রকৌশলী বা সমমান পদ সবার জন্য উন্মুক্ত করা এবং বিএসসি ডিগ্রীধারী ব্যতীত অন্য কেউ ‘প্রকৌশলী’ পদবি ব্যবহার করতে পারবে না মর্মে আইন পাশ করে গেজেট প্রকাশ করা। এই তিন দফা দাবি দ্রুত কার্যকর করার দাবি জানান শিক্ষার্থীরা।

তাদের মতে, ডিপ্লোমা ডিগ্রিধারীদের প্রভাবশালী গোষ্ঠীর কারণে প্রকৌশল পেশায় বিএসসি ডিগ্রিধারীরা পদোন্নতি ও নিয়োগে ন্যায্যতা থেকে অনেকদিন ধরেই বঞ্চিত হয়ে আসছেন। দীর্ঘ ৪ বছর কঠিন পাঠ্যক্রম, ল্যাব, থিসিস ও প্রজেক্টের মধ্য দিয়ে পাস করা বিএসসি ডিগ্রিধারী প্রকৌশলীরা চাকরির বাজারে চরম বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। সরকারি চাকরির দশম গ্রেডে একচেটিয়া শতভাগ ডিপ্লোমা ডিগ্রিধারীদের নিয়োগ এবং নবম গ্রেডে পদোন্নতিতে ৩৩.৩ শতাংশ কোটা বরাদ্দ করা আছে ডিপ্লোমা ডিগ্রিধারীদের জন্য। অধিকন্তু নবম গ্রেডে পদোন্নতির ক্ষেত্রে কোটার ব্যবস্থা ৫০ শতাংশ করার অন্যায্য দাবিও জানিয়ে আসছিলেন তারা। 

এ সময় প্রকৌশলী অধিকার আন্দোলন এর যুগ্ম আহ্বায়ক শাকিল আহমাদ ইকবাল বলেন, ‘যেই কোটার জন্য আমাদের গত জুলাইয়ে আন্দোলন করতে হয়েছে, সেই কোটার জন্য এক বছর পর আবার আন্দোলনে নামতে হচ্ছে। ডিপ্লোমারা ১০ম গ্রেড সরাসরি নিজেদের করে নিয়েছে, এখন ৯ম গ্রেডে ৩৩% কোটার নামে অনেক জায়গায় ১০০% প্রমোশন নিয়ে নিচ্ছে। এভাবে কোটার মাধ্যমে কেউ বিশেষ সুবিধা পেতে পারে না।’

এই আন্দোলনের মুখ্য সংগঠক শাকিবুল হক লিপু বলেন, ‘ডিপ্লোমাদের বিএসসি সার্টিফিকেট নেই। এভাবে প্রকৌশলী না হয়েও তারা প্রকৌশলীদের জন্য বরাদ্দকৃত চাকরির পোস্টসমূহ নিয়ে নিচ্ছে। চার বছর কষ্ট করে, পরিশ্রম করে বিএসসি ডিগ্রী অর্জন করতে হয়। এরপর এমন বৈষম্য মেনে নেয়া যায় না। এভাবে চলতে পারে না। আমরা তাই আমাদের নিজেদের দাবি আদায়ে মাঠে নেমেছি।’

বিক্ষোভকারী চুয়েট শিক্ষার্থী আমিনুল ইসলাম তার বক্তব্যে বলেন, ‘সমবাহু ত্রিভূজের ক্ষেত্রফল নির্ণয় শিখে এসে ডিপ্লোমারা প্রকৌশলের জন্য বরাদ্দকৃত পদ নিচ্ছে। এদিকে চার বছরে কঠিন কঠিন কোর্স শেষ করে আমরা চাকরিই পাচ্ছি না। আমাদেরকে আবেদন করা থেকেই বঞ্চিত করা হচ্ছে। বিসিএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণ না করে সমমর্যাদার পদ বাগিয়ে নিচ্ছে। স্বাধীন বাংলায় এমন বৈষম্য মেনে নেয়া যায় না।’

একই বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষার্থী মাহফুজুর রহমান মোহাব্বত বলেন, ‘পেশিশক্তি ও লবিংয়ের মাধ্যমে অবৈধ পদোন্নতি পাচ্ছে ডিপ্লোমারা। নিয়ম ভেঙে পদ সৃষ্টি করা হচ্ছে। চরম মাত্রার অনিয়ম চলছে। এগুলোর প্রমাণও রয়েছে। এরকম করেও তারা পার পেয়ে যাচ্ছে। এমনটা হতে পারে না। সরকারের উচিত দ্রুত উপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়া। বৈষম্য দূর করা। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সমাবেশ হচ্ছে। সবাই প্রকৌশলীই এই দাবির পক্ষে সোচ্চার।’

মন্তব্য:

দেশে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারদের প্রতি বৈষম্য যে হচ্ছে, সেটা অবশ্যই সত্য। কিন্তু প্রশ্ন হলো,এই বৈষম্য দূর হলেই কি তারা তাদের প্রাপ্য সম্মান ও মূল্য পাবে? এই রাষ্ট্র কি এমন কোনো ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট করেছে, যেখানে এই উচ্চশিক্ষিত ইঞ্জিনিয়াররা দেশের নিজস্ব ইন্ডাস্ট্রিতে দক্ষতা ও মেধা কাজে লাগাতে পারবে? আসলে, এই দেশে এমন কোনো শক্তিশালী শিল্পখাতই নেই, যেখানে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারদের নলেজ বা স্কিল প্রপারলি কাজে লাগবে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেই কাজ ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার বা টেকনিশিয়ান দিয়েই চালানো সম্ভব।

বাংলাদেশের ছাত্রছাত্রীরা বিশ্বের নানা প্রান্তে গিয়েও বিশ্বমানের কাজ করছে গুগল, মাইক্রোসফট, আমাজন, স্পেসএক্স থেকে শুরু করে ইউরোপের বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান পর্যন্ত। আমাদের ইঞ্জিনিয়াররা, সফটওয়্যার ডেভেলপাররা, ডাক্তাররা বিশ্বের বাজারে highly valued।

তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে এই সক্ষমতা আমরা নিজের দেশে ব্যবহার করতে পারছি না কেন? এই সক্ষমতাকে কাজে লাগানোর মতো কোনো ভিশন আমাদের রাষ্ট্র দেয় না।

এখানে আসল সমস্যা ডিপ্লোমা বনাম বিএসসি নয়, আসল সমস্যা হচ্ছে এই রাষ্ট্রীয় কাঠামো নিজেই একটা ভাঙা কাঠামো, যা কোনো বাস্তব ভিত্তির ওপর গড়ে ওঠেনি।

এই কাঠামোটি গড়ে তোলা হয়েছে পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থার (Capitalism) শর্ত ও নির্দেশনা অনুযায়ী। পুঁজিবাদ এর প্রধান ধারক-বাহক পশ্চিমা দেশগুলা আমাদের শিক্ষিত, মেধাবী জনগোষ্ঠীকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করছে। তারা আমাদের জন্য উন্নয়নের আশ্বাস দেয়, কিন্তু আসলে এমন একটি কাঠামো তৈরি করে রেখেছে যেখানে আমরা চিরকাল পরনির্ভরশীলই থেকে যাই।

এই সমস্যাগুলোর গোড়ায় আছে রাষ্ট্রীয়ভাবে অনুসৃত দাসসুলভ পলিসি, যা আমাদের শিক্ষা, শিল্প, গবেষণা সব কিছুকে নিয়ন্ত্রণ করে পশ্চিমা কর্পোরেট ও সংস্থাগুলোর স্বার্থ অনুযায়ী। যেমন বিশ্বব্যাংক, IMF, WTO এরা আমাদের দেশের পলিসিতে এমন সব শর্ত দিয়ে থাকে, যাতে আমরা নিজস্ব শিল্প, প্রযুক্তি বা উৎপাদনব্যবস্থা গড়ে তুলতে না পারি। স্থানীয় প্রোডাকশন ও রিসার্চ বন্ধ হয়ে যায়, আর আমাদের ইঞ্জিনিয়াররা হয় কাঁচামাল ও সস্তা শ্রমের যোগানদাতা। এর ফলে আমাদের দেশ থেকে প্রতিবছর হাজার হাজার মেধাবী শিক্ষার্থী বিদেশে পাড়ি জমায় উচ্চশিক্ষা, ভালো চাকরি কিংবা স্থায়ীভাবে বসবাসের আশায়। পাবলিক ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা দেশের জনগনের ট্যাক্স এর টাকায় পড়ে ৭০-৮০% বিদেশি কোম্পানির শ্রমিকে পরিণত হয়।

আমরা যারা এই সিস্টেমের ভুক্তভোগী, তারা নিজেদের মধ্যেই একে অপরকে প্রতিদ্বন্দ্বী বানিয়ে ফেলেছি, বিএসসি বনাম ডিপ্লোমা, পাবলিক বনাম প্রাইভেট, গ্রেড-ভিত্তিক দ্বন্দ্ব। অথচ, এই বিভক্তি তৈরি করেছে সেই সিস্টেম, যারা চায় আমরা বিভক্ত থাকি, যেন মূল শত্রুর দিকে কেউ আঙুল না তোলে।

এই কাঠামো আমাদের দারিদ্র্য থেকে মুক্ত করে না, বরং আমাদের দারিদ্র্যই টিকিয়ে রাখে, যাতে পশ্চিমা কোম্পানিগুলো সস্তায় পণ্য তৈরি ও মেধা ব্যবহার করতে পারে। এটা শুধু অর্থনৈতিক শোষণ নয়, এটা আদর্শিক, কাঠামোগত ও সাংস্কৃতিক দাসত্ব।

এই বাস্তবতা বদলাতে হলে প্রয়োজন এই পুজিবাদী সিস্টেমকে চ্যালেঞ্জ করা। একটা দুইটা আইন পরিবর্তন করলেই হবে না। প্রয়োজন এমন একটি কাঠামো যা আমাদের স্বার্থ, আমাদের মেধা, আমাদের সম্পদকে দেশেই কাজে লাগাবে। প্রয়োজন এমন এক আদর্শিক ব্যবস্থা, যা ন্যায়ভিত্তিক হবে এবং ১৩০০ বছর এই ব্যবস্থা পুরো বিশ্বে ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করে গেছে। যেখানে ইঞ্জিনিয়ার, চিকিৎসক, বিজ্ঞানী, শ্রমিক – সবার কাজই ছিল সম্মানিত ও রাষ্ট্রের কল্যাণে নিবেদিত।

ইসলামই একমাত্র আদর্শ যা প্রকৃত সমাধান দেয়

ইসলাম শুধু একটা ধর্ম নয়, বরং একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা, যার মধ্যে আছে রাষ্ট্র, সমাজ, শিক্ষা, অর্থনীতি, প্রযুক্তি ও জ্ঞানচর্চার সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা। এই আদর্শব্যবস্থায় মেধা কখনোই অবহেলিত ছিল না। বরং ইসলামি রাষ্ট্র মেধাকে সম্মান দিয়ে কাজে লাগিয়েছে, এবং সেটি শুধু থিওরিতে নয়, বাস্তবে ১৩০০ বছর ধরে বাস্তবায়িত হয়েছে।

কুরআনের নির্দেশনাই ছিল জ্ঞান, গবেষণা ও ইনসাফভিত্তিক রাষ্ট্রের ভিত্তি:

“আল্লাহ তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে এবং যাদের জ্ঞান দান করা হয়েছে, তাদের মর্যাদা বহু গুণে উন্নীত করেন।” সূরা আল-মুজাদিলা (৫৮:১১)

“যারা জানে এবং যারা জানে না, তারা কি সমান?” সূরা আয-যুমার (৩৯:৯)

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা সরাসরি জ্ঞানীদের মর্যাদা তুলে ধরেছেন, যা ইসলামি সভ্যতায় গবেষণা, শিক্ষাব্যবস্থা ও প্রযুক্তির উন্নয়নের ভিত্তি তৈরি করে।

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন- “প্রত্যেক মুসলমানের উপর জ্ঞান অর্জন করা ফরজ।” [সুনান ইবনে মাজাহ, হাদিস: ২২৪]

মুসলিম বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলীদের ইসলামি রাষ্ট্রে অবদান:

ইবনে সিনা (Avicenna): মেডিক্যাল সায়েন্স ও দর্শনের পথিকৃৎ। খিলাফতের পৃষ্ঠপোষকতায় গবেষণা, হাসপাতাল ও শিক্ষা প্রশাসনে যুক্ত ছিলেন।

আল-খোয়ারিজমি: অ্যালজেব্রা ও অ্যালগরিদমের জনক। তার কাজ Bayt al-Hikmah (জ্ঞানাগার)-এ রাষ্ট্রীয় অর্থায়নে পরিচালিত হয়েছিল।

আল-জাজারি: মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং ও রোবোটিক্সের প্রবর্তক। পানির মেশিন, স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র বানিয়ে রাষ্ট্রীয় কাজে লাগিয়েছেন।

আল-রাযী ও আল-জাবির ইবনে হাইয়ান: রসায়ন ও চিকিৎসায় বিপ্লব এনেছেন। তাদের গবেষণাগার পরিচালিত হতো সরকারি তত্ত্বাবধানে।

আল-বাতানি ও মারিয়া আল-আস্ট্রোলাবি: জ্যোতির্বিদ্যা ও নেভিগেশন টেকনোলজিতে নেতৃত্ব দিয়েছেন। নারীদের জন্যও জ্ঞানচর্চার পরিবেশ তৈরি হয়েছিল খিলাফতের অধীনে।

ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থা মেধাকে সংরক্ষণ করত, বিকাশ ঘটাত এবং বাস্তবে কাজে লাগাত – একটি আদর্শ রাষ্ট্র গঠনের জন্য। আজ যেখানে মেধা পাচার হয়, সেখানে ইসলামি আদর্শ মেধাকে সম্মান দেয়, রক্ষা করে এবং সমাজ-রাষ্ট্রে বাস্তব ভূমিকা রাখতে দেয়।

ইরান সরকারটি কেমন?

Leave a Reply