অনেক মানুষই বিশেষ করে পশ্চিমা বিশ্বে আল্লাহর প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস রাখে, কিন্তু তাদের দৃঢ় বিশ্বাস এ ভিত্তি থেকে যে আল্লাহ (শুধুমাত্র) একটি চিন্তা, (সর্বজনীন) সত্য না।
এধরনের ব্যক্তিগণ কোনো সৃষ্টিকর্তার উপর বিশ্বাসকে কোনো উপাস্যের উপর বিশ্বাসের মতোই মনে করে; তারা বলে, এটি একটি সুন্দর চিন্তা। এটি এ জন্য, যতক্ষন মানুষ এটি কল্পনা করবে, এতে বিশ্বাস করবে এবং এর শক্তির কাছে সমর্পণ করবে, ততক্ষন সে এ ধারণার উদ্দীপনায় মন্দ হতে নিজেকে দুরে রাখবে এবং কল্যাণে নিকটবর্তী হবে। তাই এটি একটি অন্তর্নিহিত নিরোধক যা বাহ্যিক নিরোধক হতে বেশি প্রভাব রাখে। তাই তারা সমর্থন করে যে মানুষের অবশ্যই আল্লাহতে বিশ্বাস করা উচিত এবং তারা এই বিশ্বাসে উৎসাহ প্রদান গুরুত্বপূর্ণ মনে করে যাতে মানুষ সৎকর্মপরায়ণ ও উদ্ধুদ্ধ থাকে, যাকে তারা ‘ধর্মীয় বাঁধা’ (الوازع الديني) বলে থাকে!!
এ ধরণের ব্যক্তিদের খুব সহজেই নাস্তিকতার দিকে টানা যায়, এবং ধর্মত্যাগের কাছাকাছি নিয়ে যাওয়া যায় যখন তাদের মানসিকতা এধরনের ধারণার অস্তিত্ব নিয়ে চিন্তা-ভাবনায় নিপতিত হয়। যদি মানুষ এই উপস্থিতিকে অনুভব না করে এবং এ উপস্থিতির প্রভাবকে উপলব্ধি না করে তাহলে সে একজন উপাস্যের অস্তিত্বকে অস্বীকার করবে এবং ফলে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলাকে অবিশ্বাস করবে। উপরন্তু, আল্লাহ একটি চিন্তা মাত্র, কোনো সত্য নয়, এটি বিশ্বাস করার মাধ্যমে কল্যাণ (goodness)ও একটি সত্যহীন চিন্তায় পরিণত হয়, একইভাবে মন্দ (evil)ও একটি সত্যহীন চিন্তায় পরিণত হয়। এই ধরণের বিশ্বাস (ঈমান) এই লোকদের এই কারণেই তৈরি হয়েছিল যে তারা আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস (ঈমান) অর্জনের জন্য বুদ্ধিবৃত্তি (‘আকল) ব্যবহার করেনি, এবং, মানব, জীবন ও মহাবিশ্ব সম্পর্কে সহজাত প্রশ্ন, (তথা) পার্থিব জীবনের পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী জীবন সম্পর্কে, এবং এর পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী জীবনের সাথে এর সম্পর্কের ব্যপারে সহজাত প্রশ্নগুলোর ফলে উদ্ভূত বড় সমস্যাটির বুদ্ধিবৃত্তিক সমাধানের জন্যও তাদের পরিচালিত করা হয়নি।
বরং তাদের শিক্ষকের ইচ্ছানুযায়ী সমাধানটি তাদের শেখানো হয়েছিল, তাই তারা এই সমাধানটি গ্রহণ করেছিল এবং তারা যা বিশ্বাস করত তার অস্তিত্ব সম্পর্কে প্রকৃত ধারণা না পেয়েই এতে বিশ্বাস করতে থাকে। তাদের অনেকেই তাদের মন ব্যবহার করার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু তাদের উত্তর দেওয়া হয়েছিল যে ধর্ম মনের বাইরে এবং (তাদের) নীরব থাকতে বাধ্য করা হয়েছিল।
সঠিক কথা হলো, আল্লাহ তাআলা একটি সত্য, কোন ধারণা নয়; এবং তাঁর অস্তিত্ব (চিন্তা করে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে) স্পর্শ করা যায় এবং বোঝা যায়, যদিও তাঁর (সুবহানাহু ওয়া তা’আলার) স্বরূপ উপলব্ধি করা অসম্ভব। তুমি কি দেখতে পাও না যে মানুষ তার ঘরের ভেতরে বসে আকাশে বিমানের শব্দ না দেখেও শুনতে পারে?
তবে, সে শব্দ শুনে এর অস্তিত্ব উপলব্ধি করে, যদিও সে এটি দেখেনি এবং এর স্বরূপ অনুভব করেনি। তাই সে শব্দ শুনে আকাশে একটি বিমানের উপস্থিতিতে বিশ্বাস করে। অন্যকথায়, সে নিশ্চিতভাবে এবং সন্দেহাতীতভাবে, বিমানের অস্তিত্বে বিশ্বাস করে। সুতরাং, বিমানের অস্তিত্ব উপলব্ধি করা তার স্বরূপ বোঝার চেয়ে আলাদা বিষয়। এর স্বরূপ বোঝা যায়না কারণ স্বরূপ ইন্দ্রিয় কর্তৃক অনুভূত হয়নি; অন্যদিকে এর অস্তিত্বের উপলব্ধি তার শব্দের অনুভূতি থেকে নিশ্চিত। সুতরাং, বিমানের অস্তিত্ব একটি সত্য এবং (নিছক) কোনো ধারণা নয়।
বোধগম্য এবং অনুভূত জিনিসের ক্ষেত্রেও এটিই প্রযোজ্য। তাদের অস্তিত্ব নিশ্চিত কারণ তাদের পর্যবেক্ষন করা যায় এবং তারা অনুভূত। তাদের ব্যতীত অন্য কিছুর উপর তাদের নির্ভরশীলতাও নিশ্চিত, কারণ এটি পর্যবেক্ষণ করা যায় এবং অনুভূত। আকাশের নক্ষত্রগুলোর ব্যবস্থার প্রয়োজন; এবং যারা কোনো কিছু পোড়াতে চায় তার জন্য তাদের আগুনের প্রয়োজন। প্রতিটি বোধগম্য এবং অনুভূত জিনিসের ক্ষেত্রে এটিই হয় কারণ সে নিজের নয়, অন্যের প্রয়োজন। নির্ভরশীল জিনিস চিরন্তন হতে পারে না, কারণ যদি এটি চিরন্তন হত তবে এটি নিজের ছাড়া অন্যের প্রয়োজন হত না। এটি নির্ভরশীল হওয়ার অর্থ হল এটি চিরন্তন নয়।
অতএব, সমস্ত বোধগম্য এবং ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জিনিসের সৃষ্টির বিষয়টি নিশ্চিত। কারণ যা চিরন্তন (আজালি) নয় তার অর্থ হল এটি একজন স্রষ্টার দ্বারা সৃষ্ট। এই সৃষ্ট জিনিসগুলোর সংবেদন, সেইসাথে প্লেনের শব্দের সংবেদনও নিশ্চিত। একইভাবে, এই সৃষ্ট জিনিসগুলোর (বস্তুর) স্রষ্টার অস্তিত্ব, যেখান থেকে তারা আসে, সেই প্লেনের অস্তিত্বের মতোই যেখান থেকে শব্দ এসেছে; যা একটি সুনিশ্চিত বিষয়। সুতরাং, এই সৃষ্ট বস্তুগুলোর স্রষ্টার অস্তিত্ব একটি সুনিশ্চিত বিষয়। অতএব, মানুষ তার সংবেদন এবং চিন্তার মাধ্যমে সৃষ্ট জিনিসগুলো (বস্তুকে) উপলব্ধি করেছে; এবং সে তাদের অনুভূতি থেকে তাদের স্রষ্টার অস্তিত্বকে স্পষ্টভাবে উপলব্ধি করেছে। সুতরাং, স্রষ্টার অস্তিত্ব এমন এক সত্য যা সংবেদনের মাধ্যমে মানুষ তার অস্তিত্বকে ধরতে পেরেছে; এবং এটি নিছক কোনো ধারণা নয় যা মানুষ তার মনে কল্পনা করেছে।
Taken from the Book “Islamic Thought”