বিশ্বাসঘাতকতা, ভুল হিসাব, অথবা কৌশলগত কারণেই হোক না কেন, ফলাফল অনস্বীকার্য: ১৩ জুন ইরানের সামরিক ও পারমাণবিক অবকাঠামোর উপর ইসরায়েলের ভোরবেলা আক্রমণ তেহরানের জন্য কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় নিরাপত্তার উপর আঘাত। কয়েক ঘন্টা ধরে চালানো এই হামলায় ইরানের সামরিক উচ্চ কমান্ড এবং শীর্ষ পরমাণু বিজ্ঞানীদের একাংশ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
নিহতদের মধ্যে ছিলেন ইসলামিক রেভোলিউশনারি গার্ড কর্পস (আইআরজিসি) এর কমান্ডার-ইন-চিফ মেজর জেনারেল হোসেইন সালামি; সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান মেজর জেনারেল মোহাম্মদ বাঘেরি; ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন কৌশলের স্থপতি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আমির আলী হাজিজাদেহ; এবং কুদস বাহিনীর কমান্ডার জেনারেল ইসমাইল কানি। এছাড়াও নিহত হয়েছেন সর্বোচ্চ নেতার একজন সিনিয়র উপদেষ্টা অ্যাডমিরাল আলী শামখানি এবং পারমাণবিক শক্তি সংস্থার প্রাক্তন প্রধান ফেরেয়দুন আব্বাসি দাভানি সহ পারমাণবিক বিশেষজ্ঞদের একটি দল এবং ইরানের প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়গুলির বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট পারমাণবিক পদার্থবিদ।
ইসরায়েলি অভিযানের মাত্রা এবং নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত অর্থাৎ একাধিক সামরিক ও পারমাণবিক স্থাপনায় আঘাত হানা, ইরানসহ বিশ্বের অনেককেই দৃশ্যত অস্থির করে তুলেছে। তেহরান এবং ইসফাহান থেকে প্রচারিত ভিডিওগুলোতে বিমান প্রতিরক্ষা তৎপরতার স্পষ্ট অভাব দেখা যাচ্ছে – আক্রমণের তীব্রতা সত্ত্বেও ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র বা কামানের কোনও উৎক্ষেপণ হয়নি। ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষায় প্রচুর বিনিয়োগকারী একটি দেশের জন্য, আকাশ প্রতিরক্ষার এই দুর্বল রূপ ছিল দুঃর্ভাগ্যজনক।

এই হামলার তালিকাটি পরিস্কারভাবে ইরানের সামরিক-শিল্প কমপ্লেক্সের নীলনকশাকে সামনে রেখে আক্রমনের একটি প্রয়াস। লক্ষ্যবস্তুর মধ্যে ছিল নাতানজে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ স্থাপনা, ইসফাহান ও খোন্দাবের পারমাণবিক স্থাপনা এবং আরাক, ফোরদো, শিরাজ এবং তাবরিজের অতিরিক্ত গবেষণা কেন্দ্র। যদিও নাতানজে দৃশ্যমান কাঠামোগত ক্ষতি হয়েছে, তবুও তেজস্ক্রিয়তা নির্গমণের অনুপস্থিতি ইঙ্গিত দেয় যে হয় সেন্ট্রিফিউজ হলগুলি অক্ষত ছিল অথবা আগেভাগেই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। পাহাড়ের গভীরে থাকা ফোরদো সম্ভবত গুরুতর ক্ষতি থেকে রক্ষা পেয়েছে – এর দুর্গটি প্রচলিত বাঙ্কার-বাস্টারদের নাগালের বাইরে অবস্থিত।
পারমাণবিক স্থাপনা ছাড়াও, ইসরায়েল ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র উৎপাদন কেন্দ্র, রাডার স্থাপনা এবং বেশ কয়েকটি ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র (SAM) ব্যাটারিতে হামলা চালানো হয়েছে। তেহরানের জেনারেল স্টাফ সদর দপ্তর, হামাদানের নোজেহ বিমানঘাঁটি এবং রাজধানী জুড়ে আইআরজিসি স্থাপনা সহ সামরিক কমান্ড হাবগুলিতেও হামলা চালানো হয়। এমনকি আইআরজিসি কমান্ডারদের আবাসস্থল হিসেবে পরিচিত আবাসিক এলাকাগুলি – যেমন শাহরাক-ই মহল্লাতি, ঘেয়তারিয়েহ এবং নিয়াভারান -ও বাদ পড়েনি।

বস্তুগত ক্ষয়ক্ষতি যাই হোক না কেন, রাজনৈতিক প্রভাব সম্ভবত আরও তাৎপর্যপূর্ণ। লক্ষ্যবস্তুতে থাকা ব্যক্তিরা মূলত আইআরজিসির অভ্যন্তরে একটি কট্টরপন্থী গোষ্ঠীর সদস্য ছিলেন, যারা প্রয়াত জেনারেল কাসেম সোলাইমানির সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন। প্রভাবশালী কিন্তু ধর্মযাজক নন এমন এই গোষ্ঠীটি দীর্ঘদিন ধরে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের বিষয়ে যেকোনো কূটনৈতিক আপসের বিরোধিতা করে আসছিল। তাদের অপসারণের ফলে শাসনব্যবস্থার মধ্যে একটি কট্টরপন্থী অংশ দুর্বল হয়ে পড়েছে – যা অজনপ্রিয় ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সম্ভাব্য প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড়িয়েছিল। জনসাধারণের শোক প্রচুর হবে, তবে বন্ধ দরজার পিছনে, ইরানের নেতৃত্বের কেউ কেউ তাদের বিদায়কে স্বাগতও জানাতে পারেন।
যুক্তরাষ্ট্র ইরান এবং ইসরাইলের সাম্প্রতিক যে অস্থিরতা তা বোঝার জন্য আমাদের গত এক দশক ধরে এ অঞ্চলে ইরানের ভূমিকা, যুক্তরাষ্ট্র কিভাবে ইরানের সাথে সম্পর্ক রক্ষা করে চলছে এবং ইসরাইল কিভাবে এখানে প্রেক্ষাপটে এল তা বোঝাটা জরুরি।
সর্বপ্রথম আমাদের ২০১৫ সালে ইরান ও পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যে স্বাক্ষরিত পারমাণবিক চুক্তি হওয়ার সময়টি পর্যালোচনা করতে হবে। এরপর আমাদের ২০১৮ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সেই চুক্তি থেকে বের হয়ে আসার উপর আলোকপাত করতে হবে। এরপর আমরা বর্তমান পরিস্থিতিকে পর্যালোচনা করতে পারবো।
এছাড়া আমরা এরও পূর্বে ইরাক যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে দেখতে পেয়েছিলাম কিভাবে ইরানের সরকার ইরাকে তাদের প্রভাব বলয় খাটিয়ে সেখানে আমেরিকার এজেন্ডা বাস্তবায়ন করেছিল। সিরিয়া ও ইরাক সীমান্তে সুন্নি গোষ্ঠীর উত্থান এর পেছনে ইতিপূর্বে মার্কিন মদদে ইরান কর্তৃক ইরাকে শিয়া গোষ্ঠীর উত্থান যে সম্পর্কিত তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। মার্কিনিরা একটি সমস্যা সমাধান করতে যেয়ে আরেকটি সমস্যার তৈরি করে অর্থাৎ বুশের আমলের সমস্যার ঘানি শেষ পর্যন্ত ওবামাকে টানতে হয়।
২০১৫ সাল। সিরিয়া ও ইরাক সীমান্তে ইতোমধ্যে সুন্নি গোষ্ঠীর উত্থান পরিষ্কারভাবে পরিলক্ষিত এবং একটি তথাকথিত ইসলামিক খেলাফত রাষ্ট্রও প্রতিষ্ঠা হয়েছে। রাষ্ট্রটির প্রভাব বলয় যাতে সত্যিকার অর্থে বৃদ্ধি না পায় সেজন্য পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী শক্তি উঠে পড়ে লাগে এই গণআকাঙ্খাকে দমন করবার জন্য।
২০১৫ সালের ১৪ জুলাই মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ইরানের সাথে একটি পারমাণবিক চুক্তি সম্পাদন করে। এই চুক্তি সম্পাদনের আরো বেশ কয়েক সপ্তাহ আগে থেকেই তৎকালীন মার্কিন প্রশাসনের এ চুক্তির ব্যাপারে প্রচন্ড আগ্রহ ও উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয়। মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক ময়দানে ইরানের প্রভাবকে আরো উন্মুক্ত করবার জন্য যাতে ইরানের জন্য সেখানে কাজ করা আরও সহজতর হয়, আন্তর্জাতিক বিভিন্ন বিধি নিষেধ থেকে অনেকটা মুক্ত হয়ে তার কার্যক্রম এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। তবে এ চুক্তির একটি অন্যতম লক্ষ্য ছিল সিরিয়ার জনগণের ইসলাম প্রতিষ্ঠার আকাঙ্খাকে ধুলিস্যাৎ করবার জন্য ইরানকে ব্যবহার করা।
যেসব কারণে ২০১৮ সালে ট্রাম্প প্রশাসন ইরানের সাথে ২০১৫ সালের পারমাণবিক চুক্তি বাতিল করতে বাধ্য হয়েছিল:
ক. ওয়াশিংটন সৌদি আরব এবং তুরস্ককে আঞ্চলিক ক্ষেত্রে নিয়ে আসে। তুরস্ক এই অঞ্চলে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিল। ২০১৬ সালে, তুরস্ক “ইউফ্রেটিস শিল্ড” অপারেশন শুরু করে এবং ২০১৮ সালের মার্চ মাসে, তারা “অপারেশন অলিভ ব্রাঞ্চ” চালু করে। এটি সৌদি আরবের আঞ্চলিক ভূমিকার অতিরিক্ত ছিল। ফলস্বরূপ, সিরিয়ায় ইরানের আর কোনও প্রধান ভূমিকা পালনের প্রয়োজন ছিল না এবং এটি হ্রাস করতে হয়েছিল। ট্রাম্প ঠিক এটিই করেছিল; তিনি এই অঞ্চলে ইরানের ভূমিকা হ্রাস করেছিলেন, তাকে একটি প্রধান খেলোয়াড় থেকে একটি গৌণ বা পরিপূরক ভূমিকায় রূপান্তরিত করেছিল।
খ. ইউরোপীয় দেশগুলিও ২০১৫ সালের পারমাণবিক চুক্তির পক্ষ ছিল এবং এর প্রধান সুবিধাভোগী ছিল। তবে, ট্রাম্প চাননি যে ওবামা প্রশাসনের সময় স্বাক্ষরিত চুক্তি থেকে ইউরোপ উপকৃত হোক, তাই তিনি এটি বাতিল করে দেন।
এইভাবে, ট্রাম্প ইরানের সাথে পারমাণবিক চুক্তি থেকে তার প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন, কারণ এই অঞ্চলে ইরানের ভূমিকা হ্রাস করার জন্য নতুন শর্তের প্রস্তুতির জন্য চুক্তি থেকে প্রত্যাহার করা আমেরিকার স্বার্থের পক্ষে ছিল।
সাম্প্রতিক সময়ে আমরা দেখতে পেলাম ট্রাম্প প্রশাসন আবারও ইরানকে সমঝোতার টেবিলে ডাকছে এবং অনেকটা বলপ্রয়োগ করে তাদের সাথে একটি দ্বিপাক্ষিক সমঝোতায় পৌছতে চাচ্ছে এবং দ্রুত চাচ্ছে। এই সমীকরণে ইসরাঈল ঢুকে পড়ে কারণ নেতানিয়াহুর ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য নিজস্ব কিছু অভিলাষ রয়েছে। ইসরাঈল ও ইরানের যুদ্ধ যাতে আরো ছড়িয়ে না পড়ে কিংবা দীর্ঘায়িত না হয় সেজন্য ট্রাম্প অনেক জোর করেই যুদ্ধে ঢুকে পড়ে এবং ইরানের নির্দিষ্ট কিছু টার্গেট ধ্বংস করার জন্য আমেরিকার সবচেয়ে শক্তিশালী যুদ্ধবিমান বি২ বম্বার ব্যবহার করে। তবে এখানে ইরানকে আগেভাগেই জানিয়ে দেয়া হয় আমেরিকার উদ্দেশ্য কী। একইভাবে ইরানও কাতারে অবস্থিত মার্কিন ঘাটি আক্রমন করার বিষয়টি আগেভাগেই মার্কিনিদের জানিয়ে দেয়। সবশেষে ট্রাম্প অনেকটা জোর করেই যুদ্ধ সমাপ্তির ঘোষনা দেয় এবং ইরান ও ইসরাঈলের মধ্যে চিরতরে যুদ্ধবিরতিরও ঘোষণা দেয়। অপরদিকে ইরানও এই যুদ্ধবিরতি মেনে নেয়, যদিও একই সময়ে গাজার নিরীহ মুসলিমরা প্রতিনিয়ত মারা পড়ছে।
এ সবকিছু দেখে খুব সহজেই এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে আমেরকিা ও ইরান উভয়ের কেউই যুদ্ধে জড়াতে চায় না, বরং নিজেদের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি সমঝোতার সম্পর্ক চায়। ট্রাম্প তার বর্তমান মেয়াদের মধ্যেই মধ্যপ্রাচের শান্তির দূত হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে চায়, তার ছলে বলে কৌশলে যেভাবে হোক না কেন। ইরান মুখে যদিও ফিলিস্তিনিদের পক্ষে কথা বলে কিন্তু কাজে ঠিক তার উল্টোটিই করছে। এমনকি পারমানবিক শক্তি হবার ব্যপারেও ইরান পাবলিকলি কোনো ইচ্ছা প্রকাশ করে না, যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল উভয়ে তাদের পারমানবিক শক্তি টিকিয়ে রেখেছে এবং তা ধ্বংস করার কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র NPT তে স্বাক্ষর করেছে, তারপরও তার পারমানবিক শক্তি ধ্বংসাত্মক কাজে ব্যবহারের জন্য বহাল তবিয়তে রেখে দিয়েছে, আর ওদিকে অন্য কেউ সেই সক্ষমতা তৈরি করতে চাইলে তাদের লেকচার দিয়ে বেড়াচ্ছে, তাদের বিভিন্ন অর্থনৈতিক চাপ দিয়ে বেড়াচ্ছে। এসকল ঘটনা আমাদের মুসলিম উম্মাহর ঐক্য ও তার সামরিক শক্তি বৃদ্ধির গুরুত্বকেই বার বার স্মরণ করিয়ে দেয়, যেমনটি আল্লাহু সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন,
وَأَعِدُّوا لَهُم مَّا اسْتَطَعْتُم مِّن قُوَّةٍ وَمِن رِّبَاطِ الْخَيْلِ تُرْهِبُونَ بِهِ عَدُوَّ اللَّهِ وَعَدُوَّكُمْ وَآخَرِينَ مِن دُونِهِمْ لَا تَعْلَمُونَهُمُ اللَّهُ يَعْلَمُهُمْ ۚ وَمَا تُنفِقُوا مِن شَيْءٍ فِي سَبِيلِ اللَّهِ يُوَفَّ إِلَيْكُمْ وَأَنتُمْ لَا تُظْلَمُونَ
আর প্রস্তুত কর তাদের সাথে যুদ্ধের জন্য যাই কিছু সংগ্রহ করতে পার নিজের শক্তি সামর্থ্যের মধ্যে থেকে এবং পালিত ঘোড়া থেকে, যেন প্রভাব পড়ে আল্লাহর শুত্রুদের উপর এবং তোমাদের শত্রুদের উপর আর তাদেরকে ছাড়া অন্যান্যদের উপরও যাদেরকে তোমরা জান না; আল্লাহ তাদেরকে চেনেন। বস্তুতঃ যা কিছু তোমরা ব্যয় করবে আল্লাহর রাহে, তা তোমরা পরিপূর্ণভাবে ফিরে পাবে এবং তোমাদের কোন হক অপূর্ণ থাকবে না। [আনফাল: ৬০]