সোশ্যাল মিডিয়ার আজ সবার জন্য জনপ্রিয় হবার দ্বার উন্মুক্ত করে দিয়েছে। আজকের যুগে যেন একটাই মন্ত্র: “জনপ্রিয়তা মানেই টাকা”। যত বেশি সাবস্ক্রাইবার বা ফলোয়ার তত বেশি সফলতা—এই ধারণা আজকের প্রজন্মের স্বপ্ন হয়ে উঠেছে। আজকের তথ্য-প্রযুক্তি নির্ভর যুগে, পপ কালচার দর্শনীয় ও মোহময় উদ্দীপনার মাধ্যমে চিত্রসংস্কৃতি ও রুচিসংস্কৃতি গঠনে বড় ভূমিকা রাখছে।
ধূসর শক্তি (Gray Power)
গত এক দশকে সোশ্যাল মিডিয়ার নতুন এক প্রভাবশালী শক্তি উঠে এসেছে— সেলেবগ্রাম বা ইউটিউবারদের মতো ইনফ্লুয়েন্সাররা, যারা ধূসর সম্প্রদায় ও তথাকথিত ‘সংবেদনশীলদের’ প্রতিনিধিত্ব করে, এবং মূলত পুঁজিবাদী শক্তির প্রতিনিধি হয়ে কাজ করে। যদিও এটা নতুন কিছু নয়, তথাপি ডিজিটালাইজেশনের যুগে এই ধূসর নৈতিক শক্তি (gray moral force) আরও পরিপক্ব হচ্ছে।
স্নায়ুযুদ্ধ (cold war) পরবর্তী যুগে, এই শক্তিকে ইচ্ছাকৃতভাবে পুঁজিবাদের বিশ্বায়নের সাথে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, যাতে করে টার্গেট করা বাজারদেশগুলোতে পুরাতন নৈতিক মূল্যবোধকে প্রশমিত করা যায়। বিশেষ করে যখন যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক বাণিজ্য জগতে এগিয়ে চলেছে, তখন তাদের পশ্চিমা নৈতিক মূল্যবোধ বিশ্বব্যাপী গ্রহণযোগ্য করে তোলা আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। যেমন দার্শনিক আয়ন র্যান্ড বলেছেন:
“The cult of moral grayness is a revolt against moral values.” অর্থাৎ, ধূসর নৈতিকতা আসলে নৈতিকতার বিরুদ্ধেই এক বিদ্রোহ।
এর ক্রমাগত রূপান্তরের মধ্যে, যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক শক্তি ২০শ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে সঙ্গীত ও চলচ্চিত্রের মাধ্যমে জনপ্রিয় সংস্কৃতি তৈরি করতে সফল হয়েছে; যা এশিয়ায় বিস্তার লাভ করেছে এবং এখন কোরিয়া তার K-POP জোয়ারের মাধ্যমে সেই ধারাবাহিকতা বজায় রাখছে। যেমনটি দেখা যাচ্ছে, চলচ্চিত্র ও শিল্প ধীরে ধীরে নৈতিকতার সাদা-কালো বিভাজন থেকে ইচ্ছাকৃতভাবে সরে আসছে, তেমনি করে সেগুলো ক্রমশ আরও বেশি ধূসর ছায়ায় বা অস্পষ্টতায় পরিণত হচ্ছে। এই মূল্যবোধগুলিকে অস্পষ্ট করার লক্ষ্য হল এগুলিকে বিশ্ববাজারে গ্রহণযোগ্য করে তোলা।
অবশেষে জনপ্রিয়তা হয়ে ওঠে নতুন এক নৈতিক মানদণ্ড, যা উদ্ভূত হয়েছে সেকুলার সাংস্কৃতিক শিল্পের হাত ধরে। পপ সংস্কৃতি যেকোনো বিষয়ের গুণগত মান ও নৈতিকতা উপেক্ষা করে শুধুমাত্র সংখ্যার ভিত্তিতে ‘চিত্র’ ও ‘রুচি’র জনপ্রিয়তাকেই গুরুত্ব দেয়। বিজ্ঞাপনগুলো এই দর্শনীয় ভিজ্যুয়াল স্টাইলের মাধ্যমে বাজারকে প্রভাবিত করে এবং ধূসর শক্তিকে (Gray Power) লালন-পালন করে। সীমাহীন সৃজনশীলতা’ স্লোগানকে ভিত্তি করে আদর্শিক বিবেচনায় দুর্বল কিছু শিল্পী ও নির্মাতাদের মধ্যে শিল্প ও সৃজনশীলতার অপব্যবহারকে উৎসাহিত করা হয়।
জনপ্রিয় সংস্কৃতিতে হিজরাহ কমিউনিটি:
সমস্যাটি হলো, এই জনপ্রিয় সংস্কৃতি শুধু সাধারণ মানুষকেই প্রভাবিত করে না, বরং তা মুসলিম সমাজের সেই অংশকেও প্রভাবিত করে যারা ইতোমধ্যে পরিবর্তনের প্রতি সচেতন – awareness to change (hijrah), যাদেরকে ইন্দোনেশিয়ায় ‘হিজরাহ কমিউনিটি’ বলা হয়ে থাকে। ইসলামী দাওয়াত ও জনপ্রিয় সংস্কৃতির এই সম্মিলন মুসলিম তরুণদের মধ্যে একটি ইসলামী পপুলিজম (জনপ্রিয়তাবাদ) তৈরি করেছে।
এর ফলে হিজরাহ কর্মীরা জনপ্রিয়তার প্রভাব (popularity syndrome) থেকে মুক্ত থাকতে পারেন না। এমনকি তারা ধূসর মনোভাব (graying attitudes) থেকেও নিরাপদ নয়। দাওয়াহ সফল কিনা—তা এখন পরিমাপ করা হয় ফলোয়ার সংখ্যা এবং কনটেন্ট ভাইরাল হওয়ার উপর, ইসলামী শিক্ষার গুণমান ও পদ্ধতির উপর নয়, যা নবী ﷺ এর উত্তরাধিকার অনুযায়ী হওয়া উচিত। এর ফলস্বরূপ, দাওয়াহ আজ জনপ্রিয়তার সংকট দ্বারা প্রভাবিত। অনেক আলেম, দাঈ, এবং ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি এই স্রোতে ভেসে যাচ্ছেন। তারা দাওয়াহকে সৃজনশীল শিল্পে রূপ দিয়েছেন এবং নিজেরাই হারিয়ে যাচ্ছেন ধূসর সংস্কৃতির প্রবাহে আড়ালে (gray wave)।
আবু ইসহাক আশ-শাতিবী (রহিমাহুল্লাহ) বলেছেন:
“الصالحين من قلوب الناس آخر ما يخرج: حب السلطة وحب الظهور”
“নেককারদের অন্তর থেকে নেতৃত্বপ্রেম ও পরিচিতির ভালোবাসা শেষ পর্যন্ত যায় না, তা কেবল মৃত্যুর সময়ই দূর হয়।” যারা হিজরাহ করে (পরিবর্তনের প্রতি সচেতন হয়েছে) হঠাৎ করে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, তাদের ঘটনা আমাদের জন্য শিক্ষা। দাওয়াহর প্রভাব ছড়ানোর বদলে তারা ধূসর মনোভাবকে জোরদার করে তোলে, যা পশ্চিমা ধারণা ‘religious moderation’-এর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ—এটি ইসলামী পরিচয়কে দুর্বল ও অস্পষ্ট করার একটি বৈশ্বিক পরিকল্পনা।
Wunderman Thompson Intelligence কর্তৃক মালয়েশিয়ার Muslim Intel Lab-এর সহযোগিতায় প্রকাশিত “The New Muslim Consumer” শীর্ষক একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ২৫ কোটি মুসলমানের মধ্যে আজকের প্রজন্ম তাদের পিতামাতার তুলনায় একেবারে ভিন্নধর্মী জীবন যাপন করছে। এই পরিবর্তনের পেছনে দুটি বিশাল প্রভাব কাজ করেছে: একটি হলো ধর্মীয় চেতনার পুনরুজ্জীবন (আস্তিকতা/ধর্মপরায়ণতা) এবং অপরটি হলো পশ্চিমা ধাঁচের ভোক্তাবাদ বা ভোগবাদের প্রসার।
এই প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে যে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মুসলিম তরুণদের মধ্যে ইসলাম এখন একটি জনপ্রিয় জীবনধারা হয়ে উঠেছে, যদিও তা মূলত বাহ্যিক এবং ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের মধ্যে সীমাবদ্ধ। তাদের ধর্মপরায়ণতা তাদেরকে পশ্চিমা বা কোরিয়ান বিনোদন সামগ্রী ভোগ করা থেকে বিরত রাখতে পারেনি।
যেমন “হিজরাহ কে-পপার” নামক একটি প্রবণতা, যেখানে একদিকে তারা ধার্মিক মুসলিম হওয়ার দাবি রাখে, কিন্তু অন্যদিকে তারা কোরিয়ান বিনোদনের ভোক্তা হিসেবেও থাকতে চায়। এই দ্ব্যর্থতা (ambiguity) এক ধরনের ধূসর মনোভাবের (gray attitude) জন্ম দেয়, যা তাদের জন্য পুঁজিবাদীদের ‘বাজার হিসেবে উপনিবেশিত’ করা সহজ করে তোলে—যাতে তারা ধর্মনিরপেক্ষ জীবনধারার পণ্যের চিরন্তন ভোক্তায় পরিণত হয়।
অন্যদিকে, জনপ্রিয় সংস্কৃতির প্রবণতা হলো—ইসলামের বার্তাকে এমনভাবে হালকা করে উপস্থাপন করা, যাতে তা সাধারণ মানুষের কাছে সহজে গ্রহণযোগ্য হয়। উদাহরণস্বরূপ, যদি আমরা কোনো বইয়ের দোকানে যাই, তাহলে দেখতে পাবো যে “হিজরাহ” শব্দটি লেখা এক সারি বই সহজেই বেস্টসেলার শেলফে প্রদর্শিত হচ্ছে। ধর্মীয় বইগুলো সাধারণত যেভাবে গম্ভীর ও আনুষ্ঠানিকভাবে লেখা হয়, তার বিপরীতে জনপ্রিয় হিজরাহ বইগুলোতে পপ-স্টাইলের প্রচ্ছদ থাকে, যেগুলো টিনএজ প্রেমের গল্প বা কমিক বইয়ের মতো চিত্রায়নে সাজানো হয় এবং ভাষাও হয় হালকা ও স্বচ্ছন্দ। একই রকম অবস্থা সোশ্যাল মিডিয়াতেও দেখা যায়। উদাহরণস্বরূপ, যখন আমরা ইনস্টাগ্রামে #hijrah হ্যাশট্যাগটি টাইপ করি, তখন প্রায় ৭ কোটি পোস্ট দেখা যায় যেগুলো হিজরাহ বিষয়ে আলোচনা করে এবং সেগুলোতে আকর্ষণীয় গ্রাফিক ডিজাইন ও হালকা ভাষার ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়।
জনপ্রিয় সংস্কৃতি ও ইসলামী দাওয়াহ—এই দুটি ধারা যখন মুসলিম যুবসমাজের মধ্যে মিলিত হয়, তখন তা সবসময় নেতিবাচক হয় না। বরং এই ঘটনাটি আসলে দুটি সংস্কৃতির মধ্যকার মতাদর্শিক দ্বন্দ্ব (সিরা‘উল ফিকর- صراع الفكر) বা চিন্তার সংঘর্ষকে প্রকাশ করে। তাই, এই পরিস্থিতির মোকাবিলা করার জন্য আমাদের প্রয়োজন এমন দাওয়াহকারীদের (প্রজ্ঞাবান দাঈদের), যারা আদর্শিকভাবে পরিপক্ব এবং মূল্যবোধ ও পরিচয়সংক্রান্ত এই ধরনের টানাপোড়েনে সচেতন। যাতে করে ইসলামই অন্য সংস্কৃতির রঙে রঞ্জিত হয়ে না যায়, বরং ইসলামী আদর্শই সমাজকে রঞ্জিত করে এবং তা সমাজে বৃহৎ পরিবর্তন আনতে পারে।
জনপ্রিয় সংস্কৃতির পরিপ্রেক্ষিতে ইসলামী দাওয়াহ পরিচালনায় সক্ষম দাওয়াহ কর্মীদের যোগ্যতা হলো—তাদের মধ্যে একটি শক্তিশালী চিন্তাগত সংবেদনশীলতা থাকতে হবে, যেন তারা ধর্মনিরপেক্ষ ও ইসলামী মূল্যবোধের পার্থক্য স্পষ্টভাবে উপলব্ধি করতে পারেন; একইসাথে জনপ্রিয় শৈলী (popular styles) ব্যবহার করে সৃজনশীল পদ্ধতি ও উপকরণের ব্যবহারে যেন কোনো ঘাটতি না থাকে। তদুপরি, দাওয়াহ কর্মীদের সবসময় স্মরণ রাখতে হবে যে, দাওয়াহর সফলতার মানদণ্ড কোনো জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব কিংবা দাওয়াহর গণগ্রহণযোগ্যতা বা মানুষের প্রশংসা নয়, বরং তা নির্ভর করে শরীয়াহর মানদণ্ড ও মূল উদ্দেশ্যের ওপর—যা হক ও বাতিলের মাঝে পার্থক্য নির্ধারণ করে। দাওয়াহ কর্মীদের উচিত ইসলাম নির্ধারিত পদ্ধতিতে প্রকৃত পরিবর্তনের পথ অবলম্বন করা, অস্পষ্টতা ও দ্ব্যর্থতা (ambiguity) পরিহার করা এবং দাওয়াহতে ধূসর মনোভাব (gray attitude) থেকে সম্পূর্ণরূপে বিরত থাকা। যেমন রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন:
«إن الحلال بيّن، وإن الحرام بيّن، وبينهما أمور مشتبهات لا يعلمهن كثير من الناس؛ فمن اتقى الشبهات فقد استبرأ لدينه وعرضه، ومن وقع في الشبهات فقد وقع في الحرام»
নিশ্চয়ই হালাল স্পষ্ট এবং হারামও স্পষ্ট। আর এদের মাঝে কিছু বিষয় আছে যা সন্দেহজনক, যা অধিকাংশ মানুষ জানে না। তাই যে ব্যক্তি সন্দেহজনক বিষয় এড়িয়ে চলে, সে তার দ্বীন ও সম্মানকে রক্ষা করে। আর যে সন্দেহজনক বিষয়ে লিপ্ত হয়, সে হারামের মধ্যেই পড়ে যায়।” (বুখারী ও মুসলিম)
কায়েস আবু মুহাম্মদ কর্তৃক অনুবাদকৃত