রিলস (Reels) হলো সোশ্যাল মিডিয়ার সবচেয়ে আকর্ষণীয় অথচ সবচেয়ে ভয়ানক ফিচারগুলোর একটা। এটা এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছে যেন মানুষের ব্রেইন প্রতিটা স্ক্রলে একধরনের ডোপামিন হিট পায়। আমরা যখনই ভাবি ‘আরেকটা দেখে বের হবো’, কিন্তু,’ সেই ‘আরেকটা’ আর শেষ হয় না। রিলস আসলে নতুন কিছু না—এই আইডিয়াটা এসেছে মানুষের স্বল্প মনোযোগের সুযোগ নিয়ে একটা লাভজনক কনটেন্ট ফর্ম তৈরি করার চিন্তা থেকে। এর পেছনের মূল কথা হলো: “অল্প সময়ে বেশি এন্টারটেইনমেন্ট”।
রিলসের ধারণা প্রথম জনপ্রিয়তা পায় ২০১৬ সালে চীনা অ্যাপ TikTok (তৎকালীন Musical .ly)-এর মাধ্যমে। এরপর Instagram, Facebook, YouTube – সব বড় সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম শর্ট ভিডিও ফিচার চালু করে। মূল উদ্দেশ্য ছিল মানুষের মনোযোগ ধরে রাখা।
রিলসের অ্যালগরিদম ব্যবহারকারীর আগ্রহ বিশ্লেষণ করে কনটেন্ট সাজায়, যেন ব্যবহারকারী স্ক্রল করতে করতেই সময় হারায়, আর প্ল্যাটফর্ম বিজ্ঞাপনদাতাদের কাছে সেই “সময়” বিক্রি করতে পারে।
এ এক নতুন অর্থনীতি -“Attention economy” যেখানে পণ্য নয়, মনোযোগই হচ্ছে মুদ্রা।
রিলস কেন এত জনপ্রিয় হলো?
অ্যালগরিদম বেসড ফিড – যেটা আমাদের পছন্দ বুঝে কনটেন্ট সাজায়।
Instant gratification – অল্প সময়েই dopamine হিট।
লো ইনভেস্টমেন্ট, হাই রিওয়ার্ড – ভিডিও বানানো সহজ, ভাইরাল হওয়ার চান্স বেশি।
রিলস কিভাবে পুঁজিবাদকে সার্ভ করে—
রিলস কেবল বিনোদনের একটি মাধ্যম নয়, বরং এটি পুঁজিবাদী ব্যবস্থার একটি শক্তিশালী হাতিয়ার। এর মাধ্যমে ব্যক্তি নয়, গোটা সমাজকেই প্রভাবিত করে এমন একটি সিস্টেম চালু হয়েছে, যেখানে মানুষ নিজের অজান্তেই শোষণের শিকার হচ্ছে।
এই বিষয়টা বোঝার জন্য আমাদের আগে বুঝতে হবে পুঁজিবাদ (Capitalism) কী চায়। পুঁজিবাদ চায় তিনটা জিনিস:
১) ব্যক্তির মনোযোগ (Attention)
২) ব্যক্তির আকাঙ্ক্ষা (Desire)
৩) ব্যক্তির টাকা (Money)
এখন রিলস এই তিনটা জিনিসই খুব সুচারুভাবে সার্ভ করে।
১. মনোযোগকে পণ্য বানানো
রিলস এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছে যাতে তুমি যতক্ষণ স্ক্রল করবে, ততক্ষণ আমাদের মনোযোগ বিক্রি করা যায় বিজ্ঞাপনদাতাদের কাছে।
এই ব্যবস্থায় আমরা পণ্য, আমাদের চোখ হলো প্রোডাক্ট।
পুঁজিবাদ মনোযোগ-ভিত্তিক ইকোনমিতে বিশ্বাস করে, আর রিলস হলো সেই ইকোনমির সবচেয়ে মারাত্মক অস্ত্র।
২. আকাঙ্ক্ষার জন্ম দেওয়া
রিলসে আমরা যেসব জীবন দেখি- দামী গাড়ি, বিলাসবহুল ভ্যাকেশন, পারফেক্ট বডি, বিলাসবহুল ডিজাইনার কাপড় ইত্যাদি ভোগ্যপন্য।
এগুলো দেখে আমাদের অনেকের মনে চাপে একধরনের চাপা হতাশা: “আমার লাইফ এমন কেন না?”
এই ফাঁকে পুঁজিবাদ আমাদের মধ্যে “কৃত্রিম চাহিদা” ঢুকিয়ে দেয়। আমরা মনে করি, “এই প্রোডাক্টটা কিনলেই হয়তো আমার লাইফ ভালো লাগবে।”
এভাবে রিলস আমাদের অভাব তৈরি করে, আর পুঁজিবাদ সেই অভাব পূরণের নামে প্রোডাক্ট বিক্রি করে।
৩. সেলফ ব্র্যান্ড কালচার
রিলসের মাধ্যমে মানুষ ক্রমশ নিজের একটি ‘ব্র্যান্ড’ হয়ে উঠতে চায়। ফলোয়ার বাড়ানো, স্পনসরশিপ পাওয়া, ভাইরাল হওয়া—সবই হয়ে দাঁড়িয়েছে ব্যক্তিগত লাভের মাধ্যম। এই প্রবণতা পুঁজিবাদের মূলমন্ত্রেরই এক রূপ: সবকিছুই একটি প্রোডাক্ট, এমনকি মানুষও।
সম্প্রতি বাবিল খানের “Log Out” মুভিতে সে বলেছে – “I have 10 million people under my control”. সে ভাবছে সে ১০ মিলিয়ন ফলোয়ার কে কন্ট্রোল করছে। কিন্তু আসলে সে পুঁজিপতিদের প্রোডাক্ট হিসেবে ইউজড হচ্ছে।
৪. শ্রম নয়, স্বপ্নের শোষণ
আগে পুঁজিবাদ মানুষের শ্রমকে শোষণ করতো, এখন শোষণ করছে স্বপ্নকে। ভাইরাল হওয়ার লোভ, ইনফ্লুয়েন্সার হওয়ার আশায় হাজার হাজার মানুষ সময়, শ্রম, ও মেধা ব্যয় করছে—কিন্তু লাভের মূল অংশ যাচ্ছে প্ল্যাটফর্ম আর বিজ্ঞাপনদাতাদের হাতে। অধিকাংশ মানুষ শুধু স্ক্রল করে সময় হারাচ্ছে, আবার কেউ কেউ ভাইরাল হওয়ার নামে নিজেদের মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষতি করছে।
ইসলাম: রিলস-ভিত্তিক পুঁজিবাদী সংস্কৃতির বিকল্প পথ
বর্তমান যুগে রিলস, শর্ট ভিডিও, ও সোশ্যাল মিডিয়া মনোযোগ-নির্ভর একটি বাজারে পরিণত হয়েছে, যেখানে মানুষ বিনোদনের নামে সময়, মনোযোগ, এবং আত্মমর্যাদা হারাচ্ছে। পুঁজিবাদ এই প্রবণতাকে পুঁজি করে মানুষকে কৃত্রিম চাহিদার গোলামে পরিণত করছে। কিন্তু ইসলাম এ সংকটের মধ্যেই একটি ভারসাম্যপূর্ণ, অন্তর্মুখী ও আত্মশুদ্ধির দিকনির্দেশনা দেয়।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালা বলেন,
তোমরা জেনে রাখ যে, দুনিয়ার জীবন ক্রীড়া কৌতুক, শোভা-সৌন্দর্য, তোমাদের পারস্পরিক গর্ব-অহঙ্কার এবং ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততিতে আধিক্যের প্রতিযোগিতা মাত্র। এর উপমা হল বৃষ্টির মত, যার উৎপন্ন ফসল কৃষকদেরকে আনন্দ দেয়, তারপর তা শুকিয়ে যায়, তখন তুমি তা হলুদ বর্ণের দেখতে পাও, তারপর তা খড়-কুটায় পরিণত হয়। আর আখিরাতে আছে কঠিন আযাব এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে ক্ষমা ও সন্তুষ্টি। আর দুনিয়ার জীবনটা তো ধোকার সামগ্রী ছাড়া আর কিছুই নয়। [সুরা আল হাদীদ, আয়াত-২০]
রিলস ও ইনফ্লুয়েন্সার কালচার এই আয়াতের জীবন্ত উদাহরণ। এটা মানুষকে প্রতিযোগিতার খেলায় ফেলে।
অথচ আমাদের সময় সংক্ষিপ্ত। যেখানে পুজিবাদ ভোগবিলাসে মত্ত থেকে সময়ের অপচয়, অশ্লীলতা শেখায় সেখানে ইসলাম আমাদের চুড়ান্ত সফলতার পথ দেখায়। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনই আমাদের মুল সফলতার পথে নিয়ে যাবে।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেন,
“সময় শেষ হওয়ার কসম! নিশ্চয়ই মানুষ ক্ষতির মধ্যে রয়েছে। তবে তারা নয় যারা ঈমান এনেছে, সৎকাজ করেছে, পরস্পরকে সত্য ও ধৈর্যের উপদেশ দিয়েছে।” [সূরা আল-আসর, আয়াত ১-৩]
“নিশ্চয় কান, চোখ ও হৃদয় এদের প্রতিটির ব্যাপারে সে জিজ্ঞাসিত হবে।” [সুরা বনী ইসরাইল, আয়াত-৩৬]
এই রিলস সংস্কৃতি আমাদের নফসের ধোকায় ফেলে। যারা রিলস বানায় বা দেখে শুধুই চাহিদা ও জনপ্রিয়তার পেছনে ছুটে, তারা বাস্তবে নিজের নফসকেই উপাস্য বানিয়ে ফেলে।
অথচ আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেন,
তবে তুমি কি তাকে লক্ষ্য করেছ, যে তার প্রবৃত্তিকে আপন ইলাহ বানিয়ে নিয়েছে? তার কাছে জ্ঞান আসার পর আল্লাহ তাকে পথভ্রষ্ট করেছেন এবং তিনি তার কান ও অন্তরে মোহর মেরে দিয়েছেন। আর তার চোখের উপর স্থাপন করেছেন আবরণ। অতএব আল্লাহর পর কে তাকে হিদায়াত করবে? তারপরও কি তোমরা উপদেশ গ্রহণ করবে না? [সুরা আল-জাসিয়া, আয়াত-২৩]
পুজিবাদী এই সংস্কৃতির বিপরীতে ইসলাম একটি তাকওয়া ভিত্তিক সমাজ নির্মাণে সহায়তা করে।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালা বলেন,
“নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে সর্বাধিক সম্মানিত সে, যে সবচেয়ে বেশি মুত্তাকি (তাকওয়াবান)।” [সূরা আল-হুজরাত, আয়াত ১৩]
রাসুলুল্লাহ (সা) বলেন, ‘মুসলমান পরস্পর ভাই ভাই। সে তার ওপর জুলুম করে না। তাকে সঙ্গীহীন ও সহায়হীনভাবে ছেড়ে দেয় না। সে তার কাছে মিথ্যা বলে না ও তাকে অপমান করে না।’ এরপর তিনি নিজের বুকের দিকে ইশারা করে বলেন, ‘তাকওয়া হচ্ছে এখানে।’ (সহিহ মুসলিম : ২৫৬৪)।
এই ধরনের ভোগবাদী, পুজিবাদী সংস্কৃতির ধোকায় না পড়ে ইসলামকে জীবন ব্যবস্থা হিসেবে নিলেই আমরা প্রকৃত সুফল পাবো। ইসলামকে পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা হিসেবে নিতে হলে খিলাফত রাষ্ট্র ব্যবস্থার কোনো বিকল্প নেই।
খিলাফত রাষ্ট্র কেবল আইন প্রয়োগকারী কোনো যান্ত্রিক ব্যবস্থাপনা নয়, বরং এটি একটি আদর্শিক কাঠামো—যেখানে মানুষের আত্মা, মন, সমাজ ও রাষ্ট্র সব একসাথে আল্লাহর বিধানে চলার সুযোগ পায়।
এই কাঠামো পুঁজিবাদী সংস্কৃতির উৎপত্তির শেকড়েই আঘাত হানে।