দক্ষিণ বিশ্বের উত্থান

বৈশ্বিক দক্ষিণ বা দক্ষিণ বিশ্ব একটি নতুন ট্রেন্ড, সবাই এ নিয়ে কথা বলছে। চীন ও রাশিয়া বলছে তারাই বিশ্বের ভবিষ্যত এবং পশ্চিমারা যারা এদের দীর্ঘ সময় ধরে অবহেলা করেছে তারাও একটি উদার ভবিষ্যত বজায় রাখার জন্য এদের অপরিহার্য হিসেবে দেখে। গোটা পৃথিবীর ক্ষমতার ভারসাম্যের যখন টালমাতাল অবস্থা তখন পৃথিবীর ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক কাঠামোকে অবশ্যই গ্লোবাল সাউথ তথা বৈশ্বিক দক্ষিণকে বিবেচনায় নিতে হবে।

এ পর্যন্ত ভূরাজনীতি পৃথিবীকে দেখে এসেছে পূর্ব পশ্চিম দৃষ্টিকোণ থেকে। বিশ্বের ধনী দেশ, বৃহত্তম সামরিক বাহিনী ও সবচেয়ে সমৃদ্ধ দেশগুলি সেখানে উপস্থিত রয়েছে। এটি বাণিজ্য ও যোগাযোগের অনুমোদন দেয় এমন জলপথে তাদের পদচারণার উপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে ছিল। বৈশ্বিক উত্তরে বসবাসকারী জাতিগুলি উত্তরেই তাদের মূল সম্পর্ক ও প্রতিযোগিতাকে দেখেছে এবং এই কারণেই তাদের মধ্যে  পূর্ব-পশ্চিমের দৃষ্টিভঙ্গি বিদ্যমান ছিল।

তাই গ্লোবাল নর্থ তথা বৈশ্বিক উত্তর বলতে শিল্পোন্নত ও ধনী দেশগুলোকে বোঝায় (ঐতিহাসিকভাবে যাদের ১ম বিশ্ব বলা হতো) যেখানে দক্ষিণ বলতে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে বোঝায় (ঐতিহাসিকভাবে যাদের দ্বিতীয় বা তৃতীয় বিশ্ব বলা হতো) যাদের উত্তরের বিপরীতে শিল্পোন্নত এবং পরিষেবা ভিত্তিক অর্থনীতির পরিবর্তে পণ্য-ভিত্তিক অর্থনীতি রয়েছে। গত ৫০০ বছর ধরে বৈশ্বিক অর্থনীতি উত্তরের পক্ষে ছিল এবং তাদের দ্বারা নির্মিত হয়েছিল, আর ঐতিহাসিকভাবে গ্লোবাল সাউথকে উচ্চ মাত্রার অর্থনৈতিক বৈষম্য দ্বারা চিহ্নিত করা হয়েছে।

গ্লোবাল সাউথ দেশগুলোকে দীর্ঘকাল ধরে ভূ-রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রান্তিক সদস্য হিসাবে বিবেচনা করা হয়ে এসেছে। তারা বৈশ্বিক ঘটনাগুলোকে পরিচালিত করার পরিবর্তে প্রতিক্রিয়া দেখাতো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যখন দ্বি-মেরুর বিশ্বের আবির্ভাব ঘটে তখন বিশ্ব সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে একটি যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল, যারা উভয়ই তাদের প্রভাব বিস্তার করতে এবং বিশ্বকে তাদের বলয় কিংবা জোটে অন্তর্ভুক্ত করতে চেয়েছিল। বিশ্বের অনেক জাতি এই যুদ্ধকে তাদের স্বায়ত্তশাসনের জন্য হুমকি হিসেবে দেখে এসেছিল। যদিও তারা উভয় শক্তিকে অর্থ ও অস্ত্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখেছিল, কিন্তু তারা বৈশ্বিক ব্যবস্থার বাইরে কিছু করতে পারেনি, এমনকি নিরপেক্ষও থাকতে পারেনি।

এই প্রেক্ষাপটে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের আবির্ভাব ঘটে এবং অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় G-77 এর আবির্ভাব ঘটে। উভয়ই খুব বেশি অর্জন করতে পারেনি কারণ বিশ্বের ঘটনাবলীর উপর তাদের সামান্যই প্রভাব ছিল। ১৯৭০-এর দশকে স্থবিরতা, বেকারত্ব ও তারল্য সংকট এর কারণে অনেককে ঋণগ্রস্ত হতে হয়েছিল এবং যখন স্নায়ুযুদ্ধ শেষ হয় তখন গ্লোবাল সাউথ স্নায়ুযুদ্ধ-পরবর্তী ভূ-রাজনৈতিক ব্যবস্থায় প্রান্তিক সদস্য হিসেবেই রয়ে যায়।

বৈশ্বিক লিবারেল ব্যবস্থা যখন বেকায়দায় পড়েছে তখন গ্লোবাল সাউথ বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় শুধুমাত্র গ্লোবাল নর্থকে তাদের পণ্য ও সেবা দিয়ে পরিবেশন করার প্রেক্ষাপটে তারা তাদের অর্থনীতির ব্যাপারে একটি ভিন্ন পথ নিতে চায়। ব্রাজিল ও ভারত ময়দানে নেতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে রাশিয়ার জন্য এবং রাজনৈতিকভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ভারত গুরুত্বপূর্ণ। ব্রাজিলের পণ্যভিত্তিক অর্থনীতি চীনের পাশাপাশি ইউরোপের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এদিকে মধ্য এশিয়ার দেশগুলোকে রাশিয়া, তুরস্ক, চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ তাদের নিজেদের প্রতি আকৃষ্ট করছে।

বৈশ্বিক উত্তরের দেশগুলোর মধ্যে উদীয়মান প্রতিযোগিতা গ্লোবাল সাউথ তাদের নিজেদের পক্ষে দেখছে। গত ৫০০ বছরের বেশিরভাগ সময় ধরে গ্লোবাল নর্থ বিশ্ব রাজনীতি ও অর্থনীতিতে আধিপত্য বিস্তার করে এসেছে এবং বৈশ্বিক দক্ষিণকে এর সঙ্গে তাল মেলানোর নিয়মনীতি ঠিক করে দিয়ে এসেছে। আগামীতে বৈশ্বিক উত্তরকে জনসংখ্যাগত ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে গিয়ে অনেকাংশেই বৈশ্বিক দক্ষিণের উপর নির্ভর করতে হবে। এই ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতায় দেখা যাচ্ছে ফ্রান্স ২০২৩ সালের আগস্টে BRICS সম্মেলনে যোগ দেওয়ার জন্য একটি ইচ্ছা প্রকাশ করেছিল, কিন্তু শি জিন পিং সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছেন।

জাপান ২০২৩ সালে একটি নথি প্রকাশ করেছে যা আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় গ্লোবাল সাউথের ক্রমবর্ধমান গুরুত্ব তুলে ধরেছে। আন্তর্জাতিক অর্থনীতি ও বাণিজ্য সম্পর্কিত এই শ্বেতপত্র বিশ্ব অর্থনীতিকে তিনটি বলয়ে বিভক্ত করেছে: পশ্চিম, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে; পূর্ব, চীন ও রাশিয়ার নেতৃত্বে এবং নিরপেক্ষ দেশ। এতে বলা হয়েছে যে গ্লোবাল সাউথের সঙ্গে সহযোগিতা গড়ে তোলা এবং জোরদার করা একটি অগ্রাধিকার ছিল, ভারতের উপর বিশেষ জোর দিয়ে।

গ্লোবাল সাউথ কি বিশ্বের নতুন মেরুতে পরিণত হতে পারবে? এটি অর্জনে বৈশ্বিক দক্ষিনকে অবশ্য বেশ কয়েকটি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে। ‘গ্লোবাল সাউথ’ এর কোনো আইনি বা রাজনৈতিক বাস্তবতা নেই, এটি সুবিধার জন্য উঠে আসা একটি শব্দ। গ্লোবাল সাউথের বেশিরভাগ আলাপ-আলোচনা দ্বিপাক্ষিক পর্যায়ে ঘটে। বৈশ্বিক দক্ষিণের অনেক দেশ দীর্ঘস্থায়ী অভ্যন্তরীণ অস্থিতিশীলতায় ভুগছে, যা উদীয়মান সম্ভাবনাময় সুবিধাগুলো নেওয়ার ক্ষেত্রে একটি বড় বাধা। গ্লোবাল সাউথ যদি উত্তরের করুণায় বেঁচে থাকার পরিবর্তে বিশ্বের উপর শক্তিশালী প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে, তবে এটি ২১ শতকে একটি বড় পরিবর্তনকে চিহ্নিত করবে।

আবদুর রহমান খান

সেকুলারিজম কি একটি আকীদা?

আইন জালুতের যুদ্ধ

Leave a Reply