পুনর্জাগরণের পথে বুদ্ধিবৃত্তিক পদ্ধতিই একমাত্র সঠিক চিন্তা পদ্ধতি

মুসলিমদের মাঝে ইসলামী রাষ্ট্রের অনুপস্থিতি এবং ফলশ্রুতিতে সঠিক ইসলামী চিন্তা না থাকার ফলে ‘জীবন পরিচালনার ক্ষেত্রে’ মুসলিম মননে বেশ কিছু ভুল চিন্তা পদ্ধতি স্থান করে নিয়েছে। এ ধারা বেশ আগে থেকেই হয়ে রয়েছে, তবে তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে এখন তা দ্রুত সারফেসে উঠে আসছে। ফলে বিভ্রান্ত হচ্ছে অসংখ্য মুসলিম। এ বিষয়টি বিস্তারিত আলোচনার দাবি রাখে। তবে আমরা সংক্ষেপে কয়েকটি বিপথগামি চিন্তা পদ্ধতির কথা উল্লেখ করবো ইন শা আল্লাহ।

১) আবেগি চিন্তা পদ্ধতি

এ ধরনের চিন্তায় মানুষ গভীর চিন্তা খাটিয়ে সমাধানে আসে না। বরং আবেগকেই বেশি প্রাধান্য দেয়। উপরিতলের চিন্তায় আবেগীভাবে মশগুল থাকাটাই এ চিন্তার বৈশিষ্ট্য। এ ধরণের চিন্তায় মানুষ ‘সেভিয়র’ তথা ‘ত্রাণকর্তা’ খুঁজে বা কাউকে ত্রাণকর্তা হিসেবে গ্রহণ করে। যেহেতু চিন্তা করে সমাধান নেয়া এই চিন্তা পদ্ধতিতে দুষ্কর কাজ তাই মানুষ তার জীবনের বড় সমস্যাগুলোর সমাধানের জন্য সবসময় ত্রাণকর্তা খুঁজে বেড়ায়। দুর্ভাগ্যবশত, অধিকাংশ সাধারন খেটে খাওয়া মানুষই এ চিন্তা পদ্ধতি অনুসরণ করে। এটি তাদের যতটা না দোষ, তার চেয়ে বেশি করুণ বাস্তবতা।ইমাম মাহদী এসে সব সমস্যার সমাধান করবেন – এ ক্যাটাগরির চিন্তায় মানুষ এই আকাঙ্ক্ষায় বিভোর থাকতে পুলকিত বোধ করে।

২) প্রতিক্রিয়াশীল চিন্তা পদ্ধতি

এ ধরণের চিন্তা অনেক আবেগী চিন্তার মতোই, তবে প্রতিক্রিয়া বিবেচনায় সল্প মেয়াদে বেশি আবেগী। এ চিন্তায় মানুষ কোনো বড় দুর্যোগ বা প্রেক্ষাপট তৈরি হলেই প্রতিক্রিয়া দেখায়, এর বাইরে সে তার গথবাধা জীবন পরিচালনা করে। এরাও চিন্তার দিক বিবেচনায় পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠী। ‘শক’ তাদের সল্প মেয়াদে কিছুটা চিন্তাশীল করে, কিন্ত তা ক্রমেই ক্ষীন হয়ে যায়। সমাজের খেটে খাওয়া মানুষ হতে উচ্চ মধ্যবিত্ত পর্যন্ত যেকোনো লেয়ারেই এই ধরণের মানুষ থাকতে পারে। এদের মধ্যে অনেকসময় তীব্র আবেগ দেখা যায় আবার কখনো দেখা যায় পরাজিত মানসিকতা।

উপরের দুই চিন্তা পদ্ধতিতে যেহেতু চিন্তা থেকে আবেগ বেশি প্রাধান্য পায়, তাই এসব মানুষ দীর্ঘমেয়াদে কিভাবে অগ্রসর হবে, তা দেখতে পায় না, খুঁজে বের করার চেষ্টাও করতে চায় না। এদের মাঝে কেউ কেউ ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের আবেগ দ্বারা বেশি তাড়িত হন এবং সমাধানের জন্য নিজস্ব চেষ্টার গন্ডিতে কোনোরূপ কারণ-ফলাফলের হিসেব-নিকেষ না করে, কেবল কিছু ইবাদত-বন্দেগি তথা আচার-অনুষ্ঠানের করেই গায়েবি তথা সয়ংক্রিয় কোনো সমাধানের আশায় থাকেন।

৩) লজিকাল চিন্তা পদ্ধতি

এ ধরণের চিন্তা সাধারণত সমাজের শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মাঝে বিদ্যমান। বৃটিশদের কেরানী তৈরির শিক্ষা ব্যবস্থায় পাবলিক-প্রাইভেটে পড়ে এই জনগোষ্ঠী তৈরি হয়। এরা নিজেদের সমাজের অন্যান্য মানুষের চেয়ে শ্রেষ্ঠ মনে করে তাই তাদের যেকোনো সিদ্ধান্ত অন্যদের চেয়ে বেশি শক্তিশালী হবে ধরেই এরা চিন্তা করে। এ চিন্তায় মানুষ যতটা না বাস্তবতাকে বুঝে চিন্তা করেন, তার চেয়ে যৌক্তিক মানসিকতা নিয়ে চিন্তা করে। তারা তাদের এডুকেটেড মেন্টালিটিকে মানুষের বাস্তবতাকে বোঝার বা অনুমান/পরিমাপ করার জন্য যথেষ্ঠ মনে করে। এতে করে তারা ক্রমেই সাধারন মানুষের চিন্তা ও আবেগ হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে পরে। এদের মধ্যে যারা সরাসরি ফিল্ড রিয়েলিটি ভালোভাবে বুঝে বা বুঝতে চায়, ব্যক্তি হিসেবে তারা তুলনামূলকভাবে বেশি ধন্য হয় সমাজে। লজিকাল শিক্ষায় শিক্ষায় শিক্ষিত হবার কারণে এরা ইসলামকেও লজিকালি নিতে চায়। ইসলামী চিন্তাকে এরা অন্ধভাবে নিলেও ইসলামের কাজকে এরা যৌক্তিকভাবে নিতে চায়, এবং যুক্তির মানদন্ডে না টিকলে তারা সে ইসলামী কাজকে হীনজ্ঞান করে এবং মেনে নিতে দ্বিধাদন্দ্ব প্রকাশ করে। আবার এদের অনেকে হাদীসে আসা অল্পবিস্তর কিয়ামতের আলামত ঘেটে, লজিকাল মাইন্ড খাটিয়ে পূণদৈঘ্য “ইসলামী শেষ জমানা” নামক চলচিত্রও তৈরি করেন, যার হিরো হচ্ছেন ঈসা (আ) ও সাইডকিক আল-মাহদী। এবং তারা তা দেখে পুলকিত বোধ করে সুখনিদ্রা যান। দুর্ভাগ্যবশতঃ উম্মাহর কল্যাণে কোনো একশন পয়েন্টে যেতে পারেন না, এবং কোনো ডিরেকশনও দিতে পারেন না। ভাগ্য গণনাকারীরা যেমন ভাগ্য গণনা করে ভবিষ্যত বলে দেন, এনারাও সুসংবাদ দেয়া ও হতাশা দূরকারী হাদীসগুলোকে ভবিষ্যত গণনার উপকরণে পরিণত করেছেন।

এখানে উল্লেখ্য যে, আবেগী ও প্রতিক্রিয়াশীল চিন্তার মানুষদের মাঝেও ইমাম মাহদী বা ঈসা (আ)-এর এসে সমস্যা সমাধান করে দিবেন – এরূপ চিন্তা থাকতে পারে। তবে তারা এসব ব্যপারে লজিকালদের মতো জটিলভাবে চিন্তা করেন না, কেবল পরিত্রানদাতা হিসেবে এদের কল্পনা করেন এবং আবেগী কল্পনায় বিভোর হন।

সমাজে অল্পকিছু ব্যক্তি থাকতে পারেন যাদের মাঝে তীব্র লজিকাল মাইন্ডসেট এবং তীব্র আবেগ দুটোই কার্যকর বলে মনে হয়, তবে তারা মূলত লজিকাল চিন্তা দ্বারা দিনের শেষে সিদ্ধান্ত নেন। এরা নিজেদের বস্তুগত স্বার্থ ও নিরাপত্তাকে তাদের জীবনের কেন্দ্রে রেখে জীবনের সিদ্ধান্তগুলো নেন। মানবসমাজের এরাই খুব সম্ভবত সবচেয়ে বিপজ্জনক চরিত্র। তবে এরা যদি সত্যের পক্ষে একনিষ্ঠভাবে চলে আসেন, তবে তারা প্রভুত কল্যাণের উসিলাও হতে পারেন।

৪) বৈজ্ঞানিক চিন্তা পদ্ধতি

এ চিন্তা পদ্ধতি লজিকাল চিন্তা পদ্ধতিরই একটি সাবসেট তথা শাখা। এমপিরিকাল ড্যাটার উপর ভিত্তি করে এই চিন্তা করা হয়। বিজ্ঞান কোনো দৃষ্টিভংগি দেয় না, আবার কোনো নির্দিষ্ট একশন পয়েন্টও দেয় না। সর্বোচ্চ একটি পরিধি দিতে পারে। বর্তমানে পশ্চিমা সেকুলার-লিবারেল হিউম্যানিস্ট জীবনচিন্তার মানুষদের অনেকেরই সিদ্ধান্ত তারা বৈজ্ঞানিক চিন্তা দিয়ে করে। তাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে আমাদের অনেকেই মানবজীবনের সমাধান বিজ্ঞান দিয়ে করার চেষ্ঠা করে। কিন্তু এতে তাদের সমস্যার সমাধান হয়না, পাশাপাশি তাদের এই পলিসির কারণে সমাজের সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার উপর ব্যাপক চাপ পড়ে।

৫) ফিকহী চিন্তা পদ্ধতি

এ ধরণের চিন্তায় মানুষ একটি ফিকহী মনস্তত্ব দ্বারা তাদের কার্যক্রম নির্ধারণ করতে চায়। কাজ করার সময় যখন প্রশ্ন করা হয় – “ভাই, কাজটাতো হালাল, সুতরাং করলে সমস্যা কোথায়”। সমস্যা এই সংকীর্ণ মনস্তত্ত্বের মাঝেই। আমাদের বোঝা প্রয়োজন, বিজ্ঞানের মতো আইনশাস্ত্র তথা ফিকহও কোনো একশন পয়েন্ট দেয়না, সর্বোচ্চ একটি সীমানা দিতে পারে। সুতরাং, এ চিন্তায় এক এক মানুষ এক এক একশন পয়েন্টে ফোকাস দিবে এবং এতে জাতিগত ঐক্য তৈরি হবার সম্ভাবনা হয়ে পরে দুরূহ। উদাহরণস্বরূপ, আপনি একটি ফুটবল ম্যাচ এর কথা চিন্তা করুন। যাকে মিডফিল্ডার হিসেবে নামানো হয়েছে, সে যদি চিরকাল আইনী বিবেচনায় চিন্তা করতে থাকে, তাহলে সে প্রয়োজন সাপেক্ষে কখনোই গোল দেবার জন্য ছুটে যাবে না, আবার প্রয়োজন সাপেক্ষে কখনোই গোল ঠেকাবার জন্য ডিফেন্সে নেমে আসবে না। আবার, যাদের দৃষ্টিভংগি ম্যাচ জেতা, তারা কোচ কাকে কোথায় দাড় করিয়েছে সে বিবেচনা না করে ম্যাচ জেতার জন্য যখন যে বাস্তবতায় যেটি করা প্রয়োজন পুরো টিম মিলে সে দৃষ্টিভংগিতে এগিয়ে যাবে। এখানে ডিসিশন থেকে দৃষ্টিভংগিই গুরুত্বপূর্ণ।—

প্রকৃতপক্ষে, আমাদের জীবন পরিচালনার প্রকৃত চিন্তার ভিত্তি হবে আমাদের আকীদা যা আমাদের একটি সুনির্দিষ্ট দৃষ্টিভংগি প্রদান করে, যা অন্য যেকোনো মতাদর্শ হতে পৃথক একটি সতন্ত্র মতাদর্শিক দৃষ্টিভংগিও বটে। এবং সেই দৃষ্টিভংগিই নির্ধারণ করবে আমাদের একশন পয়েন্ট কী হবে। এবং সেই জীবনযাত্রায় ফিকহ, বিজ্ঞান ও উম্মাহর আবেগ হচ্ছে কেবল এক একটি সহায়ক শক্তি। লজিকাল চিন্তাকে টুকটাক মেকানিক ট্রাবলশুটিং টাইপ কাজে সীমাবদ্ধ রেখে, ফিকহী চিন্তাকে আইন বের করার কাজে সীমাবদ্ধ রেখে এবং বৈজ্ঞানিক চিন্তাকে কেবলমাত্র বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রা অর্জনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখে মানবজীবনকে বাস্তবতাকে সামনে রেখে করা “বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তা” প্রক্রিয়ায় ফিরিয়ে আনার মধ্যে রয়েছে সমাজের প্রকৃত কল্যাণ ও মুক্তি।

আল্লাহ আমাদের জন্য সহজ করে দিন।

শীতের যুদ্ধ ও গনীমত

Leave a Reply