ভূমিকা: একজন মুসলিম পিতা পরবর্তী প্রজন্মের জন্য শক্ত ভিত গড়ে দেন
ইসলামে পিতৃত্ব এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে, মূলত এর মাধ্যমেই মুসলিমদের বংশ-পরিচয় নির্ধারিত হয়। আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা বলেন, [ادْعُوهُمْ لِآبَائِهِمْ هُوَ أَقْسَطُ عِندَ اللَّهِ] “তাদেরকে (সন্তানদেরকে) তোমরা তাদের পিতার পরিচয়ে সম্বোধন কর। এটাই আল্লাহ্’র দৃষ্টিতে অধিক ন্যায়সঙ্গত” [সূরা আল-আহযাব: ৫]। এই আয়াত পিতৃত্বের ভিত গড়ে দিয়েছে, যা হচ্ছে সন্তান লালন-পালনে পিতার বাধ্যবাধকতার ভিত্তি। যার মধ্যে রয়েছে সাহচর্য বা সঙ্গদান, আর্থিক ভরণপোষণ, ইসলামী চিন্তাসমূহ প্রোথিত করা, আক্বীদার প্রতি বিশ্বাস সুদৃঢ়করণ ও তাদেরকে শাসনের মাধ্যমে সুশৃঙ্খল রাখা। নিঃসন্দেহে বলা যায় ইসলামে পিতার ভূমিকা শুধুমাত্র ছেলে-মেয়েদের নামকরণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং এর চেয়ে অনেক ব্যাপক।
ইসলামী উম্মাহ্’র শিক্ষক হিসেবে রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাঁর ভূমিকাকে পিতার সাথে তুলনা করেছেন। তিনি (সা) বলেন, إِنَّمَا أَنَا لَكُمْ بِمَنْزِلَةِ الْوَالِدِ أُعَلِّمُكُمْ “আমি যেভাবে তোমাদেরকে শিক্ষা দেই, সেই অর্থে আমি বস্তুত তোমাদের পিতার মত” [সুনানে আবু দাউদ]। আমাদের নেতা ও শিক্ষক আল্লাহ্’র রাসূল (সা) নারী ও পুরুষের পুরো একটি প্রজন্মকে অভিভাবকের মতো লালন-পালন করে তাদেরকে ইসলামের একেকটি পিলার হিসেবে তৈরি করেছেন, যাদের প্রভাব মুসলিম উম্মাহ্’র ওপর এখনও বিদ্যমান। তিনি চারজন মহিমান্বিত কন্যাকে লালন-পালন করেছেন, যারা মুসলিম উম্মাহ্’র জন্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে আছেন। তিনি (সা) তাঁর বয়োঃজেষ্ঠ কিন্তু গরিবতম চাচার সন্তান আলী ইবনে আবু তালিব (রা.)-কে লালন-পালন করেছেন, যিনি পরবর্তী সময়ে ইসলামের চতুর্থ খলীফা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি (সা) তাঁর পালকপুত্র যায়েদ ইবনে হারিসা ও তার সন্তান উসামা বিন যায়ীদকে দ্বীনি পরিবেশে বড় করেছেন। তাঁর (সা) তত্ত্বাবধানে থাকা তরুণদের জন্য তিনি ছিলেন যত্নবান সঙ্গী ও ধৈর্যশীল শিক্ষক। রাসূলুল্লাহ্ (সা) মুসলিম তরুণদেরকে ইসলামী চিন্তা দ্বারা গড়ে তুলেছেন, ইসলামী আক্বীদার প্রতি তাদের ঈমানকে সুদৃঢ় করেছেন এবং তাদেরকে প্রজ্ঞা ও সহানুভূতি দ্বারা সুশৃঙ্খল করেছেন। তাঁর (সা) তত্ত্বাবধানে বেড়ে ওঠা মুসলিম নারী ও পুরুষেরাই এই পৃথিবীতে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা’র বিধান বাস্তবায়নকারী ইসলামী শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেন এবং পরবর্তীতে নবুয়্যতের আদলে প্রতিষ্ঠিত প্রথম খিলাফত রাষ্ট্রের নেতৃত্ব দেন। পর্যায়ক্রমে সাহাবাগণ (রা.) কর্তব্যনিষ্ঠ পিতা হিসেবে একটি আল্লাহভীরু ও সাহসী প্রজন্মকে লালন-পালন করেন; উদাহরণস্বরূপ বলা যায় চারজন আব্দুল্লাহ্’র কথা, যারা ইয়াজিদের যুলুমের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। শাসক কিংবা সামরিক নেতৃত্ব, স্বামী কিংবা প্রতিবেশী ইত্যাদি জীবনের সকল ক্ষেত্রেই অনুকরণীয় মানদন্ড হিসেবে অনুসরণের মাধ্যমে দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ লাভের জন্য আমরা নিঃসন্দেহে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর দৃষ্টান্তের কাছে ফিরে যাই। সুতরাং, আজকে যারা পিতা তাদের উচিত তাদের সন্তানদের লালন-পালনের ক্ষেত্রে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা তাদের উপর যে দায়িত্ব অর্পণ করেছেন তা স্মরণ রাখা, কেননা বর্তমান প্রজন্ম দ্বিতীয় খিলাফতে রাশিদাহ্’র প্রত্যাবর্তনের ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সুসংবাদ বাস্তবায়নের জন্য নিজেদেরকে প্রস্তুত করছে। তাদের উচিত তাদের প্রত্যেকের ঘরের মধ্যে সেই শক্তিশালী ইসলামী ব্যক্তিত্বদেরকে প্রস্তুত করা যারা ইসলামকে জীবনব্যবস্থা হিসেবে পুনরায় বাস্তবায়ন করবে এবং ইসলামকে দাওয়াহ্ হিসেবে সমগ্র পৃথিবীর কাছে নিয়ে যাবে।
পিতা তার সন্তানের যত্নবান সঙ্গী
একদিকে পিতা যেমন সন্তানের শিক্ষক, পরামর্শদাতা ও শৃঙ্খলা নিশ্চিতকারী, ঠিক তেমনি তিনি কোমল ও যত্নবান সহচর। স্বীয় কন্যাদের প্রতি রাসূলুল্লাহ্ (সা) ছিলেন কোমল, শ্রদ্ধাশীল, যত্নশীল অভিভাবক। উম্মুল মুমিনীন আয়েশা (রা.) বলেন, مَا رَأَيْتُ أَحَدًا مِنَ النَّاسِ كَانَ أَشْبَهَ بِالنَّبِيِّ ﷺ كَلاَمًا وَلاَ حَدِيثًا وَلاَ جِلْسَةً مِنْ فَاطِمَةَ. وَكَانَ النَّبِيُّ ﷺ إِذَا رَآهَا قَدْ أَقْبَلَتْ رَحَّبَ بِهَا، ثُمَّ قَامَ إِلَيْهَا فَقَبَّلَهَا، ثُمَّ أَخَذَ بِيَدِهَا فَجَاءَ بِهَا حَتَّى يُجْلِسَهَا فِي مَكَانِهِ، وَكَانَتْ إِذَا أَتَاهَا النَّبِيُّ ﷺ رَحَّبَتْ بِهِ، ثُمَّ قَامَتْ إِلَيْهِ فَقَبَّلَتْهُ “কথোপকথন, বক্তব্য কিংবা আচরণে আমি ফাতিমার (রা.) তুলনায় এমন কাউকে দেখিনি যে কিনা আল্লাহ্’র রাসূল (সা)-এর সাথে অধিক সামঞ্জস্যপূর্ণ। ফাতিমা (রা.) যখন আল্লাহ্’র রাসূল (সা)-এর কাছে আসতেন তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাকে সালাম জানাতেন, তার সম্মানে উঠে দাঁড়াতেন, তার কপালে চুমু খেতেন এবং তার হাত ধরে টেনে নিয়ে তার নিজের আসনে বসাতেন। যখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) ফাতিমার ঘরে বেড়াতে যেতেন তখন ফাতিমা অনুরূপভাবে রাসূলুল্লাহ্’কে সালাম জানাতেন, তাঁর সম্মানে উঠে দাঁড়াতেন এবং তাঁর কপালে চুমু খেতেন।” [আল-আদাবুল মুফরাদ]।
আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন, কতিপয় বেদুইন রাসূলুল্লাহ্ (সা) কাছে আসলেন এবং জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনি কি আপনার সন্তানদেরকে চুমু খান?” তিনি (সা) বললেন, “হ্যাঁ।” এর প্রেক্ষিতে তারা বলল, “আল্লাহ্’র শপথ আমরা আমাদের সন্তানদের চুমু খাইনা।” তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, “তবে আমার কিইবা করার আছে যদি আল্লাহ্ তোমাদেরকে রহমত থেকে বঞ্চিত রাখেন?” [মুসলিম]। আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, আল-আক্বরা বিন হাবিস দেখলেন যে রাসূলুল্লাহ্ (সা) হাসান (রা.)-কে চুমু দিচ্ছেন। তখন আল-আক্বরা বললেন, “আমার দশটি সন্তান রয়েছে কিন্তু আমি কখনই তাদেরকে চুমু দেইনি,” তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, “যে তার সন্তানদের প্রতি দয়া প্রদর্শন করে না, তার প্রতিও (আল্লাহ্’র পক্ষ থেকে) কোন দয়া প্রদর্শন করা হবে না।” [মুসলিম]।
উপরন্তু, ইসলামে একজন পিতাকে সন্তানদের প্রতি তার স্নেহ ও সুযোগ-সুবিধা প্রদানে সমতা নিশ্চিত করার জন্য বলা হয়েছে যেন কোন পক্ষপাত না হয়। নুমান বিন বশির (রা) বর্ণনা করেছেন, ذَهَبَ بِي أَبِي إِلَى النَّبِيِّ ﷺ يُشْهِدُهُ عَلَى شَىْءٍ أَعْطَانِيهِ فَقَالَ: أَلَكَ وَلَدٌ غَيْرُهُ. قَالَ نَعَمْ. وَصَفَّ بِيَدِهِ بِكَفِّهِ أَجْمَعَ كَذَا أَلاَ سَوَّيْتَ بَيْنَهُمْ “আমার পিতা আমাকে রাসূলের কাছে নিয়ে গেলেন এবং আমাকে মূল্যবান কিছু একটা দিবেন যার জন্য আল্লাহ্’র রাসূল (সা)-কে সাক্ষী হিসেবে রাখতে চাইলেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা)) জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার কি আর কোন সন্তান রয়েছে? আমার পিতা বললেন, হ্যাঁ। তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) তার হাত দিয়ে আনুভূমিকভাবে ইশারা করে বললেন, তাহলে সবাইকে তুমি সমানভাবে অনুগ্রহ করছ না কেন? [আন নাসাঈ]।
পৃথিবীতে ইসলামকে জীবনব্যবস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার বিশাল দায়িত্ব পালন করা সত্ত্বেও রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাঁর তত্ত্বাবধানে থাকা শিশুদের চাহিদার দিকে সবসময় একজন পিতার মত মনোযোগী থাকতেন। আনাস বিন মালিক (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) আমাদের বাসায় বেড়াতে আসতেন। আমার একটি ছোট ভাই ছিল, যার ডাকনাম ছিল আবু উমাইর। তার একটি পোষা চড়–ই পাখি ছিল যাকে নিয়ে সে খেলা করত। একদিন পাখিটা মরে গেল। এরপর একদিন রাসূলুল্লাহ্ (সা) বেড়াতে এসে দেখলেন আবু উমাইরের মন খারাপ। তিনি আমাদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন, “ওর কি হয়েছে?” আমরা বললাম, ওর চড়–ই পাখিটা মরে গিয়েছে। তখন রাসূলুল্লাহ্ আবু উমাইরকে বললেন, “আবু উমাইর তোমার চড়–ই পাখিটার কি হয়েছিল?” (আবু দাঊদ)।
একজন মুসলিম পিতা শিশুদের সাথে শিশুসুলভ, কিন্তু প্রয়োজনের সময় তিনি একজন দৃঢ়চেতা পুরুষ। ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর (রা.) বলেন, “একজন পুরুষের এই গুণটি আমাকে মোহিত করে যে, সে তার পরিবারের কাছে শিশুসুলভ কিন্তু তাকে যখন প্রয়োজনের সময় ডাকা হয় তখন তাকে সত্যিকারের পৌরুষদীপ্ত মানুষ হিসেবে পাওয়া যায়।” [সুত্র: সোয়াব আল-ইমান ৭৮৫১]। একজন পিতার পৌরুষদীপ্ততার উৎস হল তার শক্তিশালী ইসলামী চরিত্র এবং তার মর্যাদার উৎস হলো তার দ্বীন। উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) বলেন, একজন পুরুষের ব্যক্তিত্বের মূলভিত্তি হলো তার বুদ্ধিবৃত্তি, তার মর্যাদা বা সম্মান হল তার দ্বীন, তার চরিত্রের মধ্যে রয়েছে তার পৌরুষদীপ্ততা। [সুত্র: আদাব আল-দুনিয়া ওয়াল-দ্বীন ১/১৭]। একজন ধর্মপ্রাণ মুসলিম পিতা তার সন্তানদের একজন ভালো বন্ধু হয়ে সন্তানকে খারাপ সঙ্গের ধ্বংসাত্মক প্রভাব ও নেতিবাচক উদ্দীপনা থেকে রক্ষা করেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেন, الرَّجُلُ عَلَى دِينِ خَلِيلِهِ فَلْيَنْظُرْ أَحَدُكُمْ مَنْ يُخَالِلُ “একজন মানুষ তার বন্ধুর দ্বীন অনুসরণ করে, সুতরাং প্রত্যেককেই এ ব্যাপারে সতর্ক হওয়া উচিৎ সে কার সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করছে।” [আবু দাউদ]
একজন মুসলিম পিতা ধৈর্যশীল ও প্রেরণাদায়ক শিক্ষক
সন্তানকে শিক্ষাদানের সময় একজন মুসলিম পিতা তার সন্তানকে তার দুর্বলতার জন্য উপহাস বা বিদ্রুপ করেন না, অভিশাপ দেন না, গালিগালাজ করেন না কিংবা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য বা হেয়-প্রতিপন্ন করেন না, বরং তিনি ধৈর্য্যরে সাথে তাদের সম্মান বজায় রেখে কথা বলেন, তাদের মধ্যে সম্মানবোধ জাগিয়ে তোলা ও তাদেরকে সম্মান প্রাপ্তিতে প্রবল আগ্রহপূর্ণ করে তোলেন। তিনি তাদেরকে আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান করা এবং তাদের আত্মমর্যাদাবোধকে দৃঢ়ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠা করেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেন, لَيْسَ الْمُؤْمِنُ بِالطَّعَّانِ وَلَا اللَّعَّانِ وَلَا الْفَاحِشِ وَلَا الْبَذِيءِ “একজন মুমিন কাউকে উপহাস করে না, অভিসম্পাত করে না, অশ্লীল শব্দের দ্বারা আহ্বান করে না এবং কাউকে গালমন্দ করে না।” (তিরমিজি)। ওমর বিন আল-খাত্তাব (রা.) বলেন, “কোন ব্যক্তির তর্জন-গর্জন শুনে তোমরা বিমোহিত হয়ো না, বরং সে যদি তার আমানত রক্ষা করে, অন্য মানুষের সম্মানে আঘাত করা থেকে নিজেকে বিরত রাখে তবেই সে একজন সত্যিকারের পুরুষ।” [আল যুহদ ওয়াল রাক্বাইক ৬৮১]।
নিঃসন্দেহে ইসলামের বিভিন্ন যুগের প্রখ্যাত আলেমগণ মন্তব্য করেছেন যে, একজন ব্যক্তির পৌরুষের প্রমাণ হলো সে কাউকে অপমান করে না, কারো সমালোচনা করে না কিংবা কাউকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে না। ইমাম আইয়্যুব আল শাখতিয়ানী (রহ.) বলেন, “একজন পুরুষ কখনোই তার পৌরুষে পৌঁছাতে পারবে না কিংবা পৌরুষের পরিপূর্ণতা অর্জন করতে পারবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত সে দুটি বৈশিষ্ট্য অর্জন করতে না পারে: মানুষকে ক্ষমা করে দেওয়া এবং তাদের ভুলত্রুটিকে উপেক্ষা করা। ইমাম আব্দুল্লাহ্ ইবনে আল মুবারক (রহ.) বলেন, “যে তার মুসলিম ভাইকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করল সে অচিরেই তার পৌরুষ হারিয়ে ফেলবে।” [সিয়ার আ‘লাম আল নুবালা ১৭/২৫১]। সাঈদ ইবন আল-আস (রহ.), যিনি একসময় মদিনার ওয়ালী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন, ঘোষণা করেন, আমি যৌবনে পদার্পণ করার পর থেকে কখনো কাউকে অপমান করিনি। [আল-হিলম লি-ইবন আবি দুনিয়া, ১১৯]
কম বয়সী সাহাবাদের শিক্ষাদানের সময় রাসূলুল্লাহ্ (সা) যথেষ্ট ধৈর্য্য প্রদর্শন করতেন এবং তাদের মনোবল ও আত্মবিশ্বাসকে অক্ষুন্ন রাখতেন। আনাস (রা.) বর্ণনা করেন, خَدَمْتُ النَّبِيَّ ﷺ عَشْرَ سِنِينَ، فَمَا قَالَ لِي أُفٍّ وَلاَ لِمَ صَنَعْتَ وَلاَ أَلاَّ صَنَعْتَ “আমি দীর্ঘ ১০ বছর আল্লাহ্’র রাসূল (সা)-কে গৃহস্থালী কাজে সাহায্য করেছি। তিনি কখনোই আমার প্রতি বিরক্তিসূচক উফ্ শব্দটিও উচ্চারণ করেননি কিংবা কখনোই এই বলে অভিযোগ করেননি যে, এটা কেন করেছ বা ওটা কেন করো নাই। [বুখারী]। কম বয়সী সাহাবাদের শিক্ষাদানের সময় রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাদের কোমল মনকে চিন্তাশীলতার দিকে উদ্বুদ্ধ করতেন। আব্দুল্লাহ্ ইবনে ওমর (রা.) বর্ণনা করেন, كُنَّا عِنْدَ النَّبِيِّ ﷺ فَأُتِيَ بِجُمَّارٍ فَقَالَ إِنَّ مِنَ الشَّجَرِ شَجَرَةً مَثَلُهَا كَمَثَلِ الْمُسْلِمِ . فَأَرَدْتُ أَنْ أَقُولَ هِيَ النَّخْلَةُ، فَإِذَا أَنَا أَصْغَرُ الْقَوْمِ فَسَكَتُّ، قَالَ النَّبِيُّ ﷺ هِيَ النَّخْلَةُ “আমরা রাসুলুল্লাহ্’র সাথে ছিলাম এমন সময় কিছু তাজা খেজুর তার নিকট নিয়ে আসা হল। তিনি বললেন, গাছের মধ্যে এমন একটি গাছ রয়েছে যা বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে একজন মুসলিমের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। তখন আমি বলতে চেয়েছিলাম এর উত্তর হলো খেজুরগাছ, কিন্তু যেহেতু আমি বয়সে সবার ছোট ছিলাম তাই চুপ করে থাকলাম। তখন রাসূল নিজেই বললেন, এর উত্তর হলো খেজুর গাছ।” [বুখারী]।
রাসূলুল্লাহ্ (সা) শিশু-কিশোরদেরকে একজন আদর্শ পিতার মত ইতিবাচকভাবে অনুপ্রাণিত করতেন। আবদুল্লাহ্ ইবনে উমর (রা.) তার বোন উম্মুল মুমিনীন হাফসা (রা.) এর কাছ থেকে জানতে পারেন যে, তিনি (সা) হাফসা (রা.)-কে বলেছেন, إِنَّ عَبْدَ اللَّهِ رَجُلٌ صَالِحٌ لَوْ كَانَ يُكْثِرُ الصَّلاَةَ مِنَ اللَّيْلِ “আব্দুল্লাহ্ একজন ন্যায়পরায়ন ও ধার্মিক লোক, তবে সে যদি রাতে আরো বেশি সালাত আদায় করত তবে আরো ভালো হতো। [বুখারী]। আল জুহরী বলেন, “এরপর থেকে আব্দুল্লাহ্ (রা.) রাতের বেলায় বেশি করে সালাত আদায় করতেন।”
কর্তৃত্বপ্রয়াসী মানসিকতার অনেক ঊর্ধ্বে উঠে রাসূলুল্লাহ্ (সা) তরুণ সাহাবাদেরকে যথাযথভাবে প্রস্তুত করে তাদেরকে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব প্রদান করতেন। আল্লাহ্’র রাসূল (সা) ওসামা বিন যায়িদ (রা.)-এর নেতৃত্বে একটি সেনা অভিযান প্রেরণ করেন। এরপর কেউ কেউ যখন ওসামার নেতৃত্বের ব্যাপারে নেতিবাচক কথা বলতে লাগলো তখন রাসূলুল্লাহ্ ঘোষণা করলেন, إِنْ تَطْعُنُوا فِي إِمَارَتِهِ فَقَدْ كُنْتُمْ تَطْعُنُونَ فِي إِمَارَةِ أَبِيهِ مِنْ قَبْلُ، وَايْمُ اللَّهِ، إِنْ كَانَ لَخَلِيقًا لِلإِمَارَةِ “যদি এটা হয় যে, তোমরা ওসামার নেতৃত্বের সমালোচনা করছ, যেমনটি পূর্বে তার পিতার (যায়েদ বিন হারিসা) ব্যাপারে করেছিলে। আল্লাহ্’র কসম! তবে জেনে রাখ, সে নেতৃত্বের যোগ্য ছিল। [বুখারী]
পিতা তার সন্তানকে দ্বীনি শিক্ষা ও পরিবেশে বড় করবেন
সন্তানদের রক্ষা করতে তাদেরকে দ্বীনের শিক্ষায় শিক্ষিত করা মুসলিম পিতার দায়িত্ব। আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা বলেন, [يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا قُوا أَنفُسَكُمْ وَأَهْلِيكُمْ نَارًا وَقُودُهَا النَّاسُ وَالْحِجَارَةُ] “হে ঈমানদারগণ! তোমরা নিজেদের ও তোমাদের পরিবার-পরিজনকে জাহান্নামের সেই আগুন থেকে রক্ষা করো যার জ্বালানী হবে মানুষ ও পাথর। [আত-তাহরীম: ৬]। ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, “তোমরা আল্লাহ্’র আনুগত্য কর, তাঁর অবাধ্য হইও না এবং তোমাদের পরিবার-পরিজনকে আল্লাহ্’র আনুগত্যের আদেশ কর। তাহলে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা তোমাদের সকলকে একত্রে জাহান্নাম থেকে রক্ষা করবেন।” আলী (রা.) বলেন, “অবশ্যই তোমরা এবং তোমাদের পরিবার সৎকাজ করবে এবং অবশ্যই পরিবারকে সঠিক পথে রাখতে শাসন করবে।” মুজাহিদ (রহ.) বলেন, “তোমরা তাকওয়া অর্জন কর এবং তোমাদের পরিবার-পরিজনকে তাকওয়া অর্জনের আদেশ দাও।” কাতাদা (রহ.) বলেন, “তার দায়িত্ব হল আল্লাহ্’র আনুগত্যের এবং আল্লাহ্’র অবাধ্যতা থেকে বিরত থাকার আদেশ প্রদান করা। সে তার পরিবার-পরিজনকে আল্লাহ্’র আনুগত্যের আদেশ দেয় এবং তাদেরকে আল্লাহ্’র আনুগত্য করতে সাহায্য করে। যখনই সে তাদের কারো মধ্যে আল্লাহ্’র প্রতি অবাধ্যতা লক্ষ্য করে সে তাদেরকে নিবৃত করে এবং তা করতে নিষেধ করে।
পিতা তার সন্তানের জন্য এমন একজন শিক্ষক যিনি তার সন্তানদেরকে হালাল ও হারাম সম্পর্কে শিক্ষা দেন। সূরা তাহরীম এর ৬ নম্বর আয়াত সম্পর্কে আদ-দাহ্হাক ও মুক্বাতিল বলেন, নিকটাত্মীয়দেরকে ফরজ ও হারাম সম্পর্কে শিক্ষা দেয়াটা প্রত্যেক মুসলিমের জন্য বাধ্যতামূলক। সন্তানকে ইসলাম শিক্ষা দেওয়া একজন মুসলিম পিতার দায়িত্ব। তবে, এই দায়িত্ব তিনি নিজে সরাসরি সন্তানকে শিক্ষাদানের মাধ্যমে পালন করতে পারেন কিংবা অন্য কোন উপযুক্ত ব্যক্তিকে নিয়োগের মাধ্যমেও করতে পারেন, যিনি পিতার সরাসরি তত্ত্বাবধানে থেকে সন্তানকে ইসলাম শিক্ষা দিবেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেন, طَلَبُ الْعِلْمِ فَرِيضَةٌ عَلَى كُلِّ مُسْلِمٍ “জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক মুসলিমের জন্য বাধ্যতামূলক।” [তিরমিজি]। এই বাধ্যবাধকতার মধ্যে রয়েছে সকল প্রয়োজনীয় বিষয়সমূহের ব্যাপারে জ্ঞানার্জন; যার মধ্যে রয়েছে সালাত, সাওম, আর্থিক লেনদেন, বিপরীত লিঙ্গের সাথে সম্পর্ক এবং সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ।
ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা ওমর আল ফারুক (রা.)-এর কাছে একবার এক লোক তার সন্তানের ব্যাপারে অভিযোগ করলেন যে, তার পুত্র তাকে সম্মান করেনা। ওমর (রা.) তার পুত্রকে ডেকে পাঠালেন এবং তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি কেন তোমার পিতাকে অবজ্ঞা/অসম্মান কর?” উত্তরে লোকটির ছেলে বলল, “হে আমীরুল মুমিনীন! সন্তানের কি তার পিতার উপর কোন অধিকার নেই?” ওমর (রা.) বললেন: “অবশ্যই আছে।” তখন ছেলেটি প্রশ্ন করল, “সেগুলো কি?” এর জবাবে ওমর (রা.) বললেন, “পিতা তার জন্য ভালো মা নির্বাচন করবে, তার একটি সুন্দর নাম রাখবে এবং তাকে কুর‘আন শিক্ষা দিবে।” তখন ছেলেটি বলল, “আপনি নিশ্চিত থাকেন আমার পিতা এগুলোর কোনোটিই করেনি। আমার মা একজন অগ্নি উপাসক, সে (পিতা) আমার নাম রেখেছে যুলান (যার অর্থ গুবড়েপোঁকা) এবং সে আমাকে কুর‘আন-এর একটি হরফও শিক্ষা দেয়নি। এটা শুনে ওমর (রা.) তার পিতাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “হে জনাব! তুমি তোমার ছেলের বেয়াদবির ব্যাপারে অভিযোগ করতে আমার কাছে এসেছ। তোমার পুত্র তোমার হক্ব আদায় করতে ব্যর্থ হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তার আগে তুমি নিজেই তোমার পুত্রের হক্ব আদায় করতে ব্যর্থ হয়েছ। সে তোমার প্রতি অন্যায় করার পূর্বেই তুমি তার প্রতি অন্যায় করেছ।”
অপরদিকে ওমর (রা.) পিতা হিসেবে তার নিজের ছেলে আব্দুল্লাহ্ বিন ওমর (রা.)-এর প্রতি তার হক্ব যথাযথভাবে আদায় করেছেন। আব্দুল্লাহ্ ইবনে ওমর (রা.) ছিলেন রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর একজন সাহাবা, তিনি ছিলেন একজন ফকিহ্ এবং মুসলিম সমাজের জন্য একজন শক্তিমান ও কার্যকর নেতা ও পথপ্রদর্শক। বাস্তবিক অর্থে তিনি (রা.) ছিলেন চারজন বিখ্যাত আব্দুল্লাহ্’র মধ্যে একজন যিনি আমির মুয়াবিয়াকে জবাবদিহিতার সম্মুখীন করেছিলেন যখন মুয়াবিয়া তার সন্তানকে পরবর্তী খলিফা হিসাবে মুসলিমদের উপর চাপিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছিল। আব্দুল্লাহ্ ইবনে ওমর (রা.) বলেছিলেন, “এই খিলাফত ব্যবস্থা বাইজেন্টাইন, সিজার কিংবা খসরুর রাজতন্ত্র নয় যেখানে সন্তান তার বাবার রাজত্বের উত্তরাধিকারী হয়। যদি তাই হত তাহলে আমার পিতার মৃত্যুর পর আমি খলিফার দায়িত্ব পালন করতাম। এমনকি আমার পিতা আমার নাম ৬ জন মনোনয়ন প্রার্থীর মধ্যেও রাখেননি, তিনি খিলাফতের নির্ধারিত শর্তের বাইরে অন্যকিছুকে প্রাধান্য দেননি।”
মালিকী মাযহাবের ইমাম আবুল হাসান আলী ইবনে খালাফ আল-কাসিম (রহ.) বলেন, “যে ব্যক্তি ইচ্ছা পোষণ করে তার সন্তানকে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা তার জন্য চক্ষু শীতলকারী হিসেবে মঞ্জুর করবেন, সে যেন সন্তানকে কুর‘আন শিক্ষাদানে ব্যয়কৃত অর্থের ব্যাপারে কৃপণ না হয়। সে যদি তার সন্তানের কুর‘আন শিক্ষার জন্য অর্থ ব্যয় করে তাহলে তা তার জন্য একটি চমৎকার নেক আমল হিসেবে গণ্য হবে, ইনশাআল্লাহ্। আর যে তার সন্তানকে ভালোভাবে শিক্ষাদান করবে, তার পড়াশোনার তদারকী বা অগ্রগতি সাধন করবে এবং তাকে শৃঙ্খলা শিক্ষা দেওয়ার মাধ্যমে সুশৃঙ্খল করবে, তাহলে সে একটি উত্তম আমল করল এবং আশা করা যায়, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা তাকে দ্বিগুণ পুরস্কার দিবেন।”
পিতা তার সন্তানের ঈমানকে সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করবেন
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা বলেন, [وَوَصَّى بِهَا إِبْرَاهِيمُ بَنِيهِ وَيَعْقُوبُ يَا بَنِيَّ إِنَّ اللَّهَ اصْطَفَى لَكُمُ الدِّينَ فَلا تَمُوتُنَّ إِلَّا وَأَنْتُمْ مُسْلِمُونَ] “এরই উপদেশ দিয়েছিল ইব্রাহীম তার সন্তানদের এবং একইভাবে ইয়াকুবও যে, হে আমার সন্তানগণ, নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তোমাদের জন্য এ দ্বীনকে মনোনীত করেছেন। কাজেই তোমরা মুসলিম না হয়ে কখনও মৃত্যুবরণ করো না।” [আল-বাকারা ১৩২]। রাসূলুল্লাহ্ (সা) যেভাবে দারুল-আরকামে কিশোর/তরুণ সাহাবাদেরকে ঈমানী চেতনায় গড়ে তুলেছিলেন, ঠিক তেমনিভাবে একজন মুসলিম পিতার উচিত তার সন্তানদেরকে ইসলামী আকীদার উপর অটল ঈমানের অধিকারী হিসেবে গড়ে তোলা। আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেন, আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম তাদের ঈমানের উপর ভিত্তি করে জান্নাতের সুউচ্চ মর্যাদা লাভ করবে এবং তাদের পূণ্যবান পিতাদের সাথে একত্রিত হবে। নিঃসন্দেহে এটি হবে মৃত্যুর সাময়িক বিরতির পর এক আনন্দঘন চিরস্থায়ী সাক্ষাৎ। আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা বলেন, [وَالَّذِينَ آمَنُوا وَاتَّبَعَتْهُمْ ذُرِّيَّتُهُم بِإِيمَانٍ أَلْحَقْنَا بِهِمْ ذُرِّيَّتَهُمْ وَمَا أَلَتْنَاهُم مِّنْ عَمَلِهِم مِّن شَيْءٍ] “যারা ঈমান এনেছে এবং যাদের সন্তান-সন্ততিরাও ঈমানের ক্ষেত্রে তাদেরকে অনুসরণ করেছে, আমি তাদের সন্তান-সন্ততিকে তাদের অনুরূপ মর্যাদায় সমুন্নত করব এবং তাদের নিজেদের পুরস্কার (মর্যাদার) কোনো কমতি হবে না।” [আত তুর-২১]। ইসলাম একজন মুসলিম পিতাকে তার সন্তানের জন্য দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী প্রতিপত্তি অর্জনের জন্য সম্পদ, লেখাপড়া ও বৈষয়িক সুবিধার প্রতিযোগীতায় মশগুল হয়ে পরার তুচ্ছ স্বপ্ন দেখায় না, বরং আখিরাতের সুউচ্চ সম্মান অর্জনের লোভনীয় স্বপ্ন দেখায়। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা বলেন, [وَإِذْ قَالَ لُقْمَانُ لِابْنِهِ وَهُوَ يَعِظُهُ يَا بُنَيَّ لَا تُشْرِكْ بِاللَّهِ إِنَّ الشِّرْكَ لَظُلْمٌ عَظِيمٌ] “আর স্মরণ কর যখন লুকমান তার পুত্রকে উপদেশ দিয়ে বলেছিল, হে আমার পুত্র! আল্লাহ্’র ইবাদতে কাউকে শরিক করবে না, কারণ র্শিক হল সবচেয়ে বড় জুলুম। [লুকমান- ১৩]। একজন মুসলিম পিতা তার সন্তানের ঈমানকে সুদৃঢ় করার জন্য সর্বদা সচেষ্ট থাকবেন, কারণ তিনি জানেন যে সন্তানের সঠিকপথ বা হিদায়েত লাভের জন্য পিতা-মাতার প্রভাব সবচেয়ে বেশি। রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেন, مَا مِنْ مَوْلُودٍ إِلَّا يُولَدُ عَلَى الْفِطْرَةِ فَأَبَوَاهُ يُهَوِّدَانِهِ أَوْ يُنَصِّرَانِهِ أَوْ يُمَجِّسَانِهِ “প্রত্যেক আদম সন্তানই মুসলিম হিসেবে ভূমিষ্ঠ হয়, কিন্তু তার পিতা-মাতা তাকে একজন ইহুদি, খ্রিস্টান কিংবা অগ্নি-উপাসক বানিয়ে ফেলে। [বুখারী ও মুসলিম]।
ইসলামের প্রতি সঠিক বিশ্বাসের ক্ষেত্রে বর্তমানের মুসলিম পিতারা ধর্মনিরপেক্ষ ব্যবস্থার কারণে অনেক বড় প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হন, যে ব্যবস্থা প্রতিনিয়ত আমাদের দ্বীনের ক্ষতি সাধন করে চলেছে। ধর্মনিরপেক্ষ ব্যবস্থা ধর্মকে জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্র থেকে বিচ্ছিন্ন করার উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যেখানে ধর্মবিশ্বাসের গুরুত্ব শূন্যের কোঠায় নিয়ে আসা হয়েছে। যার ফলে, এতে অবাক হওয়ার কোনোও কারণ নেই যে পৃথিবীব্যাপী সন্দেহবাদী (agnostic) লোকের সংখ্যা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে যারা বলে যে জীবনের উদ্দেশ্যের ব্যাপারে তারা সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে। এই সন্দেহবাদ (agnosticism) এর উত্থান কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং এটি হল বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সরাসরি ফলাফল, যেগুলো ধর্মনিরপেক্ষতার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। আর তাই একজন সন্তানের মধ্যে সঠিক ঈমান প্রতিষ্ঠা করার জন্য মুসলিম পিতাকে অবশ্যই একটি শক্তিশালী এবং পুঙ্খানুপুঙ্খ ইসলামী শিক্ষাদান পদ্ধতির সাহায্য নিতে হবে।
একজন মুসলিম পিতাকে অবশ্যই আক্বীদার সাথে সম্পৃক্ত গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন বিষয়সমূহকে নিজে জানতে হবে ও সন্তানকে শিখাতে হবে; যার মধ্যে রয়েছে, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা’র অস্তিত্বের অপরিহার্যতা, নবী রাসুলের প্রয়োজনীয়তা, মহাগ্রন্থ আল কুর‘আন-এর মোজেজা, রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর সুন্নাহ্’কে ওহী হিসেবে প্রমাণ এবং ক্বাদা ও ক্বদর সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা। পাশাপাশি তাকে এ ব্যাপারেও সতর্ক থাকতে হবে যে ধর্মনিরপেক্ষ ব্যবস্থার ছত্রছায়ায় বস্তুবাদকে মহাবিশ্বের উৎপত্তির কারণ হিসেবে উপস্থাপন করা হয় যেখানে ইসলামী আক্বীদার অকাট্যতাকে এবং এর ঐশীবাণীসমূহের বৈধতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়। তাকে স্থানীয় বা আঞ্চলিক প্রথা ও আচার-অনুষ্ঠানের ব্যাপারেও সতর্ক থাকতে হবে, যেখানে পূর্বপুরুষের ধর্মবিশ্বাসকে কোন যথাযথ প্রমাণ ছাড়াই গ্রহণ করা হয়। তাকে অদৃষ্টবাদিতার (fatalism) ব্যাপারেও সতর্ক থাকতে হবে যা মুসলিমদের ইসলামী দায়িত্ব পালনের অঙ্গীকারকে দুর্বল করে দেয়। এর অর্থ হল, একজন মুসলিম পিতা তার ঘরকে দারুল-আরকামের আদলে পরিচালনা করবেন যেখানে হিদায়েতের আলো প্রস্ফুটিত হবে এবং একই সাথে সকল ভ্রান্ত ও কুফরী বিশ্বাসগুলোর কবর রচিত হবে। আর এই সঠিক প্রক্রিয়া আমাদের সন্তানদেরকে কুফরের সংক্রমণ থেকে মুক্ত থাকার শক্তি যোগাবে যে সংক্রমণ করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ থেকেও ভয়ঙ্কর; কেননা কুফর চিরস্থায়ী আখিরাতকে ধ্বংস করে দেয়। এ সকল প্রচেষ্টা সত্ত্বেও একজন মুসলিম পিতা তার সন্তানের জন্য আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা’র কাছে এই বিশ্বাস নিয়ে ক্রমাগত দোয়া করবেন যেন আমাদের এই কঠিন দুর্যোগপূর্ণ সময়ে তার সন্তানের ঈমান দৃঢ় থাকে। কেননা হিদায়াত একমাত্র আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা’র ই হাতে এবং পিতা হলেন এমন ব্যক্তি সন্তানের জন্য যার দোয়া আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা ফিরিয়ে দেন না। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন, ثَلاَثُ دَعَوَاتٍ يُسْتَجَابُ لَهُنَّ لاَ شَكَّ فِيهِنَّ دَعْوَةُ الْمَظْلُومِ وَدَعْوَةُ الْمُسَافِرِ وَدَعْوَةُ الْوَالِدِ لِوَلَدِهِ “তিনটি দোয়া আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা অবশ্যই কবুল করেন; অত্যাচারীতের দোয়া, মুসাফিরের দোয়া এবং সন্তানের জন্য পিতার দোয়া।” [ইবনে মাজাহ]
পিতা সন্তানদেরকে ইসলামের হুকুম পালনে অভ্যস্ত করে তুলবেন
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা বলেন, [يَقُولُونَ رَبَّنَا هَبْ لَنَا مِنْ أَزْوَاجِنَا وَذُرِّيَّاتِنَا قُرَّةَ أَعْيُنٍ وَاجْعَلْنَا لِلْمُتَّقِينَ إِمَاماً] “এবং যারা বলে, হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে দান করুন এমন স্ত্রী ও সন্তানদের যারা আমাদের জন্য চক্ষুশীতলকারক হবে এবং আমাদেরকে মুত্তাকীদের জন্য নেতা বানিয়ে দিন।” [আল-ফুরক্বান-৭৪]। একজন মুসলিম পিতার দায়িত্ব হল তার সন্তানদেরকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা’র ইবাদতের দিকে ধাবিত করা এবং আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা ও রাসূলের আনুগত্যের আদেশ দেওয়া। আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা আমাদের লুকমান (আ:)-এর ঘটনা স্মরণ করিয়ে পবিত্র কুর‘আন-এ বলেন, [يَا بُنَيَّ أَقِمِ الصَّلَاةَ وَأْمُرْ بِالْمَعْرُوفِ وَانْهَ عَنِ الْمُنكَرِ وَاصْبِرْ عَلَى مَا أَصَابَكَ إِنَّ ذَٰلِكَ مِنْ عَزْمِ الْأُمُورِ] “হে আমার পুত্র! সালাত কায়েম কর, সৎকাজে আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ কর এবং (এর ফলশ্রুতিতে) তোমার উপর যে বিপদ আপতিত হয় তা তুমি ধৈর্য্যসহকারে মোকাবেলা কর। নিঃসন্দেহে এটি একটি সাহসিকতাপূর্ণ কাজ যা দৃঢ় সংকল্পের মাধ্যমে অর্জন করতে হয়।” [লুকমান-১৭]। একজন মুসলিম পিতা তার সন্তানের জন্য আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা’র কাছে দোয়া করবেন এবং দৃঢ়তার সাথে এটি নিশ্চিত করবেন যেন তার সন্তানদের মধ্যে ন্যায়পরায়নতার গুণাবলী প্রোথিত হয়। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা বলেন, [قَالَ رَبِّ أَوْزِعْنِي أَنْ أَشْكُرَ نِعْمَتَكَ الَّتِي أَنْعَمْتَ عَلَيَّ وَعَلَى وَالِدَيَّ وَأَنْ أَعْمَلَ صَالِحاً تَرْضَاهُ وَأَصْلِحْ لِي فِي ذُرِّيَّتِي إِنِّي تُبْتُ إِلَيْكَ وَإِنِّي مِنَ الْمُسْلِمِينَ] “তারা বলে, হে আমাদের রব! আমার ও আমার পিতামাতার প্রতি আপনার অনুগ্রহকে স্মরণ করে আমি যেন আপনার শুকরিয়া আদায় করতে পারি সেই তৌফিক দান করুন। এবং আমার সন্তানদেরকে ন্যায়পরায়ণতার পথে পরিচালিত করুন। আমি আপনার নিকট তওবা করছি এবং কেবল আপনার কাছেই নিজেকে সমর্পণ করছি। [আহক্বাফ- ১৫]। রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেন, مَا نَحَلَ وَالِدٌ وَلَدًا مِنْ نَحْلٍ أَفْضَلَ مِنْ أَدَبٍ حَسَنٍ পিতা কর্তৃক পুত্রকে দেওয়া সবচেয়ে মূল্যবান উপহার হল উত্তম আচরণ শিক্ষাদান। [তিরমিযী]
সুতরাং মুসলিম পিতা একজন বন্ধুসুলভ ও যত্নবান শিক্ষক হওয়ার পাশাপাশি তার সন্তানকে প্রজ্ঞার সাথে শাসন দ্বারা সুশৃঙ্খল করবেন, যেন তার প্রিয় সন্তানকে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা’র ক্রোধ ও আখেরাতের কঠিন শাস্তি থেকে রক্ষা করতে পারেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেন, لأَنْ يُؤَدِّبَ الرَّجُلُ وَلَدَهُ خَيْرٌ مِنْ أَنْ يَتَصَدَّقَ بِصَاعٍ “একজন ব্যক্তির জন্য এক সা‘আ পরিমাণ সম্পদ দান করার চেয়ে তার সন্তানকে সুশৃঙ্খলভাবে গড়ে তোলা অধিক উত্তম।” [তিরমিযী]। আল্লাহ্’র রাসূল (সা) আরও বলেন, مَنْ عَالَ ثَلاَثَ بَنَاتٍ فَأَدَّبَهُنَّ وَزَوَّجَهُنَّ وَأَحْسَنَ إِلَيْهِنَّ فَلَهُ الْجَنَّةُ “কোন ব্যক্তি যদি তিনটি কন্যা সন্তানকে লালন-পালন করে, তাদেরকে সুশৃঙ্খল হিসেবে গড়ে তুলে, তাদেরকে উত্তমভাবে বিয়ে দেয় এবং তাদের জন্য কল্যানকর কিছু করে তাহলে সে জান্নাতী।” [আবু দাউদ]।
সন্তানের প্রতি একজন মুসলিম পিতার শাসন হওয়া উচিত সন্তানের প্রতি তার মমতা ও যত্নশীলতার বহিঃপ্রকাশস্বরূপ। এই শাসন কখনোই হতাশা, রাগ কিংবা শত্রুভাবাপন্ন মনোভাব থেকে হওয়া উচিত নয়। সন্তানের জন্য দুনিয়ার পদমর্যাদার আকাঙ্খা থেকেও একজন মুসলিম পিতা তার সন্তানকে শাসন করবেন না, বরং এই শাসন হবে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা’র সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য এবং চিরস্থায়ী আখিরাতে সন্তানের উচ্চ মর্যাদা নিশ্চিত করার জন্য। রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেন, “সাহরি না খেয়ে কেউ যদি সকালে ঘুম থেকে উঠে তাহলে সে নাস্তা না খেয়ে তার রোজা সম্পূর্ণ করবে এবং কেউ যদি সকালে নাস্তা খেয়ে ফেলে তাহলে ইফতার পর্যন্ত বাকি দিন সে না খেয়ে থাকবে।” [মুসলিম]। ইমাম মুসলিম আরও বর্ণনা করেন, সাহাবাগণ (রা.) বলেছেন, “সুতরাং আমরা সবাই আশুরার দিনে সওম পালন করতাম এবং আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা’র রহমতে আমাদের সন্তানরাও সাওম পালন করত। আমরা সন্তানদেরকে নিয়ে মসজিদে চলে যেতাম এবং তাদের জন্য তুলা দিয়ে খেলনা বানিয়ে নিতাম। যখন তাদের ক্ষুধা পেত এবং খাবারের জন্য কান্না করত তখন আমরা এই খেলনাগুলো তাদেরকে দিতাম যেন ইফতার পর্যন্ত তাদের কান্না বন্ধ থাকে।”
যথাযথভাবে শিক্ষাদান, উৎসাহ প্রদান, উপদেশ দেওয়া, আদেশ করা, তিরস্কার করা এবং ভীতি প্রদর্শনের পরও যদি দশ বা তার অধিক বছরের সন্তান সালাত আদায় না করে তাহলে সর্বশেষ বিকল্প হিসেবে মুসলিম পিতার উচিত সন্তানকে প্রহার করা। রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেন, مُرُوا الصَّبِيَّ بِالصَّلَاةِ إِذَا بَلَغَ سَبْعَ سِنِينَ، فَإِذَا بَلَغَ عَشْرَ سِنِينَ فَاضْرِبُوهُ عَلَيْهَا সাত বছর পূর্ণ হলে তোমরা সন্তানদেরকে সালাত আদায়ের আদেশ কর। যদি বয়স ১০ বছর পূর্ণ হয় তাহলে সালাত আদায় না করলে তাদেরকে প্রহারের মাধ্যমে সুশৃঙ্খল কর। [আবু দাউদ, তিরমিযী]।
আজকের দিনের মুসলিম পিতাকে সন্তানদের কঠোর নিয়মানুবর্তিতার প্রতি বিশেষভাবে গুরুত্ব দিতে হবে, কেননা বর্তমানে জীবনব্যবস্থা হিসেবে ইসলাম অনুপস্থিত। বিশ্বব্যাপী ধর্মনিরপেক্ষতার আধিপত্যের কারণে ব্যক্তিস্বাধীনতার মূল্যবোধসমূহ মুসলিম তরুণদের বিপথগামী করছে। এর পরিণাম হিসেবে উদ্ভূত সমস্যাগুলো মুসলিম পিতাদের জন্য গভীর চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, বিশেষ করে যাদের বয়সন্ধিকালীন ও কিশোর বয়সী সন্তান রয়েছে। এই বয়সী সন্তানের বাবাদেরকে প্রায়শই তাদের নিজেদের কিশোর সময়ের স্মৃতিচারণ করে পরিতাপ প্রকাশ করতে দেখা যায়। শিক্ষাব্যবস্থার পশ্চিমীকরণ ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রভাবে তরুণদের মধ্যে এক ধরনের ধ্বংসাত্মক পরিণতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ব্যাক্তিস্বাধীনতার চর্চা ও ব্যক্তিকেন্দ্রিক মানসিকতা তরুণদের মধ্যে অন্য কারো প্রভুত্ব বা শাসন না মানার সহজাত প্রবণতা তৈরি করেছে; যেখানে তারা পিতা তো দূরে থাক আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা’র আদেশও মানতে চায় না।
বস্তুবাদ ও হেডোনিসম (hedonism) তরুণদের মধ্যে কামনা-বাসনা বশবর্তী হওয়ার অদম্য আকাঙ্খা তৈরি করেছে, যেখানে তারা কোনো বিধিনিষেধ বা পরামর্শের তোয়াক্কাই করছেনা। বর্তমান ধর্মনিরপেক্ষ ব্যবস্থায় মুসলিম তরুণদের হরহামেশাই বিভিন্ন ফরজ দায়িত্ব পরিত্যাগ করতে এবং হারাম কাজে জড়িত হতে দেখা যায়; যেমন, মদ্যপান, নেশাজাতীয় দ্রব্য সেবন ও যিনা-ব্যভিচার। পাপাচার এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে অনেক অবিবাহিত মেয়েরা গর্ভপাত করছে এবং কেউ কেউ তো প্রকাশ্যে নিজেদেরকে সমকামী হিসেবে ঘোষণা করছে। এসব কিছুই ঘটছে কারণ আমাদের মুসলিম পরিবারগুলো অসংখ্য দুর্বল ব্যক্তিত্ব তৈরি করছে। এসব অপকর্মের পাশাপাশি এই দুর্বল ব্যক্তিত্বের মানুষগুলো তাদের রাগকে দমন করতে পারছেনা এবং নারী ও শিশুদেরকে অত্যাচার করছে; সেটা নির্দয় শারীরিক প্রহারই হোক কিংবা মানসিক নির্যাতনই হোক। এই সমস্যাগুলো পশ্চিমা সমাজে যেমন বিদ্যমান তেমনি মুসলিম দেশগুলোতেও দৃশ্যমান; পার্থক্য শুধুমাত্র তীব্রতার মাত্রায়।
আর্থিক ভরণপোষণের দায়িত্ব পিতার
ইসলামে স্ত্রী ও তার সন্তানের ভরণপোষণের দায়িত্ব পালন করা পিতার উপর ফরজ। সন্তানের মা যতই অর্থ-বিত্তের মালিক হোন না কেন সন্তান কিংবা স্বামীর ভরণপোষণের কোন দায়বদ্ধতা তার নেই। আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা বলেন, [الرِّجَالُ قَوَّامُونَ عَلَى النِّسَاءِ بِمَا فَضَّلَ اللَّهُ بَعْضَهُمْ عَلَىٰ بَعْضٍ وَبِمَا أَنفَقُوا مِنْ أَمْوَالِهِمْ] “পুরুষ হলো নারীর অভিভাবক/তত্ত্বাবধায়ক, কারণ পুরুষকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা নারীর উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন এবং তার দায়িত্ব হলো নারীর ভরণপোষণ। [নিসা: ৩৪]। স্ত্রী-সন্তানের পাশাপাশি একজন মুসলিম পিতার দায়িত্ব হলো তার স্বীয় পিতা-মাতা ও নিকটাত্মীয়দেরকে আর্থিকভাবে সহায়তা করা। আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা বলেন, [قُلْ مَا أَنفَقْتُم مِّنْ خَيْرٍ فَلِلْوَالِدَيْنِ وَالْأَقْرَبِينَ] “বল, আর যা কিছুই তোমরা খরচ কর তা তোমাদের পিতামাতা ও নিকটাত্মীয়দের জন্য।” [সূরা আল বাকারা-২১৫]। এই আর্থিক ভরণপোষণ কোন অনুগ্রহ কিংবা দান নয়, বরং তা হল আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা প্রদত্ত একটি ফরজ দায়িত্ব। ভরণপোষণ এমনভাবে প্রদান করতে হবে যেন তা প্রয়োজন পূরণের জন্য যথেষ্ট হয় এবং এক্ষেত্রে কৃপণতাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এর কোনরুপ ব্যতয় একটি গুরুতর বিষয় যার জন্য ইসলামী বিচারক পিতার বিরুদ্ধে রায় প্রদান করবেন। হিন্দ বিন্ত উতবা রাসূলুল্লাহ্-এর কাছে অভিযোগ করে বললেন, আবু সুফিয়ান একজন কৃপণ মানুষ যার কারণে তার সম্পদ থেকে অগোচরে আমাকে ব্যয় করতে হয়। উত্তরে রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, خُذِي مَا يَكْفِيكِ وَوَلَدَكِ بِالْمَعْرُوفِ “তোমার নিজের ও সন্তানদের প্রয়োজন মতো খরচ কর যা তোমাদের জন্য যথেষ্ট (বিল মা‘রুফ) হয়। [বুখারী]।
আর্থিক ভরণপোষণের ক্ষেত্রে বিল-মা‘রুফ এর অন্তর্ভুক্ত হল সকল মৌলিক চাহিদাসমূহ; যেমন, খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান এবং কিছু বিলাস দ্রব্য। বিল-মা‘রুফ হতে হবে যুক্তিসঙ্গত উপায়ে যেখানে কোনো নির্দিষ্ট পরিবারের বসবাসের স্থানের জীবনযাত্রার মানকে মূল বিবেচ্য হিসেবে ধরা হবে; উদাহরণস্বরূপ: ভরণপোষণে বিল মা‘রুফ এর পরিমাণ শহর অঞ্চলে বেশি, গ্রাম অঞ্চলে তুলনামূলকভাবে কম এবং মরু অঞ্চলে (বেদুইনদের) আরো কম।
বর্তমান মুসলিম বিশ্বে যুক্তিসঙ্গত ভরণপোষণ নিজেই একটি বিরাট প্রতিবন্ধকতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। বিনামূল্যে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার আনুপস্থিতিতে অনেক পিতাকেই সন্তানের জন্য প্রাইভেট শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সেবার ব্যয় মেটাতে গিয়ে নিদারূণ সঙ্কটের মুখে পড়তে হচ্ছে। ভরণপোষণ প্রদান করা একজন মুসলিম পিতার জন্য একটি অবশ্যপালনীয় দায়িত্ব, তবে একমাত্র দায়িত্ব নয়। অন্যান্য দায়িত্বপালনতো দূরে থাক একজন মুসলিম পিতা বর্তমানে আর্থিক ভরণপোষণের দায়িত্ব পালন করতেই হিমশিম খাচ্ছেন।
উপসংহার: ধর্মপ্রাণ সন্তানরা পিতার জন্য দুনিয়া ও আখিরাত উভয়ের জন্যই কল্যাণকর
নিঃসন্দেহে একজন মুসলিম পিতাকে তার সন্তানদের প্রতি অনেকগুলো ফরজ দায়িত্ব পালন করতে হয় যেগুলো সঠিকভাবে পালন করলে যেমন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা’র পক্ষ থেকে পুরস্কার রয়েছে ঠিক তেমনি উপেক্ষা করলে শাস্তি রয়েছে। একজন পিতা তার পরিবারের উপর দায়িত্বশীল এবং এই দায়িত্বের ব্যাপারে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করবেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেন, إن الله َسائلٌ كلَّ راعٍ عما استرعاه أَحَفِظَ أم ضيَع حتى يُسألَ الرجلُ عن أهلِ بيتِه “নিশ্চয়ই আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা প্রত্যেক দায়িত্বশীল ব্যক্তিকে তাদের দায়িত্বের আওতাভুক্ত বিষয়গুলো নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করবেন যে সে তা সঠিকভাবে পালন করেছিল, নাকি উপেক্ষা করেছিল এবং অবশেষে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা একজন ব্যক্তিকে তার পরিবারের সদস্যদের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করবেন।” [নাসাঈ, ইবনে হিব্বান]। রাসূলুল্লাহ্ (সা) আরো বলেন, مَا مِنْ عَبْدٍ يَسْتَرعِيهِ اللهُ رَعِيَّة يَموتُ يَوْمَ يَمُوتُ وهو غَاشٌّ لِرَعِيَّتِهِ إِلا حَرَّمَ اللهُ عليه الجَنَّةَ “আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা’র বান্দাদের মধ্যে এমন কেউ নেই যাকে কিছু মানুষের উপর দায়িত্ববান করা হয়েছিল কিন্তু সে তার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেনি যার জন্য জান্নাতকে হারাম করা হয়নি।” (মুসলিম)। রাসূলুল্লাহ্ (সা) আরো বলেন, مَا مِنْ عَبْدٍ يَسْتَرْعِيهِ اللَّهُ رَعِيَّةً فَلَمْ يَحُطْهَا بِنَصِيحَةٍ إِلَّا لَمْ يجد رَائِحَة الْجنَّة “কাউকে যদি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা কিছু লোকের উপর কর্তৃত্ব দেন এবং সে তার অধীনস্থদেরকে সদুপদেশ দ্বারা রক্ষা না করে তবে সে জান্নাতের গন্ধও পাবে না।” [বুখারী]। তিনিই একজন সৌভাগ্যবান পিতা যিনি সন্তানদেরকে যথাযথ শিক্ষাদান ও শাসন এর মাধ্যমে সুপথে পরিচালিত করেন এবং আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা’র অনুগ্রহে ন্যায়পরায়ন সন্তান পেয়ে থাকেন। এই ন্যায়পরায়ন সন্তানরা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা ও তাঁর রাসূলের (সা) প্রতি ভালোবাসা থেকে স্বেচ্ছায় তাদের পিতাকে তার হক্ব মোতাবেক যথাসাধ্য মান্য করবে। আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা’র অনুগ্রহে এমন একজন কর্তব্যপরায়ন পিতা দুনিয়া ও আখিরাতের জীবনে ধন্য। রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেন, إِذَا مَاتَ الإِنْسَانُ انْقَطَعَ عَنْهُ عَمَلُهُ إِلاَّ مِنْ ثَلاَثَةٍ إِلاَّ مِنْ صَدَقَةٍ جَارِيَةٍ أَوْ عِلْمٍ يُنْتَفَعُ بِهِ أَوْ وَلَدٍ صَالِحٍ يَدْعُو لَهُ “একজন মানুষের মৃত্যুর পর তার আমলের সকল দরজা বন্ধ হয়ে যায়; তিনটি ব্যতীত, সাদাকায়ে যারিয়া, তার রেখে যাওয়া জ্ঞান যার দ্বারা মানুষ উপকৃত হয় এবং একজন ধর্মপ্রাণ সন্তান যে তার পিতার জন্য দোয়া করতে থাকে।” [আন-নাসাঈ]। রাসূলুল্লাহ্ (সা) আরো বলেন, إِنَّ الرَّجُلَ لَتُرْفَعُ دَرَجَتُهُ فِي الْجَنَّةِ فَيَقُولُ أَنَّى هَذَا فَيُقَالُ بِاسْتِغْفَارِ وَلَدِكَ لَكَ “একজন ব্যক্তিকে জান্নাতে তার অর্জিত সম্মানের চেয়ে অধিক সম্মানজনক স্থানে রাখা হবে। এর ফলে সে জিজ্ঞাসা করবে, এই বাড়তি সম্মান কেন দেওয়া হল?। তখন তাকে বলা হবে, এর কারণ এই যে তোমার সন্তান তোমার মাগফিরাতের জন্য দোয়া করত।” (ইবনে মাজাহ)।
হে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা! পিতা হিসেবে আমরা যেন আমাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে পারি। আমাদের পুত্র-কন্যারা যেন আমাদের জন্য চক্ষুশীতলকারক হয় এবং মুসলিম উম্মাহ্’র একেকটি পিলারে পরিণত হয়। আমাদের সন্তানরা যেন দ্বিতীয় খিলাফতে রাশেদাহ্ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে আমাদের সাথে যোগদান করে এবং ইসলামকে জীবনব্যবস্থা হিসেবে পুনরায় প্রতিষ্ঠার পর এর দাওয়াহ-কে পুরো বিশ্বের কাছে নিয়ে যেতে পারে। আমিন।
রাসূলুল্লাহ্ (সা) আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা’র আহকামের যথাযথ ব্যাখ্যা তার নিজের উক্তিতে সুন্নাহর অংশ হিসেবে আমাদেরকে অবহিত করেছেন এবং তিনি ওহী ব্যতীত কোন কথা বলতেন না, যা বিশ্বজগতের রবের পক্ষ থেকে অবতীর্ণ হত। আহমদ বর্ণনা করেছেন যে রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেন, تَكُونُ النُّبُوَّةُ فِيكُمْ مَا شَاءَ اللَّهُ أَنْ تَكُونَ ثُمَّ يَرْفَعُهَا إِذَا شَاءَ أَنْ يَرْفَعَهَا ثُمَّ تَكُونُ خِلَافَةٌ عَلَى مِنْهَاجِ النُّبُوَّةِ فَتَكُونُ مَا شَاءَ اللَّهُ أَنْ تَكُونَ ثُمَّ يَرْفَعُهَا إِذَا شَاءَ اللَّهُ أَنْ يَرْفَعَهَا ثُمَّ تَكُونُ مُلْكًا عَاضًّا فَيَكُونُ مَا شَاءَ اللَّهُ أَنْ يَكُونَ ثُمَّ يَرْفَعُهَا إِذَا شَاءَ أَنْ يَرْفَعَهَا ثُمَّ تَكُونُ مُلْكًا جَبْرِيَّةً فَتَكُونُ مَا شَاءَ اللَّهُ أَنْ تَكُونَ ثُمَّ يَرْفَعُهَا إِذَا شَاءَ أَنْ يَرْفَعَهَا ثُمَّ تَكُونُ خِلَافَةً عَلَى مِنْهَاجِ النُّبُوَّة “আমার নবুয়াত তোমাদের মধ্যে ততকাল থাকবে যতকাল আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা ইচ্ছা করেন। এরপর আসবে নবুয়াতের আদলে খিলাফত এবং তা ততদিন থাকবে যতদিন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা ইচ্ছাপোষণ করেন। এরপর আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা এর অবসান ঘটাবেন। এরপর আসবে আঁকড়ে ধরা (বংশের) শাসন এবং তা ততদিন অবস্থান করবে যতদিন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা ইচ্ছা পোষণ করেন। এরপর আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা এর অবসান ঘটাবেন। এরপর আসবে অত্যাচারী জালিমের শাসন এবং তা ততকাল অবস্থান করবে যতকাল আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা ইচ্ছা পোষণ করেন। এরপর আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা এর অবসান ঘটাবেন। এরপর আবার আসবে খিলাফত, নবুয়্যতের আদলে।” এরপর আল্লাহ্’র রাসূল (সা) চুপ থাকলেন।