প্রশ্ন-উত্তর: নামাযে দূরত্ব বজায় রাখা একটি বিদ’আহ্, যার গুনাহ্ শাসকদের আমলনামায় লিপিবদ্ধ হচ্ছে

নিচের অনুবাদটি সম্মানিত মুজতাহিদ ও মুফাচ্ছির শাইখ আতা ইবন খলীল আবু আল-রাশতা (আল্লাহ তাকে হেফাজত করুন) কর্তৃক দেয়া এক প্রশ্নের জবাব, আরবী থেকে অনুদিত

সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা’র, এবং আল্লাহ্’র রহমত ও শান্তি বর্ষিত হোক রাসূলুল্লাহ্ (সা), তাঁর (সা) পরিবার, সাহাবাগণ (রা), এবং তাঁর (সা) অনুসারীদের প্রতি।

তাদের সবাইকে উদ্দেশ্য করে এই প্রশ্নোত্তর, যারা আমাকে জুম্মা এবং অন্যান্য জামাতে নামায আদায়ের সময়ে ইবাদতকারী এবং তার পাশের জনের মধ্যে দুই-মিটার ব্যবধান বা দূরত্ব বজায় রাখার বিষয়ে প্রশ্ন করেছেন… এবং তারা বলেছেন, কিছু মুসলিম দেশের শাসকেরা মসজিদসমূহ বন্ধ করে এবং অতঃপর সেগুলো খুলে দেয়ার পর তারা ইবাদতকারীদেরকে পরষ্পরের মধ্যে দুই-মিটার দূরত্ব বজায় রাখতে বাধ্য করছে। তারা এই বিষয়টিকে এটা বলে বৈধতা দেয়ার চেষ্টা করছে, যেহেতু অসুস্থ ব্যক্তির ওজর রয়েছে এবং তাকে বসে নামায আদায়ের অনুমতি দেয়া হয়েছে, সেহেতু ক্বিয়াস অনুসারে একজন মুসলিম তার পাশের ব্যক্তি থেকে দুই মিটার দূরে থাকতে পারেন, যদিওবা তিনি অসুস্থ না হন, কিন্তু অসুস্থ হওয়ার আশঙ্কা করেন, সেক্ষেত্রে তার এই দূরত্ব বজায় রাখা উচিত… এবং তারা জিজ্ঞেস করেছেন: উল্লেখিত পদ্ধতিতে দূরত্ব বজায় রেখে পৃথকভাবে নামায আদায়ে বাধ্য করা কি শাসকদের জন্য বৈধ? কিংবা, এই দূরত্ব বজায় রাখার বিষয়টি কি দ্বীনের মধ্যে এমন নতুন এক উদ্ভাবন (বিদ’আহ্) যার গুনাহ শাসকদের আমলনামায় লিপিবদ্ধ হচ্ছে? প্রশ্নকারীগণ উত্তরগুলো খুঁজে পাওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছেন…

তাদের প্রশ্নের জবাবে বলছি, এবং আল্লাহ্ সকল সাফল্যের একমাত্র অভিভাবক:

আমরা ইতিপূর্বে নতুন কিছু উদ্ভাবন (বিদ’আহ্) সম্পর্কিত একাধিক প্রশ্নোত্তর প্রদান করেছি, এবং প্রশ্নকারীগণ যদি সেগুলো পর্যালোচনা করেন তবে তাদের নিকট এই উত্তরটি পরিষ্কার হয়ে যাবে যে, নামাযে দূরত্ব বজায় রাখার বিষয়টি এমন এক নতুন উদ্ভাবন যা পালনে শাসকগণ যদি মানুষকে বাধ্য করে তবে তারা এর জন্য গুনাহ্গার হবে, এবং এর ব্যাখ্যা নিম্নরূপ:

প্রথমত: আরবী ২৮শে রজব, ১৪৩৪ হিজরীতে, এবং ইংরেজি ০৭/০৬/২০১৩ খ্রিস্টাব্দে আমরা একটি প্রশ্নোত্তর প্রকাশ করি, যেখানে বলা হয়েছিল:

(শারী’আহ্’র কোন একটি বিষয়ে নতুন কিছু উদ্ভাবন করা হচ্ছে একটি সুস্পষ্ট সীমালঙ্ঘনকারী কাজ, যখন বিষয়টি ইতিমধ্যে শারী’আহ্ কর্তৃক সুনির্ধারিত হয়ে আছে। লিসান আল-আরব-এ উদ্ভাবন সম্পর্কে ভাষাতত্ত্বের দৃষ্টিকোন থেকে উল্লেখ করা হয়েছে যে: “المبتدع الّذي يأتي أمراً على شبهٍ لم يكن…، وأبدعت الشّيء: اخترعته لا على مثالٍ” “নতুন কিছু আনয়নকারী একটি বিষয়কে নতুন একরূপে নিয়ে আসে যা তার আগ পর্যন্ত অস্তিত্বহীন ছিল… একটি বিষয় ‘উদ্ভাবন’ করে সেটার স্বপক্ষে কোন উদাহরণ (দলিল) ছাড়াই মনগড়াভাবে তৈরি করে”। ইসলামী চিন্তাগত দৃষ্টিকোন থেকে এর অর্থও একই। উদাহরণস্বরূপ, যদি রাসূলুল্লাহ্ (সা) কোন একটি নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে কিছু করেন এবং একজন মুসলিম সেই পদ্ধতি থেকে বিচ্যুত হয়, তবে এটি একটি বিদ’আহ্। অতএব,কোন একটি শারী‘আহ্ হুকুম পালনের জন্য শারী’আহ্ নির্ধারিত পদ্ধতি থেকে বিচ্যুত হওয়াটাই বিদ’আহ্। এবং, এই হাদীসটির অনুমিত অর্থ হচ্ছে: «وَمَنْ عَمِلَ عَمَلًا لَيْسَ عَلَيْهِ أَمْرُنَا فَهُوَ رَدٌّ» “যে কেউ আমাদের এই বিষয়ে (অর্থাৎ, ইসলামে) এমন কিছু প্রবর্তন করে যা এর অন্তর্ভূক্ত নয়, তবে তা প্রত্যাখ্যাত।” [বুখারী ও মুসলিম]

উদাহরণস্বরূপ, যদি কেউ তার নামাযে দুইটির বদলে তিনটি সিজদাহ্ দেয়, অর্থাৎ সে নতুন একটি বিষয় উদ্ভাবন করে, তবে সে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর পদ্ধতি থেকে বিচ্যুত হয়েছে বলে গণ্য হবে। যদি কেউ মিনায় সাতটি পাথরের পরিবর্তে আটটি পাথর নিক্ষেপ করে, তবে সেটা হবে তার পক্ষ থেকে নতুন কিছু উদ্ভাবন, কারণ এটি রাসূলুল্লাহ্ (সা) কর্তৃক প্রদর্শিত কাজের বিরোধিতার শামিল। এবং, উদাহরণস্বরূপ, যদি কেউ আযানে নতুন কোন শব্দ যুক্ত করে, বা আযান হতে কোন শব্দ বাদ দিয়ে দেয়, তবে সেই ব্যক্তিও বিদ’আহ্-এর মধ্যে পতিত হবে, যেহেতু নবী করিম (সা) আযানের জন্য সুনির্দিষ্ট শব্দসমূহ অনুমোদন করে গেছেন।

তবে, শারী’আহ্ বিষয়বস্তু (যাতে কোনো পৃথক পদ্ধতি নির্ধারণ করা হয়নি) হতে বিচ্যুতির বিষয়ে হুকুম হচ্ছে, সেটি একটি আইনী অধ্যাদেশের মধ্যে পড়বে, অর্থাৎ: সেটা হয় হারাম, মাকরুহ, ইত্যাদি হিসেবে বিবেচিত হবে; আর যদি সেটা নিয়ন্ত্রক অধ্যাদেশের (হুকুম ওয়াদ’ঈ) অন্তর্ভুক্ত হয় এবং প্রযোজ্য ইঙ্গিতের উপর নির্ভর করে, তবে সেটি বাতিল, ফাসিক, ইত্যাদি শ্রেণীর আওতাভুক্ত হবে।

উদাহরণস্বরূপ, রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সালাতের বর্ণনা স¤পর্কে আয়েশা (রা) হতে মুসলিম কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি (রা) বলেছেন: «…وَكَانَ إِذَا رَفَعَ رَأْسَهُ مِنَ الرُّكُوعِ لَمْ يَسْجُدْ، حَتَّى يَسْتَوِيَ قَائِمًا، وَكَانَ إِذَا رَفَعَ رَأْسَهُ مِنَ السَّجْدَةِ، لَمْ يَسْجُدْ حَتَّى يَسْتَوِيَ جَالِسًا…» “রাসূলুল্লাহ্ (সা) যখন রুকু থেকে মাথা উঠাতেন তখন সোজা হয়ে না দাঁড়িয়ে সিজদাহ্’তে যেতেন না, এবং যখন সিজদাহ্ থেকে মাথা উঠাতেন তখন সোজা হয়ে না বসে পুনরায় সিজদাহ্’তে যেতেন না”।

তদানুসারে, এই বর্ণনায় রাসূলুল্লাহ্ (সা) আমাদেরকে দেখিয়েছেন যে, নামাযরত অবস্থায় একজন মুসলিমের রুকু হতে মাথা উঠানো উচিত এবং সোজা হয়ে দন্ডায়মান না হওয়া পর্যন্ত তার সিজদায় যাওয়া উচিত নয়, এবং যদি সে সিজদাহ্ থেকে উঠে আসে তবে সে যেন সোজা হয়ে বসার আগ পর্যন্ত পুনরায় সিজদাহ্ অবস্থায় ফিরে না যায়। এটাই রাসূলুল্লাহ্ (সা) কর্তৃক নির্ধারিত পদ্ধতি, এবং যদি কেউ এই নির্ধারিত পদ্ধতি হতে বিচ্যুত হয় তবে সে নতুন উদ্ভাবন (বিদ’আহ্) মধ্যে পড়ে যাবে। সুতরাং, নামাযে যদি কোন মুসলিম রুকু ও সিজদাহ্’র মধ্যে সোজা হয়ে দন্ডায়মান না হয়ে তাৎক্ষণিকভাবে রুকু থেকে সিজদায় চলে যায়, তবে সে বিদ’আহ্-এর মধ্যে পতিত হবে, কারণ এর মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ্’র (সা) প্রদর্শিত পদ্ধতির বিরোধিতা করা হবে। এটি হবে একটি বেআইনী উদ্ভাবন এবং এর সম্পাদনকারী গুরুতর গুনাহ্’র মধ্যে পতিত হবে।

উবায়দাহ্ বিন সামিত-এর বর্ণনার ভিত্তিতে মুসলিম কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে যে, إِنِّي سَمِعْتُ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «يَنْهَى عَنْ بَيْعِ  الذَّهَبِ بِالذَّهَبِ، وَالْفِضَّةِ بِالْفِضَّةِ، وَالْبُرِّ بِالْبُرِّ، وَالشَّعِيرِ بِالشَّعِيرِ، وَالتَّمْرِ بِالتَّمْرِ، وَالْمِلْحِ بِالْمِلْحِ، إِلَّا سَوَاءً بِسَوَاءٍ، عَيْنًا بِعَيْنٍ، فَمَنْ زَادَ، أَوِ ازْدَادَ، فَقَدْ أَرْبَى “আমি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে বলতে শুনেছি: তিনি (সা) তৎক্ষণাৎ ও সমান মাপের লেনদেন না হলে স্বর্ণের বিনিময়ে স্বর্ণ, রৌপ্যের বিনিময়ে রৌপ্য, গমের বিনিময়ে গম, খেজুরের বিনিময়ে খেজুর, এবং লবণের বিনিময়ে লবণ বিক্রয় করাকে নিষিদ্ধ করেছেন, যে ব্যক্তি কোন কিছু যোগ করে কিংবা অতিরিক্ত কিছু গ্রহণ করে এই লেনদেন করবে সে সুদের (রিবা) মধ্যে লিপ্ত হয়।” যদি কোন মুসলিম এই হাদীসটিকে লঙ্ঘন করে, এবং ওজনের সাথে ওজন পরিমাপ না করে স্বর্ণের বিনিময়ে বর্ধিত (সুদ) পরিমাণ স্বর্ণ বিক্রয় করে, তবে বলা হয়নি যে, সে বিদ‘আহ্ করেছে, বরং বলা হয়েছে যে, সে হারাম করেছে, অর্থাৎ, সুদে লিপ্ত হয়েছে।

উপসংহারে বলা হয়েছিল: রাসূলুল্লাহ্ (সা) কর্তৃক নির্ধারিত পদ্ধতি থেকে বিচ্যুতি হচ্ছে বিদ’আহ্। এবং, কোন নির্দিষ্ট পদ্ধতি বর্ণনা ব্যতিরেকে রাসূলুল্লাহ্ (সা) কর্তৃক নির্ধারিত চূড়ান্ত আদেশ থেকে বিচ্যুতি আইন ও অধ্যাদেশের (আহকাম শারী‘আহ্) নিম্নোক্ত যেকোন একটির অন্তর্ভুক্ত: হারাম এবং মাকরুহ, ফাসিদ এবং বাতিল… শারী’আহ্ দলিলসমূহ অনুসারে এটাই নির্ধারিত হয়েছে।) উদ্ধৃতি সমাপ্ত।

আরবী ৮ই জিলহজ, ১৪৩৬ হিজরী, এবং ইংরেজি ২২/০৯/২০১৫ খ্রিস্টাব্দে আমরা বিদ’আহ্-এর বিষয়ে আরো বিস্তারিত তথ্যসম্বলিত উত্তর প্রকাশ করেছি, এবং আমরা এর আগে ও পরে অন্যান্য উত্তরও প্রদান করেছি, যা আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা’র অনুগ্রহে যথেষ্ট।

দ্বিতীয়ত: তদনুসারে, যদি মুসলিম দেশগুলোর সরকারসমূহ শুক্রবার বা ওয়াক্তের নামাযের জামায়াতে সংক্রমণের ভয়ে, বিশেষ করে রোগের কোনরূপ উপসর্গ ছাড়াই ইবাদতকারীদেরকে পরষ্পরের কাছ থেকে এক বা দুই মিটার দূরত্ব বজায় রাখতে বাধ্য করে, তবে তারা গুরুতর গুনাহ্’র কাজ করবে, কারণ এটি একটি বিদ’আহ্, যেহেতু শারী’আহ্ (আইনী) দলিল দ্বারা প্রমাণিত যে, এটি রাসূলুল্লাহ্ (সা) কর্তৃক নির্দেশিত পদ্ধতির, অর্থাৎ কাতারবন্দী হওয়া এবং পরস্পর কাছাকাছি থাকার হুকুম হতে পরিষ্কার বিচ্যুতি, নিম্নোক্ত হাদীসসমূহ এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত:

– আল বুখারী তাঁর সহীহ্-তে আবু সুলায়মান মালিক ইবনে আল হুওয়াইরিস হতে বর্ণনা করেছেন: “আমরা রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর কাছে সমবয়সী যুবক অবস্থায় এসেছিলাম। আমরা তাঁর (সা) সাথে বিশ রাত অতিবাহিত করেছিলাম… তিনি দয়ালু ও সহানুভূতিশীল ছিলেন, এবং বলেছিলেন: «فَقَالَ ارْجِعُوا إِلَى أَهْلِيكُمْ فَعَلِّمُوهُمْ وَمُرُوهُمْ وَصَلُّوا كَمَا رَأَيْتُمُونِي أُصَلِّي وَإِذَا حَضَرَتِ الصَّلَاةُ فَلْيُؤَذِّنْ لَكُمْ أَحَدُكُمْ ثُمَّ لِيَؤُمَّكُمْ أَكْبَرُكُمْ» “তোমাদের পরিবারের কাছে ফিরে যাও। তাদেরকে শিক্ষা দাও এবং আদেশ কর। তোমরা আমাকে যেভাবে নামায পড়তে দেখেছ সেভাবে নামায পড়। যখন নামাযের সময় হবে তখন তোমাদের মধ্য হতে কাউকে আযান দিতে দাও, এবং তোমাদের মধ্যে যিনি প্রবীণতম ব্যক্তি তাকে নামাযের নেতৃত্ব দিতে দাও।”

– এবং আল-বুখারী তাঁর সহীহ্-তে আনাস বিন মালিক হতে বর্ণিত করেছেন, তিনি বলেছেন: যখন ইকামাহ্ ঘোষণা করা হয়তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) আমাদের দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন: «أَقِيمُوا صُفُوفَكُمْ، وَتَرَاصُّوا، فَإِنِّي أَرَاكُمْ مِنْ وَرَاءِ ظَهْرِي» “তোমরা কাতার সোজা করো এবং একসাথে কাছাকাছি দাঁড়াও, নিশ্চয়ই আমি আমার পিছন হতেও তোমাদেরকে দেখতে পাই।”

– মুসলিম তাঁর সহীহ্-তে আল নুমান ইবনে বশীর (রা) হতে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেছেন: রাসূলুল্লাহ্ (সা) আমাদের কাতারগুলোকে তীরের মত সোজা রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি ততক্ষণ পর্যন্ত বিষয়টির উপর তাগিদ দিতে থাকতেন যতক্ষণ না তিনি বুঝতে পারতেন আমরা এটি তার কাছ থেকে শিখতে পেরেছি (এর তাৎপর্য বুঝতে সক্ষম হয়েছি)। একদিন তিনি মসজিদে এসে দাঁড়ালেন। তিনি তাকবীর (আল্লাহ্ মহান) দিতে যাচ্ছিলেন, তখন তিনি এমন এক ব্যক্তিকে লক্ষ্য করলেন যার বুক কাতার থেকে বেরিয়ে এসেছিল, তাই তিনি বললেন: «عِبَادَ اللهِ لَتُسَوُّنَّ صُفُوفَكُمْ، أَوْ لَيُخَالِفَنَّ اللهُ بَيْنَ وُجُوهِكُمْ» “হে আল্লাহ্’র বান্দাগণ, তোমাদের অবশ্যই নিজেদের কাতার সোজা করে নেয়া উচিত, নতুবা আল্লাহ্ তোমাদের চেহারাসমূহকে বৈপরীত্যের (পরস্পর মতভেদ) মধ্যে পতিত করবেন।”

এবং মুসলিম তাঁর সহীহ্-তে জাবির ইবনে সামরাহ্ হতে বর্ণিত করেছেন, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেছেন: «أَلَا تَصُفُّونَ كَمَا تَصُفُّ الْمَلَائِكَةُ عِنْدَ رَبِّهَا؟» فَقُلْنَا يَا رَسُولَ اللهِ، وَكَيْفَ تَصُفُّ الْمَلَائِكَةُ عِنْدَ رَبِّهَا؟ قَالَ: «يُتِمُّونَ الصُّفُوفَ الْأُوَلَ وَيَتَرَاصُّونَ فِي الصَّفِّ» “ফেরেশতারা যেভাবে তাদের প্রতিপালকের সামনে সারি বেঁধে দাঁড়ায় তোমরা কেন সেভাবে সারি বেঁধে দাঁড়াও না? আমরা বলছেলিাম: হে আল্লাহ্’র রাসূল (সা), কিভাবে ফেরেশতারা তাদের রবের সামনে কাতারবন্দী হন? তিনি (সা) বলেছিলেন: তারা প্রথম সারি আগে র্পূণ করে এবং পরষ্পররে সাথে মিলে দাঁড়ায়”।

– আবদুল্লাহ্ ইবনে উমর হতে আল-হাকমি র্বণনা করছেনে এবং মুসলমি-এর র্শতানুযায়ী এটিকে নির্ভরযোগ্য হিসেবে অভিহিত করেছেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেছেন: «مَنْ وَصَلَ صَفّاً وَصَلَهُ اللَّهُ، وَمَنْ قَطَعَ صَفّاً قَطَعَهُ اللَّهُ» “যে ব্যক্তি একটি কাতার পূর্ণ করে আল্লাহ্ তার প্রতি সদয় হন, এবং যে ব্যক্তি কাতার ভঙ্গ করে আল্লাহ্ তাকে বিচ্ছিন্ন বা ধ্বংস করে দেন।”

– আবদুল্লাহ্ ইবনে উমর হতে আহমাদ বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেছেন: «أَقِيمُوا الصُّفُوفَ فَإِنَّمَا تَصُفُّونَ بِصُفُوفِ الْمَلَائِكَةِ وَحَاذُوا بَيْنَ الْمَنَاكِبِ وَسُدُّوا الْخَلَلَ وَلِينُوا فِي أَيْدِي إِخْوَانِكُمْ وَلَا تَذَرُوا فُرُجَاتٍ لِلشَّيْطَانِ وَمَنْ وَصَلَ صَفّاً وَصَلَهُ اللَّهُ تَبَارَكَ وَتَعَالَى وَمَنْ قَطَعَ صَفّاً قَطَعَهُ اللَّهُ» “তোমরা কাতারগুলোকে সোজা করে নাও, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়াও, ফাঁকগুলো বন্ধ করে দাও, তোমাদের ভাইদের হাতের প্রতি সদয় থাক, এবং শয়তানের দন্ডায়মান হওয়ার জন্য ফাঁক রেখো না। যদি কেউ একটি কাতারে যোগ দেয় তবে আল্লাহ্ তার সাথে যোগ দেন, কিন্তু কেউ যদি একটি কাতার ভেঙে দেয় তবে আল্লাহ্ তাকে বিচ্ছিন্ন করে দেন।”

কিভাবে জামায়াতে নামায আদায় করতে হবে সে বিষয়ে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর পক্ষ থেকে এটি একটি পরিপূর্ণ ব্যাখ্যা, এবং সাহাবায়ে কেরামগণ (রা) এর প্রতি অবিচল ছিলেন। আল-মুওয়াতায় মালিক এবং আস-সুনান আল কুবরায় আল বায়হাকী বর্ণনা করেছেন যে, “উমর ইবনে আল-খাত্তাব নামাযের কাতারসমূহ সোজা করার নির্দেশ দিতেন, এবং তারা যখন তার কাছে এসে তাকে বলতো যে, কাতারগুলো সোজা হয়েছে তখন তিনি তাকবীর দিতেন।”

তৃতীয়ত: এটা বলা হয়নি যে, সংক্রামক ব্যাধি এমন একটি ওজর যা নামাযে দূরত্ব বজায় রাখার অনুমতি প্রদান করে, এরকম বলা হয়নি কারণ সংক্রামক ব্যাধি হলে তা মসজিদে না যাওয়ার ওজর হিসেবে বিবেচিত হবে, কিন্তু মসজিদে গমন করা এবং নামাযে পাশের ইবাদতকারী থেকে ১ বা ২ মিটার দূরত্বে থাকার ওজর হিসেবে এটি বিবেচিত হবে না!! কারণ, রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর যুগেও সংক্রামক রোগের (প্লেগের) প্রাদুর্ভাব ঘটেছিল, এবং রাসূলুল্লাহ্ (সা) কর্তৃক এটা বর্ণিত নেই যে, প্লেগে আক্রান্ত অসুস্থ ব্যক্তি নামায পড়তে গিয়েছে এবং তার ভাই থেকে ২ মিটার দূরত্ব বজায় রেখেছে, বরং তাকে এ বিষয়ে অব্যাহতি দেয়া হতো এবং সে গৃহে নামায আদায় করে নিত… যে অঞ্চলে ব্যাধি ছড়িয়ে পড়ে সেখানে রাষ্ট্রের তত্ত্বাবধানে বিনা খরচে ও সযত্নে চিকিৎসা সেবা জোরদার করা হয়, এবং অসুস্থদের সুস্থদের সাথে মেশানো/একত্রিত করা হয় না… যেমনটি উসামা বিন যায়েদ হতে মুসলিম তার সহীহ্-তে বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেছেন: «الطَّاعُونُ آيَةُ الرِّجْزِ ابْتَلَى اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ بِهِ نَاساً مِنْ عِبَادِهِ، فَإِذَا سَمِعْتُمْ بِهِ فَلَا تَدْخُلُوا عَلَيْهِ وَإِذَا وَقَعَ بِأَرْضٍ وَأَنْتُمْ بِهَا فَلَا تَفِرُّوا مِنْهُ» “প্লেগ হচ্ছে দুর্যোগের নিদর্শন, যার দ্বারা মহিমান্বিত ও গৌরবময় আল্লাহ্ তাঁর বান্দাদের মধ্যকার জনগোষ্ঠীকে আক্রান্ত করেন। সুতরাং, যখন তোমরা এর উপস্থিতি সম্পর্কে অবহিত হবে তখন সেখানে প্রবেশ করো না (যেখানে এর প্রাদুর্ভাব ঘটেছে), এবং যখন এটি কোন ভূ-খন্ডে ইতিমধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে এবং তোমরা সেখানে অবস্থান করছো, তখন সেখান থেকে পালিয়ে যেও না।” অর্থাৎ, সংক্রামক রোগে আক্রান্ত রোগী সুস্থ লোকের সাথে মিশবে না এবং তাকে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা’র নির্দেশ মোতাবেক পর্যাপ্ত চিকিৎসা সেবা দেয়া হবে। সুস্থ ব্যক্তিগণ মসজিদে যাবে এবং শুক্রবার ও জামাতে নামায আদায় করবে, কোনরূপ দূরত্ব বজায় না রেখেই।

চতুর্থত: অনুরূপভাবে এটি বলাও সঠিক নয় যে, মহামারীর সময়ে নামাযে দূরত্ব বজায় রাখার বিষয়টি অসুস্থতার সময়ে বসে নামায আদায় করার অনুমতির (রুখসা) সঙ্গে ক্বিয়াসের মাধ্যমে নির্ধারিত। কেননা, এটি কোন শরঈ ক্বিয়াস নয়, কারণ অসুস্থ ব্যক্তি আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা প্রদত্ত রুখসা’র কারণে বসে নামায পড়তে পারেন, আর এই ওজর-এর কারণ হলো তার অসুস্থতা। ওজর বা অব্যাহতিগুলো হলো আসবাব, কারণ বা যুক্তি (ইলাল) নয়, তাই শরঈ সেগুলোর কারণ ব্যাখ্যা করেনি, বরং প্রতিটি ওজরকে সেই হুকুমের জন্য ওজর হিসেবে নির্ধারণ করেছে, যা কেবলমাত্র নির্দিষ্ট সেই হুকুমের জন্যই প্রযোজ্য হবে, অন্য কোন হুকুমের জন্য নয়, কারণ এটি শুধুমাত্র সেই নির্দিষ্ট হুকুমের জন্যই বিশেষ ওজর হিসেবে এসেছে, এবং এটি সকল হুকুমের জন্য প্রযোজ্য সাধারণ ওজর নয়; এটি ইল্লাহ্-এর কারণ (ওয়াজহ আল-ইল্লাহ্) দিকেও ইঙ্গিত (মুফহিম) করে না। সুতরাং, এর দ্বারা ক্বিয়াস করা যাবে না, কেননা এটি (আসবাব) সুনির্দিষ্ট, এবং এটিকে অন্য কোন ক্ষেত্রে প্রসারিত করা যায় না, যা দিয়ে তুলনা করা যাবে। এটি ইল্লাহ্ হতে আলাদা, কেননা ইল্লাহ্ যে হুকুমের জন্য প্রণীত কেবলমাত্র সেই হুকুমের জন্য সুনির্দিষ্ট নয়, বরং তা অন্যান্য হুকুমে ক্ষেত্রেও প্রসারিত করা যায়, এবং এর দ্বারা ক্বিয়াস করা যায়… অতএব এটি সুস্পষ্ট যে, ইবাদত সংক্রান্ত কাজগুলো হচ্ছে আসবাব, এবং ইলাল নয়, ইবাদত সংক্রান্ত কাজগুলো তাওকিফিয়া (আইনপ্রণেতা কর্তৃক নির্দিষ্ট), ইল্লাহ্ (যুক্তি/কারণ) প্রদান করে না, এবং এগুলোর উপর কোন ক্বিয়াস করার সুযোগ নেই; কেননা আসবাব সুনির্দিষ্টভাবে শুধুমাত্র আসবাব হওয়ার কারণের সাথে সম্পর্কিত।

পঞ্চমত: এছাড়াও, রুখসা (আইনি বৈধতা/অনুমতি) ঘোষণামূলক সুস্পষ্ট বিধিসমূহের (হুকুম ওয়াদ’) অন্তর্ভুক্ত, যা ঘোষণা বা সুস্পষ্ট বক্তব্য হিসেবে বান্দার কাজ সংক্রান্ত বিষয়ে আইনপ্রণেতার বক্তব্য হিসেবে এসেছে, এবং যেহেতু এটি আইনপ্রণেতার বক্তব্য সেহেতু অবশ্যই এর স্বপক্ষে আইনী (শরঈ) দলিল থাকতে হবে যা এটিকে নির্দেশ করবে। উদাহরণস্বরূপ, অসুস্থ ব্যক্তির বসে নামায পড়ার বিষয়ে আল-বুখারী তার সহীহ্ গ্রন্থে ‘ইমরান বিন হুসাইন হতে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি বলেন: আমার পাইলস ছিল, তাই আমি নামাযের বিষয়ে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে জিজ্ঞাসা করলাম, তিনি (সা) বললেন: «صَلِّ قَائِماً فَإِنْ لَمْ تَسْتَطِعْ فَقَاعِداً، فَإِنْ لَمْ تَسْتَطِعْ فَعَلَى جَنْبٍ» “দাঁড়িয়ে নামায পড়, এবং যদিনা পারো তাহলে বসে পড়, এবং সেটাও যদি না পারো তাহলে কাত হয়ে শুয়ে নামায পড়ো”, এটি একটি অনুমতি (রুখসা) যা একটি বৈধ অব্যাহতি, এবং আইনী দলিলগুলোতে সুনির্দিষ্ট হুকুমের জন্য অব্যাহতি হিসেবে যা যা উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলোই অব্যাহতি হিসেবে বিবেচিত হবে। এছাড়া যেগুলোর স্বপক্ষে কোন দলিল নেই সেগুলোর কোনো মূল্য নেই, এবং সেগুলো বৈধ অব্যহতি হিসেবে বিবেচিত হবে না। এবং যেহেতু অসুস্থ ব্যক্তির জন্য তার পাশের জনের থেকে ১ বা ২ মিটার দূরত্বে নামায পড়ার পক্ষে কোন দলিল নেই, সেহেতু এই বক্তব্যের কোন মূল্য নেই এবং এটি সঠিক নয়। এটি কেমন সিদ্ধান্ত, সে অসুস্থ নয়, অথচ কেবলমাত্র রোগাক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কায় সে তা করবে…?!

ষষ্ঠত: উপরোক্ত ব্যাখ্যার সারসংক্ষেপ নিম্নরূপ:

১- রাসূলুল্লাহ্ (সা) নামাযের জন্য যে পদ্ধতি নির্ধারণ করেছেন, তার পরিবর্তন বিদ’আহ্ হিসেবে পরিগণিত। এবং, এ বিষয়ে শরঈ হুকুম হলো সুস্থ ব্যক্তি স্বাভাবিক নিয়মে নামায পড়তে যাবেন, পাশাপাশি দাঁড়িয়ে, সোজা সারিবদ্ধ হয়ে, কোনো ফাঁকা জায়গা না রেখে। আর, অসুস্থ ব্যক্তি যার কোন সংক্রামক ব্যাধি রয়েছে, তিনি মসজিদে যাবেন না এবং অন্যদেরকে সংক্রমিত করবেন না।

২- যদি রাষ্ট্র মসজিদসমূহ বন্ধ করে দেয়, এবং অতঃপর সুস্থ ব্যক্তিদেরকে শুক্রবার ও জামাতে নামায পড়া থেকে বিরত রাখে, তাহলে এটি শুক্রবার ও জামাতের নামায বিঘ্ন করার গুরুতর গুনাহ্ হিসেবে বিবেচিত হবে, কেননা রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নির্দেশনা অনুযায়ী মসজিদসমূহ নামাযের জন্য উন্মুক্ত রাখতে হবে।

৩- অনুরূপভাবে, যদি রাষ্ট্র রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নির্দেশিত পদ্ধতিতে নামায আদায় করা থেকে মুসল্লীদেরকে নিষেধ করে, এবং যদি একজন মুসল্লীকে তার পাশের জনের সাথে সংক্রমণের ভয়ে এক বা দুই মিটার দূরত্ব বজায় রাখতে বাধ্য করে, বিশেষ করে দৃশ্যত কোন উপসর্গ না থাকা সত্ত্বেও, তবে এটা একটি গুরুতর গুনাহ।

এ বিষয়ে এটিই হলো শরঈ হুকুম যা আমার বিবেচনায় সঠিক, আর আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা সবচেয়ে ভালো জানেন এবং তিনি সর্বজ্ঞানী… এবং, আমি আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা’র কাছে প্রার্থনা করি যেন তিনি মুসলিমদেরকে ন্যায়ের পথে এবং তাঁর নির্দেশ মোতাবেক তাঁর ইবাদতের দিকে পরিচালিত করেন। এবং, তাদের জন্য এটি ফরয যে তারা রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর পদ্ধতি অনুসরণ করে এবং কোন বিচ্যুতি ব্যতিরেকে খিলাফতে রাশিদাহ্ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সঠিক শরঈ প্রতিষ্ঠা করে, যার মধ্যে আছে উত্তম বিষয়াবলী এবং বিজয়, আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা’র অনুগ্রহে, যিনি আসমান ও জমিনের কোন কিছু দ্বারা ব্যর্থ হন না, তিনি সর্বশক্তিমান, মহাজ্ঞানী।

ওয়াসসালামু আলাইকুম ওয়া রহ্মতুল্লাহ ওয়া বারাকাতুহ।

১৭ই শাওয়াল, ১৪৪১ হিজরী

০৮/০৬/২০২০ খ্রিষ্টাব্দ

Leave a Reply