পুনর্জাগরণ এক ধরণের বুদ্ধিবৃত্তিক উত্থান। উন্নতি বলতে কেবল অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিকে বোঝায় না। প্রমাণস্বরূপ কুয়েত অর্থনৈতিক দিক থেকে ইউরোপীয় রাষ্ট্র সুইডেন, হল্যান্ড এবং বেলজিয়াম থেকে উন্নত হলেও; সুইডেন, হল্যান্ড এবং বেলজিয়ামকে উন্নত মনে করা হয়। কিন্তু কুয়েতকে উন্নত মনে করা হয় না। তাছাড়া নৈতিকভাবে উন্নতিও পুনর্জাগরণ নয়। পৃথিবীতে যেকোন রাষ্ট্রের চেয়ে মদিনা নৈতিকভাবে সবচেয়ে উন্নত হলেও, এটাকে উন্নত মনে করা হয় না। সুতরাং, বুদ্ধিবৃত্তিক উত্থানই একমাত্র পুনর্জাগরণ বা উন্নতি।
পুনর্জাগরণ সঠিক বা ভূল হতে পারে। যেমন, আমেরিকা, ইউরোপ এবং রাশিয়া ভূল ভাবে উন্নত। কারণ তাদের পুনর্জাগরণ আধ্যাত্মিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত নয়। সঠিক পুনর্জাগরণ সেটাই যা আধ্যাত্মিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। অর্থাৎ যে পুনর্জাগরণ বা বুদ্ধিবৃত্তিক উত্থান আধ্যাত্মিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত নয় তা একধরণের ভূল বুদ্ধিবৃত্তিক উত্থান। সুতরাং ইসলামি চিন্তা (আকিদা) ব্যতিত কোন উত্থানই সঠিক পুনর্জাগরণ নয়। কারণ একমাত্র ইসলামি পুনর্জাগরণই আধ্যাত্মিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত।
পুনর্জাগরণ শুরু করতে হলে, বর্তমান রাষ্ট্রীয় কাঠামো, আইন ও বিচার ব্যবস্থা বাদ দিয়ে একটি সুনির্দিষ্ট চিন্তার ভিত্তিতে সরকার কাঠামো দাঁড় করাতে হবে। বিদ্যমান আইন কানুন ঠিক রেখে, রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করলে পুনর্জাগরণ ঘটানো সম্ভব হবে না, বরং এই পন্থা আরো বিভ্রান্তি সৃষ্টি করবে ও পুনর্জাগরণের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। কর্তৃত্ব ও শাসন কাঠামো একটি সুনির্দিষ্ট চিন্তার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত করা ছাড়া পুনর্জাগরণ কখনো সম্ভব হবে না। উপরন্তু, মানব জীবনের সব সমস্যার সমাধান ঐ চিন্তা থেকে গ্রহণ করা হবে, যা থেকে রাষ্ট্রীয় কাঠামো, আইন ও বিচার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে আলাদা করে ও কিছু স্বাধীনতা যুক্ত চিন্তার ভিত্তিতে ইউরোপীয়রা পুনর্জাগরিত হয়। “বস্তুবাদ ও বস্তুগত বিবর্তন অর্থাৎ প্রকৃতির সবগুলো বস্তু উন্নতির দিকে পরিবর্তিত হয়” এই চিন্তার ভিত্তিতে রাশিয়ার পুনর্জাগরণ ঘটে। ১৯১৭ সালে এই চিন্তার ভিত্তিতে শাসন কাঠামো প্রতিষ্ঠা করে, যার ফলে রাশিয়ার পুনর্জাগরণ ঘটে । আল্লাহ কর্তৃক প্রেরিত “ইসলামি চিন্তার” ভিত্তিতে যখন রাসুল (সা) শাসন কাঠামো ও কর্তৃত্ব (সুলতান) প্রতিষ্ঠা করেন তখন আরবরা পুনর্জাগরিত হয়। প্রকৃতপক্ষে আরবরা যখন ইসলামি চিন্তা গ্রহণ করে ও তার ভিত্তিতে শাসন কাঠামো গঠন করে কেবল তখনই তাঁরা পুনর্জাগরিত হয়।
প্রমাণস্বরূপ, তুরষ্কে পুনর্জাগরণ ঘটানোর লক্ষ্যে মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক বিদ্যমান রাষ্ট্রীয় কাঠামোর উপর সরকার প্রতিষ্ঠা ও আইন কানুন চালু করেছিল। মোস্তফা কামাল জবরদস্তি পশ্চিমা শাসন পদ্ধতি ও আইন প্রয়োগ শুরু করেছিল, ফলস্বরূপ তুরষ্ক পুনর্জাগরণের পরিবর্তে পূর্বেকার অবস্থা থেকে আরো বেশি অধঃপতিত হয়। বর্তমানের তুরষ্ক সবচেয়ে অধঃপতিত রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে একটি। অন্যদিকে মোস্তফা কামালের সমসময়ে, লেনিন যখন রাশিয়ার পুনর্জাগরণ শুরু করেছিল তখন কার্যকরীভাবে রাশিয়ার পুনর্জাগরণ সংগঠিত হয়েছিল। ফলে রাশিয়াকে (পতনপূর্ব) শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোর একটি মনে করা হত। কারণ, লেনিন কমিউনিস্ট চিন্তার ভিত্তিতে শাসন কাঠামো প্রতিষ্ঠা করেছিল। ঐ চিন্তা থেকে দৈনন্দিন সমস্যাগুলোর সমাধান করত যেমন রাষ্ট্রীয় কাঠামো ও আইন কানুন। সুতরাং বলা যায় কমিউনিস্ট চিন্তার ভিত্তিতে লেনিন শাসন কাঠামো প্রতিষ্ঠা করে এবং আইন কানুন গ্রহণের মাধ্যমে সমস্যাগুলোর সমাধান করে। ১৯১৭ সালে লেনিন একটি চিন্তার ভিত্তিতে শাসন কাঠামো প্রতিষ্ঠা করে ফলে রাশিয়ার পুনর্জাগরণ সংগঠিত হয়েছিল। অন্যদিকে ১৯২৪ সালে মোস্তফা কামাল পুনর্জাগরণের লক্ষ্যে বিদ্যমান রাষ্ট্রীয় কাঠামো ও আইনের উপর সরকার গঠন করে ফলে এটি ব্যর্থ হল এবং আরো বেশি অধঃপতিত হল।
মোহগ্রস্থ হয়ে বিদ্যমান রাষ্ট্রীয় কাঠামো ও আইনের উপর সরকার গঠন করে পুনর্জাগরণে ব্যর্থ হয় তুরষ্ক।
মিশরে জামাল আব্দুল নাসেরও এই ধরনের প্রচেষ্টা চালিয়েছিল। ১৯৫২ সালে জামাল আব্দুল নাসের বিদ্যমান রাষ্ট্রীয় কাঠামো ও আইনের উপর সরকার গঠন করে। শুরুতে সে রাজতন্ত্রকে অপসারণ করে গণপ্রজাতন্ত্রীক সরকার প্রতিষ্ঠা করে এবং কৃষিজমির বন্টন করে দেয়। তারপর সমাজতন্ত্রকে গ্রহণ করে রাষ্ট্রীয় সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে কিন্ত তা সত্ত্বেও মিশরকে পুনর্জাগরিত করতে ব্যর্থ হয়। উপরন্তু, ১৯৫২ সালের সামরিক ক্যু পূর্বেকার সময় থেকে আজকের মিশর বুদ্ধিবৃত্তিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে আরো বেশি অধঃপতিত। এমনকি ১৯৫২ সালের পার্লামেন্ট মেম্বারদের সাথে বর্তমান পার্লামেন্ট (জাতীয় কাউন্সিল) মেম্বারদের রাজনৈতিক সক্ষমতা, রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক দৃষ্টিকোণ তুলনা করলে তাদের অধঃপতন আরো স্পষ্ট হয়ে উঠে। বিদ্যমান রাষ্ট্রীয় কাঠামো ও আইনের উপর সরকার গঠন করার কারণে মিশর পুনর্জাগরণে ব্যর্থ হয়। কেবলমাত্র সুনির্দিষ্ট চিন্তার ভিত্তিতে শাসন কাঠামো প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই পুনর্জাগরণ ঘটানো সম্ভব।
চিন্তার ভিত্তিতে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এমন নয় যে, সামরিক ক্যু এর মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে পূর্বেকার একই চিন্তার ভিত্তিতে সরকার গঠন করা। এই পন্থা অবলম্বনে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল হতে পারে কিন্তু পুনর্জাগরণ ঘটতে পারে না। বরং যে চিন্তার ভিত্তিতে পুনর্জাগরণ ঘটানো হবে সেটি উম্মাহকে বা উম্মাহর প্রভাবশালী অংশকে ব্যাখ্যা করা, ওই চিন্তার ভিত্তিতে উম্মাহকে জীবনসংগ্রামে পরিচালিত করা, ঐ চিন্তার ভিত্তিতে রাষ্ট্র প্রতিষ্টা করা, এভাবেই নিশ্চিতভাবে পুনর্জাগরণ সংগটিত হবে। সুতরাং পুনর্জাগরণ বলতে ক্ষমতা দখল করা নয়, বরং সুনির্দিষ্ট চিন্তার ভিত্তিতে উম্মাহকে ঐক্যবদ্ধ করে ঐ চিন্তার ভিত্তিতে জীবন পরিচালনা করা।
ক্ষমতা গ্রহণ করে এবং ঐ চিন্তার ভিত্তিতে রাষ্ট্র প্রতিষ্টা করা হবে। ক্ষমতা দখল করা এখানে মুল উদ্দেশ্য নয়, এবং ক্ষমতা দখল করার চিন্তা একটি ভূল উদ্দেশ্য। বরং ক্ষমতা গ্রহণ করে চিন্তার ভিত্তিতে রাষ্ট্র প্রতিষ্টা করা পুনর্জাগরণের একটি পদ্ধতি। এভাবেই আমাদের পুনর্জাগরণ সংগঠিত হবে। রাসুল (সা) এই পদ্ধতি অবলম্বন করেছিলেন। যখন সর্বশক্তিমান আল্লাহ তাঁর রাসুল (সা)-কে ইসলাম এর বার্তা দিয়ে পাঠিয়েছিলেন, তখন রাসুল (সা) সবাইকে ইসলামের আকিদার (চিন্তার) দিকে আহবান করেছিলেন। এবং মদিনায় যখন আউজ ও খাজরাজ গোত্র এই চিন্তাটি গ্রহণ করে ঐক্যবদ্ধ হলো, তাঁদের জীবনকে এই চিন্তা দিয়ে পরিচালিত করতে আরম্ভ করলো, তখন রাসুল (সা) মদিনায় শাসন কর্তৃত্ব গ্রহণ করলেন এবং ঘোষণা করলেন; ‘আমাকে আদেশ করা হয়েছে আমি ততক্ষণ পর্যন্ত লোকজনের সাথে যুদ্ধ করতে থাকব যতক্ষণ না তারা বলে “লা ইলাহা ইল্লালা মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ”। যদি তাঁরা এটিকে মেনে নেয় তাহলে তাঁদের রক্ত এবং সম্পদ আমার পক্ষ থেকে নিরাপত্তা পাবে..’। শুরুতে রাসুল (সা) ইসলামি আকিদার চিন্তার দিকে মানুষকে আহবান করেন, ফলে মদিনার পুনর্জাগরণ শুরু হয়, সমগ্র আরবের পুনর্জাগরণ হয় এবং ইসলাম গ্রহণ করা প্রত্যেকের পুনর্জাগরণ সংগঠিত হয়। অর্থাৎ চিন্তা গ্রহণ করা এবং জনগণের দৈনন্দিন বিষয়াদি দেখাশুনা ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা।
আজকে, সবগুলো দেশে ইসলামি উম্মাহ নিঃসন্দেহে অধঃপতিত অবস্থায় আছে, দুইশত বছর চেষ্টার পরও পুনর্জাগরণ অর্জনে তাঁরা ব্যর্থ। কারণ সরকার অনৈসলামি ব্যবস্থা, আইন ও শাসনের উপর প্রতিষ্ঠিত। অধিকাংশ মুসলিম রাষ্ট্র কুফর ব্যবস্থা দ্বারা পরিচালিত। ইয়েমেনের মত কিছু রাষ্ট্রে আস-সাল্লাহর বিপ্লব পূর্ব ইসলামি ব্যবস্থা দ্বারা পরিচালিত হলেও সবাই অধঃপতিত ছিল। এমনকি ইসলামি ব্যবস্থা ও শরিয়ার উপর শাসন প্রতিষ্ঠা করার পরও পুনর্জাগরণ সম্ভব হয়নি। সুতরাং ইসলামি চিন্তার ভিত্তিতে শাসন প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে পুনর্জাগরণ শুরু করতে হবে, অর্থাৎ ইসলামি আকিদার উপর প্রতিষ্টা করা। “লা ইলাহা ইল্লালা মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ” এই ভিত্তির উপর রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করলেই পুনর্জাগরণ সংগটিত হবে। অন্যদিকে কোন মাযহাব অথবা তাহতাউই এর মত কোন গ্রন্থ বা শরিয়ার উপর প্রতিষ্ঠা করলেও পুনর্জাগরণ সংঘটিত হবে না।
সুতরাং একমাত্র “লা ইলাহা ইল্লালা মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ” এই ভিত্তির উপর রাষ্ট্র প্রতিষ্টা করলেই পুনর্জাগরণ সংগটিত হবে। তারপর আল্লাহর আদেশ অনুসারে তাঁদের সক্ষমতার ভিত্তিতে শরিয়া গ্রহণ করা হবে। আল্লাহর আদেশ-নিষেধ সমুহ তাঁদের জন্য কল্যাণকর বা অকল্যাণকর হোক অথবা পছন্দ-অপছন্দ বিবেচনা না করে বাস্তবায়ন করা হবে। কারণ তা আল্লাহ সুবাহানাহু ওয়া তাআলা পাঠিয়েছেন এবং একমাত্র “লা ইলাহা ইল্লালা মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ” এই ভিত্তি চিন্তা হতে উৎসারিত হয়েছে, এভাবেই পুনর্জাগরণ সংঘটিত হবে।
সুতরাং এই উম্মাহকে উন্নত বা পুনর্জাগরণ সংঘঠিত করতে গেলে তাকে অবশ্যই ইসলামি আকিদাকে গ্রহণ করতে হবে, এর ভিত্তিতে জীবনকে পরিচালিত করতে হবে, এই ভিত্তির উপর শাসন এবং কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে হবে, দৈনন্দিন বিষয়াদির সমস্যাগুলো এই আকিদা দিয়ে সমাধান করতে হবে। উল্লেখ্য, সক্ষমতার ভিত্তিতে শরিয়া গ্রহণ আল্লাহর নির্দেশনা হিসেবে করা হবে অন্য কোন কারণে নয়। এভাবেই সঠিক পুনর্জাগরণ পদ্ধতিতেই নিশ্চিতভাব পুনর্জাগরণ সংঘঠিত হবে, অন্যকোন পুনর্জাগরণ পন্থার মাধ্যমে নয়। এভাবেই উম্মাহ তাঁর হারানো ঐতিহ্য ফিরে পাবে এবং পৃথিবীর কর্তৃত্ব সর্বোচ্চ চুড়ায় আরোহণ করবে।
Taken from an old leaflet written by Sheikh Taqi uddin an Nabhani (rah)