সুফিয়ান ইবনে আব্দুল্লাহ আস-সাকাফী রা বলেন, আমি একবার রাসুল (সা) এর নিকট গিয়ে বললাম, হে আল্লাহ রাসুল আমাকে ইসলাম এর ব্যাপারে এমন কথা বলে দিন যেন সে বিষয়ে আপনি ছাড়া আর কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করতে না হয়।তিনি (সা) বললেন, “বল, আমি ঈমান আনলাম, তারপর এর ওপর অবিচল (ইস্তিকামাহ) হয়ে যাও। ” [ মুসনাদ আল-আহমাদ, সহীহ মুসলিম]
এই হাদিসে রাসুল সা ঈমানের পর সকল বিষয়কে একটি শব্দের দ্বারাই প্রকাশ করেছেন আর তা হল অবিচলতা বা ইস্তিকামাহ। ঈমান আনার পর বিলাল রা তার বুকে পাথরের বোঝা বহন করার পরও বলেছিলেন আহাদ!, এটাই ইস্তিকামাতের দৃষ্টান্ত। তাওহীদের স্বীকারোক্তির পর ইয়াসির পরিবারের উপর মক্কার জালিম শাসকদের নির্যাতনের পরও তাওহীদের উপর অটল থাকা ছিল ইস্তিকামাহ। দীন প্রতিষ্ঠার জন্য সাহাবি ও রাসুল সা এর দীর্ঘ ১৩ বছরের বুদ্ধিবৃত্তিক ও রাজনৈতিক সংগ্রাম ছিল ইস্তিকামাহ বা অবিচলতার নিদর্শন।
তাই ঈমান আনার পর, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহর উপর ইস্তিকামাহ থাকা, আল্লাহর আনুগত্যে কোনরকম বিচ্যুতি ছাড়াই দ্বীনের পথ আকড়ে ধরে থাকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
ইস্তিকামাহর অর্থ
ইস্তিকামাহ এর শাব্দিক অর্থ ন্যায়পরায়নতা, সততা, বিচ্যুতি ছাড়াই সোজাভাবে দাঁড়িয়ে থাকা। قام শব্দমূল থেকে এই শব্দের উৎপত্তি। মুস্তাকিম শব্দটিও একই শব্দমূল থেকে নির্গত, যার অর্থ সোজা বা সরল। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা রাসুল সা কে হুকুম করছেন এই বলে,
فَاسْتَقِمْكَمَاأُمِرْتَوَمَنتَابَمَعَكَوَلَاتَطْغَوْاۚإِنَّهُبِمَاتَعْمَلُونَبَصِيرٌ
“তুমি (দ্বীনের পথে) দৃঢ়পদ হয়ে সোজা চলতে থাক, যেভাবে তোমাকে আদেশ করা হয়েছে, এবং তোমার সাথে যারা তওবা করেছে (তারাও) এবং সীমালঙ্ঘন করো না। তোমরা যা কিছু করছ, নিশ্চয়ই তিনি তার প্রতি দৃষ্টি রাখেন।” [সুরা হুদ: ১১২]
এই আয়াতে ইস্তিকামাহ দিয়ে বোঝানো হয়েছে দৃঢ় বা অবিচলভাবে সোজাপথে চলা বা দাঁড়িয়ে থাকা।যাতে করে দ্বীনের পথ থেকে কোনরুপ বিচ্যুতি না হয়। আর এটি রাসুল সা কে আদেশ দেওয়া হয়েছে, আলাদাভাবে আদেশের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে যাতে এর গুরুত্ব মুমিনরা উপলদ্ধি করতে পারে।
উমার ইবনুল খাত্তাব রা ইস্তিকামাতের ব্যাখ্যায় বলেন,
الِاسْتِقَامَةُأَنْتَسْتَقِيمَعَلَىالْأَمْرِوَالنَّهْيِ،وَلَاتَرُوغَرَوَغَانَالثَّعْلَبِ
“ইস্তিকামাহ হচ্ছে আল্লাহর আদেশ নিষেধের উপর দৃঢ় থাকা, শৃগালের মত এদিক ওদিক বিচরন না করা।” [তাফসিরে বাগাবী, ৪/২০৩]
আলী ইবনে আবু তালিব রা ইস্তিকামাহ শব্দের ব্যাখ্যায় বলেন,
ثمأدواالفرائض
“ফরযসমূহ পালন করা।” [তাফসির আল কুরতুবি ১৫/৩৫৮]
উসমান রা বলেন,
ثمأخلصواالعمللله
“আল্লাহর জন্য নিষ্ঠার (ইখলাস) সাথে কাজ করা।” [ তাফসির আল কুরতুবি ১৫/৩৫৮] কাতাদাহ র বলেন,
استقامواعلىالطاعةلله
“আল্লাহর আনুগত্যে অবিচল থাকা।” [ তাফসির আল কুরতুবি ১৫/৩৫৮] হাসান বসরী রহ বলেন,
استقامواعلىأمراللهفعملوابطاعتهواجتنبوامعصيته
“আল্লাহর আদেশের উপর অবিচল থাকা, তার আনুগত্যে কাজ করা এবং তার অবাধ্যতা থেকে বিরত থাকা।” [তাফসির আল কুরতুবি ১৫/৩৫৮] মুজাহিদ ও ইকরিমাহ রহ বলেন,
استقامواعلىشهادةأنلاإلٰهإلااللهحتىماتوا
“শাহাদাহ, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহর উপর মৃত্যু পর্যন্ত অবিচল থাকা।” [তাফসির আল কুরতুবি ১৫/৩৫৮]
লা ইলাহা ইল্লাল্লাহর স্বীকারোক্তি মানেই মৃত্যু পর্যন্ত এর দাবি পূরন করার দায়িত্ব কাধে নেওয়া। ফরয বিষয়গুলো মৃত্যু পর্যন্ত পালন করা। রাসুলের সুন্নাহ অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করা। রাসুলের সুন্নাহ অনুযায়ী খিলাফত প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অবিরাম কাজ করে যাওয়া। মৃত্যু পর্যন্ত সৎ কাজে আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ করার দায়িত্ব পালন করা। প্রকাশ্যে এবং গোপনে হারাম কাজ করার সুযোগ থাকা সত্তেও তা থেকে দূরে থাকা। তা না হলে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা ইসলামের উপর অবিচল থাকার যে আদেশ দিয়েছেন তা লঙ্ঘিত হবে।
দ্বীনের উপর ইস্তিকামাত থাকার ফলে সামাজিকভাবে, রাষ্ট্রীয়ভাবে, পারিবারিকভাবে নানা ধরনের অত্যাচার, নিপীড়ন ও পীড়াদায়ক কথার মুখোমুখি হতে হবে।
দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্য এই দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়ার ক্লান্তি, চলার পথে অসহনীয় শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রনা আমাদের পা দুটিকে টলিয়ে দিতে পারে। শয়তান তখন তার কুটচালে আমাদের দ্বীন প্রতিষ্ঠা থেকে ও ক্রমাগত আল্লাহ ও তার রাসুলের আনুগত্য থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়ার উপলক্ষ্য পায়। আমাদের সিরাতুল মুস্তাকিমে চলার গতি মন্থর হয়ে যায়। লক্ষ্য অর্জনের জন্য যে নববী পদ্ধতিতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি এক পর্যায়ে তা অবাস্তব, অকার্যকর মনে হয়। অবিরাম কাজ করে যাওয়ার পর কোন দৃশ্যমান বস্তুগত ফলাফল না দেখায় আমরা হতাশ হয়ে পড়ি।
كَتَبَاللَّهُلَأَغْلِبَنَّأَنَاوَرُسُلِيۚإِنَّاللَّهَقَوِيٌّعَزِيزٌ٥٨:٢١
“আল্লাহ লিখে দিয়েছেন, আমি এবং আমার রসূলগণ অবশ্যই বিজয়ী হব। নিশ্চয় আল্লাহ শক্তিধর, পরাক্রমশালী।“ [মুজাদিলা: ২১]
তাই শুধুমাত্র পেশিশক্তি ও শারীরিক সামর্থ্য দ্বারা এই পরিস্থিতির মুকাবিলা করা সম্ভব নয়। বরঞ্চ এর জন্য প্রয়োজন অবিচল নিষ্ঠা, সিরাতুল মুস্তাকিমের পথে চলার জন্য দৃঢ় মানসিক শক্তি যাকে উপরোক্ত কুরআনের আয়াত ও হাদিসের ভাষায় ইস্তিকামাহ বলা হচ্ছে। এই ইস্তাকামাতের চিন্তাটা তাই আমাদের ভালোভাবে বোঝা জরুরি যে,আমাদের কোন কোন বিষয়ে অবিচল থাকতে হবে? অবিচল থাকার ফলাফল হিসেবে আমরা কি পাব? কিভাবে আল্লাহর আদেশ নিষেধের উপর ও দ্বীন প্রতিষ্ঠার কাজে অবিচল থাকতে পারি?
ইস্তিকামাহ থাকার ফলাফল
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন,
إِنَّالَّذِينَقَالُوارَبُّنَااللَّهُثُمَّاسْتَقَامُواتَتَنَزَّلُعَلَيْهِمُالْمَلَائِكَةُأَلَّاتَخَافُواوَلَاتَحْزَنُواوَأَبْشِرُوابِالْجَنَّةِالَّتِيكُنتُمْتُوعَدُونَنَحْنُأَوْلِيَاؤُكُمْفِيالْحَيَاةِالدُّنْيَاوَفِيالْآخِرَةِۖوَلَكُمْفِيهَامَاتَشْتَهِيأَنفُسُكُمْوَلَكُمْفِيهَامَاتَدَّعُونَنُزُلًامِّنْغَفُورٍرَّحِيمٍ
“নিশ্চয় যারা বলে, আমাদের পালনকর্তা আল্লাহ, অতঃপর তাতেই অবিচল থাকে, তাদের কাছে ফেরেশতা অবতীর্ণ হয় এবং বলে, তোমরা ভয় করো না, চিন্তা করো না এবং তোমাদের প্রতিশ্রুত জান্নাতের সুসংবাদ শোন।ইহকালে ও পরকালে আমরা তোমাদের বন্ধু। সেখানে তোমাদের জন্য আছে যা তোমাদের মন চায় এবং সেখানে তোমাদের জন্যে আছে তোমরা দাবী কর। এটা ক্ষমাশীল করুনাময়ের পক্ষ থেকে সাদর আপ্যায়ন”। [ফুসসিলাত ৩০-৩২]
এই আয়াতে দ্বীনের উপর দৃঢ় ও অবিচল থাকার ফলাফল নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
যেসকল বিষয়ে ইস্তিকামাত থাকতে হবে
আম্মার ইবনু ইয়াসির রা, বিলাল রা, খাব্বাব রা, আব্দুল্লাহ ইবনে মাসুদ রা প্রমুখ সাহাবীদের উপর আসা প্রবল নির্যাতনের পরেও এই দুর্বল, রুগ্ন মানুষগুলোই সবচেয়ে বেশি দৃঢ়তার পরিচয় দিয়েছিল, সরল পথ থেকে কখনও এক বিন্দুও বিচ্যুত হয়নি। শত জুলুম নির্যাতনের পরেও দ্বীনের দাওয়াহ ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়েছিল তারা। শিয়াবে আবু তালিবে রাসুল সা ও তার সাহাবীদের নিদারুন কষ্টের পরেও তারা ছিল দ্বীনকে বিজয়ী করতে অবিচল। তারা তাদের সমাজে ছিল সবচেয়ে তুচ্ছ, স্বল্পসংখ্যক ও দুর্বল। কিন্তু যখন সবাই জাহিলিয়্যাতের সমুদ্রে নিমজ্জিত ছিল তখন এই দুর্বল মানুষগুলোই ছিল আলোকিত চিন্তার অধিকারী, আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত। এই বৈরি পরিবেশে দ্বীন আল কায়্যিমে (সরল পথ) হেটে চলার শক্তিই অবিচল নিষ্ঠা, দৃঢ়পদতা বা ইস্তিকামাহ।
তাইইবনে তাইমিয়্যাহ রহ বলেন,
أَعْظَمُالْكَرَامَةِلُزُومُالِاسْتِقَامَةِ
“(আল্লাহর কাছে) শ্রেষ্ঠ পদমর্যাদার জন্য প্রয়োজন ইস্তিকামাহ” [মাদারিজুস সালিকিন ২/১০৬]
দ্বীনের উপর দৃঢ় ও অবিচল থাকার জন্যই সাহাবারা আল্লাহর কাছে শ্রেষ্ঠ পদমর্যাদার অধিকারী হয়েছিলেন।
তাই আজ কুফর দ্বারা পরিচালিত এই সমাজে যেখানে হারামের সয়লাব, যেই সমাজে ঈমান ধরে রাখা হাতে জলন্ত কয়লা ধরে রাখার চেয়েও কঠিন, সেই সমাজে দ্বীনের উপর ইস্তিকামাত থেকে সমাজ পরিবর্তনে রাজনৈতিক সংগ্রাম করার মাধ্যমে আমরাও আল্লাহর কাছে সাহাবীদের মত সম্মানিত হতে পারি।
আজকের এই পুঁজিবাদী সমাজে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে আমাদেরকে বিভিন্নভাবে আক্রমনের স্বীকার হতে হবে। কেননা পশ্চিমারা চায়, ইসলাম যাতে কখনই আবার ফিরে না আসতে পারে। তাই একে ধ্বংস করার জন্য তারা বিভিন্ন উপায় অবলম্বন করছে। যার মাধ্যমে তারা মুমিনদের প্রচেষ্টাসমূহকে ব্যর্থ করে দিতে তৎপর। তাদের দ্বীন ইসলাম ও তাদের আকিদাহকে ধ্বংস করতে প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছে। তাই যে সকল বিষয়ে আমাদের পরীক্ষার স্বীকার হতে হবে এবং দ্বীনের উপর অবিচল থাকা প্রয়োজন তা হল:
১. ইসলামী চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গিসমূহ, বিশ্বাস ও আইনসমুহকে পশ্চিমা কুফফার শক্তি ও তাদের দোসররা ক্রমাগত আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু বানাচ্ছে তাদের মিডিয়া ও বুদ্ধিজীবিদের মাধ্যমে। খিলাফাহ, জিহাদ, হুদুদ ইত্যাদি বিধিবিধানের মত মৌলিক বিষয়সমূহের প্রতি তাদের আক্রমন, বিষদ্গার চলছে। এই ক্ষেত্রে আমাদের সামগ্রিক ইসলামের উপর এই আঘাতকে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে প্রতিহত করতে হবে এবং ইসলামের উপর ইস্তিকামাত থাকতে হবে। খিলাফতের জন্য কাজ করে যেতে হবে। ২. মুসলিম ভূমিগুলোতে পশ্চিমা ধর্মনিরপেক্ষ মূল্যবোধকে জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে দালাল শাসকগুলোর মাধ্যমে। যেসকল মূল্যবোধ ও চিন্তাসমূহ সম্পূর্ণরূপে শরিয়াহ বিরোধী। যেমন: স্কুল-কলেজসমূহে হিজাব নিষিদ্ধকরণ, ইসলামী রাজনীতিকে ঘৃণিতরূপে প্রচার করা, গনতন্ত্রকে বৈধতা দেওয়া। তাই কুফফারদের কোন ধরনের চাপেই নতি স্বীকার করা যাবে না, বরঞ্চ দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্য অবিচল থাকতে হবে। ৩. দালাল গণতান্ত্রিক সরকারগুলোর মাধ্যমে ইসলামের একটি পরিবর্তিত সংস্করন [reformed islam] গ্রহন করতে, এবং প্রতিষ্ঠিত করতে সকল ধরনের প্রচারনা করা হচ্ছে, যা আসলে পশ্চিমা ধর্মনিরপেক্ষ মূল্যবোধ ও চিন্তাসমূহকে ইসলামীকরনের একটি অপচেষ্টা। যেমন: সুফিবাদী ইসলামকে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে কেননা এটি রাজনীতি বিবর্জিত ইসলামের কথা বলে। এছাড়াও গণতন্ত্রের মত একটি কুফর শাসনব্যাবস্থাকে ইসলামীকরন করার প্রয়াসও এই এজেন্ডার অংশ। মানবাধিকার,নারীর ক্ষমতায়নের মাধ্যমে নারীদেরকে ভোগ্যপন্য ও পুরুষের সাথে অসামঞ্জস্য প্রতিযোগীতা ইত্যাদি স্পষ্ট শরিয়াহর সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ বিষয়সমূহকেও শরীয়াহ সমর্থিত বলে প্রচার করা হচ্ছে। যাতে করে ইসলামী চিন্তাসমূহ তার বিশুদ্ধতা (purity) হারাচ্ছে।
ইসলামকে পরিবর্ধন, পরিবর্তনের মাধ্যমে প্রকাশ্য এই আক্রমনের দ্বারা তারা মুসলিমদেরকে প্রকৃত ইসলাম থেকে দূরে সরিয়ে দিতে চায়। যাতে করে তারা প্রকৃত ইসলামের উপর অবিচল না থাকতে পারে। তাই আমাদের ইসলামকে মৌলিকভাবে [radically] এবং সার্বিকভাবে [comprehensively] গ্রহন করতে হবে এবং তা প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করে যেতে হবে। এবং এই ক্ষেত্রে যাতে আমাদের পদস্থলন না হয়, এবং আমরা ইস্তিকামাহ বা দৃঢ়পদ থাকি। যাতে কুফফারদের আকিদা থেকে উৎসারিত চিন্তা (ফিকরাহ) ও ব্যাবস্থাসমূহকে আমরা গ্রহন না করি। কেননা রাসুল সা কে এজন্যই ইস্তিকামাহ থাকতে আদেশ করা হয়েছে,
وَلَاتَرْكَنُواإِلَىالَّذِينَظَلَمُوافَتَمَسَّكُمُالنَّارُوَمَالَكُممِّندُونِاللَّهِمِنْأَوْلِيَاءَثُمَّلَاتُنصَرُونَ “আর জালিমদের প্রতি ঝুঁকবে না। নতুবা তোমাদেরকেও আগুনে ধরবে। আর আল্লাহ ব্যতীত তোমাদের কোন বন্ধু নাই। অতএব কোথাও সাহায্য পাবে না।” [হুদ: ১১৩]
এটিই ইস্তিকামাত থাকার নির্দেশের পরবর্তী আয়াত যা থেকে বোঝা যায় যারা জালেম, তাদের প্রতি কোনভাবেই ঝোকা যাবে না। তাদের জীবনাদর্শ (মাবদা), সংস্কৃতি (সাকাফা), ব্যাবস্থাসমূহ (নিযাম) কোন কিছুই গ্রহন করা যাবে না। এ ব্যাপারে তাদের সাথে কোন ধরনের আপোষ করা যাবে না।
তাই যদি আমরা জালিম শাসকদের ও তাদের প্রভুদের সাথে দ্বীনের ক্ষেত্রে কোন ধরনের আপোষ করি, তাদের দ্বীন থেকে কোন কিছু গ্রহন করি, তাদের চিন্তা-দর্শন ও আকিদাসমূহের দিকে ঝুকে পড়ি বা আকৃষ্ট হই, তাহলে তা আল্লাহর কাছে ইস্তিকামাহ হিসেবে গন্য হবে না। বরঞ্চ উপরোক্ত আয়াতে মুমিনদেরকে আল্লাহ আগুনের ভয় দেখাচ্ছেন। মুমিনরা এক্ষেত্রে বন্ধু হিসেবে কাউকে পাবে না, এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে বা অন্য কোন জায়গা থেকে সাহায্যও (নুসরাহ) পাবে না।
এছাড়া আমরা যদি ব্যক্তিগতভাবে হারাম কাজে লিপ্ত হই যেমন সালাতে অবহেলা, পরনিন্দা, হারাম সম্পর্ক, অশ্লীলতার চর্চা ইত্যাদি তাহলে আমাদের প্রচেষ্টাও আল্লাহর কাছে গ্রহনযোগ্য হবে না। যদি সমাজের প্রচলিত অনৈসলামি চিন্তাসমূহ নিজের মধ্য থেকে ছেকে না ফেলি তাহলেও একই বিধান প্রযোজ্য।
তাই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা সম্মান-মর্যাদা এবং সাহায্য (নুসরাহ) রেখেছেন দ্বীন এর উপর অবিচল বা ইস্তিকামাত থাকার মাঝেই। তাই আমাদের দ্বীনকে আবারো পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য রাসুল সা এর সুন্নাহ অনুযায়ী কাজ করে যেতে হবে, এবং দ্বীন থেকে কোনভাবেই বিচ্যুত হওয়া যাবে না, ইস্তিকামাহ থাকতে হবে। ইবনুল কায়্যিম রহ সালাফদের উক্তি উল্লেখ করেছেন,
كُنْصَاحِبَالِاسْتِقَامَةِ،لَاطَالِبَالْكَرَامَةِ. فَإِنَّنَفْسَكَمُتَحَرِّكَةٌفِيطَلَبِالْكَرَامَةِ. وَرَبَّكَيُطَالِبُكَبِالِاسْتِقَامَةِ
“অবিচলতার সাথী হও, সম্মান-মর্যাদার অন্বেষণকারী হয়ো না (মানুষের কাছ থেকে)। কেননা তোমার অন্তর মর্যাদা পেতে চায়, কিন্তু তোমার রব বলে অবিচলতার (ইস্তিকামাত) মাধ্যমে সম্মান ও মর্যাদা লাভ করতে’’ [মাদারিজুস সালিকিন ২/১০৬]
ইসলামের উপর ইস্তিকামাত থাকার উপায়
আমরা যারা খিলাফত প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করে যাচ্ছি, ইসলামের উপর ইস্তিকামাত থাকতে হলে আমাদের যা করনীয় তা হল:
*দাওয়াহ এর কাজে নিজের সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করা ও একে অপরের সাথে প্রতিযোগীতা করা। আল্লাহ বলেন,
وَمَنْأَحْسَنُقَوْلًامِّمَّندَعَاإِلَىاللَّهِوَعَمِلَصَالِحًاوَقَالَإِنَّنِيمِنَالْمُسْلِمِينَ
“যে আল্লাহর দিকে দাওয়াহ দেয়, সৎকর্ম করে এবং বলে, আমি একজন আজ্ঞাবহ, তার কথা অপেক্ষা উত্তম কথা আর কার?” [ফুসসিলাত: ৩৩]
আল্লাহ ইসলাম প্রতিষ্ঠার দাওয়াহ আগে করতে বলেছেন। অতঃপর যে আদেশ দিয়েছেন তা হল ইসলামের উপর অবিচল থাকার। এ থেকে বোঝা যায় অবিচল থাকার, আপোষহীন থাকার গুরুত্ব কত বশি। আল্লাহ বলেন,
فَلِذَٰلِكَفَادْعُۖوَاسْتَقِمْكَمَاأُمِرْتَۖوَلَاتَتَّبِعْأَهْوَاءَهُمْۖوَقُلْآمَنتُبِمَاأَنزَلَاللَّهُمِنكِتَابٍۖوَأُمِرْتُلِأَعْدِلَبَيْنَكُمُۖاللَّهُرَبُّنَاوَرَبُّكُمْۖلَنَاأَعْمَالُنَاوَلَكُمْأَعْمَالُكُمْۖلَاحُجَّةَبَيْنَنَاوَبَيْنَكُمُۖاللَّهُيَجْمَعُبَيْنَنَاۖوَإِلَيْهِالْمَصِيرُ
”সুতরাং আপনি এর (ইসলামের) প্রতিই দাওয়াত দিন এবং হুকুম অনুযায়ী অবিচল (ইস্তিকামাহ) থাকুন; আপনি তাদের খেয়ালখুশীর অনুসরণ করবেন না। বলুন, আল্লাহ যে কিতাব নাযিল করেছেন, আমি তাতে বিশ্বাস স্থাপন করেছি। আমি তোমাদের মধ্যে ন্যায় বিচার করতে আদিষ্ট হয়েছি। আল্লাহ আমাদের পালনকর্তা ও তোমাদের পালনকর্তা। আমাদের জন্যে আমাদের কর্ম এবং তোমাদের জন্যে তোমাদের কর্ম। আমাদের মধ্যে ও তোমাদের মধ্যে বিবাদ নেই। আল্লাহ আমাদেরকে সমবেত করবেন এবং তাঁরই দিকে প্রত্যাবর্তণ হবে।” [শুরা: ১৫]
ইসলামের উপর অবিচল থাকার জন্য নেক কাজে প্রতিযোগীতা করার মানসিকতা তৈরি করা প্রয়োজন। আল্লাহ বলেন,
وَلِكُلٍّوِجْهَةٌهُوَمُوَلِّيهَاۖفَاسْتَبِقُواالْخَيْرَاتِۚأَيْنَمَاتَكُونُوايَأْتِبِكُمُاللَّهُجَمِيعًاۚإِنَّاللَّهَعَلَىٰكُلِّشَيْءٍقَدِيرٌ
“আর সবার জন্যই রয়েছে কেবলা একেক দিকে, যে দিকে সে মুখ করে (এবাদত করবে)। কাজেই সৎকাজে প্রতিযোগিতামূলকভাবে এগিয়ে যাও। যেখানেই তোমরা থাকবে, আল্লাহ অবশ্যই তোমাদেরকে সমবেত করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্ব বিষয়ে ক্ষমতাশীল।” [বাকারা: ১৪৮]
اللَّهُمَّيَامُقَلِّبَالْقُلُوبِ،ثَبِّتْقَلْبِيعَلَىدِينِكَ
“হে আল্লাহ, হে অন্তরসমূহের পরিবর্তনকারী। আমার অন্তরকে তোমার দীনের উপর অবিচল রাখো ” (তিরমিযী,আহমাদ, হাকিম,ইবনে হিব্বান)
يَاأَيُّهَاالَّذِينَآمَنُوااصْبِرُواوَصَابِرُواوَرَابِطُواوَاتَّقُوااللَّهَلَعَلَّكُمْتُفْلِحُونَ
“হে ঈমানদানগণ! ধৈর্য্য ধারণ কর এবং মোকাবেলায় দৃঢ়তা অবলম্বন কর। আর আল্লাহকে ভয় করতে থাক যাতে তোমরা তোমাদের উদ্দেশ্য লাভে সমর্থ হতে পার।” [আলে ইমরান ২০০]
“অবশ্যই আল্লাহ এই কিতাবের মাধ্যমে কিছু লোকের উত্থান ঘটাবেন এবং কিছু লোকের পতন ঘটাবেন।” [মুসলিম]
তাই আমাদেরকে অবশ্যই ইসলামী সাকাফাহ তথা সংস্কৃতির ছাচে নিজেকে গড়ে তুলতে হবে; কুরআন, সুন্নাহর জ্ঞান ও এর ফিকহ অর্জনে মনোনিবেশ করার মাধ্যমে। যাতে করে আমরা দুনিয়ায় খিলাফতের মাধ্যমে নেতৃত্বদানকারী জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারি। ওয়ামা তাউফিক ইল্লা বিল্লাহ।
লেখক: ইবনুল আযরাক