সাম্প্রতিক সময়ে গ্লোবাল ফিনেনশিয়াল ইন্টেগ্রিটি নামক একটি প্রতিষ্ঠানের প্রকাশিত রিপোর্ট থেকে জানা যায়, বাংলাদেশ দক্ষিন এশিয়ার মধ্যে অর্থ পাচারে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে। বৈশ্বিকভাবে ১৯ তম। প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৫ সালের এক বছরেই বাংলাদেশ থেকে পাচার হয় ৫ শ’ ৯০ কোটি মার্কিন ডলার বা প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা। পাচারের অর্থের বেশিরভাগই গেছে আমদানি-রফতানির বাণিজ্যের আড়ালে। ১৫ সালের আগের এগারো বছরে পাচার হয়েছে প্রায় ৬ লাখ ৮৬ হাজার কোটি টাকা। (কালের কন্ঠ ২৯/১/২০১৯)
দেশ থেকে অতিমাত্রায় অর্থ বিদেশে চলে যাওয়ার সবচেয়ে বড় কারন হল বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ পুজিবাদী শাসকেরা ৪৯ বছরেও দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে পারে নি।
মূল সমস্যা নিয়ে আলোচনা না করে ঢালাওভাবে অর্থপাচারের দায় ফেলা হয় হুন্ডি, ভিওআইপি ব্যাবসার উপরে। কিন্তু আলোচনা করা হয় না কেন জনগন দেশে টাকা রাখতে চায় না। এতে বর্তমান শাসকগোষ্ঠীর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অরাজকতাই দায়ী তা সামনে আসে না।
দেশে বিনিয়োগ ও ব্যাবসা-বানিজ্যের জন্য স্থিতিশীল পরিবেশ, উৎপাদনমুখী অর্থনীতির জন্য সহায়ক অবকাঠামো, উন্নত শিক্ষা ও চিকিৎসা এবং শক্তিশালী স্থানীয় ইন্ডাস্ট্রি গড়ে তোলা যার মাধ্যমে চাকরির সুযোগ সৃষ্টি সহ দেশের অভ্যন্তরে প্রয়োজনীয় পন্য সরবরাহ করা যায়; এর কিছুই এদেশের শাসকশ্রেনী নিশ্চিত করতে পারে নি বরং ব্যর্থ হয়েছে।
দেশের অর্থনীতির প্রতি এরুপ অবহেলা প্রদর্শন করে, দুর্নীতিতে বিরল নজির স্থাপন করে, জনগণের জান মালের নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে বরঞ্চ ‘অর্থপাচার দেশের অর্থনীতিতে কোন প্রভাব ফেলবে না’ বলে বক্তব্য দিয়েছে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান।(যুগান্তর, ১৯/১/২০১৯) এভাবেই ধর্মনিরপেক্ষ শাসকেরা এদেশের জনগনের সাথে প্রতারনা করেই যাচ্ছে,এবং জনগনের স্বার্থকে উপেক্ষা করেই যাচ্ছে।
দেশে আওয়ামী-বিএনপি কোন্দলে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারনে ব্যাবসা বানিজ্যে তীব্র মন্দা বিনিয়োগের পরিবেশ নেতিবাচক হচ্ছে। দেশে চাদাবাজি, দূর্নীতি, গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলোর গুন্ডাবাহিনীর তান্ডবে মানুষ বাধ্য হচ্ছে যেকোন উপায়ে নিজেদের অর্থ সম্পদ বাইরের দেশগুলোতে পাঠিয়ে রক্ষা করতে। দেশে বিনিয়োগ না করে বরং বিদেশে বিনিয়োগ করতে। দেশের জ্বালানী সম্পদ ব্যাবহার করে ভারী ইন্ডাষ্ট্রি গড়ে তোলার জন্য যে সুউচ্চ ভিশন তা বর্তমান গণতান্ত্রিক শাসকদের না থাকায়, বিনিয়োগের ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে না, চাকরির সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে না। বরঞ্চ আমাদের শাসকেরা এদেশের জ্বালানী খাতকে পশ্চিমা কোম্পানীগুলোর হাতে তুলে দিয়েছে, ফলে জ্বালানীর দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে ক্রমান্বয়ে। এর ফলে দেশে পন্য উৎপাদন ব্যয়বহুল হওয়ায়, দেশ আমদানীমুখী হয়ে পড়ছে। স্বাভাবিকভাবেই আমদানীর প্রভাবে দেশের অর্থ বিদেশে চলে যাচ্ছে।
এছাড়াও ব্যাবসা বানিজ্যে নানাবিধ অতিরিক্ত কর আরোপ করার কারনেও দেশে বিনিয়োগে সদিচ্ছার অভাব দেখা দিচ্ছে। করের হাত থেকে টাকা বাচাতে তা পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে সুইজারল্যান্ড সহ বিভিন্ন ‘ট্যাক্স হ্যাভেন’ দেশগুলোতে।
দেশের শিক্ষার মান না থাকায় অন্য দেশে পড়াশোনা ও তার করতে যাচ্ছে প্রচুর ছাত্র, যাদের বেশিরভাগই বিদেশে পড়শোনা শেষ করে সেখানেই চাকরি পাওয়ার স্বপ্ন দেখে। উন্নত চিকিৎসার জন্য প্রতিবছরই মানুষ হচ্ছে বিদেশমুখী। যার ফলে প্রচুর অর্থ দেশ থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে।
এদেশের গণতান্ত্রিক শাসকরাও দূর্নীতির মাধ্যমে অবৈধভাবে অর্জিত অর্থ বিদেশে পাচার করছেন। প্রকৃতপক্ষে আমাদের শাসকেরা জনগণের কল্যান সাধনের কোন তোয়াক্কাই করে না বরঞ্চ নিজেদের আখের গোছাতেই ব্যাস্ত।
সমাধান
একমাত্র নবুয়্যতের আদলের খিলাফতই পারে ক্রমবর্ধমান এই অর্থপাচার (capital flight) ঠেকাতে।
১। একমাত্র খিলাফত রাষ্ট্রই এক খলিফার নের্তৃত্বে মুসলিমদের ঐক্যবদ্ধ করে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করবে।
“রাসুল (সা) বলেন, যখন একজন ইমামের হাতে বাইয়াত সম্পূর্ন হয়ে যায় তখন তাকে যথাসাধ্য মান্য করবে, এমতাবস্থায় যদি কেউ তার সাথে বিরোধ করতে আসে, তবে দ্বিতীয়জনকে হত্যা করবে।“[সহিহ মুসলিম হাদিস নং ১৮৪৪]
তাই রাজনৈতিক অরাজকতা সৃষ্টির কোন সুযোগ থাকবে না।
২। এছাড়াও দেশের অফুরন্ত সম্পদ কাজে লাগিয়ে একটি শক্তিশালী অর্থনীতি নির্মান করবে খিলাফত, যাতে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত হবে। যেভাবে ১৪০০ বছরের একটি শক্তিশালী অর্থনীতি তৈরি করেছিল খিলাফত।
খিলাফত রাষ্ট্র দেশের জ্বালানী খাতকে গণমালিকানাধীন সম্পদে পরিনত করবে, এবং দেশের জ্বালানী বৈদেশিক শক্তির হাত থেকে মুক্ত করে এর মাধ্যমে একটি শক্তিশালী ভারী শিল্প কাঠামো গড়ে তুলবে। ফলে পর্যাপ্ত জ্বালানী সরবরাহ নিশ্চিতের মাধ্যমে দেশে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি হবে। শুধুমাত্র তাই নয়, এটি খিলাফত রাষ্ট্রের ভিশন কারণ ভারী সমরশিল্প গড়ে তোলা, এবং উন্নত প্রযুক্তির বিকাশ সাধন খিলাফত রাষ্ট্রের জন্য ফরয, কেননা আল্লাহ বলেন,
“ আর প্রস্তুত কর তাদের সাথে যুদ্ধের জন্য যাই কিছু সংগ্রহ করতে পার নিজের শক্তি সামর্থ্যের মধ্যে থেকে এবং পালিত ঘোড়া থেকে, যেন প্রভাব পড়ে আল্লাহর শুত্রুদের উপর এবং তোমাদের শত্রুদের উপর আর তাদেরকে ছাড়া অন্যান্যদের উপর ও যাদেরকে তোমরা জান না; আল্লাহ তাদেরকে চেনেন। বস্তুতঃ যা কিছু তোমরা ব্যয় করবে আল্লাহর রাহে, তা তোমরা পরিপূর্ণভাবে ফিরে পাবে এবং তোমাদের কোন হক অপূর্ণ থাকবে না”। [আনফাল ৬০]
ফলে দেশের অর্থ বাইরে যাওয়ার হার কমে আসবে। কেননা এভাবে খিলাফত রাষ্ট্রে বিনিয়োগের ক্ষেত্র প্রস্তুত হবে।
৩। খিলাফত রাষ্ট্র জনগনের জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা প্রদান করবে, এতে করে সম্পদ ও অর্থের পাচার থেমে যাবে। আবু বাকরা (রা) রাসুল (সা) থেকে বর্ননা করেন,
أَلاَ إِنَّ اللَّهَ حَرَّمَ عَلَيْكُمْ دِمَاءَكُمْ وَأَمْوَالَكُمْ، كَحُرْمَةِ يَوْمِكُمْ هَذَا، فِي بَلَدِكُمْ هَذَا، فِي شَهْرِكُمْ هَذَا
“নিশ্চই তোমাদের রক্ত, তোমাদের সম্পদ এবং তোমাদের সম্মান আল্লাহ পবিত্র ও হারাম করেছেন যেমন তোমাদের এই দিন, এই শহর, এই মাস”। [বুখারী, হাদিস নং ৪৪০৩, আসসুনাসুস সাগির লি বাইহাকি, হাদিস নং ৩১২১]
৪। খিলাফত রাষ্ট্র খারাজ, জিজিয়া ও উশর ছাড়া অন্য কোন কর আরোপ করবে না। কেননা আয়কর, এবং বিভিন্ন ধরনের শুল্ক ইসলাম হারাম ঘোষনা করেছে। শুধুমাত্র ব্যাবসায়িক পন্য থেকে এর যাকাত নেওয়া হবে, অন্য কোন কর থাকবে না। ফলে জনগন করের বোঝায় জর্জরিত হয়ে অর্থ বিদেশে পাঠাবে না।রাসুল সা বলেছেন,
«لَا يَدْخُلُ صَاحِبُ مَكْسٍ الْجَنَّةَ» ‘
“অবৈধভাবে কর আদায়কারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না” [মুসনাদ আল আহমাদ, হাদিস নং ১৭০২৩]
৫। খিলাফত রাষ্ট্র উন্নত শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করবে, যেরকমভাবে পূর্বে যখন ইউরোপ অন্ধকার গহ্বরে নিমজ্জিত ছিল, তখন খিলাফত রাষ্ট্রে ফেয, কর্ডোভা, আলেক্সান্দ্রিয়া, বাগদাদ আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞানের পীঠস্থান ছিল। তাই ইউরোপ থেকে ছাত্র এসে খিলাফত রাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটিগুলোতে পড়ালেখা করত।
৬। খিলাফত রাষ্ট্র উন্নত চিকিৎসার ব্যাবস্থা করবে, খিলাফত রাষ্ট্রের খসড়া সংবিধানে ১৬৪ ধারায় রয়েছে:
‘রাষ্ট্র সকলের জন্য বিনামূল্যে চিকিৎসার ব্যাবস্থা করবে’।
কেননা রাসুল (সা) মদীনায় ডাক্তার নিয়োগ করেছিলেন। তাই খিলাফত রাষ্ট্রে বাইতুল মাল চিকিৎসাসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় সেবার ব্যাবস্থা করবে। এতে করে দেশের অর্থ বিদেশে যাবে না।
৭। এছাড়াও, খিলাফত রাষ্ট্র দূর্নীতি রোধে সর্বত্র তাকওয়ার পরিবেশ নিশ্চিত করবে। এতে করে প্রশাসন থেকে শুরু করে সব জায়গায় দূর্নীতি দূর করা সম্ভব হবে। এছড়াও হিসবাহ আদালত সকল পর্যায়ে দূর্নীতি মনিটর করবে যাতে তা কমে আসে। ফলে জনমনে উদ্বিগ্নতা ও আস্থার অভাব (lack of confidence) দূর হবে। অর্থ বাহিরে বিনিয়োগ ও নিরাপত্তার জন্য প্রেরন করার প্রবণতা হ্রাস পাবে। শাসকরা বায়তুল মাল থেকে প্রাপ্ত ভাতার বাইরে কোন ধরনের ব্যক্তিগত অর্থনৈতিক কার্যক্রমে জড়িত থাকতে পারবে না। তাদেরকে অর্থসম্পদের উপর সার্বক্ষণিক নজরদারি রাখা হবে। যেকোন অনাকাংক্ষিত অর্থ বৃদ্ধি দেখা গেলে তা বাজেয়াপ্ত করে বায়তুল মালে জমা করা হবে। তাই শাসকশ্রেনীর অর্থের পাহাড় গড়ে তা পাচারের সুযোগ খিলাফত রাষ্ট্রে থাকবে না।
এবং এভাবেই খিলাফত রাষ্ট্র ইসলামী বিধিবিধান বাস্তবায়নের মাধ্যমে আল্লাহু সুবহানাহু ওয়া তা’আলার রহমত দ্বারা পরিবেষ্টিত হবে, এবং তার সন্তুষ্টি অর্জনে সক্ষম হবে।
وَابْتَغِ فِيمَا آتَاكَ اللَّهُ الدَّارَ الآخِرَةَ وَلاَ تَنسَ نَصِيبَكَ مِنَ الدُّنْيَا وَأَحْسِنْ كَمَا أَحْسَنَ اللَّهُ إِلَيْكَ وَلاَ تَبْغِ الْفَسَادَ فِي الأَرْضِ إِنَّ اللَّهَ لاَ يُحِبُّالْمُفْسِدِينَ
“আল্লাহ তোমাকে যা দান করেছেন, তদ্বারা পরকালের গৃহ অনুসন্ধান কর, এবং ইহকাল থেকে তোমার অংশ ভূলে যেয়ো না। তুমি অনুগ্রহ কর, যেমন আল্লাহ তোমার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন এবং পৃথিবীতে অনর্থ সৃষ্টি করতে প্রয়াসী হয়ো না। নিশ্চয় আল্লাহ অনর্থ সৃষ্টিকারীদেরকে পছন্দ করেন না।” [কাসাস: ৭৭]
লেখক: ইবনুল আযরাক