উই ওয়ান্ট জাস্টিস

রাজধানী ঢাকার এয়ারপোর্ট রোডে কুর্মিটোলা হাসপাতালের সামনে জাবালে নূর বাসের ধাক্কায় শহীদ রমিজউদ্দিন কলেজের দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুর ঘটনায় পুরো দেশব্যাপী এক অভূতপূর্ব আন্দোলন গড়ে উঠে। সরকারের দূর্নীতিগ্রস্ত সড়ক পরিবহন ব্যবস্থাপনা থেকে শুরু করে সর্বোপরি দুঃশাসনের বিরুদ্ধে প্রধানত স্কুলের কিশোর কিশোরী ও তাদের অভিভাবকদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের মাধ্যমে টানা সাত দিন ব্যাপী যে তীব্র ঘৃণা ও বিক্ষোভ প্রদর্শিত হয়েছে তা ছিল নজিরবিহীন। সরকার এ তুমুল জনপ্রিয় আন্দোলনকে আগের মত প্রতারণা এবং দলীয় পেশী শক্তি ও প্রশাসনের মাধ্যমে দমন করার চেষ্টা করেছে। সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে এ ধরনের আন্দোলন এ সরকারের সময়ে আরও হয়েছে। যেমন শাহবাগী নাস্তিক চক্রের বিরুদ্ধে গড়ে উঠা হেফাজতের আন্দোলন, ভ্যাটবিরোধী প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আন্দোলন, সারাদেশ ব্যাপী গড়ে উঠা বৈষম্যপূর্ণ কোটা বিরোধী আন্দোলন। 

যখন পুঁজিবাদী ও তথাকথিত ইসলামিক রাজনৈতিক দলসমূহ সরকারের দূর্নীতি, অপশাসন, লুটপাট, স্বেচ্ছাচারিতা ও জুলুমের বিরুদ্ধে কার্যকর গণআন্দোলন গড়ে তুলতে ব্যর্থ হচ্ছে তখন এ ধরনের আন্দোলনের মাধ্যমে বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ, ঘৃণা ও প্রত্যাখান সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। অবশ্য ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্ষেত্রে আন্দোলনকে ছড়িয়ে দিতে প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষ ভূমিকা পালন করেছে। এই দশকের শুরুর দিকে আরব বিশ্বব্যাপী ঘটে যাওয়া আরব বসন্তের সাথে এসব আন্দোলনের সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়। ধর্মনিরপেক্ষ পুঁজিবাদী গণতন্ত্র অথবা স্বৈরতন্ত্রের মাধ্যমে মুসলিম বিশ্বব্যাপী নব্য উপনিবেশবাদ বজায় রাখা হয়েছে। পুঁজিবাদে আপামর জনগণকে দারিদ্রতার মধ্যে রেখে সম্পদ মুষ্টিমেয় পুঁজিপতির হাতে কৌশলে তুলে দেয়া হয় । মানুষের আইন তৈরির ক্ষমতার কারণে এ ব্যবস্থায় দূর্নীতি, দুঃশাসন, প্রতারণা, স্বেচ্ছাচারিতা খুবই স্বাভাবিক। সেকারণে মুসলিম বিশ্বের বিশ্বাসঘাতক শাসকগণ তাদের উপনিবেশবাদী প্রভূদের মত জনগণকে প্রতারণা ও ত্রাস সৃষ্টি করার মাধ্যমে ন্যায্য দাবি থেকে দূরে রাখে। কিন্তু মুহম্মদ (সা) এর উম্মতের মধ্যে খায়ের থাকার কারণে উম্মাহ একটি সময় পর প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে উঠে। কারণ উম্মাহ’র মধ্যে সব সময় একটি নিষ্ঠাবান ও অধিক সংবেদনশীল অংশ রয়ে যায়- যারা উম্মাহ’র বিরুদ্ধে করা ষড়যন্ত্রকে সাহসিকতার সাথে উন্মোচন করে দূর্নীতিবাজ শাসকের মুখোশ খুলে দেয়। তবে এসব আন্দোলন অনেক সময় কাঙ্খিত লক্ষ্য পূরণে ব্যর্থ হয়। এসব আন্দোলনের ভাগ্যে যাই ঘটুক-আন্দোলনের স্পিরিটের সাথে নিষ্ঠাবান যে কেউ একাত্মতা ঘোষণা করবে ও স্বাগত জানাবে। 

তবে নিষ্ঠাবান মুসলিমদের ভাবতে হবে কেন উম্মাহ’র এ আন্তরিক প্রতিবাদসমূহ জুলুমের পুরোপুরি অবসান ঘটিয়ে সত্যিকারের পরিবর্তন সূচনা করছে না। এর একটি কারণ হল আন্দোলনগুলো ছিল ইস্যুভিত্তিক। সামগ্রিক পরিবর্তনের জন্য অর্থাৎ আদর্শিক পরিবর্তনের জন্য সেভাবে কোন আন্দোলন গড়ে উঠেনি। ইস্যু আদায় হয়ে গেলে ইস্যু ভিত্তিক আন্দোলন এর অপরিহার্যতা হারিয়ে ফেলে। জনগণ ইস্যুভিত্তিক আন্দোলন করতে থাকলে শাসকশ্রেণীর তাতে খুব বড় সমস্যা হয় না। কেননা ত্রটিপূর্ণ পুঁজিবাদী জীবনব্যবস্থা মানুষের জীবনে বাস্তবায়িত থাকার কারণে সমস্যার কোন অন্ত নেই। প্রতিটি সমস্যা নিয়ে রাস্তায় নামতে থাকলে একজন মানুষের এক জীবন যথেষ্ট নয়। আর দূর্নীতিপূর্ণ একটি ব্যবস্থাকে অটুট রেখে এর কিয়দংশে সংস্কার করলে সেই ব্যবস্থা মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠে, কারণ তখন সেটি আগের চেয়ে কম ত্রুটিপূর্ণ বলে মানুষ মনে হতে থাকে। তাই ইস্যুভিত্তিক আন্দোলন উম্মাহ’র গুরুত্বপূর্ণ প্রাণশক্তি ও উদ্দীপনাকে নষ্ট করে এবং প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থার গ্রহণযোগ্যতাকে আরও বাড়িয়ে দেয়। আন্দোলনের নেতৃত্ব এর লক্ষ্য সর্ম্পকে দৃঢ়তা প্রদর্শন করতে ব্যর্থ হয়েছে। ইস্যু ভিত্তিক আন্দোলনে দৃঢ়তা প্রদর্শন সম্ভব নয়। আর আদর্শিক উপনিবেশিক শক্তি আন্দোলনরত জনগনকে ধোকা দিয়ে এর গতিপথকে নিজের সুবিধামতো পরিবর্তন করেছে এবং সর্বশেষ ফলাফলটি নিজের ঘরে তুলে নিয়েছে। আরব বসন্ত এর প্রকৃষ্ঠ উদাহরণ। এসব আন্দোলনের মাধ্যমে দূর্ভাগ্যবশতঃ মুসলিমগণ ক্রীড়নক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে এবং একধরনের কসমেটিক পরিবর্তন হয়েছে। খুব শীঘ্রই উম্মাহ বুঝতে পেরেছে যে, উপনিবেশবাদী কাফেররা পুরোদমেই নিয়ন্ত্রনে আছে। 

তাহলে সমাধান কী? সমাধান হল মূল সমস্যাকে ধরতে পারা এবং এর বিলোপ সাধনের জন্য সব শক্তিকে বিনিয়োগ করা। মূল সমস্যা হল ধর্মনিরপেক্ষ পুঁজিবাদী ব্যবস্থা এবং এর শাসনব্যবস্থা গণতন্ত্র-যা থেকে অন্য সব উপসর্গ সমস্যা তৈরি হয়। মূল সমস্যাকে পাশ কাটিয়ে উপসর্গের চিকিৎসা কখনওই প্রকৃত পরিবর্তন বয়ে আনবে না। আবার কেউ যদি মনে করে কেবলমাত্র গণআন্দোলনের মাধ্যমে ব্যবস্থার পরিবর্তন আসবে সেটাও ঠিক নয়। ব্যবস্থা পরিবর্তনের জন্য জনসচেতনতা তৈরি করা একটি সামগ্রিক পরিবর্তনের আংশিক কাজ মাত্র। জনসচেতনতা তৈরির পাশাপাশি রাষ্ট্র ও সমাজের পাওয়ার পকেটসমূহ থেকে কার্যকর সাহায্য পাওয়া গেলেই কেবলমাত্র ব্যবস্থা বা আদর্শিক পরিবর্তন সম্ভব। এর প্রকৃষ্ঠ উদাহরণ হল আরব বসন্ত। তিউনিসিয়া, লিবিয়া, মিশর, ইয়েমেন ও সিরিয়ায় ইসলামী ব্যবস্থার পক্ষে ব্যাপক জনসমর্থন থাকলেও পাওয়ার পকেটসমূহ বা সেনাবাহিনী থেকে কার্যকর সাহায্য না পাওয়ায় সেসব দেশ দারুল ইসলামে (ইসলামী রাষ্ট্রে) পরিণত হতে পারেনি। সাধারণ জনগন ও পাওয়ার পকেটের কার্যকর প্রচেষ্টার মধ্য দিয়েই পৃথিবীর ইতিহাসে আদর্শিক সব পরিবর্তন হয়েছে। আজ থেকে দেড় হাজার বছর আগে রাসূলুল্লাহ (সা) মদীনার আউস ও খাজরাজ গোত্রের সাধারণ জনগণ ও গোত্র প্রধানদের (যারা পাওয়ার পকেট বা আহলুল হাল ওয়াল আকদ ছিলেন) ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় খিলাফত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ফরাসী বিপ্লব, বলশেভিক বিপ্লব, চীনে কমিউনিস্ট বিপ্লব সব একইভাবে হয়েছে। আদর্শিক পরিবর্তনের এ বাস্তবতা পরিবর্তকামী প্রতিটি ব্যক্তিকে গভীরভাবে অনুধাবন করতে হবে এবং এ অনুযায়ী কাজ করতে হবে। 

নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের শ্লোগানসমূহ বেশ নজর কেড়েছে। এর মধ্যে সর্বাধিক আলোচিত ছিল ‘ওই ওয়ান্ট জাস্টিস’ (আমরা ন্যায়বিচার চাই)। আসলে এই ‘জাস্টিস’ শব্দটি ব্যাপক। যে কারও মনে হতে পারে এই জাস্টিস কার কাছে চাওয়া হচ্ছে? উত্তর হতে পারে সরকারের কাছে। কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যেখানে মানুষের সার্বভৌমত্ব কায়েম রয়েছে সেখান থেকে কী জাস্টিস পাওয়া সম্ভব? ইসলামে সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা। মানুষকে এ ক্ষমতা দেয়া হয়নি কারণ সে সীমাবদ্ধ জ্ঞানের অধিকারী এবং পরিবেশ দ্বারা প্রভাবিত। এ কারণেই আওয়ামীলীগ যে আইন করে তা বিএনপির বিরুদ্ধে যায়। আবার বিএনপি যখন আইন করেছিল তখন তার সুবিধার্থে তা করেছিল। মানুষকে আইন করতে দিলে সে স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠে। সেকারণে আমরা দেখতে পাই শিক্ষার্থীগন মন্ত্রী, এমপি, পুলিশের অফিসার ও সচিবদের নিকট ড্রাইভিং লাইসেন্স চেক করে পায়নি। অর্থাৎ শাসকশ্রেণী যে আইন করে সে আইন তারা নিজেরাই মানে না। জনগন শাসকের কাছে জবাবদিহী করে, কিন্তু শাসকের জবাবদিহীতা না থাকায় সে হয়ে উঠে দূর্বিনীত স্বৈরাচার ও জালিম। এই মানবীয় দূর্বলতা অসঙ্গতি, জুলুম ও ভোগান্তির জন্ম দেয়। তাই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা পবিত্র কুরআনে বলেন, ‘যারা আল্লাহ যা নাজিল করেছেন তা ছাড়া অন্য কিছু দিয়ে বিচার ফায়সালা করে তারাই জালিম’ (সূরা মায়েদাহ)। সেকারণে মানবরচিত ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার কাছে জাস্টিস পাওয়ার আকাঙ্খা আম গাছ লাগিয়ে জাম খাওয়ার মত আকাশ কুসুম কল্পনা ছাড়া আর কিছুই নয়। জাস্টিস পাওয়া যাবে একটি জাস্ট ব্যবস্থা এবং এই ব্যবস্থার ভিত্তিতে পরিচালিত শাসকের কাছ থেকে। মহাবিশ্বের স্রষ্টা কোন ব্যক্তি বা দল দ্বারা প্রভাবিত নয় এবং মানুষের স্রষ্টা হিসেবে তার বাস্তবতা সর্ম্পকে সম্যক ধারণা থাকায়, তিনিই একটি ত্রটিমুক্ত জীবনব্যবস্থা দিতে পারেন। আর একমাত্র ইসলামই হল জাস্ট ব্যবস্থা এবং ইসলামের ভিত্তিতে পরিচালিত শাসকই ন্যায়পরায়ণ। জাস্টিস তাই ইসলামী ব্যবস্থা ও ইসলামি খলিফার কাছে চাওয়া যেতে পারে, অন্য কারও কাছে নয়। জাস্টিস চাওয়া যেতে পারে ওমর (রা) এর মত শাসকের কাছে কেননা তিনি জনসম্মুখে জবাবদিহীতার সম্মুখীন হতে পরোয়া করতেন না। জাস্টিস চাইতে হবে আলী (রা) এর মত শাসকের কাছে যিনি ছেলে ব্যতিরেকে আর কোন সাক্ষী না থাকার কারণে বিচারপতির কাছে চুরি যাওয়া তলোয়ার ফেরত পাননি। জাস্টিস চাইতে হবে ওমর বিন আবদুল আজিজ (র) এর মত শাসকের কাছে যার সময় যাকাত নেওয়ার মত লোক খুঁজে পাওয়া যেত না অথচ রাষ্ট্রের মধ্যে দরিদ্র লোকের তালিকায় তার নাম শীর্ষে উঠে এসেছিল। 

যদি আমরা সবাই রাসূলুল্লাহ (সা) এর তরীকা অনুসারে এই জাস্ট ব্যবস্থা-ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করি, তাহলে সেইদিন খুব বেশী দূরে নয়, যখন জাস্টিসের জন্য লক্ষ মানুষকে রাস্তায় নামতে হবে না, জাস্টিসের জন্য আন্দোলন করতে গিয়ে কোন মা কে সন্তান হারাতে হবে না, জালিম শাসকের কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে নিক্ষিপ্ত হতে হবে না, বরং প্রত্যেক প্রাপককে তার যথাযথ প্রাপ্য পৌঁছে দেয়া হবে এবং সবক্ষেত্রে জাস্টিস প্রতিষ্ঠিত হবে ইনশাআল্লাহ।

Leave a Reply