রাষ্ট্রের পতাকা ও ব্যানার

ইসলামী রাষ্ট্রের পতাকা (আল-ওয়্যিয়াহ্) ও ব্যানার (রাইয়াত) থাকবে যা নেয়া হয়েছে মদিনায় রাসূলুল্লাহ্ (সা) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত প্রথম ইসলামী রাষ্ট্রের উদাহরণ থেকে। এগুলোর বিস্তারিত বর্ণনা নিম্নরূপ: 

১. ভাষাগতভাবে পতাকা ও ব্যানারকে ’আলম বলা হয়। আল কামুস আল মুহীতে উল্লেখিত আছে যে, মূলতঃ আল-রাইয়া অর্থ হল আল-আলম, যার বহুবচন হল রাইয়াত। এছাড়া, আল-লিওয়া শব্দমূল থেকে আল-আলম শব্দটি এসেছে যার বহুবচন হল আল-ওয়্যিয়াহ্। এর পাশাপাশি এইসব প্রতিটি শব্দের শারী’আহ্ নির্ধারিত অর্থ ও তাৎপর্য রয়েছে: 

– পতাকা (লিওয়া) হবে সাদা, যেখানে কাল অক্ষরে লেখা থাকবে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদ উর রাসূলুল্লাহ্’। এটা সেনাবাহিনীর আমীর বা নেতার সাথে বাঁধা থাকবে। এটা তার অবস্থানের নিদর্শন হিসেবে থাকবে এবং এটি তার সাথে সাথে যাবে। এ বিষয়ে দলিল হল, মক্কাবিজয়ের দিন রাসূলুল্লাহ্  (সা) একটি সাদা পতাকা উড়িয়েছিলেন। এ হাদীসটি জাবিরের সূত্রে ইবনে মাজাহ্ বর্ণনা করেছেন। এছাড়া, আন-নাসায়ী আনাস থেকে বর্ণনা করেছেন যে, রোমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য যখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) উসামা বিন যায়েদকে সেনাবাহিনীর আমীর নিযুক্ত করেন তখন তিনি নিজ হাতে উসামার পতাকা বেঁধে দেন।

– আর, ব্যানার (রাইয়া) হবে কাল যাতে সাদা অক্ষরে লেখা থাকবে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদ উর রাসূলুল্লাহ্’। সেনাবাহিনীর বিভিন্ন বিভাগের আমীরগণ এটা বহন করবেন (রেজিমেন্ট, ডিটাচমেন্ট এবং অন্যান্য সামরিক ইউনিটসমূহ)। এ বিষয়ে দলিল হল, রাসূলুল্লাহ্ (সা) যখন খায়বারের যুদ্ধে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন তখন ঘোষণা করেছিলেন: “আগামীকাল আমি এমন একজনকে রাইয়া প্রদান করবো যে আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলকে ভালবাসে এবং তারপর তিনি এটি আলীকে দিলেন।” এই হাদীসের ব্যাপারে সকলের ঐক্যমত আছে (মুত্তাফিকুন ’আলাইহি)। তখন আলীকে একটি ডিভিশন বা রেজিমেন্টর নেতা হিসাবে ধরা হয়েছিল। এছাড়া, আল-হারিছ বিন হাস্সান বিন আল-বকরী বর্ণিত একটি হাদীসে বলা হয়েছে, “আমরা মদিনাতে এলাম এবং রাসূল (সা) কে মিম্বরে উপবিষ্ট অবস্থায় দেখলাম, যখন বিলাল তাঁর সামনে তলোয়ার পরিহিত অবস্থায় দন্ডায়মান ছিল। রাসূল (সা) এর সামনে কিছু কাল পতাকা ছিল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “এগুলো কিসের পতাকা?” তারা বলল, “আমর ইবনুল ’আস এইমাত্র অভিযান থেকে এসেছেন।” “সেখানে কিছু কাল পতাকা ছিল” – একথাটির অর্থ হল, সেনাবাহিনী অনেক পতাকা বহন করছিল, যদিও এর নেতৃত্বে ছিল একজন, যিনি ছিলেন আমর ইবনুল ’আস। এটা নির্দেশ করে যে, সেনাবাহিনীর একটি মাত্র পতাকা (ইলওয়া) থাকবে, কিন্তু, ব্যানার অনেক থাকতে পারে। সুতরাং, পতাকা (লিওয়া) হল সেনাবাহিনী প্রধানের চিহ্ন (’আলম) বা প্রতীক; আর, ব্যানার (রাইয়া) হল সৈন্যদলের প্রতীক (’আলম)।   

২. পতাকা (লিওয়া) সেনাবাহিনীর আমীরের সাথে বাঁধা থাকবে – যা সেনাপ্রধানের প্রধান কার্যালয়ের প্রতীক হিসাবে নির্দেশিত হবে। তবে, যুদ্ধক্ষেত্রে যুদ্ধের আমীর, হোক তিনি সেনাবাহিনীর আমীর অথবা তার পক্ষ থেকে নিযুক্ত কেউ, তাকে যুদ্ধকালীন সময়ের জন্য ব্যানার (রাইয়া) প্রদান করা হবে। একারণে ব্যানারকে (রাইয়া) যুদ্ধের জননী বলা হয়, কারণ যুদ্ধরত নেতাগণ যুদ্ধের ময়দানে এটি বহন করে থাকে।

সুতরাং, প্রকৃত অর্থে যখন যুদ্ধ সংঘটিত হবে, তখন যুদ্ধের প্রতিটি আমীর এর জন্য একটি করে ব্যানার থাকবে – যার প্রচলন অতীতে ছিল। ব্যানারকে উচ্চে তুলে ধরার মধ্য দিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে নেতাদের শক্তিমত্তা প্রকাশিত হত। যুদ্ধের ঐতিহ্য অনুসারে এ বিষয়টিকে একটি প্রশাসনিক নির্দেশ হিসাবে পালন করা হত । 

আল্লাহ্’র রাসূল (সা) জা’ফর, যায়িদ ও ইবন রুওয়াহা’র মৃত্যুসংবাদ সেনাবাহিনী যুদ্ধক্ষেত্রে থেকে ফিরে আসার আগেই ঘোষণা করেছিলেন:

“যায়িদ ব্যানার (রাইয়া) তুলে নিল, এবং নিহত হল; এবং তারপর, জা’ফর তা তুলে নিল এবং সেও নিহত হল। এবং তারপর, ইবন রুওয়াহা তা নিল এবং সেও নিহত হল।”
(সহীহ বুখারী, হাদীস নং-৩৫৭৫)

এছাড়া, যুদ্ধের সময় যদি যুদ্ধক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে খলীফা থাকেন, তবে পতাকা (লিওয়া) ও ব্যানার (রাইয়া) দু’টোই বহন করা যেতে পারে। এ বিষয়ে সীরাত ইবনে হিশামে গাজওয়া বদর (বদরের যুদ্ধ) সম্পর্কে কিছু বর্ণনা আছে যে, সেখানে পতাকা ও ব্যানার দু’টোই ছিল।

আর, যুদ্ধ শেষে শান্তির সময় সাধারণতঃ ব্যানারগুলোকে সেনাবাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট, রেজিমেন্ট, ডিভিশন এবং ব্যাটেলিয়ানের মধ্যে বিতরণ করে দেয়া হয় এবং তারা এগুলো বহন করে, যা কিনা আল-হারিছ ইবন হাস্সান আল-বকরী বর্ণিত হাদীসে আমর ইবনুল ’আস এর বাহিনী সম্পর্কে বলা হয়েছে।

৩. ইসলামে খলীফা হলেন সেনাবাহিনীর প্রধান। এজন্য, আইনত পতাকা তার কার্যালয়ের উপরে উত্তোলিত থাকবে; অর্থাৎ, তার বাসভবনের উপরে। কারণ, এ পতাকা সেনাপ্রধানের সাথে বাঁধা থাকবে। এছাড়া, প্রশাসনিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে খলীফার বাসভবনের উপর ব্যানার উত্তোলন করাও অনুমোদিত; কারণ, খলীফা রাষ্ট্রের সকল প্রতিষ্ঠানেরও প্রধান। এছাড়া, রাষ্ট্রের অন্যান্য প্রতিষ্ঠান, বিভাগের ও স্থাপনার ক্ষেত্রে, শুধুমাত্র ব্যানার উত্তোলিত হবে। কারণ, পতাকা শুধুমাত্র সেনাপ্রধানের প্রতীক, যা তার অবস্থানকে নির্দেশ করে।

৪. পতাকা সাধারণতঃ সূচালো লাঠির শেষ মাথায় বাঁধা অবস্থায় থাকবে। সেনাবাহিনীর সংখ্যার উপর ভিত্তি করে এটি সেনাবাহিনীর আমীরকে দেয়া হবে। সুতরাং, এটা বাঁধা থাকবে প্রথম বাহিনী, দ্বিতীয় বাহিনী কিংবা, আলশামের বাহিনী, ইরাকের বাহিনী, আলিপ্পোর বাহিনী অথবা বৈরুতের বাহিনী, ইত্যাদি বাহিনীসমূহের প্রধানদের সাথে।

মূলতঃ বর্শার শেষ মাথায় পতাকা প্যাঁচানো অবস্থায় থাকবে এবং প্রয়োজন ব্যতীত এটি খোলা হবে না। উদাহরণ হিসাবে বলা যায় যে, খলীফা বাসভবনের উপর এটি উত্তোলিত থাকবে তার গুরুত্ব বা মর্যাদা বোঝানোর খাতিরে। একই কথা প্রযোজ্য হবে শান্তির সময় সেনাবাহিনীর অন্যান্য আমীরদের অবস্থানের ক্ষেত্রে, যেন উম্মাহ্ তাদের সেনাবাহিনীর শৌর্যবীর্য ও প্রভাবপ্রতিপত্তি অনুভব করতে পারে। কিন্তু, এ বিষয়টি যদি নিরাপত্তার জন্য সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়, যেমন: এর ফলে যদি শত্রট্টপক্ষ আমীরদের অবস্থান সম্পর্কে অবহিত হয়, তবে, মূল নিয়মে ফিরে যেতে হবে; অর্থাৎ, এটি পেঁচানো অবস্থায় থাকবে এবং প্রয়োজন ব্যতীত খোলা হবে না। 

ব্যানারের ক্ষেত্রে বলা যায় যে, এটি বাতাসে পত্পত্ করে উড়ার জন্য মুক্ত রাখা হবে, যেভাবে এখন পতাকা ব্যবহার করা হয়। এজন্য এটিকে রাষ্ট্রের বিভিন্ন বিভাগের উপরে উত্তোলন করা হবে।  সংক্ষেপে পুরো বিষয়টিকে এভাবে বলা যায়: 

প্রথমত: সেনাবাহিনীর ক্ষেত্রে:

১. প্রকৃত যুদ্ধের সময় পতাকা সেনাবাহিনীর আমীরের সাথে সংযুক্ত থাকবে। মূলনীতি অনুযায়ী, সাধারণতঃ এটি খোলা হবে না বরং বর্শার মাথায় প্যাঁচানো অবস্থায় থাকবে। নিরাপত্তা সম্পর্কিত ইস্যুগুলো বিবেচনায় রেখে এটিকে প্রসারিত করা যেতে পারে। যুদ্ধের ময়দানে যুদ্ধক্ষেত্রের আমীর একটি ব্যানার বহন করবে। যদি খলীফা রণক্ষেত্রে উপস্থিত থাকেন তাহলে ব্যানার এর সাথে পতাকাও বহন করা যাবে। 

২. শান্তির সময় সেনাবাহিনীর আমীরদের সাথে পতাকা প্যাঁচানো অবস্থায় থাকবে। তবে, তারা যেখানে অবস্থান করবেন সেখানে পতাকা উত্তোলন করা যাবে। সেনাবাহিনীর বিভিন্ন বিভাগ, রেজিমেন্ট, ব্যাটালিয়ন ইত্যাদি ব্যানার উত্তোলন করবে। প্রত্যেক বিভাগ, রেজিমেন্ট, ব্যাটালিয়নের জন্য আবার নির্দিষ্ট ব্যানার থাকতে পারে যেন তাদের প্রশাসনিকভাবে আলাদা করা যায় – যা মূল ব্যানারের সাথে উত্তোলন করা হবে।

দ্বিতীয়ত: রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিষয়ক প্রতিষ্ঠান, অন্যান্য বিভাগ (departments) ও স্থাপনাগুলোতে ব্যানার উত্তোলন করা হবে; কিন্তু, সেনাবাহিনী প্রধান হিসাবে শুধুমাত্র খলীফার বাসভবনে পতাকা উত্তোলন করা হবে। এছাড়া, প্রশাসনিক দৃষ্টিকোন থেকে খলীফার বাসভবনে ব্যানারও উত্তোলন করা হবে; কারণ, খলীফা রাষ্ট্রের সকল প্রতিষ্ঠানেরও প্রধান। সাধারণ জনগণ শুধুমাত্র তাদের বাসভবন, স্কুল-কলেজ কিংবা, অন্যান্য স্থাপনাসমূহে ব্যানার উত্তোলন করতে পারবে; বিশেষ করে উৎসবের দিনগুলোতে, যেমন: ঈদ, বিজয়ের উৎসব ইত্যাদি।  

মাজলিস আল উম্মাহ্

Leave a Reply