(উম্মাহ্’র কাউন্সিল, শূরা ও জবাবদিহিতা)
মাজলিস আল উম্মাহ্ বিভিন্ন ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়ে গঠিত এমন একটি কাউন্সিল বা পরামর্শ সভা, যা বৃহত্তর মুসলিম জনগোষ্ঠীর মতামতের প্রতিনিধিত্ব করবে এবং যাদের সাথে প্রয়োজন হলে খলীফা বিভিন্ন বিষয়ের ব্যাপারে পরামর্শ করবেন। আবার, অপরদিকে তারা শাসকদের জবাবদিহিতার সম্মুখীন করার ক্ষেত্রে উম্মাহ্’র প্রতিনিধিত্ব করবে। এ বিষয়টি রাসূলুল্লাহ্ (সা) এর কর্মকান্ডের আলোকে গ্রহণ করা হয়েছে। কারণ, তিনি (সা) আনসার ও মুহাজির’দের কিছু ব্যক্তিবর্গের সাথে পরামর্শ করতেন, যারা তাদের নিজ নিজ গোত্রের প্রতিনিধিত্ব করতেন। এছাড়া, তিনি (সা) পরামর্শদাতা হিসাবে কিছু সাহাবীকেও মনোনীত করেছিলেন, পরামর্শ কালে তিনি (সা) সাধারণতঃ অন্যদের চাইতে তাঁদের মতামতকে বেশী গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতেন; যেমন: আবু বকর (রা), উমর (রা), হামযাহ্ (রা), আলী (রা), সালমান আলফারসী (রা), হুজাইফা (রা) প্রমূখ ব্যক্তিবর্গ।
এছাড়া, এ বিষয়ে আরও দলিল পাওয়া যায় আবু বকরের জীবনী থেকে। প্রকৃত অর্থে, আবু বকর (রা) আনসার ও মুহাজির’দের মধ্য হতে কিছু ব্যক্তিকে মনোনীত করেছিলেন এবং যখন কোন ঘটনা ঘটত (যে বিষয়ে পরামর্শ করা প্রয়োজন) তখন তিনি উক্ত বিষয়ে তাদের মতামত চাইতেন। আবু বকরের সময়ে শূরা কাউন্সিলের সদস্যদের মধ্যে ছিলেন ওলামা ও ফাত্ওয়া প্রদানে সক্ষম ব্যক্তিবর্গ। ইবনে সা’দ, আল-কাসিম হতে বর্ণনা করেছেন যে, যখন কোন ঘটনা ঘটত এবং আবু বকর মতামত প্রদানে সক্ষম ব্যক্তি ও ফকীহ্গণের সাথে আলোচনা করতে চাইতেন, তখন তিনি আনসার ও মুহাজির’দের মধ্য হতে কিছু ব্যক্তিকে ডাকতেন। আবু বকরের সময় উমর (রা), উসমান (রা), আলী (রা), আবদুর রহমান বিন আউফ (রা), উবাই বিন কাব (রা), যায়িদ বিন ছাবিত (রা), মু’য়াজ বিন জাবাল (রা) প্রমুখ সাহাবীগণ তাঁদের মতামত প্রদান করতেন। লোকেরা তাদের ফাত্ওয়া বা রায়ও গ্রহণ করত। পরবর্তীতে, উমর (রা) যখন খলীফা হলেন তখন তিনিও এসব ব্যক্তিবর্গের পরামর্শ গ্রহণ করতেন। এছাড়া, মুসলিমদের পক্ষ থেকে শাসকদের জবাবদিহি করার বিষয়েও দলিল-প্রমাণ রয়েছে। খোলাফায়ে রাশেদীনদের (রা) সময় মুসলিমরা শাসকদের জবাবদিহিতার সম্মুখীন করতো। বস্তুতঃ যেহেতু শূরা বা কাউন্সিলের মাধ্যমে উম্মাহ্’র মতামতের প্রতিনিধিত্ব করা অনুমোদিত; একইভাবে, এ কাউন্সিলের মাধ্যমে উম্মাহ্’র পক্ষ থেকে শাসককে জবাবদিহিতার সম্মুখীন করাও অনুমোদিত। উপরোল্লিখিত সমস্ত কিছুই প্রমাণ করে যে, মতামত প্রদান ও শাসককে জবাবদিহিতার সম্মুখীন করার জন্য উম্মাহ্’র পক্ষ থেকে একটি বিশেষ পরামর্শ সভা বা কাউন্সিল গঠন করা শারী’আহ্ কর্তৃক অনুমোদিত, যা কিনা গঠিত হবে আল্লাহ্’র কিতাব ও রাসূল (সা)এর সুন্নাহ্’র আলোকে। এটিকে “উম্মাহ্’র কাউন্সিল” বলা হবে, কারণ এ কাউন্সিল বা পরামর্শ সভাটি উম্মাহ্’র থেকে মতামত প্রদান ও শাসককে জবাবদিহি করার জন্য গর্ঠিত হয়েছে।
রাষ্ট্রের অমুসলিম নাগরিকদেরও এ কাউন্সিলের সদস্য হবার অনুমোদন রয়েছে, যেন তারা তাদের উপর শাসকদের দ্বারা কোন অন্যায়-অবিচার সংঘটিত হলে; কিংবা, তাদের উপর শারী’আহ্ আইনের অপপ্রয়োগ হলে; কিংবা, সেবা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে কোনপ্রকার ঘাটতি হলে বা এ জাতীয় কোন সমস্যা হলে অভিযোগ দায়ের করতে পারে।
শূরার অধিকার
শূরা হল সমস্ত মুসলিমের অধিকার যা পূরণ করা খলীফার কর্তব্য। খলীফাকে পরামর্শ দেয়া তাদের অধিকার এবং খলীফার উচিত বিভিন্ন বিষয়ে তাদের মতামত ও পরামর্শ গ্রহণ করা। পবিত্র কুর’আনে আল্লাহ্ বলেন,
‘কাজে কর্মে তাদের পরামর্শ কর। অতঃপর যখন কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ফেল, তখন আল্লাহ্’র উপর ভরসা কর।’
[সূরা আল ইমরান: ১৫৯]
তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) আরও বলেন,
‘তারা পারষ্পরিক পরামর্শক্রমে কাজ করে।’
[সূরা আশ শূরা: ৩৮]
রাসূলুল্লাহ্ (সা) লোকদের কাছে মতামত চাইতেন এবং তাদের পরামর্শ শুনতেন। বদরের যুদ্ধের দিন তিনি যুদ্ধক্ষেত্রের অবস্থান নিয়ে সাহাবীদের (রা) সাথে পরামর্শ করেছিলেন, এবং ওহুদের যুদ্ধের সময় মদিনার ভেতরে না বাইরে যুদ্ধ করা উচিত এ বিষয়ে সাহাবীদের (রা) সাথে আলোচনা করেছিলেন। বদরের যুদ্ধের দিন তিনি (সা) যুদ্ধকৌশলের ব্যাপারে অভিজ্ঞ আল হাবাব ইবনুল মুনজির (রা) এর পরামর্শ গ্রহণ করেছিলেন। ওহুদের যুদ্ধের দিন তিনি (সা) সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত গ্রহণ করেছিলেন, যদিও এ ব্যাপারে তাঁর নিজস্ব মতামত ছিল ভিন্ন।
উমর ইবনুল খাত্তাব (রা) মুসলিমদের সাথে ইরাকের ভূমি বিষয়ে পরামর্শ করেছিলেন। যেহেতু এটি যুদ্ধলব্ধ সম্পদ ছিল, সেহেতু এগুলো কি মুসলিমদের মধ্যে বন্টন করে দেয়া হবে, নাকি মালিকানা রাষ্ট্রীয় কোষাগারের হাতে রেখে খারাজ প্রদানের শর্তে এ অঞ্চলের লোকদের হাতেই ভূমিগুলো ছেড়ে দেয়া হবে। তারপর তিনি তাঁর নিজের ইজতিহাদ অনুসারে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন এবং অধিকাংশ সাহাবী (রা) এ ব্যাপারে সমর্থন দিয়েছিলেন। অর্থাৎ, তিনি সে অঞ্চলের লোকদের হাতেই ভূমিগুলো ছেড়ে দেন এবং তাদের খারাজ প্রদানের নির্দেশ প্রদান করেন।
জবাবদিহিতার অধিকার
মুসলিমদের এ অধিকার রয়েছে যে, খলীফা তাদের পরামর্শ করবেন এবং সেইসাথে, তাদেরও অবশ্যই শাসকদের গৃহীত সিদ্ধান্ত ও কর্মকান্ড সম্পর্কে তাদের জবাবদিহিতার সম্মুখীন করতে হবে। আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা শাসকদের জবাবদিহিতার সম্মুখীন করাকে মুসলিমদের জন্য বাধ্যতামূলক করে দিয়েছেন; এবং তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) মুসলিমদের অকাট্য নির্দেশের মাধ্যমে আদেশ দিয়েছেন যেন মুসলিমরা শাসকদের জবাবদিহিতার সম্মুখীন করে এবং অপসারিত করে, যদি তারা জনগণের অধিকার ক্ষুন্ন করে, তাদের প্রতি দায়িত্বপালনে ব্যর্থতার পরিচয় দেয় কিংবা, জনগণের কোন বিষয় অবহেলা করে, বা, শারী’আহ্ আইন লঙ্ঘন করে, কিংবা, আল্লাহ্’র আইন ব্যতীত অন্য কোন আইন দিয়ে শাসনকার্য পরিচালনা করে। উম্মে সালামা (রা) থেকে মুসলিম বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেছেন,
“এমন কিছু আমীর আসবে যাদের কিছু কাজের ব্যাপারে তোমরা একমত পোষণ করবে এবং কিছু কাজ প্রত্যাখান করবে। সুতরাং, যারা তাদের ভাল কাজের ব্যাপারে ঐক্যমত পোষণ করবে তারা গুনাহ থেকে মুক্তি পেল; যে মন্দ কাজকে প্রত্যাখান করল সেও নিরাপদ হয়ে গেল। কিন্তু, তার কী হল যে (মন্দ কাজকে) গ্রহণ করল এবং তা প্রত্যাখান করল না? তারা জিজ্ঞেস করলেন, ‘এমতাবস্থায় আমাদের কী তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা উচিত নয়?’ উত্তরে তিনি (সা) বললেন, ‘না, যতক্ষণ পর্যন্ত তারা সালাত কায়েম রাখে।”এখানে সালাত বলতে শারী’আহ্ আইন অনুযায়ী শাসন করাকে বোঝানো হয়েছে।
আবু বকরের খিলাফতের সময় উমর (রা) ও তাঁর অনুসারী মুসলিমগণ মুরতাদদের বিরুদ্ধে আবু বকরের যুদ্ধের সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে অস্বীকার করেছিলেন (যখন প্রথম মুরতাদ সম্পর্কিত সমস্যা শুরু হয়েছিল)। আল বুখারী ও মুসলিম আবু হুরাইরা থেকে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি বলেছেন:
“যখন আল্লাহ্’র রাসূল (সা) ইন্তেকাল করলেন এবং আবু বকর খলীফা হলেন তখন আরবের কিছু গোত্র মুরতাদ (অর্থাৎ, ইসলাম ত্যাগ করল) হয়ে গেল। উমর বললেন, ‘আপনি কিভাবে লোকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবেন যখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেছেন,
“আমি (আল্লাহ্’র পক্ষ থেকে) আদিষ্ট হয়েছি যেন মানুষের সাথে আমি ততক্ষণ পর্যন্ত যুদ্ধ করতে থাকি যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা “আল্লাহ্ ছাড়া আর কোন ইলাহ্ নেই এবং মুহাম্মদ (সা) আল্লাহ্’র রাসূল” এ কথার স্বীকৃতি দেয় এবং নামাজ কায়েম করে ও যাকাত আদায় করে। অতএব, যদি তারা তা করে তবে তাদের জীবন ও সম্পদ আমার নিকট হতে নিরাপদ, তবে যেটা আল্লাহ্’র আইন (অর্থাৎ, শারী’আহ্ লঙ্ঘনে প্রাপ্য শাস্তি) তা ব্যতীত। আর, তাদের হিসাবনিকাশ তো আল্লাহ্’র কাছে।”
(সহীহ্ বুখারী, হাদীস নং-২৯৪৬)
উত্তরে আবু বকর বললেন, ‘আল্লাহ্’র কসম! আমি অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব যারা সালাত ও যাকাতের মধ্যে পার্থক্য করেছে। কারণ, যাকাত হল সম্পদের উপর (আল্লাহ্’র) অধিকার। আল্লাহ্’র কসম, তারা যদি কোন বাচ্চা ছাগীও যাকাত দিতে অস্বীকার করে, যা তারা রাসূলুল্লাহ্ (সা) কে দিত, এই অস্বীকৃতির কারণে আমি তাদের সাথে যুদ্ধ করব।’ তখন উমর (রা) বললেন, ‘আল্লাহ্’র কসম, তিনিই আল্লাহ্ যিনি দ্রুত আবু বকরের হৃদয়কে প্রশস্ত করে দিয়েছেন এবং আমি জানি তিনি সত্য বলেছেন।’
উমর (রা) এর সময় বিলাল ইবনে রাবাহ্ এবং আল-যুবায়ের সহ অন্যান্যরাও মুজাহিদদের মাঝে ইরাকের ভূমি বন্টন না করার সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছিলেন। একজন বেদুইনও উমরের রাষ্ট্রের জন্য কিছু জমি সংরক্ষিত করার সিদ্ধান্তকে প্রত্যাখান করেছিল। আবু উবাইদ তার আল-আমওয়াল গ্রন্থে আমীর আব্দুল্লাহ্ ইবন যুবায়ের হতে এবং ইবন যুবায়ের তাঁর পিতা হতে বর্ণনা করেছেন যে, ‘একজন বেদুইন উমরের কাছে আসল এবং বলল, ‘হে আমীরুল মু’মিনীন, অন্ধকার যুগে এগুলো আমাদের ভূমি ছিল যেগুলোর জন্য আমরা যুদ্ধ করেছিলাম। এখন আমরা ইসলাম গ্রহণ করেছি এবং এগুলো আমাদেরই থাকার কথা। তাহলে, আপনি কেন এ ভূমি সংরক্ষিত করতে চাইছেন?’ উমর একথা শোনার পর মাথা নাড়াতে লাগলেন এবং নিজের গোঁফে আঙুল চালাতে লাগলেন। যখন কোন বিষয় নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়তেন তখন তিনি এরকম করতেন। এমতাবস্থায় বেদুইন উমরকে আবারও প্রশ্ন করল। অতঃপর উমর বললেন, ‘সম্পদের মালিক হলেন আল্লাহ্ এবং লোকেরা তাঁর দাস মাত্র। আল্লাহ্’র কসম, আমি যদি ফি সাবিলিল্লাহর (জিহাদের) ব্যাপারে কোনরূপ চাপ অনুভব না করতাম তাহলে এই জমির এক ইঞ্চিও রাখতাম না।’ তারপর, উমর গণমালিকানাধীন সম্পদ হতে মুসলিমদের (জিহাদে ব্যবহৃত) ঘোড়ার জন্য কিছু ভূমি অধিগ্রহণ করেন। এছাড়া, (বিবাহের সময়) চারশত দিরহামের বেশী মোহরানা ধার্য না করার ব্যাপারে উমরের নিষেধাজ্ঞাকে এক মহিলা চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। উক্ত মহিলা উমরকে বলেছিলেন, ‘হে উমর, ‘আপনার এটা বলার কোন অধিকার নেই। আপনি কি আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার এ আয়াত শুনেননি যে, “তোমরা যদি তাদের একজনকে রাশি রাশি ধন প্রদান করে থাকো, তবে তার মধ্য হতে কিছুই ফিরিয়ে নিও না।” [সূরা নিসা : ২০]
তিনি প্রত্যুত্তরে বললেন, ‘এই মহিলা সঠিক আর উমর ভুল।’
এছাড়া, উসমানের (রা) সাথে, যখন তিনি আমীর-উল-মু’মিনীন ছিলেন, আলী (রা) হজ্জ্ব ও উমরাহ্ সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গীর বিষয়ে বিতর্কে লিপ্ত হয়েছিলেন। আহমাদ বিশুদ্ধ সনদ সহকারে আবদুল্লাহ্ ইবন যুবায়ের থেকে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি বলেছেন: “আমরা উসমানের সাথে আল-জুফাহ্’তে থাকাকালে আল-শাম থেকে আগত একদল লোক, যাদের মধ্যে হাবীব ইবন মাসলামা আল-ফাহ্রী ছিলেন। উসমানকে হজ্জ্বের সাথে (তামাত্তু) উমরাহ্’র বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বললেন: ‘হজ্জ্বের মাসে হজ্জ্ব ও উমরাহ একসাথে না করাই উত্তম। এটা ভাল হবে যে, তোমরা দ্বিতীয়বার আল্লাহ্’র ঘরে না আসা পর্যন্ত উমরাহ’কে বিলম্বিত করে নিও। কারণ, তিনি তাঁর এ ঘরকে সৎকাজের জন্য প্রশস্ত করেছেন।’ আলী এসময় এ উপত্যকায় উট চরাচ্ছিলেন। উসমানের উমরাহ্’র বিষয়ে দৃষ্টিভঙ্গী জানার পর তিনি তাঁর দিকে অগ্রসর হলেন যে পর্যন্ত না তাঁর সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন এবং বললেন: ‘তুমি কি রাসূলের সুন্নাহ্’কে পাল্টে দিতে চাও এবং আল্লাহ্ তাঁর কিতাবে তাঁর বান্দাদের যে বিষয়ে অনুমতি (রুখসাহ্) দিয়েছেন তা রহিত করতে চাও? তুমি এ ব্যাপারে নিষেধ করছো, অথচ যারা দূরবর্তী স্থান থেকে আসে সে সকল লোকের জন্য এটা অনুমোদিত।’ একথা শুনে উসমান লোকদের দিকে ফিরলেন এবং বললেন, ‘আমি কি তোমাদের এটা করতে নিষেধ করেছি? না, আমি তা করিনি। এটা শুধু আমার দৃষ্টিভঙ্গী এবং উপদেশ। যে কেউ চাইলে এটা গ্রহণ করতে পারে কিংবা, না চাইলে প্রত্যাখান করতে পারে।”
সুতরাং, উম্মাহ্’র কাউন্সিল বা পরামর্শ সভার পরামর্শ (শূরা) দেয়ার অধিকার রয়েছে এবং শাসকদের জবাবদিহি করা তাদের জন্য বাধ্যতামূলক।
শূরা এবং জবাবদিহিতার মধ্যকার পার্থক্য সুস্পষ্ট। শূরা হল একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে এ ব্যাপারে মতামত চাওয়া এবং শোনা; আর, জবাবদিহিতা হল সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নের সমালোচনা বা বিরোধিতা করা।
উম্মাহ্’র কাউন্সিলের সদস্য নির্বাচন
উম্মাহ্’র কাউন্সিলের সদস্যরা নির্বাচিত, নিয়োগ প্রাপ্ত নন। জনগণের মতামতকে জোরালোভাবে উপস্থাপনের জন্য তারা হলেন জনগণের প্রতিনিধি। প্রতিনিধি তাদের দ্বারাই নির্বাচিত হওয়া উচিত যাদের প্রতিনিধিত্ব তারা করবেন এবং কোন অবস্থাতেই এ প্রতিনিধিদের জনগণের উপর চাপিয়ে দেয়া যাবে না। তাছাড়া, যেহেতু ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর মতামত জোরালোভাবে উপস্থাপনের জন্য এবং তাদের পক্ষ থেকে শাসককে জবাবদিহি করার জন্য উম্মাহ্’র কাউন্সিল গঠন করা হয়, সেহেতু এ উদ্দেশ্য কখনও অর্জিত হবে না, যদি উক্ত ব্যক্তি বা গোষ্ঠী নিজেরা তাদের প্রতিনিধি নির্বাচিত না করে।
এছাড়া, আল্লাহ্’র রাসূল (সা) যাদের সাথে পরামর্শ করতেন তাদের তিনি ব্যক্তিত্ব, যোগ্যতা বা সক্ষমতার ভিত্তিতে নির্বাচিত করতেন না; বরং, তাদের নির্বাচন করার ক্ষেত্রে তিনি (সা) দুটি বিষয়কে প্রাধান্য দিতেন। প্রথমত: তারা তাদের গোত্র বা গোষ্ঠীর প্রধান ছিলেন, তাদের যোগ্যতা যাই হোক না কেন। আর, দ্বিতীয়ত: তারা আনসার আর মুহাজিরদের প্রতিনিধিত্ব করতেন। কারণ, শূরা গঠনের মূল উদ্দেশ্য হল জনগণের প্রতিনিধিত্ব করা। সুতরাং, যে নীতির ভিত্তিতে উম্মাহ্’র কাউন্সিলের সদস্যরা নির্বাচিত হবেন, তা হল: প্রথমত: জনগণের প্রতিনিধিত্ব করা – যা প্রতিফলিত হয়েছিল রাসূল (সা) কর্তৃক গোত্র প্রধানদের নির্বাচিত করার মাধ্যমে। আর, দ্বিতীয়ত: কোন দল বা গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করা – যা প্রতিফলিত হয়েছিল তিনি (সা) কর্তৃক আনসার ও মুহাজিরদের প্রতিনিধি বাছাই করার ক্ষেত্রে। বস্তুতঃ অগনিত মানুষ ও দলের ক্ষেত্রে নির্বাচন ব্যতীত এ প্রতিনিধি নির্বাচন করা সম্ভব নয়। আর, তাই উম্মাহ্ কাউন্সিলের সদস্যদের অবশ্যই নির্বাচিত হতে হবে।
তবে এটা সত্য যে, আল্লাহ্’র রাসূল (সা) যাদের সাথে পরামর্শ করতেন তাদের তিনি (সা) নিজেই মনোনীত করেছিলেন। এর কারণ হল, মদিনা ছিল একটি ছোট অঞ্চল এবং এখানে সকল মুসলিমই তাঁর পরিচিত ছিল। বিপরীতভাবে, আমরা দেখতে পাই যে, আক্বাবার দ্বিতীয় শপথের সময় যে মুসলিমরা তাঁকে বাই’আত দিয়েছিলেন তারা তাঁর পরিচিত ছিল না বিধায় তিনি নেতা নির্বাচনের বিষয়টি তাদের উপর ন্যস্ত করেছিলেন এবং বলেছিলেন:
“তোমরা তোমাদের মধ্য হতে বারো জন নেতা নির্বাচিত করো যারা তাদের লোকেদের উপর দায়িত্বশীল।”
এ ঘটনাটি কা’ব ইবন মালিকের সূত্রে সীরাত ইবন হিশামে বর্ণিত আছে।
উপরোক্ত ঘটনাবলী থেকে আমরা এ সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারি যে, যেহেতু উম্মাহ্ বা শূরা কাউন্সিলের সদস্যগণ বৃহত্তর মুসলিম জনগোষ্ঠীর মতামতের প্রতিনিধিত্ব করে, এবং যেহেতু এ কাউন্সিল গঠনের মূল উদ্দেশ্য বিভিন্ন ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর মতামতকে জোরালোভাবে উপস্থাপন করা এবং সেইসাথে, তাদের পক্ষ থেকে শাসকদের জবাবদিহিতার সম্মুখীন করা; এবং যেহেতু এ উদ্দেশ্য অর্জন করা কখনো সম্ভব নয় যদি না প্রতিনিধিবৃন্দ জনগণের মধ্য হতে জনগণের দ্বারা নির্বাচিত হয়; সুতরাং, এটা প্রমাণিত যে, উম্মাহ্ বা শূরা কাউন্সিলের সদস্যদের অবশ্যই নির্বাচিত হতে হবে, তারা রাষ্ট্র কর্তৃক নিযুক্ত হবে না।
উম্মাহ্’র কাউন্সিল নির্বাচিত করার পদ্ধতি
১. গভর্ণর (ওয়ালী) সংক্রান্ত আলোচনায় আমরা পূর্বেই বলেছি যে, আমরা দু’টি কারণে উলাই’য়াহ্ কাউন্সিল (যা জনগণের প্রতিনিধিত্ব করবে) নির্বাচনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছি। প্রথমত: উলাই’য়াহর জনগণের প্রয়োজন ও অবস্থা সম্পর্কে ওয়ালীকে প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ করা। এর কারণ হল, ওয়ালীকে তার দায়িত্ব পালনে এমনভাবে সহায়তা করা যাতে উলাই’য়াহর জনগণের স্বস্তিপূর্ণ ও নিরাপদ জীবন সুনিশ্চিত করা সম্ভব হয় এবং সেইসাথে, তাদের প্রয়োজন পূরণ ও সেবার বিভিন্ন অনুসঙ্গ সরবরাহ করা যায়। দ্বিতীয়ত: উলাই’য়াহর শাসনকার্য পরিচালনার ব্যাপারে জনগণের সন্তুষ্টি ও অভিযোগ সম্পর্কে অবহিত হওয়া। কারণ, উলাই’য়াহ্ কাউন্সিলের অধিকাংশের অভিযোগ ওয়ালীর অপসারণকে অনিবার্য করে তুলে। সুতরাং, উলাই’য়াহ্ কাউন্সিলের বাস্তবতা প্রশাসনিক – যা উলাই’য়াহর জনগণের অবস্থা সম্পর্কে এবং ওয়ালীর কাজের ব্যাপারে সন্তুষ্টি ও অভিযোগ অবহিতকরণের মাধ্যমে ওয়ালীকে তার দায়িত্ব পালনে সহায়তা করে। এ সমস্ত কিছুই ওয়ালীকে প্রতিনিয়ত তার কাজ উন্নত করতে উদ্ধুদ্ধ করে। এছাড়া, উম্মাহ্’র কাউন্সিল এর মত এই কাউন্সিলের কিছু আবশ্যিক বা নির্বাহী
ক্ষমতা (mandatory power) রয়েছে যে সম্পর্কে (উম্মাহ্’র কাউন্সিল এর আবশ্যিক বা নির্বাহী ক্ষমতা সম্পর্কে) কিছু পরে আলোচিত হবে।
২. আমরা সমগ্র উম্মাহ্’র জন্য একটি কেন্দ্রীয় উম্মাহ্ কাউন্সিল (শূরা ও জবাবদিহিতার জন্য) গঠন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছি, যা অবশ্যই উম্মাহ্’র দ্বারা নির্বাচিত হবে এবং উম্মাহ্’কে প্রতিনিধিত্ব করবে। এর আবশ্যিক ক্ষমতাগুলো পরবর্তীতে আলোচিত হবে।
৩. এর অর্থ হল উলাই’য়াহ্ কাউন্সিল এর সদস্য নির্বাচনের জন্য একটি নির্বাচন হবে এবং উম্মাহ্’র কাউন্সিল এর সদস্যদের জন্য আরেকটি নির্বাচন হবে।
৪. নির্বাচনী প্রক্রিয়া সহজতর করার লক্ষ্যে ও জনগণকে পুনঃনির্বাচনের বিড়ম্বনা থেকে মুক্তি দেয়ার জন্য আমরা প্রথমে উলাই’য়াহ্ কাউন্সিল এর নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি; তারপর, যারা এ নির্বাচনে জয়লাভ করবে তারা নিজেদের মধ্য হতে উম্মাহ্’র কাউন্সিল এর সদস্য নির্বাচিত করবে। এর অর্থ হল, উলাই’য়াহ্ কাউন্সিল এর সদস্যগণ উম্মাহ্ কর্তৃক সরাসরি নির্বাচিত হবেন; আর, উম্মাহ্’র কাউন্সিল উলাই’য়াহ্ কাউন্সিল এর দ্বারা নির্বাচিত হবে। অর্থাৎ, উলাই’য়াহ্ কাউন্সিল এর শুরু ও শেষের মেয়াদকাল উম্মাহ্’র কাউন্সিল এর শুরু ও শেষের মেয়াদকাল একই হবে।
৫. উলাই’য়াহ্ কাউন্সিল থেকে যিনি উম্মাহ্’র কাউন্সিল এর সদস্য হিসাবে নির্বাচিত হবেন, তার শূণ্য আসনটি
উলাই’য়াহ্ কাউন্সিল নির্বাচনে পরাজিত ব্যক্তিদের মধ্য হতে যিনি সর্বোচ্চ ভোটপ্রাপ্ত হয়েছিলেন, তার দ্বারা পূরণ করা হবে। যদি এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হয় যে দু’জন ব্যক্তি সমান ভোট পেয়েছিলেন, সেক্ষেত্রে লটারির মাধ্যমে বিষয়টি নিষ্পন্ন করা হবে।
৬. অমুসলিমগণ (আহলুল দিম্মা) উলাই’য়াহ্ কাউন্সিলে তাদের নিজস্ব প্রতিনিধি নির্বাচন করবে এবং তারাই আবার উম্মাহ্’র কাউন্সিলে তাদের নিজস্ব সদস্য নির্বাচন করবেন। এ সমস্ত কিছুই উলাই’য়াহ্ কাউন্সিল নির্বাচন ও উম্মাহ্’র কাউন্সিল নির্বাচনের সময়ে সংঘটিত হবে।
এ পরিপ্রেক্ষিতে, আমরা একটি আইন প্রস্তুত করেছি, যা উপরে বর্ণিত বিষয়সমূহকে বিবেচনা করবে এবং উলাই’য়াহ্ কাউন্সিল ও উম্মাহ্’র কাউন্সিল নির্বাচন সংক্রান্ত প্রস্তুতি ও সাবধানতা সমূহকে বিশদ ভাবে ব্যাখ্যা করবে। এই আইনটি যথাসময়ে আলোচিত ও গৃহীত হবে, ইনশাআল্লাহ্ ।
উম্মাহ্ কাউন্সিলের সদস্যপদ
যে কোন ব্যক্তি, যে রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব বহন করে, যদি সে পরিণত ও সুস্থ মস্তিকের অধিকারী হয়, তবে তার উম্মাহ্’র কাউন্সিল এর সদস্য নির্বাচিত হবার এবং কাউন্সিল এর সদস্য নির্বাচন করার অধিকার রয়েছে; সে ব্যক্তি নারী বা পুরুষ যে’ই হোক না কেন। এর কারণ হল, উম্মাহ্’র কাউন্সিল এর শাসন করার কোন এখতিয়ার নেই। এজন্য এটি রাসূল (সা) এর সেই প্রসিদ্ধ হাদীস যা নারীদের শাসক পদে নিযুক্ত করার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, তা এক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না। এটা বরং শূরা (পরামর্শ) ও জবাবদিহিতার সাথে সম্পর্কিত, যা কিনা নারী এবং পুরুষ উভয়েরই অধিকার। আল্লাহ্’র রাসূল (সা) এর নবুয়্যতের তেরতম বছরে, অর্থাৎ যে বছরে তিনি হিজরত করেছিলেন, সে বছর মদিনা থেকে ৭৫ জন মুসলিম মক্কায় আগমন করেছিলেন, যাদের মধ্যে দুই জন ছিলেন নারী; এবং তারা সকলেই তাঁকে বাই’আত দিয়েছিলেন, যা আক্বাবার দ্বিতীয় শপথ নামে পরিচিত। প্রকৃতপক্ষে এ বাই’আত ছিল যুদ্ধের বাই’আত, ছিল স্বশস্ত্র সংগ্রাম ও রাজনৈতিক বাই’আত। তারা সকলে বাই’আত দেবার পর রাসূল (সা) বললেন:
“তোমরা তোমাদের মধ্য হতে বারো জন নেতা (নাকীব) নির্বাচিত করো যারা তাদের লোকেদের উপর দায়িত্বশীল।”এটি কা’ব ইবন মালিকে সূত্রে আহমাদ বর্ণিত একটি দীর্ঘ হাদীসের অংশ; এবং এটা তাঁর পক্ষ থেকে উপস্থিত সকলের মধ্য হতে বারোজন নির্বাচিত করার নির্দেশ।
এখানে তিনি (সা) পুরুষদের কথা বিশেষভাবে বলেননি, আবার নারীদেরকেও বাদ দেননি কিংবা, কাদের নির্বাচিত করা হবে বা কারা নির্বাচিত করবে, সে বিষয়েও কিছু বলেননি। সুতরাং, এক্ষেত্রে শারী’আহ্’র মুতলাক্ব (অনির্ধারিত) এর নিয়ম অনুসরণ করা হবে, যে পর্যন্ত এমন কোন দলিল পাওয়া যায় যা এ বিষয়ে কোন সীমাবদ্ধতা আরোপ করেছে। এছাড়া, একইসাথে এক্ষেত্রে ’আম (সাধারণ) নির্দেশের আওতায় এ নির্দেশটিকে ধরা হবে, যতক্ষণ পর্যন্ত না কোন দলিলের মাধ্যমে এটি নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়। উপরোক্ত হাদীসের ক্ষেত্রে রাসূল (সা) এর নির্দেশটি ছিল মুতলাক্ব (অনির্ধারিত) এবং আ’ম (সাধারণ) এবং এ ব্যাপারে এমন কোন দলিল নেই যা, নির্দিষ্টকরণ বা কোনপ্রকার সীমাবদ্ধতা আরোপ করাকে নির্দেশ করে। সুতরাং, এর মাধ্যমে এটাই প্রমাণিত হয় যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) এখানে উক্ত দু’জন নারীকেও তাদের নাকীব নির্বাচন করার এবং তাদের পক্ষ থেকে নাকীব হিসাবে নির্বাচিত হবার অধিকার প্রদান করেছেন।
একবার রাসূলুল্লাহ্ (সা) বাই’আত গ্রহণ করছিলেন, যখন তাঁর সাথে আবু বকর (রা) ও উমর (রা) ও ছিলেন। এসময় তিনি (সা) নারী-পুরুষ উভয়েরই বাই’আত গ্রহণ করেছিলেন। এই বাই’আত ইসলামের জন্য ছিল না, বরং শাসনের জন্য ছিল; আর ঐসব নারীগণ তখন মুসলিমই ছিল। হুদাইবিয়ার প্রান্তরে রিদওয়ানের বাই’আতের পর নারীগণও তাঁকে বাই’আত দিয়েছিল। আল্লাহ্ বলেন,
‘হে নবী, ঈমানদার নারীরা যখন আপনার কাছে এসে আনুগত্যের শপথ করে যে, তারা আল্লাহ্’র সাথে কাউকে শরীক করবে না, চুরি করবে না, ব্যভিচার করবে না, তাদের সন্তানদেরকে হত্যা করবে না, জারজ সন্তানকে স্বামীর ঔরস থেকে আপন গর্ভজাত সন্তান বলে মিথ্যা দাবি করবে না এবং ভাল কাজে আপনার অবাধ্যতা করবে না, তখন তাদের আনুগত্য গ্রহণ করুন এবং তাদের জন্যে আল্লাহ্’র কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করুন। নিশ্চয় আল্লাহ্ ক্ষমাশীল অত্যন্ত দয়ালু।’
[সূরা মুমতাহিনা: ১২]
এই আয়াতে বর্ণিত বাই’আতও শাসনের বাই’আত। পবিত্র কুর’আনের বর্ণনা অনুযায়ী নারীরা এখানে ঈমানদার এবং তাদের প্রদত্ত বাই’আত এই বিষয়ে যে, তারা সৎ কাজে আল্লাহ্’র রাসূলকে অমান্য করবে না।
এছাড়া, নারীদের রয়েছে প্রতিনিধিত্ব করার ও মতামত উপস্থাপনের ক্ষেত্রে প্রতিনিধি হিসাবে নির্বাচিত হবার অধিকার। এর কারণ হল, তার নিজস্ব মত উপস্থাপন বা প্রকাশের অধিকার রয়েছে; সুতরাং, তার প্রতিনিধি নির্বাচন করার অধিকারও রয়েছে। উপরন্তু, যেহেতু এ ধরনের প্রতিনিধিত্বের জন্য পুরুষ হওয়া আবশ্যিক নয়, তাই যারা তাকে নির্বাচিত করবে তাদের প্রতিনিধিত্ব করার অধিকারও তার রয়েছে।
এছাড়া, এটাও প্রমাণিত যে, আমাদের নেতা উমর (রা) যখন কোন সমস্যায় পড়তেন – হোক সেটা হুকুম শারী’আহ্ সংক্রান্ত বা, শাসনকার্য সংক্রান্ত বা, রাষ্ট্রীয় কোন কাজ সংক্রান্ত, তখন তিনি এসব ব্যাপারে মতামতের জন্য মুসলিমদের দ্বারস্থ হতেন। কোন সমস্যার মুখোমুখি হলে তিনি সাধারণতঃ মদিনার মুসলিমদের মসজিদে সমবেত হতে বলতেন, এবং নারী ও পুরুষ সকলকেই তিনি আহ্বান করতেন এবং তাদের সকলেন কাছে মতামত চাইতেন। মোহরানার সীমাবদ্ধতা আরোপের ব্যাপারে যখন একজন নারী তার সিদ্ধান্তের বিরোধীতা করেছিল, তখন উমর তার নিজস্ব সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছিলেন।
অমুসলিমদেরও মুসলিমদের মত উম্মাহ্’র কাউন্সিলে প্রতিনিধিত্ব করার এবং তাদের নিজস্ব প্রতিনিধি নির্বাচন করার অধিকার রয়েছে; যেন তারা এর মাধ্যমে তাদের পক্ষ থেকে, তাদের উপর শারী’আহ্ আইনের অপপ্রয়োগ এবং তাদের উপর পতিত শাসকের জুলুম-নির্যাতন সংক্রান্ত বিষয়গুলো তুলে ধরতে পারে।
তবে, শারী’আহ্ আইনের সাথে সংশ্লিষ্ট কোন বিষয়ে অমুসলিমগণ তাদের মতামত উপস্থাপন করতে পারবে না, কেননা শারী’আহ্ আইন ইসলামী আক্বীদাহ্ থেকে উৎসারিত। বস্তুতঃ আহ্কাম শারী’আহ্ হচ্ছে বাস্তবে প্রয়োগের লক্ষ্যে বিশদ দলিল-প্রমাণের ভিত্তিতে গৃহীত একগুচ্ছ শারী’আহ্ আইনের সমষ্টি, যা মানুষের জীবনের সাথে জড়িত সকল সমস্যাকে ইসলামী আক্বীদাহ্ নির্দেশিত একটি বিশেষ দৃষ্টিকোন থেকে বিচার করে। আর, অমুসলিমরা জীবন সম্পর্কে এমন এক বিশ্বাসকে আঁকড়ে ধরে যা সম্পূর্ণ ভাবে ইসলামী আক্বীদাহ্ বর্হিভূত ও এর সাথে সাংঘর্ষিক; সেইসাথে, জীবন সম্পর্কে তাদের দৃষ্টিভঙ্গীও ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গীর সাথে সংঘর্ষপূর্ণ। তাই, শারী’আহ্ আইনসংক্রান্ত বিষয়ে তাদের মতামত বিবেচনা করা হয় না।
এছাড়া, অমুসলিমদের খলীফা নির্বাচন করারও কোন অধিকার নেই; না তাদের খলীফা নির্বাচিত হতে ইচ্ছুক প্রার্থীদের তালিকা সংক্ষেপণে অংশগ্রহণ করার অধিকার রয়েছে; কারণ, শাসনকার্য সম্পর্কিত কোন বিষয়ে তাদের অধিকার নেই। এছাড়া অন্যান্য বিষয়ে, যা উম্মাহ্’র কাউন্সিল এর আবশ্যিক ক্ষমতার সাথে সম্পর্কিত, এ সকল বিষয়ে মুসলিমদের মতোই তার মতামত জোরালোভাবে উপস্থাপনের অধিকার রয়েছে।
উম্মাহ্’র কাউন্সিলের সদস্যপদের মেয়াদকাল
উম্মাহ্’র কাউন্সিলের সদস্যপদের মেয়াদকাল সীমাবদ্ধ। কারণ, আবু বকরের (রা) তাদের সাথে পরামর্শ করার ব্যাপারে কোন বাধ্যবাধকতা ছিল না যাদের সাথে রাসূলুল্লাহ্ (সা) পরামর্শ করতেন। আবার, উমর ইবনুল খাত্তাবের (রা) উপরও আবু বকর (রা) তাঁর শাসনামলের শেষদিকে যাদের সাথে পরামর্শ করতেন, তাদের সাথে পরামর্শ করার ব্যাপারে কোনপ্রকার বাধ্যবাধকতা ছিল না। উমর (রা) তাঁর শাসনামলের প্রথম বছরগুলোতে যাদের সাথে পরামর্শ গ্রহণ করেছিলেন, পরের বছরগুলোতে তিনি পরামর্শের জন্য অন্যান্যদের পছন্দ করেছেন। এ ঘটনাসমূহ থেকে বোঝা যায় যে, উম্মাহ্’র কাউন্সিল এর সদস্যপদ একটি নির্দিষ্ট মেয়াদকালের জন্য। আমরা এই মেয়াদকাল পাঁচ বছর করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছি।
উম্মাহ্’র কাউন্সিলের আবশ্যিক ক্ষমতাসমূহ
উম্মাহ্’র কাউন্সিলের আবশ্যিক ক্ষমতাসমূহ নিম্নরূপ এবং এগুলো হল:
১. ক) খলীফাকে অবশ্যই কাউন্সিলের সাথে পরামর্শ করতে হবে এবং কাউন্সিলের অধিকার রয়েছে খলীফাকে এমন সব বাস্তব বিষয় ও কর্মকান্ডের ব্যাপারে পরামর্শ দেয়ার, যেগুলো আভ্যন্তরীণ নীতি বাস্তবায়নের সাথে জড়িত এবং যে সমস্ত বিষয়ে গভীর চিন্তাভাবনা ও পর্যালোচনার কোন প্রয়োজন হয় না। যেমন: শাসন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি, বাণিজ্য, শিল্প, কৃষি ইত্যাদি। বস্তুতঃ এ সমস্ত ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সেবা নিশ্চিত করা জনগণের জীবনকে করে আনন্দময় ও প্রশান্তিমন্ডিত। এ বিষয়গুলো ছাড়াও রয়েছে নগরসমূহের প্রতিরক্ষা শক্তিশালী করা, জনগণের জীবনে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং শত্রু হুমকী বিদূরিত করা ইত্যাদি। এ সমস্ত বিষয়ে কাউন্সিলের মতামত গ্রহণ করা খলীফার জন্য বাধ্যতামূলক; অর্থাৎ, এক্ষেত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত কার্যকরী করা হবে।
খ) এছাড়া, বুদ্ধিবৃত্তিক বিষয় যেগুলোতে গভীর চিন্তা ও বিশ্লেষণের অবকাশ রয়েছে, যেমন: তথ্য প্রকাশ, যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নেয়া, কিংবা, যে সমস্ত বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা লব্ধ জ্ঞান ও প্রয়োজনীয় তথ্যের দরকার হয়, যেমন: সামরিক পরিকল্পনা এবং সকল ধরনের প্রযুক্তি বা শিল্পসংক্রান্ত বিষয় – এ সকল ক্ষেত্রে অবশ্যই সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের মতামত গ্রহণ করা হবে, সংখ্যাগরিষ্ঠের নয়। একই কথা প্রযোজ্য হবে, অর্থনীতি, সেনাবাহিনী ও পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে। এ সমস্ত বিষয়ে শারী’আহ্ আইনের আলোকে খলীফার নিজস্ব মত ও ইজতিহাদ অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেবার অধিকার আছে, এ সমস্ত বিষয় উম্মাহ্’র কাউন্সিলের আবশ্যিক ক্ষমতার মধ্যে অন্তর্ভূক্ত হবে না। তবে, খলীফার অধিকার রয়েছে এ বিষয়সমূহ কাউন্সিলের মাধ্যমে জনগণের সামনে উপস্থাপন করা এবং তাদের মতামত সম্পর্কে অবহিত হওয়া। কিন্তু, এ সকল বিষয়ে তাদের মতামত গ্রহণ করতে খলীফা বাধ্য নন।
২. আইন গ্রহণ সংক্রান্ত বিষয়ে কাউন্সিলের পরামর্শ বা মতামত জানতে চাওয়া হবে না। বরং, আইন প্রণয়ণ করা হবে শুধুমাত্র আল্লাহ্’র কিতাব, রাসূলের সুন্নাহ্, সাহাবীদের ইজমা’ এবং সঠিক ইজতিহাদের মাধ্যমে কৃত ক্বিয়াসের ভিত্তিতে। এভাবেই বিভিন্ন বিষয়ে শারী’আহ্ আইন গ্রহণ ও কার্যকর করা হবে। তবে, খলীফা চাইলে তিনি যে আইন ও বিধিবিধান গ্রহণ করতে চান তা কাউন্সিলের সামনে উপস্থাপন করতে পারেন। কাউন্সিলের মুসলিম সদস্যগণ এ বিষয়ে তাদের মতামত প্রদান ও বিতর্ক করতে পারেন। তবে, রাষ্ট্র কর্তৃক শারী’আহ্ আইন গ্রহণ করার যে শারী’আহ্ মূলনীতি (উসুল) গৃহীত হয়েছে, কোন বিষয়ে খলীফার উপস্থাপিত দলিল-প্রমাণ যদি এ মূলনীতির সাথে সাংঘর্ষিক বা মূলনীতি বহির্ভূত হয়, তবে কাউন্সিলের (মুসলিম) সদস্যরা এ আইনের বিরোধীতা করতে পারবেন। সেক্ষেত্রে, এ বিষয়টি মাহকামাতুল মাযালিম এর কাছে ন্যস্ত করা হবে এবং এ বিষয়ে তার প্রদত্ত সিদ্ধান্তকেই বাস্তবায়ন করা হবে।
৩. উম্মাহ্’র কাউন্সিল রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে কার্যকরীভাবে সংঘটিত যে কোন বিষয়ের ব্যাপারে খলীফাকে জবাবদিহিতার সম্মুখীন করার অধিকার সংরক্ষণ করে; তা আভ্যন্তরীণ বিষয়, বৈদেশিক বিষয়, অর্থনৈতিক বিষয় বা সামরিক বিষয় যে কোন ধরনের বিষয় সম্পর্কেই হোক। যে সকল ক্ষেত্রে কাউন্সিলের অধিকাংশ সদস্যদের মতামত গ্রহণ করা খলীফার জন্য বাধ্যতামূলক, সে সকল ক্ষেত্রে তাকে তাদের মতামত গ্রহণ করতে হবে। আর, যে সকল বিষয়ে অধিকাংশের মতামত গ্রহণ করার উপর কোন বাধ্যবাধকতা নেই, সেক্ষেত্রে তাদের রায় মেনে নেয়া আবশ্যিক হবে না।
যদি উম্মাহ্’র কাউন্সিল ও খলীফার সাথে এমন কোন বিষয়ে মতবিরোধের সৃষ্টি হয়, যা ইতোমধ্যে কার্যকরী হয়ে গেছে, তবে সেক্ষেত্রে এ বিষয়টি সমাধানের জন্য মাযালিম আদালতে উপস্থাপন করতে হবে এবং এ আদালতে প্রদত্ত রায়ই বাস্তবায়ন করতে হবে।
৪. উম্মাহ্’র কাউন্সিল খলীফার সহকারী, ওয়ালী ও আমীলদের ব্যাপারে অসন্তুষ্টি প্রকাশের অধিকার সংরক্ষণ করে। এসব ক্ষেত্রে তাদের মতামত গ্রহণ করা খলীফার জন্য বাধ্যতামূলক এবং কাউন্সিলের মতামতের ভিত্তিতে
খলীফাকে তাদের তৎক্ষণাৎ পদচ্যূত করতে হবে। যদি ওয়ালী বা আমীলদের উপর সন্তুষ্টি বা অসন্তুষ্টি বিষয়ে
উম্মাহ্’র কাউন্সিলের সাথে সংশ্লিষ্ট উলাই’য়াহ্ কাউন্সিলের মতপার্থক্য দেখা দেয়, তবে এক্ষেত্রে উলাই’য়াহ্ কাউন্সিলের মতামতকে প্রাধান্য দেয়া হবে।
৫. খলীফা হিসাবে নিযুক্ত হবার সকল শর্তপূরণের মাধ্যমে যারা এ পদে প্রতিদ্ব›িদ্বতা করার জন্য মাহকামাতুল মাযালিম কর্তৃক ছাড়পত্র পেয়েছেন, উম্মাহ্’র কাউন্সিলের মুসলিম সদস্যগণ তাদের তালিকা সংক্ষিপ্ত করতে পারেন; হতে পারে এই সংখ্যা দুই বা ছয়, যা কিনা ইতোমধ্যে খলীফা নির্বাচন অধ্যায়ে আলোচিত হয়েছে। এক্ষেত্রে তাদের মতামত গ্রহণ করা বাধ্যতামূলক এবং তাদের সংক্ষিপ্তকৃত তালিকার বাইরে কোন প্রার্থীকে বিবেচনা করা হবে না।
বস্তুতঃ এগুলোই হল উম্মাহ্’র কাউন্সিলের আবশ্যিক ক্ষমতাসমূহ। এগুলোর দলিল-প্রমাণ সম্পর্কিত আলোচনা নিম্নরূপ:
প্রথম অনুচ্ছেদ, ক. বাস্তবতা ভিত্তিক বিষয় ও কর্মকান্ডসমূহে, যেগুলোর ব্যাপারে কোন গভীর চিন্তাভাবনা বা পর্যালোচনার প্রয়োজন নেই, এ সকল ক্ষেত্রে উম্মাহ্’র কাউন্সিলের মতামত গ্রহণ করা যে খলীফার জন্য বাধ্যতামূলক তার দলিল হিসাবে বলা যায় যে, আল্লাহ্’র রাসূল (সা) ওহুদের যুদ্ধের সময় মদিনার বাইরে মুশরিক শত্রুপক্ষের মুকাবিলার ব্যাপারে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত গ্রহণ করেছিলেন, যদিও এ বিষয়ে তাঁর ও তাঁর সাহাবীদের মতামত ছিল মদিনার বাইরে না গিয়ে ভেতরে থেকেই যুদ্ধ পরিচালনা করা।
এ নীতিটি আরও গ্রহণযোগ্য হয়েছে আবু বকর (রা) ও উমর (রা) এর প্রতি রাসূল (সা) এর উক্তি থেকে: “যদি তোমরা দু’জনে কোন বিষয়ে পরামর্শের মাধ্যমে একমত হও তবে আমি তোমাদের সাথে দ্বিমত পোষণ করবো না।”
সুতরাং, মতামতের সাথে জড়িত বাস্তবভিত্তিক যে সমস্ত বিষয়, যেমন: নাগরিকের জীবনযাত্রার মান নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সেবাপ্রদান করা, তাদের নিরাপত্তা বিধান করা, নগরের প্রতিরক্ষা শক্তিশালী করা, জনগণের জন্য হুমকীস্বরূপ বিষয়গুলোকে দূরীভূত করা ইত্যাদি বিষয়ে খলীফাকে বাধ্যতামূলক ভাবে উম্মাহ্ কাউন্সিলের সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত গ্রহণ করতে হবে, যদিও এ ব্যাপারে খলীফার মতামত ভিন্ন হয়ে থাকে। এর কারণ, আল্লাহ্’র রাসূল (সা) ওহুদের যুদ্ধে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতকে মেনে নিয়েই মদিনার বাইরে শত্রুপক্ষের মুকাবিলা করেছিলেন।
প্রথম অনুচ্ছেদ, খ. নীতিগতভাবে, খলীফা এ অনুচ্ছেদে আলোচিত বিষয়সমূহের ব্যাপারে বিজ্ঞ পন্ডিত ব্যক্তিবর্গ, বিশেষজ্ঞ এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ে দক্ষ ব্যক্তিদের পরামর্শ গ্রহণ করবেন। এ বিষয়ের দলিল হল, আল্লাহ্’র রাসূল (সা) বদরের যুদ্ধের স্থান নির্ধারণের ক্ষেত্রে আল-হাবাব বিন আল-মুনদির (রা) এর পরামর্শ গ্রহণ করেছিলেন। সীরাত ইবন হিশামে বর্ণিত আছে যে,
“যখন আল্লাহ্’র রাসূল (সা) বদরের কুপের কাছাকাছি তাঁবু স্থাপন করলেন, তখন তাঁর স্থান নির্বাচনের বিষয়ে আল-হাবাব বিন আল-মুনদির সন্তুষ্ট হতে পারলেন না। তিনি রাসূল (সা) কে জিজ্ঞেস করলেন: ‘হে আল্লাহ্’র রাসূল! আল্লাহ্ কি আপনাকে এ স্থানে তাঁবু স্থাপনের নির্দেশ দিয়েছেন যে আমরা এ স্থান ত্যাগ করতে পারবো না? নাকি, এটা যুদ্ধ ও কৌশলের ব্যাপারে আপনার নিজস্ব মতামত? তিনি (সা) বললেন: ‘এটা যুদ্ধ ও কৌশলের ব্যাপারে শুধুই একটা মতামত।’ তখন আল-হাবাব বিন আল-মুনদির বললেন: ‘হে আল্লাহ্’র রাসূল! যুদ্ধ করার জন্য এটা সঠিক স্থান নয়। এখান থেকে লোকদের সরিয়ে নিন যে পর্যন্ত না আমরা শত্রুপক্ষের কাছাকাছি অবস্থিত কুপের নিকট পৌঁছাই এবং আমরা সেখানে অবস্থান গ্রহণ করবো; তারপর আমরা কুপের পানি অন্যত্র সরিয়ে নেব, তার উপর আমরা একটি বেসিন (পাত্র সদৃশ) তৈরী করবো; তারপর উক্ত বেসিনটি পানি দিয়ে পূর্ণ করবো। তারপর, আমরা আমাদের শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবো, যাতে আমরা পানি পান করি, কিন্তু, পান করার জন্য তারা কোন পানি না পায়।’ আল্লাহ্’র রাসূল (সা) বললেন: ‘তুমি ঠিক কথাই বলেছো।’ সুতরাং, আল্লাহ্’র রাসূল (সা) এবং মুসলিমরা উঠে দাঁড়ালেন এবং হাঁটতে শুরু করলেন যে পর্যন্ত না শত্রুপক্ষের নিকটবর্তী কুপের কাছে পৌঁছালেন এবং সেখানেই তাঁবু স্থাপন করলেন। তারপর, তিনি (সা) উক্ত কুপের পানি সরিয়ে নেয়ার নির্দেশ দিলেন এবং তাই করা হল। এরপর, একটি বেসিন তৈরী করে তা পানি দিয়ে পূর্ণ করা হল এবং বাকী কুপগুলো বন্ধ করে দেয়া হল এবং তারা তাদের পানির পাত্রগুলো উক্ত বেসিনে নিক্ষেপ করলেন।”
সুতরাং,
এক্ষেত্রে আল্লাহ্’র রাসূল (সা) আল-হাবাবের মতামতের সাথে একমত পোষণ করেছিলেন।
এ ধরনের ঘটনার ক্ষেত্রে যুদ্ধ ও কৌশলই মুখ্য, এখানে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মতামতের কোন মূল্য নেই। বরং, একজন বিশেষজ্ঞের মতামতই এক্ষেত্রে বিবেচনা করা হবে। এছাড়া, প্রযুক্তি সংক্রান্ত ও গভীর চিন্তাভাবনার সাথে জড়িত বিষয়গুলো যেখানে পর্যাপ্ত গবেষণা ও পর্যালোচনার প্রয়োজন সে সকল ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য হবে। এই সমস্ত ক্ষেত্রে, সাধারণ মানুষের মতামতের চাইতে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের মতামতকে অধিক গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হবে। বস্তুতঃ এ সকল বিষয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মতামতের কোন মূল্যই নেই। বরং, মূল্য আছে অভিজ্ঞতা, জ্ঞান ও পান্ডিত্যের।
অর্থনৈতিক বিষয়ের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। কারণ, হুকুম শারী’আহ্ অর্থ সংগ্রহের ক্ষেত্র, যা অবশ্যই সংগ্রহ করতে হবে এবং এ প্রাপ্ত অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রগুলোও সুনির্দিষ্ট করে দিয়েছে। এছাড়া, কখন ও কোন অবস্থায় জনগণের উপর কর ধার্য করা যাবে সেটাও নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। সুতরাং, অর্থ সংগ্রহ বা বরাদ্দের ব্যাপারে জনগণের মতামত জানতে চাওয়ার কোন প্রয়োজন এখানে নেই। একই কথা সেনাবাহিনীর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। কারণ, হুকুম শারী’আহ্ খলীফাকে সেনাবাহিনীর বিষয়সমূহ পরিচালনা করার অধিকার দিয়েছে এবং জিহাদের সম্পর্কিত আইনকানুনও শারী’আহ্ কর্তৃক নির্ধারণ করে দিয়েছে। সুতরাং, শারী’আহ্ নির্ধারিত বিষয়সমূহে জনগণের মতামতের কোন মূল্য নেই। একই কথা খিলাফত রাষ্ট্রের সাথে অন্যান্য রাষ্ট্রের সম্পর্ক বিষয়েও প্রযোজ্য। কারণ, এ বিষয়ে মতামত প্রদান করতে হলে পর্যাপ্ত চিন্তাভাবনা, গবেষণা, পর্যালোচনা ও গভীর অর্ন্তদৃষ্টি প্রয়োজন এবং এ বিষয়টি জিহাদের সাথেও সম্পর্কিত। উপরন্তু, এ বিষয়টি যুদ্ধ ও এর কৌশলের সাথে জড়িত। সুতরাং, এ বিষয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ কিংবা লঘিষ্ঠ কারো মতামতেরই কোন মূল্য নেই। তবে, এ বিষয়ে জনগণের সাথে পরামর্শ বা তাদের মতামত জানার জন্য খলীফার এ বিষয়সমূহকে কাউন্সিলের সামনে উপস্থাপন করার অধিকার রয়েছে। কারণ, এ বিষয়টি মুবাহ্ (অনুমোদিত) বিষয়ের অন্তর্ভূক্ত। তবে, বদরের প্রান্তরের মতো এক্ষেত্রে কাউন্সিলের মতামত গ্রহণ করা খলীফার জন্য বাধ্যতামূলক নয়। বরং, এ সিদ্ধান্তগুলো যোগ্য ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সাথে সম্পর্কিত।
‘ক’ ও ‘খ’ অনুচ্ছেদের মধ্যে পার্থক্যের নির্ণয়ের ক্ষেত্রে আমরা বলতে পারি যে,
প্রায় সম্পূর্ণভাবে যোগাযোগবিচ্ছিন্ন একটি গ্রামে বসবাসরত মানুষের স্বার্থরক্ষার্থে অর্থাৎ, উক্ত গ্রামের বাসিন্দাদের যাতায়াতের সুবিধার্থে কোন নদীর উপর যদি একটি সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিতে হয়, তবে এক্ষেত্রে জনসাধারণের যাতায়াত সমস্যা সমাধান করার লক্ষ্যে উম্মাহ্’র কাউন্সিলের অধিকাংশের মতামত গ্রহণ করা খলীফার জন্য বাধ্যতামূলক। তবে, প্রযুক্তিগত দিক থেকে সেতু নির্মাণের উপযুক্ত স্থান এবং সর্বোত্তম প্রকৌশল ও স্থাপত্য নকশা নির্ধারণের ক্ষেত্রে, যেমন: সেতুটি কি ঝুলন্ত হবে না বা ভিত্তির উপর নির্মাণ করা হবে, ইত্যাদি নির্ধারণের ক্ষেত্রে এ বিষয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিবর্গের সাথেই পরামর্শ করা উচিত। এক্ষেত্রে, কাউন্সিলের সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত গ্রহণ করা অবান্তর।
একইভাবে, কোন এক গ্রামে শিশুদের জন্য একটি বিদ্যালয় নির্মাণের ক্ষেত্রে, যেখানে এসব শিশুদের জন্য দূরবর্তী শহরে গিয়ে পড়াশোনা করা অত্যন্ত কষ্টসাধ্য বিষয়, এক্ষেত্রে কাউন্সিলের অধিকাংশের মতামত গ্রহণ করা খলীফার জন্য বাধ্যতামূলক। কিন্তু, মাটির ধারণ ক্ষমতার উপর নির্ভর করে প্রস্তাবিত নকশা অনুযায়ী বিদ্যালয়টি গ্রামের কোন এলাকায় হলে ভাল হয়, কিংবা, ভবনের নকশাটি কেমন হওয়া উচিত, কিংবা, বিদ্যালয়টি রাষ্ট্রের অধীনে থাকবে কিনা, বা, এর জন্য বরাদ্দকৃত জমি কি লিজ নেয়া হবে নাকি ক্রয় করা হবে, এ সমস্ত বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিবর্গের পরামর্শই গ্রহণ করতে হবে। যদিও খলীফা চাইলে এ বিষয়সমূহের ব্যাপারে কাউন্সিলের সাথে পরামর্শ করতে পারেন, কিন্তু, এক্ষেত্রে তাদের মতামত গ্রহণ করা তার জন্য বাধ্যতামূলক হবে না।
একইভাবে, রাষ্ট্রের কোন অঞ্চল যদি একেবারে সীমান্তবর্তী এলাকায় হয় এবং শত্রুর আক্রমণের ঝুঁকির মধ্যে থাকে, এক্ষেত্রে অঞ্চলটিকে সুরক্ষিত করা, শত্রুপক্ষের আক্রমণ থেকে নিরাপদ করা, এ অঞ্চলে বসবাসরত জনগণকে শত্রুর হাতে হত্যা ও নিজভূমি হতে বিতাড়ন বা যে কোন ধরনের সম্ভাব্য আক্রমণ থেকে রক্ষার খাতিরে কাউন্সিলের অধিকাংশ সদস্যের মতামত গ্রহণ করা খলীফার জন্য বাধ্যতামূলক। তবে, উক্ত অঞ্চলকে সুরক্ষিত করার পদ্ধতি এবং শত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করার বা তাদের সাথে যুদ্ধ করার পদ্ধতি সম্পর্কে কাউন্সিলের অধিকাংশ সদস্যদের মতামতের পরিবর্তে অবশ্যই বিশেষজ্ঞদের মতামত গ্রহণ করতে হবে।
দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ: আইন প্রণয়নের একমাত্র অধিপতি হচ্ছেন আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা। এ সম্পর্কে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন,
‘আল্লাহ্ ছাড়া কারও বিধান দেবার ক্ষমতা নেই।’
[সূরা ইউসুফ: ৪০]
‘কিন্তু না, তোমার রবের কসম! তারা ততক্ষণ পর্যন্ত ঈমানদার হতে পারবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা তাদের বিবাদবিসম্বাদের ভার তোমার উপর ন্যস্ত করে। অতঃপর তোমার মীমাংসার ব্যাপারে নিজেদের মনে কোন রকম সংকীর্ণতা পায় না এবং তা হƒষ্টচিত্তে কবুল করে নেয়।’
[সূরা নিসা: ৬৫]
‘তারা আল্লাহ্’র পরিবর্তে তাদের ধর্মযাজক ও সাধুদের নিজেদের প্রভু বানিয়ে নিয়েছে।’
[সূরা তওবাহ: ৩১]
এ আয়াতের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেছেন, হাদীসটি আদি ইবনে হাতীমের মাধ্যমে তিরমিযী বর্ণনা করেছেন:
‘আমি একদিন একটি স্বর্ণের ক্রস পরিহিত অবস্থায় নবী (সা) এর সামনে উপস্থিত হলাম। তিনি বললেন, হে আদি! এই মূর্তি ছুড়ে ফেল। তারপর, আমি তাঁকে সূরা আল-বারা’আহ্ তেলাওয়াত করতে শুনলাম, ‘তারা আল্লাহ্’র পরিবর্তে তাদের ধর্মযাজক ও সাধুদের নিজেদের প্রভু বানিয়ে নিয়েছে।’ তিনি বললেন, ‘তারা তাদের উপাসনা করত না, কিন্তু, তারা যে ব্যাপারে অনুমোদন দিত তাকে তারা হালাল মনে করত এবং যেটা নিষেধ করত সেটাকে হারাম মনে করত।’
(সূনানে তিরমিযী, হাদীস নং-৩০৯৫)
সুতরাং, কাউন্সিলের অধিকাংশের মতামত, এমনকি সর্বসম্মতিক্রমেও আইনগ্রহণ করা যাবে না। বরং, এটা গ্রহণ করতে হবে আল্লাহ্’র কিতাব, রাসূলের সনন্নাহ ও এগুলোর ভিত্তিতে কৃত সঠিক ইজতিহাদের মাধ্যমে। সেকারণে রাসূলুল্লাহ্ (সা) হুদাইবিয়ার সন্ধিতে অধিকাংশের মতামতকে অগ্রাহ্য করেছেন এবং বলেছেন,
‘আমি হচ্ছি আল্লাহ্’র বান্দা ও তাঁর প্রেরিত রাসূল এবং কখনোই তার আদেশ অমান্য করব না।’
এর কারণ হল, এই শান্তিচুক্তি ছিল আল্লাহ্’র দেয়া একটি বিধান। এজন্য এক্ষেত্রে জনগণের মতামত গ্রহণ করা হয়নি। এর উপর ভিত্তি করে বলা যায় যে, আহ্কাম শারী’আহ্ গ্রহণ করা, কোন শারী’আহ্ বিধানকে কার্যকর করা এবং শারী’আহ্ বিধিবিধান ও আইনকানুন জারি করা একমাত্র খলীফার আবশ্যিক ক্ষমতার অন্তর্ভূক্ত, যে বিষয়ে পূর্বেই আলোচনা করা হয়েছে। তবে, হুকুম শারী’আহ্ গ্রহণ বা কোন আইনকানুন জারি করার পূর্বে উম্মাহ্’র মতামত সম্পর্কে অবহিত হওয়ার জন্য খলীফা চাইলে এ বিষয়সমূহকে উম্মাহ্’র কাউন্সিলে উপস্থাপন করতে পারেন। যেমনটি হয়েছিল, ইরাকের যুদ্ধলব্ধ ভূমিসমূহ বন্টনের বিষয়ে। এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বে উমর (রা) মুসলিমদের মতামত জানার জন্য তাদের কাছে এ বিষয়টি উপস্থাপন করেছিলেন এবং এ ব্যাপারে সাহাবীরা (রা) তাঁকে বাঁধা দেননি। মুসলিমরা তাঁকে এ ভূমি মুজাহিদদের (যারা এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে) মধ্যে বন্টন করে দিতে বলেছিলেন। কিন্তু, উমর তাঁর নিজস্ব ইজতিহাদ অনুযায়ী এ ভূমি মুসলিমদের মধ্যে বন্টন না করে উক্ত জনপদের বাসিন্দাদের হাতেই ছেড়ে দিয়েছিলেন, বিনিময়ে তাদেরকে মাথাপিছু জিযিয়া প্রদানের পাশাপাশি উক্ত জমির উপর খারাজ দেবার নির্দেশ দিয়েছিলেন। সাহাবীদের উপস্থিতিতে উমরের এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ, যেখানে তাঁরা কেউ তাঁকে এ ব্যাপারে বাঁধা দেননি, প্রমাণ করে যে এ ব্যাপারে সাহাবীদের ইজমা ছিল। এটাই প্রমাণ করে যে, খলীফার এ সকল বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবার অধিকার আছে।
এছাড়া, কোন বিষয়ে শারী’আহ্ আইন গ্রহণ সম্পর্কে, কিংবা, রাষ্ট্র কর্তৃক গৃহীত উসুলের সাথে সংঘর্ষপূর্ণ দলিল-প্রমাণের ভিত্তিতে আইন গ্রহণ, ইত্যাদি বিষয়ে খলীফার সাথে উম্মাহ’র কাউন্সিলের কোনপ্রকার মতবিরোধের সৃষ্টি হলে তা মাহকামাতুল মাযালিম এর নিকট পেশ করতে হবে। এ সকল ক্ষেত্রে, মাহকামাতুল মাযালিম এর বিচারক খলীফা কর্তৃক গৃহীত আইনটি শারী’আহ্ দলিলের ভিত্তিতে পর্যালোচনা করবেন; অর্থাৎ, এর কি শারী’আহ্ দলিল-প্রমাণ আছে কিনা, কিংবা, যে দলিল তিনি উপস্থাপন করেছেন তা ঐ বিষয়ের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কিনা তা যাচাই-বাছাই করবেন। সুতরাং, খলীফা গৃহীত কোন হুকুমের বৈধতার ব্যাপারে যদি তার সাথে উম্মাহ্ কাউন্সিলের বেশীর ভাগ সদস্যের মতপার্থক্য সৃষ্টি হয়, তবে এ বিবাদ নিরসনের দায়িত্ব অবশ্যই মাহকামাতুল মাযালিম এর হাতে ন্যস্ত করতে হবে। কারণ, এটা তার বিশেষত্ব বা এ সমস্যা সমাধানে তিনিই একমাত্র যোগ্যব্যক্তি এবং এ ব্যাপারে মাযালিম এর বিচারকের রায় গ্রহণ করা বাধ্যতামূলক হবে।
কাউন্সিলের অমুসলিম সদস্যদের খলীফা যে সমস্ত শারী’আহ্ আইনকানুন গ্রহণ করতে চান, সে ব্যাপারে পর্যালোচনা করা বা মতামত দেয়ার কোন অধিকার নেই। কারণ, তারা ইসলামী মতাদর্শে বিশ্বাস করে না। তাদের অধিকার শুধুমাত্র শাসকের মাধ্যমে তাদের উপর আপতিত জুলুম-নির্যাতন বা তাদের উপর শারী’আহ্ আইন অপপ্রয়োগের বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিবাদ করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
তৃতীয় অনুচ্ছেদ: এটি শাসককে জবাবদিহিতার সম্মুখীন করার সাথে সম্পৃক্ত সার্বজনীন শারী’আহ্ দলিল থেকে গ্রহণ করা হয়েছে। ইবনে উমর (রা) থেকে আহমদ বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেছেন,
‘তোমাদের উপর এমন আমীর আসবেন তারা তোমাদের যা করতে বলবেন তা নিজেরা করবেন না। যে তাদের মিথ্যাকে বিশ্বাস করবে এবং তাদের জুলুমে সহায়তা করবে তারা আমার দলভুক্ত নয় এবং আমিও তাদের দলভুক্ত নই এবং সে ব্যক্তি আমার সাথে হাউজে কাউসারে অংশ নেবে না।’
(আল মুনদিরী, আল তারগীব ওয়াল তারহীব, খন্ড ৩, পৃষ্ঠা ২২০৩)
আবু সা’ঈদ আল খুদরী (রা) থেকে আহমাদ বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেছেন,
‘অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে হক্ব কথা বলা সর্বোত্তম জিহাদ।’
(সূনানে আবু দাউদ, হাদীস নং-৪৩৪৪)
আল হাকীম, আল জাবের থেকে বর্ণনা করেছেন যে, নবী (সা) বলেছেন,
‘শহীদদের সর্দার হল হামযাহ্ বিন আবদুল মুত্তালিব এবং সেই ব্যক্তি যে অত্যাচারী শাসকের সামনে দাঁড়িয়ে তাকে (হক্ব কাজের) আদেশ করলো এবং (মন্দ কাজ থেকে) নিষেধ করলো এবং ঐ শাসক তাকে হত্যা করল।
(আল মুনদিরী, আল তারগীব ওয়াল তারহীব, খন্ড ৩, পৃষ্ঠা ২২৯)
উম্মে সালামাহ্ (রা) হতে মুসলিম বর্ণনা করেছেন যে,
“এমন কিছু আমীর আসবে যাদের কিছু কাজের ব্যাপারে তোমরা একমত পোষণ করবে এবং কিছু কাজ প্রত্যাখান করবে। সুতরাং, তাদের ভাল কাজের ব্যাপারে যারা ঐক্যমত পোষণ করবে তারা গুনাহ থেকে মুক্তি পেল; যে মন্দ কাজকে প্রত্যাখান করল সেও নিরাপদ হয়ে গেল। কিন্তু, তার কী হল যে (মন্দ কাজকে) গ্রহণ করল, আর তা প্রত্যাখান করল না? (অর্থাৎ, সে নিরাপদ নয়)।”
এ দলিলগুলো সার্বজনীন এবং এখানে, শারী’আহ্ আইন অনুযায়ী শাসকদের জবাবদিহি করার কথা বলা হয়েছে। এই জবাবদিহিতা শাসকদের যে কোন কাজের ব্যাপারেই হতে পারে। উম্মাহ্’র কাউন্সিল কর্তৃক এই জবাবদিহিতা খলীফা, তার সহকারীবৃন্দ, গভর্ণর বা আমীলের যে কোন কাজ, যা কিনা শারী’আহ্ আইনের সাথে সাংঘর্ষিক, কিংবা, মুসলিমদের জন্য ক্ষতিকারক, কিংবা, তাদের ভুল সিদ্ধান্ত অথবা, জনগণের স্বার্থ সংরক্ষণের দিক থেকে তাদের প্রতি অবিচারসুলভ, ইত্যাদি। এ জবাবদিহিতার ব্যাপারে খলীফাকে অবশ্যই ইতিবাচক সাড়া দিতে হবে এবং তার বক্তব্য ও কাজের স্বপক্ষে উপযুক্ত দলিল-প্রমাণ হাজির করতে হবে, যেন কাউন্সিল তার সততা, যোগ্যতা ও আন্তরিকতার ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারে। আর, যদি কাউন্সিলের কাছে তার বক্তব্য, দৃষ্টিভঙ্গি ও উপস্থাপিত দলিল-প্রমাণ গৃহীত না হয়, তবে বিষয়টি ভালভাবে খতিয়ে দেখতে হবে। যদি বিষয়টি এমন হয়, যে ব্যাপারে কাউন্সিলের অধিকাংশের মতামত গ্রহণ করা খলীফার জন্য বাধ্যতামূলক যেমনটি বলা হয়েছে ১(ক) অনুচ্ছেদে তবে, খলীফাকে কাউন্সিলের মতামত গ্রহণ করতে হবে। যেমন: পূর্বে বর্ণিত বিদ্যালয়ের উদাহরণ থেকে বলা যায় যে, যদি খলীফাকে উক্ত গ্রামে বিদ্যালয় স্থাপনের ব্যাপারে জবাবদিহিতার সম্মুখীন করা হয়, তবে তার জন্য এ জবাবদিহিতা বাধ্যতামূলক। আর, যদি জবাবদিহিতা হয় বিদ্যালয়ের জন্য তার বাছাইকৃত নকশা বিষয়ক, তবে এক্ষেত্রে এ জবাবদিহিতা তার জন্য বাধ্যতামূলক হবে না।
আর, যারা তাকে জবাবদিহিতার সম্মুখীন করবেন তারা যদি কোন শারী’আহ্ আইনের ব্যাপারে আইনী দৃষ্টিকোন থেকে তার বিরোধিতা করে, তবে কাউন্সিলকে অবশ্যই অন্যায় আচরণ সংক্রান্ত আদালত বা মাহকামাতুল মাযালিম এর কাছে বিষয়টি ন্যস্ত করতে হবে। কারণ, আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা কুর’আনে বলেন:
‘হে ঈমানদারগণ! আল্লাহ্’র নির্দেশ মান্য কর, নির্দেশ মান্য কর রাসূলের এবং তোমাদের মধ্যে উপর যারা কর্তৃত্বশীল তাদের। তারপর যদি তোমরা কোন বিষয়ে বিবাদে লিপ্ত হয়ে পড়, তাহলে তা আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের দিকে ফিরিয়ে দাও।’
[সূরা নিসা : ৫৯]
অর্থাৎ, মুসলিমরা যদি কোন বিষয়ে কর্তৃত্বশীল কারও সাথে বিবাদে লিপ্ত হয়, তাহলে তা অবশ্যই আল্লাহ্ ও রাসূলের কাছে সমর্পণ করতে হবে এবং এটাই শারী’আহ্’র নির্দেশ। আল্লাহ্ ও রাসূলের কাছে সমর্পণ করার অর্থ হল বিচারব্যবস্থার কাছে সমর্পণ করা, অর্থাৎ, মাহকামাতুল মাযালিম এর কাছে বিষয়টি ন্যস্ত করা। কারণ, এই সমস্ত ক্ষেত্রে একমাত্র আদালতেরই আবশ্যিক ক্ষমতা আছে।
চতুর্থ অনুচ্ছেদ: এ অনুচ্ছেদের দলিল হিসাবে বলা যায় যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাঁর বাহরাইনে নিযুক্ত আমীল, আল ’আলা ইবনে আল-হাদরামীকে অপসারণ করেছিলেন। কারণ, আবদ ক্বায়েস এর প্রতিনিধিগণ তার ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ্ (সা) এর কাছে অভিযোগ করেছিলেন। মুহম্মদ বিন উমরের বরাত দিয়ে ইবনে সা’দ বর্ণনা করেছেন যে,
“আল্লাহ্’র রাসূল (সা) পত্র মারফত আল ’আলা ইবন আল-হাদরামীকে ’আবদ ক্বায়েসের বিশজন প্রতিনিধিসহ তাঁর নিকট উপস্থিত হবার নির্দেশ দিলেন। তিনি বিশজন লোকসহ তাঁর কাছে হাজির হলেন, যাদের নেতৃত্বে ছিলেন আবদুল্লাহ্ বিন আউফ আল-আসহাজ্জ্ব; এবং তারপরে, এ দলের দায়িত্বে ছিল আল-মুনদির বিন সাওয়া। প্রতিনিধিবৃন্দ রাসূল (সা)এর কাছে আল ’আলা হাদরামীর ব্যাপারে অভিযোগ করলে তিনি (সা) তাকে দায়িত্ব থেকে অপসারণ করেন এবং তার স্থলে ইবান বিন সাইদ বিন আল-আস’কে নিযুক্ত করেন এবং তাকে বলেন: “আবদ ক্বায়েসের দেখাশোনা করবে এবং তাদের নেতৃস্থানীয়দের সম্মান করবে।”
এছাড়া, উমর ইবনুল খাত্তাব (রা) শুধুমাত্র জনগণের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে একটি উলাই’য়াহ্ থেকে সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাসকে অপসারণ করেছিলেন এবং বলেছিলেন: “আমি তাকে তার অযোগ্যতা বা বিশ্বাসঘাতকতার জন্য অপসারণ করিনি।” এ সমস্ত উদাহরণ থেকে বোঝা যায় যে, ওয়ালী বা আমীলদের বিরুদ্ধে অসন্তুষ্টি বা উষ্মা প্রকাশের অধিকার উলাই’য়াহ্’র জনগণের রয়েছে এবং এক্ষেত্রে, খলীফাকে অবশ্যই তাদের অপসারণ করতে হবে। একইভাবে, বৃহত্তর মুসলিম জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি হিসাবে উম্মাহ্’র কাউন্সিলেরও ওয়ালী ও আমীলের ব্যাপারে তাদের অসন্তুষ্টি বা উষ্মা প্রকাশের অধিকার রয়েছে; এবং এ অভিযোগ যদি উলাই’য়াহ্ কাউন্সিল বা উম্মাহ্’র কাউন্সিলের অধিকাংশ সদস্যদের পক্ষ থেকে আসে তাহলে খলীফাকে তৎক্ষণাৎ তাদের অপসারণ করতে হবে। আর, যদি এমন হয় যে, দুটি কাউন্সিলের মধ্যে এ বিষয়ে মতপার্থক্য দেখা দিয়েছে, তবে খলীফা উলাই’য়াহ্ কাউন্সিলের মতামতকে প্রাধান্য দেবেন। কারণ, ওয়ালী ও আমীলদের কার্য সম্পর্কে এ কাউন্সিল উম্মাহ্’র কাউন্সিলের চাইতে অনেক বেশী সচেতন ও অবগত।
পঞ্চম অনুচ্ছেদ: এখানে দু’টি ইস্যু রয়েছে: প্রথমটি হল মনোনীতদের তালিকা সংক্ষেপন এবং দ্বিতীয়ত, এই তালিকা সংক্ষিপ্ত করে প্রথমে ছয় এবং পরে দুইজনে নামিয়ে আনা।
প্রথম ইস্যুর ক্ষেত্রে, খোলাফায়ে রাশেদীনদের (রা) ধারা অনুসরণ করলে আমরা দেখতে পাই তালিকা সংক্ষেপনের দায়িত্ব সরাসরি মুসলিমদের প্রতিনিধিরা পালন করতেন অথবা তাদের পক্ষ থেকে খলীফাকে এ দায়িত্ব পালনে অনুরোধ করা হত। বনু সাঈদার প্রাঙ্গনে মনোনীতরা ছিলেন আবু বকর (রা), উমর (রা), আবু উবাইদা (রা) এবং সা’দ ইবনে উবাইদা (রা)। তাঁরা সকলের কাছেই পরীক্ষিত ব্যক্তিত্ব ছিলেন এবং তাঁদের মধ্যেই মনোনয়ন সীমাবদ্ধ ছিল। পুরো প্রাঙ্গনভর্তি লোকের সামনে এ মনোনয়ন পর্ব অনুষ্ঠিত হয় এবং পরবর্তীতে সাহাবীগণও এ বিষয়ে সম্মতি প্রদান করেন। পরবর্তীতে, বাই’আতের মাধ্যমে তাঁরা আবু বকরকে খলীফা হিসাবে নির্বাচিত করেন।
আবু বকরের শাসনামলের শেষের দিকে তিনি তিনমাস মুসলিমদের সাথে আলোচনা করেন খলীফার পদের ব্যাপারে। আলোচনার পর তারা খলীফা হিসাবে উমরকে মনোনীত করে অর্থাৎ, এক্ষেত্রে মনোনয়ন মাত্র একজন ব্যক্তির মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়।
তালিকা সংক্ষেপনের বিষয়টি আরও পরিষ্কারভাবে বোঝা যায় উমর (রা) ছুরিকাঘাতে আহত হবার পর। বস্তুতঃ তখন মনোনয়ন একটি অপরিহার্য বিষয়ে পরিণত হয়। এমতাবস্থায় মুসলিমরা তাঁর কাছে যায় এবং তাদের জন্য প্রার্থী মনোনীত করতে অনুরোধ জানায়। এ পরিপ্রেক্ষিতে তিনি অন্যদেরকে বঞ্চিত করে তালিকা ৬ জনের মধ্যে সীমাবদ্ধ করেন; এবং এ ব্যাপারে জোরালো নির্দেশ দেন, যে ব্যাপারটি সকলের জানা আছে। এছাড়া, আলী (রা) এর মনোনয়নের সময় তিনি একমাত্র প্রার্থী ছিলেন। আর কেউ তাঁর প্রতিদ্বন্দী ছিল না। সেকারণে তালিকা সংক্ষেপনের কোন প্রয়োজন ছিল না।
তালিকা সংক্ষেপনের এই প্রক্রিয়াটি সাধারণতঃ মুসলিমদের জনসমাবেশের সামনে সংঘটিত হত; যদি বিষয়টির বিরোধিতা করা হত, এর অর্থ হত বিষয়টি আসলে অনুমোদিত নয়। কারণ, এর মাধ্যমে (তালিকা সংক্ষেপণ) আসলে অন্যদের মনোনীত হবার অধিকার রহিত হয়ে যায়। এর অর্থ হচ্ছে খলীফা পদপ্রার্থীদের তালিকা সংক্ষেপণের বিষয়টি সাহাবীদের ইজমা (ঐক্যমত)। সুতরাং, উম্মাহ্’র অর্থাৎ, প্রতিনিধিবৃন্দের জন্য তালিকা সংক্ষেপণের কাজ অনুমোদিত; এ সংক্ষিপ্তকরণ প্রক্রিয়া সরাসরি উম্মাহ্ অর্থাৎ, তার প্রতিনিধি কর্তৃক সংঘটিত হোক বা, তাদের পক্ষ থেকে বিদায়ী খলীফাকে এ অধিকার প্রদানের মাধ্যমেই হোক।
এটা গেল তালিকা সংক্ষেপণ সংক্রান্ত বিষয়। আর, প্রার্থীদের তালিকা প্রথমে ছয়জনের মধ্যে সীমাবদ্ধ করার বিষয়টি নেয়া হয়েছে উমর (রা) এর কর্মকান্ড থেকে এবং পরবর্তীতে, ছয়জন থেকে দুইজনে নামিয়ে নিয়ে আসার বিষয়টি নেয়া হয়েছে আবদুর রহমান বিন আউফ (রা) এর কর্মকান্ড থেকে। এছাড়া, এটা একইসাথে অধিকাংশ মুসলিম ভোটারের বাই’আতের মাধ্যমে নির্বাচিত হওয়ার যথার্থতা প্রমাণ করে। কারণ, যদি প্রার্থী দু’য়ের অধিক হত তাহলে হয়ত বিজয়ী প্রার্থী শতকরা ৩০ ভাগ ভোট পেত; যা কিনা অধিকাংশের চাইতে কম। আর যদি প্রার্থী দুইয়ের বেশী না হয় সেক্ষেত্রে বিজয়ী প্রার্থী সবসময়ই সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটেই নির্বাচিত হবে।
উম্মাহ্ কাউন্সিলের মাধ্যমে ছয়জন এবং পরবর্তীতে দুইজন বাছাই করার ক্ষেত্রে, মাহকামাতুল মাযালিম’কে এটা অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে যে, প্রার্থীগণ খলীফা পদে নিযুক্ত হবার সকল শর্তাবলী পুরণ করেছেন। কারণ, উম্মাহ্ কাউন্সিল এদের মধ্য হতেই খলীফা নির্বাচনের জন্য তালিকা সংক্ষেপণ করবে। অন্য ভাবে বলা যায় যে, প্রার্থীদের অবশ্যই নিয়োগচুক্তির সকল শর্তাবলী পূরণ করতে হবে। সুতরাং, মাহকামাতুল মাযালিম চুক্তির শর্তাবলী পূরণে ব্যর্থ ব্যক্তিদের তালিকা থেকে বাদ দেবেন। এরপর, মাহকামাতুল মাযালিম প্রদত্ত তালিকার ভিত্তিতেই উম্মাহ্ কাউন্সিল প্রার্থীদের তালিকা সংক্ষিপ্ত করবেন।
নির্বিঘ্নে মতামত উপস্থাপন ও প্রকাশ করার অধিকার
উম্মাহ্ কাউন্সিলের প্রতিটি সদস্যের শারী’আহ্ প্রদত্ত সীমার মধ্যে থেকে নির্বিঘ্নে ও কোনপ্রকার চাপ ছাড়াই তার নিজস্ব মতামত জোরালো ভাবে উপস্থাপন করার অধিকার রয়েছে। কাউন্সিলের সদস্যরা হলেন উম্মাহ্’র মতামত উপস্থাপনের জন্য তাদের পক্ষ থেকে নির্বাচিত প্রতিনিধি। সুতরাং, তাদের কাজ হল খলীফা, তার সহকারীবৃন্দ এবং ওয়ালী ও আমীল সহ রাষ্ট্রের সকল শাসক কিংবা, রাষ্ট্রের যে কোন বিভাগের যে কোন কর্মচারী ও জনপ্রশাসকদের কার্যাবলী সতর্কতার সাথে পর্যালোচনা করে তাদের জবাবদিহিতার সম্মুখীন করা, উপদেশ প্রদান করা, তাদের কাজের ব্যাপারে মতামত উপস্থাপন করা। তারা এ কাজগুলো করবেন মুসলিমদের পক্ষ থেকে যাদের উপর সৎকাজের আদেশ দান ও অসৎকাজে বাঁধা দেয়া এবং শাসকদের জবাবদিহিতার সম্মুখীন করাকে আল্লাহ্ তা’আলা ফরয করেছেন। আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন,
‘তোমরাই হলে সর্বোত্তম উম্মাহ্, মানবজাতির কল্যাণের জন্যেই তোমাদের উদ্ভব ঘটানো হয়েছে। তোমরা সৎকাজের নির্দেশ দান করবে ও অন্যায় কাজে বাঁধা দেবে।’
[সূরা আলি ইমরান : ১১০]
এবং তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেন,
‘তারা এমন লোক যাদেরকে আমি পৃথিবীতে শাসন-কর্তৃত্ব দান করলে তারা নামায কায়েম করবে, যাকাত দেবে এবং সৎকাজে আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করবে।’
[সূরা হাজ্জ: ৪১]
আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা এ ব্যাপারে আরও বলেন,
‘আর তোমাদের মধ্যে এমন একটা দল থাকবে যারা কল্যাণের প্রতি আহ্বান করবে এবং সৎকাজের নির্দেশ দেবে আর অসৎকাজে নিষেধ করবে এবং তারাই হবে সফলকাম।’
[সূরা আলি ইমরান: ১০৪]
সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধের ব্যাপারে অসংখ্য হাদীস রয়েছে। যেমন: একটি হাদীসে রাসূল (সা) বলেছেন,
“ঐ সত্তার শপথ! যার হাতে আমার প্রাণ, তোমরা অবশ্যই আমর বিল মা’রূফ এবং নাহি আ’নিল মুনকার (সৎ কাজের আদেশ এবং অসৎ কাজে নিষেধ) করবে। অন্যথায় অচিরেই তোমাদের উপর আল্লাহ্’র শাস্তি আরোপিত হবে। অতঃপর তোমরা তাঁকে ডাকবে কিন্তু তোমাদের ডাকে সাড়া দেয়া হবে না।’ এটি হুযাইফার বরাত দিয়ে আহমাদ বর্ণনা করেন।
(সূনানে আবু দাউদ, হাদীস নং-৪৩৩৬)
তিনি (সা) আরও বলেছেন,
“তোমাদের মধ্যে কোন ব্যক্তি অন্যায় কাজ হতে দেখলে সে যেন তার হাত দ্বারা তা প্রতিহত করে। তার এই সামর্থ্য না থাকলে সে যেন তার মুখ দ্বারা তা প্রতিহত করে। আর. তার যদি এ সামর্থ্যও না থাকে সে যেন তার অন্তর দ্বারা তা করে (ঘৃণার মাধ্যমে); আর, এটা হলো দূর্বলতম ঈমান।”
(এ হাদীসটি মুসলিম বর্ণনা করেছেন আবু সা’ইদ এর সূত্রে, সহীহ্, হাদীস নং-১৭৫)
এইসব আয়াত ও হাদীস মুসলিমদের সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করার ব্যাপারে নির্দেশ প্রদান করে। শাসককে জবাবদিহিতার সম্মুখীন করাও এ কাজের অর্ন্তভুক্ত। কিছু কিছু হাদীসে সুনির্দিষ্ট ভাবে শাসকদের জবাবদিহি করার কথা বলা হয়েছে। আবু সা’দ এর বরাত দিয়ে উম্মে আতিয়া (রা) বর্ণনা করেছেন যে, রাসূল (সা) বলেছেন:
‘অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে হক্ব কথা বলা সর্বোত্তম জিহাদ।’
(সূনানে আবু দাউদ, হাদীস নং-৪৩৪৪)
এ হাদীসে এ কাজকে সর্বোত্তম জিহাদ হিসাবে বিবেচনা করে, শাসকের ভৎর্সনা বা সমালোচনা করা এবং তার মুখের উপর সত্য কথা উচ্চারণকে বাধ্যবাধকতার পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। রাসূলুল্লাহ্ (সা) এ ধরনের জিহাদকে প্রচন্ডভাবে উদ্ধুদ্ধ করেছেন এবং মুসলিমদের কাছে অত্যন্ত আকাঙ্খিত করেছেন, যদিও এতে জীবন নাশের ঝুঁকি থাকে। ইতোমধ্যে বর্ণিত একটি সহীহ্ হাদীসে নবী (সা) বলেছেন,
“শহীদদের সর্দার হামযাহ্ এবং ঐ ব্যক্তি, যে অত্যাচারী শাসকের সামনে দাঁড়িয়ে (উক্ত শাসককে) হক্ব কথার উপদেশ দেয় এবং (ঐ শাসক) তাকে হত্যা করে।”
(আল মুনদিরী, আল-তারগীব ওয়াল তারতীব, খন্ড ৩, পৃষ্ঠা ২২৯)
যখন সাহাবাগণ (আল্লাহ্ তাঁদের উপর সন্তুষ্ট থাকুন) হুদাইবিয়ার শান্তিচুক্তির ব্যাপারে আল্লাহ্’র রাসূলের প্রচন্ড বিরোধিতা করেন, তখন তিনি (সা) তাঁদের এ কাজকে তিরষ্কার বা ভৎর্সনা করেননি। বরং, তিনি (সা) শুধুমাত্র তাঁদের মতামতকে প্রত্যাখান করেছিলেন এবং শান্তিচুক্তি সম্পাদন করেছিলেন। কেননা এ ব্যাপারে আল্লাহ্’র পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা এসেছিল, যেখানে তাঁদের মতামতের কোন মূল্য ছিল না। তিনি (সা) সাহাবীদের এজন্য ভৎর্সনা করেছিলেন যে, তাঁরা আদেশ মান্য করেনি যখন তাঁরা কুরবানীর জন্য রাখা উটগুলোকে কুরবানী করেনি, তাঁদের মাথা মুন্ডন করেনি এবং এহরাম ভঙ্গ করেনি। এছাড়া, রাসূলুল্লাহ্ (সা) হাবাব বিন মুনযির (রা) কে বদরের যুদ্ধে ভৎর্সনা করেননি যখন তিনি নবী (সা) এর সাথে তাবু স্থাপনের অবস্থান নিয়ে দ্বিমত পোষণ করেছিলেন, বরং তিনি (সা) তাঁর পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করেছিলেন।
এছাড়া, অধিকাংশের মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে রাসূলুল্লাহ্ (সা) কুরাইশদের সাথে মদিনার বাইরে গিয়ে যুদ্ধ করেছেন, যদিও এ ব্যাপারে তাঁর নিজস্ব মতামত ছিল ভিন্ন। এ সমস্ত ক্ষেত্রেই রাসূল (সা) সকলের অভিযোগ শুনেছেন এবং পরে, তাঁর নিজস্ব মতামত দিয়েছেন।
রাসূলুল্লাহ্ (সা) এর পর খোলাফায়ে রাশেদীনদের শাসনামলেও সাহাবীগণ (রা) এই ধারা অব্যাহত রাখেন। এজন্য তাঁরাও কাউকে ভৎর্সনা করেননি। তাঁরা উমরকে (রা) মিম্বরে দাঁড়ানো অবস্থায় ইয়েমেনী কাপড়ের বন্টন সম্পর্কে জবাবদিহি করেছিলেন। একজন নারী তাঁকে (রা) চ্যালেঞ্জ করেছিলেন, কারণ উমর (রা) মোহরানা বৃদ্ধির উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিলেন এবং সাহাবীরাও (রা) ইরাক বিজয়ের পর ইরাকের ভূমি বন্টনের ব্যাপারে উমরের (রা) সিদ্ধান্তের সাথে দ্বিমত পোষণ করেছিলেন। বিশেষ করে, বিলাল (রা) ও আল যুবায়ের (রা) বিরোধিতার ব্যাপারে অত্যন্ত কঠোর ছিলেন। তিনি (রা) তাঁদের (রা) সাথে বিতর্ক করতেন এবং যতক্ষণ পর্যন্ত না তাঁর (রা) মতামত সাহাবীদের (রা) বুঝাতে পারতেন ততক্ষণ আলোচনা চালিয়ে যেতেন।
সুতরাং, বৃহত্তর মুসলিম উম্মাহ্’র প্রতিনিধি হিসেবে উম্মাহ্ কাউন্সিলের সদস্য কোনপ্রকার বাঁধা বা চাপ ব্যতীত তার ইচ্ছানুযায়ী মতপ্রকাশের অধিকার সংরক্ষণ করেন। তার রয়েছে খলীফা, মু’ওয়ায়ীন (খলীফার সহকারীবৃন্দ), ওয়ালী, আমীল ও জনপ্রশাসকদের জবাবদিহি করার অধিকার। এরা সকলেই কাউন্সিল সদস্যদের কাছে ততক্ষণ পর্যন্ত জবাবদিহি করতে বাধ্য যতক্ষণ পর্যন্ত তারা শারী’আহ্ আইনের সীমার মধ্যে এ কার্য সম্পাদন করেন এবং তাদের মতামত উপস্থাপন করেন। উম্মাহ্ কাউন্সিলের অমুসলিম সদস্যগণও শারী’আহ্ নির্ধারিত সীমার মধ্যে নির্বিঘ্ন ও চাপমুক্ত অবস্থায় তাদের উপর শাসক কর্তৃক সংঘটিত সকল জুলুম-নির্যাতনের ব্যাপারে মতামত তুলে ধরার অধিকার সংরক্ষণ করেন।