আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিভাগ রাষ্ট্রের আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট সকল বিষয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত থাকবে এবং এ বিভাগের দায়িত্বে থাকবেন একজন মহাব্যবস্থাপক। প্রত্যেক প্রদেশে এই বিভাগের একটি করে শাখা থাকবে যাকে আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা শাখা বলা হবে, এর প্রধানকে বলা হবে সাহিব আল সুরতাহ্ (Sahib al-shurta) এবং সেখানে তিনি প্রাদেশিক গভর্ণরের তত্ত্বাবধানের কাজ করবেন। তবে, প্রশাসনিক বিষয়ে তিনি কেন্দ্রের আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিভাগের অধীনস্ত থাকবেন যা পরিচালিত হবে একটি বিশেষ আইন দ্বারা।
আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিভাগ নিরাপত্তার সাথে সংশ্লিষ্ট যে কোন বিষয়ের ব্যাপারে দায়িত্বশীল। এ বিভাগ পুলিশবাহিনীর (সুরতাহ্) মাধ্যমে রাষ্ট্রের আইনশৃংখলা পরিস্থিতি বজায় রাখে। বস্তুতঃ এটাই হল নিরাপত্তা রক্ষার প্রধান উপকরণ। নিরাপত্তা রক্ষার স্বার্থে পুলিশবাহিনীকে যে কোন সময়, যেভাবে ইচ্ছা ব্যবহার করা আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিভাগের জন্য অনুমোদিত এবং এ বিভাগের নির্দেশ পাওয়া মাত্র তৎক্ষণাৎ পুলিশবাহিনীকে তা কার্যকর করতে হবে। আবার, যদি পুলিশবাহিনীর সেনাবাহিনীর সহায়তার প্রয়োজন হয় তাহলে খলীফা বরাবর এ ব্যাপারে আবেদন করতে হবে। তিনি সেনাবাহিনীকে আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিভাগকে সহায়তা করার নির্দেশ দিতে পারেন কিংবা, অন্য কোন উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন। তবে, খলীফা এ আবেদন প্রত্যাখানও করতে পারেন এবং পুলিশবাহিনীকেই এ কাজ সম্পাদনের নির্দেশ দিতে পারেন।
পূর্ণবয়স্ক পুরুষ নাগরিকদের দ্বারাই পুলিশবাহিনী গঠিত হবে। তবে, আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বজায় রাখার স্বার্থে নারীদের প্রয়োজনে মহিলাদেরও পুলিশ বিভাগে নিয়োগ দেয়া অনুমোদিত। হুকুম শারী’আহ্’র আলোকে এ ব্যাপারে একটি বিশেষ আইন প্রস্তুত করা হবে।
পুলিশবাহিনী দু’ভাগে বিভক্ত থাকবে: এর এক ভাগে থাকবে সেনাপুলিশ এবং আরেক ভাগে থাকবে সরাসরি শাসকের নির্দেশাধীন পুলিশ; যাদের জন্য অবশ্যই বিশেষ পোষাক ও চিহ্ন নির্ধারিত থাকবে এবং এরা নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত থাকবে।
সুরতাহ্’র সংজ্ঞা দিতে গিয়ে আল আজহারী বলেছেন, ‘সুরতাহ্ শব্দের অর্থ হলো কোন কিছুর মধ্যে যা উত্তম। এই অর্থ সুরাতকেও (নিরাপত্তাবাহিনীকে) বুঝায় কেননা তারা শ্রেষ্ঠ সৈন্য। এটা বলা হয় যে, সুরতাহ হল প্রথম গ্রুপ যারা সেনাবাহিনীর অগ্রে অবস্থান নেয় । তাদেরকে সুরাত বলা হয় একারণে যে, পদবি ও পোষাকের দিক থেকে তাদের রয়েছে বিশেষ বৈশিষ্ট্য। আল আসমা’য়ী সুরতার এই সংজ্ঞা পছন্দ করেছেন। আল কামুস অভিধান গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ‘সুরতাহ্’র প্রত্যেককে আলাদাভাবে সুরাত বলা হয় – যার অর্থ হল প্রথম ব্যাটালিয়ন হিসেবে যারা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করবে এবং মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত থাকবে। এই সুরতাহ্ ওয়ালীদের সাহায্যকারীও বটে। আর, তাদেরকে এ নামে ডাকার কারণ হল একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ চিহ্ন দ্বারা তারা নিজেদের আলাদা করে নিয়েছে।’
আর, সেনা পুলিশ (military police) হল সেনাবাহিনীর একটি অংশ, তাদের রয়েছে বিশেষ চিহ্ন এবং তারা শৃংখলা রক্ষার জন্য সেনাবাহিনীর অগ্রে থাকবে। তারা আমীরুল জিহাদ অর্থাৎ যুদ্ধ বিভাগের আনুগত্য করবে। কিন্তু, পুলিশবাহিনী যা শাসকদের নির্দেশে চলবে তা আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিভাগের আনুগত্য করবে।
আল বুখারী আনাস হতে বর্ণনা করেছেন যে, ‘আমীরদের সাথে কথা বলার সময় কায়েস ইবনে সা’দ পুলিশের মত রাসূলুল্লাহ্ (সা) এর সামনে থাকত।’ এখানে কায়েস ইবনে সা’দ ইবনে উবাদা আল আনসারী আল খারাজকে বুঝানো হয়েছে। আল তিরমিযী বর্ণনা করেছেন যে, ‘আমীরদের সাথে কথা বলার সময় কায়েস ইবনে সা’দ পুলিশের মত রাসূলুল্লাহ্ (সা) এর সামনে থাকত।’ আল আনসারী বলেছেন, এর অর্থ হল তাকে এ ব্যাপারে দায়িত্বভার দেয়া হয়েছিল।
খলীফা ইচ্ছে করলে আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত সুরতাহ্ বা পুলিশবাহিনীকে সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করতে পারেন অর্থাৎ যুদ্ধবিভাগের অধীন করতে পারেন। আবার, তিনি একটি স্বাধীন বিভাগও গঠন করতে পারেন; যেমন: আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিভাগ।
তবে, আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা রক্ষার জন্য আমরা একটি পৃথক স্বাধীন বিভাগ গঠন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি অর্থাৎ শাসকদের নির্দেশাধীন সুরতাহ্ বা পুলিশবাহিনীকে অবশ্যই আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিভাগের অধীনস্থ থাকতে হবে – যা হবে স্বাধীন একটি বিভাগ এবং রাষ্ট্রের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মত তাদের জবাবদিহিতা থাকবে সরাসরি খলীফার কাছে। আর এ ব্যাপারে দলিল হল কায়েস ইবনে সা’দ এর হাদীসটি। জিহাদের সাথে সম্পর্কযুক্ত চারটি বিভাগের স্বাধীনতা বিষয়ে পূর্বে উল্লেখিত হুমকির কারণে এগুলো একটি মাত্র প্রতিষ্ঠান হওয়ার পরিবর্তে প্রতিটি বিভাগই পৃথক পৃথক ভাবে খলীফার নির্দেশাধীন থাকবে। সুতরাং, আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা সুরতাহ্ আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিভাগের অধিনস্ত থাকবে।
আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিভাগের কার্যপরিধি
আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিভাগের কাজ হল রাষ্ট্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। যে সব কর্মকান্ডের কারণে রাষ্ট্রের আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে তাদের তালিকা বৃহৎ, যেমন:
ইসলাম ত্যাগ করা, ধ্বংসাত্মক ও অন্তর্ঘাতমূলক কর্মকান্ডের মাধ্যমে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা – যেমন: রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় আঘাত বা সেগুলো দখল করে নেয়া কিংবা ব্যক্তিগত, গণমালিকানাধীন বা রাষ্ট্রীয় সম্পদ বিনষ্ট করা ইত্যাদি। এছাড়া, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহের মাধ্যমেও রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে।
এছাড়াও আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য যেসব কর্মকান্ড হুমকি হতে পারে সেগুলো হল: চুরি, লুটপাট, ডাকাতি ও আত্মসাৎ এর মাধ্যমে অন্যায় ভাবে জনগণের সম্পদ হরণ করা এবং সেইসাথে, হয়রানি, শারীরিক অত্যাচার-নির্যাতন ও হত্যাকান্ডের মাধ্যমে সাধারণ জনগণকে আক্রমণ করা এবং মিথ্যা অভিযোগ ও অপবাদ আরোপ, কলঙ্ক লেপন ও ধর্ষণের মাধ্যমে মানুষের সম্মানহানি করা ইত্যাদি।
আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিভাগের অন্যান্য কাজের মধ্যে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল সন্দেহভাজনদের নজরে রাখা এবং তাদের সম্ভাব্য ক্ষতির হাত থেকে রাষ্ট্র ও জনগণকে রক্ষা করা।
প্রধানতঃ এ সমস্ত কার্যাবলীই রাষ্ট্রের আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিঘ্নিত করার জন্য সবচাইতে বেশী হুমকি স্বরূপ। আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিভাগ মূলতঃ রাষ্ট্র ও জনগণকে এসব অন্যায় ও অপরাধপ্রবণ কর্মকান্ড থেকে রক্ষা করে। সুতরাং, কেউ (ইসলাম) ধর্ম ত্যাগ করার পর যদি অনুতপ্ত না হয়, তাহলে তার মৃত্যুদন্ডের রায় হবে এবং এই বিভাগ এই রায় কার্যকর করবে। যদি ধর্মত্যাগীরা একটি দল হয় তাহলে তাদেরকে প্রথমে ইসলামে ফিরে আসার আহ্বান জানাতে হবে। যদি তারা অনুতপ্ত হয়ে ইসলামে ফিরে আসে এবং শারী’আহ্ আইনকানুন মেনে নেয়, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা রাষ্ট্রের উচিত হবে না। আর, যদি তারা ধর্মত্যাগের উপর অটল থাকে তাহলে অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। যদি তারা সংখ্যায় কম হয়, তাহলে আভ্যন্তরীন নিরাপত্তা রক্ষায় নিয়োজিত পুলিশবাহিনীই তাদের দমন করার জন্য যথেষ্ট হবে। কিন্তু, যদি তারা সংখ্যায় বেশী হয় এবং পুলিশবাহিনী তাদেরকে দমন করার জন্য যথেষ্ট না হয়, তবে সেক্ষেত্রে তাদের অতিরিক্ত সেনাপুলিশ দিয়ে সাহায্য করার জন্য খলীফাকে অনুরোধ জানাতে হবে। যদি সেনাপুলিশও এ কাজের জন্য যথেষ্ট না হয় তাহলে তাদের অবশ্যই সেনাবাহিনী দিয়ে সাহায্য করার ব্যাপারে খলীফার বরাবর আবেদন করতে হবে।
এটা গেল ধর্মত্যাগীদের কথা। এছাড়া, সাধারণ জনগণের মধ্য হতে কেউ যদি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে এবং এ বিদ্রোহমূলক কর্মকান্ডে তারা যদি অস্ত্র ব্যবহার না করে শুধুমাত্র ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ড, হরতাল, বিক্ষোভ কর্মসূচী, রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাসমূহ দখল করে নেয়া ইত্যাদির মাধ্যমে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে; কিংবা, ব্যাপক ভাংচুরের মাধ্যমে ব্যক্তিগত, গণমালিকানাধীন ও রাষ্ট্রীয় সম্পদ বিনষ্ট করে, তাহলে আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিভাগ এ সমস্ত ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ড নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য শুধুমাত্র পুলিশবাহিনীকে নিয়োজিত করবে। কিন্তু, যদি এ বিভাগ এসব আগ্রাসী কর্মকান্ড নিয়ন্ত্রণে আনতে ব্যর্থ হয়, তাহলে ধ্বংসাত্মক ও ষড়যন্ত্রমূলক এসকল কর্মকান্ড বন্ধ করার লক্ষ্যে সেনাপুলিশের সাহায্য কামনা করে খলীফা বরাবর অনুরোধ জানাতে হবে।
তবে, যদি বিদ্রোহীরা অস্ত্র ব্যবহার করে ও একটি অঞ্চলে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে ফেলে এবং আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিভাগ কেবলমাত্র পুলিশের দ্বারা তাদের নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়, তাহলে অবস্থার উপর নির্ভর করে বিদ্রোহ দমনের জন্য তারা খলীফাকে সেনাবাহিনী পাঠাতে অনুরোধ জানাবে। তবে, বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনার পূর্বে আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিভাগের পক্ষ থেকে তাদের সাথে যোগাযোগ করা উচিত এবং তাদের অভিযোগ সম্পর্কে জানার চেষ্টা করা ও তা খতিয়ে দেখা উচিত। এছাড়া, আভ্যন্তরীন নিরাপত্তা বিভাগের পক্ষ থেকে তাদের অস্ত্রসমর্পণের মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহ্’র জামায়া’ত ও রাষ্ট্রের আনুগত্যে ফিরে আসার আহবান জানাতে হবে। যদি তারা এ প্রস্তাবে ইতিবাচক ভাবে সাড়া দিয়ে আত্মসর্মপণ করে এবং রাষ্ট্রের আনুগত্যে ফিরে আসে, তবে রাষ্ট্রকে অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা থেকে বিরত থাকতে হবে। কিন্তু, যদি তারা এ প্রস্তাব প্রত্যাখান করে এবং বিদ্রোহের ব্যাপারে অটল থাকে, তবে শাস্তিপ্রদান ও শৃংখলা ফিরিয়ে নিয়ে আসার লক্ষ্যে তাদের সাথে যুদ্ধ করতে হবে, তাদের সমূলে উচ্ছেদ বা ধ্বংস করার লক্ষ্যে নয়। রাষ্ট্র তাদের সাথে এ লক্ষ্যে যুদ্ধ করবে যেন তারা রাষ্ট্রের আনুগত্যে ফিরে আসে, বিদ্রোহের পথ পরিবর্তন করে তাদের অস্ত্রশস্ত্র সমর্পণ করে।
এর চমৎকার উদাহরণ হল যেভাবে ইমাম আলী বিন আবি তালিব (রা) খাওয়ারিজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন। তিনি তাদের প্রথমে আত্মসমর্পন করতে বলেন। তারা যদি বিদ্রোহের পথ থেকে সরে আসত তাহলে তিনি তাদের সাথে যুদ্ধ করতেন না। কিন্তু, তারা বিদ্রোহের সিদ্ধান্তে অটল থাকায় তিনি শৃংখলা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে তাদের সাথে যুদ্ধ করেন, যেন তারা আনুগত্যের পথে ফিরে আসে, বিদ্রোহের পথ পরিবর্তন করে এবং সেইসাথে অস্ত্র সমর্পণ করে।
এছাড়া, যারা সন্ত্রাসী কর্মকান্ড পরিচালনা করে, যেমন: যারা মহাসড়কে ডাকাতি করে সাধারণ মানুষকে আক্রমণ করে, জোরপূর্বক মহাসড়কে চলাচলকালে বাধা সৃষ্টি করে, ধন-সম্পদ ছিনিয়ে নেয় ও হত্যা করে, তাদের দমনের জন্য আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিভাগ পুলিশবাহিনী প্রেরণ করবে এবং নিম্নোক্ত আয়াত অনুসারে তাদের যথোপযুক্ত শাস্তি প্রদান করবে – যা হতে পারে হত্যা এবং ক্রুশবিদ্ধ করা, হত্যা করা, বিপরীত অঙ্গচ্ছেদ করা অথবা তাদের অন্যত্র নির্বাসনে পাঠানো ইত্যাদি।
‘যারা আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের সাথে সংগ্রাম করে এবং দেশে হাঙ্গামা সৃষ্টি করতে সচেষ্ট হয়, তাদের শাস্তি হচ্ছে এই যে, তাদেরকে হত্যা করা হবে অথবা শূলে চড়ানো হবে অথবা তাদের হস্তপদসমূহ বিপরীত দিক থেকে কেটে দেয়া হবে অথবা দেশ থেকে বহিষ্কার করা হবে।’
[সূরা মায়েদা: ৩৩]
এসব দুর্বৃত্তের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা আর দেশদ্রোহীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা এক কথা নয়। বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের উদ্দেশ্য হল তাদের শৃংখলার ভেতর নিয়ে আসা। কিন্তু এইসব দুর্বৃত্তের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার মানে হল তাদেরকে হত্যা করা হবে অথবা শূলে চড়ানো; সুতরাং, এইসব মহাসড়ক ডাকাতরা যদি নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করে কিংবা পালিয়েও যায়, তারপরও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। কারণ, উপরোক্ত আয়াত অনুসারে তাদের সাথে আচরণ করা হবে: যে হত্যা করবে এবং সম্পদ ছিনিয়ে নেবে, তাকে হত্যা করা হবে এবং শূলে চড়ানো হবে; যে শুধুমাত্র হত্যা করবে কিন্তু সম্পদ ছিনিয়ে নেবে না, তাকে হত্যা করা হবে কিন্তু শূলে চড়ানো হবে না; যে হত্যা করবে না কিন্তু সম্পদ ছিনিয়ে নেবে তাকে হত্যা না করে তার হাত-পা বিপরীত দিক থেকে কেটে দেয়া হবে; আর যে ব্যক্তি অস্ত্র হাতে ভয়ভীতি বা আতঙ্ক সৃষ্টি করবে, কিন্তু হত্যাও করবে না বা স¤পদও ছিনিয়ে নেবে না তাকে নির্বাসনে পাঠানো হবে।
বস্তুতঃ আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিভাগের জন্য রাষ্ট্রের আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে শুধুমাত্র পুলিশবাহিনীকে ব্যবহার করাই অনুমোদিত। পুলিশ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে বা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না, এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি না হলে আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিভাগের জন্য অন্য কোন বাহিনীকে ব্যবহার করা অনুমোদিত নয়। তবে, এরকম পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে এ বিভাগ প্রয়োজনানুসারে সেনাপুলিশ বা সেনাবাহিনীর সাহায্য কামনা করে খলীফার কাছে আবেদন করতে পারে। এছাড়া, আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিভাগ চুরি, ছিনতাই, লুটপাট, ডাকাতি, আত্মসাৎ ইত্যাদির মাধ্যমে সম্পদ হরণ কিংবা, জুলুম-নির্যাতন ও হতাহত করা কিংবা, মিথ্যা অপবাদ, চরিত্র হনন বা ধর্ষণের মাধ্যমে সম্মান হানি করা ইত্যাদি অপরাধসমূহ নিয়মিত টহল, রক্ষী বা পাহারাদার মোতায়েন করে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে এবং সেইসাথে মানুষের জান, মাল ও ইজ্জতের ওপর আক্রমণকারী দূর্বৃত্তদের উপর আদালতের রায় বাস্তবায়ন করেও এইসব অপরাধ দমন করতে পারে। বস্তুতঃ কেবলমাত্র পুলিশবাহিনীর মাধ্যমেই এ কাজগুলো সম্পাদন করা যায়।
আইন-শৃংখলা রক্ষা করা, আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা পর্যবেক্ষণ ও আদালয়ের রায় বাস্তবায়ন ইত্যাদি সুরতাহ্’র দায়িত্ব। আর এটা এ কারণে যে, আনাস (রা) বর্ণিত হাদীস থেকে আমরা দেখতে পাই যে, কায়েস ইবনে সা’দ রাসূলুল্লাহ্ (সা) এর সামনে সাহিব আস সুরতাহ্ (পুলিশবাহিনীর প্রধান) হিসেবে দন্ডায়মান থাকতেন। এ থেকে বোঝা যায় যে, সুরতাহ্ শাসকদের সম্মুখে দন্ডায়মান থাকে। এর অর্থ হল, শারী’আহ্ আইনকানুন বাস্তবায়ন, আইন-শৃংখলা এবং নিরাপত্তা রক্ষার কাজে শাসকদের যে কোন ধরনের নির্দেশ পালন করতে তারা বাধ্য। এর মধ্যে টহলকার্যও অন্তর্ভূক্ত যেমন: রাতের বেলা টহলের মাধ্যমে চোর-ডাকাত, অপরাধী ও দুর্বৃত্ত দমন করা ইত্যাদি। আবু বকর (রা) এর সময় আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) রাতের টহলের আমীর ছিলেন। উমর ইবন খাত্তাব (রা) নিজেই রাতের টহলের দায়িত্ব পালন করতেন এবং
কখনওবা সাথে তাঁর ভৃত্য অথবা আবদুর রহমান বিন আউফ (রা) থাকতেন।
সুতরাং, বর্তমানে কিছু কিছু মুসলিম দেশে দোকান মালিকেরা নিজ দায়িত্বে রাতের পাহারাদার নিয়োগ করে থাকে কিংবা কোন কোন ক্ষেত্রে দোকান মালিকদের খরচে সরকার পাহারাদার নিয়োগ করে – এ সবই সম্পূর্ণরূপে ভুল। এর কারণ হল রাতের টহল বা পাহারা পুরোপুরি রাষ্ট্রের দায়িত্ব এবং এটি পুলিশবাহিনীর দায়িত্বের অন্তর্ভূক্ত। সুতরাং, জনগণের কাঁধে এ দায়িত্ব অর্পণ করা যাবে না কিংবা তাদের কাছ থেকে এজন্য কোনপ্রকার অর্থ আদায় করা যাবে না।
এছাড়া, রাষ্ট্র, সম্প্রদায় ও ব্যক্তির জন্য ক্ষতিকর এরকম সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের নজরে রাখা এবং তাদের সম্ভাব্য ক্ষতির হাত থেকে রাষ্ট্র ও জনগণকে রক্ষা করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। উম্মাহ্’র মধ্য থেকে কারও কাছে যদি এ ধরনের ব্যক্তির ব্যাপারে কোন তথ্য থাকে তবে তা অবশ্যই রাষ্ট্রকে অবহিত করতে হবে। এ ব্যাপারে দলিল হল আল আরকাম থেকে বুখারী ও মুসলিমের বর্ণিত হাদীস:
“আমি একটি অভিযানে ছিলাম এবং শুনতে পেলাম আবদুল্লাহ ইবন উবাই বলছে, আল্লাহ্’র রাসূল ও তাঁর সঙ্গীদের জন্য তোমরা ব্যয় করো না এবং তোমরা তাঁর চারপাশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাও; এরপর যখন আমরা আমার চাচা অর্থাৎ, উমরের কাছে পৌঁছালাম, তিনি এ ঘটনাটি আল্লাহ্’র রাসূলের কাছে বর্ণনা করলেন। তিনি আমাকে ডাকলেন এবং আমি তাঁর কাছে ঘটনাটি বর্ণনা করলাম।” (সহীহ্ বুখারী, হাদীস নং: ৪৯০১, সহীহ মুসলিম, হাদীস নং: ২৭৭২) মুসলিমের বর্ণনা অনুযায়ী, “আমি নবী করীম (সা) এর কাছে আসলাম এবং তাঁকে আবদুল্লাহ ইবন উবাই সম্পর্কে জানালাম, যে কিনা মুসলিমদের প্রতি শত্রুতা পোষণকারী কাফিরদের সাথে ঘন ঘন সাক্ষাৎ করে এবং একইভাবে, মদীনার চারপাশের ইহুদী এবং মুসলিমদের শত্রুদের সাথেও যোগাযোগ রক্ষা করে।”
এ ব্যাপারটি আরও ভালভাবে বোঝার জন্য আমরা এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো যাতে করে এটি সাধারণ নাগরিকদের উপর গোয়েন্দাগিরির সাথে মিশ্রিত না হয়ে যায়, কারণ সাধারণ মানুষের উপর গোয়েন্দাগিরি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এ ব্যাপারে পবিত্র কুর’আনে আল্লাহ্ বলেন,
‘এবং একে অপরের গোপনীয় বিষয় সন্ধান (গোয়েন্দাগিরি) করো না।’
[সূরা হুযুরাত: ১২]
সুতরাং, গোয়েন্দাগিরি বা নজরদারীর বিষয়টি শুধুমাত্র সন্দেহভাজনদের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ।
এখানে সন্দেহভাজন তারাই যারা কাফের শত্রুরাষ্ট্র অর্থাৎ, যারা মুসলিমদের সাথে যুদ্ধরত কিংবা যাদের সাথে যুদ্ধের সম্ভাবনা রয়েছে তাদের সাথে ঘন ঘন সাক্ষাৎ করে বা যোগাযোগ রক্ষা করে। এর কারণ হল, যুদ্ধের কৌশল হিসাবে এবং মুসলিমদের সম্ভাব্য ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করার জন্য কাফিরদের উপর গোয়েন্দাগিরি করা শারী’আহ্ কর্তৃক অনুমোদিত; উপরন্তু, এ বিষয়ে যে শারী’আহ্ দলিলসমূহ পাওয়া যায় তার মধ্যে সকল শত্রুভাবাপন্ন কাফিররাই অন্তর্ভূক্ত। এর কারণ হল, যদি তারা প্রকৃতপক্ষে মুসলিমদের সাথে যুদ্ধরত জনগোষ্ঠী হয় তাহলে তাদের উপর গোয়েন্দাগিরি করা আবশ্যক। আর, যদি তারা মুসলিমদের প্রতি শত্রট্টভাবাপন্ন হয়ে থাকে তবে তাদের উপর গোয়েন্দাগিরি অনুমোদিত, কেননা তাদের সাথে যে কোন সময় যুদ্ধ বাঁধার সম্ভাবনা থাকে।
সুতরাং, কোন ব্যক্তি যদি যুদ্ধরত কাফেরদের সাথে নিবিড় সম্পর্ক বজায় রাখে তাহলে সে সন্দেহভাজন ব্যক্তি বলে বিবেচিত হবে; কারণ সে এমন কারও সাথে সম্পর্ক রাখছে যাদের উপর গোয়েন্দাগিরি করা শারী’আহ্ কর্তৃক অনুমোদিত, অর্থাৎ কাফের শত্রট্টরাষ্ট্র।
এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা নিম্নরূপ:
১. মুসলিমদের সাথে যুদ্ধরত কাফেরদের উপর গোয়েন্দাগিরি করা রাষ্ট্রের জন্য বাধ্যতামূলক। উপরোক্ত দলিল ছাড়াও শারী’আহ্ মূলনীতি অনুসারে, ‘ফরয সম্পাদনের জন্য যা করা প্রয়োজন তাও ফরয।’ কারণ শত্রুকে পরাজিত করতে হলে শত্রুর শক্তিমত্তা, তার পরিকল্পনা, তার লক্ষ্য এবং এর কৌশলগত অবস্থান ইত্যাদি সম্পর্কে
তথ্য জানা দরকার। আর, এ দায়িত্ব পালন করে থাকে যুদ্ধ বিভাগ। যুদ্ধের সম্পর্ক বজায় থাকায় যুদ্ধরত কাফেরদের সাথে খিলাফত রাষ্ট্রের নাগরিকদের মধ্যে সুসম্পর্ক থাকার যুক্তি সঙ্গত কারণ নেই। তাই যদি তাদের সাথে এ ধরনের সম্পর্ক কোন নাগরিক বজায় রাখে তাহলে গুপ্তচরবৃত্তির আওতায় সে নাগরিকও পড়বে।
২. এছাড়া, যুদ্ধে জড়িয়ে পরার সম্ভাবনা রয়েছে এমন কাফেরদের উপর গুপ্তচরবৃত্তি করা অনুমোদিত এবং ক্ষেত্র বিশেষে এটি বাধ্যতামূলক এই কারণে যে, এর মাধ্যমে রাষ্ট্রকে সম্ভাব্য ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করা যায়। বিশেষ করে যদি এমন আশঙ্কা থাকে যে, তারা ইসলামী রাষ্ট্রের সাথে যুদ্ধরত রাষ্ট্রকে সহযোগিতা করবে বা তাদের সাথে যোগ দেবে, তবে অবশ্যই তাদের ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। যাদের সাথে যুদ্ধের সম্ভাবনা রয়েছে এরকম কাফেরদের দু’ভাগে ভাগ করা যায়:
প্রথমত: নিজদেশে বসবাসরত সম্ভাব্য শত্রুভাবাপন্ন কাফের যাদের বিরুদ্ধে খিলাফত রাষ্ট্রের যুদ্ধবিভাগ গুপ্তচরবৃত্তি করবে।
দ্বিতীয়ত: সম্ভাব্য শত্রুভাবাপন্ন কাফের যারা ইসলামী রাষ্ট্রে প্রবেশ করবে, যেমন: দূত হিসাবে বা চুক্তির কারণে আগত ব্যক্তিবর্গ ইত্যাদি। আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিভাগ এদের পর্যবেক্ষণ করবে ও গোয়েন্দাগিরির আওতায় রাখবে।
আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিভাগ খিলাফত রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে অবস্থানরত সম্ভাব্য শত্রুভাবাপন্ন কাফের রাষ্ট্রের বিভিন্ন কর্মকর্তা বা প্রতিনিধিদের সাথে যেসব নাগরিক নিবিড় সম্পর্ক বজায় রাখবে বা ঘন ঘন যোগাযোগ রক্ষা করে চলবে তাদের উপরে নজরদারী ও গোয়েন্দাগিরি করবে। অন্যদিকে, খিলাফত রাষ্ট্রের যে সব নাগরিক মুসলিমদের সাথে প্রকৃত অর্থে যুদ্ধরত কাফের রাষ্ট্রের বিভিন্ন কর্মকর্তা বা প্রতিনিধিদের সাথে তাদের দেশে ভ্রমণ করে দেখা সাক্ষাৎ করবে তাদের উপর যুদ্ধবিভাগ গোয়েন্দাগিরি করবে। তবে এর জন্য দু’টি শর্ত রয়েছে:
প্রথমত: আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিভাগ বা যুদ্ধ বিভাগের পর্যবেক্ষণে যদি এইরকম প্রমাণিত হয় যে, খিলাফত রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে বা বাইরে অবস্থানরত সম্ভাব্য শত্রুভাবাপন্ন কাফের রাষ্ট্রের বিভিন্ন কর্মকর্তা বা প্রতিনিধিদের সাথে খিলাফত রাষ্ট্রের যেসব নাগরিক সম্পর্ক বা যোগাযোগ রক্ষা করে চলছে তা অস্বাভাবিক ও দৃষ্টি আকর্ষণ করবার মত।
দ্বিতীয়ত: এই দু’বিভাগের পর্যবেক্ষণ ও নজরদারীতে যা কিছু বের হয়ে আসবে তা অবশ্যই কাজী হিসবা’র সামনে
পেশ করতে হবে এবং তিনি এ ব্যাপারে রায় দিবেন।
যদি এ ধরনের পরিস্থিতির উদ্ভব হয় তবেই আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিভাগ রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে অবস্থানরত শত্রুভাবাপন্ন কাফের রাষ্ট্রের বিভিন্ন কর্মকর্তা বা প্রতিনিধিদের সাথে যেসব নাগরিক সম্পর্ক বা যোগাযোগ রক্ষা করে চলে তাদের ব্যাপারে গোয়েন্দাগিরি করবে। অন্যদিকে, একই বাস্তবতার কারণে শত্রুভাবাপন্ন কাফের রাষ্ট্রে অবস্থানরত কাফেরদের বিভিন্ন কর্মকর্তা বা প্রতিনিধিদের সাথে খিলাফত রাষ্ট্রের যেসব নাগরিক সম্পর্ক বা যোগাযোগ রক্ষা করে চলে ও সেসব রাষ্ট্রে ঘন ঘন ভ্রমণ করে তাদের উপর যুদ্ধবিভাগ গোয়েন্দাগিরি করবে। এগুলোর ব্যাপারে দলিল হল:
১. নিম্নোক্ত আয়াত অনুসারে মুসলিমদের উপর গোয়েন্দাগিরি করা হারাম। আল্লাহ্ বলেন,
‘এবং একে অপরের গোপনীয় বিষয় অনুসন্ধান (গোয়েন্দাগিরি) করো না।’
[সূরা হুযুরাত-১২]
এটা হল গোয়েন্দাগিরি নিষিদ্ধের ব্যাপারে স্বাভাবিক নিষেধাজ্ঞা এবং উপযুক্ত প্রমাণ ব্যতীত তা মেনে চলতে হবে। আল মুকদাদ ও আবু উমামাহ থেকে বর্ণিত এ হাদীসটিকে আহমাদ এবং আবু দাউদ নিশ্চিত করেছেন: রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেছেন,
“যদি কোন আমীর তার লোকদের ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করেন তাহলে তিনি তাদেরকে অপমানিত করলেন।’
(সূনানে আবু দাউদ, হাদীস নং-৪৮৮৯ এবং আল হাইছামী, মাজমা’ আল-জাওয়ায়িদ, খন্ড ৫, পৃষ্ঠা ২১৮)
সুতরাং, উপরোক্ত দলিলসমূহ থেকে এটা স্পষ্ট যে, মুসলিমদের বিষয়ে গুপ্তচরবৃত্তি করা নিষিদ্ধ। রাষ্ট্রের অমুসলিম নাগরিকদের ব্যাপারেও এ নিয়ম প্রযোজ্য। সুতরাং, মুসলিম বা অমুসলিম যে কোন নাগরিকের উপর গোয়েন্দাগিরি করা নিষিদ্ধ।
২. সেসব কাফের যারা খিলাফত রাষ্ট্রের সাথে যুদ্ধাবস্থায় রয়েছে এবং যাদের সাথে যুদ্ধের সম্ভাবনা রয়েছে – যেমন: যারা দূত হিসাবে বা চুক্তির কারণে আমাদের রাষ্ট্রে আগত; কিংবা, নিজ দেশে অবস্থানরত মুসলিমদের সাথে প্রকৃত যুদ্ধরত কাফেরদের উপর গোয়েন্দাগিরি করা বৈধ। প্রকৃত অর্থে, প্রকৃত যুদ্ধরত কাফেরদের উপর গোয়েন্দাগিরি করা আবশ্যক এবং ক্ষতির সম্ভাবনা থাকলে শত্রুভাবাপন্ন কাফেরের ব্যাপারে গোয়েন্দাগিরি ক্ষেত্র বিশেষে ফরয।
— এ ব্যাপারে দলিলসমূহ রাসূলুল্লাহ্ (সা) এর সীরাত থেকে স্পষ্ট:
সীরাত ইবনে হিশামে আবদুল্লাহ ইবনে জাহশের (রা) অভিযান সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, নবী (সা) তাঁকে দুই দিন ভ্রমণ করার নির্দেশ দেন। দুই দিন ভ্রমণের পর আবদুল্লাহ ইবনে জাহশ রাসূলুল্লাহ্ (সা) এর চিঠিখানা খুললেন এবং পড়লেন। যেখানে তাঁকে বলা হয়েছে, ‘আমার চিঠিখানা পড়ার পর তুমি মক্কা ও তায়েফের মধ্যবর্তী নাকলাহ্ পর্যন্ত ভ্রমণ করবে; তারপর সেখানে তাঁবু স্থাপন করবে এবং কুরাইশদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে আমাদের জন্য তথ্য সংগ্রহ করবে।’
— সীরাত ইবনে হিশামে বদরের যুদ্ধ সম্পর্কে বর্ণিত আছে যে, ইবনে ইসহাক বলেন:
‘রাসূলুল্লাহ্ (সা) এবং আবু বকর (রা) ঘোড়ার পিঠে যাত্রা করছিলেন যতক্ষণ পর্যন্ত না তাঁদের একজন বয়োবৃদ্ধ আরবের সাথে সাক্ষাৎ হল। তিনি (সা) ঐ ব্যক্তির কাছে কুরাইশ, মুহাম্মদ এবং তাঁর সাহাবীদের সম্পর্কে কোন তথ্য জানে কিনা জিজ্ঞেস করলেন। সে বলল, আমি ততক্ষণ পর্যন্ত কোন তথ্য দেব না যতক্ষণ পর্যন্ত না তোমরা কোত্থেকে এসেছ এ ব্যাপারে আমাকে বল। রাসূল (সা) বললেন, যদি তুমি আমাদের তথ্য দাও তাহলে আমরাও তোমাকে দেব। লোকটি বলল, তাহলে কি এটার বিনিময়ে ওটা? তিনি বললেন, হ্যাঁ। সে তখন বলল, অমুক দিন, যদি লোকটি আমাকে সত্য বলে থাকে তাহলে তারা অমুক অমুক জায়গায় থাকবে; একথা বলে সে কুরাইশদের অবস্থানের জায়গার নাম উল্লেখ করে বললো। তারপর লোকটি বলল, তোমরা কোত্থেকে এসেছ? রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন: জলাশয় এবং তিনি তারপর তাঁর কাছ থেকে চলে এলেন। ইবনে ইসহাক বলেন, লোকটি তখন বলছিল, জলাশয় নাকি ইরাকের জলাশয়? তারপর রাসূলুল্লাহ্ (সা) সাহাবীদের কাছে ফিরে গেলেন। যখন রাত নেমে এল তখন তিনি আলী ইবনে আবি তালিব, জুবায়ের ইবনে আল আওয়াম এবং সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস সহ আরও কিছু সাহাবীকে খবর সংগ্রহের জন্য বদরের কূপের দিকে পাঠালেন অর্থাৎ কুরাইশদের ব্যাপারে গোয়েন্দাগিরি করার জন্য।’
— ইবনে ইসহাক আরও বলেছেন যে, ইবনে হিশাম তার সীরাত গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ‘বাসবাস ইবনে আমরু এবং আদী ইবনে আবু আল জাগবা খবর সংগ্রহের জন্য গুপ্তচরবৃত্তি করতেন।’ তিনি বলেছেন, তারা কুরাইশদের ব্যাপারে দু’জন দাসীর কথোপকথন শুনতে পেলেন। শোনামাত্র তারা লাফিয়ে উটের পিঠে উঠলেন এবং যা শুনেছেন সে সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ্ (সা) কে অবগত করলেন।
যদিও এ তথ্যসমূহ কুরাইশদের সম্পর্কে ছিল – যারা ছিল মুসলিমদের সাথে প্রকৃত অর্থে যুদ্ধরত কাফের। কিন্তু, এ বিধানটি সম্ভাব্য শত্রুভাবাপন্ন কাফেরদের বেলায়ও প্রযোজ্য, কারণ তাদের সাথে যুদ্ধের সম্ভাবনা রয়েছে। পার্থক্য শুধু এতটুকু যে, প্রকৃত যুদ্ধরত কাফেরদের উপর গোয়েন্দাগিরি করা বাধ্যতামূলক, কারণ শত্রুকে পরাজিত করার যুদ্ধকৌশল হিসাবে এটা প্রয়োজন। আর, অন্যদিকে সম্ভাব্য শত্রুভাবাপন্ন কাফেরদের জন্য বিষয়টি অনুমোদিত; কারণ তাদের সাথে যুদ্ধ কাঙ্খিত। তবে, যদি তাদের কাছ থেকে কোন ধরনের ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে, যেমন এটা যদি ধারণা করা হয় যে তারা প্রকৃত যুদ্ধরত কাফেরদের সহযোগিতা করবে কিংবা প্রকৃতঅর্থে তাদের সাথে যুদ্ধে যোগদান করবে, তবে তাদের বেলায়ও গোয়েন্দাগিরি করা ফরয হয়ে যায়।
সুতরাং, কাফের শত্রুদের বিরুদ্ধে গোয়েন্দাগিরি করা মুসলিমদের জন্য অনুমোদিত এবং রাষ্ট্রকে বাধ্যতামূলকভাবে এ দায়িত্ব পালন করতে হবে। রাসূলুল্লাহ্ (সা) এর নির্দেশের কারণেই তা করতে হবে; কিংবা এক্ষেত্রে এ শারী’আহ্ মূলনীতিও প্রযোজ্য যে, ‘ফরয সম্পাদনের জন্য যা কিছু করা প্রয়োজন তাও ফরয।’
খিলাফত রাষ্ট্রের কোন নাগরিক, সে মুসলিম হোক বা না হোক, যদি কাফের শত্রুদের সাথে ঘন ঘন সাক্ষাৎ করে (তারা আমাদের সাথে প্রকৃত অর্থে যুদ্ধরত কাফের হোক বা আমাদের সম্ভাব্য শত্রু হোক, তারা নিজ দেশে অবস্থান করুক বা আমাদের দেশে অবস্থান করুক), তবে উক্ত নাগরিক সন্দেহভাজন ব্যক্তি বলে বিবেচিত হবে এবং তার উপর গোয়েন্দাগিরি করা ও তার ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহ করা অনুমোদিত হবে। কারণ, তারা এমন কারও সাথে সম্পর্ক রাখছে যাদের উপর গোয়েন্দাগিরি করা অনুমোদিত। এছাড়া, তারা যদি কাফেরদের সাহায্যর্থে গুপ্তচরবৃত্তি করে থাকে তাহলে রাষ্ট্রের প্রবল ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে।
তবে, এ ধরনের নাগরিকদের উপর গোয়েন্দাগিরি করার পূর্বে উপরোল্লিখিত বিষয় দুটি ভালভাবে খতিয়ে দেখতে হবে। যুদ্ধ বিভাগ সেইসব নাগরিকদের উপর গোয়েন্দাগিরি করবে যারা আমাদের সাথে যুদ্ধরত কাফেরদের সাথে ঘন ঘন সাক্ষাৎ করে এবং যারা শত্রুভাবাপন্ন কাফেরদের কর্মকর্তা ও প্রতিনিধিদের সাথে তাদের দেশে ঘন ঘন সাক্ষাৎ করে। আর, আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিভাগ সেইসব নাগরিকের ব্যাপারে গোয়েন্দাগিরি করবে যারা খিলাফত রাষ্ট্রে অবস্থানরত শত্রুভাবাপন্ন দেশের কাফেরদের কর্মকর্তা ও প্রতিনিধিদের সাথে নিবিড় সম্পর্ক রক্ষা করে।