আমীরুল জিহাদ-যুদ্ধ বিভাগ (সেনাবাহিনী)

যুদ্ধ বিভাগ হল রাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। এর প্রধানকে জিহাদের ব্যবস্থাপক না বলে আমীরুল জিহাদ বলা হয়। এর কারণ, রাসূলুল্লাহ্ (সা) সেনাবাহিনীর প্রধানদের আমীর নাম দিয়েছেন। ইবনে সাদ বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেছেন, 

যায়েদ বিন হারিছাহ হল মুসলিমদের আমীর; যদি তিনি শহীদ হয়ে যান তাহলে আমীর জাফর বিন আবি তালিব; এবং তিনি যদি শহীদ হন তাহলে আমীর আবদুল্লাহ ইবনে রুয়াহাহ্ এবং তিনিও যদি শহীদ হন তাহলে মুসলিমরা তাদের মধ্য হতে একজনকে আমীর নির্বাচিত করে নেবে।’

ইমাম বুখারী আব্দুল্লাহ্ ইবন উমর (রা) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, “আল্লাহ্’র রাসূল (সা) মুতার যুদ্ধে যায়িদ ইবন হারিছাহ্’কে আমীর নিযুক্ত করেছিলেন…” আল বুখারী সালামাহ্ ইবন আল-আকওয়া বর্ণিত একটি হাদীস থেকে বর্ণনা করেছেন যে,“আমি যায়িদের সাথে একটি যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলাম এবং তাকে আমাদের আমীর নিযুক্ত করা হয়েছিল।”

আবুদল্লাহ বিন উমর (রা) থেকে বুখারী ও মুসলিম বর্ণনা করেন যে: ‘নবী (সা) (যুদ্ধের উদ্দেশ্যে) একটি সেনাবাহিনী প্রেরণ করেন এবং তাতে উসামা বিন যয়িদকে আমীর মনোনীত করেন। কেউ কেউ তার নেতৃত্বের ব্যাপারে সন্দেহ প্রকাশ করে। তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেন, 

‘তোমরা যদি তার নেতৃত্বে সন্দেহ প্রকাশ কর তাহলে তার পিতার নেতৃত্বেও সন্দেহ প্রকাশ করলে। আল্লাহ্’র কসম! সে অবশ্যই নেতৃত্বের যোগ্য…।’
(সহীহ্ বুখারী, হাদীস নং-৪২৫০; সহীহ্ মুসলিম, হাদীস নং-২৪৩৬) 

সাহাবীগণ (রা) সাধারণত মু’তার সেনাবাহিনীকে ‘আমীরদের সেনাবাহিনী’ বলে অভিহিত করতেন। ইবনে বুরাইদা হতে মুসলিম বর্ণনা করেছেন যে, তিনি বলেছেন, “রাসূলুল্লাহ্ (সা) যখন কাউকে কোন বাহিনী অথবা অভিযানের আমীর নিযুক্ত করতেন তখন তাকে উপদেশ দিতেন…।’ 

যুদ্ধবিভাগ সশস্ত্রবাহিনীর সাথে সম্পৃক্ত সব বিষয়ের দায়িত্ব গ্রহণ করবে: যেমন, সেনাবাহিনী, সরঞ্জাম, অস্ত্র, বিস্ফোরক এবং এ জাতীয় জিনিসপত্র। এছাড়াও মিলিটারী একাডেমী, সেনা মিশন, সেনাসদস্যদের ইসলামী এবং সাধারণ জ্ঞানার্জনের জন্য যা যা প্রয়োজন এবং যুদ্ধ ও এর পরিকল্পনা সম্পর্কিত সকল বিষয়ের দায়িত্বও যুদ্ধবিভােেগর উপর থাকবে। এছাড়া, মুসলিমদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত শত্রু রাষ্ট্রগুলোতে গোয়েন্দা প্রেরণ করাও যুদ্ধবিভাগের একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব এবং এজন্য একটি বিশেষ বিভাগ থাকবে। রাসূলুল্লাহ্ (সা) এর সীরাত থেকে এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। 

এসব কিছুই যুদ্ধবিভাগের তত্ত্বাবধানের থাকবে ও পরিচালিত হবে। কারণ, এ বিভাগের নামই নির্দেশ করে যে  যুদ্ধ বিগ্রহের সাথে সম্পর্কযুক্ত সমস্ত কিছু এ বিভাগের অধীনে থাকবে। যুদ্ধের জন্য সেনাবাহিনী প্রয়োজন। আর, সেনাবাহিনীকে নেতৃত্ব, চীফ অব স্টাফ, কর্মকর্তা ও সৈন্যের মাধ্যমে সংগঠিত ও প্রস্তুত করা প্রয়োজন। 

এছাড়া, সেনাবাহিনীকে সুসংগঠিত করার জন্য শারীরিক ও প্রযুক্তিগত দক্ষতা ও প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। এই প্রশিক্ষণ কর্মসূচীগুলোর মধ্যে যুদ্ধের কলাকৌশল, বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র পরিচালনা শিক্ষা, উন্নত ও আধুনিক অস্ত্রের ব্যবহার শিক্ষা ইত্যাদি অন্তর্ভূক্ত। সুতরাং, প্রযুক্তিগত ও সামরিক শিক্ষা, যুদ্ধকৌশল আয়ত্বের জন্য প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র পরিচালনা শিক্ষা ইত্যাদি সেনাবাহিনীর জন্য অপরিহার্য। 

আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা মুসলিম উম্মাহ্’কে সমগ্র বিশ্বের কাছে ইসলামের আহ্বান পৌঁছে দেবার দায়িত্ব প্রদান করে সম্মানিত করেছেন। এ লক্ষ্যে তিনি দাওয়াত ও জিহাদকে ইসলাম প্রচারের পদ্ধতি হিসাবে নির্ধারণ করে দিয়েছেন এবং তিনি মুসলিমদের উপর জিহাদকে ফরয করেছেন। তাই, জিহাদের প্রস্তুতি হিসাবে প্রতিটি মুসলিম পুরুষ, যারা পনের বছর বয়সে উপনীত হয়েছে তাদের জন্য সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করা বাধ্যতামূলক। আর, স্থায়ীভাবে সেনাবাহিনীতে যোগদানের ব্যাপারটি হল মুসলিমদের একটি সম্মিলিত দায়িত্ব (ফরযে কিফায়া)।  সামরিক বাহিনীতে যোগদানের ব্যাপারে পবিত্র কুর’আনের সুস্পষ্ট দলিল আছে: 

‘আর তাদের সাথে যুদ্ধ কর যতক্ষণ পর্যন্ত না ফিতনা নিশ্চিহ্ন হয়; এবং দ্বীন শুধুমাত্র আল্লাহ্’র জন্যই নির্দিষ্ট হয়।’[সূরা আনফাল : ৩৯]

এ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ্ (সা) এর হাদীসও আছে, 

‘মুশরিকদের বিরুদ্ধে তোমাদের সম্পদ, হাত ও জিব্বাহ দ্বারা জিহাদ কর।’ আনাস (রা) হতে আবু দাউদ এ হাদীস বর্ণনা করেন।
(সূনানে দাউদ, হাদীস নং-২৫০৪)

শত্রুকে পরাজিত করা এবং নতুন নতুন ভূখন্ড জয় করার লক্ষ্যে শারী’আহ্ নির্ধারিত পথে জিহাদ পরিচালনার জন্য সামরিক প্রশিক্ষণ অপরিহার্য; এবং এ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করা জিহাদের মতোই ফরয। কেননা শারী’আহ্ মূলনীতি হল, ‘ফরয সম্পাদনের জন্য যা করা প্রয়োজন সেটাও ফরয’। বস্তুতঃ জিহাদে যোগদানের জন্য চেষ্টা করা জিহাদের আদেশের অর্ন্তভুক্ত। কারণ, যখন আল্লাহ্  বলেন, ‘আর তাদের সাথে যুদ্ধ কর’- এটা একই সাথে যুদ্ধ করা এবং যে সমস্ত বিষয় যুদ্ধ করাকে সম্ভব করে তোলে তা করার নির্দেশ। এছাড়াও আল্লাহ্  বলেন, 

‘আর প্রস্তূত কর তাদের সাথে যুদ্ধের জন্য যাই কিছু সংগ্রহ করতে পার নিজের শক্তি সামর্থ্যরে মধ্যে থেকে’
[সূরা আনফাল:৬০]

প্রশিক্ষণ গ্রহণ ও উচ্চমান সম্পন্ন সামরিক দক্ষতা অর্জন যুদ্ধ প্রস্তুতির অন্তর্ভূক্ত; কেননা যুদ্ধ করাকে সম্ভব করে তোলার জন্য এ বিষয়গুলোর উপস্থিতি আবশ্যকীয়। সুতরাং, সামরিক প্রশিক্ষণ সামরিক শক্তিরই অংশ যা অবশ্যই অর্জন করতে হবে, যেমন: সামরিক যন্ত্রপাতি এবং সামরিক মিশন ইত্যাদির বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ ইত্যাদি। 

আর, স্থায়ীভাবে সেনাবাহিনীতে অংশগ্রহণ কিংবা সেনাবাহিনী গঠনার্থে জনবল নিয়োগ করার ক্ষেত্রে বলা যায় যে, সঠিক ও কার্যকরভাবে জিহাদ সম্পাদন এবং জিহাদের সাথে সম্পর্কিত সকল দায়িত্ব পালনের জন্য মুজাহিদিন-এর উপস্থিতি অপরিহার্য এবং এটা আমাদের জন্য ফরয। কারণ, শত্রু আক্রমণ করুক বা না করুক ইসলামের বাণীকে বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে অব্যাহত ভাবে জিহাদ পরিচালনা করা মুসলিমদের উপর অর্পিত ফরয দায়িত্ব। এজন্যই স্থায়ীভাবে সেনাবাহিনীতে অংশগ্রহণ করা মুসলিমদের জন্য ফরযে কিফায়াহ্ (সামষ্টিক দায়িত্ব) এবং এ দায়িত্ব জিহাদের শারী’আহ্ আদেশেরই অন্তর্ভূক্ত। 

জিহাদে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে পনের বছর পূর্ণ হবার বাধ্যবাধকতা প্রসঙ্গে নাফিঈ’র বরাত থেকে আল বুখারী বর্ণিত হাদীসটি দলিল হিসাবে উপস্থাপন করা যায়: 

ইবনে উমর (রা) আমাকে (নাফিঈ’কে) বলেছেন যে, ওহুদের দিন রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাঁর দিকে তাকালেন, তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র চৌদ্দ এবং সে কারণে রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাঁকে যুদ্ধে যাবার অনুমতি দেননি। আবার খন্দকের যুদ্ধের দিন তিনি আমার দিকে তাকালেন এবং যুদ্ধে যাবার অনুমতি দিলেন। তখন আমার বয়স ছিল পনের।” (সহীহ্ বুখারী, হাদীস নং-২৬৬৪)

এছাড়া, নাফিঈ আরও বলেছেন যে, “যখন উমর বিন আবদুল আজিজ খলীফা ছিলেন তখন তাঁর সাথে আমি সাক্ষাৎ করতে যাই। আমি তাঁকে এ হাদীস সম্পর্কে বলার পর তিনি বললেন, ‘এটাই হল কৈশোর ও বয়ঃপ্রাপ্ত হবার মধ্যকার সীমা। সুতরাং, তিনি তাঁর গভর্ণরদেরকে যাদের পনের বছর হয়েছে তাদের উপর দায়িত্ব অর্পণ করার নির্দেশ দেন।” অর্থাৎ তাদের জন্য সামরিক কোষাগার থেকে অর্থ বরাদ্দের নির্দেশ দেন।

এ সকল দলিল-প্রমাণ থেকে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে, কোন মুসলিম (পুরুষ) পনের বছর বয়সে পৌঁছানোর সাথে সাথে তাকে সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে হবে। 

সেনাবাহিনীর বিভাগসমূহ

সেনাবাহিনীকে প্রধানত দু’ভাগে বিভক্ত করা হবে। প্রথম ভাগে থাকবে “রিজার্ভ সেনাবাহিনী”- যার মধ্যে জিহাদ করতে সক্ষম প্রতিটি মুসলিম পুরুষ অন্তর্ভুক্ত থাকবে। আর, দ্বিতীয় ভাগে থাকবে “নিয়মিত সেনাবাহিনী”- যাদের স্থায়ীভাবে সেনাবাহিনীতে নিয়োগ দেয়া হবে এবং রাষ্ট্রের অন্যান্য যে কোন কর্মচারীর মতোই রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে তাদের বেতনভাতা প্রদান করা হবে।

বস্তুতঃ রিজার্ভ বাহিনীর ধারণা এসেছে প্রতিটি মুসলিমের উপর জিহাদ ফরয হবার শারী’আহ্ অর্পিত বাধ্যবাধকতা থেকে। কারণ, হুকুম শারী’আহ্ প্রতিটি সক্ষম মুসলিমের উপর জিহাদ ফরয করেছে। তাই, এ নির্দেশ একইসাথে জিহাদের জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ নেয়াকেও বাধ্যতামূলক করেছে। এছাড়া, নিয়মিত বাহিনী প্রস্তুত রাখার ব্যাপারটি “ফরয পালনের জন্য যা প্রয়োজন তা নিজেই ফরয” এ শারী’আহ্ মূলনীতির ভিত্তিতে গৃহীত হয়েছে। যেহেতু, একটি স্থায়ী ও নিয়মিত সেনাবাহিনী ব্যতীত জিহাদের দায়িত্ব অবিরামভাবে পালন করা এবং ইসলাম ও মুসলিমদের কাফিরদের হাত থেকে রক্ষা করা কোনভাবেই সম্ভব নয়, সেহেতু খলীফাকে অবশ্যই একটি স্থায়ী সেনাবাহিনী প্রস্তুত রাখতে হবে।

আর, সেনাসদস্যদের বেতন-ভাতার ক্ষেত্রে বলা যায় যে, তাদেরকে অবশ্যই রাষ্ট্রের অন্যান্য কাজে নিয়োজিত কর্মচারীদের মতোই দেখতে হবে। একজন অমুসলিমের উপর জিহাদ করার কোন বাধ্যবাধকতা নেই। কিন্তু, কোন অমুসলিম যদি স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে জিহাদে অংশগ্রহণ করতে চায় তাহলে তাকে অনুমতি দেয়া হবে এবং এর জন্য তাকে বেতনভাতা প্রদান করাও শারী’আহ্ সম্মত হবে। কারণ, আল-জুহরী থেকে আল-তিরমিযী বর্ণনা করেছেন যে, 

‘রাসূলুল্লাহ্ (সা) কিছু ইহুদীদের কাছ থেকে (যুদ্ধকালীন) সেবা গ্রহণ করেছিলেন এবং এ ব্যাপারে তাদের জন্য পারিশ্রমিকও বরাদ্দ করেছিলেন।’

এছাড়া, ইবনে হিশাম বর্ণনা করেছেন যে, ‘সাফওয়ান বিন উমাইয়া রাসূলুল্লাহ্ (সা) এর সাথে হুনায়নে একটি অভিযানে যান, যদিও তখন সে মুশরিক ছিল এবং রাসূলুল্লাহ্ (সা) নওমুসলিমদের (মু’য়াল্লাফাতি কুলুবিহীম) জন্য রক্ষিত গণীমতের মাল থেকে কিছু অর্থ তার জন্য বরাদ্দ করেন।’ 

সুতরাং, মুসলিম সেনাবাহিনীর সাথে অমুসলিমরাও যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারবে এবং সেনাবাহিনীতে তাদের উপস্থিতির জন্য তাদের অর্থও প্রদান করা যাবে। তাছাড়া, ইজারা’র সংজ্ঞা অনুযায়ী নিয়োগকারী ব্যক্তি নিযুক্ত ব্যক্তির কাছ থেকে কোন উপযোগ গ্রহণ করলে ক্ষতিপূরণবাবদ সেই ব্যক্তি পারিশ্রমিক পেয়ে থাকে। তাই, এই নীতির ভিত্তিতে যে কেউ পারিশ্রমিকের বিনিময়ে যে কাউকে কোন কাজে নিযুক্ত করতে পারে। সেনাবাহিনীতে অমুসলিম নিয়োগ করা এই ধরনের ইজারা’র চুক্তির মধ্যে পড়ে, কারণ এটাও এক ধরনের উপযোগ। সুতরাং, উপযোগ প্রাপ্তির লক্ষ্যে কাউকে নিযুক্ত করার ব্যাপারে যে শারী’আহ্ দলিল-প্রমাণগুলো পাওয়া যায় তার ভিত্তিতেই অমুসলিমদের সামরিকসেবা ও যুদ্ধের জন্য সেনাবাহিনীতে নিয়োগ করা বৈধ।

এটা গেল অমুসলিমদের কথা। আর, মুসলিমদের জন্য জিহাদ একটি ইবাদত হলেও ইজারা’র দলিল-প্রমাণের আওতায় সামরিক সেবা ও যুদ্ধের জন্য মুসলিমদেরও অর্থের বিনিময়ে নিযুক্ত করা যাবে। ইবাদতের ক্ষেত্রে কাউকে পারিশ্রমিক দেয়া তখনই বৈধ হবে যখন এর উপযোগ ঐ ব্যক্তিকে ছাড়িয়ে যাবে। এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেছেন, 

‘পারিশ্রমিকের জন্য সবচাইতে উপযুক্ত কাজ হল আল্লাহ্’র কিতাব শিক্ষা দেয়ার মাধ্যমে পারিশ্রমিক গ্রহণ করা।’ এ হাদীসটি ইবনে আব্বাস হতে বুখারী বর্ণনা করেছেন।
(সহীহ্ বুখারী, হাদীস নং-৫৭৩৭) 

আল্লাহ্’র কিতাব শিক্ষা দেয়া একটি ইবাদত। যেহেতু, আল্লাহ্’র কিতাব শিক্ষা দেয়া, আযান দেয়া এবং নামাযে ইমামতি করা, এ সবকিছুর জন্যই যে কোন মুসলিমকে অর্থের বিনিময়ে নিযুক্ত করা অনুমোদিত সেহেতু সামরিক সেবা বা জিহাদের মত ইবাদতের জন্যও কাউকে অর্থের বিনিময়ে নিযুক্ত করা শারী’আহ্ সম্মত হবে। কেননা এসব কাজের উপযোগিতা (benefit) সম্পাদনকারী ব্যক্তিকে ছাড়িয়ে যায়। তাছাড়া, মুসলিমদের জন্য জিহাদ ফরয হওয়া সত্ত্বেও অর্থের বিনিময়ে কোন মুসলিমকে জিহাদে নিযুক্ত করার ব্যাপারে সুস্পষ্ট দলিল রয়েছে, যা কিনা রাসূল (সা) এর হাদীসে স্পষ্টভাবে উল্লেখিত হয়েছে। আবদুল্লাহ বিন আমরু থেকে আবু দাউদ বর্ণনা করেছেন যে, রাসূল (সা) বলেছেন: 

‘আল গাজীর জন্য বেতন-ভাতা রয়েছে এবং আল জা’ইলের জন্যও বেতন-ভাতা রয়েছে …।’
(সূনানে আবু দাউদ, হাদীস নং-২৫২৬)

আল গাজী এমন একজন ব্যক্তি যে নিজের জন্য জিহাদ করেছে। আর, আল জাইল এমন একজন ব্যক্তি যার পক্ষে আরেকজন পারিশ্রমিকের বিনিময়ে জিহাদ করেছে। আল মুহিত অভিধানে এ ব্যাপারে উল্লেখ আছে যে, আল জা’আলা শব্দের অর্থ হলো কাউকে তার কাজের বিনিময়ে যে পরিমাণ পারিশ্রমিক দেয়া হয় এবং একজন মুজাহিদ (গাজী) যদি তোমার তরফ থেকে নিয়োগ পেয়ে জিহাদ করে এবং তার কাজের বিনিময়ে যে পরিমান পারিশ্রমিক দেয়া হয় তা হল জু’ল”। সুতরাং এ হাদীস থেকে বুঝা যায় যে, পারিশ্রমিকের বিনিময়ে একজনের পক্ষে অন্য আরেকজন জিহাদ করতে পারবে এবং জিহাদের জন্য কাউকে অর্থের বিনিময়ে নিযুক্ত করা যাবে।   

জুবায়ের বিন নুফায়ের থেকে আল বায়হাকী বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেন, 

‘আমার উম্মতের মধ্যে যারা জিহাদ করে এবং পারিশ্রমিক গ্রহণ করে এবং তাদের শত্রুদের বিরুদ্ধে নিজেদের শক্তিশালী করে তারা যেন মুসার মাতার মত – যে মুসাকে দুধ পান করিয়েছে এবং তার আজর (পুরষ্কার) গ্রহণ করেছে।’ 

এখানে আজর বলতে পারিশ্রমিক বুঝানো হয়েছে। সুতরাং, সৈন্যদের অন্যান্য সরকারী কর্মচারীদের মতই বেতন-ভাতা দেয়া যাবে।

মুসলিম সেনাগণ বেতন-ভাতা গ্রহণ করলেও, আল্লাহ্’র কাছ থেকে তারা পুরষ্কার (সওয়াব) থেকে বঞ্চিত হবে না। আর এটা জায়েয হয়েছে আল বুখারীর হাদীস থেকে যেখানে আল্লাহ্’র কিতাব শিক্ষা দিয়ে পারিশ্রমিক নিতে বলা হয়েছে – যা মূলতঃ একটি ইবাদত। অর্থাৎ এ ধরনের শিক্ষক তার নিয়্যত অনুযায়ী আল্লাহ্’র কাছ থেকেও তার জন্য নির্দিষ্ট সওয়াব লাভ করবে।

ইসলামিক সেনাবাহিনী মূলতঃ একটি সেনাবাহিনী যা বিভিন্ন কন্টিনজেন্টের (contingents) সমন্বয়ে গঠিত। এইসব কন্টিনজেন্টকে বিভিন্ন সংখ্যা দ্বারা সংজ্ঞায়িত করা যায় যেমন: প্রথম, দ্বিতীয় ইত্যাদি বা বিভিন্ন প্রদেশের নামেও এদের নামকরণ করা যাবে, যেমন: আল শামের সেনাবাহিনী, মিশরের সেনাবাহিনী, সা’নার সেনাবাহিনী প্রভৃতি।  

ইসলামিক সেনাবাহিনী বিশেষ ক্যাম্পে অবস্থান করে। একটি ক্যাম্পে সেনাগণ একটি ইউনিট হিসেবে অথবা একটি ইউনিটের অংশ বা অনেকগুলো ইউনিট হিসেবে থাকতে পারে। এই ক্যাম্পগুলোকে প্রত্যেকটি প্রদেশে স্থাপন করা উচিত এবং কিছু কিছু ক্যাম্পকে সেনাঘাঁটিতে রূপান্তর করা উচিত। কিছু কিছু ক্যাম্প ভ্রাম্যমান হবে এবং এগুলো হবে বিশাল। এ ক্যাম্পসমুহের নাম দেয়া যেতে পারে, যেমন: হাব্বানিয়ার ক্যাম্প। এবং প্রত্যেক ক্যাম্পের একটি করে ব্যানার থাকতে পারে।   

উল্লেখিত কিছু কিছু বিষয় খলীফার জন্য মুবাহ (অনুমোদিত, permitted matter), যেমন: উলাই’য়াহর নাম অনুসারে সেনাবাহিনীর নামকরণ করা, কোন বিশেষ সংখ্যা দেয়া ইত্যাদি সবই খলীফার মতামত ও ইজতিহাদের উপর নির্ভর করে। আর অন্যান্য বিষয়সমূহের সাথে বাধ্যবাধকতার একটি ব্যাপার আছে, যেমন: রাষ্ট্রকে রক্ষা করবার প্রয়োজনীয়তা, সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী করা, সীমান্তে সেনাবাহিনী প্রেরণ, সব উলাই’য়াহ্ ও কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ক্যাম্প স্থাপন ইত্যাদি।

উমর আল খাত্তাব (রা) সব উলাই’য়াহ্ জুড়ে তার সেনাবাহিনীর ক্যাম্প ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। তিনি একটি ইউনিট ফিলিস্তিনে এবং একটি ইউনিট আল মুসুলে স্থাপন করেছিলেন ইত্যাদি। তিনি অপর একটি ইউনিটকে রাষ্ট্রের কেন্দ্রে রাখতেন এবং আরেকটিকে এক মুহূর্তের নোটিশে মার্চ করবার জন্য প্রস্তুত রাখতেন। 

খলীফা সেনাবাহিনীর প্রধান

খলীফা হলেন সেনাবাহিনীর প্রধান এবং তিনিই চীফ অব স্টাফ, প্রত্যেক ব্রিগেডের আমীর, প্রত্যেক ডিভিশনের কমান্ডার নিয়োগ দিয়ে থাকেন। আর ব্রিগেডের কমান্ডারগণ সেনাবাহিনীর অন্যান্য নেতৃত্ব নিয়োগ দিয়ে থাকেন। সেনাবাহিনীতে কোন স্টাফ নিয়োগ হয়ে থাকে সেনাবাহিনীর সংস্কৃতি ও চীফ অব স্টাফের অনুমোদনক্রমে। 

খলীফা সেনাবাহিনীর প্রধান। কারণ, খলীফা হলেন শারী’আহ্ আইনকানুন বাস্তবায়ন ও বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তে ইসলাম পৌঁছে দেবার জন্য সব মুসলিমের সার্বজনীন নেতৃত্ব। আর, বিশ্বের দরবারে ইসলাম পৌঁছে দেয়ার শারী’আহ্ নির্ধারিত পদ্ধতি হল জিহাদ। সুতরাং, খলীফাকেই জিহাদ পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে, কারণ খিলাফতের চুক্তি তার সাথেই সম্পাদিত হয়েছে। সেকারণে তিনি ছাড়া আর কেউই এ দায়িত্ব পালন করতে পারবে না। খলীফা নিজের কাঁধে এ দায়িত্ব তুলে নেবেন। প্রত্যেক মুসলিমের উপর জিহাদের ফরয দায়িত্ব থাকা সত্ত্বেও এ ব্যাপারে খলীফা দায়িত্ব গ্রহণ করবেন। সুতরাং জিহাদে অংশ নেয়া একটি বিষয় এবং জিহাদের দায়িত্ব কাধে তুলে নেয়া আরেকটি বিষয়। জিহাদে অংশ নেয়া প্রত্যেক মুসলিমের অবশ্য কর্তব্য কিন্তু জিহাদের পুরো দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেয়ার একমাত্র দায়িত্বশীল হলেন খলীফা। 

খলীফা তার প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণ ও তত্ত্বাবধানের আওতায় রেখে তার পক্ষে অন্য কাউকে এ কাজের দায়িত্বভার অর্পণ করতে পারেন। তবে সে ব্যক্তি খলীফার প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণ ও তত্ত্বাবধান ব্যতীত স্বাধীনভাবে এ কাজ করতে পারবে না। এ প্রতিনিধিত্ব খলীফার সহকারীদের মত নয়। খলীফাকে এ ব্যাপারে নিয়মিত রিপোর্ট করার অর্থ হল খলীফার পক্ষ থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি খলীফার প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানের থেকে এ কাজ সম্পাদন করবেন। প্রত্যক্ষ তত্তাবধান ও পর্যবেক্ষণের শর্তে সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব খলীফা পছন্দমত যে কাউকে দিতে পারেন। খলীফাকে নামমাত্র প্রধান রেখে তার তত্তাবধান ও পর্যবেক্ষণ ব্যতীত কাউকে সেনাবাহিনী বা জিহাদের দায়িত্ব অর্পণ করা অনুমোদিত নয়। কেননা খিলাফতের চুক্তি তার সাথেই সম্পাদিত হয়েছে এবং তিনিই এ ব্যাপারে দায়িত্বশীল। অনৈসলামিক ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের প্রধান নামে মাত্র সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক হন এবং আরেকজন ব্যক্তি স্বাধীনভাবে সেনাবাহিনীকে পরিচালনা করেন – যা ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক। এটি এমন একটি বিষয় যা শারী’আহ্ কর্তৃক অনুমোদিত নয়। বরং, হুকুম শারী’আহ্ খলীফাকে সেনাবাহিনীর প্রকৃত নেতৃত্ব গ্রহণ করতে বাধ্য করেছে। এছাড়া, সেনাবাহিনীর প্রশাসনিক ও প্রযুক্তিগত বিষয় সমূহে নেতৃত্ব দেবার ক্ষেত্রে  খলীফা তার পক্ষে স্বাধীনভাবে কাজ করবার জন্য যে কাউকে নিযুক্ত করতে পারেন। তবে এ বিষয়সমূহও খলীফার প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণের আওতায় থাকতে হবে। 

রাসূলুল্লাহ্ (সা) নিজেই সেনাবাহিনী প্রধানের দায়িত্ব পালন করতেন, যুদ্ধের ময়দানে নেতৃত্ব দিতেন এবং যে সব যুদ্ধে তিনি (সা) অংশগ্রহণ করতেন না সেসব যুদ্ধের নেতৃত্ব নির্ধারণ করে দিতেন – যেগুলোকে মূলতঃ অভিযান বলা হয়। প্রত্যেক অভিযানেই তিনি কমান্ডার ঠিক করে দিতেন। এমনকি কিছু কিছু অভিযানে সাবধানতাবশতঃ কোন কমান্ডার নিহত হলে কে তার স্থলাভিষিক্ত হবে সেটাও আগে থেকে ঠিক করে দিতেন, যেমনটি দিয়েছিলেন মু’তার অভিযানের সময়। আবদুল্লাহ বিন উমরের (রা) রেওয়াতে আল বুখারী বর্ণনা করেছেন যে, 

রাসূলুল্লাহ্ (সা) জায়েদ বিন হারিসকে মু’তার যুদ্ধে সৈন্যদের আমীর নিযুক্ত করলেন; অতঃপর রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেন, ‘যদি তিনি শহীদ হয়ে যান তাহলে আমীর হবে জাফর বিন আবি তালিব; আর তিনিও যদি শহীদ হন তাহলে আমীর হবে আবদুল্লাহ ইবনে রুয়াহাহ’’।  

সুতরাং, খলীফাই হচ্ছেন সেই ব্যক্তি যিনি সেনাবাহিনীর আমীর, কমান্ডার, বিভিন্ন বিভাগের আমীরদের নিযোগ দেবেন ও পতাকা বেঁধে দেবেন।  

রাসূলুল্লাহ্ (সা) কর্তৃক মু’তায় প্রেরিত বাহিনী বা উসামার বাহিনী, যে বাহিনীকে সিরিয়া প্রেরণ করা হয়েছিল – তা মূলতঃ একটি ব্রিগেড। কেননা রাসূলুল্লাহ্ (সা) উসামাকে পতাকা বেঁধে দিয়েছিলেন। এছাড়া, আরব উপদ্বীপে যেসব অভিযান পরিচালিত হয়েছে এবং পরে তারা মদীনায় ফেরত এসেছে, যেমন: সাদ বিন আবি ওয়াক্কাসের (রা) মক্কা অভিমুখে গমণকৃত বাহিনী – এটা ছিল একটি ডিভিশন। এ থেকে নির্দেশনা পাওয়া যায় যে, বিভিন্ন ব্রিগেডের আমীর ও ডিভিশনের কমান্ডারদেরও খলীফা নিয়োগ দিয়ে থাকেন। তবে ব্রিগেডের আমীর ও ডিভিশনের কমান্ডার ব্যতীত অন্যান্য আমীরদের রাসূলুল্লাহ্ (সা) নিয়োগ দিয়েছিলেন বলে জানা যায় না। এর অর্থ হল, অভিযানের প্রধানের উপর এ দায়িত্ব তিনি ছেড়ে দিয়েছিলেন। এছাড়া, কারিগরী বা প্রযুক্তি সম্পর্কিত বিষয়ের প্রধান চীফ অব স্টাফকেও খলীফা নিয়োগ দেবেন। তবে, তিনি খলীফার প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণ ছাড়া স্বাধীনভাবে তার কাজ পরিচালনা করতে পারেন – যদিও তাকে সবসময়ই খলীফার নির্দেশাধীন থাকতে হবে।

জিহাদ

Leave a Reply