জিহাদ হল ইসলামের সর্বোচ্চ চূড়া এবং বিশ্বের কাছে ইসলাম পৌঁছে দেবার জন্য ইসলাম নির্ধারিত মৌলিক পদ্ধতি। রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে ইসলামের বিধিবিধান বাস্তবায়নের পর ইসলামের দাওয়াতী কাজ পরিচালনা করা ইসলামী রাষ্ট্রের প্রধান কাজ।
আল্লাহ্’র বাণীকে সুউচ্চে তুলে ধরার জন্য যে যুদ্ধ করা হয় তাকেই জিহাদ বলে। জিহাদ পরিচালনার জন্য প্রয়োজন সেনাবাহিনী এবং সেইসাথে প্রস্তুত করা প্রয়োজন এই বাহিনীর নেতৃত্ব, চীফ অফ স্টাফ, কর্মকর্তা ও সৈনিকদল। এছাড়া, এই সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণ, অস্ত্র ও বিস্ফোরক সরবরাহ এবং যুদ্ধ সরঞ্জামও প্রয়োজন, যার জন্য দরকার শিল্প কারখানা। সুতরাং, শিল্পকারখানা হচ্ছে সেনাবাহিনী ও জিহাদের জন্য একটি অপরিহার্য বিষয়। এই বাস্তবতার কারণে রাষ্ট্রের সব শিল্পকারখানা অবশ্যই যুদ্ধ শিল্পের (war industry) ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠা করা উচিত।
এছাড়াও আভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা যোদ্ধাদের শক্তিবৃদ্ধির সহায়ক হিসাবে কাজ করে। কারণ, যদি আভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি নিরাপদ ও স্থিতিশীল না হয়, তবে তা জিহাদে গমনকারী সৈন্যদের মন ও মগজ বিক্ষিপ্ত করতে পারে। বস্তুতঃ সেনাবাহিনী জিহাদে লিপ্ত থাকার সময় আভ্যন্তরীণ অস্থিতিশীলতা তাদের কর্মদক্ষতার উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, যার পরিণতিতে সেনাবাহিনী ক্রমশঃ দূর্বল হয়ে যায় এবং এ পরিস্থিতি যুদ্ধ অব্যাহত রাখা দুঃসাধ্য করে তোলে।
বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্রের সাথে কুটনৈতিক সম্পর্কও ইসলামী দাওয়াতী কার্য পরিচালনার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
এ কারণে এই চারটি বিভাগ যথা: সেনাবাহিনী, আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা, শিল্প এবং বৈদেশিক সম্পর্ক – খলীফা নিযুক্ত একজন আমীরের নেতৃত্বে একটি মাত্র বিভাগের আওতায় নিয়ে আসা যায়। কারণ, এ চারটি বিষয়ই জিহাদের সাথে সম্পৃক্ত।
তবে, এ চারটি বিভাগকে পরস্পর পরস্পর থেকে আলাদা রাখাও অনুমোদিত। সেক্ষেত্রে, প্রত্যেক বিভাগের জন্য খলীফা একজন ব্যবস্থাপক এবং সেনাবাহিনীর একজন আমীর নিযুক্ত করবেন।
রাসূলুল্লাহ্ (সা) সাধারণত বিভিন্ন অভিযানে প্রেরণের সময় নিজেই সেনাবাহিনীর আমীর নিযুক্ত করতেন – যার সাথে শিল্পের কোন সম্পর্ক ছিল না অর্থাৎ শিল্প বিভাগের জন্য তিনি (সা) অন্য কাউকে নিযুক্ত করতেন। আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য, যেমন: পুলিশ, টহল পুলিশ, হাইওয়ে ডাকাতি বা সাধারণ চৌর্যবৃত্তি প্রতিরোধ করা ইত্যাদি। বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। রাসূলুল্লাহ্ (সা) এর সময়ে বৈদেশিক সম্পর্ক যে আলাদা একটি বিভাগের অধীণে ছিল তা বিভিন্ন রাজা-বাদশাহদের কাছে তাঁর প্রেরিত চিঠি থেকেই বোঝা যায়।
একজন ব্যবস্থাপক নিয়োগের মাধ্যমে প্রতিটি বিভাগকে পরস্পর পরস্পর থেকে পৃথক করার বিষয়টি নিম্নোক্ত দলিলগুলো দ্বারা প্রমাণিত:
প্রথমত: সেনাবাহিনী
— রাসূলুল্লাহ্ (সা) মুতার যুদ্ধে যায়েদ বিন হারিস (রা) কে আমীর নিযুক্ত করেছিলেন এবং তিনি শহীদ হয়ে গেলে পর্যায়ক্রমে যারা নেতৃত্বে থাকবে তাদের নামও নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন। ইবনে সা’দ থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেছিলেন,
‘যায়েদ বিন হারিস সৈন্যদের আমীর; যদি তিনি শহীদ হয়ে যান তাহলে জাফর বিন আবি তালিব; এবং তিনি যদি শহীদ হন তাহলে আবদুল্লাহ ইবনে রুয়াহাহ্ এবং তিনিও যদি শহীদ হন তাহলে মুসলিমগই তাদের মধ্য হতে একজনকে আমীর নির্বাচিত করে নেবে।’
আবুদল্লাহ বিন উমর (রা) থেকে আল বুখারী বর্ণনা করেছেন যে,
‘মু’তার অভিযানে রাসূলুল্লাহ্ (সা) যায়েদ বিন হারিসকে আমীর নিযুক্ত করলেন…’
সালামাহ্ ইবনে আল আকওয়া থেকে আল বুখারী আরও বর্ণনা করেছেন যে, ‘আমি যায়েদের সাথে যুদ্ধ করতে গিয়েছিলাম এবং তাকে আমাদের আমীর নিযুক্ত করা হয়েছিল।’
আবুদল্লাহ বিন উমর (রা) থেকে বুখারী ও মুসলিম বর্ণনা করেছেন যে,
‘নবী (সা) একটি সেনাবাহিনী প্রেরণ করেন এবং তাতে ওসামা বিন যায়েদকে আমীর মনোনীত করেন। কেউ কেউ তার নেতৃত্বের ব্যাপারে সন্দেহ প্রকাশ করে। তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেন, ‘তোমরা যদি তার নেতৃত্বে সন্দেহ প্রকাশ কর তাহলে তার পিতার নেতৃত্বেও সন্দেহ প্রকাশ করলে। আল্লাহ্’র কসম! সে অবশ্যই নেতৃত্বের যোগ্য…।’
(সহীহ্ বুখারী, হাদীস নং-৪২৫০; সহীহ্ মুসলিম, হাদীস নং-২৪৩৬)
সাহাবীগণ (রা) সাধারণত মু’তার সেনাবাহিনীকে ‘আমীরদের সেনাবাহিনী’ নামে অভিহিত করতেন। ইবনে বুরাইদা হতে মুসলিম বর্ণনা করেছেন যে, ইবন বুরাইদা বলেছেন, “রাসূলুল্লাহ্ (সা) যখন কাউকে কোন বাহিনীর অথবা অভিযানের আমীর নিযুক্ত করতেন তখন উপদেশ দিতেন…।”
— আবু বকর (রা) খালিদ (রা) কে মুরতাদদের বিরুদ্ধে ও ইয়ারমুকের যুদ্ধে আমীর নিযুক্ত করেন। খলীফা বর্ণনা করেছেন যে, ‘তিনি খালিদ ইবনে ওয়ালিদকে লোকদের উপর নেতৃত্ব দিলেন এবং ছাবিত ইবনে কায়েস ইবনে সাম্মাসকে নিযুক্ত করলেন বিশেষ করে আনসারদের উপর। যদিও খালিদ তাদের সবাইকেই নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন।” ইয়ারমুকের যুদ্ধে খালিদের নেতৃত্বের অধীণে আবু বকর আল শামের সেনাবাহিনীকে একত্রিত করেছিলেন। ইবনে জারীর বলেছেন, ‘তিনি ইরাকে অবস্থানরত খালিদকে আল শামের সেনাবাহিনীর আমীর নিযুক্ত করার জন্য ডেকে পাঠান।’ এছাড়া, উমর (রা) আল-শামের সেনাবাহিনীকে আবু উবাইদা’র নেতৃত্বাধীনে একত্রিত করেছিলেন। ইবনে আসকীর বলেছেন, ‘এবং তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি আশ-শামে আমীরদের আমীর নিযুক্ত করেন।’
দ্বিতীয়ত: আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা
আল বুখারী আনাস (রা) হতে বর্ণনা করেছেন যে,
‘আমীরদের সাথে কথা বলার সময় কায়েস ইবনে সা’দ পুলিশের মত রাসূলুল্লাহ্ (সা) এর সামনে থাকত।’
(সহীহ্ বুখারী, হাদীস নং-৭১৫৫)
এখানে কায়েস ইবনে সা’দ ইবনে উবাদাহ্ আল আনসারী আল খারাজীকে বুঝানো হয়েছে।
আল তিরমিযী বর্ণনা করেছেন যে,
‘আমীরদের সাথে কথা বলার সময় কায়েস ইবনে সা’দ পুলিশের মত রাসূলুল্লাহ্ (সা) এর সামনে থাকত। আল আনসারী বলেন, এর অর্থ হল তাকে এ ব্যাপারে দায়িত্বভার দেয়া হয়েছিল।’ ইবনে হাব্বান এর ব্যাখ্যায় বলেন, ‘মুশরিকদের সাথে বৈঠকের সময় রাসূলুল্লাহ্ (সা) এর নিরাপত্তার ভার কায়েস ইবনে সা’দ এর উপর ন্যস্ত থাকত।’
আল বুখারী থেকে বর্ণিত আছে যে, একবার নবী (সা) আলী ইবনে আবি তালিব (রা) কে একস্থানে প্রেরণ করেন, যে সম্পর্কে তিনি (আলী) বলেছেন, “রাসূলুল্লাহ্ (সা) আমাকে, আল জুবায়ের এবং আল মারছাদকে প্রেরণ করলেন – আমরা প্রত্যেককেই অশ্বারোহী যোদ্ধা ছিলাম। তিনি (সা) বললেন, “রাওদাত হাজ্ব এ না পৌঁছানো পর্যন্ত তোমরা যাত্রা অব্যাহত রাখবে”। আবু আওয়ানা বলেন জায়গাটির নাম ছিল রাওদাত হাজ্ব। আরেকটি বর্ণনায় জায়গাটির নাম বলা হয় খাক্ব। ‘সেখানে একজন মহিলা আছে যার কাছে মুশরিকদের উদ্দেশ্যে লেখা হাতিব ইবনে আবি বালতাহ-এর একটি চিঠি রয়েছে। এটা আমার কাছে নিয়ে আসবে।’ সুতরাং আমরা ততক্ষণ পর্যন্ত ঘোড়া ছুটালাম যতক্ষণ না রাসূলুল্লাহ্ (সা) নির্দেশিত স্থানে পৌঁছালাম। মহিলাটি উটের পিঠে চড়ে যাত্রা করছিল। হাতিব মক্কাবাসীকে রাসূলুল্লাহ্ (সা) এর অভিযান সম্পর্কে অবহিত করে পত্র লিখেছিল। আমরা বললাম, ‘তোমার নিকট রক্ষিত চিঠিটা কোথায়?’ প্রত্যুত্তরে সে বলল, ‘আমার কাছে কোন চিঠি নেই।’ আমরা তার ঘোড়াকে বসিয়ে জিনের ভেতর খুঁজলাম, কিন্তু কিছুই পেলাম না। আমি বললাম, ‘বন্ধুগণ, আমি তো তার কাছে কোন চিঠি পেলাম না। কিন্তু, আমরা জানি রাসূলুল্লাহ্ (সা) মিথ্যে বলতে পারেন না।’ অতঃপর আলী (রা) প্রতিজ্ঞা করলেন এই বলে যে, ‘যার নামে শপথ নেয়া হয় তার নামে বলছি! তোমাকে অবশ্যই চিঠিটা বের করে দিতে হবে। অন্যথায় আমি তোমার কাপড় খুলে ফেলব।’ তারপর উক্ত মহিলা তার কোমড় বন্ধনীর নীচ থেকে চিঠিটি বের করে আনলো যা দিয়ে সে তার কাপড় বেঁধে রেখেছিল। অতঃপর তারা চিঠিটি রাসূলুল্লাহ্ (সা) এর কাছে নিয়ে গেলেন…।”
তৃতীয়ত: শিল্প
রাসূলুল্লাহ্ (সা) পাথর নিক্ষেপের যন্ত্র (catapult) ও অস্ত্র সজ্জিত বাহন (armored car) তৈরির নির্দেশ দিয়েছিলেন। আল বায়হাকী তার সুনান গ্রন্থে উল্লেখ করেন যে, আবু উবাইদা (রা) বলেছেন, ‘তারপর রাসূলুল্লাহ্ (সা) তায়েফের চারদিকে অবরোধ আরোপ করলেন এবং পাথর নিক্ষেপের যন্ত্র তৈরী করে সতের দিন যাবত তা তাক করে রাখলেন।’ আবু দাউদ আল-মারাসিল গ্রন্থে মাখুল থেকে বর্ণনা করেছেন যে, ‘রাসূলুল্লাহ্ (সা) তায়েফের লোকদের বিরুদ্ধে পাথর নিক্ষেপের যন্ত্র তৈরী করেন।’ আল সানানী সুবুল আল-সালাম গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন যে, এই হাদীসের বর্ণনাকারী নির্ভরযোগ্য। এছাড়া, সীরাত হালাবিয়্যা গ্রন্থের লেখক বলেছেন, ‘সালমান ফারসী (রা) তাঁকে (সা) এ ব্যাপারে পরামর্শ প্রদান করেন। তিনি (রা) বলেন, ‘পারস্যে আমরা দূর্গের উপরে পাথর নিক্ষেপের যন্ত্র মোতায়েন করি এবং তা দিয়ে শত্রুদের আঘাত করি।’ সালমান (রা) নিজের হাতে এ যন্ত্র তৈরি করেছিলেন বলে জানা যায়।’ সাদ ইবনে আল মু’য়াজ থেকে আল কাইম এবং ইবনে হিশাম ইবনে ইসহাকের সীরাত গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন যে,
“তায়েফের দূর্গের কাছাকাছি অবরোধ আরোপের দিন থেকে, আল্লাহ্’র রাসূল (সা) এর সাহাবীদের মধ্য হতে কিছু ব্যক্তি ট্যাঙ্কের মতো এক বাহনে চড়ে দূর্গের দেয়ালের কাছাকাছি আক্রমণ করার চেষ্টা করছিল যেন খুব সহজেই দূর্গের প্রতিরক্ষা দেয়াল ধ্বসিয়ে দেয়া যায়। কিন্তু, অগ্রসর হওয়া মাত্রই ছাকিফ গোত্রের লোকেরা তাঁদের দিকে জ্বলন্ত ধাতুর টুকরা ছুঁড়ে মারতে থাকে যাতে ট্যাঙ্কগুলো থেকে তারা মুক্তি পায়। এরপর মুসলিমরা আত্মরক্ষার্থে পালাতে থাকে এবং এ সুযোগে তারা মুসলিমদের দিকে বৃষ্টির মতো তীর নিক্ষেপ করে বেশকিছু মুসলিম যোদ্ধাকে হত্যা করে ফেলে।”
এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে, সালমান (রা) পাথর নিক্ষেপের যন্ত্র তৈরির পরামর্শ দেন এবং তিনি নিজ হাতে এটি প্রস্তত করেছিলেন বলে জানা যায়। তবে, এ সমস্ত ঘটনা অবশ্যই রাসূল (সা) এর নির্দেশ অনুযায়ীই ঘটেছিল। সীরাত গ্রন্থে আল-হালাবিয়্যার বক্তব্য লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, ‘তিনি তাঁকে এ ব্যাপারে নির্দেশনা দিয়েছিলেন।’ অর্থাৎ, রাসূল (সা) কে এ ব্যাপারে পরামর্শ দেয়া হয়েছিল।
এসব বর্ণনা থেকে যে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠে তা হল, সমরশিল্প গড়ে তোলার দায়িত্ব হল খলীফার এবং এ কাজ পরিচালনার জন্য তিনি যাকে উপযুক্ত মনে করেন তার কাছ থেকে এ বিষয়ে সহায়তা নিতে পারেন। এজন্য শিল্পকারখানার একজন আমীরের চাইতে বরং ব্যবস্থাপকের দরকার। সালমান (রা) সমরশিল্পের আমীর ছিলেন না বরং পাথর ছোঁড়ার যন্ত্র তৈরীর ব্যবস্থাপক ছিলেন; এবং এক্ষেত্রে, তাঁকে হয়ত নিজের হাতে কাজ করতে হয়েছিল।
এছাড়া, সমরশিল্প প্রতিষ্ঠা করা বাধ্যতামূলক, কারণ আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা পবিত্র কুর’আনে বলেন,
‘আর প্রস্তুত কর তাদের সাথে যুদ্ধের জন্য যাই কিছু সংগ্রহ করতে পার নিজের শক্তি সামর্থ্যরে মধ্যে থেকে এবং পালিত ঘোড়া থেকে, যেন ভীতির সঞ্চার হয় আল্লাহ্’র শত্রুদের উপর এবং তোমাদের শত্রুদের উপর আর তাদেরকে ছাড়া অন্যান্যদের উপর ও যাদেরকে তোমরা জান না; [কিন্তু] আল্লাহ্ তাদেরকে জানেন।’
[সূরা আনফাল : ৬০]
বস্তুতঃ প্রস্তুতি ছাড়া এই ভয় সৃষ্টি করা সম্ভব নয় এবং প্রস্তুতির জন্য দরকার কলকারখানা। আসলে, উপরোক্ত আয়াতে পরোক্ষভাবে সমরশিল্পের প্রয়োজনের অপরিহার্যতাকেই নির্দেশ করা হয়েছে (দালালাত আল-ইলতিযাম)। আর, পরোক্ষ এ নির্দেশের মাধ্যমে মূলতঃ সমরশিল্প প্রতিষ্ঠা করাকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কারণ, শারী’আহ্ মূলনীতি অনুযায়ী ‘ফরয সম্পাদনের জন্য যা প্রয়োজন সেটিও ফরয’। জিহাদকে যে সব দলিলের মাধ্যমে ফরয করা হয়েছে, তার পাশাপাশি এই দালালাত আল-ইলতিযাম (প্রয়োজনের অপরিহার্যতা) হল সমরশিল্প বা কলকারখানা প্রতিষ্ঠা করার বাধ্যবাধকতার আরও একটি দলিল।
তবে, রাষ্ট্র কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত এই সমস্ত কলকারখানাগুলো শুধুমাত্র সমরশিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় কলকারখানার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। রাষ্ট্রকে অন্যান্য শিল্পকারখানাও প্রতিষ্ঠা করতে হবে যা আমাদের প্রণীত “খিলাফত রাষ্ট্রের কোষাগার সমূহ” (The Funds of Khilafah State) গ্রন্থে বিশদভাবে আলোচনা করা হয়েছে :
শিল্প কারখানাসূহঃ জনগণের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়সমূহ দেখাশোনা করার যে বাধ্যবাধকতা রাষ্ট্রের রয়েছে তার উপর ভিত্তি করে রাষ্ট্রকে অবশ্যই দু’ধরনের কলকারখানা স্থাপন করতে হবে:
প্রথম ধরন: যে সব কারখানা গণমালিকানাধীন সম্পদের সাথে সম্পর্কযুক্ত, যেমন: খনিজ সম্পদ আহরণ, বিশোধন, বিগলন এবং তেল সম্পদ উত্তোলন ও পরিশোধন ইত্যাদির সাথে সম্পর্কযুক্ত শিল্পকারখানা। এসব কারখানা যেসব দ্রব্যাদি উৎপাদন করে সেগুলো গণমালিকানাধীন, তাই এ কারখানাগুলোও হবে গণমালিকানাধীন। ইসলামে যেহেতু গণমালিকানাধীন সম্পত্তি সকল মুসলিমের সম্পদ, সেহেতু এ সমস্ত কারখানার মালিকও সকল মুসলিম এবং রাষ্ট্র মুসলিমদের পক্ষ হতে এগুলো প্রতিষ্ঠা করবে।
দ্বিতীয় ধরন: শিল্পকারখানা, যেগুলো ভারী শিল্প ও সমরাস্ত্র শিল্পের সাথে জড়িত। এ ধরনের কারখানা ব্যক্তিখাতেও থাকতে পারে যেহেতু এগুলো ব্যক্তিগত সম্পদের অন্তর্গত। তবে এ ধরনের কারখানা প্রতিষ্ঠার জন্য প্রচুর বিনিয়োগের দরকার যা বেশীরভাগ ক্ষেত্রে ব্যক্তিবিশেষের পক্ষে অসম্ভব। এছাড়া, আজকের দিনে অস্ত্র উৎপাদনকারী ভারী শিল্পকারখানাগুলো এখন আর ব্যক্তিমালিকানার অধীন নয়, যেমনটি ছিল রাসূলুল্লাহ্ (সা) ও খোলাফায়ে রাশেদীনদের সময়। বরং, এগুলোর মালিক এখন হল রাষ্ট্র; মূলতঃ দায়িত্ব পালনের দায়বদ্ধতা থেকেই রাষ্ট্র এক্ষেত্রে অর্থায়ন করে থাকে। বিশেষ করে বর্তমান সময়ে যখন অস্ত্রশস্ত্রের ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হয়েছে এবং এর জন্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন সরঞ্জামসমূহ অনেক ব্যয়বহুলও হয়ে গেছে… সুতরাং অস্ত্র উৎপাদনের জন্য ও ভারী শিল্প প্রতিষ্ঠা করা রাষ্ট্রের জন্য বাধ্যতামূলক। তবে, এর অর্থ এই নয় যে, এর মাধ্যমে এক্ষেত্রে ব্যক্তিখাতকে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। এখানে বোঝানো হচ্ছে যে, এইসব শিল্পকারখানা প্রতিষ্ঠা করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের অর্থাৎ খলীফার। খলীফা এ সকল কাজ সম্পাদনের জন্য একজন মহাব্যবস্থাপক নিয়োগ করবেন, যিনি খলীফা, তার ডেপুটি কিংবা খলীফা যাকে পছন্দ করেন তার সাথে সরাসরি যুক্ত থাকবেন।
চতুর্থত: আন্তর্জাতিক সম্পর্ক
এটা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে খলীফার নির্বাহী সহকারী খিলাফত রাষ্ট্র ও অন্যান্য দেশের মধ্যে সংযোগ রক্ষা করবেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) এবং খোলাফায়ে রাশেদীনগণ (রা) তাদের সচিবদের (নির্বাহী সহকারী) মাধ্যমে সরাসরি এসব সম্পর্ক রক্ষা করতেন। এছাড়া, হুদাইবিয়া সন্ধির সময় রাসূল (সা) নিজেই মুশরিকদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করেছেন এবং শান্তিচুক্তি সম্পাদন করেছেন। তাছাড়া উমর (রা) থেকে জানা যায় কিসরা থেকে যখন একটি প্রতিনিধি দল তাঁর কাছে এসেছিল, সে সময় তারা তাঁকে মদীনাতুল মনোয়ারার একটি ফটকে ঘুমন্ত অবস্থায় পেয়েছিল।
সুতরাং, উপরোক্ত আলোচনা থেকে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে, খলীফা তার নির্বাহী সহকারীর মাধ্যমে সরাসরি বৈদেশিক সম্পর্কের বিষয়গুলো দেখতে পারেন অথবা একজন ব্যবস্থাপক নিয়োগ করে তা পরিচালিত করতে পারেন।
সুতরাং, এ চারটি বিভাগকে একটি বিভাগের অধীনে অন্তর্ভুক্ত করে আমীরুল জিহাদের বিভাগ নামে স্বতন্ত্র একটি বিভাগ করা যেতে পারে, কারণ এরা পরস্পর সম্পর্কযুক্ত ।
আবার, রাসূলুল্লাহ্ (সা) এর মত এগুলোকে স্বতন্ত্রও রাখা যেতে পারে।
এ চারটি বিভাগের কাজের পরিধি ব্যাপক। বিশেষ করে বর্তমান সময়ে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, এ বিভাগগুলোর মধ্যে অনেক বিষয় অন্তর্ভূক্ত হয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে সেনাবাহিনীর বিভিন্ন বিভাগ, আভ্যন্তরীণ সমস্যা, বিভিন্ন রাষ্ট্র, তাদের এজেন্ট ও স্বার্থান্বেষী রাজনীতিবিদ কর্তৃক গৃহীত গোপন পরিকল্পনা বা ষড়যন্ত্রের জাল উম্মোচন এবং বিভিন্ন ধরনের অপরাধ ও আর্ন্তজাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের জটিলতার নিরসন ইত্যাদি। এছাড়াও রয়েছে শিল্পকারখানার বিভিন্ন বিভাগ ও উন্নতমানের প্রযুক্তি ব্যবহার ইত্যাদি। তবে, আমীরুল জিহাদের আবশ্যিক ক্ষমতা এমন পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া উচিত নয়, যেখানে তিনি ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়ে যান। কারণ, এক্ষেত্রে যদি তার তাকওয়ার অবনতি ঘটে তবে তা রাষ্ট্রের জন্য বিরাট ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। এজন্য এ চারটি বিভাগকে আমরা একটি অপরটি থেকে বিচ্ছিন্ন রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছি, যেগুলো কিনা রাষ্ট্রের অন্যান্য প্রতিষ্ঠান থেকে স্বতন্ত্র অবস্থায় সরাসরি খলীফার সাথে যুক্ত থাকবে। এ বিভাগগুলো হল: