ওয়ালী (গভর্ণর) হচ্ছেন এমন একজন ব্যক্তি যাকে খলীফা খিলাফত রাষ্ট্রের ভেতর কোন একটি উলাই’য়াহ্ বা প্রদেশে শাসক এবং আমীর হিসেবে নিয়োগ দিয়ে থাকেন।
ইসলামী রাষ্ট্রের অন্তর্ভূক্ত ভূমিসমূহকে বিভিন্ন প্রদেশে বিভক্ত করা হবে এবং প্রতিটি প্রদেশ একটি উলাই’য়াহ হিসেবে পরিগণিত হবে। প্রতিটি উলাই’য়াহকে আবার কয়েকটি জেলায় বিভক্ত করা হবে এবং প্রতিটি জেলাকে ইমালাহ্ বলা হবে। উলাই’য়াহ দায়িত্বে যাকে নিযুক্ত করা হবে তাকে ওয়ালী বা আমীর বলা হবে এবং ইমালাহ্’র দায়িত্বে নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে আমীল বা হাকীম বলা হবে।
প্রতিটি ইমালাহ্ আবার কয়েকটি প্রশাসনিক এককে বিভক্ত, যাদের প্রত্যেককে কাসাবাহ্ (মেট্রোপলিস) বলা হয়। কাসাবাহ সমূহ আরও ছোট প্রশাসনিক এককে বিভক্ত যাদের প্রত্যেকটিকে হাই’ই (Hayy) বা কোয়ার্টার বলা হয়। কাসাবাহ্ এবং হাই’ইর প্রধানদের ব্যবস্থাপক (Manager) বলা হয় এবং তাদের কাজ প্রশাসনিক।
ওয়ালী হলেন একজন শাসক, কারণ, উলাই’য়াহ্’র অর্থই হচ্ছে শাসন করা। আল মুহিত অভিধানে, এটাকে নেতৃত্ব (ইমারাহ) ও কর্তৃত্ব অর্থে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। যেহেতু তারা শাসক সেহেতু তাদের শাসক হবার সকল শর্ত পূরণ করতে হবে। সে কারণে ওয়ালীকে অবশ্যই পুরুষ, মুক্ত, মুসলিম, প্রাপ্তবয়স্ক, সুস্থ মস্তিষ্কের অধিকারী, ন্যায়পরায়ন এবং তার কর্তব্য সম্পাদনে যোগ্য হতে হবে। তাকে খলীফা অথবা খলীফার পক্ষ থেকে কারও মাধ্যমে নিযুক্ত হতে হবে। অর্থাৎ, ওয়ালীগণ কেবলমাত্র খলীফার মাধ্যমে নিযুক্ত হতে পারেন। উলাই’য়াহ্ অথবা ইমারাহ অর্থাৎ ওয়ালী বা আমীর নিয়োগের বিষয়ে দলিল পাওয়া যায় রাসূলুল্লাহ্ (সা) এর শাসনামল থেকে। বিভিন্ন বর্ণনানুসারে এটা নিশ্চিত যে, তিনি (সা) বিভিন্ন অঞ্চলে ওয়ালীদের নিয়োগ দিতেন এবং তাদের প্রদেশসমূহে শাসন করবার ক্ষমতা প্রদান করতেন। তিনি (সা) মুয়াজ ইবন জাবালকে আল-জানাদে, যিয়াদ ইবনে লাবিদকে হাজরামাউতে এবং আবু মুসা আল আশয়ারীকে জাবিদ এবং এডেনে (ওয়ালী হিসাবে) নিযুক্ত করেছিলেন।
যারা শাসনকার্যে যোগ্য, জ্ঞানী ও পরহেজগার (আল্লাহভীরু) বলে পরিচিত ছিলেন তাদেরই রাসূলুল্লাহ্ (সা) ওয়ালী হিসেবে মনোনীত করতেন। তিনি (সা) তাদের মধ্য হতে ওয়ালী বাছাই করতেন যারা এই কাজে পারদর্শী ছিল এবং যারা মানুষের হৃদয়ে ঈমানের আলো ও রাষ্ট্রের প্রতি ভালোবাসায় পরিপূর্ণ করতে সক্ষম ছিল। সুলাইমান ইবনে বারুদা তার বাবার বরাত দিয়ে বলেন,
“যখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) কোন অভিযান কিংবা সেনাবাহিনীতে একজন আমীর নিয়োগ করতেন, তখন তিনি (সা) তাকে আল্লাহ্’কে ভয় করতে এবং তার সহযোগী মুসলিমদের প্রতি সদয় ব্যবহার করার নির্দেশ দিতেন।” মুসলিমের বর্ণনা অনুসারে;
(আল-বায়হাকী, সুনান আল কুবরা, খন্ড-৯, পৃষ্ঠা-৪১)।
যেহেতু ওয়ালী একটি উলাই’য়াহের আমীর, সেহেতু তার ক্ষেত্রেও এ হাদীস প্রযোজ্য।
ওয়ালীকে বরখাস্থ বা অপসারণ করার ক্ষেত্রে বলা যায় যে, এর ভার খলীফার উপরই ন্যস্থ থাকবে কিংবা যদি উলাই’য়াহের অধিকাংশ জনগণ অথবা তাদের প্রতিনিধি ওয়ালীর প্রতি অসন্তুষ্ট হন তখন ওয়ালীকে পদচ্যুত করা যাবে। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে দুটি কারণে উলাই’য়াহ্’র জনগণের পক্ষ থেকে একটি উলাই’য়াহ্ প্রতিনিধি পরিষদ গঠন করা হবে। প্রথমত: তারা প্রদেশের বাস্তবতার ব্যাপারে ওয়ালীকে অবহিত করবেন; কারণ, তারা ঐ প্রদেশ বা অঞ্চলে বসবাস করেন এবং সে প্রদেশের বাস্তবতা সম্পর্কে তারা ওয়ালীর চেয়ে ভাল ধারণা রাখেন। তখন ওয়ালী সে তথ্যসমূহ ব্যবহার করে আরও ভালভাবে তার কার্য সম্পাদন করতে পারবেন। আর, দ্বিতীয়ত: ওয়ালীর কাজের ব্যাপারে কাউন্সিলের মতামত গ্রহণ করার উদ্দেশ্যে। যদি অধিকাংশ কাউন্সিল সদস্য ওয়ালীর কাজের ব্যাপারে অভিযোগ করেন তাহলে খলীফা তাকে অপসারণ করবেন। কারণ, রাসূলুল্লাহ্ (সা) আবদ কায়েসের প্রতিনিধিদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বাইরাইনের আমীর আল ’আলা ইবনে আল হাদরামীকে অপসারণ করেছিলেন। এছাড়া, কোন কারণ বা অভিযোগ ছাড়াও খলীফা ওয়ালীকে পদচ্যুত করতে পারেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) ইয়েমেনের আমীর মুয়াজ বিন জাবালকে কোন কারণ ছাড়াই অপসারণ করেন।
উমর বিন আল-খাত্তাবও (রা) ওয়ালীদের কারণে বা বিনা কারণে বরখাস্ত করতেন। তিনি যিয়াদ ইবনু আবু সুফিয়ানকে কোন কারণ ছাড়াই অপসারণ করেন এবং সাদ বিন আবি ওয়াক্কাসকে জনগণের অভিযোগের ভিত্তিতে বরখাস্ত করেন এবং বলেন, “আমি তাকে অদক্ষতা বা বিদ্রোহের কারণে অপসারণ করিনি।” এ ঘটনাগুলো এটাই প্রমাণ করে যে, খলীফা কোন ওয়ালীকে তার উলাই’য়াহের জনগণের পক্ষ থেকে অভিযোগ আসুক বা না আসুক সর্বাবস্থায় অপসারণ করার ক্ষমতা রাখেন।
অতীতে দুই ধরনের উলাই’য়াহ্ ছিল: উলাই’য়াহতুল সালাহ এবং উলাই’য়াহতুল খারাজ। এ কারণে ইতিহাসের বইসমূহে উলাই’য়াহের আমীর সম্বন্ধে আমরা দু’ধরনের শব্দ ব্যবহার করতে দেখি: প্রথমটি হল সালাহ্ কিংবা খারাজ এর উপর কর্তৃত্ব (ইমারাহ) এবং অন্যটি হল সালাহ্ এবং খারাজ উভয়ের উপর কর্তৃত্ব। অন্যভাবে বললে বলা যায়, শুধুমাত্র সালাহ্ কিংবা খারাজ এর উপর ওয়ালী নিযুক্ত করা যায়। আবার, সালাহ্ এবং খারাজ উভয়ের উপর আমীর নিযুক্ত করা যায়। উলাই’য়াহ্ অথাবা ইমারার ক্ষেত্রে সালাহ্ শব্দটির অর্থ শুধু নামাজের ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দেয়া নয়, বরং এর অর্থ হল তহবিল বাদে সমস্ত বিষয় পরিচালনা করা। কারণ, সালাহ্ শব্দটির অর্থ হল কর ধার্য করার এখতিয়ার ব্যাতিরেকে সব বিষয়ে শাসনকার্য পরিচালনা করা। সুতরাং, যদি একজন ওয়ালীকে সালাহ্ এবং খারাজ উভয়ের আমীর নিযুক্ত করা হয়, তাহলে সেটি সাধারণ উলাই’য়াহ্ (উলাই’য়াহ্ ’আম্মা) হিসেবে বিবেচিত হবে। আর, যদি তাকে শুধুমাত্র সালাহ্ বা খারাজ এর আমীর নিযুক্ত করা হয়, তাহলে সেক্ষেত্রে উলাই’য়াহ্টি বিশেষ উলাই’য়াহ্ (উলাই’য়াহ্ খাসসা) হিসেবে বিবেচিত হবে।
তবে, যেভাবেই হোক না কেন প্রকৃতঅর্থে এটা খলীফার সিদ্ধান্তের উপরই ছেড়ে দেয়া হবে। কারণ, তিনি ইচ্ছে করলে কোন উলাই’য়াহকে শুধুমাত্র খারাজ অথবা বিচারব্যবস্থার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে পারেন, কিংবা খারাজ, বিচারব্যবস্থা ও সেনাবাহিনী ছাড়া অন্য কোনকিছুর মধ্যেও সীমাবদ্ধ রাখতে পারেন। রাষ্ট্র বা উলাই’য়াহকে পরিচালনার জন্য তিনি যে সিদ্ধান্তকে উপযোগী মনে করবেন সেটাই করতে পারেন। কারণ, হুকুম শারী’আহ ওয়ালীর জন্য কোন দায়িত্ব নির্দিষ্ট করে দেয়নি এবং শাসনকার্যের সকল দায়িত্ব তার উপর বাধ্যতামূলক করা হয়নি। শুধুমাত্র এটা নির্দিষ্ট করা হয়েছে যে, ওয়ালী অথবা আমীরের দায়িত্ব শাসন ও কর্তৃত্বের সাথে সর্ম্পকিত হবে এবং তাকে একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের আমীর নিযুক্ত করতে হবে।
এ সমস্ত কিছুই আল্লাহ্’র রাসূল (সা)এর জীবনী থেকে নির্ধারণ করা হয়েছে।
বস্তুতঃ হুকুম শারী’আহ্ খলীফার জন্য ওয়ালী নিযুক্ত করা বাধ্যতামূলক করেছে; তার বিচার-বিবেচনার ভিত্তিতে এই ওয়ালী উলাই’য়াহ্ আম্মা অথবা উলাই’য়াহ্ খাসসা’ যে কোন উলাই’য়াহের জন্য নিযুক্ত হতে পারে। রাসূল (সা) এর কর্মকান্ড থেকে এটাই প্রতিফলিত হয়েছে। রাসূলুল্লাহ্ (সা) সাধারণ ভাবে শাসনকার্য পরিচালনার দায়িত্ব দিয়ে ওয়ালী নিয়োগ করেছেন, যেমন আমরু বিন হাজেমকে তিনি এভাবে ইয়েমেনে নিযুক্ত করেছিলেন। আবার, তিনি বিশেষ দায়িত্ব দিয়েও ওয়ালী নিয়োগ করেছেন, যেমন আলী বিন আবি তালিব (রা) কে ইয়েমেনে বিচারকার্য পরিচালনার জন্য প্রেরণ করেছিলেন। সীরাত ইবনে হিশামে উল্লেখিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) ফারওয়া বিন মুসায়িককে মুরাদ, জুবায়ের ও মিদহাজ গোত্রের ওয়ালী নিয়োগ করেছিলেন এবং তার সাথে তিনি খালিদ বিন সায়ীদ বিন আল ’আসকে সাদাকা সম্পর্কিত বিষয়াবলী পরিচালনার ওয়ালী পদে নিয়োগ করেছিলেন। এটাও উল্লেখিত আছে যে, রাসূল (সা) যিয়াদ বিন লাবিদ আল আনসারীকে হাজরামাউতে ওয়ালী হিসাবে ও সাদাকার দায়িত্ব দিয়ে প্রেরণ করেন। এছাড়া, তিনি আলী বিন আবি তালিব (রা) কে নাজরানে সাদাকা ও জিযিয়ার দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়েছিলেন। হাকীমের বর্ণনা অনুসারে, তিনি (সা) আলী বিন আবি তালিব (রা) কে ইয়েমেনে বিচারকের দায়িত্ব দিয়েও প্রেরণ করেছিলেন। আল-ইসতিয়া’ব গ্রন্থে উল্লেখিত আছে রাসূলুল্লাহ্ (সা) মুয়াজ বিন জাবালকে আল জানাদের লোকদের কুর’আন, ইসলামী আইন শিক্ষা দেয়া ও বিচার ফায়সালার জন্য প্রেরণ করেছিলেন। তিনি (সা) তাঁকে ইয়েমেনের আমীলদের কাছ থেকে সাদাকা সংগ্রহের ক্ষমতাও দিয়েছিলেন।
যদিও খলীফার সাধারণ ও বিশেষ দু’ভাবেই ওয়ালী নিয়োগ করার ক্ষমতা রয়েছে, তবে এটা প্রমাণিত সত্য যে, আব্বাসীয় খিলাফতের দূর্বলতার সময় সাধারণ উলাই’য়াহ্ ওয়ালীদের সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে শাসন করার সুযোগ তৈরী করে দিয়েছিল। যে সময়ে খলীফা নিতান্তই একটি নামসর্বস্ব পদবীতে পরিণত হয়েছিল, যাকে কেবলমাত্র জনসভায় দোয়ার সময় স্মরণ করা হত এবং মুদ্রায় তার নাম প্রতীক হিসাবে খোদাই করা থাকত। এভাবেই, সাধারণ উলাই’য়াহ্ ব্যবস্থা ইসলামী রাষ্ট্রের ব্যাপক ক্ষতি সাধন করেছিল।
যেহেতু খলীফার সাধারণ ও বিশেষ কর্তৃত্ব দিয়ে ওয়ালী নিযুক্ত করবার ক্ষমতা রয়েছে এবং যেহেতু সাধারণ উলাই’য়াহ্ ব্যবস্থা ইসলামী রাষ্ট্রকে ক্ষতির দিকে ধাবিত করতে পারে এবং রাষ্ট্রের জন্য বড় ধরনের বিপদ ডেকে আনতে পারে, তাই আমরা বিশেষ উলাই’য়াহ্ ব্যবস্থা বা উলাই’য়াহ্ খাসসা গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি, যেন ওয়ালীর তাকওয়া যদি কখনও নিন্মগামীও হয় তাহলেও যেন তিনি রাষ্ট্রকে বিভক্ত করতে না পারেন। গবেষণা থেকে আমরা দেখেছি, যে সকল ক্ষেত্র ওয়ালীকে শক্তিশালী করে সেগুলো হল সেনাবাহিনী, বিচারব্যবস্থা ও অর্থের উপর নিয়ন্ত্রণ। সেজন্য, এ ক্ষেত্রগুলোকে অবশ্যই ওয়ালীর কর্তৃত্ব থেকে মুক্ত রাখতে হবে এবং রাষ্ট্রের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মত খলীফার অধীনে রাখতে হবে।
অর্থাৎ, এ ক্ষেত্রগুলো অবশ্যই খলীফার প্রত্যক্ষ নজরদারিতে রাখতে হবে।
ওয়ালীকে এক উলাই’য়াহ্ থেকে অন্য উলাই’য়াহতে স্থানান্তরিত করা যাবে না, বরং তাকে এক উলাই’য়াহ্’র দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে, তারপর অন্য উলাই’য়াহতে পুনঃনিয়োগ দিতে হবে। কারণ, এটা রাসূলুল্লাহ্ (সা) এর কর্মকান্ড থেকে পরিষ্কার যে, তিনি (সা) ওয়ালীদের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিতেন। এরকম কোন বর্ণনা নেই যে, যেখানে দেখা যায় তিনি (সা) ওয়ালীদের এক উলাই’য়াহ্ থেকে অন্য উলাই’য়াহতে স্থানান্তর করেছিলেন। এছাড়া, উলাই’য়াহ্ হল এমন এক ধরনের চুক্তি যার ধারাসমূহ সুস্পষ্ট। সে কারণে একটি অঞ্চল বা প্রদেশে উলাই’য়াহ্ নিয়োগের চুক্তিতে যে সীমানা পর্যন্ত ওয়ালীর শাসন বিরাজমান থাকবে তা পরিস্কারভাবে উল্লেখ থাকতে হবে এবং খলীফা তাকে অপসারণ করবার পূর্ব পর্যন্ত উক্ত অঞ্চলে তার শাসনক্ষমতা বলবৎ থাকবে। কোন একটি অঞ্চল থেকে তাকে অপসারণ করবার পূর্ব পর্যন্ত তিনি সে অঞ্চলের ওয়ালী বলেই গণ্য হবেন। তাকে যদি অন্য কোন জায়গায় স্থানান্তর করা হয় তার মাধ্যমে তিনি পূর্বের পদ থেকে অপসারিত হবেন না কিংবা নতুন জায়গার ওয়ালীও হবেন না। কারণ, প্রথম পদ থেকে তাকে অপসারণ করতে হলে সুস্পষ্টভাবে সেই উলাই’য়াহের দায়িত্বভার থেকে মুক্ত হওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করতে হবে এবং একইভাবে নতুন উলাই’য়াহতে তার নিযুক্ত করার ক্ষেত্রে নিয়োগের চুক্তিতে সুস্পষ্টভাবে সেই বিশেষ অঞ্চল সম্পর্কে উল্লেখ থাকতে হবে। সে কারণে একজন ওয়ালীকে স্থানান্তর করা যায় না, বরং প্র মে নিযুক্ত পদ থেকে নিষ্কৃতি দেবার পরই নতুন স্থানে তাকে পুনঃনিয়োগ দেয়া যায়।
খলীফাকে ওয়ালীদের কাজের নিয়মিত তদন্ত করতে হবে:
খলীফাকে ওয়ালীদের কাজ তদন্ত করতে হবে এবং তাদের নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে। এ কাজটি খলীফা প্রত্যক্ষভাবে করতে পারেন অথবা তিনি তার পক্ষ থেকে কাউকে এ পর্যবেক্ষণের জন্য নিয়োগ করতে পারেন। মু’ওয়ায়ীনও (প্রতিনিধিত্বকারী সহকারী) খলীফাকে সাহায্য করবার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন প্রদেশের ওয়ালীদের কাজ নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে পারবেন। তবে, এ ব্যাপারে তার অনুসন্ধান লব্ধ তথ্য ও গৃহীত সিদ্ধান্ত অবশ্যই খলীফাকে অবহিত করতে হবে – যা প্রতিনিধিত্বকারী সহকারীর দায়িত্বের অধ্যায়ে ইতোমধ্যে আলোচনা করা হয়েছে। এভাবে খলীফাকে বিভিন্ন প্রদেশ সমূহের পরিস্থিতি সম্পর্কে সজাগ থাকতে হবে এবং নিয়মিতভাবে তাদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে হবে। এছাড়া, তাকে বিভিন্ন সময়ে ওয়ালীদের সবার সাথে অথবা কিছু সংখ্যকের সাথে বসে তাদের বিরুদ্ধে জনগণের অভিযোগও শুনতে হবে।
এটা নিশ্চিত যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) ওয়ালীদের নিয়োগের সময় তাদের যাচাই করে নিতেন, যেমনটি তিনি করেছিলেন মুয়াজ ও আবু মুসার ক্ষেত্রে। তিনি (সা) সাধারণত কিভাবে দায়িত্ব পালন করতে হবে সে ব্যাপারে তাদের নির্দেশনা প্রদান করতেন, যেমনটি তিনি করেছিলেন আমর বিন হাজম এর ক্ষেত্রে। এছাড়া, তিনি (সা) কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতেন যেমনটি তিনি করেছিলেন আবান বিন সা’ঈদ এর ক্ষেত্রে। তাকে বাহরাইনে ওয়ালী হিসেবে নিয়োগ দেয়ার সময় তিনি (সা) বলেছিলেন,
“আবদ কায়েসের দেখাশোনা করো এবং এর প্রধানদের সম্মান করো।”
এছাড়াও তিনি (সা) ওয়ালীদের জবাবদিহি করতেন, তাদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ ও তাদের বিষয়ে তদন্ত করতেন এবং তাদের সর্ম্পকিত সকল সংবাদ মনোযোগ সহকারে শ্রবণ করতেন। আয়-ব্যয়ের বিষয়ে তিনি (সা) তাদের জবাবদিহি করতেন। আবু হুমায়িদ আল সা’ঈদী থেকে আল বুখারী ও মুসলিম বর্ণনা করেছেন যে,
“রাসূলুল্লাহ্ (সা) ইবন-উল-উতবিয়াকে বানু সালিম গোত্রে সাদাকা আদায়ের জন্য আমীল নিযুক্ত করেন। যখন তিনি নবী (সা) এর কাছে ফেরত এলেন, তিনি বললেন, “এটি আপনার জন্য এবং এই (উপহার) আমার জন্য।” তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেন, “তুমি কেন তোমার পিতামাতার গৃহেই থেকে গেলে না যাতে সেখানেই তোমার কাছে উপহার আসে যদি তুমি সত্য বলে থাক।”
(সহীহ্ বুখারী, হাদীস নং-৬৯৭৯)
উমরও (রা) খুব নিবিড়ভাবে ওয়ালীদের পর্যবেক্ষণ করতেন। তিনি মুহম্মদ ইবনে মাসলামাকে ওয়ালীদের বিষয়াদি পর্যবেক্ষণ ও তদন্ত করার জন্য নিয়োগ করেছিলেন। হজ্জের সময় তিনি সব ওয়ালীদের কাজের দক্ষতা মূল্যায়নের জন্য তাদের একত্র করতেন এবং তাদের বিরুদ্ধে জনগণের অভিযোগ শ্রবণ করতেন। এছাড়া, তিনি উলাই’য়াহের বিভিন্ন বিষয় ও তাদের নিজেদের অবস্থা সম্পর্কেও খোঁজখবর নিতেন। এটা বর্ণিত আছে যে, একবার উমর (রা) তার আশেপাশের লোকদের জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘তোমরা কি মনে কর, তোমাদের মধ্য হতে সর্বোত্তম লোকটিকে তোমাদের উপর নিযুক্ত করলে এবং তাকে ন্যায়পরায়ন হতে বললেই আমার দায়িত্ব শেষ হয়ে হবে?’ লোকেরা বলল, ‘হ্যাঁ’। তখন তিনি বললেন, ‘না, যতক্ষণ পর্যন্ত না আমি তার কাজের মূল্যায়ন করব এবং নিশ্চিত হব যে, আমার আদেশ সঠিকভাবে পালিত হয়েছে।’ ওয়ালী এবং আমীলদের কঠোর ভাবে জবাবদিহিতার সম্মুখীন করার জন্য উমর (রা) প্রসিদ্ধ ছিলেন। তিনি শুধুমাত্র সন্দেহের বশবর্তী হয়ে অকাট্য দলিল-প্রমাণ ছাড়াই তাদের মধ্যে অনেককে অপসারণ করেছেন এবং কিছু ওয়ালীকে সামান্যতম সংশয়ের কারণে অপসারণ করেছেন, যা কিনা সন্দেহের পর্যায়েও পরে না। তাঁকে এ সম্পর্কে একদা জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেছিলেন, ‘জনগণের বিষয়াবলী দেখাশোনার ক্ষেত্রে ভুল-ত্রুটি সংশোধনের জন্য একজন আমীরের পরিবর্তে আরেকজনকে স্থলাভিষিক্ত করা সহজ। ’
তবে, কঠোরতা সত্বেও তিনি তাদের স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন ও শাসক হিসেবে সুনাম অর্জনের জন্যও মনযোগ দিতেন। তিনি তাদের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতেন এবং তাদের যুক্তিসমূহ বিবেচনায় নিতেন। যদি কোন যুক্তি তার পছন্দ হতো তাহলে তার স্বীকৃতি দেবার ব্যাপারে এবং আমীলদের প্রশংসার জোয়ারে ভাসাতে তিনি অকুন্ঠ ছিলেন। একদা হোমসের আমী’ল উমায়ের ইবনু সা’দ সম্পর্কে উমরের কাছে খবর আসল যে, মিম্বারে দন্ডায়মান থাকা অবস্থায় তিনি বলেছেন, ‘ইসলাম ততদিন অক্ষয় থাকবে যতদিন এর শাসন কর্তৃত্ব শক্তিশালী থাকবে। তবে, কর্তৃত্বের শক্তি তলোয়ারের আঘাতে হত্যা কিংবা চাবুকের ঘা দিয়ে আসে না, বরং তা সত্য দিয়ে শাসন ও ন্যায়পরায়ণতাকে সুউচ্চে তুলে ধরার মধ্য দিয়ে আসে।’ এ কথা শোনার পর উমর (রা) বললেন, ‘মুসলিমদের দেখভাল করার জন্য উমায়ের ইবনে সা’দ এর মত আরও মানুষ যদি আমার থাকতো।’