খলীফা

খলীফা হচ্ছেন এমন একজন ব্যক্তি যিনি শাসন, কর্তৃত্ব এবং শারী’আহ্‌’র বিধি-বিধান সমূহ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে মুসলিম উম্মাহ্‌’র প্রতিনিধিত্ব করেন। ইসলাম এটি নির্ধারণ করে দিয়েছে যে, শাসন ও কর্তৃত থাকবে উম্মাহ্‌’র অধিকারে।

এজন্যই উম্মাহ্‌ শাসনকার্য পরিচালনা ও তাদের উপর শারী’আহ্‌’র হুকুম-আহ্‌কাম সমূহ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে তার পক্ষ হতে একজনকে নিযুক্ত করে। বস্তুতঃ আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা প্রতিটি শারী’আহ্‌ আইন বাস্তবায়ন করা উম্মাহ্‌’র জন্য বাধ্যতামূলক করে দিয়েছেন। যেহেতু খলীফা মুসলিমদের দ্বারা নির্বাচিত হন, সেহেতু স্বভাবতই তাকে শাসন, কর্তৃত্ব ও শারী’আহ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে উম্মাহ্‌’র প্রতিনিধি হিসাবে বিবেচনা করা হয়। সুতরাং, কোন ব্যক্তিই ততক্ষণ পর্যন্ত খলীফা হতে পারবেন না যতক্ষণ পর্যন্ত না তিনি উম্মাহ্‌’র কাছ থেকে বাই’আত প্রাপ্ত হবেন; কারণ, মূলতঃ শাসন, কর্তৃত্ব ও শারী’আহ্‌ আইনসমূহ বাস্তবায়ন করা উম্মাহ্‌’র এখতিয়ারে। প্রকৃতঅর্থে, একজন ব্যক্তিকে খলীফা হিসাবে বাই’আত দিয়েই মুসলিম উম্মাহ্‌ কার্যকরীভাবে তাকে উম্মাহ্‌’র প্রতিনিধি হিসাবে নিযুক্ত করে। আর, এই বাই’আতের মাধ্যমেই তার উপর খিলাফত রাষ্ট্রের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়, খলীফাকে (উম্মাহ্‌’র উপর) কর্তৃত্বশীল করা হয় এবং সর্বোপরি, উম্মাহ্‌কে তার আনুগত্য করতে বাধ্য করা হয়।

বস্তুতঃ যিনি মুসলিমদের শাসন করবেন, তিনি ততক্ষণ পর্যন্ত খলীফা হতে পারবেন না যতক্ষণ পর্যন্ত না উম্মাহ্‌’র মধ্য হতে প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ (আহ্‌লুল হাল্লি ওয়াল আকদ্‌) স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাকে বাই’আত প্রদান করেন। খলীফা হিসেবে নিয়োগ পাবার জন্য তাকে অবশ্যই বাধ্যতামূলক কিছু শর্ত পূরণ করতে হবে এবং তারপর তাকে শারী’আহ বাস্তবায়নের দিকে অগ্রসর হতে হবে।

পদবি

খলীফার পদবি হতে পারে খলীফা অথবা ‘ইমাম’ কিংবা ‘আমীর উল মু’মিনীন (বিশ্বাসীদের নেতা)। এই পদবিসমূহ সহীহ্‌ হাদীস এবং ইজ্‌মা আস্‌ সাহাবা (রা) থেকে পাওয়া যায়। খোলাফায়ে রাশেদীনদের (প্রথম চার খলীফা) এইসব পদবী দেয়া হয়েছিল। আবু সা’ঈদ আল খুদরী (রা) থেকে বর্ণিত রাসূল (সাঃ) বলেছেন,

“যদি দুই জন খলীফাকে আনুগত্যের শপথ দেয়া হয়, তাহলে তাদের মধ্যে পরের জনকে হত্যা কর।”
(সহীহ্‌ মুসলিম, হাদীস নং- ১৮৪২)

আবদুল্লাহ্‌ বিন আমর বিন আল আস্‌ (রা) থেকে হতে ইমাম মুসলিম বর্ণনা করেন, রাসূল (সা) বলেছেন,

“যখন একজন ইমামের হাতে বাই’আত গ্রহণ সম্পূর্ণ হয়ে যায় তখন তাকে যথাসাধ্য মান্য করবে…”
(সহীহ্‌ মুসলিম, হাদীস নং-১৮৪৪)

আউফ ইবনে মালিক (রা) থেকে বর্ণিত, “রাসূল (সাঃ) বলেছেন,

“তোমাদের ইমামদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হচ্ছে তারা যারা তোমাদেরকে ভালবাসে এবং তোমরা তাদেরকে ভালবাসো এবং যারা তোমাদের জন্য প্রার্থনা করে এবং তোমরা যাদের জন্য প্রার্থনা কর;… ”
(সহীহ্‌ মুসলিম, হাদীস নং-৪৭৮২)

এসব হাদীস থেকে বুঝা যায় যে, ইসলামের নিয়ম অনুসারে শাসকদের পদবি হল খলীফা অথবা ইমাম।

“আমীর উল মু’মিনীন” উপাধির ব্যাপারে সবচাইতে নির্ভরযোগ্য হাদীসটি এসেছে শিহাব আল জুহরী’র বর্ণনা থেকে। এ হাদীসটি আল-হাকিম তার মুসতাদরাক গ্রন্থে (খন্ড-৩, পৃষ্ঠা-৭৩, হাদীস নং-৪৪৮০) উল্লেখ করেছেন এবং আল-জাহাবী (তালখিস গ্রন্থে) এটিকে সহীহ্‌ হাদীস বলে উল্লেখ করেছেন। একই বিষয়ে আল-তাবারাণীর একটি বর্ণনা পাওয়া যায় যেটি সম্পর্কে আল-হাইছামী বলেছেন, এ হাদীসের বর্ণনাকারীদের ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। আল-হাকিম হাদীসটি এভাবে বর্ণনা করেছেন যে :”ইবনে শিহাব বর্ণনা করেছেন যে, উমর ইবন আব্দুল আজিজ, আবু বকর ইবন সুলাইমান ইবন আবি হাইছামাকে জিজ্ঞেস করেন যে, “কে প্রথম আমীর উল মু’মিনীন উপাধি লিখতে আরম্ভ করেন? তিনি বলেন, “আশ-শিফা’, যিনি নারীদের মধ্যে সর্বপ্রথম হিজরতকারী ছিলেন, আমাকে বললেন যে, উমর ইবন আল-খাত্তাব (রা) ইরাকের গভর্ণরকে পত্র মারফত দু’জন সত্যনিষ্ঠ ব্যক্তিকে পাঠানোর আদেশ দিলেন যেন তিনি (রা) তাদের কাছ থেকে ইরাক এবং সেখানকার জনগণ সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে পারেন। তিনি (ইরাকের গভর্ণর) লাবিদ ইবন রাবিয়াহ্‌ এবং আদি ইবন হাতিমকে তাঁর কাছে পাঠালেন।

মদিনায় এসে পৌঁছানোর পর তারা তাদের উটগুলোকে (মদিনার) মসজিদ প্রাঙ্গনে থামালেন এবং মসজিদের ভেতর প্রবেশ করলেন। হঠাৎ তারা আমর ইবন আল-আসকে দেখলেন এবং বললেন, “হে আমর! আমীর উল মু’মিনীনের সাথে আমাদের সাক্ষাতের অনুমতির ব্যবস্থা করে দাও!” আমর বললেন, “আল্লাহ’র কসম, তোমরা তাঁকে সঠিক নামেই ডেকেছো। তিনি হচ্ছেন আমাদের আমির, আর আমরা হচ্ছি বিশ্বাসী (মু’মিনীন)।” তারপর আমর লাফিয়ে উঠে উমর, আমির উল মু’মিনীনের কক্ষে প্রবেশ করলেন এবং বললেন, “আস্‌সালামু আলাইকুম, হে আমীর উল মু’মিনীন (আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হোক, হে বিশ্বাসীদের আমীর)। উমর (রা) তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার মাথায় এ উপাধি কিভাবে আসলো, হে আমর? আল্লাহ্‌’র কসম, তুমি যা বলেছো (এটা যে ঠিক) তা তোমাকে প্রমাণ করতে হবে।” তখন তিনি (আমর) বললেন, “লাবিদ ইবন রাবিয়াহ্‌ এবং আদি ইবন হাতিম মদিনায় এসে পৌঁছেছে এবং তারা তাদের উটগুলো মসজিদ প্রাঙ্গনে বেঁধে রেখে আমাকে বলেছে, “হে আমর! আমীর উল মু’মিনীদের সাথে আমাদের সাক্ষাতের অনুমতির ব্যবস্থা করে দাও। আল্লাহ্‌’র কসম! তারা আপনাকে সঠিক উপাধিই দিয়েছে। কারণ, আমরা হলাম বিশ্বাসী (মু’মিনীন) আর আপনি হলেন আমাদের আমীর (নেতা)।” তারপর থেকেই তারা তাদের লেখনীতে আমীর উল মু’মিনীন উপাধি ব্যবহার করতে আরম্ভ করেন।” আশ-শিফা (রা) ছিলেন আবু বকর ইবন সুলাইমানের নানী। এরপর থেকে উমর (রা) এর পরের খলীফাদেরও মুসলিমরা এই উপাধিতে সম্বোধন করতে আরম্ভ করে।”

খলীফা হওয়ার শর্তাবলী

একজন ব্যক্তিকে খলীফা পদের জন্য এবং বাই’য়াতের জন্য বৈধভাবে উপযুক্ত হতে হলে তাকে সাতটি শর্ত পূর্ণ করতে হবে। এ সাতটি শর্ত অবশ্যই পূরণীয়। যদি এদের মধ্যে কোন একটির ব্যত্যয় ঘটে, তাহলে তিনি খলীফার পদের জন্য অনুপযুক্ত হবেন।

অবশ্য পূরণীয় শর্ত সমূহ

প্রথমত: খলীফা অবশ্যই মুসলিম হবেন।

কাফেরদের জন্য এ পদ সংরক্ষিত নয় এবং তাকে মানতেও মুসলিমরা বাধ্য নয়। আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন:

আর মুসলিমদের উপর কাফেরদের কর্তৃত্ব করার কোন পথই আল্লাহ অবশিষ্ট রাখেননি।
[সূরা আন-নিসা: ১৪১]

শাসন করা হল শাসিতের উপর শাসকের শক্তিশালী অবস্থান। সে কারণে ‘লান’ (কখনওই না) শব্দটি দিয়ে মুসলিমদের উপর কাফিরদের কর্তৃত্ব করবার (খলীফা বা অন্য কোন শাসন সংক্রান্ত পদ) ব্যাপারটি সন্দেহাতীত ভাবে নিষিদ্ধ (categorical prohibition) হিসেবে দেখানো হয়েছে। এ কারণে কাফেরদের শাসন মেনে নেয়া মুসলিমদের জন্য হারাম।

যেহেতু খলীফা একজন কর্তৃত্বশীল ব্যক্তি এবং আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা তাকে মুসলিমদের ব্যাপারে দায়িত্বশীল করেছেন সেহেতু তাকে মুসলিম হতে হবে। আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন,

হে ঈমানদারগণ; আলাহ্‌’র নির্দেশ মান্য কর, নির্দেশ মান্য কর রাসূলের এবং তোমাদের মধ্যে যারা কর্তৃত্বশীল (উলীল আমর) তাদের
[সূরা আন-নিসা: ৫৯]

তিনি (আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) আরও বলেন,

তারা যখনই কোন প্রকার জননিরাপত্তা সংক্রান্ত কিংবা ভীতিকর খবর শুনতে পায়, তখনি তা সর্বত্র প্রচার করে দেয় অথচ তারা যদি তা রাসূল ও তাদের উপর কর্তৃত্বশীল ব্যক্তিদের (উলীল আমর) কাছে পৌছে দিত।
[সূরা আন-নিসা: ৮৩]

উলীল আমর শব্দ দুটি সব সময় মুসলিমদের ক্ষেত্রেই ব্যবহার করা হয়েছে। এছাড়া অন্য কোন অর্থে এদের ব্যবহার করা হয়নি। এটা প্রমাণ করে যে, তাদেরকে (কর্ততৃশীল বা উলীল আমর)) সব সময় মুসলিম হতে হবে। যেহেতু খলীফা পদ হচ্ছে সর্বোচ্চ কর্তৃত্বশীল পদ এবং তিনিই অন্যান্যদের কর্তৃত্বশীল পদে নিযুক্ত করবেন, যেমন: তার সহকারীগণ, ওয়ালী, আমীল প্রমুখ, সেহেতু তাকে অবশ্যই মুসলিম হতে হবে।

দ্বিতীয়ত: খলীফাকে অবশ্যই পুরুষ হতে হবে।

মহিলাদের খলীফা হবার কোন বিধান নেই অর্থাৎ কোন নারী খলীফা হতে পারবেন না। বুখারী থেকে বর্ণিত যে, রাসূল (সা) যখন শুনলেন পারস্যের জনগণ কিসরার কন্যাকে তাদের রাণী হিসেবে নিযুক্ত করেছে, তখন তিনি (সা) বললেন,

যারা নারীদেরকে শাসক হিসেবে নিযুক্ত করে তারা কখনওই সফল হবে না।

যেহেতু রাসূলুল্লাহ (সা) এই হাদীসে যারা তাদের বিষয়সমূহ নিষ্পত্তির জন্য নারীদের শাসক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে তাদের সফল না হবার ব্যাপারে ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, সেহেতু তিনি এ ব্যাপারটি নিষিদ্ধ করেছেন। অর্থাৎ যারা নারীদের তাদের বিষয়াবলী নিষ্পত্তির জন্য শাসক হিসেবে নিযুক্ত করবে তাদেরকে সাফল্য পরিত্যাগ করবে এবং এখানে ‘সাফল্য পরিত্যাগ করবে’ শব্দের ব্যবহার হবার কারণে এ নিষেধাজ্ঞাটি অকাট্য (Decisive) বলে গণ্য হবে, অর্থাৎ একজন মহিলাকে ওয়ালী হিসেবে নিয়োগ দান হারাম। সে কারণে নারীদের জন্য যে কোন শাসকের পদ অলংকৃত করা সেটি খলীফা কিংবা অন্য কিছু হোক সেটা হারাম। এর কারণ হচ্ছে হাদীসের বিষয়বস্তু শুধুমাত্র কিসরার কন্যার রাণী হওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, বরং এটি শাসনের সাথে বিজড়িত। আবার হাদীসটি সব বিষয়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয় যেমন বিচারব্যবস্থা, শূরা কাউন্সিল, শাসকদের জবাবদিহি করা কিংবা নির্বাচনে ভোট দিতে পারা ইত্যাদি। বরং এসবই নারীদের জন্য বৈধ, যা পরবর্তীতে আলোচিত হবে।

তৃতীয়ত: খলীফাকে অবশ্যই বালেগ হতে হবে।

নাবালেগ কাউকে খলীফা হিসেবে নিযুক্ত করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। আবু দাউদ, আলী (রা:) থেকে বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা) বলেন:

জবাবদিহিতা তিন ব্যক্তির জন্য নয়: ঘুমন্ত ব্যক্তি যতক্ষণ না সে জেগে উঠে, বালক যতক্ষণ না প্রাপ্তবয়স্ক হয় এবং উম্মাদ ব্যক্তি যতক্ষণ না সে মানসিকভাবে সুস্থ হয়।

আলী (রা:) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা) বলেছেন:

তিন ব্যক্তির আমল নামায় কিছুই লেখা হয় না: উম্মাদ ব্যক্তি যতক্ষন না সে সুস্থ হয়, ঘুমন্ত ব্যক্তি যতক্ষন না সে জেগে উঠে এবং নাবালেগ যতক্ষন না সে বালেগ হয়।

অর্থাৎ যার উপর থেকে বিচারের কলম উঠিয়ে নেয়া হয়েছে সে তার কাজের জন্য দায়ী হবে না। তার কোন শরীয়াগত দায়দায়িত্ব নেই। যে ব্যক্তি নিজের কর্মকান্ডের জন্য দায়িত্বশীল নয় তাকে সে কারণে খলীফাও বানানো যাবে না। এ ব্যাপারে আরও দলিল পাওয়া যায় বুখারীর কাছ থেকে যিনি বর্ণনা করেছেন আবু আকীল জাহারা ইবনে মা’বাদ থেকে; তিনি বর্ণনা করেছেন তার দাদা আবদুলাহ ইবনে হিশাম থেকে যিনি রাসূল (সা) এর সময় জীবিত ছিলেন। ইবনে হিশামের মা তাঁকে রাসূলুলাহ (সা) এর কাছে নিয়ে গেলেন এবং বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! তাঁর কাছ থেকে বাই’য়াত গ্রহণ করুন।’ তখন রাসূল (সা) বললেন, ‘সে তো ছোট’। অতঃপর তিনি (সা) আবদুল্লাহ ইবনে হিশামের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন এবং তার জন্য দোয়া করলেন। সুতরাং নাবালেগের বাই’য়াত যেহেতু গ্রহণযোগ্য নয় সেহেতু তার পক্ষে খলীফা হওয়াও সম্ভবপর নয়।

চতুর্থত: খলীফাকে সুস্থ মস্তিষ্কের হতে হবে।

অসুস্থ মস্তিষ্কের কোন ব্যক্তি খলীফা হতে পারবে না। কারণ রাসূল (সা) বলেন:

“তিন ব্যক্তির আমল নামায় কিছুই লেখা হয় না: উম্মাদ ব্যক্তি যতক্ষন না সে সুস্থ হয়…” বলতে বুঝানো হয়েছে অপ্রকৃতস্থ ব্যক্তি ততক্ষণ পর্যন্ত জবাবদিহিতার আওতায় আসবে না যতক্ষন সে মানসিকভাবে সুস্থ হয়। কারণ মানসিক সুস্থতা যে কোন দায়িত্ব অনুভব করবার জন্য একান্ত প্রয়োজন। খলীফা আইন গ্রহণ করেন এবং বাস্তবায়ন করেন। সে কারণে একজন অপ্রকৃতস্থ খলীফা থাকা বৈধ নয়, কারণ যে ব্যক্তি নিজের ব্যাপারে দায়িত্বশীল নয় সে ব্যক্তি কি করে উম্মাহ্‌র ব্যাপারে দায়িত্বশীল হবেন?

পঞ্চমত: খলীফা ন্যায়পরায়ণ হবেন।

কোন ফাসিক ব্যক্তি – যিনি নির্ভরযোগ্য নন তিনি খলীফা হতে পারবেন না। খলীফা নিয়োগ ও এর ধারাবাহিকতার জন্য সততা একটি আবশ্যিক গুণ। আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেছেন, সাক্ষ্যদানকারী গন অবশ্যই ন্যায়পরায়ণ হবেন। তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেন:

আর এমন দু’জন লোককে সাক্ষী বানাবে যারা তোমাদের মাঝে সুবিচারবাদী হবে।”
[সূরা আত-তালাক: ২]

যেহেতু সাক্ষ্য দানকারীদের সততার কথা বলা হয়েছে সেহেতু যিনি ঐসব সাক্ষ্য দানকারীর শাসক ও উচ্চপদস্থ হবেন তাকে তো অবশ্যই সৎ হতে হবে।

ষষ্ঠত: খলীফা অবশ্যই আযাদ বা মুক্ত হবেন।

যেহেতু একজন দাস তার ব্যাপারে স্বাধীন নয়, সে তার প্রভূর নিয়ন্ত্রনাধীন, সেহেতু জনগণের বিষয়াবলী দেখা ও তাদের শাসন করা তার পক্ষে সম্ভবপর নয়।

সপ্তমত: খিলাফতের দায়িত্ব পালনে খলীফাকে অবশ্যই পারঙ্গম হতে হবে।

কারণ এটি বাই’য়াতের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। যে ব্যক্তি দায়িত্ব পালনে অক্ষম সে কীভাবে বাই’য়াত অনুসারে মানুষের সমস্যাবলী নিরসন করবে এবং আল্লাহ্‌’র কিতাব ও রাসূল (সা) এর সুন্নাহ্‌ দিয়ে শাসন করবে? মাযালিম আদালত (The Court of Unjust Act) এর ক্ষমতা রয়েছে একজন খলীফার কী ধরণের অযোগ্যতা থাকতে পারবে না সে বিষয়সমূহ নির্ধারণ করবার।

পছন্দনীয় শর্তাবলী

উপরে উল্লেখিত শর্তাবলী একজন খলীফা নিযুক্ত হবার জন্য আবশ্যিক গুনাবলী। এ সাতটি বাদে বাকী কোন শর্তই খলীফা নিযুক্ত হবার জন্য বাধ্যতামূলক নয়। আর কিছু শর্তাবলী রয়েছে যেগুলো সহীহ দলিল প্রমাণের মাধ্যমে যদি জরুরী প্রমাণিত হয় তাহলে আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এগুলো গ্রহণ করা যেতে পারে, তবে সেগুলো হবে পছন্দনীয় শর্তাবলী। যদি কোন নির্দেশ অকাট্য (Decisive) বলে প্রমাণিত হয় তাহলে সেটাকে আবশ্যিক শর্তাবলীর আওতায় নেয়া হবে। আর যদি দলিলের ভিত্তিতে সেটি অকাট্য বা চূড়ান্ত (Decisive) বলে প্রমাণিত না হয় তাহলে সে শর্তটি পছন্দনীয় বলে পরিগণিত হবে। এখন পর্যন্ত উল্লেখিত সাতটি আবশ্যিক শর্তাবলী ব্যতীত দলিল প্রমাণের ভিত্তিতে আর কোন গুনাবলী আবশ্যিক বলে পরিগণিত হয়নি। সে কারণে এই সাতটিই খলীফা নিয়োগের জন্য আবশ্যিক শর্তাবলী হিসেবে বিবেচিত। পছন্দনীয় শর্তাবলীর মধ্যে রয়েছে, যেমন:খলীফা হবেন কুরাই’শ, মুজতাহিদ কিংবা অস্ত্র চালনায় পারদর্শী – যেগুলোর ব্যাপারে অকাট্য দলীল নেই।

খলীফা নিয়োগ করার প্রক্রিয়া

শরী’আহ যখন উম্মাহ্‌’র উপর একজন খলীফা নিয়োগ করাকে বাধ্যতামূলক করে দিয়েছে, একইসাথে, শরী’আহ খলীফা নিয়োগ করার পদ্ধতিও নির্ধারণ করে দিয়েছে। এ পদ্ধতি আল্লাহ্‌’র কিতাব ও রাসূল (সা) এর সুন্নাহ্‌ দ্বারা প্রমাণিত। যে সমস্ত মুসলিম খলীফাকে বাই’আত দিবে তাদের অবশ্যই সে সময়ে খিলাফত রাষ্ট্রের নাগরিক হতে হবে। আর, যদি পরিস্থিতি এরকম হয় যে, যখন কোন খিলাফত রাষ্ট্র নেই, তখন সে অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর উপরই বাই’আত দেবার দায়িত্ব বর্তাবে যেখানে খিলাফত রাষ্ট্রব্যবস্থা কার্যকর করা হবে।

বাই’আত যে খলীফা নির্বাচনের পদ্ধতি তা প্রমাণিত হয়, রাসূল (সা) কে মুসলিমদের বাই’আত দেবার ঘটনা ও ইমামকে বাই’আত দেয়ার ব্যাপারে আল্লাহ্‌’র রাসূল (সা) এর নির্দেশ থেকে। তৎকালীন মুসলিমরা রাসূল (সা) কে নবী হিসাবে বাই’আত দেয়নি; বরং শাসক হিসাবে বাই’আত দিয়েছিল। কারণ, তাদের এ বাই’আত বিশ্বাসের সাথে সম্পর্কিত ছিল না, বরঞ্চ তাদের কাজের সাথে সম্পর্কিত ছিল। সুতরাং, রাসূল (সা) কে নবী বা রাসূল হিসেবে বাই’আত দেয়া হয়নি বরং শাসক হিসেবেই বাই’আত দেয়া হয়েছিল। কারণ, নবুয়্যতকে স্বীকৃতি দেবার বিষয়টি মূলতঃ বিশ্বাসের সাথে সম্পর্কিত এবং এখানে বাই’আতের প্রক্রিয়াটি প্রযোজ্য নয়। সুতরাং, আল্লাহ্‌’র রাসূলকে বাই’আত দেবার বিষয়টি তাকে শাসক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া বলেই বিবেচিত হবে।

পবিত্র কুর’আন ও হাদীসেও বাই’আতের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন:

হে নবী ! তোমার নিকট মুমিন স্ত্রী লোকেরা যদি একথার উপর বাই’আত করবার জন্য আসে যে, তারা আল্লাহ্‌’র সাথে কাউকে শরীক করবে না, চুরি করবে না, ব্যাভিচার করবে না, নিজেদের সন্তান হত্যা করবে না, আপন গর্ভজাত জারজ সন্তানকে স্বামীর সন্তান বলে মিথ্যা দাবি করবে না এবং কোন ভাল কাজের ব্যাপারে তোমার অবাধ্যতা করবে না, তবে তুমি তাদের বাই’আত গ্রহণ কর।”
[সূরা মুমতাহিনা : ১২]

অন্য আয়াতে আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন,

হে নবী! যেসব লোক তোমার নিকট বাই’আত গ্রহণ করেছিল তারা আসলে আল্লাহ্‌’র নিকট বাই’আত করছিল। তাদের হাতের উপর আল্লাহ্‌’র হাত ছিল।”
[সূরা আল ফাত্‌হ : ১০]

বুখারী থেকে বর্ণিত হযরত উবাদা ইবন সামিত (রা) বর্ণনা করেন,

“আমরা রাসূল (সা) এর নিকট সন্তুষ্টি-অসন্তুষ্টি উভয় অবস্থায় শ্রবন ও আনুগত্য করার শপথ নিয়েছি। একথার উপরও শপথ নিয়েছি যে, আমরা উলূল আমর (শাসন কর্তৃত্বশীল)-এর সাথে বিবাদ করবনা। আমরা এই মর্মেও শপথ নিয়েছি যে, হকের জন্য উঠে দাঁড়াবো কিংবা হক কথা বলব যে অবস্থায়ই থাকি না কেন। আর, আল্লাহ্‌’র কাজের ব্যাপারে কোন নিন্দুকের নিন্দাকে ভয় করবো না।”
(সহীহ্‌ বুখারী, হাদীস নং-৭০৫৪; সহীহ্‌ মুসলিম, হাদীস নং-৪৭৪৮)

হযরত আবদুল্লাহ্‌ বিন আমর বিন আ’স (রা) থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, আমি আল্লাহ্‌’র রাসূলকে (সা) বলতে শুনেছি যে,

“যে ব্যক্তি কোন ইমামকে বাই’আত প্রদান করল, সে যেন তাকে নিজ হাতের কর্তৃত্ব ও স্বীয় অন্তরের ফল (অর্থাৎ সব কিছু) দিয়ে দিল। এরপর তার উচিৎ উক্ত ইমামের আনুগত্য করা। যদি অন্য কেউ এসে (প্রথম নিযুক্ত) খলীফার সাথে (ক্ষমতার ব্যাপারে) বিবাদে লিপ্ত হয়, তাহলে দ্বিতীয় জনের গর্দান উড়িয়ে দাও।”
(মুসনাদে আহমাদ, খন্ড ৩, পৃষ্ঠা-১০)

এছাড়াও মুসলিম বর্ণনা করেন আবু সাইদ খুদ্‌রী (রা) রাসূল (সা) কে বলতে শুনেছেন:

যদি দু’জন খলীফাকে বাই’আত দেয়া হয়, তাহলে দ্বিতীয়জনকে হত্যা কর।
(সহীহ্‌ মুসলিম, হাদীস নং-১৮৫৩)

আবু হাজিমের বরাত দিয়ে ইমাম মুসলিম আরও বর্ণনা করেন যে, আমি আবু হুরায়রার সাথে পাঁচ বছর অতিবাহিত করেছি এবং তাঁকে বলতে শুনেছি, রাসূল (সা) বলেছেন,

বনী ইসরাইলকে শাসন করতেন নবীগণ। যখন এক নবী মৃত্যুবরণ করতেন তখন তাঁর স্থলে অন্য নবী আসতেন, কিন্তু আমার পর আর কোনও নবী নেই। শীঘ্রই অনেক সংখ্যক খলীফা আসবেন। তাঁরা (রা) জিজ্ঞেস করলেন তখন আপনি আমাদের কী করতে আদেশ করেন? তিনি (সাঃ) বললেন, তোমরা একজনের পর একজনের বাই’আত পূর্ণ করবে, তাদের হক আদায় করবে। অবশ্যই আল্লাহ্‌ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) তাদেরকে তাদের উপর অর্পিত দায়িত্বের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করবেন।” (সহীহ্‌ বুখারী, হাদীস নং-৩৪৫৫)

উপরোক্ত দলীল সমূহ এটা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, আল্লাহ্‌’র কিতাব ও রাসূলের সুন্নাহ্‌ অনুযায়ী খলীফা নিয়োগ করার প্রক্রিয়া হল বাই’আত। সকল সাহাবী (রা) এটি জানতেন এবং তাদের জীবনে তা কার্যকর করেছিলেন। সুতরাং, খোলাফায়ে রাশেদীনদের কেন বাই’আত দেয়া হয়েছিল, এ সমস্ত দলীল-প্রমাণ থেকে তা পরিষ্কার।

খলীফা নিয়োগ করা ও বাই’আত প্রদানের জন্য গৃহীত বাস্তব পদক্ষেপসমূহ

বাই’আত প্রদানের পূর্বে খলীফা নিয়োগের বাস্তব পদক্ষেপসমূহ বিভিন্ন রকম হতে পারে। যে রকমটি হয়েছিল খোলাফায়ে রাশেদীনদের সময়ে, যারা আল্লাহ্‌’র রাসূল (সা) এর ইন্তিকালের পরপরই উম্মাহ্‌’র খলীফা হিসাবে মনোনীত হয়েছিলেন – যেমন: আবু বকর, উমর, উসমান এবং আলী (রা)। এ সমস্ত পদক্ষেপের ব্যাপারে সকল সাহাবী (রা) নীরব থেকে তাঁদের স্বীকৃতি ও সম্মতি প্রদান করেছিলেন। এ বিষয়সমূহ যদি শারী’আহ্‌ সম্মত না হত তাহলে তাঁরা তা কোনক্রমেই মেনে নিতেন না। কারণ, এটি এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যার উপর মুসলিমদের মর্যাদা ও শরী’আহ্‌ হুকুম-আহ্‌কাম বাস্তবায়ন নির্ভর করে। আমরা যদি খোলাফায়ে রাশেদীনদের নিয়োগের বিভিন্ন ধাপসমূহের দিকে লক্ষ্য করি তাহলে দেখব যে, বনু সা’ইদার প্রাঙ্গনে কিছু মুসলিমের মধ্যে আলোচনা হয়েছিল। (আল্লাহ্‌’র রাসূলের পর) সম্ভাব্য খলীফা হিসাবে সা’দ, আবু উবাইদাহ্‌, উমর ও আবু বকর (রা) প্রাথমিকভাবে মনোনীত হয়েছিলেন। এদের মধ্যে, উমর ও আবু উবাইদাহ্‌ (রা) আবু বকর (রা) কে চ্যালেঞ্জ করতে অস্বীকৃতি জানান। অর্থাৎ, বিষয়টি তখন সা’দ এবং আবু বকর (রা) মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে যায়। অনেক তর্ক-বিতর্ক ও আলোচনার পর আবু বকর (রা) কে খলীফা হিসাবে বাই’আত দেয়া হয়। পরদিন মুসলিমদেরকে মসজিদে আহ্বান করা হয় এবং তারা সেখানে আবু বকর (রা) কে বাই’আত দেয়। এ ঘটনা থেকে বোঝা যায় যে, বনু সা’ইদার প্রাঙ্গনের বাই’আতটি ছিল খলীফা হিসাবে নিয়োগের বাই’আত – যার মাধ্যমে আবু বকর (রা) মুসলিমদের খলীফা হিসাবে নির্বাচিত হন। আর তার পরের দিন, মসজিদে গৃহীত বাই’আতটি ছিল আনুগত্যের বাই’আত।

আবু বকর (রা) যখন বুঝতে পারলেন যে তাঁর অসুস্থতা তাঁকে ক্রমশঃ মৃত্যুর দিকে ধাবিত করছে, ঠিক সে সময়ে মুসলিম সেনাবাহিনী পারস্য ও রোমান পরাশক্তিগুলোর সাথে যুদ্ধ করছিল। তখন তিনি তাঁর মৃত্যুর পর কে খলীফা হবেন এ ব্যাপারে মুসলিমদের সাথে আলোচনা করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন। তিনি প্রায় ৩ মাস ব্যাপী মদীনার মুসলিমদের সাথে এ বিষয়ে আলোচনা করলেন। আলোচনার এক পর্যায়ে যখন তিনি অধিকাংশ মুসলিমের মনোভাব বুঝতে পারলেন, তখন তাঁর উত্তরসূরী হিসাবে তিনি উমর (রা.) এর নাম ঘোষণা করলেন। তবে, তাঁর এই মনোনয়ন উমরকে তাঁর পরবর্তী খলীফা হিসেবে নিয়োগের চুড়ান্ত চুক্তি হিসাবে বিবেচিত হয়নি। কারণ, আবু বকরের মৃত্যুর পর মুসলিমরা মসজিদে এসে উমর (রা) কে বাইয়াত দেয় এবং এভাবেই খলীফা হিসাবে তাঁর নিয়োগ চূড়ান্ত হয়। সুতরাং এটা স্পষ্ট যে, উমর (রা) শুধুমাত্র বাই’আতের মাধ্যমেই খলীফা হয়েছিলেন; মুসলিমদের সাথে আবু বকর (রা) এর আলাপ-আলোচনা বা তাঁর মনোনয়নের মাধ্যমে নয়। যদি আবু বকর (রা) এর মনোনয়নই খলীফা নিয়োগের চূড়ান্ত চুক্তি হত, তাহলে উমর (রা) কে মুসলিমদের বাই’আত দেবার কোন প্রয়োজন ছিল না। সুতরাং, এ ঘটনা আমাদের স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করে যে, মুসলিমদের বাই’আত ছাড়া কেউ খলীফা হিসাবে নির্বাচিত হতে পারবে না।

খলীফা থাকাকালীন সময়ে উমর (রা) যখন গুরুতরভাবে আহত হলেন তখন মুসলিমরা তাঁকে একজন খলীফা মনোনীত করার জন্য অনুরোধ করলেন; কিন্তু তিনি তা প্রত্যাখ্যান করলেন। কিন্তু, এ ব্যাপারে তাদের ক্রমাগত অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি ছয়জনকে খলীফা পদের জন্য মনোনীত করেন। অতঃপর তিনি শুয়াইব (রা) কে ইমাম নিযুক্ত করলেন এবং তাঁর মনোনীত ছয়ব্যক্তিকে গভীরভাবে পর্যালোচনা করে (তাঁর মৃত্যুর) তিনদিনের মধ্যে শুয়াইব (রা) কে খলীফা নির্বাচনের দায়িত্ব দিলেন। উমর (রা), শুয়াইব (রা) কে বললেন, “…যদি (ছয়জনের মধ্যে) পাঁচজন একব্যক্তির (খলীফা হবার) ব্যাপারে ঐকমত্যে পৌঁছে এবং একজন দ্বিমত পোষণ করে তাহলে তরবারি দিয়ে তার মস্তক উড়িয়ে দেবে..।” এ ঘটনাটি তাবারণী তার তা’রীখ গ্রন্থেও উল্লেখ করেছেন; এছাড়া, আরও উল্লেখিত আছে ইবন কুতাইবা’র গ্রন্থ আল ইমামা ও সিয়াসাহ, যা কিনা ‘খিলাফতের ইতিহাস’ (দ্যা হিস্ট্রি অফ খিলাফাহ্‌) নামে পরিচিত এবং ইবন সা’দ এর গ্রন্থ আত-তাবাকাত আল-কুবরাহ্‌’তে। তারপর উমর (রা) আবু তাল্‌হা আল-আনসারীকে পঞ্চাশ জন ব্যক্তির সহায়তায় তাঁর মনোনীত ছয়ব্যক্তির নিরাপত্তার দায়িত্বে নিযুক্ত করলেন এবং সেই সাথে, আল মিকদাদ ইবনে আল-আসওয়াদকে উক্ত ছয়প্রার্থীর মিলিত হবার স্থান নির্ধারণের দায়িত্ব দিলেন। উমর (রা) এর মৃত্যুর পর তাঁর মনোনীত ছয় ব্যক্তি একত্রিত হলেন। এরপর, আব্দুর রহমান বিন আউফ (রা) তাদের প্রশ্ন করলেন, “তোমাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম ব্যক্তিকে খলীফা নির্বাচিত করার জন্য কে নিজেকে এ পদ থেকে সরিয়ে নিতে চাও?” এ প্রশ্নের উত্তরে সকলে নিশ্চুপ থাকলে তিনি বললেন, “আমি স্বেচ্ছায় খলীফার পদ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিচ্ছি।” তারপর তিনি এক এক করে প্রত্যেকের সাথে আলাদাভাবে আলোচনা করলেন। তিনি প্রত্যেককে জিজ্ঞেস করলেন, “নিজেকে ছাড়া ছয়জনের মধ্যে আর কাকে তুমি এ পদের জন্য যোগ্যতম ব্যক্তি বলে মনে কর?” তাদের সকলের উত্তর আলী (রা) এবং উসমানের (রা) মধ্যে সীমাবদ্ধ হল। এরপর, আব্দুর রহমান বিন আউফ (রা) এ দু’জনের মধ্যে কাকে জনগণ খলীফা নির্বাচিত করতে চায়, সে বিষয়ে মতামত সংগ্রহের জন্য বেরিয়ে পড়লেন। জনমত যাচাই এর জন্য তিনি মদীনার নারী-পুরুষ সবাইকে জিজ্ঞেস করেছিলেন এবং খলীফা নির্বাচনের এ গুরুত্বপূর্ণ সময়ে তিনি দিনরাত কাজ করেছিলেন। আল মুসওয়ার ইবনে মাখরামা’র বরাত দিয়ে আল-বুখারী বর্ণনা করেছেন যে, “রাতের কিছু সময় অতিবাহিত হবার পর আব্দুর রহমান বিন আউফ আমার ঘরের দরজায় কড়া নাড়ছিল যে পর্যন্ত না আমি জেগে উঠলাম। তিনি বললেন, “আমি দেখতে পাচ্ছি তুমি ঘুমাচ্ছো, কিন্তু আল্লাহ্‌’র কসম, গত তিন রাত আমি খুব কমই ঘুমের আনন্দ উপভোগ করেছি।” এরপর মদীনার জনগণ ফজরের সালাত আদায় করার পর উসমান (রা) কে খলীফা হিসেবে বাই’আত দিল এবং এভাবেই তিনি মুসলিমদের বাই’আতের মাধ্যমে খলীফা হিসাবে নির্বাচিত হলেন। সুতরাং, উসমান (রা) মুসলিমদের বাই’আতের মাধ্যমেই খলীফা হয়েছিলেন, উমর (রা) কর্তৃক মনোনয়নের মাধ্যমে নয়।

উসমান (রা) নিহত হওয়ার সময় মদীনার সাধারণ জনগণ এবং কুফাবাসী আলী ইবনে আবি তালিব (রা) কে খলীফা হিসেবে বাই’আত দেন। এভাবে তিনিও মুসলিমদের বাই’আতের মাধ্যমে খলীফা হিসাবে নির্বাচিত হন।

সাহাবীদের বাই’আত দেয়ার প্রক্রিয়াকে সূক্ষ্ণ বিশ্লেষণ করলে এটা পরিস্কারভাবে বোঝা যায় যে, প্রথমে জনগণের কাছে খলীফা পদপ্রার্থীদের নাম ঘোষণা করা হতো এবং এদের প্রত্যেককে অবশ্যই খলীফা হবার আবশ্যিক শর্তাবলী পূরণ করতে হত। তারপর উম্মাহ্‌’র প্রভাবশালী ব্যক্তি – যারা উম্মাহ্‌কে প্রতিনিধিত্ব করতেন তাদের মতামত সংগ্রহ করা হত।

খোলাফায়ে রাশেদীনদের সময়ে উম্মাহ্‌’র প্রতিনিধি ছিলেন সাহাবা (রা) কিংবা মদীনার অধিবাসীগণ। যে ব্যক্তি সাহাবীদের (রা) অথবা অধিকাংশ জনগণের মতামতের ভিত্তিতে নির্বাচিত হতেন, তাকেই বাই’আত দেয়া হত এবং তার আনুগত্য করা তখন মুসলিমদের উপর ফরয হয়ে যেত। এভাবেই মুসলিমরা খলীফাকে আনুগত্যের বাই’আত প্রদান করতো এবং তাদের নির্বাচিত খলীফাই শাসন ও কর্তৃত্বের ব্যাপারে উম্মাহ্‌’র প্রতিনিধি হয়ে যেতেন।

খোলাফায়ে রাশেদীনদের (রা) বাই’আত দেবার ঘটনাসমূহ থেকে মূলতঃ এ বিষয়গুলোই বোঝা যায়। এছাড়া, উমর (রা) এর ছয়জন ব্যক্তি মনোনীত করার বিষয়টি এবং উসমান (রা) কে বাই’আত দেবার সময় যে প্রক্রিয়া অবলম্বন করা হয়েছিল, তা থেকে আরও দু’টি বিষয় পরিস্কারভাবে বোঝা যায়। আর তা হল, প্রথমত একজন অন্তর্বর্তীকালীন আমীর (নেতা) এর উপস্থিতি, যিনি নতুন খলীফা নির্বাচিত হওয়া কালীন সময় উম্মাহ্‌’র দায়িত্বে থাকবেন এবং দ্বিতীয়ত খলীফার জন্য মনোনীত ব্যক্তিদের সংখ্যা ছয়জনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা।

অন্তর্বর্তীকালীন আমীর

একজন খলীফার কাছে তার মৃত্যু নিকটবর্তী মনে হলে কিংবা খলীফার পদ শূন্য হবার মত কোন পরিস্থিতির উদ্ভব হলে নতুন খলীফা নির্বাচিত হওয়া কালীন সময়ে মুসলিমদের বিষয়াবলী দেখশুনা করার জন্য একজন অন্তর্বর্তীকালীন আমীর নিয়োগ করার ক্ষমতা খলীফার রয়েছে। পূর্ববর্তী খলীফার মৃত্যুর পর তিনি দায়িত্ব গ্রহণ করবেন এবং তার প্রধান কাজ হবে তিনদিনের ভেতর নতুন খলীফা নির্বাচিত করা।

নতুন কোন আইন গ্রহণ করবার ক্ষমতা অন্তর্বর্তীকালীন খলীফার নেই। কারণ, এটি কেবলমাত্র উম্মাহ্‌’র বাই’আতের মাধ্যমে নির্বাচিত খলীফার জন্য সংরক্ষিত। খলীফা পদের জন্য মনোনীতদের মধ্য হতে কেউ অন্তর্বর্তীকালীন আমীর হতে পারবেন না কিংবা মনোনীতদের কাউকে তিনি সমর্থন করতে পারবে না। কারণ, উমর (রা) তাঁর মনোনীত ছয়জনের মধ্য হতে কাউকে অন্তর্বর্তীকালীন আমীর হিসেবে নিয়োগ দেননি।

নতুন খলীফা নির্বাচিত হওয়া মাত্রই অন্তর্বর্তীকালীন আমীরের কার্যকাল শেষ হয়ে যাবে, কারণ তার মেয়াদ অস্থায়ী এবং দায়িত্ব একটি বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনের (নতুন খলীফা নির্বাচিত করা) মধ্যেই সীমিত।

শুয়াইব (রা) যে উমর (রা) কর্তৃক নির্বাচিত অন্তর্বর্তীকালীন আমীর ছিলেন তা উমর (রা) এর মনোনীত ছয়ব্যক্তি সম্পর্কিত উক্তি থেকে বোঝা যায়: “যে তিনদিন তোমরা আলোচনা করবে সে সময় শুয়াইব তোমাদের সালাতে ইমামতি করবে।” এরপর তিনি বলেছিলেন, “…যদি (ছয়জনের মধ্যে) পাঁচজন একব্যক্তির (খলীফা হবার) ব্যাপারে ঐক্যমতে পৌঁছে এবং একজন দ্বিমত পোষণ করে তাহলে তরবারি দিয়ে তার মস্তক উড়িয়ে দেবে..।” এটা প্রমাণ করে যে, শুয়াইব (রা) কে তাদের উপর কর্তৃত্ব দেয়া হয়েছিল। এছাড়া, শুয়াইব (রা) কে সালাতের ইমামও নিযুক্ত করা হয়েছিল এবং সে সময়ে সালাতে ইমামতির অর্থ ছিল জনগণের উপরও ইমাম (নেতা) নিযুক্ত হওয়া। এছাড়া, তাঁকে শাস্তি প্রদানের (মস্তক উড়িয়ে দেয়ার) ক্ষমতাও দেয়া হয়েছিল এবং আমরা জানি যে, একমাত্র আমীরই কোন ব্যক্তিকে শাস্তি প্রদান করার ক্ষমতা রাখেন।

আমীর নির্বাচনের এ ঘটনাটি একদল সাহাবীদের সম্মুখেই ঘটেছিল এবং এ বিষয়ে তারা কেউ কোন দ্বিমত পোষণ করেননি। সুতরাং, এটি ইজমা আস-সাহাবা বা সাহাবীগণের ঐক্যমত যে, নতুন খলীফা নির্বাচিত হবার পূর্বে অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে উম্মাহ্‌’র বিষয়াবলী এবং নতুন খলীফা নিযুক্ত করার প্রক্রিয়া সমূহ দেখাশুনা করার জন্য একজনকে আমীর নিযুক্ত করার ক্ষমতা খলীফার রয়েছে। এর উপর ভিত্তি করে বলা যায় যে, খলীফা তার জীবদ্দশায় রাষ্ট্রের সংবিধানে এ অনুচ্ছেদটি সংযুক্ত করতে পারেন যে, যদি কোন খলীফা অন্তর্বর্তীকালীন আমীর নিযুক্ত না করেই ইন্তেকাল করেন, তবে একজনকে অবশ্যই অন্তর্বর্তীকালীন আমীর হিসাবে নিযুক্ত করতে হবে।

একইভাবে আমরা এ সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে, খলীফার শাসনকালের শেষের দিকে যদি তার পক্ষে অন্তর্বর্তীকালীন আমীর নিয়োগ করা সম্ভব না হয়, তবে খলীফার পরবর্তী জ্যেষ্ঠ্য প্রতিনিধিত্বকারী সহকারী (Next Eldest Delegated Assistant) অন্তর্বর্তীকালীন আমীর হবেন যদি না তাকে খলীফা পদের জন্য মনোনীত করা হয়। যদি তিনি খলীফা পদের জন্য মনোনীত ব্যক্তিদের মধ্যে অন্তর্ভূক্ত হন, তাহলে তার পরবর্তী জ্যেষ্ঠ্য প্রতিনিধিত্বকারী সহকারী অন্তর্বর্তীকালীন আমীর হবেন। যদি খলীফার সব প্রতিনিধিত্বকারী সহকারীই পরবর্তী খলীফা পদের জন্য মনোনীত হন, তবে খলীফার জ্যেষ্ঠ্য নির্বাহী সহকারীকে আমীর নিযুক্ত করা হবে এবং পূর্বের মতোই ব্যাপারটি চলতে থাকবে। যদি উল্লেখিত সকলেই মনোনীত হন তবে কনিষ্ঠ নির্বাহী সহকারী অন্তর্বর্তীকালীন আমীর হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করতে বাধ্য থাকবেন।

যদি খলীফাকে কোন কারণে তার পদ থেকে অপসারণ করা হয় তাহলেও এ নিয়ম প্রযোজ্য হবে। এক্ষেত্রেও একইভাবে খলীফার জ্যেষ্ঠ্য প্রতিনিধিত্বকারী সহকারী অন্তর্বর্তীকালীন আমীর হবেন, যদি না তিনি মনোনীতদের মধ্যে কেউ হন। আর, যদি তিনি মনোনীতদের একজন হন তাহলে তার পরবর্তী জ্যেষ্ঠ্য প্রতিনিধিত্বকারী সহকারী আমীর নিযুক্ত হবেন এবং এভাবে প্রতিনিধিত্বকারী সহকারীদের শেষব্যক্তি পর্যন্ত ব্যাপারটি চলতে থাকবে। প্রতিনিধিত্ব সহকারীদের সকলেই মনোনীত হলে, জ্যেষ্ঠ্য নির্বাহী সহকারী আমীর হবেন এবং পূর্বের মতোই ব্যাপারটি চলতে থাকবে। যদি উল্লেখিত সকলেই মনোনীত হন তবে কনিষ্ঠ নির্বাহী সহকারী অন্তর্বর্তীকালীন আমীর হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করতে বাধ্য থাকবেন।

খলীফা যদি শত্রুর হাতে বন্দী হন সেক্ষেত্রেও এ নিয়ম প্রযোজ্য। তবে, এক্ষেত্রে খলীফাকে উদ্ধার করার কোন সম্ভাবনা না থাকলে অন্তর্বর্তীকালীন আমীরের নির্বাহী ক্ষমতা সম্পর্কে বিস্তারিত উল্লেখ থাকতে হবে। এ বিষয়ে একটি প্রস্তাবনা যথাযথ সময়ে উম্মাহ্‌’র কাছে উপস্থাপন করা হবে।

এখানে উল্লেখ্য যে, এই অন্তর্বর্তীকালীন আমীর খলীফা জিহাদে বা ভ্রমণে যাবার সময় যে ধরনের ডেপুটি বা প্রতিনিধি নিয়োগ করেন সেরকম কিছু নয়। রাসূল (সা) যখন জিহাদে বা হিজ্জাত আল ওয়াদাতে যেতেন তখন এ রকম ডেপুটি নিয়োগ করতেন। জনগণের বিষয়াদি দেখাশুনা করার জন্য যতটুকু নির্বাহী ক্ষমতার দরকার হয়, সাধারণত এ ধরনের ডেপুটি খলীফা কর্তৃক ততটুকু নির্বাহী ক্ষমতা প্রাপ্ত হন।

মনোনীতদের তালিকা সংক্ষিপ্তকরণ

খোলাফায়ে রাশেদীনদের খলীফাপদে নিযুক্ত করার প্রক্রিয়া বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, এখানে মনোনীত ব্যক্তিদের তালিকা সংক্ষিপ্তকরণের একটি বিষয় ছিল। বানু সা’ইদার প্রাঙ্গনে মনোনীত ব্যক্তিদের মধ্যে ছিলেন আবু বকর (রা), উমর (রা), আবু উবাইদাহ (রা) এবং সা’দ বিন উবাদাহ্‌ (রা)। কিন্তু, উমর (রা) এবং আবু উবাইদাহ (রা) নিজেদেরকে আবু বকরের সমতুল্য মনে করেননি, এজন্য তাঁরা আবু বকরকে চ্যালেঞ্জও করেননি। এ কারণে প্রতিযোগিতা আবু বকর ও সা’দ বিন উবাদাহ্‌র মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। পরবর্তীতে, বানু সাইদা’র প্রাঙ্গণে উপস্থিত মদীনার প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ আবু বকরকে বাই’আত দিয়ে খলীফা হিসাবে নির্বাচিত করলেন এবং এর পরদিন জনগণ আবু বকর (রা) কে আনুগত্যের বাই’আত দিলেন।

আবু বকর (রা) শুধুমাত্র উমর (রা) কে তাঁর পরবর্তী খলীফা হিসাবে মনোনীত করেছিলেন। এ পদের জন্য তিনি অন্য আর কাউকেই মনোনীত করে যাননি। পরবর্তীতে, মদীনার মুসলিমরা প্রথমে উমরকে নিযুক্তির বাই’আত ও পরে আনুগত্যের বাই’আত প্রদান করে।

উমর (রা) ছয়ব্যক্তিকে খলীফা পদের জন্য মনোনীত করেছিলেন এবং খিলাফতকে এদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ করেছিলেন।

সেইসাথে, তিনি জনগণকে ছয়জনের মধ্য হতে একজনকে পছন্দ করবার সুযোগ দিয়েছিলেন। মনোনীতদের মধ্য হতে আব্দুর রহমান (রা) নিজেকে এ পদ থেকে সরিয়ে নিয়ে বাকী পাঁচজনের সাথে একান্তে আলোচনা করে সংখ্যাটি দুইয়ে নামিয়ে এনেছিলেন – এরা ছিলেন আলী (রা) এবং উসমান (রা)। পরবর্তীতে জনগণের মতামত যাচাই-বাছাই এর পর উসমান (রা) দিকে পাল্লা ভারী হয় এবং উসমান (রা) মুসলিমদের খলীফা নিযুক্ত হন।

আলী (রা) কে খলীফা হিসাবে নিযুক্ত করার ক্ষেত্রে সে সময় খলীফা পদের জন্য আর কেউ মনোনীত না হওয়ায় মদীনা ও কুফার অধিকাংশ মুসলিম তাঁকেই বাই’আত দেয়। আর, এভাবেই তিনি চতুর্থ খলীফা হিসাবে নিযুক্ত হন।

যেহেতু উসমান (রা) কে খলীফা হিসাবে নিয়োগ করার ক্ষেত্রে (শরী’আহ্‌) অনুমোদিত সর্বোচ্চ সময়ের সবটুকুই নেয়া হয়েছিল; অর্থাৎ, তিনদিন ও এই দিনগুলোর মধ্যবর্তী দুই রাত এবং মনোনীত ব্যক্তিদের সংখ্যা ছয়জনের মধ্যে সীমাবদ্ধ করা হয়েছিল, যা পরবর্তীতে সংক্ষিপ্ত করে দুই ব্যক্তিতে নামিয়ে আনা হয়েছিল, সেহেতু গুরুত্বের কথা বিবেচনা করে সঠিকভাবে বিষয়টি বোঝার জন্য আমরা বিস্তারিতভাবে এ ঘটনা সম্পর্কে আলোচনা করবো :

১. ২৩ হিজরীর জিলহজ্ব মাস শেষ হবার চারদিন আগে বুধবার ভোরে মিহরাবে নামাজে দাঁড়ানো অবস্থায় উমর (রা) কে ছুরিকাঘাত করা হয়। অভিশপ্ত আবু লু’লুয়া’র ছুরিকাঘাতে আহত হয়ে ২৪ হিজরীর মহররম মাসের প্রথমদিন রবিবার সকালে উমর (রা) শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। উমর (রা) এর ইচ্ছা অনুসারে শুয়াইব (রা) তাঁর জানাযার নামাজ পড়ান।

২. উমর (রা) এর দাফনের পর, তাঁর পূর্ববর্তী নির্দেশ অনুসারে আল মিকদাদ (রা) উমরের মনোনীত ছয়ব্যক্তিকে একটি বাড়ীতে একত্রিত করেন; যাদের নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব ছিল আবু তাল্‌হা’র উপর। এরপর, তাঁরা একে অন্যের সাথে আলোচনায় বসেন। পরবর্তীতে তাঁরা আব্দুর রহমান বিন আউফ (রা) কে তাঁদের মধ্য হতে এবং তাঁদের সম্মতিক্রমে খলীফা নির্বাচিত করার ব্যাপারে প্রতিনিধি হিসেবে নিযুক্ত করেন।

৩. আব্দুর রহমান (রা.) তাঁদের সাথে একান্তে আলোচনা করেন এবং প্রত্যেককে জিজ্ঞেস করলেন, “নিজেকে ছাড়া ছয়জনের মধ্যে আর কাকে তুমি এ পদের জন্য যোগ্যতম ব্যক্তি বলে মনে কর?” তাঁদের উত্তর আলী (রা) এবং উসমানের (রা) মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়েছিল। এভাবে আব্দুর রহমান (রা) বিষয়টি ছয়ব্যক্তি থেকে বিষয়টি দুইব্যক্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ করেন।

৪. এরপর আব্দুর রহমান (রা) মদীনার জনগণের সাথে আলোচনা করা শুরু করেন।

৫. বুধবার রাতে, অর্থাৎ (রবিবার) উমর (রা) ইন্তেকালের পর তৃতীয় দিন রাতে আব্দুর রহমান তাঁর ভাতিজা আল মুসওয়ার ইবনে মাখরামার বাড়িতে গেলেন। এ বিষয়ে ইবনে কাসীর তাঁর প্রসিদ্ধ গ্রন্থ ‘আল বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াতে বর্ণনা করেছেন যে :

“যখন উমরের মৃত্যুর পর চতুর্থ দিনের রাত শুরু হল আবদূর রহমান তাঁর ভাতিজা আল মুসওয়ার ইবনে মাখরামার বাড়িতে গেলেন এবং বললেন, “দেখতে পাচ্ছি তুমি ঘুমাচ্ছো, কিন্তু আল্লাহ্‌’র কসম! গত তিনরাত আমি খুব কমই ঘুমের আনন্দ উপভোগ করেছি।” তিনরাত মানে রবিবার সকালে উমর (রা.) মারা যাবার পরে অর্থাৎ, সোম, মঙ্গল ও বুধবারের রাত। তারপর তিনি বললেন, “…যাও আলী এবং উসমানকে ডেকে নিয়ে এসো..”, তারপর তিনি তাঁদেরকে (আলী ও উসমানকে) মসজিদে ডেকে নিয়ে আসলেন এবং জনসাধারণকে নামাজের জন্য ডাকা হলো। এটা ছিল বুধবার ভোরের ঘটনা। তারপর তিনি আলী (রা) এর হাত ধরলেন এবং তাঁকে আল্লাহ্‌’র কিতাব, রাসূল (সা) এর সুন্নাহ্‌ ও আবু বকর ও উমর (রা) এর কর্মের উপর বাই’আত করতে বললেন। আলী (রা) তাঁকে তার সেই বিখ্যাত উত্তরটি দিলেন, “আল্লাহ্‌’র কিতাব ও রাসূল (সা) এর সুন্নাহ্‌র উপর আমি বাই’আত নিলাম। কিন্তু, আবু বকর ও উমরের কর্মের বিষয়ে তিনি বললেন যে, এ সকল বিষয়ে তিনি তাঁর নিজস্ব ইজ্‌তিহাদ প্রয়োগ করবেন। এ কথা শুনার পর আব্দুর রহমান, আলীর হাত ছেড়ে দিলেন। এরপর, আব্দুর রহমান বিন আউফ, উসমান (রা) এর হাতটি ধরলেন ও তাঁকেও একই কথা বলতে বললেন। উসমান (রা) বললেন, ‘হ্যাঁ, আল্লাহ্‌’র নামে।’ এভাবে উসমান (রা) এর বাই’আত সম্পন্ন হল।

শুয়াইব (রা) সেদিনের ফযর ও জোহরের নামাযে ইমামতি করলেন। এরপর, উসমান (রা) মুসলিম উম্মাহ্‌’র খলীফা হিসেবে আসর থেকে ইমামতি শুরু করলেন। এর অর্থ হচ্ছে, যদিও উসমান (রা) ফজরের সময় নিযুক্তির বাই’আত পেয়েছিলেন, কিন্তু মদীনার প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গের বাই’আত পাবার পূর্ব পর্যন্ত মুসলিমদের আমীর হিসেবে শুয়াইব (রা) এর কর্তৃত্বই বহাল ছিল। প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গের বাই’আত দেবার পর্ব শেষ হয়েছিল মূলতঃ আসরের কিছু আগে, যখন সাহাবারা উসমান (রা) কে বাই’আত দেয়ার ব্যাপারে একে অপরকে আহ্বান করছিলেন। আসরের কিছুকাল পূর্বে বাই’আত গ্রহণ পর্ব শেষ হয়ে যাবার সাথে সাথে আমীর হিসাবে শুয়াইব (রা) এর কার্যকালও শেষ হয়ে যায় এবং আসরের নামায থেকে উম্মাহ্‌’র খলীফা হিসাবে উসমান (রা) ইমামতি শুরু করেন।

‘আল বিদায়াহ ওয়ান নিহায়া’ গ্রন্থের রচয়িতা ব্যাখ্যা করেছেন, কেন উসমান (রা) ফজরের সময় বাই’আত নেয়া সত্ত্বেও শুয়াইব (রা) জোহরের নামাযে ইমামতি করেছিলেন। এ বিষয়ে তার ব্যাখ্যা হল: “কিছু মানুষ মসজিদে উসমানকে বাই’আত দেয়ার পর তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় মাজলিশ আশ-শুরা ভবনে (যেখানে শুরা কমিটির লোকজন মিলিত হতেন)।

সেখানে বাকীরা তাঁকে বাই’আত দেয়। এ ঘটনা থেকে বোঝা যায় যে, জোহর নামায অতিক্রান্ত হবার পরও উসমানের বাই’আত গ্রহণ পর্ব চলছিল। আর, এ কারণেই মসজিদে নববীতে জোহরের নামাযে শুয়াইব (রা) ইমামতি করেছিলেন।

সুতরাং, মুসলিম উম্মাহ্‌’র খলীফা হিসাবে উসমান (রা) প্রথম যে নামাযে ইমামতি করেছিলেন তা ছিল আসরের নামায।”

বিভিন্ন বর্ণনা অনুসারে উমর (রা) ছুরিকাহত হওয়ার দিন, আহত হবার পর তাঁর ইন্তিকালের দিন এবং উসমান (রা) এর বাই’আতের দিনগুলোর ব্যাপারে কিছু মতপার্থক্য আছে। তবে, আমরা চেষ্টা করেছি দলীল-প্রমাণের দিক থেকে যেটি সবচাইতে শক্তিশালী ও গ্রহণযোগ্য সেটি উপস্থাপন করতে।

উপরোক্ত আলোচনা অনুসারে, (খলীফার ইন্তিকাল কিংবা অপসারণের মাধ্যমে) খলীফার পদ শূন্য হওয়ার পর নতুন খলীফা মনোনয়নের ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত বিষয়াবলীর প্রতি অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে :

১. খলীফা নিয়োগের কাজটি দিন-রাত ব্যাপী করতে হবে যতক্ষণ পর্যন্ত না এটি সম্পন্ন হয়।

২. খলীফা নিযুক্ত হবার আবশ্যিক শর্তাবলী পূরণের মাধ্যমে মনোনীতদের তালিকা করতে হবে এবং এ বিষয়টি মূলতঃ পরিচালিত হবে মাহ্‌কামাতুল মাযালিমের মাধ্যমে।

৩. তারপর মনোনীতদের তালিকা সংক্ষিপ্ত করা হবে দু’বার: প্রথমে ছয় এবং পরে দুই। উম্মাহ্‌’র প্রতিনিধি হিসাবে মজলিশ আল-উম্মাহ্‌ এই সংক্ষিপ্ত তালিকা তৈরীর কাজ করবে। এর কারণ হল, উম্মাহ্‌ উমর (রা) কে তাদের প্রতিনিধি নিযুক্ত করেছিল এবং উম্মাহ্‌’র প্রতিনিধি হিসাবেই তিনি সম্ভাব্য ছয়জনের তালিকা প্রস্তুত করেছিলেন।

পরবর্তীতে, মনোনীত এই ছয়জন তাঁদের মধ্য হতে একজনকে অর্থাৎ, আব্দুর রহমান বিন আউফকে তাঁদের প্রতিনিধি নির্বাচন করেছিলেন। যিনি আবার আলোচনার ভিত্তিতে এই তালিকা সংক্ষিপ্ত করে তা দু’জনের মধ্যে সীমাবদ্ধ করেছিলেন। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, প্রতিটি পর্যায়ে উম্মাহ্‌’র প্রতিনিধিদের মাধ্যমেই বিষয়টি সম্পন্ন হয়েছে। সুতরাং, এটি উম্মাহ্‌’র প্রতিনিধিত্বকারী মজলিশ আল-উম্মাহ্‌’র কাজ।

৪. নতুন খলীফা নির্বাচনের ঘোষণার সাথে সাথে অন্তর্বর্তীকালীন আমীরের কার্যকাল শেষ হবে না; বরং বাই’আত গ্রহণ পর্ব পুরোপুরি সম্পন্ন হবার পর তার কার্যকাল শেষ হয়ে যাবে। কারণ, শুয়াইব (রা) এর কার্যকাল উসমান (রা) খলীফা নির্বাচিত হবার সাথে সাথে শেষ হয়নি; বরং বাই’আত গ্রহণ পর্ব সম্পন্ন হবার পরই তা শেষ হয়েছিল।

তিন দিন এবং এদের অন্তর্বর্তী রাত সমূহের ভেতর কিভাবে নতুন খলীফা নির্বাচিত করা যায় সে ব্যাপারে একটি বিল পাশ করা হবে। অবশ্য এটি ইতিমধ্যে কার্যকর হয়ে গেছে। ইন্‌শাআল্লাহ্‌ আমরা যথা সময়ে এটি উম্মাহ্‌’র কাছে উপস্থাপন করবো।

সুতরাং, মুসলিম উম্মাহ্‌’র যদি একজন খলীফা থাকে এবং কোন কারণে যদি তাকে অপসারণ করা হয় কিংবা তার মৃত্যু হয়, তবে এ সকল ক্ষেত্রে এ বিধানগুলো প্রযোজ্য হবে। কিন্তু পরিস্থিতি যদি এমন হয় যে, মুসলিম উম্মাহ্‌’র উপর কোন খলীফা কর্তৃত্বশীল অবস্থায় নেই, তবে সেক্ষেত্রে মুসলিমদের জন্য শারী’আহ্‌ আইন বাস্তবায়ন করা এবং বিশ্বব্যাপী ইসলামের দাওয়াতকে ছড়িয়ে দেবার জন্য তাদের উপর একজন খলীফা নিয়োগ করা বাধ্যতামূলক হবে; ১৩৪২ হিজরীর ২৮ রজব তারিখে (১৯২৪ সালে ৩ মার্চ) ইস্তাম্বুলে খিলাফত রাষ্ট্রব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যাবার পর যে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এ অবস্থায় মুসলিমদের প্রতিটি ভূমিই খলীফা নিয়োগ দেবার জন্য উপযুক্ত, যে খলীফার উপর খিলাফত রাষ্ট্রের গুরুভার অর্পণ করা হবে। সুতরাং, মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে কোন একটি দেশের জনগণ যদি কাউকে খলীফা হিসেবে বাই’আত দেয় এবং তার উপর খিলাফতের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়, তাহলে বিশ্বের অন্যান্য মুসলিম দেশগুলোর উপর উক্ত খলীফাকে আনুগত্যের বাই’আত দেয়া ফরয হয়ে যাবে, অর্থাৎ তার শাসন-কর্তৃত্বকে পরিপূর্ণভাবে স্বীকার করে নিতে হবে। তবে, এটি শুধুমাত্র উক্ত খলীফাকে তার নিজ ভূমির জনগণ বাই’আতের মাধ্যমে তার উপর খিলাফতের দায়িত্ব অর্পণ করার পরেই কার্যকরী হবে। যাই হোক, উক্ত রাষ্ট্রকে (যে রাষ্ট্রে খলীফা নিয়োগ করা হবে) নিম্নলিখিত শর্তগুলো পূরণ করতে হবে:

১. উক্ত রাষ্ট্রের শাসন-কর্তৃত্ব অবশ্যই মুসলিমদের হাতে থাকতে হবে। এ শাসন-কর্তৃত্ব কোন কাফির-মুশরিক
রাষ্ট্র কিংবা শক্তির অধীনস্থ হতে পারবে না।

২. উক্ত রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ইসলামের মাধ্যমে নিশ্চিত করতে হবে অর্থাৎ দেশের আভ্যন্তরীণ এবং বৈদেশিক নিরাপত্তা অন্য সবকিছু ব্যাতীত শুধুমাত্র ইসলামের নামে হতে হবে এবং তা ইসলামী (মুসলিম) সেনাবাহিনীর হাতে থাকতে হবে।

৩. উক্ত রাষ্ট্রে ইসলামকে তাৎক্ষণিক, পূর্ণাঙ্গ এবং মৌলিকভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। ইসলামের দাওয়াতী কার্যক্রমের সাথে খলীফাকে যুক্ত থাকতে হবে।

৪. খলীফাকে অবশ্যই নিয়োগের সকল আবশ্যিক শর্ত পূরণ করতে হবে, যদিও পছন্দনীয় শর্তসমূহ (preferred condition) পূরণ না করলেও চলবে।

যদি কোন রাষ্ট্র এ চারটি শর্ত পূরণ করতে সক্ষম হয় তাহলে শুধুমাত্র তাদের বাই’আতের মাধ্যমেই খিলাফত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে এবং তাদের মাধ্যমেই খিলাফত প্রতিষ্ঠার কাজটি সম্পন্ন হবে। সেইসাথে, তাদের নির্বাচিত খলীফা হবেন উম্মাহ্‌’র বৈধ খলীফা এবং এ অবস্থায় তাকে ছাড়া অন্য কাউকে বাই’আত প্রদান করা শরী’আহ্‌ সম্মত হবে না।

এরপর যদি অন্য কোন রাষ্ট্র কাউকে খলীফা হিসাবে বাই’আত দেয় তবে তা বাতিল বলে বিবেচিত হবে। কারণ রাসূল (সাঃ) বলেছেন,

যদি দুই জন খলীফাকে বাই’আত দেয়া হয় তাহলে পরের জনকে হত্যা কর।” (সহীহ্‌ মুসলিম, হাদীস নং-১৮৫৩)

প্রথমজনের বাই’আত সম্পূর্ণ কর, তারপরও প্রথমজনের।” (সহীহ্‌ বুখারী, হাদীস নং-৩৪৫৫)

যে ব্যক্তি কোন ইমামকে বাই’আত প্রদান করল, সে যেন তাকে নিজ হাতের কর্তৃত্ব ও স্বীয় অন্তরের ফল (অর্থাৎ সব কিছু) দিয়ে দিল। এরপর তার উচিত উক্ত ইমামের আনুগত্য করা। যদি অন্য কেউ এসে (প্রথম নিযুক্ত) খলীফার সাথে (ক্ষমতার ব্যাপারে) বিবাদে লিপ্ত হয়, তাহলে দ্বিতীয় জনের গর্দান উড়িয়ে দাও।
(সহীহ্‌ মুসলিম, হাদীস নং-১৮৪৪)

বাই’আতের প্রক্রিয়া

পূর্বের আলোচনায় আমরা খলীফা নিয়োগের ক্ষেত্রে বাই’আত-ই যে একমাত্র ইসলাম সম্মত প্রক্রিয়া সে ব্যাপারে দলীলপ্রমাণ উপস্থাপন করেছি। বাস্তবে বাই’আত প্রদান প্রক্রিয়াটি হাতে হাত মিলানো কিংবা লেখার মাধ্যমে সম্পন্ন হতে পারে।

আব্দুল্লাহ্‌ ইবনে দীনার থেকে বর্ণিত আছে যে, “যখন জনসাধারণ আব্দুল মালিক ইবনে মারওয়ানকে খলীফা নির্বাচনের বিষয়ে সম্মত হল তখন আমি ইবনে উমরকে এটি লিখতে দেখেছি যে, ‘আমি এই মর্মে লিখছি যে, আল্লাহ্‌’র কিতাব, রাসূলের (সা) সুন্নাহ এবং আমার সাধ্যনুসারে আমি আমীর উল মু’মিনীন আবদুল মালিকের নির্দেশ শুনতে ও মানতে রাজী আছি।” অন্য যে উপায়েও বাই’আত দেয়া যেতে পারে।

তবে, কেবলমাত্র প্রাপ্তবয়স্করাই বাই’আত দিতে পারবে। কারণ, অপ্রাপ্তবয়স্কদের বাই’আত গ্রহণযোগ্য নয়। আবু আকীল জাহ্‌রাহ ইবনে মা’বাদ তাঁর দাদা আবদুল্লাহ বিন হিশাম থেকে বর্ণনা করেছেন যে, যিনি (ইবনে হিশাম) রাসূল (সা) এর সময় জীবিত ছিল। তাঁর মা যয়নাব ইবনাতু হামিদ তাঁকে রাসূলুল্লাহ (সা) এর কাছে নিয়ে গেলেন এবং বললেন, ‘হে আল্লাহ্‌’র রাসূল! তাঁর কাছ থেকে বাই’আত গ্রহণ করুন।’ তখন রাসূল (সা) বললেন, ‘সে তো ছোট’। অতঃপর তিনি আবদুল্লাহ ইবনে হিশামের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন এবং দোয়া করলেন। (সহীহ্‌ বুখারী, হাদীস নং-৭২১০)

বাই’আতে উচ্চারিত শব্দ সমূহের ব্যাপারে কোন সীমাবদ্ধতা নেই; তবে খলীফা যে আল্লাহ্‌’র কিতাব এবং রাসূলের সুন্নাহ্‌ দ্বারা শাসন করবেন এ ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি থাকা উচিত এবং যে ব্যক্তি বাই’আত দেবে সে যে সুসময়ে ও দুঃসময়ে এবং ভাল-মন্দ উভয় অবস্থাতেই খলীফার আনুগত্য করবে তাও উল্লেখ থাকা প্রয়োজন। উপরে উল্লেখিত বিষয়বস্তু অনুসারে বাই’আতে উচ্চারিত শব্দসমূহের ব্যাপারে পরবর্তীতে একটি আইন পাশ করা হবে।

কোন ব্যক্তি যখন খলীফাকে বাই’আত দেবে তখন প্রদত্ত বাই’আত উক্ত ব্যক্তির উপর আমানত হয়ে যাবে এবং সে চাইলেই এ বাই’আত থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারবে না। কারণ, খলীফা নিয়োগের ক্ষেত্রে বাই’আত প্রদান পর্যন্ত অন্যসব মুসলিমদের মতোই এটি তার অধিকার। কিন্তু, একবার বাই’আত প্রদান করলে সেখান থেকে হাত উঠিয়ে নেবার কোন অধিকার তার নেই। এমনকি সে চাইলেও তাকে অনুমতি দেয়া হবে না। জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা) থেকে আল বুখারী বর্ণনা করেছেন যে, একজন বেদুইন রাসূলুল্লাহ্‌ (সা) কে ইসলামের ব্যাপারে বাই’আত দিল। কিন্তু তারপর সে অসুস্থ হয়ে পড়ল। এরপর সে রাসূল (সা) এর কাছে গিয়ে বলল,

“আমাকে বাই’আত থেকে মুক্ত করে দিন।’ তিনি (সা) তা করতে অস্বীকৃতি জানালেন। তারপর ঐ ব্যক্তি আবার আসল এবং একই দাবি করল কিন্তু রাসূল (সা) আবারও তাকে প্রত্যাখান করলেন। তারপর সে ব্যক্তি শহর ছেড়ে চলে গেল। [এ পরিপ্রেক্ষিতে] রাসূল (সা) বললেন, “এই শহর হচ্ছে কামারের জ্বলন্ত চুল্লীর মতো; এটি অপবিত্রতা ও অপরিচ্ছন্নতা থেকে নিজেকে মুক্ত করে এবং সেইসাথে, শ্বাশত সুন্দর ও সত্যকে আলোকদ্যুতির মতো বিচ্ছুরিত করে।”
(সহীহ্‌ বুখারী, হাদীস নং-৭২০৯)

এছাড়া, আব্দুল্লাহ্‌ বিন উমরের বরাত দিয়ে মুসলিম নাফিঈ থেকে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি (ইবন উমর (রা) রাসূল (সা) কে বলতে শুনেছেন,

‘যে ব্যক্তি আনুগত্যের হাত সরিয়ে নিল, সে কিয়ামতের দিন এমনভাবে আল্লাহ্‌’র সাথে দেখা করবে যে তার পক্ষে কোন প্রমাণ থাকবে না।’ 
(সহীহ্‌ মুসলিম, হাদীস নং-১৮৫১)

বস্তুতঃ খলীফার বাই’আত থেকে হাত উঠিয়ে নেবার অর্থ হল আল্লাহ্‌’র আনুগত্য থেকে হাত সরিয়ে নেয়া। তবে, এটি শুধুমাত্র সে অবস্থার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে যখন খলীফাকে নিযুক্তির বাই’আত দেয়া হবে কিংবা মুসলিম উম্মাহ্‌ খলীফাকে পূর্ণ আনুগত্যের শপথ প্রদান করবে। তবে, কেউ যদি কোন ব্যক্তিকে প্রাথমিকভাবে খলীফা হিসাবে মনোনীত করে বাই’আত দেয়, কিন্তু উক্ত মনোনীত ব্যক্তি যদি মুসলিম উম্মাহ্‌ কর্তৃক নিযুক্তির বাই’আত না পায়, তবে এক্ষেত্রে বাই’আত দানকারী ব্যক্তি তার প্রদত্ত বাই’আত থেকে হাত সরিয়ে নিতে পারবে। কারণ, সে মুসলিম উম্মাহ্‌ কর্তৃক নিযুক্তির বাই’আত প্রাপ্ত হয়নি। মূলতঃ উপরোক্ত হাদীসটি (চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত) খলীফার আনুগত্য থেকে হাত সরিয়ে নেবার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে; এমন ব্যক্তির উপর থেকে নয় যিনি খলীফা হিসাবে চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত বা নিযুক্ত হননি।

খিলাফতের ঐক্য

মুসলিমরা এক রাষ্ট্রে একজন শাসক দ্বারা শাসিত হতে বাধ্য। একের বেশী রাষ্ট্র থাকা এবং একাধিক শাসক দ্বারা শাসিত হওয়া অবৈধ। খিলাফত হল একটি ঐক্যের শাসন এবং এটি ফেডারেল পদ্ধতির শাসন নয়।

হযরত আবদুলাহ্‌ বিন আমর বিন আ’স (রা) থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন-আমি আল্লাহ্‌’র রাসূলকে (সা) বলতে শুনেছি যে,

“যে ব্যক্তি কোন ইমামকে বাই’আত প্রদান করল, সে যেন তাকে নিজ হাতের কর্তৃত্ব ও স্বীয় অন্তরের ফল (অর্থাৎ সব কিছু) দিয়ে দিল। এর পর তার উচিৎ উক্ত ইমামের আনুগত্য করা। যদি অন্য কেউ এসে (প্রথম নিযুক্ত) খলীফার সাথে (ক্ষমতার ব্যপারে) বিবাদে লিপ্ত হয়, তাহলে দ্বিতীয় জনের গর্দান উড়িয়ে দাও।”
(মুসলিম)

’আরফাযার রেওয়াতে ইমাম মুসলিম বর্ণণা করেন, তিনি রাসুল (সা) কে বলতে শুনেছেন,

“যখন তোমরা এক ব্যক্তির নেতৃত্বের মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ অবস্থায় থাকবে তখন কেউ যদি তোমাদের কর্তৃত্ব ও ঐক্যে ফাটল সৃষ্টি করার বাসনা নিয়ে আসে তবে তাকে হত্যা কর।”

আবু সাঈদ খুদরী (রা) এর রেওয়াতে মুসলিম বর্ণণা করেন যে, তিনি রাসূল (সা) -কে বর্ণনা করতে শুনেছেন,

“যদি দু’জনের জন্য খলীফা নিযুক্তির বাই’য়াত নেয়া হয় তাহলে পরের জনকে হত্যা কর।”

আবু হাজিমের বরাত দিয়ে ইমাম মুসলিম আরও বর্ণনা করেন যে, আমি আবু হুরায়রার সাথে পাঁচ বছর অতিবাহিত করেছি এবং তাকে বলতে শুনেছি, রাসূল (সা) বলেন,

“বনী ইসরাইলকে শাসন করতেন নবীগণ। যখন এক নবী মৃত্যুবরণ করতেন তখন তাঁর স্থলে অন্য নবী আসতেন, কিন্তু আমার পর আর কোনও নবী নেই। শীঘ্রই অনেক সংখ্যক খলীফা আসবেন। তাঁরা (রা) জিজ্ঞেস করলেন তখন আপনি আমাদের কী করতে আদেশ করেন? তিনি (সা) বললেন, তোমরা একজনের পর একজনের বাই’য়াত পূর্ণ করবে, তাদের হক আদায় করবে। অবশ্যই আল্লাহ্‌ (সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালা) তাদেরকে তাদের উপর অর্পিত দায়িত্বের ব্যাপারে জবাবদিহি করবেন।”

প্রথম হাদীস অনুসারে, যদি কাউকে ইমাম বা খলীফা নিযুক্ত করা হয় তবে তার আনুগত্য করতে হবে। এমতাবস্থায় কেউ যদি খলীফার কর্তৃত্বের ব্যাপারে বিবাদ করতে আসে তাহলে তার সাথে যুদ্ধ করতে হবে এবং তাকে হত্যা করতে হবে – যদি সে বিবাদ থেকে বিরত না হয়।

দ্বিতীয় হাদীস অনুসারে, মুসলিমরা এক আমীরের অধীনে ঐক্যবদ্ধ থাকবে। এ অবস্থায় কোন ব্যক্তি যদি খলীফার কর্তৃত্বের এবং মুসলমানদের ঐক্যে ফাটল ধরাতে চায় তাহলে তাকে হত্যা করা বাধ্যতামূলক। দু’টি হাদীসই রাষ্ট্রের অখন্ডতা, রাষ্ট্রের নেতৃত্বের অভিন্নতার কথা বলেছে সেটা শক্তি প্রয়োগ করে হলেও।

তৃতীয় হাদীস অনুসারে, খলীফার অনুপস্থিতি – সেটা মৃত্যুর কারণে কিংবা অপসারণ বা পদত্যাগের পর দু’জন খলীফাকে বাই’য়াত দেয়া হলে দ্বিতীয় জনকে হত্যা করবার কথা বলা হয়েছে। তার মানে হল প্রথম যাকে বাই’য়াত দেয়া হয় তিনিই খলীফা এবং দ্বিতীয় জনকে অবশ্যই হত্যা করতে হবে যদি না তিনি তাকে সে পদ থেকে প্রত্যাহার করে নেয়। এর অর্থ হল রাষ্ট্রকে খন্ড খন্ড করা, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রে বিভক্ত করা নিষিদ্ধ, এটা একটি অখন্ড রাষ্ট্র হবে।

চতুর্থ হাদীস অনুসারে, রাসূল (সা) এর পর খলীফা আসবেন এবং তারা সংখ্যায় হবেন অনেক। তারপর সাহাবা (রা) যখন এ ব্যাপারে তাদের দায়িত্ব সর্ম্পকে জিজ্ঞেস করলেন তখন রাসূল (সা) বললেন, তাদেরকে (সাহাবাদেরকে) একজনের পর একজন খলীফার প্রতি নিযুক্তির বাই’য়াত সম্পন্ন করতে হবে এবং প্রত্যেক ক্ষেত্রেই প্রথমজনকে বৈধ খলীফা হিসেবে মেনে নিতে হবে। প্রথমজনের পরে যে বা যারা নিজেদের খলীফা হিসেবে বাই’য়াত গ্রহণ করবে, সেই বাই’য়াত বাতিল ও অবৈধ বলে পরিগণিত হবেন। এ হাদীস অনুসারে একজন খলীফার প্রতি আনুগত্য বাধ্যতামূলক। সুতরাং মুসলমানদের একের অধিক খলীফা থাকা এবং একাধিক রাষ্ট্র থাকা অনুমোদিত নয়।

খলীফার নির্বাহী ক্ষমতাসমূহ

খলীফা নিম্নলিখিত নির্বাহী ক্ষমতাসমূহ ভোগ করবেন:

ক- তিনি উম্মাহ্‌’র বিষয়াবলী নিরসনের জন্য আহকামে শরী’আহ বা শরী’আহ আইন গ্রহণ করবেন-যেগুলো আল্লাহর কিতাব, রাসূল (সা) এর সুন্নাহ অনুযায়ী নির্ভরযোগ্য ইজতিহাদের ভিত্তিতে উৎসারিত। সুতরাং এগুলো বাধ্যতামূলক আইন হবে এবং কেউ প্রত্যাখান করতে পারবে না।

খ- তিনি আভ্যন্তরীণ এবং বৈদেশিক নীতির জন্য দায়িত্বশীল হবেন; তিনি প্রতিরক্ষা বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হবেন এবং যে কোন যুদ্ধ ঘোষণা, শান্তি চুক্তি সম্পাদন, যুদ্ধ বিরতি চুক্তি ইত্যাদি বিভিন্ন চুক্তি সম্পাদনের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হবেন।

গ- তার বিদেশী দূত গ্রহণ ও প্রত্যাখানের ক্ষমতা থাকবে এবং অন্য রাষ্ট্রে মুসলিম দূত প্রেরণ ও প্রত্যাহারে ক্ষমতাধিকারী হবেন।

ঘ- খলীফা তার সহকারীগণ ও ওয়ালীগণকে নিয়োগ ও প্রত্যাহার করতে পারবেন। তারা সবাই খলীফা ও মজলিসে উম্মাহর কাছে দায়বদ্ধ থাকবেন।

ঙ- খলীফা সর্বোচ্চ বিচারপতি (কাজী-উল-কুযাত – qadhi-ul-qudhat), অন্যান্য বিচারপতি নিয়োগ ও অপসারণ করতে পারবেন। শুধুমাত্র মাহকামাতুল মাজালিমকে তিনি নিয়োগ করতে পারবেন কিন্তু তাকে সরিয়ে দেবার ক্ষেত্রে খলীফার কিছু সীমাবদ্ধতা থাকবে যা বিচারব্যবস্থার অধ্যায়ে আলোচিত হবে। তিনি প্রশাসনিক বিভাগের ব্যবস্থাপক, সেনা কমান্ডার, চীফ অব স্টাফ, প্রধান সেনা কমান্ডারদেরকেও নিয়োগ দেবেন। তাদের সবার দায়বদ্ধতা খলীফার প্রতি, মজলিসে উম্মাহর প্রতি নয়।

চ- তিনি শরী’আহ্‌র আলোকে রাষ্ট্রের বাজেট প্রণয়ন করবেন এবং বাজেটের খুটিনাটি, প্রত্যেক বিভাগে অর্থ বরাদ্দ সেটা আয় কিংবা ব্যয়ের ক্ষেত্রেই হোক না কেন সবই তাঁর এখতিয়ারধীন থাকবে।

উপরে উল্লেখিত ছয়টি ভাগের বিশদ দলীলের ক্ষেত্রে:

‘ক’ অংশের ব্যাপারে সাহাবাগণের সাধারণ ঐকমত্য ছিল। কানুন (আইন) শব্দের অর্থ হল শাসকের আদেশ যা জনগন মেনে চলে, বিশেষজ্ঞগণের মতে, “The host of principles that the Sultan (ruler) compels people to follow in their relations.” অন্য কথায় যদি সুলতান কোন বিধি জারি করেন সেটাই মানুষের জন্য আইন হয়ে যায় এবং তাদেরকে এটা মেনে চলতে হয় এবং যদি সুলতান বিধিটি জারি না করেন তাহলে জনগন তা মেনে চলতে বাধ্য নয়। মুসলিমরা শারী’আহর বিধিসমূহ মেনে চলে অর্থাৎ তারা আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার বিধি নিষেধ মেনে চলে। তারা আল্লাহর আদেশ নিষেধ মেনে চলে, সুলতানের নয় অর্থাৎ সুলতানের নিজের আইন মুসলিমরা মানে না বরং শরী’আহ আইনই তাদের বিবেচ্য বিষয়। তবে সাহাবারা শরী’আহর বিধির ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করতেন। তারা সরাসরি ঐশী বাণী থেকে আইন বুঝতেন এবং বুঝার ভিন্নতার কারণে ভিন্নতা দেখা যেত। প্রত্যেকে তিনি যা বুঝতেন তার উপরই আমল করতেন এবং সেটাই তার পক্ষ থেকে শরী’আহ বলে পরিগনিত হত। তবে উম্মাহর বিভিন্ন বিষয়ের উপরে কিছু কিছু শরী’আহ নির্দেশনা রয়েছে যার ব্যাপারে একটি মতামত গ্রহণ করা উচিত এবং একাধিক ইজতিহাদ একই সময়ে চর্চা করা ঠিক নয়। এরকম অতীতে হয়েছিল। যেমন আবু বকর (রা) সব মুসলিমকে সমানভাবে অর্থ বরাদ্দ করতেন কেননা তিনি মনে করতেন এতে সকল মুসলমানের সমান অধিকার। কিন্তু উমর (রা) এ ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করতেন এবং যারা রাসূল (সা) এ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছে এবং যারা তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে কিন্তু পরবর্তীতে মুসলমান হয়েছে তাদের একচোখে দেখতে আগ্রহী ছিলেন না। তাঁর উমর (রা) আর একটি যুক্তি ছিল যে, স্বচ্ছল আর অস্বচ্ছলদের একভাবে দেখাও ঠিক নয়। তবে যতদিন আবু বকর (রা) খলীফা ছিলেন ততদিন তিনি তাঁর সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন এবং বিচারক, ওয়ালীগণ এমনকি ওমর (রা) সে অনুযায়ী বিচার ফায়সালা ও আইন বাস্তবায়ন করেছেন। তারপর ওমর (রা) যখন খলীফা হলেন তখন তিনি তাঁর মতামতকে প্রয়োগ করলেন এবং তার মতামত অনুযায়ী সম্পদ বণ্টন করলেন। অর্থাৎ মুসলিম হওয়ার সময়কাল এবং প্রয়োজনীয়তা অনুসারে সম্পদ বন্টিত হল। মুসলিমরা এভাবে আইন মেনে চলে এবং ওয়ালী ও বিচারকগণ তা বাস্তবায়ন করেন। সুতরাং এ ব্যাপারে সাহাবাদের মধ্যে ঐকমত্য ছিল যে, শাসকগণ বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে এভাবে আইন গ্রহণ করতে পারবেন এবং বাস্তবায়ন করতে পারবেন। মুসলিমদের সেক্ষেত্রে তাদের নিজেদের ইজতিহাদের সাথে সাংঘর্ষিক হলেও মেনে নিতে হবে এবং ঐ বিষয়ে নিজেদের ইজতিহাদ বর্জন করতে হবে। খলীফার ইজতিহাদই ছিল আইন (কানুন) এবং ইজতিহাকে আইনে রূপ দেয়ার ক্ষমতা অন্য কারো নয় কেবলমাত্র খলীফারই রয়েছে।

‘খ’ অংশের ব্যাপারে দলীল পাওয়া যায় রাসূল (সা) এর সুন্নাহ থেকে। তিনি (সা) ওয়ালী এবং বিচারক নিয়োগ করতেন এবং তাদের জবাবদিহি করতেন। তিনি (সা) বাজার তদারকি করতেন এবং প্রতারণা, ফটকাবাজির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতেন। রাসূল (সা) লোকদের মধ্যে অর্থ বিতরণ করতেন এবং কর্মহীনদের কাজ পাবার ব্যাপারে সহায়তা দিতেন। তিনি রাষ্ট্রের সকল আভ্যন্তরীণ বিষয়াবলী দেখতেন।

তিনি (সা) অন্য রাষ্ট্রপ্রধানদের কাছে চিঠি পাঠাতেন এবং বৈদেশিক কর্মকর্তা ও দূতদের সাথে বসতেন। তিনি রাষ্ট্রের সকল বৈদেশিক বিষয়গুলো দেখাশুনা করতেন।

রাসূল (সা) যুদ্ধের সময় নেতৃত্ব দিতেন এবং নতুন এলাকা জয় করবার জন্য অভিযান চালানোর অনুমতি দিতেন এবং অভিযানের নেতৃত্ব ঠিক করে দিতেন। একটা সময়ে তিনি (সা) ওসামা বিন জায়েদ (রা) কে আশ শাম অঞ্চলে অভিযানের প্রধান হিসেবে পাঠালেন। ওসামা (রা) এর কম বয়সের কারণে সাহাবীরা এ ব্যাপারে অখুশী ছিলেন। কিন্তু রাসূল (সা) তাদের বাধ্য করেছিলেন ওসামার নেতৃত্ব মেনে নেবার জন্য। এটাই প্রমান করে তিনি (সা) কার্যকরভাবেই সেনাবাহিনীর প্রধান ছিলেন কেবলমাত্র নামমাত্র প্রধান ছিলেন না।

তিনি (সা) কুরাইশ, বানু কুরাইজা, বানু নাদির, বানু কায়নুকা, খায়বার এবং রোমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। এর অর্থ হল কেবলমাত্র খলীফার যুদ্ধ ঘোষণার অধিকার রয়েছে। তিনি (সা) বানু মাদলিজ এবং তাদের বন্ধু গোত্র বানু ধোমরার সাথে চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। তিনি আয়লার (Ayla) প্রধান ইউহানা বিন রু’বার সাথে চুক্তি করেন এবং হুদাইবিয়ার সন্ধিতেও স্বাক্ষর করেন। মুসলিমরা এক্ষেত্রে অসন্তুষ্ট থাকলেও তিনি (সা) তাদের আপত্তি অগ্রাহ্য করেন এবং চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এটাই প্রমাণ করে কেবলমাত্র খলীফার চুক্তি স্বাক্ষরের নির্বাহী ক্ষমতা রয়েছে -সেটা শান্তি চুক্তি বা অন্য কোন চুক্তিই হোক।

‘গ’ অংশের ক্ষেত্রে প্রমাণ হল যে, রাসূল (সা) নিজে মুসায়লামার দুইজন দূতকে গ্রহণ করেন এবং কুরাইশদের প্রতিনিধি আবু রাফির সাথে সাক্ষাৎ করেন। তিনি হিরাক্লিয়াস, খসরু, আল মুকাওকিস, আল হারিস আল গাসানী এবং আল হেরার রাজা, আল হারিদ আল হিমিয়ারী, ইয়েমেনের রাজা, আবিসিনিয়ার নিগাসের কাছে দূত পাঠান এবং উসমান বিন আফফানকে হুদাইবিয়ার ব্যপারে কুরাইশদের কাছে প্রেরণ করেছিলেন। এটাই প্রমাণ করে খলীফা বিদেশী দূত গ্রহণ ও প্রত্যাখানের ক্ষমতা রাখেন এবং অন্য রাষ্ট্রে মুসলিম দূত প্রেরণ ও প্রত্যাহারের ক্ষমতা রাখেন।

‘ঘ’ অংশের জন্য প্রমাণ হচ্ছে রাসূল (সা) নিজে ওয়ালীদের নিয়োগ দিতেন, যেমন: তিনি মু’য়াজ (রা) কে ইয়েমেনের ওয়ালী হিসেবে নিয়োগ করেছিলেন। তিনি তাদের পদচ্যুতও করতেন যেমন: লোকজন অভিযোগ করায় আল আলা বিন আল হাদরামীকে বাহরাইনের ওয়ালীর পদ থেকে বরখাস্ত করেন। এর অর্থ হল ওয়ালীদের জবাবদিহিতা জনগণ, খলীফা এবং মজলিসে উম্মাহের প্রতি- যেহেতু সব ওলাইয়ার প্রতিনিধিত্ব এখানে রয়েছে।

খলীফার সহকারীর ক্ষেত্রে রাসুল (সা) এর দুইজন সহরকারী ছিলেন, আবু বকর (রা) এবং উমর (রা)। তাঁর (সা) এর জীবদ্দশায় এই দুইজনকে পদচ্যূতও করা হয়নি এবং অন্য কাউকে তাদের স্থলাভিষিক্তও করা হয়নি। সহকারীগণ খলীফার কাছ থেকে কর্তৃত্ব লাভ করেন এবং খলীফাকে তার সহকারীর দক্ষতার উপর নির্ভর করতে হয়-সেকারণে খলীফার অধিকার রয়েছে সহকারীকে পদচ্যুত করবার। এটা অনেকটা প্রতিনিধিত্বের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। একজন ব্যক্তি তার প্রতিনিধিকে বরখাস্ত করতেই পারে।

‘ঙ’ অংশের জন্য প্রমাণ হিসেবে বলা যায়, রাসূল (সা) আলী (রা) কে ইয়েমেনের বিচারক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন।

আহমাদ থেকে বর্ণিত, আমরু বিন আল আস (রা) বলেন, ‘দুই জন লোক তাদের মধ্যকার বিবাদের কারণে ন্যায়বিচারের জন্য রাসূল (সা) এর কাছে আসলেন। তারপর তিনি (সা) আমাকে বললেন, ”হে আমরু, তাদের মধ্যে ফায়সালা কর।” আমি বললাম, ‘আপনিই এর জন্য ভাল ও যোগ্যতর।’ তিনি (সা) বললেন, ‘তারপরেও’। অতপর আমি বললাম, ‘আমি বিচার করলে কি পাব?’ তিনি (সা) বললেন,”তুমি যদি বিচার কর এবং তা যদি সঠিক হয় তাহলে তুমি দশ নেকী পাবে এবং যদি তুমি ভুল কর তাহলে এক নেকী পাবে।

উমর (রা) বিচারক নিয়োগ ও বরখাস্ত করতেন। তিনি শারীই’কে কুফার বিচারক নিয়োগ করেন এবং আবু মুসাকে বসরার বিচারক নিয়োগ করেন। তিনি শুরাহবিল বিন হাসনাকে আশ শামের ওয়ালীর পদ থেকে সরিয়ে সেখানে মুয়া’বিয়া (রা)কে স্থলাভিষিক্ত করেন। শুরাহবিল উমরকে বললেন, ‘আমাকে কি আনুগত্যহীনতা কিংবা রাষ্ট্রদ্রোহিতার কারণে অপসারণ করা হয়েছে?’ ওমর প্রত্যুত্তরে বললেন, ‘না, কিন্তু আমি আরও শক্তিশালী কাউকে চাচ্ছিলাম।’ আলী (রা) ও একসময় আবু আল আসওয়াদকে নিয়োগ দেন এবং পরর্বীতে সরিয়ে নেন। আবু আল আসওয়াদ তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি কেন আমাকে অপসারণ করলেন? আমি প্রতারণা করিনি এবং কোন অপরাধ করিনি। আলী বললেন, ‘আমি দেখতে পাচ্ছি তুমি বিবাদী লোকদের চেয়ে উচ্চস্বরে কথা বলছ।’ ওমর এবং আলী অন্যান্য সাহাবাদের সম্মুখেই এরকম করতেন এবং তারা এ কাজকে অগ্রহণযোগ্য মনে করেননি বা নিন্দা করেননি। এর অর্থ হল নীতিগতভাবে খলীফা বিচারক

নিয়োগের অধিকার সংরক্ষণ করেন এবং ইচ্ছে করলে তিনি কাউকে এ নিয়োগ প্রদানের ব্যাপারে প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব দিতে পারবেন। এটা প্রতিনিধিত্বের অনুরূপ। তিনি যে কাউকে তার নির্বাহী ক্ষমতাসমূহ চর্চার জন্য সহকারী হিসেবে নিয়োগ দিতে পারেন।

খলীফা, তার সহকারী ও প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে মাহকামাত আল মাজালিমের আদালতে চলমান মামলার সময় মাহকামাত আল মাজালিমের বিচারককে অপসারণ করা যাবে না। শরীয়ার মূলনীতি অনুসারে, ‘হারাম করবার সকল উপকরণই হারাম’। যদি খলীফাকে সেসময় মাজালিমের বিচারককে বরখাস্ত করবার অধিকার দেয়া হয় তাহলে বিচারককে প্রভাবিত করবার ক্ষমতা তিনি পেয়ে যান, অর্থাৎ তিনি শারী’আহর আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করতে পারবেন এবং এটা হারাম। সেকারণে এই বিষয়ে মাজালিমের বিচারককে বরখাস্ত করবার ব্যাপারে খলীফার কর্তৃত্ব একটি হারামের উপকরণ। তাই এ সময় মাজালিমের বিচারককে বরখাস্ত করবার ক্ষমতা রয়েছে মাহকামাত আল মাজালিমের। এটা ছাড়া অন্য সবক্ষেত্রে হুকুম আগের মতই অর্থাৎ খলীফা মাজালিমের বিচারক নিয়োগ ও বরখাস্ত করতে পারবেন।

রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন বিভাগের পরিচালকের ক্ষেত্রে, রাসূল (সা) নিজে বিভিন্ন বিভাগের সচিবদের নিয়োগ দিতেন। তারাই বিভিন্ন বিভাগের পরিচালক হিসেবে বিবেচিত হতেন। তিনি (সা) আল মুয়েকীব বিন আবি ফাতিমা আদ দুসিকে অফিসিয়াল সীলমোহর ও গনীমতের মালের দায়িত্ব দেন। হিজাজ অঞ্চলের ফসলের উপর কর নির্ধারণের জন্য হুযাইফা বিন ইয়ামান (রা) কে এবং জুবায়ের বিন আল আওমকে সাদাকার কোষাগারের দায়িত্ব দেন। তিনি (সা) আল মুগীরা বিন শুভাকে ঋণ লিপিবদ্ধকরণ এবং বিভিন্ন হিসাবাদির দায়িত্ব দেন।

সেনা কমান্ডার এবং প্রধান কমান্ডার নিয়োগের ক্ষেত্রে, রাসূল (সা) হামজা বিন আবদুল মুত্তালিবকে সমুদ্রতীরে কুরাইশদের সাথে সংঘাতের জন্য ত্রিশটি অশ্বারোহী দলের কমান্ডার পদে এবং কুরাইশদের সাথে রাবিগের ওয়াযিতে যুদ্ধের জন্য মুহাম্মদ বিন উবাইদা বিন হারিসকে ষাটজন যোদ্ধার কমান্ডার হিসেবে নিয়োগ দেন। সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাসকে বিশজন যোদ্ধার কমান্ডার হিসেবে মক্কার দিকে প্রেরণ করেন। এর অর্থ তিনি (সা) সেনাবাহিনীর কমান্ডারদের নিয়োগ দিতেন অর্থাৎ খলীফা সেনাবাহিনীর কমান্ডার ও সেনাপ্রধানকে নিয়োগ দিয়ে থাকেন।

উল্লেখিত পদসমূহে নিযুক্ত ব্যক্তিরা শুধুমাত্র রাসূল (সা) এর কাছে জবাবদিহী করতেন, আর কারো কাছে নয়। এটাই প্রমাণ করে খলীফা বিচারক, প্রশাসনিক বিভাগের ব্যবস্থাপক, সেনা কমান্ডার, চীফ অব স্টাফ, এবং বিভিন্ন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের দায়বদ্ধতা খলীফার প্রতি, মজলিসে উম্মাহর প্রতি নয়। কেবলমাত্র খলীফার প্রতিনিধিত্বকারী সহকারীগণ, ওয়ালী ও আমীলগণ মজলিসে উম্মাহর কাছে দায়বদ্ধ থাকবেন কেননা তারা হচ্ছেন শাসক পদে নিযুক্ত। তাদের ছাড়া আর কেউই মজলিসে উম্মাহর কাছে দায়বদ্ধ নন, বরং বাকি সবাই খলীফার কাছে দায়বদ্ধ থাকবেন।

‘চ’ অংশের জন্য, রাষ্ট্রীয় বাজেটে আয় এবং ব্যয় পুরোপরি শারী’আহ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। শারী’আহর হুকুম ছাড়া এক ফুটো পয়সাও কর ধার্য করা যাবে না এবং ব্যয় করা যাবে না। ব্যয়ের বিস্তারিত অর্থাৎ যাকে বাজেটীয় অংশ বলে এ ব্যাপারে খলীফার সিদ্ধান্তই শেষ কথা- যা তিনি ইজতিহাদের মাধ্যমে গ্রহণ করবেন। একই কথা আয়ের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।

উদাহরনস্বরুপ কেবলমাত্র খলীফাই খারাজ, জিযিয়া এবং অন্যান্য করের পরিমাণ ধার্য করবেন। রাস্তাঘাট নির্মাণ বা সংস্কার, হাসপাতাল তৈরী করা এবং অন্যান্য সকল ব্যয়ের ক্ষেত্রে খলীফার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। এ ব্যাপারে তিনি তার মতামত বা ইজতিহাদের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন।

রাসূল (সা) আমিল’দের কাছ থেকে রাজস্ব গ্রহণ করতেন এবং তা ব্যয় করতেন। মাঝে মাঝে তিনি ওয়ালীগণদের অর্থ গ্রহণ ও খরচ করবার কর্তৃত্ব দিতেন। এরকম হয়েছিল রাসূল (সা) যখন মুয়াজকে ইয়েমেনে পাঠিয়েছিলেন। পরবর্তীতে খোলাফায়ে রাশেদীনগণ এ প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখেন। তারাও নিজ নিজ মতামত ও ইজতিহাদ ব্যবহার করে রাজস্ব আদায় করতেন এবং ব্যয় করতেন। কোন সাহাবা এ ব্যাপারে কখনওই দ্বিমত করেন নি বা খলীফার মতামত ছাড়া একটি ফুটো পয়সাও খরচ করেননি। যখন উমর (রা) মুয়াবিয়া কে ওয়ালী হিসেবে একটি উলাই’য়াহ্‌তে নিয়োগ দেন তখন তিনি তাকে অর্থ সংগ্রহ ও ব্যয়ের সাধারণ অধিকার প্রদান করেন। এর অর্থ হল খলীফা বাজেটের বিভিন্ন অংশের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেন অথবা তার পক্ষ থেকে কেউ এ ব্যাপারে দায়িত্ব পালন করতে পারেন।

এগুলোই হল খলীফার নির্বাহী ক্ষমতার বিস্তারিত আলোচনা এবং এটি নিশ্চিত হওয়া যায় আহমাদ এবং আল বুখারী বর্ণিত হাদীস থেকে যা নেয়া হয়েছে আবদুল্লাহ বিন উমর থেকে যিনি রাসূল (সা) কে বলতে শুনেছেন: ”ইমাম হলেন অভিভাবক এবং তিনি তার প্রজাদের ব্যাপারে দায়িত্বশীল।”

এর অর্থ হল প্রজাদের সব বিষয়ে ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব খলীফার এবং তিনি যে কাউকে যে কোন দায়িত্ব দিয়ে প্রেরণ করতে পারেন। তার এ ক্ষমতার ব্যাপারে ওয়াকালা’র (representation – প্রতিনিধিত্ব) হুকুম প্রযোজ্য, অর্থাৎ তিনি যে কাউকে তার নির্বাহী ক্ষমতাসমূহ চর্চার জন্য প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগ দিতে পারেন।

খলীফা শরী’আহ্‌ বিধান দিয়ে আইন গ্রহণে বাধ্য

খলীফা তার আইন গ্রহণের ক্ষমতার (power of adopting laws) ক্ষেত্রে শরী’আহ বিধান অনুসরণ করতে বাধ্য। তার এমন কোন আইন গ্রহণ করার অধিকার নেই যার কোন শরী’আহ দলীল নেই। এছাড়া, তিনি যে সব শরী’আহ বিধিবিধান অনুসরণ করবেন এবং (নিজস্ব কিংবা অন্য কারও) ইজতিহাদের যে পদ্ধতি অনুসরণ করবেন তা দিয়েও আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা।

সুতরাং, এমন কোন আইন গ্রহণ করা তার জন্য নিষিদ্ধ, যা তার অনুসৃত ইজতিহাদের পদ্ধতির সাথে সাংঘর্ষিক।

একইসাথে, এমন কোন আইনকানুন জারি করাও তার জন্য নিষিদ্ধ, যা তার অনুসৃত আইনের সাথে সাংঘর্ষিক। সুতরাং, আইন গ্রহণের ক্ষমতার ক্ষেত্রে খলীফার সীমাবদ্ধতা দু’টি।

খলীফার প্রথম সীমাবদ্ধতা অর্থাৎ, আইন গ্রহণের ক্ষেত্রে খলীফা যে শরী’আহ্‌ বিধান অনুসরণ করতে বাধ্য – এ ব্যাপারে শরী’আহ্‌ দলীল নিম্নরূপ:

১. আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা খলীফা সহ প্রতিটি মুসলিমকে তাদের সকল কাজের ক্ষেত্রে ঐশী বিধান (শরী’আহ্‌) মেনে চলা বাধ্যতামূলক করেছেন। তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেন,

‘কিন্তু না, তোমার রবের শপথ! তারা ততক্ষণ পর্যন্ত ঈমানদার হতে পারবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা তাদের পারস্পরিক বিবাদ-বিসম্ববাদের বিষয় সমূহে তোমাকে বিচারক হিসেবে মেনে নেয়।’
[সূরা নিসা : ৬৫]

আইনপ্রণেতার (আল্লাহ্‌’র) বাণী বোঝার ক্ষেত্রে যদি কোনপ্রকার মতভেদের সৃষ্টি হয় (অর্থাৎ, কোন আয়াতের যদি একাধিক ব্যাখ্যা থাকে) তবে সেক্ষেত্রে, মুসলিমরা একটি নির্দিষ্ট ব্যাখ্যার ভিত্তিতে একটি নির্দিষ্ট শারী’আহ্‌ আইন অনুসরণ করতে বাধ্য। সুতরাং, (একই বিষয়ের জন্য অনুমোদিত) বিভিন্ন শরী’আহ্‌ আইন থেকে একটি নির্দিষ্ট আইনকে নিজের জন্য গ্রহণ করতে মুসলিমরা বাধ্য, যখন তারা উক্ত কাজটি সম্পাদন করতে চায় বা বিধানটি প্রয়োগ করতে চায়। এ নিয়মটি একইভাবে খলীফার কার্যসম্পাদনের জন্যও প্রযোজ্য; অর্থাৎ, যখন তিনি শাসনকার্য সম্পাদন করতে চান তখন এ বিধানটি সমভাবে তার উপরও প্রযোজ্য হবে। (অর্থাৎ, তাকেও এক্ষেত্রে কোন নির্দিষ্ট শরী’আহ্‌ আইন অনুসরণ করতে হবে।)

২. বাই’আতের শপথে উচ্চারিত শব্দসমূহ ও খলীফাকে শরী’আহ আইন-কানুন দ্বারা শাসন করতে বাধ্য করে, কেননা খলীফা আল্লাহ্‌’র কিতাব ও রাসূল ( ﷺ) এর সুন্নাহ্‌’র ভিত্তিতেই বাই’আত প্রাপ্ত হয়ে থাকেন। সুতরাং, এ শপথ ভঙ্গ করা তার জন্য আইনত নিষিদ্ধ এবং যদি তিনি সজ্ঞানে ও দৃঢ়তার সাথে তা করে থাকেন তবে তা কুফরী হিসাবে বিবেচিত হবে।

কিন্তু, তিনি যদি দৃঢ়তার সাথে তা না করে থাকেন, তাহলে সেক্ষেত্রে তিনি অবাধ্য, পথভ্রষ্ট এবং বিদ্রোহী বলে বিবেচিত হবেন।

৩. বস্তুতঃ খলীফাকে শাসক হিসাবে নিয়োগ দেয়াই হয় হুকুম-শারী’আহ্‌ বাস্তবায়ন করার জন্য, সেকারণে মুসলিমদের শাসনের ক্ষেত্রে শারী’আহ্‌ আইন-কানুন ছাড়া অন্য কোনকিছু বিবেচনায় আনা তার জন্য নিষিদ্ধ। কারণ, হুকুম-শারী’আহ্‌ নিজেই একে অবৈধ বলে ঘোষণা করেছে। যে ব্যক্তি হুকুম শারী’আহ্‌ ছাড়া অন্য কোন কিছু দিয়ে শাসন করবে, প্রকৃতঅর্থে সে তার ঈমানকেই ক্ষতিগ্রস্থ করবে। আর, এটা হচ্ছে এমন একটি বিষয় যে ব্যাপারে অকাট্য শারী’আহ্‌ দলীল রয়েছে।

সুতরাং, খলীফা কেবলমাত্র হুকুম শরী’আহ্‌’র ভিত্তিতেই আইন গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে পারবেন এবং এ ব্যাপারে তিনি দায়বদ্ধ। এছাড়া, তিনি যদি দৃঢ়তার সাথে জেনেশুনে শরী’আহ ছাড়া অন্য কোনকিছুর ভিত্তিতে আইন গ্রহণ করেন তাহলে তা প্রকাশ্য কুফরী হিসাবে বিবেচিত হবে। আর, তিনি যদি শারী’আহ্‌ বহির্ভূত ভিত্তিতে বিশ্বাস না করে তা বাস্তবায়ন করেন, তাহলে তিনি অবাধ্য, পথভ্রষ্ট এবং বিদ্রোহী হিসেবে বিবেচিত হবেন।

আর, খলীফার দ্বিতীয় সীমাবদ্ধতার ব্যাপারে বলা যায় যে, খলীফা যে সমস্ত শারী’আহ্‌ বিধি-বিধান অনুসরণ করবেন এবং ইজতিহাদের যে পদ্ধতি অনুসরণ করবেন, তা দিয়েই তার কার্যাবলী সীমাবদ্ধ থাকবে। এ ব্যাপারে শরী’আহ্‌ দলিল হল, তিনি যে শারী’আহ্‌ আইন বাস্তবায়ন করবেন, ঐ আইনের ব্যাপারে তারই দ্বায়বদ্ধতা থাকবে, অন্য কারো নয়। অন্যভাবে বললে বলা যায় যে, খলীফা তার কার্যাবলী সম্পাদন করার জন্য ঐ নির্দিষ্ট শরী’আহ্‌ আইনটিই গ্রহণ করেছেন, যে কোন আইন গ্রহণ করেননি; তাই এ আইনের ব্যাপারে তার নিজস্ব দ্বায়বদ্ধতা রয়েছে। অর্থাৎ, খলীফা যদি কোন বিষয়ে নিজস্ব ইজতিহাদের মাধ্যমে কোন আইন গ্রহণ করেন কিংবা কোন মুজতাহিদের ইজতিহাদ অনুসরণ করেন, তবে উক্ত বিষয়ের ক্ষেত্রে ঐ নির্দিষ্ট বিধানটি তার জন্য আল্লাহ্‌’র বিধান হিসাবে বিবেচিত হবে। তাই, মুসলিমদের জন্যও তাকে ঐ আইন গ্রহণ করতে হবে। অন্য কোন আইন গ্রহণ করা তার জন্য নিষিদ্ধ হবে কারণ, অন্য কোন আইনের ব্যাপারে তার কোন শরী’আহ্‌ দ্বায়বদ্ধতা নেই অর্থাৎ, এটি তার জন্য আল্লাহ্‌’র বিধান হিসাবে বিবেচিত নয় তাই, একইভাবে এটি মুসলিমদের জন্যও শারী’আহ্‌ বিধান বলে বিবেচিত হবে না। সুতরাং, জনগণকে শাসন করার ক্ষেত্রে তার গ্রহণকৃত শারী’আহ আইন সমূহের মাধ্যমেই তাকে বিধিবিধান জারি করতে হবে। তিনি এমন কোন আইন বা বিধি-বিধান জারি করতে পারবেন না যা তার অনুসৃত শরী’আহ্‌ আইনের সাথে সাংঘর্ষিক হয়। কারণ, যদি তিনি তা করেন অর্থাৎ, তার গ্রহণকৃত শরী’আহ্‌ আইনের সাথে সাংঘর্ষিক অন্য কোন (শরী’আহ্‌) আইনের মাধ্যমে তিনি যদি কোন বিধান জারি করেন, তবে এক্ষেত্রে তা হুকুম-শারী’আহ্‌’র সাথে সাংঘর্ষিক বলেই বিবেচিত হবে।

ইসতিনবাত বা ইজতিহাদের পদ্ধতির ভিন্নতার কারণেও শরী’আহ্‌’র হুকুম বোঝা বা ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে ভিন্নতা সৃষ্টি হয়।

উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, খলীফা যদি আইনপ্রণেতার বাণী থেকে উৎসারিত ইল্লাহ্‌কে’ই (কোন হুকুম প্রণয়নের কারণ, effective legal cause of a rule) শরী’আহ্‌ সঙ্গত ইল্লাহ্‌ বলে মনে করেন এবং সেইসাথে, তিনি লাভ-ক্ষতিকে (মাসলাহা) শারী’আহ সঙ্গত ইল্লাহ্‌ কিংবা মাসালিহ্‌ মুরসালাকে (অসংজ্ঞায়িত পার্থিব লাভ-ক্ষতি) শারী’আহ সঙ্গত দলীলপ্রমাণ হিসেবে বিবেচনা না করেন, তাহলে এটাই তার জন্য ইসতিনবাতের পদ্ধতি হিসাবে বিবেচিত হবে। কারণ, এ পদ্ধতিই তিনি নিজের জন্য গ্রহণ করেছেন। এক্ষেত্রে, তার গৃহীত বিধি-বিধান এই নীতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতে হবে এবং তিনি এমন কোন আইন গ্রহণ করতে পারবেন না যার দলীল-প্রমাণ মাসালিহ্‌ মুরসালাহ্‌’র উপর প্রতিষ্ঠিত; কিংবা, এমন কোন ক্বিয়াস গ্রহণ করতে পারবেন না যার ইল্লাহ্‌ আল্লাহ্‌’র বাণী থেকে উৎসারিত হয়নি। এই ধরনের শরী’আহ্‌ আইন তার জন্য আল্লাহ্‌’র বিধান হিসাবে বিবেচিত হবে না এবং এ আইনকানুনের ব্যাপারে তার কোনপ্রকার দ্বায়বদ্ধতাও থাকবে না; কেননা তিনি এ সমস্ত বিধিবিধানের উৎসকে শারী’আহ্‌ সঙ্গত উৎস বলে বিবেচনা করেননি। সুতরাং, তার দৃষ্টিকোন থেকে এগুলো শারী’আহ্‌ আইন হিসাবে বিবেচিত হবে না। আর, যেহেতু এটি খলীফার জন্য শারী’আহ্‌ আইন হিসাবে গ্রহণযোগ্য হবে না, সুতরাং একইভাবে এটি মুসলিমদের জন্যও শারী’আহ্‌ আইন হিসাবে গ্রহণযোগ্য হবে না।

তিনি যদি (তার গৃহীত ভিত্তি ছাড়া) অন্য কোন ভিত্তির উপর আইনকানুন গ্রহণ করেন, তাহলে বিষয়টি এমন হবে যেন তিনি শরী’আহ্‌ ব্যতীত অন্যকিছুকে ভিত্তি করে আইন গ্রহণ করলেন, যা সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ।

আর, খলীফা যদি মুকাল্লিদ (অনুকারক) হন অথবা মুজতাহিদ ফী মাসা’লা হন অর্থাৎ একটি মাত্র বিষয়ের উপর তিনি ইজতিহাদ করে থাকেন; কিংবা তার যদি নিজস্ব কোন ইসতিনবাতের পদ্ধতি না থাকে, এ সমস্ত ক্ষেত্রে যে কোন শরী’আহ্‌ আইন গ্রহণ করার অধিকার তার রয়েছে, তার দলীল যাই হোক না কেন। যতক্ষণ পর্যন্ত তার গ্রহণকৃত আইনকানুনের শারী’আহ সঙ্গত দলীল-প্রমাণ থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত যে কোন বিধিবিধান গ্রহণের ক্ষেত্রে তার কোনপ্রকার সীমাবদ্ধতা থাকবে না। শুধুমাত্র কোন বিষয়ে নির্দেশ প্রদানের ক্ষেত্রেই তার সীমাবদ্ধতা থাকবে; কারণ তাকে তার গৃহীত বিধিবিধানের ভিত্তিতেই নির্দেশ প্রদান করতে হবে, অন্যকোন বিধানের উপর ভিত্তি করে নয়।

খিলাফত কোন যাজকতান্ত্রিক বা মোল্লাতান্ত্রিক (theocratic) রাষ্ট্র নয়

ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থাই হচ্ছে খিলাফত রাষ্ট্র। সমগ্র বিশ্বের মুসলিমদের জন্য এটি হচ্ছে সর্বোচ্চ নেতৃত্ব। সুতরাং, যদি কোন মুসলিম রাষ্ট্রে একজন খলীফাকে বৈধভাবে বাই’আত দেয়া হয় এবং পৃথিবীর কোন স্থানে খিলাফত প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়, তখন বিশ্বের সকল মুসলিমদের জন্য আরেকটি খিলাফত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা নিষিদ্ধ হয়ে যাবে। কারণ রাসূল (সা) বলেছেন,

যদি দুইজন খলীফার জন্য বাই’আত নেয়া হয়, তবে দ্বিতীয় জনকে হত্যা কর।
(সহীহ্‌ মুসলিম, হাদীস নং-১৮৫৩)

বস্তুতঃ ইসলামী ধ্যান-ধারণার ভিত্তিতে শারী’আহ্ আইনকানুন ও বিধিবিধান সমূহ বাস্তবায়ন করা এবং সেইসাথে, ইসলামের আহবানকে সমগ্র বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত করার লক্ষ্যেই খিলাফত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ইসলামী ধ্যান-ধারণার সাথে মানুষকে পরিচিত করিয়ে, তাদেরকে ইসলাম গ্রহণের দিকে আহ্বান করে এবং সেইসাথে, আল্লাহ্‌’র রাস্তায় জিহাদের মাধ্যমেই ইসলামের সুমহান বাণীকে পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে দিতে হবে। খিলাফতকে আবার ইমামাহ্‌ বা ইমারাতুল মু’মিনীনও (বিশ্বাসীদের নেতৃত্ব) বলা হয়। এটি ক্ষণস্থায়ী এ দুনিয়ার অস্থায়ী একটি পদ, পরকালের সাথে এ পদ সম্পর্কিত নয়।

মানুষের মাঝে ইসলামকে বাস্তবায়ন করা এবং ইসলামের দাওয়াতকে বিস্তৃত করার জন্যই খিলাফত রাষ্ট্রের প্রয়োজন। তাই, এটি অবশ্যই নব্যুয়তের চেয়ে আলাদা। নব্যুয়ত হল একটি ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক পদ। এটি আল্লাহ্‌ যাকে ইচ্ছা তাকে দান করেন। অপরদিকে খিলাফত হল একটি মানবীয় পদ; যেখানে মুসলিমরা যাকে ইচ্ছা তাকে বাই’আত দিতে পারে এবং মুসলিমদের মধ্য হতে যাকে ইচ্ছা তাকে নির্বাচিত করে খলীফা হিসাবে নিযুক্ত করতে পারে। আমাদের নবী মুহম্মদ (সা) একজন শাসক ছিলেন যিনি আল্লাহ্‌ প্রদত্ত শারী’আহ্‌’কে বাস্তবায়ন করেছিলেন।

সুতরাং, একদিকে তিনি যেমন নবী ও আল্লাহ্‌’র রাসূল ছিলেন, সেইসাথে তিনি (সা) আল্লাহ্‌’র বিধানকে বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে মুসলিমদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। এভাবে আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা তাঁকে রিসালাতের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি শাসনকার্য পরিচালনা করারও দায়িত্ব দিয়েছিলেন।তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) তাঁকে নির্দেশ দিয়েছিলেন:

“এবং তাদের মধ্যে ফায়সালা করুন যা আল্লাহ্‌ অবতীর্ণ করেছেন তা দিয়ে” 
[সূরা মায়িদাহ্‌: ৪৯]

তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) আরও বলেন:

“আমরা এই কিতাব পূর্ণ সত্যতা সহকারে তোমার প্রতি নাযিল করেছি, যেন আল্লাহ্‌ তোমাকে যে সত্য পথ দেখিয়েছেন, সে অনুসারে মানুষের মাঝে তুমি বিচার-ফায়সালা করতে পার”। 
[সূরা নিসা : ১০৫]

আল্লাহ্‌ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) আরও বলেন,

“হে রাসূল, তোমার রবের পক্ষ হতে তোমার প্রতি যা কিছু নাযিল করা হয়েছে, তা লোকদের নিকট পৌছিয়ে দাও।”
[সূরা মায়িদাহ্‌: ৬৭]

“আর এ কুর’আন আমার নিকট ওহীর মাধ্যমে প্রেরণ করা হয়েছে; যেন আমি তোমাদের ও যাদের নিকট এটা পৌঁছাবে তাদের সকলকে সতর্ক ও সাবধান করে দেই।” 
[সূরা আনআম: ১৯]

হে কম্বল আবৃতকারী! উঠো এবং সতর্ক কর।” 
[সূরা মুদ্দাস্সির : ১-২]

সুতরাং, উপরোক্ত দলিল-প্রমাণ থেকে দেখা যাচ্ছে যে, রাসূল (সা) দুটি পদের অধিকারী ছিলেন। একটি হল নবুয়্যত ও রিসালাতের পদ এবং অপরটি হল, মুসলিমদের নেতা হিসাবে দুনিয়ার জীবনে আল্লাহ্‌’র নাযিলকৃত শারী’আহ্‌ বিধানসমূহ বাস্তবায়নের পদ।

তবে রাসূল (সা) এর পর যারা খিলাফতের দায়িত্ব পালন করেছেন তারা শুধুমাত্র মানুষ ছিলেন; অর্থাৎ, এদের কেউই রাসূল ছিলেন না। সুতরাং, এটা সম্ভব যে, এই সমস্ত খলীফারা অন্য মানুষদের মতোই ভুলভ্রান্ত চিন্তা করতে পারেন কিংবা, অন্যমনস্ক, অমনোযোগী বা গুণাহ্‌’র কাজে লিপ্ত হতে পারেন ইত্যাদি। কারণ, তারা ছিলেন মানুষ। তাই, মানুষ হিসাবে তারা কেউই ভুল-ভ্রান্তির ঊর্ধ্বে ছিলেন না। রাসূল (সা) আমাদের বলে গেছেন যে, ইমামগণ ভুল করতে পারেন কিংবা এমন কোন কাজও করতে পারেন যার জন্য জনগণ তাদের ঘৃণা করতে পারে বা অভিশাপ দিতে পারে, যেমন: তিনি অত্যাচারী হতে পারেন, (আল্লাহ্‌’র প্রতি) অবাধ্যতা প্রদর্শন করতে পারেন ইত্যাদি। তিনি আরও বলেছেন যে, ইমামগণ প্রকাশ্যে কুফরীতেও লিপ্ত হতে পারেন। আবু হুরাইরা (রা) রেওয়ায়াতে ইমাম মুসলিম বর্ণনা করেন যে, রাসূল (সা) বলেছেন,

অবশ্যই ইমামগণ ঢালস্বরূপ যার পেছনে থেকে লোকেরা যুদ্ধ করে ও নিজেদের রক্ষা করে। সুতরাং তিনি যদি তাকওয়া অবলম্বন করবার আদেশ দেন এবং ন্যায়বিচারক হন তাহলে তিনি এ সমস্ত কাজের সমপরিমাণ পুরস্কার পাবেন। আর, যদি তিনি তার এর বিরুদ্ধে কিছু করেন তবে তিনি সমপরিমাণ শাস্তি পাবেন। ”
(সহীহ্‌ বুখারী, হাদীস নং-২৯৫৭)

এর অর্থ হল, ইমামগণ আল্লাহ্‌’কে ভয় না করে অন্য কোন হুকুম দিতে পারেন। আবদুল্লাহ্‌ ইবনে মাসউদ থেকে মুসলিম বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন:

আমার পরে স্বার্থপরতা এবং এমন ঘটনা ঘটতে পারে যা তোমরা ঘৃণা করবে। সাহাবীগণ তখন বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ্‌! আমাদের মধ্য হতে যারা ঐ ঘটনাগুলোর সাক্ষী হবে, তাদের আপনি কি করার আদেশ দেবেন?’ তিনি (সা) তখন বললেন, ‘তোমাদের প্রতি অর্পিত দায়িত্ব পালন করবে এবং আল্লাহ্‌ প্রদত্ত তোমাদের অধিকার চাইবে।”
(সহীহ্‌ বুখারী, হাদীস নং-৭০৫২)

জুনাদা বিন আবু উমাইয়া হতে ইমাম বুখারী বর্ণনা করেছেন যে, ‘আমরা উবাদা বিন আস সামিতকে অসুস্থ অবস্থায় দেখতে গেলাম এবং তাকে বললাম আল্লাহ্‌ তোমাকে পথ প্রদর্শন করুন! রাসূল (সা) এর কাছ থেকে শোনা একটি হাদীস আমাদের শোনাও যার মাধ্যমে তুমি উপকৃত হবে। তিনি বললেন:

‘রাসূলুল্লাহ্‌ (সা) আমাদের ডাকলেন এবং আমরা তাঁকে বাই’আত দিলাম। তিনি আমাদের কাছে যে ব্যাপারে বাই’আত গ্রহণ করেছেন সে ব্যাপারে বললেন যে, আমরা তাঁকে সন্তুষ্টি ও অসন্তুষ্টি কিংবা সুসময় ও দুঃসময় উভয় অবস্থায় তাঁর আদেশ শ্রবণ ও তাঁর আনুগত্যের শপথ নিয়েছি। আমরা ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের উপর যারা কর্তৃত্বশীল তাদের সাথে কোন বিবাদ করবো না যতক্ষণ পর্যন্ত না তাদের প্রকাশ্যে কুফরে লিপ্ত হতে দেখি, যে ব্যাপারে আমাদের কাছে আল্লাহ্‌ পক্ষ হতে শক্তিশালী দলীল রয়েছে।’
(সহীহ্‌ বুখারী, হাদীস নং-৭০৫৫)

আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেছেন যে রাসূল (সা) বলেছেন,

যতটা সম্ভব মুসলিমদের শাস্তি থেকে পরিত্রাণ দেবে। সুতরাং, যদি সম্ভব হয় তাহলে আসামীকে মুক্ত করে দাও; কেননা শাস্তি দেবার ক্ষেত্রে ইমামদের ভুল করার চেয়ে ক্ষমা করার ক্ষেত্রে ভুল করা অধিকতর ভাল।”
(সূনানে তিরমিযী, হাদীস নং-১৪২৪)

সুতরাং, এইসব হাদীস এটাই প্রমাণ করে যে, ইমামদের পক্ষে ভুল করা, অমনোযোগী বা গুণাহের কাজে লিপ্ত হওয়া সম্ভব। এ সবকিছুর পরও রাসূল (সা) তাকে মান্য করার নির্দেশ দিয়েছেন যতক্ষণ পর্যন্ত তিনি ইসলাম দিয়ে শাসনকার্য পরিচালনা করছেন এবং প্রকাশ্যে কুফরী থেকে বিরত থাকছেন ও গুণাহ্‌’র কাজে লিপ্ত হবার নির্দেশ না দিচ্ছেন। সুতরাং, রাসূল (সা) এর পর যে সব খলীফা এসেছেন তারা সঠিক ও ভুল দুটোই করেছেন এবং তারা কেউই ভুলের ঊর্ধ্বে ছিলেন না। কারণ, তারা শুধু মানুষ ছিলেন, নবী ছিলেন না। সুতরাং, এটা বলা ভুল হবে যে খিলাফত একটি আধ্যাত্মিক রাষ্ট্র।বরং, এটা একটি মানবীয় রাষ্ট্র, যেখানে মুসলিমরা খলীফাকে ইসলামী শারী’আহ্‌’র বিধিবিধান সমূহ বাস্তবায়নের জন্য বাই’আত দিয়ে থাকে।

খলীফার মেয়াদকাল

খলীফার মেয়াদকাল সুনির্দিষ্ট নয়। যতক্ষণ পর্যন্ত তিনি শারী’আহ্ মেনে চলবেন এবং এর বিধিবিধান সমূহকে কার্যকর করবেন এবং রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে সক্ষম থাকবেন ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি খলীফা পদে বহাল থাকবেন। এর কারণ হচ্ছে বাই’আত সংক্রান্ত দলিল-প্রমাণগুলো এসেছে অনির্দিষ্ট (মুতলাক) অর্থে, যেখানে কোন নির্দিষ্ট সময়কাল নির্ধারণ করে দেয়া হয়নি। আনাস বিন মালিক বর্ণনা করেছেন যে, রাসূল (সা) বলেছেন,

‘যদি একজন আবিসিয়ান দাসও তোমাদের উপর কর্তৃত্বশীল হয়, যার চুল কিসমিসের মতো কালো, তবুও তোমরা তার কথা শুনবে এবং আনুগত্য করবে।’
(সহীহ্ বুখারী, হাদীস নং-৭১৪২)

অপর একটি বর্ণনা অনুসারে তিনি (সা) বলেছেন যে,

‘…যতক্ষণ পর্যন্ত তিনি তোমাদের আল্লাহ্’র কিতাব দ্বারা পরিচালিত করবেন।’

এছাড়া, হাদীসগুলোতে যেভাবে বর্ণনা করা হয়েছে খোলাফায়ে রাশেদীনরা (রা.) এভাবে অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য বাই’আত প্রাপ্ত হয়েছিলেন। তাঁরা কেউই নির্দিষ্ট কোন সময়ের জন্য খলীফা পদে নিযুক্ত ছিলেন না। বরং, প্রত্যেকেই তাঁদের মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত খলীফার পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। এ ঘটনাগুলো প্রমাণ করে যে, সাহাবীরা (রা.) এ ব্যাপারে একমত ছিলেন যে খিলাফতের দায়িত্ব কোন নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নয়; বরং তা অনির্দিষ্টকালের জন্য। সুতরাং, যদি কোন খলীফাকে বাই’আত দেয়া হয়, তবে তিনি মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত সে পদে বহাল থাকতে পারেন।

কিন্তু, খলীফার মধ্যে যদি এমন কোন পরিবর্তন সাধিত হয়, যা তাকে উক্ত পদের জন্য অযোগ্য হিসাবে প্রমাণ করে এবং  তাকে অপসারণ করার প্রয়োজন দেখা দেয়, তবে সেক্ষেত্রে তার সময়কাল শেষ হয়ে যাবে এবং তাকে অপসারণও করা  যাবে। তবে, এ বিষয়টিকে খলীফার পদে বহাল থাকার সময়কালের সীমাবদ্ধতা হিসাবে গ্রহণ করা যাবে না। বরঞ্চ, খিলাফতের দায়িত্ব প্রাপ্ত হবার ক্ষেত্রে কোন প্রকার শর্ত ভঙ্গ হলেই কেবল এ বিধানটি প্রযোজ্য হবে। বস্তুতঃ বাই’আত প্রদানের শব্দাবলী এবং সাহাবীদের ঐক্যমত অনুসারে খিলাফতের দায়িত্ব অনির্দিষ্ট সময়ের জন্যই নির্ধারিত। প্রকৃতপক্ষে,  খলীফার পদে বহাল থাকার সীমাবদ্ধতা সে কাজ দ্বারা নির্ধারিত, যে কাজের জন্য তিনি বাই’আত প্রাপ্ত হয়ে থাকেন; অর্থাৎ, আল্লাহ্’র কিতাব ও সুন্নাহ্’র ভিত্তিতে শাসন করা এবং শারী’আহ্ বিধিবিধান সমূহকে বাস্তবায়ন করতে খলীফা দ্বায়বদ্ধ।  সুতরাং, তিনি যদি শারী’আহ্’কে সুউচ্চ না করেন কিংবা এর বাস্তবায়ন না করেন, তবে তাকে অবশ্যই অপসারণ করতে  হবে।

খলীফার অপসারণ

খলীফা যদি এ পদে নিযুক্ত হবার সাতটি আবশ্যিক গুণাবলীর মধ্যে কোন একটি হারিয়ে ফেলেন তাহলে আইনগতভাবে তাকে অবশ্যই পদচ্যুত করতে হবে।

এ সিদ্ধান্তের একচ্ছত্র মালিক ‘মাহ্কামাতুল মাযালিম’- যিনি সিদ্ধান্ত নেবেন খলীফা আবশ্যিক গুণাবলীর কোনটি হারিয়ে  ফেলেছেন কিনা। কারণ, কোন বিষয় যার জন্য খলীফাকে অপসারণ করা যায় অথবা তাকে পদচ্যুত করা জরুরী হয়ে পড়ে, তাকে বলা হয় ‘মাযলিমা’(অন্যায় কাজ)। এ বিষয়গুলোর সমাধান করা প্রয়োজন। তাই, খলীফার বিরুদ্ধে এ ধরনের  কোন অভিযোগ থাকলে সেগুলো অবশ্যই তদন্ত করতে হবে এবং একজন বিচারকের সম্মুখে তার অপরাধ প্রমাণ করতে হবে। মাহ্কামাতুল মাযালিম-ই (অন্যায় কাজ তদন্তের জন্য নির্ধারিত আদালত) হচ্ছে একমাত্র দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান যা খলীফার বিরুদ্ধে দায়েরকৃত সকল অভিযোগ গ্রহণ করবে এবং এ আদালতের বিচারক এ ব্যাপারটি প্রমাণ করবেন এবং  প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন। অর্থাৎ, মাহ্কামাতুল মাযালিম সিদ্ধান্ত নেবে খলীফা কোন আবশ্যকীয় শর্তাবলী ভঙ্গ  করেছেন কিনা এবং তাকে অপসারণ করা প্রয়োজন কিনা। যদি এ ধরনের পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় এবং খলীফা পদত্যাগ  করেন, তাহলে বিষয়টি এখানেই নিস্পত্তি হয়ে যাবে। আর, যদি মুসলিমরা মনে করে যে খলীফাকে পদচ্যুত করা উচিত;  কিন্তু, খলীফা এ ব্যাপারে তাদের সাথে বিতর্কে লিপ্ত হয় তাহলে এ বিষয়টি বিচারব্যবস্থার উপর ন্যস্ত করা হবে। কারণ  আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন:

“…অতঃপর কোন ব্যাপারে তোমরা যদি এক অপরের সাথে মতবিরোধে লিপ্ত হও, তাহলে সে বিষয়টি (ফয়সালার জন্য) আল্লাহ্ ও তার রাসূলের দিকে ফিরিয়ে দাও।”
[সূরা নিসা: ৫৯]

অন্যভাবে বললে বলা যায়, উম্মাহ্’র  যদি কর্তৃত্বশীল কারও সাথে বিরোধপূর্ণ অবস্থার সৃষ্টি হয়, তার অর্থ হচ্ছে এ বিরোধ হচ্ছে শাসক এবং উম্মাহ্’র  মধ্যে। আর, এ বিরোধকে আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের কাছে উপস্থাপন করার অর্থ হল ইসলামী বিচারব্যবস্থা অর্থাৎ মাহ্কামাতুল মাযালিমের কাছে তা উপস্থাপন করা।

খলীফা নির্বাচনে মুসলিমদের জন্য বরাদ্দকৃত সময়কাল

খলীফা নির্বাচনে মুসলিমদের জন্য অনুমোদিত সর্বোচ্চ সময়কাল হল তিনদিন এবং তাদের মধ্যবর্তী রাতসমূহ। কাঁধে বাই’আত নেই এ অবস্থায় তিনরাতের বেশী থাকা যে কোন মুসলিমের জন্য হারাম। তিনরাতের সর্বোচ্চ সময়টুকু ব্যবহার

করা অনুমদিত এ কারণে যে, পূর্ববর্তী খলীফার মৃত্যু বা অপসারণ হওয়া মাত্রই পরবর্তী খলীফা নির্বাচন করা মুসলিমদের  জন্য ফরয বা বাধ্যতামূলক হয়ে যায়। তাই, মুসলিমরা যদি তিনদিন এবং এর মধ্যবর্তী রাতসমূহ খলীফা নির্বাচন কাজেই  ব্যস্ত থাকে, তবে এক্ষেত্রে খলীফা নির্বাচনে এই বিলম্ব অনুমোদন যোগ্য হবে। যদি নির্ধারিত তিনরাত অতিক্রান্ত হয়ে যায়  এবং তারপরেও এ সময়ের মধ্যে খলীফা নির্বাচিত না হয়, তবে বিষয়টি খতিয়ে দেখতে হবে। মুসলিমরা যদি খলীফা নির্বাচনে ব্যস্ত থাকে এবং এমন কোন কারণে খলীফা নির্বাচন করতে ব্যর্থ হয়, যা তাদের নিয়ন্ত্রণ ও ক্ষমতার বাইরে, তবে  এর জন্য তারা গুনাহ্গার হবে না। এর কারণ, এক্ষেত্রে তারা তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে আপ্রাণ চেষ্টায় রত ছিল  এবং তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তারা তাদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে। কারণ ইবনে হাব্বান এবং ইবনে মাজাহ ইবনে  আব্বাস থেকে বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন,

‘আল্লাহ্ আমার উম্মাহ্’কে তাদের ভুল-ভ্রান্তি, ভুলে যাওয়া এবং তাদেরকে যে সব বিষয়ের জন্য বাধ্য করা হয়েছে, তার জন্য ক্ষমা করে দিয়েছেন’
(আল-নাওয়ায়ী, আল-মাজমু’ শারহ্ আল-মুহাদ্দাব, খন্ড-৮, পৃষ্ঠা-৪৫০)

কিন্তু, তারা যদি সে চেষ্টায় রত না থাকে তাহলে ততক্ষণ পর্যন্ত তারা গুনাহ্’র মধ্যে থাকবে যতক্ষণ পর্যন্ত না একজন খলীফা নির্বাচিত হয় এবং একমাত্র তখনই তাদের কাঁধ থেকে গুনাহ্’র বোঝা অপসারিত হবে। তবে, খলীফা নির্বাচনের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে অবহেলা করার কারণে তারা যে গুনাহ্গার হয়েছিল, তা থেকে তারা মুক্ত হবে না। বরং, এটা তাদের কাঁধেই থাকবে এবং আল্লাহ্ তা’আলা যে কোন মুসলিমকে গুণাহ্ করলে বা কোন ফরয দায়িত্ব পালন না করলে যেমন শাস্তি দেবেন এ জন্যও তাদের তেমন শাস্তি প্রদান করবেন।

খলীফার পদটি শূন্য হওয়া মাত্রই যে খলীফা নির্বাচন করার কাজে সম্পৃক্ত হতে হবে, এ বিষয়ে দলীল হল সাহাবীগণ (রা.) রাসূল (সা) এর ইন্তেকালের পরপরই একই দিনে, তাঁর (সা) দাফনের পূর্বেই এ কাজটি সম্পন্ন করার জন্য বানু সাই’দা’র প্রাঙ্গনে মিলিত হয়েছিলেন। আবু বকরকে (রা.) খলীফা নিযুক্তির বাই’আত সেদিনই সম্পন্ন হয়েছিল। পরেরদিন মদীনার জনগণ আনুগত্যের বাই’আত প্রদানের জন্য মসজিদে সমবেত হয়েছিল।

আর, খলীফা নির্বাচনে সর্বোচ্চ সময়সীমা যে তিনদিন এবং তাদের মধ্যবর্তী রাতসমূহ, এ ব্যাপারে দলিল হল, যখন উমর (রা.) অনুভব করলেন যে তাঁর মৃত্যু আসন্ন তখন তিনি একজন খলীফা নির্বাচনের জন্য (মাজলিসে) শুরার লোকদের দায়িত্ব দিয়ে তাদের তিনদিনের একটি সময়সীমা বেঁধে দিলেন এবং তিনদিন পার হয়ে যাবার পর যে কারও মতানৈক্যের জন্য যদি খলীফা নির্বাচন করা সম্ভব না হয় তাহলে তাকে হত্যা করার নির্দেশ দিলেন। হত্যা করার এ নির্দেশ মুসলিমদের মধ্য হতে পঞ্চাশ জন ব্যক্তিকে দেয়া হয়েছিল, যদিও যে দলের মধ্য হতে কোন একজনকে হত্যার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল, তাঁরা প্রত্যেকেই শুরা সদস্য ও উচ্চ পর্যায়ের সাহাবী (রা.) ছিলেন। সাহাবীদের (রা.) উপস্থিতিতেই এ নির্দেশ দেয়া হয়েছিল এবং তাঁদের কেউ এ নির্দেশের প্রতিবাদ কিংবা এর সাথে দ্বিমত পোষণ করেননি। তাই, এটা বলা যায় যে, মুসলিমদের তিনদিন এবং তাদের মধ্যবর্তী রাতসমূহের অধিক সময় খলীফাবিহীন অবস্থায় থাকা নিষিদ্ধ এটা সাহাবীদের (রা.) একটি সাধারণ ঐক্যমত। আর, কোন বিষয়ে সাহাবীদের (রা.) ঐক্যমত কুর’আন ও সুন্নাহ্’র মতোই শারী’আহ্ দলিল।

আল-মিশওয়ার ইবন মাকরামাহ্ থেকে আল-বুখারী বর্ণনা করেছেন যে, তিনি (ইবন মাকরামাহ্) বলেছেন যে,

“রাতের কিছু অংশ অতিবাহিত হবার পর আব্দুর রহমান আমার দরজায় কড়া নাড়তে থাকলেন যতক্ষণ পর্যন্ত না আমি জেগে উঠলাম। তিনি বললেন, ‘আমি দেখতে পাচ্ছি তুমি ঘুমাচ্ছো। আল্লাহ্’র কসম! গত তিনরাত যাবত আমি ঘুমের আনন্দ উপভোগ করতে পারিনি…।”
(সহীহ্ বুখারী, হাদীস নং-৭২০৭)

মদীনার লোকেরা ফজর নামাজের পর উসমান (রা.) কে বাই’আত প্রদান সম্পন্ন করলো।

সুতরাং, এটা মুসলিমদের জন্য বাধ্যতামূলক যে, যখনই খলীফার পদ শূন্য হয়ে যায় তখনই পরবর্তী খলীফাকে বাই’আত প্রদানের কাজে সম্পৃক্ত হওয়া এবং তিনদিনের মধ্যে তা সম্পন্ন করা। আর, যদি মুসলিমরা নিজেদেরকে এ কাজে  নিয়োজিত না করে, তাহলে এ ব্যাপারে নীরবতার জন্য পূর্ববর্তী খলীফার মৃত্যুর পর থেকে ততক্ষণ পর্যন্ত তারা গুনাহ্গার হবে যতক্ষণ পর্যন্ত তারা নীরব থাকবে। এ অবস্থা এখন বিরাজ করছে; যেখানে মুসলিমরা এখন গুনাহ্গার, কারণ তারা  ১৩৪২ হিজরীর ২৮ রজব তারিখে খিলাফত বিলুপ্ত হবার পর এখন পর্যন্ত খিলাফত প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি। কেবলমাত্র  তারাই এ গুনাহ্’র  হাত থেকে রক্ষা পাবে যারা এটা প্রতিষ্ঠিত করবার মতো একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজে আন্তরিকতার

সাথে একটি সত্যপন্থী ও সত্যনিষ্ঠ দলের সাথে গভীর প্রচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে। একমাত্র এক্ষেত্রেই কোন মুসলিম এ গুনাহ্’র   হাত থেকে রক্ষা পাবে। মনে রাখতে হবে যে, এ পাপ ততখানি ভয়াবহ যতোটা রাসূল (সা) হাদীসের মাধ্যমে বর্ণনা করেছেন:

“যে ব্যক্তি কাঁধে বাই’আতের শপথ ব্যতীত মৃত্যুবরণ করলো সে যেন জাহেলিয়াতের (ইসলামবিহীন অবস্থায় মৃত্যু) মৃত্যুবরণ করল।”
(সহীহ্ বুখারী, হাদীস নং-৭০৫৪; সহীহ্ মুসলিম, হাদীস নং-৪৭৬৭)

এই হাদীস এ অপরাধের ব্যাপকতাকে তুলে ধরে।

Leave a Reply