সামগ্রিকভাবে পুরো গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন করুন এবং খিলাফত প্রতিষ্ঠা করুন
গত এক মাসেরও বেশি সময় ধরে দেশের সমগ্র রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক অঙ্গন – রাজনৈতিক দলসমূহ, গণমাধ্যম ও তথাকথিত বুদ্ধিজীবীগণ – সকলেই নতুন নির্বাচন কমিশন নিয়োগের জন্য সার্চ কমিটি গঠন এবং একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে ব্যাপক আলোচনায় লিপ্ত থাকতে দেখেছি। তারা রাজনৈতিক বক্তব্য/কর্মসূচী, বিবৃতি, পত্রিকার কলাম ও টক-শো’র মাধ্যমে সাধারণ জনগণের উপরে তাদের উদ্বেগ ও নিজস্ব মতামতসমূহ চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে। এখন যখন নতুন নির্বাচন কমিশনার নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছে তখন তার নিরপেক্ষতা ও সক্ষমতা ইত্যাদি নিয়ে আবারও বিতর্ক ও আলোচনা শুরু হয়েছে এবং তা অব্যাহত রাখার প্রক্রিয়া চলমান থাকবে।
কিন্তু আসল বিষয় হচ্ছে, এই সার্চ কমিটি এবং একটি নিরপেক্ষ ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠনের ধারনা কেবলমাত্র একটি প্রতারণা ব্যতিরেকে আর কিছুই নয়।
গণতন্ত্র বিশ্বব্যাপী এক ব্যর্থ ব্যবস্থা
বিশ্বজুড়েই গণতন্ত্র ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। আর যখন এটা প্রমান হয়ে গেছে যে, বিশ্বব্যাপী গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা কার্যকারিতা হারাচ্ছে তখন এইসব বিশ্বাসঘাতক শাসক, রাজনীতিবিদ এবং শিক্ষিত ও সংস্কৃতিমনা সম্প্রদায় নতুন সার্চ কমিটি ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন জাতির জন্য আদৌ কোন কল্যান বয়ে আনবে কি না সে বিষয়ে কোন আলোচনা করছে না, কিংবা এ সংক্রান্ত কোন আলোচনার সুযোগ দিচ্ছে না। বিগত ২৬ বছর ধরেই অমরা এ ধরনের গণতান্ত্রিক প্রতারণার শিকার হচ্ছি, যদিওবা আমরা জানি যে রাসূল (সা) বলেছেন:
لَا يُلْدَغُ الْمُؤْمِنُ مِنْ جُحْرٍ وَاحِدٍ مَرَّتَيْنِ
“মু’মিন একই গর্তে দুই বার দংশিত হয় না” (বুখারি)।
আমরা কি ইউরোপীয় দেশগুলোর অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন প্রত্যক্ষ করি না? ইউরোপের শতকরা ৩০ ভাগেরও কম সংখ্যক লোক তাদের নিজেদের জাতীয় সংসদের উপর আস্থা রাখে (ইউরোপীয় ইউনিয়ন ব্যুরোর অফিসিয়াল জরিপ ২০১৬ অনুসারে)। এমনকি ট্রাম্পের ক্ষমতা গ্রহণের পরে আমেরিকার বেশিরভাগ নাগরিক বলতে শুরু করেছে যে তারা গণতন্ত্রের উপর বিশ্বাস হারিয়েছে।
রাজনৈতিক ব্যবস্থার ভিত্তি সম্পর্কিত আলোচনা দূরে রেখে শাখা-প্রশাখার আলোচনা তথা সুষ্ঠু নির্বাচনের বিতর্ক কেবল বুদ্ধিবৃত্তিক ও রাজনৈতিক বিশ্বাসঘাতকতা ছাড়া আর কিছুই নয়। যখন একটি দেশের রাজনীতি দুর্নীতিগ্রস্থ গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের উপর গড়ে ওঠে, তখন সার্চ কমিটি ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের কাছ থেকে কেবলমাত্র তিক্ত ফলই পাওয়া যাবে। আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন:
أَلَمْ تَرَ كَيْفَ ضَرَبَ اللَّهُ مَثَلًا كَلِمَةً طَيِّبَةً كَشَجَرَةٍ طَيِّبَةٍ أَصْلُهَا ثَابِتٌ وَفَرْعُهَا فِي السَّمَاءِ، تُؤْتِي أُكُلَهَا كُلَّ حِينٍ بِإِذْنِ رَبِّهَا وَيَضْرِبُ اللَّهُ الْأَمْثَالَ لِلنَّاسِ لَعَلَّهُمْ يَتَذَكَّرُونَ، وَمَثَلُ كَلِمَةٍ خَبِيثَةٍ كَشَجَرَةٍ خَبِيثَةٍ اجْتُثَّتْ مِنْ فَوْقِ الْأَرْضِ مَا لَهَا مِنْ قَرَارٍ
“তুমি কি লক্ষ্য করনি আল্লাহ্ কিভাবে দৃষ্টান্ত দিয়েছেন একটি পবিত্র বাণীর (কালেমায়ে তাইয়্যেবার) যে, তা একটি পবিত্র বৃক্ষের ন্যায় যার শিকড় (জমিনে) সুদৃঢ় এবং যার শাখা-প্রশাখা উর্ধ্বে উত্থিত, সে বৃক্ষ স্বীয় রবের আদেশে প্রত্যেক মওসুমে তার ফলদান করে….আর অপবিত্র কথার (কালেমা খাবিছার) তুলনা হচ্ছে একটি নিকৃষ্ট বৃক্ষ, যার মূল জমিন থেকে বিচ্ছিন্ন, যার কোনো স্থায়িত্ব নাই” (সুরা-ইব্রাহিম: ২৪-২৬)।
গণতন্ত্র কোন প্রকৃত পরিবর্তন বয়ে আনবে না
প্রথমত, গণতান্ত্রিক শাসকেরা কুফর ব্যবস্থা দিয়ে জনগণকে শাসন করা অব্যাহত রাখবে, দেশের মুসলিমদেরকে অত্যাচার ও নিপীড়ণ করতে থাকবে এবং জনগণের প্রয়োজনীয় বিষয়াদি অগ্রাহ্য করে তাদের সম্পদ লুণ্ঠন করে আরও অসহায় অবস্থার দিকে ঠেলে দেবে।
পশ্চিমাশক্তি সমর্থিত বাংলাদেশী গণতন্ত্রের অধীনে কেবলমাত্র অত্যাচারীর চেহারা পরিবর্তন ব্যতিরেকে আর কিছুই অর্জিত হবে না। এখন এদেশের জনগণ ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের নামে আওয়ামী লীগ (হাসিনা) কর্তৃক অত্যাচারিত হচ্ছে; আর একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে বড় জোর এই ক্ষমতাসীন আওয়ামী শাসকগোষ্ঠীর পরিবর্তে ধর্মনিরপেক্ষ বিএনপি’র (খালেদা-তারেক) হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরিত হবে, যারা একইভাবে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের নামে জনগণকে শোষণ করতে থাকবে।
দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশ পশ্চিমা শক্তিসমূহের অনুগত একটি রাষ্ট্র এবং যারাই ক্ষমতায় আসুক না কেন তারা ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাবে এবং দেশের জনগণের কষ্ট ও ভোগান্তির বিনিময়ে পশ্চিমা ও আঞ্চলিক প্রভুদের সন্তুষ্ট করতে সচেষ্ট থাকবে…
সাম্রাজ্যবাদীদের (আমেরিকা-বৃটেন-ভারতের) জন্য সবচেয়ে অনুগত দালাল শাসক খুঁজে বের করাই হচ্ছে এই সার্চ কমিটি এবং অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের একমাত্র উদ্দেশ্য, যারা কার্যকরভাবে জনগণকে বশে রাখবে, ইসলামের উত্থানকে দমন করবে এবং সুচারুভাবে পশ্চিমাদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করবে। মুসলিম বিশ্বের নির্বাচনসমূহ নিরপেক্ষ কিংবা পক্ষপাতদুষ্ট যাই হোক না কেন, যতক্ষণ পর্যন্ত নির্বাচিত শাসকেরা তাদের প্রভুদের হীন স্বার্থ সংরক্ষন করবে ততক্ষন পর্যন্ত পশ্চিমা শক্তিসমূহ এসব দালালদেরকে সমর্থন দিয়ে যাবে। আমরা সকলেই প্রত্যক্ষ করেছি যে, ২০১৪ সালে হাসিনা সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত ভোটারবিহীন নির্বাচনে নজিরবিহীন জালিয়াতির পরেও কিভাবে আমেরিকা ও ইউরোপীয় দেশগুলো তার সরকারকে বৈধতা দিয়েছে!!
প্রকৃত সমাধান
পশ্চিমা উপনিবেশিক শক্তিসমূহ তাদের দালালদের মাধ্যমে ১৯২৪ সালে খিলাফতকে ধ্বংস করে দেয় এবং মুসলিম ভূ-খন্ডসমূহে জোরপূর্বক গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা চাপিয়ে দেয়, যা মুসলিমদের বর্তমান সমস্যা ও সঙ্কটের মূল কারণ।
গণতন্ত্র হচ্ছে একটি কুফর শাসনব্যবস্থা; শাসকগোষ্ঠী ও তাদের প্রভুদের স্বার্থ রক্ষার জন্যই এ মানব রচিত ব্যবস্থা সৃষ্টি করা হয়েছে। পশ্চিমা শক্তিসমূহ কর্তৃক চাপিয়ে দেয়া এই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মূলোৎপাটন ব্যতিরেকে আমাদের সমস্যা সমাধান এবং একটি ন্যায়পরায়ণ ব্যবস্থা বাস্তবায়ন কখনোই সম্ভব নয়।
মুসলিমদের জন্য ইসলাম খিলাফত ব্যবস্থা প্রদান করেছে এবং প্রকৃত পরিবর্তন আনয়নের এটিই একমাত্র পথ।
প্রথমত, এটি উম্মাহ্’র উপর একটি ফরয দায়িত্ব; কারণ রাসূল (সা) বলেছেন:
وَمَنْ مَاتَ وَلَيْسَ فِى عُنُقِهِ بَيْعَةٌ مَاتَ مِيتَةً جَاهِلِيَّةً
“যারা খলিফার বাই’য়াত ছাড়া মৃত্যুবরণ করবে তাদের মৃত্যু হবে জাহিলিয়াতের মৃত্যু” (মুসলিম)।
অর্থাৎ, খলীফাবিহীন সময়ে মৃত্যুবরণ করা ইসলামপূর্ব আইয়ামে জাহিলিয়্যাতের মতোই ভয়ংকর ও পংকিলতাপূর্ণ। কেবলমাত্র খিলাফত ফিরিয়ে আনার কাজে রত থাকলেই কিয়ামত দিবসে এই অপরাধ হতে আমরা নিজেদের মুক্ত করতে পারবো।
দ্বিতীয়ত, উন্নতি ও সমৃদ্ধি অর্জনের এটিই একমাত্র পথ; ক্ষুদা ও দারিদ্রমুক্ত দেশ গড়ার এটিই একমাত্র পন্থা। আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন:
وَلَوْ أَنَّ أَهْلَ الْقُرَى آمَنُوا وَاتَّقَوْا لَفَتَحْنَا عَلَيْهِمْ بَرَكَاتٍ مِنَ السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ
“আর যদি সেই জনপদের অধিবাসীরা ঈমান আনত এবং তাক্বওয়া অবলম্বন করত, তবে আমি অবশ্যই উম্মুক্ত করে দিতাম তাদের জন্য আসমান ও জমিনের বরকতসমুহ” (সূরা আল-আরাফ: ৯৬)।
খিলাফত রাষ্ট্র ব্যবস্থাই হচ্ছে সে ব্যবস্থা যা ঈমান ও তাকওয়ার উপর ভিত্তি করে সমাজ পরিচালনা করে যা আল্লাহর রাসূলের সীরাত ও খুলাফায়ে রাশিদীনদের জীবনী হতে দেখতে পাই।
তৃতীয়ত, এটিই হচ্ছে একমাত্র ব্যবস্থা যা ইসলাম ও মুসলিমদেরকে ইসলামের বিরুদ্ধে অবিশ্বাসী ও তাদের দালাল কর্তৃক পরিচালিত যুদ্ধ থেকে সুরক্ষা দিতে পারে।
আল্লাহ রব্বুল আলামীন বলেন,
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنْ تَنْصُرُوا اللَّهَ يَنْصُرْكُمْ وَيُثَبِّتْ أَقْدَامَكُمْ
হে ঈমানদারগণ, তোমরা যদি আল্লাহকে সাহায্য করো তবে আল্লাহ তোমাদের সাহায্য করবেন এবং তোমাদের পা দৃঢ়প্রতিষ্ঠ করবেন। (সূরা মুহাম্মদ: ৭)
রাসূল (সা) বলেন,
إِنَّمَا الإِمَامُ جُنَّةٌ يُقَاتَلُ مِنْ وَرَائِهِ وَيُتَّقَى بِهِ
“নিশ্চয়ই খলীফা (ইমাম) হচ্ছে ঢালস্বরূপ, যার পেছনে দাঁড়িয়ে (শত্রুদের বিরুদ্ধে) যুদ্ধ করা হয় ও নিজেদেরকে সুরক্ষা করা হয়” (তিরমিযি)।
সঠিক রাজনৈতিক কর্মসূচীর দিক-নির্দেশনা
যখনই সুযোগ পাওয়া যায় আমাদের তখনই মুসলিমদের শাসনব্যবস্থা হিসাবে গণতন্ত্রের বৈধতা ও জবাবদিহিতা সম্পর্কে প্রশ্ন করা উচিত; এটা হতে পারে জনসমাগমস্থলে, কিংবা বাসে, বা পরিবার ও বন্ধু-বান্ধবদের সাথে। টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচারিত ‘টক-শো’গুলোতে, কিংবা যেখানেই আমরা এসব তথাকথিত বুদ্ধিজীবী ও দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদদের দেখা পাবো সেখানেই তাদেরকে চ্যালেঞ্জ করতে হবে, এবং তাদেরকে প্রশ্নের সম্মুখীন করতে হবে যে কেন তারা গণতন্ত্রের মিথ্যা মোহকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছে।
এবং একইসাথে খিলাফত প্রতিষ্ঠার জন্য কঠোর পরিশ্রম করতে হবে, যা আমাদের সকলের জন্য ফরয; এবং, প্রতিশ্রুত দ্বিতীয় খিলাফতে রাশিদাহ্ বাস্তবায়নের প্রচেষ্টাকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করুন, যার মাধ্যমে আমরা একটি সমৃদ্ধ জীবন শুরু করতে পারবো এবং আমাদের হারানো গৌরব ফিরিয়ে এনে পৃথিবীতে নিজেদেরকে একটি নেতৃত্বস্থানীয় ও শক্তিশালী জাতিতে পরিণত করতে সক্ষম হবো…এবং আখিরাতেও সফলতা অর্জন করবো ও নিজেদেরকে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার ক্রোধ থেকে রক্ষা করতে পারবো, ইনশা’আল্লাহ্।
আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন,
يُثَبِّتُ اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا بِالْقَوْلِ الثَّابِتِ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَفِي الْآخِرَةِ وَيُضِلُّ اللَّهُ الظَّالِمِينَ وَيَفْعَلُ اللَّهُ مَا يَشَاءُ
যারা ঈমান এনেছে আল্লাহ্ তাদের প্রতিষ্ঠিত করেন শাশ্বত বাণীর দ্বারা এই দুনিয়ার জীবনে ও পরকালে, আর আল্লাহ্ পথহারা করেন অন্যায়কারীদের, আর আল্লাহ্ যা ইচ্ছে করেন তাই করেন। (সূরা ইবরাহীম: ২৭)