দাফন বিলম্বের ব্যাপারে আলোচনার পূর্বে আমাদের শরীআহ হুকুমের ক্ষেত্রে কিছু উসূলী ব্যাপার উল্লেখ করা প্রয়োজন।
মৌলিকভাবে প্রত্যেক শরীআহ বিষয় তা কোনো কাজ হোক কিংবা কথা, তা কোনো নির্দেশ হিসেবে গণ্য হতে হলে তার জন্য একটি কারীনা (আইনী সূচক) দরকার হয় যা হুকুমটির প্রকৃতি নির্দেশ করে।
কারীনা চুড়ান্ত নির্দেশনা প্রদান করলে হুকুমটি ফরজ হিসেবে গণ্য হয়। আর কারীনা চুড়ান্ত নির্দেশ প্রদান না করলে তা মানদুব (উৎসাহিত) হিসেবে গণ্য হয়। আর কারীনা বাছাই (করা বা না করা)-এর নির্দেশনা দিলে তা মুবাহ হিসেবে গণ্য হয়।
এবং এ বিষয়টি শরীআহর সকল ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, তা আল্লাহর কিতাবের কোনো কথা হোক কিংবা রাসূল (সা) এর কোনো সুন্নাহ হোক কিংবা নবী (সা) এর কোনো কাজ হোক কিংবা সাহাবা (রা)-দের কোনো ইজমা হোক কিংবা হোক তা নবী (সা)-এর কোনো অনুমতি প্রদান।
১. উদাহরণস্বরূপ, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার বক্তব্য:
فَإِذَا قُضِيَتِ الصَّلَاةُ فَانْتَشِرُوا فِي الْأَرْضِ وَابْتَغُوا مِنْ فَضْلِ اللَّهِ وَاذْكُرُوا اللَّهَ كَثِيرًا لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ
“অতঃপর যখন সালাত সমাপ্ত হবে তখন তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ো আর আল্লাহ’র অনুগ্রহ অনুসন্ধান কর এবং আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ কর, যাতে তোমরা সফল হতে পারো” । [সূরা জুমুআ: ১০]
এখানে (فَانْتَشِرُوا) দ্বারা জুমার পর মসজিদ থেকে বের হয়ে ছড়িয়ে পড়ার নির্দেশ প্রদান করে। এখন, এ হুকুমটির কারীনার মাধ্যমে বুঝতে হবে এটি কি ফরজ, মানদুব নাকি মুবাহ। উল্লেখ্য, এ আয়াতে (فَانْتَشِرُوا) মুবাহ অর্থে এসেছে।
২. জানাযা যাওয়ার সময় উঠে দাঁড়ানোর উদাহরণ:
আবদুল্লাহ বিন আবী আস-সাফার হতে শু’বা বর্ণনা করেন: আমি শুনেছি আশ-শা’বী আবী সাঈদ বর্ণনা করেন: (إِنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَرَّتْ بِهِ جَنَازَةٌ فَقَامَ) একটি জানাযা অতিক্রম হচ্ছিল এবং (তা দেখে) রাসূল (সা) উঠে দাড়িয়েছিলেন। [সুনান আন-নাসাঈ]
নবী (সা) জানাযা যাওয়ার সময় উঠে দাড়িয়েছিলেন, এ কাজটি একটি আদেশের হুকুম প্রদান করে।
আমরা যখন হুকুমটির প্রকৃতি বোঝার জন্য এর কারীনার জন্য সীরাহ অধ্যয়ন করবো অর্থাৎ এটি বোঝার জন্য যে এ আদেশটি চুড়ান্ত (ফরজ), উৎসাহিত (মানদুব) না বৈধ (মুবাহ) হুকুম প্রদান করে, তখন দেখবো একটি জানাজা অতিক্রান্ত হওয়ার সময় আল-হাসান বিন আলী (রা) উঠে দাঁড়িয়েছিলেন কিন্তু ইবন আব্বাস উঠে দাড়াননি, (তখন) আল-হাসান (রা) বলেন, (أَلَيْسَ قَدْ قَامَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لِجَنَازَةِ يَهُودِيٍّ؟) “আল্লাহর রাসূল কি উঠে দাড়াননি যখন একজন ইহুদীর জানাযা অতিক্রান্ত হচ্ছিল? ইবন আব্বাস (রা) বলেন, হ্যাঁ, এর তিনি (সা) বসে পড়েন।” এ ঘটনা নির্দেশনা দেয় যে এখানে (দাড়ানো বা বসা) বাছাই করার সুযোগ রয়েছে অর্থাৎ এটি বৈধ (মুবাহ)।
সাকীফাহ-তে বাইয়াতের ঘটনার ক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাই, এ ব্যাপারে সাহাবা (রা) গণ ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলেন। এ ঘটনা নির্দেশনা প্রদান করে যে একজন খলীফাকে বাইয়াত প্রদান করতে হবে। এখন এ আদেশটির প্রকৃতি বুঝতে হলে এর কারীনা খুঁজে দেখতে হবে, এবং এর কারীনা নির্দেশনা দেয় যে এটি একটি ফরজ দায়িত্ব যেহেতু সাহাবা (রা) গণ বিষয়টিকে আল্লাহর রাসূল (সা)-এর দাফন তথা একটি ফরজ দায়িত্বের উপরে প্রাধান্য দান করেছেন। অর্থাৎ, একটি ফরজের উপর কোনো বিষয়কে প্রাধান্য দেওয়াটি ওই বিষয়টিকেও ফরজিয়্যাত প্রদান করে। এবং এও প্রমাণ হয় যে এটি শুধুমাত্র একটি ফরজ না বরং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ফরজ।
ফিকহী দৃষ্টিকোন থেকে:
এটি বলা যে দাফনের সাথে বাইয়াতের কোনো সম্পর্ক নেই, বরং মুসলিমদের জানাযার জন্য একত্রিত হবার জন্য সময় দেয়া হচ্ছিল, এটি যা ঘটেছিল তা থেকে অনেক দুরে।
আল্লাহর রাসূল (সা)-এর মৃত্যু একটি বড় ঘটনা ছিল। এবং মদীনা ও তার আশেপাশের সকল মুসলিম খবরটি শুনতে পায় এবং মদীনা ও মসজিদের দিকে মুসলিমদের ঢল নামে। কিন্তু তারা আবু বকরের বাইয়াত নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। সীরাহ গ্রন্থগুলোতে ঘটনার প্রবাহটি এরকম:
আল্লাহর রাসূল (সা) সোমবার দোহার ওয়াক্তে মৃত্যুবরণ করেন; মঙ্গলবার রাত্রি পর্যন্ত তার দাফন সম্পন্ন হয়নি। মঙ্গলবার সকালে আবু বকরকে বাইয়াত প্রদান করা হয় এবং বুধবার মধ্যরাতে রাসূল (সা)-এর দাফন সম্পন্ন হয়।
আবু বকরকে রাসূল (সা) এর দাফনের পূর্বেই বাইয়াত প্রদান করা হয়। এটি সাহাবা (রা) গণের ইজমা ছিল; অর্থাৎ মৃতের দাফনের উপর খলীফা নিয়োগ দেওয়ার কাজে রত থাকাকে প্রাধান্য প্রদান।
দাফনের বিলম্ব এজন্য হয় নি যাতে মুসলিমগণ জানাযা দেখতে আসার জন্য সময় পায় কারণ তারা সকলে তখন সেখানেই ছিল বিশেষ করে সাহাবা (রা) গণ, কিন্তু তারা বাইয়াত নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।
চুক্তির ও আনুগত্যের বাইয়াত শেষ হবার সাথে সাথে তারা রাসূল (সা)-এর দাফনের কাজ সম্পন্নের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন, এবং এটি কখন? এটি বাইয়াত শেষ হবার পর মধ্যরাতে।
যদি বিলম্ব এ কারণে হয়ে থাকতো যাতে মানুষ জানাযার জন্য একত্রিত হতে পারে, তাহলে সোমবার, মঙ্গলবার রাত্রি কিংবা মঙ্গলবার সকালেও তা হতে পারতো…কিন্তু তারা আবু বকরের জন্য চুক্তি ও আনুগত্যের বাইয়াত শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করেন। যখনি তা শেষ হয় তারা অনতিবিলম্বে দাফন কাজ সম্পাদনে রত হয়ে পড়েন, বুধবার মধ্যরাতে।
দাফনে বিলম্বের বিষয়ে চিন্তা করলে যা পরিষ্কারভাবে প্রতিফলিত হয় তা হলো এ বিলম্ব কেবলমাত্র আবু বকরের চুক্তি ও আনুগত্যের বাইয়াত সম্পন্ন শেষ হওয়ার জন্যই হয়েছে। সুতরাং এটি বাইয়াতের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত।
শাইখ আতা বিন খলীল আবু রাশতা কর্তৃক এক প্রশ্নোত্তর অবলম্বনে লিখিত
মূল প্রশ্নোত্তরটির লিংক: ইংরেজি আরবী