নাম সাওবান, পিতার নাম নাজদাহ, কুনিয়াত বা ডাকনাম আবু আবদিল্রাহ। ইয়ামানের প্রসিদ্ধ হিময়ার গোত্রের সন্তান। (আসাহ হুস সিয়ার-৫৯৯) কোন কারণে তিনি দাসে পরিণত হন। হযরত রাসূলে কারীম সা: তাকে খরীদ করেন এবং পরে আযাদ করে দেন। আযাদ করার সময় তিনি সাওবানকে বলেন, ইচ্ছা করলে তুমি স্বগোত্রীয় লোকদের কাছে চলে যেতে পার অথবা আমার সাথে থাকতে পার। আমার সাথে থাকলে আমার পরিবারের সদস্য বলে গণ্য হবে। সাওবান নিজ গোত্রে ফিরে যাওয়ার চেয়ে রাসূলুল্লাহর সা: সাহচর্যে থাকাকেই শ্রেয় মনে করেন।
হযরত রাসূলে কারীমের ওফাতের পর অল্প কিছুদিন তিনি মদীনায় ছিলেন। রাসূল সা: ছাড়া মদীনা তার কাছে অসহনীয় হয়ে ওঠে। তিনি মদীনা ছেড়ে শামের ‘রামলা’ নামক স্থানে বসবাস শুরু করেন। মিসর অভিযানে তিনি অংশগ্রহণ করেন এবং ‘রামলা’ ছেড়ে ‘হিমসে’ বসতি স্থাপন করেন। এই হিমসে হিজরী ৫৪ সনে তিনি ইনতিকাল করেন।
হযরত সাওবান ছিলেন রাসুল সা: এর বিশেষ খাদেম। ভেতর বাহির সর্ব অবস্থায় তিনি রাসূল সা: সঙ্গ লাভের সুযোগ পান। এ কারণে স্বাভাবিকভাবে ‘উলুমে নববী’ বা নবীর জ্ঞান সমূহে বিশেষ পারদর্শিতা অর্জন করেন। তার থেকে রাসুল সা: এর ১২৭টি হাদীস বর্ণিত হয়েছে। তিনি হাদীস হিফজ বা মুখস্থ করার সাথে সাথে প্রচার ও প্রসারের দায়িত্বও পালন করতেন। আল্লামাহ ইবন আবদিল বার বলেছেন, সাওবান সেই সব লোকদের একজন যারা হাদীস মুখস্থ করণের সাথে সাথে তার প্রচারের কাজও করেছেন।
হযরত সাওবানের প্রচুর হাদীস মুখস্থ থাকায় অসংখ্য লোক তা শোনার জন্য তার নিকট আসতো। একবার লোকেরা তার নিকট হাদীস শোনার আগ্রহ প্রকাশ করলে তিনি বলেন: কোন মুসলমান আল্লাহর উদ্দেশ্যে একটি সিজদাহ করলে আল্লাহ তার একটি মর্যাদা বৃদ্ধি করে দেন এবং তার গোনাহ সমূহও মাফ করে দেন। (মুসনাদে ইমাম আহমাদ ইবন হাম্বল-৫/২৭৬)।
হযরত সাওবানের যুগের প্রখ্যাত মুহাদ্দিসগণ অন্যদের নিকট থেকে শ্রুত তাদের হাদীস সমূহের সত্যাসত্য তার নিকট থেকে যাচাই করতেন। সা’দান ইবন তালহার মত উচু স্তরের একজন হাদীস বিশারদ হযরত আবুদ দারদার (রা) নিকট থেকে একটি হাদীস শোনেন এবং তার সত্যাসত্য যাচাই করেন হযরত সাওবানের নিকট থেকে। হযরত রাসূলে কারীমের সা: ওফাতের পর তিনি মদীনার অন্যতম মুজতাহিদ সাহাবী হিসাবে পরিগণিত হন। (আলামুল মুওয়াক্কিরীন -১/১৫)।
হযরত সাওবানের ছাত্রদের গন্ডিও সুপ্রশস্ত। সা’দান ইবন তালহা, রাশেদ ইবন সাদ, জুবাইর ইবন নুদাইর, আব্দুর রহমান ইবন গানাম, আবু ইদরীস প্রমূখ ছিলেন তার উল্লেখযোগ্য ছাত্র।
হযরত রাসূলে কারীমের সা: প্রতি তার এত বেশি ভক্তি ও শ্রদ্ধা ছিল যে, রাসুলুল্লাহর সা: প্রতি বিন্দুমাত্র অশ্রদ্ধার ভাব প্রকাশ পায় এমন কোন একটি শব্দও তিনি অমুসলিমের মুখ থেকে শুনে সহ্য করতে পারতেন না। একবার এক ইয়াহুদী রাসুল সা: এর নিকট এসে বললো: আসসালামু আলাইকা ইয়া মুহাম্মাদ। সাথে সাথে সাওবান ক্রোধে ফেটে পড়লেন। তিনি সেই ইয়াহুদীকে এমন জোরে এক ধাক্কা দিলেন যে বেচারা পড়তে পড়তে কোন রকম টাল সামলাল। লোকটি একটু স্থির হয়ে তার এত রাগের কারণ কি তা জানতে চাইলো। সাওবান বললেন: তুমি কেন ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ’ না বলে ‘ইয়া মুহাম্মাদ’ বললে? লোকটি বললো, এতে এমন কি অপরাধ হয়েছে? আমি তার খান্দানী নামই উচ্চারণ করেছি। রাসুল সা: তার কথায় সায় দিয়ে বললেন, হা, আমার খান্দানী নাম মুহাম্মাদ।
নবুওয়াতের সম্মান তো বিরাট ব্যাপার। রাসুল সা: এর সাথে তার যে গোলামী বা দাসত্বের সম্পর্ক ছিল তাও যদি কেউ উপেক্ষা বা অবহেলার দৃষ্টিতে দেখতো, তিনি তাকে সতর্ক করে দিতেন। হিমসে অবস্থান কালে একবার তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। হিমসের ততকালীন ওয়ালী আবদুল্লাহ ইবন কারাত ইযদী যখন তাকে দেখতে এলেন না, তখন তিনি একটি চিঠিতে লিখলেন: যদি মূসা ও ঈসার দাস তোমার এখানে থাকতো, তুমি তার অসুস্থতা সম্পর্কে খোঁজ নিতে বা দেখতে যেতে। এই চিঠি পেয়ে ওয়ালী এমন ব্যস্ততার সাথে বাড়ী থেকে বের হন যে, লোকেরা মনে করে নিশ্চয় বিরাট কোন কিছু ঘটেছে। এ অবস্থায় তিনি হযরত সাওবানের বাড়ী পৌঁছেন এবং দীর্ঘক্ষণ তার পাশে বসে থাকেন।
হযরত রাসূলে কারীম সা: এর নির্দেশ পালনের ব্যাপারে তিনি এত বেশি সচেতন ছিলেন যে, একবার যে নির্দেশ তিনি রাসুল সা: থেকে লাভ করেছেন আজীবন তা পালন করেছেন এবং কোন নির্দেশ অমান্য করার বিন্দুমাত্র আশংকা থাকে এমন কাজ তিনি কখনও করেননি। তাবারানী আবু উমামা (রা) থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন: রাসুল সা: বললেন: কে বাইয়াত করবে? সাওবান বললেন: ইয়া রাসূলুল্লাহ, আমরা তো বাইয়াত করেছি। রাসূল সা: বললেন: কারও কাছে কোন কিছু চাইবে না- এ কথার উপর বাইয়াত। সাওবান বললেন: কিসের জন্য ইয়া রাসুলুল্লাহ! বললেন: জান্নাতের জন্য। সাওবান্ এ কথার উপর বাইয়াত করলেন। আবু উমামা বলেন: আমি তাকে মক্কায় মানুষের ভিড়ের মধ্যে সওয়ারী অবস্থায় দেখেছি। এ অবস্থায় তার হাত থেকে চাবুকটি পড়ে যায়। সম্ভবত: তা এক ব্যক্তির ঘাড়ের উপর পড়ে এবং সে চাবুকটি ধরে ফেলে। অত:পর সে তা সাওবানের হাতে তুলে দিতে চায়; কিন্তু তিনি তা গ্রহণ না করে বাহন থেকে নেমে এসে নিজ হাতে তুলে নেন। (হায়াতুস সাহাবা-১/২৪২)।
অন্য একটি বর্ণনায় এসেছে, রাসূল সা: বললেন: মানুষের কাছে সাওয়াল করবে না, এ নিশ্চয়তা যে আমাকে দেবে আমি তাকে জান্নাতের নিশ্চয়তা দিচ্ছি। এ কথা শুনে সাওবান বলে উঠলেন: আমি নিশ্চয়তা দিচ্ছি। এরপর তিনি কারও কাছে কিছু চাইতেন না। (আল ইসাবা-১/২০৪)।
ইউসুফ ইবন আবদিল হামীদ বর্ণনা করেছেন। সাওবান আমাকে বলেছেন, একবার রাসূল সা: তার আহল বা পরিবারবর্গের জন্য দুআ করলেন। আমি বললাম, আমিও তো আহলি বাইতের (আপনার পরিবারবর্গের) অন্তর্গত। তৃতীয়বার তিনি বললেন: হা, তুমি আমার পরিবারের অন্তর্গত। তবে ততক্ষণ পর্যন্ত তুমি কোন বন্ধ দরযায় না দাড়াবে অথবা কোন আমীরের কাছে কিছু চাইতে না যাবে। (আল ইসাবা-১/২০৪)।
এই সব নির্দেশের পর তিনি জীবনে আর কখনও কারও নিকট কোন কিছু চাননি বলে ইতিহাসে জানা যায়।