নাম সালামা, ডাক নাম আবু হাশেম। পিতা হিশাম ইবন মুগীরা এবং মাতা দাবায়া বিনতু আমের। ইসলামের ঘোরতর শত্রু আবু জাহলের ভাই।
ড: মুহাম্মাদ হামীদুল্লাহ সালামার মা দাবায়া বিনতু আমেরের জাহিলী জীবনের এক চমকপ্রদ কাহিনী বর্ণনা করেছেন। হাইসাম ও ইবনুল কালবী বর্ণনা করেছেন: মুত্তালিব ইবন আবী ওয়াদায়া ইবন আব্বাসকে বলেছেন: দাবায়া বিনতু আমের ছিলেন হাওজা ইবন আলীর স্ত্রী। হাওজা মারা গেলে দাবায়া উত্তরাধিকারী হিসাবে প্রচুর সম্পত্তি লাভ করেন। অত:পর তিনি পিতৃ গোত্রে ফিরে আসেন। সেখানে আবদুল্লাহ ইবন জুদয়ান আত তাইমী দাবায়ার পিতার নিকট তাকে বিয়ের প্রস্তাব পাঠান। তার পিতা রাজী হন এবং আবদুল্লাহর সাথে তাকে বিয়ে দেন।
এদিকে দাবায়ার পিতা বলেন,আমি তো তাকে ইবন জুদয়ানের সাথে বিয়ে দিয়েছি। হুযন তখন শপথ করে বলে, দাবায়া যদি ইবন জুদয়ানের কাছে যায় তাহলে আমি তার স্বামীর সামনেই তাকে হত্যা করবো।
দাবায়ার পিতা ঘটনাটি ইবন জুদয়ানকে জানালেন। ইবন জুদয়ানও পাল্টা জানিয়ে দিলেন, যদি তিনি দাবায়ার চাচাতো ভাইয়ের দাবী অনুযায়ী কাজ করেন তাহলে উকাজ মেলায় তার বিরুদ্ধে চুক্তি ভঙ্গের অভিযোগের ঝান্ডা উত্তোলন করা হবে। দাবায়ার পিতা তার চাচাতো ভাইয়ের নিকট বিষয়টি বর্ণনা করলে সে নমনীয় হয়ে যায় এবং তার দাবী প্রত্যাহার করে নেয়। দাবায়াকে ইবন জুদয়ানের নিকট পাঠানো হলো। আল্লাহর মর্জি যতদিন ছিল, তিনি সেখানে থাকলেন। দাবায়া ছিলেন অতি সুন্দরী যুবতী। ইবন জুদয়ানের সাথে দাম্পত্য জীবন চলাকালে একদিন মক্কায় কাবার তাওয়াফ করছিলেন, এ সময় হিশাম ইবন মুগীরার নজরে পড়লেন। দাবায়ার রূপে হিশাম মুগ্ধ হলেন। কাবার চত্বরে তারা কিছুক্ষণ কথা বললেন, এক পর্যায়ে হিশাম বললেন: দাবায়া! এই রূপ ও যৌবন নিয়ে তুমি একজন বৃদ্ধের ঘর করছো? তার নিকট থেকে তালাক নিতে পারলে আমি তোমাকে বিয়ে করবো।
ঘরে ফিরে দাবায়া স্বামী ইবন জুদয়ানকে বললেন: আমি একজন যুবতী নারী, আর তুমি এক বৃদ্ধ। ইবন জুদয়ান বললেন: এ কথা কেন? আমি জানতে পেরেছি, তাওয়াফের সময় হিশাম তোমার সাথে কথা বলেছে। তুমি হিশামকে বিয়ে করবে না- যতক্ষণ তুমি আমার কাছে এ অঙ্গীকার না করছো, আমি তোমাকে তালাক দিচ্ছি না। তোমাকে আরও অঙ্গীকার করতে হবে, যদি তাকে বিয়ে কর তাহলে তুমি আমার এই শর্তগুলি পূরণ করবে: ১. উলঙ্গ হয়ে কাবা তাওয়াফ করবে, ২. এতগুলি উট কুরবানী করবে, ৩. এত পরিমাণ পশমের সূতা কাটবে।
দাবায়া এই শর্তের কথা হিশামকে জানালেন। হিশাম বললেন: প্রথম শর্তটির ব্যাপারে আমি কুরাইশদের সাথে আলোচনা করে কাবার চত্বর সম্পূর্ণ ফাকা করে দেব। তুমি শেষ রাতে অন্ধকারে একাকী উলঙ্গ হয়ে তাওয়াফ সেরে নেবে। কেউ দেখার সুযোগ পাবে না। আর তোমার পক্ষ থেকে উট আমি কুরবানী করে দেব। আর সূতা কাটার ব্যাপারটি, তা এটা কোন ধর্ম নয়। কুরাইশরা এটা তৈরী করেছে। আমার প্রতিবেশী মহিলারা তোমার পক্ষ থেকে এ কাজটি করে দেবে। হিশামের প্রতিশ্রুতি পেয়ে দাবায়া স্বামী ইবন জুদয়ানকে বলেন, আমি তোমার শর্তে রাজী। হিশামকে বিয়ে করলে তোমার এ শর্ত সমূহ পূরণ করবো। এভাবে ইবন জুদয়ানের নিকট থেকে তালাক নিয়ে দাবায়া হিশামকে বিয়ে করেন। হিশাম কুরাইশদের সাথে কথা বলে কাবার চত্তর খালি করে দিলে দাবায়া উলঙ্গ হয়ে কাবা তাওয়াফ করেন। কালবী বলেন: মুত্তালিব ইবন আবী ওয়াদায়া বলেছেন: আমি তখন এক বালক। মসজিদের একটি দরযা দিয়ে উঁকি মেরে দেখছিলাম। দেখলাম, দাবায়া কাপড় খুলে ফেললো। এভাবে এক সপ্তাহ ধরে সে একটি শ্লোক আবৃত্তি করতে করতে তাওয়াফ করলো। অন্য শর্ত দুটিও হিশাম পূরণ করেন। এই হিশামের ঔরষে দাবায়ার গর্ভে জন্ম গ্রহণ করেন সালামা ইবন হিশাম। উত্তরকালে এই সালামা হলেন পরীক্ষিত উত্তম মুসলমান। হিশামের সাথে দাম্পত্য জীবন চলাকালে দাবায়ার পূর্ব স্বামী আবদুল্লাহ ইবন জুদয়ান মারা যান। তার মৃত্যুর খবর শুনে দাবায়া মন্তব্য করেন: তিনি ছিলেন একজন আরব রমণীর এক চমতকার স্বামী। এর কিছুদিন পর হিশাম মারা গেলে দাবায়া বিধবা হন।
পরবর্তীকালে দাবায়া ইসলাম গ্রহণ করেন। এদিকে পুত্র সালামাও বড় হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেছেন। হযরত রাসূলে কারীম সা: সালামার নিকট তার মাকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। সালামা তার মায়ের সাথে পরামর্শ করে তার মধ্যে অনীহার ভাব লক্ষ্য করে রাসূল সা: কে জানান। রাসূল সা: ও প্রস্তাব প্রত্যাহার করে নেন। (ড. হামীদুল্লাহ সম্পাদিত আনসাবুল আশরাফ-১, টীকা নং-৩, পৃ. ৪৬০-৪৬১)।
মক্কায় ইসলামী দাওয়াতের সূচনা পর্বেই সালামা ইসলাম গ্রহণ করেন। হাবশায় হিজরাত করেন। কিছুদিন সেখানে থাকার পর আরও অনেক মুহাজিরদের সাথে তিনিও মক্কায় ফিরে আসেন। অনেকেই আবার হাবশায় ফিরে যান। সালামাও যেতে চান, কিন্তু আবু জাহল তাকে বাধা দেয়। তার উপর অত্যাচার শুরু হয়। তাকে অনাহারে রাখা হয় এবং মারপিটও চলতে থাকে। তবে তাদের সব চেষ্টাই ব্যর্থ হয়। তখন পর্যন্ত ইসলাম তেমন শক্তি অর্জন করতে পারেনি। রাসূল সা: ও কোন রকম সাহায্য করতে সক্ষম ছিলেন না। তবে নামাযের পর সালামা ও তার মত নির্যাতিতদের জন্য এই বলে দুআ করতেন: হে আল্লাহ, ওয়ালীদ ইবন ওয়ালীদ, সালামা ইবন হিশাম ও আয়্যাশ ইবন রাবীয়াকে মক্কার মুশরিকদের কঠোরতা থেকে মুক্তি দাও। ওয়ালীদের জীবনীতে সালামার মুক্তি ও মদীনা হিজরাতের ঘটনা বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে।
তিনি মক্কায় কাফিরদের হাতে বন্দী থাকা অবস্থায় বদর যুদ্ধ শেষ হয়। বদর যুদ্ধের পর, মতান্তরে খন্দক যুদ্ধের পর তিনি মদীনায় আসেন। মদীনায় আসার পর সংঘটিত সকল যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। মুতার যুদ্ধে শত্রু বাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণে যারা ময়দান থেকে পালিয়েছিলেন তাদের মধ্যে তিনিও একজন। এই লজ্জা ও অনুশোচনায় পরবর্তী জীবনে তিনি ঘর থেকে বের হওয়া প্রায় ছেড়ে দেন। উম্মুল মুমিনীন হযরত উম্মু সালামা থেকে ইবন ইসহাক বর্ণনা করেছেন। তিনি সালামা ইবন হিশামের স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করেন, সালামার হয়েছে কি, আমি তাকে রাসূলুল্লাহ সা: ও মুসলমানদের সাথে নামাযের জামায়াতে শামিল হতে দেখিনে কেন? সালামার স্ত্রী বললেন: আল্লাহর কসম, তিনি বের হতেই পারেন না। বের হলেই মানুষ তাকে দেখে চেঁচিয়ে বলতে থাকে-ইয়া ফুররার, ফারারতুম ফী সাবীলিল্লাহ, ওহে পলাতক, আল্লাহর রাস্তা থেকে তোমরা পালিয়েছো। এ কারণে তিনি বাড়ীতেই থাকেন, বাইরে কোথাও যান না। (সীরাতু ইবন হিশাম-২/৩৮২-৮৩)।
হযরত রাসূলে কারীম সা: তাকে ‘কাররার’ বা প্রচণ্ড আক্রমণকারী বলে সম্বোধন করতেন। (আল ইসাবা-২/৬৯)।
হযরত আবু বকর সিদ্দীকের (রা) খিলাফতকালে তিনি শাম বা সিরিয়া অভিযানে অংশগ্রহণ করেন। এই অভিযানের এক পর্যায়ে হযরত উমারের খিলাফতকালে হিজরী ১৪ সনের মুহাররম মাসে সংঘটিত ‘মারজে সফর’ বা ‘মারজে রোম’ নামক যুদ্ধে শাহাদত বরণ করেন। তবে উরওয়া মূসা ইবন উকবা, আবু যারয়া আদ দিমাশকীর মতে তিনি আজনাদাইন যুদ্ধে শহীদ হন। (আল ইসাবা-২৬৯)।
সালামার মা দাবায়া একটি কবিতায় বলেছেন: হে সম্মানিত কাবার প্রভূ: কোন দুশ্চিন্তা নেই। সালামাকে প্রতিটি শত্রুর বিরুদ্ধে বিজয়ী কর। অনিশ্চিত কর্মকান্ডে তার দুটি হাত, যার একটি প্রকাশ পায় এবং অন্যটি দানশীল। (আনসাবুল আশরাফ-১/২০৮)।