আবু বারযাহর আসল নামের ব্যাপারে রিজাল শাস্ত্রবিদদের যথেষ্ট মতপার্থক্য আছে। সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য মতানুসারে নাদলা ইবন উবাইদ তার নাম এবং আবু বারযাহ কুনিয়াত বা উপনাম। (আল ইসাবা-৪/১৯)
মক্কায় ইসলামী দাওয়াতের সূচনা পর্বেই তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। মুসলমান হওয়ার পর কাফিরদের সাথে যত সংঘর্ষ হয়েছে তার সবগুলিতে তিনি হযরত রাসূলে কারীমের সা: সাথে ছিলেন। মক্কা বিজয়ের দিন রাসূলে কারীম সা: তার চরম শত্রুকেও ক্ষমা করে দেন। তবে শত্রুতা ও বিদ্রোহের সীমা লংঘনকারী কতিপয় দুষ্কৃতিকারীকে সেদিন হত্যা করা হয়েছিল। আবদুর রহমান ইবন খাতাল ছিল এমনি একজন। এ ব্যক্তি প্রথমে ইসলাম গ্রহণ করেছিল। কিন্তু তার এক মুসলমান দাসকে হত্যা করে ইসলামী দণ্ড ‘কিসাস’ থেকে বাঁচার জন্য ‘মুরতাদ’ (ইসলাম ত্যাগ) হয়ে মক্কায় পালিয়ে যায়। তার ছিল দুটি দাসী। তারা মক্কার বাজারে মুহাম্মাদের সা: নিন্দাসূচক গীত গেয়ে বেড়াতো। মক্কা বিজয়ের দিন কোন উপায় না দেখে নরাধম ইবন খাতাল নিরাপত্তার আশায় কাবার গিলাফ আঁকড়ে ধরে পড়ে থাকলো। সাহাবীরা রাসূল সা: কে বললেন: ইবন খাতাল কাবার গিলাফের আশ্রয়ে আছে। রাসূল সা: তাকে হত্যার নির্দেশ দিলেন। এ নির্দেশ লাভের সাথে সাথে আবু বারযাহ ছুটে গিয়ে তাকে হত্যা করেন। (আবু দাউদ, কিতাবুল জিহাদ; সীরাতু ইবন হিশাম-২/৪১০)
হযরত রাসূলে পাকের সা: জীবদ্দশা পর্যন্ত আবু বারযাহ মদীনায় বসবাসরত ছিলেন। হযরত উমারের (রা) খিলাফতকালে তিনি বসরার বাসিন্দা হন। সিফফীন যুদ্ধে হযরত আলীর (রা) পক্ষে এবং নাহরাওয়ানে খারেজীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। খুরাসান অভিযানে তিনি ছিলেন একজন মুজাহিদ।
হযরত আবু বারযাহর (রা) মৃত্যুর সময়কাল সম্পর্কে মতপার্থক্য আছে। কারও মতে হিজরী ৬০, আবার কারও মতে হিজরী ৬৫ সনে তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন। দ্বিতীয় মতটি অধিকতর সঠিক বলে মনে হয়। কারণ, মারওয়ান ও আবদুল্লাহ ইবন যুবাইরের (রা) সংঘর্ষের সময় পর্যন্ত তিনি জীবিত ছিলেন এবং তিনি বলতেন, তারা সব দুনিয়ার ঝগড়া বিবাদ করছে। (হায়াতুস সাহাবা-২/৪০৭)। তিনি মৃত্যুকালে একমাত্র ছেলে মুগীরাকে রেখে যান।
হযরত আবু বারযাহ (রা) হযরত রাসূলে কারীম সা: এর দীর্ঘ সাহচর্যের সুযোগ পেয়েছিলেন। এ কারণে রাসূলুল্লাহ সা: হাদীসের একটি নির্ভরযোগ্য সংখ্যা তিনি স্মৃতিতে সংরক্ষণ করেছিলেন। তার বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা ৬৪। তার মধ্যে ২৭টি মুত্তাফাক আলাইহি। দুটি বুখারী ও চারটি মুসলিম এককভাবে বর্ণনা করেছেন।
হযরত আবু বারযাহর (রা) স্বভাবে যুহদের একটা ভাব বিদ্যমান ছিল। তিনি দামী কাপড় পরতেন না এবং ঘোড়ায়ও সওয়ার হতেন না। গেরুয়া রঙ্গের দু খানি কাপড় দিয়ে সতর ঢেকে চলতেন। তারই এক সমসাময়িক সাহাবী আয়িজ ইবন উমার। তিনি যেমন মূল্যবান কাপড় পরতেন তেমনি ঘোড়ায়ও সওয়ার হতেন। এক ব্যক্তি তাদের দুজনের মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টির উদ্দেশ্যে হযরত আয়িজের নিকট এসে বললো: আপনি আবু বারযাহকে দেখুন, তিনি পোশাক আশাকে আপনার বিরোধিতা করেন। আপনি দামী ‘খুয’ কাপড় পরেন, ঘোড়ায় চড়েন। আর তিনি এ দুটি জিনিসই পরিহার করেন। কিন্তু সাহাবীদের ভাতৃত্ব ছিল বাহ্যিক পোশাক আশাক ও চালচলন থেকেও অতি গভীর ও দৃঢ়। হযরত আয়িজ লোকটিকে জবাব দেন: আল্লাহ আবু বারযাহর ওপর রহম করুন। আজ আমাদের মধ্যে তার সমপর্যায়ের আর কে আছে? লোকটি হতাশ হয়ে সেখান থেকে আবু বারযাহর নিকট গেল এবং তাকে বললো: আপনি আয়িজকে একটু দেখুন। আপনার চালচলন তার পসন্দ নয়। তিনি ঘোড়ায় সোয়ার হয়ে ঘুরে বেড়ান, মূল্যবান ‘খুয’ কাপড় তার দেহে শোভা পায়। কিন্তু লোকটি এখানেও একই জবাব পেল। আবু বারযাহ লোকটিকে বললেন: আল্লাহ আয়িজের ওপর রহম করুন। আমাদের মধ্যে তার সমমর্যাদার আর কে আছে?
একবার এক ব্যক্তি হযরত আবু বকর সিদ্দীককে (রা) একটা শক্ত কথা বলে ফেলে। সংগে সংগে আবু বারযাহ বলে উঠলেন: আমি কি তার গর্দান উড়িয়ে দেব? আবু বকর (রা) তাকে ধমক দিয়ে বললেন: রাসূলুল্লাহর সা: পর আর কারও ক্ষেত্রে এতটুকু অপরাধের শাস্তি বৈধ নয়। (কানযুল উম্মাল-২/১৬১, হায়াতুস সাহাবা-২/৬৩৮)
গরীব দু:খীর সেবা করা ছিল আবু বারযাহর বিশেষ বৈশিষ্ট্য। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তিনি ফকীর মিসকীনকে আহার করাতেন। হাসান ইবন হাকীম তার মা নিকট থেকে বর্ণনা করেছেন।
আবু বারযাহ বিধবা, ইয়াতিম ও মিসকীনদের সকালে এবং সন্ধ্যায় ‘সারীদ’ (আরবদের এক প্রকার প্রিয় খাদ্য) আহার করাতেন। (হায়াতুস সাহাবা-২/১৯৪-৯৫)।
হযরত রাসূলে কারীম সা: সম্পর্কে কোন প্রকার বিদ্রুপ বা হাসি কৌতুক তিনি বরদাশত করতে পারতেন না। উবাইদুল্লাহ ইবন যিয়াদের ‘হাউজে কাউসার’ সম্পর্কে কিছু জানার বাসনা হলো। তিনি লোকদের কাছে জিজ্ঞেস করলেন ‘হাউজে কাউসার’ সম্পর্কে কে বলতে পারবে? লোকেরা আবু বারযাহর (রা) কথা বললো। উবাইদুল্লাহ তাকে ডেকে পাঠালেন। তিনি গেলেন। তাকে আসতে দেখে উবাইদুল্লাহ বিদ্রুপের সুরে বললো: এই সেই তোমাদের মুহাম্মাদী? অত্যন্ত ক্ষুব্ধভাবে আবু বারযাহ জবাব দিলেন, আল্লাহর শুকরিয়া! আমি এমন এক যুগে বেঁচে আছি যখন সাহাবিয়্যাতের (সাহচর্যের) মর্যাদাকে হেয় চোখে দেখা হয়। এ কথা বলতে বলতে অত্যন্ত রুষ্টভাবে তিনি আসন গ্রহণ করেন। উবাইদুল্লাহ প্রশ্নটি উত্থাপন করলেন, জবাবে আবু বারযাহ বললেন: যে ব্যক্তি হাউজে কাওসার অস্বীকার করবে সে তার ধারে কাছেও যেতে পারবে না এবং আল্লাহ তাকে তার থেকে পানও করাবেন না।’ এ কথা বলে তিনি উঠে চলে আসেন।
হযরত আবু বারযাহ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন: এক যুদ্ধে (মতান্তরে খাইবার) আমরা মুশরিক বাহিনীকে হামলা করে তাদের রুটি তৈরীর সাজ সরঞ্জাম থেকে দূরে তাড়িয়ে দেই। তারপর আমরা সেগুলি দখল করে খেতে শুরু করি। জাহিলী যুগে আমরা শুনতাম, যারা সাদা রুটি খায় তারা মোটা হয়ে যায়। তাদের পরিত্যক্ত রুটি খাওয়ার পর আমাদের কেউ কেউ তার নিজের কাঁধের দিকে তাকিয়ে দেখতে থাকে যে সে মোটা হয়েছে কি না। (হায়াতুস সাহাবা-১/৩২৩) এ ঘটনা দ্বারা বুঝা যায় সাহাবায়ে কিরাম সাদা মিহি আটা সাধারণত ব্যবহার করতেন না।