নাম বুরাইদাহ, কুনিয়াত বা ডাকনাম আবু আবদিল্লাহ। পিতার নাম হুসাইব ইবন আবদিল্লাহ। বনু আসলাম গোত্রের সরদার। রাসুল সা: হিজরাতের সময় বুরাইদাহ ইসলাম গ্রহণ করেন। হযরত রাসূলে কারীম সা: মক্কা থেকে মদীনার উদ্দেশ্যে যাত্রা করে ‘গামীম’ নামক স্থানে পৌঁছলে বুরাইদাহ রাসূলুল্লাহর খিদমতে হাজির হন। রাসূল সা: তার সামনে ইসলামের দাওয়াত পেশ করেন এবং তিনি বিনা বাক্য ব্যয়ে তা কবুল করেন। উল্লেখ্য যে, এই ‘গামীম’ মক্কা থেকে দুই মনযিল দূরে অবস্থিত। এখানে তার সাথে বনু আসলামের আরও আশি ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করে। রাসূল সা: সেখানে ইশার নামায আদায় করেন এবং বুরাইদাহ ও তার সঙ্গীরা রাসূল সা: পেছনে ইকতিদা করে নামায আদায় করেন। (হায়াতুস সাহাবা-১/৩) ইসলাম গ্রহণের পর তিনি নিজ গোত্রে অবস্থান করতে থাকেন এবং বদর ও উহুদ যুদ্ধের পর মদীনায় আসেন। অবশ্য তার ইসলাম গ্রহণ ও মদীনায় আসার সময়কাল সম্পর্কে ইতিহাস ভিন্নমতও লক্ষ্য করা যায়।
হিজরী ষষ্ঠ সনের পূর্বে তিনি মদীনায় হিজরাত করেন এবং সর্বপ্রথম হুদাইবিয়ার সন্ধিতে অংশগ্রহণ করে ‘বাইয়াতে রিদওয়ানের’ সৌভাগ্য অর্জন করেন। হিজরী ৭ম সনে খাইবার অভিযানে অংশগ্রহণ করেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বর্ণনা করেন: আমরা খাইবার অবরোধ করলাম। প্রথম দিন ঝান্ডা নিলেন আবু বকর; কিন্তু জয় হলো না। দ্বিতীয় দিনও একই অবস্থা। লোকেরা হতাশ হয়ে পড়ছিল। রাসূল সা: তখন বললেন: আগামী দিন আমি এমন এক ব্যক্তির হাতে ঝান্ডা তুলে দেব যে কি না আল্লাহ ও রাসূলের অতি প্রিয়। আগামী কালই বিষয়টি ফায়সালা হবে এ কথা চিন্তা করে লোকেরা খুব খুশী হলো। পরদিন প্রত্যুষে রাসূল সা: ফজরের নামায আদায়ের পর ঝান্ডা আনার নির্দেশ দিলেন। লোকেরা ছিল কাতারবন্দী। তিনি আলীকে ডাকলেন এবং তার হাতে ঝান্ডাটি তুলে দিলেন। এই দিন আলীর হাতে খাইবার জয় হয়।
হিজরী ৮ম সনে রাসূল সা: মক্কা অভিযানে বুরাইদাহ সংগী ছিলেন এবং একটি বাহিনীর পতাকা হাতে নিয়ে মক্কায় প্রবেশ করেন। (হায়াতুস সাহাব-১/১৬৭)।
এ প্রসঙ্গে তিনি বর্ণনা করেন যে, মক্কা বিজয়ের দিন তিন এক ওজুতে কয়েক ওয়াক্তের নামায আদায় করেন।
তাবুক যুদ্ধের সময় হযরত রাসূলে কারীম সা: মক্কা সহ বিভিন্ন অঞ্চলের লোকদের যুদ্ধে যোগদানে উতসাহিত করার জন্য বিভিন্ন গোত্রের নিকট লোক পাঠান। এ সময় তিনি বুরাইদাকে আসলাম গোত্রের নিকট পাঠান এবং তাকে নির্দেশ দেন তিনি যেন মক্কা মদীনার মধ্যবর্তী স্থান ‘ফুরআ’ নামক স্থানে উপস্থিত হন। (তারীখে ইবন আসাকির-১/১১০)।
মক্কা বিজয়ের পর হযরত রাসূলে কারীম সা: হযরত খালিদ ইবনুল ওয়ালীদের নেতৃত্বে একটি বাহিনী ইয়ামনে পাঠান। বুরাইদাহও এ বাহিনীর একজন সদস্য ছিলেন। পরে হযরত আলীর নেতৃত্বে অন্য একটি বাহিনী সেখানো পাঠানো হয় এবং গোটা বাহিনীর নেতৃত্ব আলী (রা) এর হাতে অর্পণ করা হয়। যুদ্ধ শেষে হযরত আলী (রা) গণীমতের মাল থেকে একটি দাসী নিজে গ্রহণ করেন। বুরাইদাহ এটা মেনে নিতে পারেননি। মদীনায় ফিরে বিষয়টি তিনি রাসূল সা: নিকট উত্থাপন করেন। সবকিছু শুনে রাসূল সা: বলেন: বুরাইদাহ, তোমার কি আলীর প্রতি কোন বিদ্বেষ আছে? বুরাইদাহ অস্বীকার করেন। তখন রাসূল করীম সা: বলেন: আলীর প্রতি মনে কোন রকম হিংসা রেখ না। গণীমতের এক পঞ্চমাংশ থেকে সে এরচেয়েও বেশি পায়। (সহীহুল বুখারী- বাবু বা’সু আলী ইলাল ইয়ামন)।
অন্য একটি বর্ণনায় এসেছে, বুরাইদাহর বক্তব্য শুনে রাসুল সা: এর চেহারা মুবারকের রং পাল্টে যায়। তিনি বলেন: বুরাইদাহ, মুমিনদের ওপর তাদের নিজ সত্তা অপেক্ষাও কি কি আমার অধিকার বেশি নয়? বুরাইদাহ জবাব দিলেন: হাঁ, ইয়া রাসূলুল্লাহ! রাসূল সা: বললেন: আমি যার মাওলা (মনিব/ দাস) আলীও তার মাওলা। বুরাইদাহ বলেন: রাসূলুল্লাহর সা: পবিত্র যবান থেকে এ বাণী শোনারপর আলীর প্রতি আমার সকল অভিযোগ দূর হয়ে যায়। আর সেই দিন থেকে তার প্রতি আমার অন্তরে যে গভীর মুহাব্বাতের সৃষ্টি হয় তা আর কারও প্রতি কখনো হয়নি। (মুসনাদে ইমাম আহমাদ ইবন হাম্বল)।
হযরত রাসূলে কারীম সা: জীবনের শেষ অধ্যায়ে উসামাকে সিরিয়ায় একটি অভিযান পরিচালনার নির্দেশ দেন। এ বাহিনীর পতাকাবাহী ছিলেন বুরাইদাহ। উসামা মদীনা থেকে বের হয়ে মদীনার উপকন্ঠে শিবির স্থাপন করে যাত্রার তোড়জোড় করছেন, এমন সময় রাসূলুল্লাহর সা: অন্তিম অবস্থার খবর পেলেন। তিনি যাত্রা স্থগিত করে ছুটে এলেন রাসূলুল্লাহর সা: শয্যা পাশে। অন্যদের সাথে বুরাইদাহও ঝান্ডা হাতে মদীনায় ফিরে এলেন এবং রাসূলুল্লাহর সা: ঘরের দরজার সামনে তা গেঁড়ে দিলেন। রাসূল সা: তিরোধানের পর হযরত আবু বকর খিলাফতের দায়িত্বভার গ্রহণ করলেন। বুরাইদাহ খলীফার নির্দেশে আবার ঝান্ডা তুলে নিয়ে সিরিয়া যান এবং যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। যুদ্ধ শেষে ঝান্ডা হাতে আবার মদীনায় ফিরে এলেন এবং উসামার বাড়ীর সামনে ঝান্ডাটি গেড়ে দিলেন। উসামার জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ঝান্ডাটি সেখানে ছিল। (হায়াতুস সাহাবা-১/৪২৫-২৬)
হযরত বুরাইদাহ ইসলাম গ্রহণের পর রাসূলুল্লাহর সা: জীবদ্দশায় যতগুলি যুদ্ধ হয়েছে সবগুলিতে অংশগ্রহণ করেন। সহীহাইনে তার থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি রাসূলুল্লাহর সা: মোট ১৬ (ষোল)টি যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন। (আল ইসাবা-১১৪৬, তাবাকাতে ইবন সা’দ-মাগাযী অধ্যায়-১৩৬)।
হযরত রাসূলে কারীমের জীবদ্দশায় বুরাইদাহ মদীনার বাসিন্দা ছিলেন। খলীফা উমারের (রা) খিলাফতকালে বসরা শহরের পত্তন হলে তিনি সেখানকার স্থায়ী বাসিন্দা হন। হযরত বুরাইদাহর শিরা উপশিরায় জিহাদের খুন টগবগ করতো। লোকদের তিনি বলতেন: জীবনের মজা তো ঘোড়া দাবড়ানোর মধ্যেই। এই আবেগ ও উচ্ছাসের কারণে খলীফাদের যুগেও তিনি বিভিন্ন অভিযানে সৈনিক হিসাবে ঘর থেকে বের হয়ে পড়েন। হযরত উসমানের খিলাফতকালে খুরাসান অভিযানে অংশ নিয়ে মারভে চলে যান এবং সেখানেই থেকে যান। হযরত বুরাইদাহ একজন বীর মুজাহিদ হওয়া সত্ত্বেও খলীফাদের যুগে মুসলমানদের পারষ্পরিক ঝগড়ায় তার তরবারি সব সময় কোষবদ্ধ থাকে। তার জীবদ্দশায় দ্বিতীয় ও তৃতীয় খলীফার যুগে যত গৃহযুদ্ধ হয়েছে তার একটিতেও তিনি অংশগ্রহণ করেননি। এমনকি অত্যধিক সতর্কতার কারণে দুপক্ষের যারা সেই দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন তাদের সম্পর্কেও কোন মতামত ব্যক্ত করতেন না। এ প্রসঙ্গে বনী বকর ইবন ওয়াযিলের এক ব্যক্তি বলেন: একবার আমি বুরাইদাহ আল আসলামীর সাথে সিজিস্তানে ছিলাম। একদিন আমি তার কাছে আলী, উসমান, তালহা ও যুবাইর সম্পর্কে তার মতামত জানার জন্য তাদের প্রসঙ্গ উঠালাম। বুরাইদাহ সংগে সংগে কিবলার দিকে মুখ করে বসে দুহাত তুলে দুআ করতে শুরু করেন: হে আল্লাহ, তুমি উসমানকে ক্ষমা করে দাও। তুমি আলী, তালহা, যুবাইরওকে মাফ করে দাও। বর্ণনাকারী বলেন: অত:পর তিনি আমার দিকে ফিরে বলেন, তুমি কি আমার হত্যাকারী হতে চাও? আমি বললাম: আমি আপনার হত্যাকারী হতে যাব কেন? তবে আপনার কাছে এমনটি চেয়েছি। বুরাইদাহ বললেন: তারা ছিলেন এমন একদল লোক যাদের সম্পর্কে আল্লাহর ইচ্ছা পূর্বেই স্থির হয়ে আছে। তিনি চাইলে তাদের ক্ষমা করে দিতে পারেন অথবা শাস্তি দিতে পারেন। তাদের হিসাব নিকাশের দায়িত্ব আল্লাহর। (ইবন সা’দ-৪/১৭৬, হায়াতুস সাহাবা-৩/৩৮৮)
একবার তিনি হযরত আমীরে মুআবিয়ার (রা) কাছে যান। মুআবিয়া (রা) তখন একজন লোকের সাথে বসে কথা বলছিলেন। বুরাইদাহ বললেন: মুআবিয়া, আমাকেও একটু কথা বলার সুযোগ দেবেন? মুআবিয়া বললেন: হাঁ, তিনি মনে করেছিলেন বুরাইদাহ হয়ত অন্যদের মতই কিছু বলবেন। কিন্তু বুরাইদাহ বললেন: আমি রাসুলুল্লাহকে সা: বলতে শুনেছি: ‘আমি আশা করি কিয়ামতের দিন জগতের সকল গাছ, পাথর ও বালুর সমপরিমাণ মানুষের জন্য সুপারিশ করবো। মুআবিয়া, আপনি এ সুপারিশের আশা করেন, আর আলী তার আশা করতে পারে না? (মুসনাদে ইমাম আহমাদ-৪/৩৪৭, হায়াতুস সাহাবা-৩/৪৯) সম্ভবত প্রথম ব্যক্তি হযরত আলীর সমালোচনা করছিল এবং মুআবিয়া (রা) বুরাইদাহর মুখ থেকে তাই শোনার আশা করছিলেন। সত্য বলা ছিল তার বিশেষ গুণ। এ ব্যাপারে তিনি বিরাট ব্যক্তিত্বকেও ভয় করতেন না।
সাহাবা সমাজের মধ্যে বুরাইদাহর ছিল বিশেষ সম্মান ও মর্যাদা। তিনি রাসূলুল্লাহর সা: বহু হাদীস স্মৃতিতে সংরক্ষণ করেন। তার বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা প্রায় ১৬৪। তার মধ্যে মুত্তাফাক আলাইহি, দুটি বুখারী ও ১১টি মুসলিম এককভাবে বর্ণনা করেছেন। তার বর্ণিত হাদীসগুলির সবই সরাসরি রাসূলুল্লাহর সা: যবানীতে। তার ছাত্রদের মধ্যে পুত্র আবদুল্লাহ ও সুলাইমান, এবং অন্যদের মধ্যে আবদুল্লাহ ইবন খাযায়ী, শা’বী ও মালীহ ইবন উসামা বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
হযরত রাসূলে কারীম সা: তার সাথে অত্যন্ত সহজ ও সাধারণ ভাবে মিশতেন। একবার বুরাইদাহ কোথাও যাচ্ছেন, পথে রাসূল সা: এর সাথে দেখা। রাসূল সা: বুরাইদাহর হাতে হাত রেখে হাঁটতে শুরু করেন।
বুরাইদাহ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন: আমরা রাসূল সা: এর নিকট বসা ছিলাম, এমন সময় কুরাইশ বংশের এক ব্যক্তি আসলো। রাসূল সা: তাকে ডেকে কাছে বসালেন। লোকটি যখন যাওয়ার জন্য উঠলো, রাসূল সা: আমাকে বললেন: বুরাইদাহ, তুমি কি এ লোকটিকে চেন? বললাম: হাঁ, বংশ মর্যাদার দিক দিয়ে সে কুরাইশদের মধ্যে মধ্যম শ্রেণীর। তবে সে সর্বাধিক অর্থ সম্পদের অধিকারী। কথাটি আমি তিনবার বললাম। তারপর আমি বললাম: ইয়া রাসূলুল্লাহ, তার সম্পর্কে আমার যা জানা আছে তাই আপনাকে জানালাম। তবে আপনি আমার চেয়ে বেশি জানেন। রাসূল সা: বললেন: কিয়ামতের দিন তার এই বৈশিষ্ট্য আল্লাহর কাছে কোন গুরুত্ববহ হবে না।
রাসূল সা: মুখ থেকে তিনি একবার যা শুনতেন তা হুবহু পালন করার চেষ্ঠা করতেন। একবার তিনি রাসূল সা: কাছে বসে ছিলেন। রাসূল সা: বললেন: আমার উম্মাতকে ঢালের ন্যায় চওড়া ও ছোট ছোট চোখ বিশিষ্ট জাতির লোকেরা তিনবার তাড়াবে। এমনকি তাড়াতে তাড়াতে ‘জাযীরাতুল আরবের’ মধ্যে ঘিরে ফেলবে। তাদের প্রথম আক্রমণে যারা পালাবে তারা বেঁচে যাবে। দ্বিতীয় আক্রমণে কিছু বাঁচবে, কিছু মারা পড়বে! কিন্তু তৃতীয় আক্রমণে সবাই মারা পড়বে। লোকেরা জিজ্ঞেস করলো: ইয়া রাসূলুল্লাহ! তারা কারা? বললেন: তুর্কী। তিনি আরও বললেন: সেই সত্তার কসম যার হাতে আমার জীবন! সেই লোকেরা তাদের ঘোড়া সমূহ মুসলমানদের মসজিদের খুঁটির সাথে বাঁধবে।
এই ভয়াবহ ভবিষ্যদ্বাণীর পর বুরাইদাহ সর্বদা দুই তিনটি উট, সফরের পাথেয় ও পানি পান করার একটি পাত্র প্রস্তুত রাখতেন। যাতে যখনই এ সময় আসুক, এ আযাব থেকে পালাতে পারেন। (মুসনাদে ইমাম আহমাদ-৫/৩৪৭)।
হযরত বুরাইদাহ ছিলেন আসলাম গোত্রের সরদার। হযরত রাবীয়া আল আসলামী ছিলেন রাসূলুল্লাহর সা: এক সহায় সম্বলহীন খাদেম। তিনি বিয়ে করলে, রাসূল সা: বুরাইদাহকে নির্দেশ দিলেন তার মোহর আদায়ের ব্যবস্থা করতে। বুরাইদাহ চাঁদা উঠিয়ে সে নির্দেশ পালন করেন।
তিনি ইয়াযীদ ইবন মুআবিয়ার খিলাফতকালে হিজরী ৬৩ সনে পারস্যের মারভে ইনতিকাল করেন। তিনি আবদুল্লাহ ও সুলাইমান নামে দু ছেলে রেখে যান।