আসমা’ বিনত আবী বকর (রা)

হযরত রাসূলে কারীমের (সা) জীবনকালের অন্তরঙ্গ বন্ধু, ওফাতের পর তাঁর প্রথম খলীফা হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা) হযরত আসমার (রা) পিতা। মাতা কুতাইলা বিনত ‘আবদিল ‘উযযা। এই ‘আবদুল ‘উযযা ছিলেন কুরায়শ বংশের একজন বিখ্যাত সম্মানীয় নেতা। আবূ বকরের (রা) সম্মানিত পিতা আবূ কুহাফা বা আবূ ‘আতীক তাঁর পিতামহ। ‘আবদুল্লাহ ইবন আবী বকর তাঁর সহোদর ভাই ও উম্মুল মু‘মিনীন হযরত ‘আয়িশা (রা) সৎ বোন। রাসূলুল্লাহর (সা) হাওয়ারী তথা বিশেষ সাহায্যকারী যুবায়র ইবনুল ‘আওয়াম (রা) স্বামী এবং সত্য ও ন্যায়ের পথে শহীদ হযরত ‘আবদুল্লাহর ইবন যুবায়র (রা) তাঁর পুত্র। হিজরাতের ২৭ (সাতাশ) বছর পূর্বে মক্কায় জন্মগ্রহণ করেন। তখন তাঁর পিতা হযরত আবূ বকর সিদ্দীকের (রা) বয়স বিশ বছরের কিছু বেশী।[তাবাকাতু ইবন সা‘দ-৮/৪৪৯; উসুদুল গাবা-৫/৩৭২; সিয়ারু আ‘লাম আন-নুবালা-২/২৯৭] এ হলো হযরত আসমা‘ বিনত আবী বকরের সংক্ষিপ্ত পরিচয়। তাঁর আরো কিছু পরিচয় আছে। স্বামী যুবায়র ইবন ‘আওয়াম (রা) দুনিয়াতে জীবদ্দশায় জান্নাতের সুসংবাদ প্রাপ্ত দশজনের অন্যতম, আর তাঁর শাশুড়ী হলেন রাসূলুল্লাহর (সা) মুহারামা ফুফু হযরত সাফিয়্যা বিনত আবদিল মুত্তালিব (রা)। উল্লেখ্য যে, তিনি আবূ বকর সিদ্দীকের (রা) জ্যেষ্ঠ সন্তান এবং ‘আয়িশার (রা) চেয়ে দশ বছরের কিছু বেশী দিনের বড়।[সিয়ারু আ‘লাম আন-নুবালা-২/২৮৮] বংশ ও ইসলাম উভয় দিক দিয়ে এ মহিলা সাহাবী উঁচু সম্মান ও মর্যাদার অধিকারিণী ছিলেন। বংশগত দিক দিয়ে মক্কার কুরায়শ খান্দানের তাইম শাখার সন্তান। অন্যদিকে তাঁর পিতা, পিতামহ, ভগ্রিন, শাশুড়ী, পুত্র সকলেই ছিলেন রাসূলুল্লাহর (সা) বিশিষ্ট সাহাবী। একজন সুসলমানের এর চাইতে বেশী সম্মান, মর্যাদা ও গৌরবের বিষয় কী হতে পারে?

হযরত রাসূলে কারীম (সা) মক্কায় ইসলামী দা‘ওয়াত ও তাবলীগের কাজ শুরু করার পর তথাকার পৌত্তলিক প্রতিপক্ষ তাঁর উপর অত্যাচর-উৎপীড়ন আরম্ভ করে। দিনে দিনে এর মাত্রা বৃদ্ধি পেতে থাকে। এক পর্যায়ে তারা রাসূলকে (সা) হত্যার সিদ্ধান্ত নেয়। তখন তিনি মক্কা ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেন। সে সময় পর্যন্ত মক্কায় যাঁরা ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন আবূ বকর (রা) তাদের অন্যতম। তিনি রাসূলুল্লাহর (সা) অতি বিশ্বস্ত ঘনিষ্টজন ছিলেন। একদিন রাতের বেলা সকলের অগোচরে চুপে চুপে আবূ বকরকে (রা) সঙ্গে করে রাসূল (সা) মক্কা থেকে বের হন এবং মক্কার উপকণ্ঠে ‘ছূর’ পর্বতের একটি গুহায় আশ্রয় নেন। এজন্য আবূ বকরকে (রা) ‘রফীকুল গার’ বা গুহার বন্ধু বলা হয়। মক্কার পৌত্তলিকরা তাঁদের খোঁজে পর্বতের এ গুহার মুখ পর্যন্ত উপস্থিত হয়, কিন্তু আল্লাহ তাঁর প্রিয় নবীকে (সা) বিশেষ ব্যবস্থায় রক্ষা করেন। এ সময় গোপনে যাঁরা তাঁদের সংগে যোগাযোগ রক্ষা ও সাহায্য করতেন হযরত আসমা (রা) তাঁদের অন্যতম। তিনি প্রতিদিন রাতের অন্ধকারে একাকী বাড়ী থেকে খাবার নিয়ে গুহায় যেতেন এবং তাঁদেরকে আহার করিয়ে আবার ফিরে আসতেন।

হযরত আসমার (রা) ভাই ‘আবদুল্লাহ (রা) যিনি তখনও ইসলাম গ্রহণ করেননি, সারাদিন মক্কার এখানে-ওখানে ঘোরাঘুরি করে পৌত্তলিকদের পরামর্শ, উদ্দেশ্য সম্পর্কে অবগত হতেন এবং রাতের আঁধারে তা রাসূলুল্লাহকে (সা) জানিয়ে আসতেন। হযরত আবূ বকর সিদ্দীকের (রা) বিশ্বস্ত রাখালের নাম ছিল ‘আমির। তিনি “ছূর” পর্বতের আশেপাশে ছাগল চরাতেন এবং পাল নিয়ে গুহার মুখে চলে যেতেন এবং দুধ দুইয়ে তাঁদেরকে দিয়ে আসতেন। আর এই ছাগলের পাল নিয়ে যাওয়াতে আসমা (রা) ও আবদুল্লাহর (রা) যাওয়া-আসার পদচিহ্ন মুছে যেত। ফলে পৌত্তলিকরা কোনভাবেই সন্ধান পায়নি।

মক্কার পৌত্তলিকরা আপ্রাণ চেষ্টা করেও যখন তাঁদের কোন খোঁজ পেল না তখন ঘোষণা করে দিল যে, কেউ তাঁদের সন্ধান দিতে পারলে একশো উট পুরস্কার দেওয়া হবে। এমতাবস্থায় তৃতীয় রাতে হযরত আসমা‘ তাঁদের জন্য খাবার নিয়ে গেলে রাসূল (সা) বললেন, তুমি ফিরে গিয়ে ‘আলীকে (রা) বলবে, সে যেন আগামী কাল রাতে তিনটি উট এবং একজন পথ প্রদর্শক নিয়ে এই গুহায় আসে। নির্দেশমত ‘আলী (রা) তিনটি উট ও একজন পথপ্রদর্শক নিয়ে হাজির হন। আর হযরত আসমা‘ (রা) তাঁদের দুই-তিন দিনের পাথেয় সামগ্রী নিয়ে উপস্থিত হন। রাসূল (সা) দ্রুত যাত্রার প্রস্তুতি নিতে বলেন। পাথেয় সামগ্রীর পটলার ও পানির মশকের মুখ বাঁধার প্রয়োজন দেখা দিল। তাড়াহুড়োর মধ্যে হাতের কাছে কোন রশি পাওয়অ গেল না। তখন আসমা’ (রা) নিজের ‘নিতাক’ বা কোমর বন্ধনী খুলে দুই টুকরো করেন। একটি দিয়ে পাথেয় সামগ্রী ও অন্যটি দিয়ে মশকের মুখ বাঁধেন। তা দেখে রাসূলের মুখ থেকে উচ্চারিত হয় : (আরবী**********)

‘আল্লাহ যেন এই একটি ‘নিতাকের’ বিনিময়ে জান্নাতে তোমাকে দুইটি ‘নিতাক’ দান করেন।’

এভাবে তিনি ‘জাতুন নিতাকাইন’ (দুইটি কোমর বন্ধনীর অধিকারিণী) উপাধি লাভ করেন।[তাবাকাত-৮/৪৫০; আল-ইসতী‘আব-৪/২২৯; উসুদুল গাবা-৫/৩৭২ (৬৬৯৮); আল-বায়হাকী, দালায়িল আন-নুবুওয়াহ্-২/৪৭২;  তাহযীবুল আসমা’ ওয়াল লুগাত-২/৫৯৭]  রাসূলুল্লাহর  (সা) পবিত্র মুখ থেকে উচ্চারিত এ উপাধিটি আল্লাহ কবুল করেন। আর তাই আজ  প্রায় দেড় হাজার  বঝর পরেও তিনি বিশ্ববাসীর নিকট এ উপাধিতে প্রসিদ্ধ হয়ে আছেন।

আসমার ‘যাতুন নিকাতাইন’ উপাধি লাভের কারণ সম্পর্কে আরো কয়েকটি মত  আছে। কেউ  বলেছেন, তিনি একটি কোমর বন্ধনীর উপর আরেকটি কোমরবন্ধনী বাঁধতেন, তাই এ উপাধি লাভ করেছেন। কেউ  বলেছেন, তাঁর দুইটি নিতাক বা কোমরবন্ধনী ছিল। একটি কোমরে বাঁধতেন,  আর অন্যটি দ্বারা রাসূলুল্লাহর (সা) প্রয়োজনীয় আহার্য সামগ্রী  বেঁধে গুহায় নিয়ে যেতেন। তাই তিনি এই উপাধি পেয়েছেন। উল্লেখ্য যে, কোমরবন্ধনী বাঁধা আরব  নারীদের সাধারণ অভ্যাস।[নিসা’ মিন ‘আসর আন-নুবুওয়াহ্ -২৩৮, টীকা-১]

ইবন হাজার (র) বলেন, তিনি তাঁর নিতাকটি ছিঁড়ে দু‘টুকরো করেন। একটি দিয়ে রাসূলুল্লাহ (সা) ও আবূ বকরের (রা) পাথেয় বাঁধেন, আর অন্যটি দ্বারা নিজের কোমর  বন্ধনীর কাজ চালান। আর সেখান থেকেই তাকে বলা হতে থাকে ‘যাতুন নিতাক’ বা  ‘যাতুন নিতাকাইন’ অর্থাৎ একটি কোমর  বন্ধনী বা দু‘টি কোমর বন্ধনীর অধিকারিণী।[বানাত আস-সাহাবা -৫০]

‘নিতাক’ –এর এইয়টনাটি ‘ছূর’ পর্বতের গুহায় ঘটেছিল, না রাসূল (সা) ও আবূ বকরের (রা) মক্কা থেকে বের হওয়ার সময় আবূ বকরের (রা) বাড়ীতে, সে সম্পর্কে বর্ণনার ভিন্নতা দেখা যায়। ইমাম বুখারী ও ইবন ইসহাকের সীরাতের একটি বর্ণনায় বুঝা যায়, এটি মক্কায়  আবূ বকরের (রা) গৃহ থেকে রাতের অন্ধকারে বের হওয়ার সময়ের ঘটনা।

যেমন একথা বর্ণিত হয়েছে যে, মক্কার মুসলামারদের আল্লাহ মক্কা থেকে মদীনায় হিজরাতের অনুমতি দিলে মক্কার অত্যাচারিত, নির্যাতিত মুসলমানগণ দলে দলে মক্কা ছেড়ে মদীনায় চলে যেতে থাকে। পৌত্তলিকরা তাতে বাধা দিতে আরম্ভ করলে মুসলমানরা গোপনে একাকী বা ছোট ছোট দলে মক্কা ত্যাগ করতে থাকে। সকলে হিজরাদের অতি বড় ফযীলতের কথা উপলব্ধি করতে পেছিল, তাই সেই সৌভাগ্য অর্জনের জন্য যেন পরস্পর প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছিল। হযরত আবূ বকর (রা) একদিন প্রিয় নবীর (সা) নিকট গিয়ে হিজরাতের অনুমতি চাইলেন। নবী (সা) বললেন : (আরবী***** ) –এত তাড়াহুড়ো করবেন না, আল্লাহ আপনাকে একজন সঙ্গী দিবেন।’ আবূ বকর (রা) বুঝলেন, তাঁর সফরের সেই সঙ্গী হবেন খোদ নবী (সা)। আনন্দে আবূ বকরের (রা) হৃদয় মন বরে গেল। রাসূলুল্লাহর (সা) দারুল হিজরাহ মদীনায় যাবার সফসঙ্গী হবেন তিনি, এর চেয়ে বড় আনন্দের আর কী হতে পারে?

রাসূলুল্লাহর (সা) এই ইঙ্গিতময় বাণী শোনার পর আবূ বকর (রা) সে কথা তাঁর দুই কন্যা- আসমা‘ ও আয়িশাকে (রা) বলেন। তাঁরাও খুশীতে বাগবাগ হয়ে গেলেন একথা জেনে যে, তাঁদের পিতা হবেন আল্লাহর রাসূলের (সা) হিজরাতের সফরসঙ্গী। এরপর থেকে তাঁরা সেই শুভ ক্ষণটির প্রতীক্ষায় কাটাতে থাকেন।

এরপর একদিন আল্লাহ তাঁর নবীকে মদীনায় হিজরাতের অনুমতি দেন। নবী (সা) ঠিক দুপুরের সময় কুরায়শ পৌত্তলিকদের সকল প্রহরীর চোখ ফাঁকি দিযে আবূ বকরের (রা) যাচ্ছেন। আসমা’ (রা) বাড়ীর ভিতর থেকে সর্বপ্রতম তা দেখতে পান এবং দৌড়ে পিতার নিকট যেয়ে বলেন : আব্বু!  এই যে রাসূলুল্লাহ (সা) মাথা-মুখ ঢেকে আমাদের বাড়ীর দিকে আসছেন। এমন সময় তো তিনি কখনও আসেন না। আবূ বকর (রা) বললেন : আমার মা-বাবা তাঁর জন্য কুরবান হোন! আল্লাহর কসম! নিশ্চয় বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার  ছাড়া এ সময় তিনি আসেননি।

আবূ বকর (রা) নবীকে (সা) স্বাগত জানানোর জন্য ছুটে গেলেন। তিনি ঘরে প্রবেশের অনুমতি চাইলেন। আবূ বকর (রা) অনুমতি দিলে তিনি ঘরে ঢুকলেন। আবূ বকরকে (রা) বললেন : আপনার আশেপাশে যারা আছে তাদেরকে একটু বের করে দিন। সেখানে আসমা’ ও আয়িশা ছিলেন। আবূ বকর (রা) বলেন : ইয়া রাসূলাল্লাহ! এরা আমার দুই কন্য।

নবী (সা) বললেন : আমাকে বের হওয়ার (হিজরাত করার) অনুমতি দেওয়া হয়েছ। খুশীর আতিশয্যে আবূ বকর (রা) কেঁদে দেন। বলেন! ইয়া রাসূলাল্লাহ্! সঙ্গী হওয়ার সৌভাগ্য কি হবে? বললেন :হাঁ। ‘আয়িশা (রা) বলেন : আল্লাহর কসম! কেউ যে আনন্দের আতিশয্যে কাঁদতে পারে আমি সেই দিনের পূর্বে কখনো ভাবতে পারিনি। সেদিন আমি আবূ বকরকে কাঁদতে দেখেছি।[মুসনাদে আহমাদ-৬/৩৪৮; সাহীহ আল-বুখারী, হাদীছ নং-৩৯০৫; তাবাকাত-৮/২৫]

‘আয়িশা (রা) ‘যাতুন নিতাক’ ঘটনা সম্পর্কে আরো বলেছেন : আমরা দুই বোন তাঁদের জন্য প্রয়োজনীয় পাথেয় গুছাচ্ছিলাম। তাদের প্রয়োজনীয় জিনিস একটি চামড়ার থলিতে ভরলাম। তারপর আসমা’ তাঁর নিতাকটি কেটে থলির মুখ বাঁধেন। আর সেখান থেকে তিনি লাভ করেন ‘যাতুন নিতাক’ উপাধি।[সাহীহ আল-বুখারী-হাদীছ নং-৩৯০৫;]

উপরের এ বর্ণনা দ্বারা বুঝা যায়, হযরত আসমার (রা) ‘নিতাক’ ছিড়ে দু’ভাগ করা এবং ‘যাতুন নিতাকাইন’ উপাধি লাভ করার ঘটনাটি হযরত আবূ বকরে (রা) গৃহে ঘটে যখন রাসূষ (সা) ও আবূ বকর (রা) ‘ছূর’ পর্বতের দিকে যাত্রা করেন।

আসমার ছেলে ‘আবদুল্লাহ ইবন যুবায়র (রা) পরবর্তীকালে উমাইয়্যা খলীফাদের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়ে যুদ্ধে লিপ্ত হন।ঠ তখন শামের অধিবাসীরা তাঁকে ‘যাতুন নিকাতাইন’ –এর ছেলে বলে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতো। একথা আসমার কানে গেলে তিনি ছেলেকে বলেন : তারা তোমাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে? বললেন : হাঁ। আসমা (রা) বলেন : আল্লাহর কসম! তারা যা বলে, সত্য। এরপর হাজ্জাজ ইবন ইউসুফ যখন আসমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসেন তখন তিনি তাঁকে বলেন: তোমরা কিভাবে আবদুল্লাহকে ‘যাতুন নিকাতাইন’ বলে অপমান করার চেষ্টা কর? হাঁ, আমার একটি মাত্র নিতাক ছিল্ আর তা মেয়েদের অবশ্যই থাকতে হয়। আর অন্য একটি নিতাক দিয়ে আমি রাসূলুল্লাহর (সা) খাদ্য সামগ্রী বেঁধেছিলাম।[আ‘লাম আন-নিসা’-১/৪৭]

বিয়ে ও ইসলাম গ্রহণ

হযরত আসমা’ (রা) হযরত আবূ বকরের (রা) জ্যেষ্ঠ সন্তান। মক্কায় ইসলামী দা‘ওয়াতের সূচনা পর্বে পুরুষদের মধ্যে আবূ বকর (রা) সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণ করেন। আর এটাই স্বাভাবিক যে, তিনি তাঁর পরিবারের সদস্যদের নিকট ইসলামের দা‘ওয়াত পেশ করে থাকবেন, আর তাঁরাও দা’ওয়াত কবুল করেছেন। সুতরাং ধরে নেওয়া যায়, আসমা’ (রা) সাহাবীদের সন্তানদের মধ্যে প্রথম ইসলাম গ্রহণকারিণী। আর যেহেতু তিনি হিজরাতের ২৭ বছর পূর্বে জন্মগ্রহণ করেছেন, তাই তাঁর বয়স তখন দ্বিতীয় দশকের মাঝামাঝি হবে। তিনি তখন একজন কিশোরী মাত্র। ইমাম নাওবী (রা) বলেন :[ তাহযীবুল আসমা’ ওয়াল লুগাত-২/৫৯৭; বানাত আস-সাহাবা-৪০] (আরবী*******)

‘আসমা’ (রা) বহু আগে সতেরোজন মানুষের পরে ইসলাম গ্রহণ করেন।’ ইবন ‘আবদিল বার (রা) বলেন :[ আল-ইসতী‘আব-১২/১৯৬;]

‘(আরবী*****)-তাঁর ইসলাম গ্রহণ ছিল মক্কায় বহু আগে।’ ইবন ‘আসাকির উল্লেখ করেছেন যে, আসমা (রা) ‘আয়িশার (রা) চেয়ে দশ বছরের বড়। তারপর তিনি মুহাজিদের ইসলাম বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে বলেছে: [তারীখু মাদীনাতি দিমাশক, (তারাজিম আন-নিসা’)১০]

(আরবী********)

‘তারপর আরব গোত্রগুলোর কিছু মানুষ ইসলাম গ্রহণ করেন। তাঁদের অন্যতম হলেন আসমা’ বিনত আবী বকর(রা)। তিনি তখন অল্প বয়স্কা তবে প্রথম ইসলাম গ্রহণকারিণী মহিলাদের ক্রমধারা এ রকম : খাদীজা, উম্মু আয়মান আল-হাবশিয়্যাহ, হযরত ‘আব্বাসের স্ত্রী উম্মুল ফাদল ও হযরত ‘উমারের (রা) বোন ফাতিমা বিনত খাত্তাব (রা)।[বানাত আস-সাহাবা-৪১]

মক্কায় যখন ইসলামের দা‘ওয়াত দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে, পৌত্তলিক কুরায়শদের যুলুম- নির্যাতনের মাত্রাও বেড়ে চলছে, আর রাসূলুল্লাহর (সা) নির্দেশে নির্যাতিত মুসলমানগণ মক্কা থেকে একে একে হিজরাত করছে, এমনই এক সময়ে হযরত রাসূলে কারীমের (সা) ফুফাতো ভাই যুবায়র ইবনুল ‘আওয়াম (রা) আসমাকে (রা) বিয়ের পয়গাম পাঠান।

ইসলামের প্রথম পর্বে হযরত আবূ বকরের (রা) দা‘ওয়াতে যে সকল যুবক সাড়া দিয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন যুবায়র তাঁদের অন্যতম। ইসলাম গ্রহণের পর প্রথম পর্বের অন্য মুসলমানদের ন্যায় ইসলামের সেবায় নিজেকে বিলিয়ে দেন। এবং প্রতিপক্ষ পৌত্তলিকদের নানা রকম যুলুম-নির্যাতন হাসিমুখে সহ্য করেন। আর তাই তিনি রাসূলুল্লাহর (সা) একান্ত সাহাগ্যকারী ও অশ্বারোহী হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন।

যুবায়র (রা) একজন সাহসী যুবক। তিনি ‍দুনিয়ার উপর দীনকে অগ্রাধিকার দেন। পরকালীন জীবনকে পার্থিব জীবনের উপর প্রাধান্য দেন। তবে তিনি যখন আবূ বকরের (রা) মত একটি ধনাঢ্য অভিজাত পরিবারের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের প্রস্তাব পাঠান তখন সম্পদের মধ্যে তাঁর একটি মাত্র ঘোড়া ছাড়া আর কিছুই ছিল না। আবূ বকরের (রা) পরিবার এই প্রস্তাবে রাযী হয়ে যান এবং আসমা‘-যুবায়রের বিয়ের কাজ সম্পন্ন হয়।

আসমার চাতুরী ও কৌশল

হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা) যখন ইসলাম গ্রহণ করেন তখন নগতে তাঁর হাতে প্রায় এক লাখ দিরহাম ছিল। ইসলাম গ্রহণের পর ইসলামের প্রচার-প্রসার এবং নও মুসলিমদের সাহায্য-সহযোগিতার জন্য নিজের সব ধন-সম্পদ রাসূলুল্লাহর (সা) হাতে তুলে দেন। এ কারণে হিজরাতের সময় তাঁর হাতে দেড় মতান্তরে পাঁচ অথবা ছয় হাজারের মত যে অর্থ ছিল তার সবগুলো নিয়ে বেরিয়ে পড়েন্ সন্তান-সন্ততি ও পরিবার-পরিজনকে আল্লাহর যিম্মাদারিতে ছেড়ে যান। ‘ছূর’ পর্বত থেকে রাসূল (সা) ও আবূ বকরকে (রা) বিদায় দিয়ে আসমা’ (রা) ঘরে ফিরে আসেন। আবূ বকরের (রা) পিতা আবী কুহাফা, আসমা’র দাদা- যিনি তখনও ইসলাম গ্রহণ করেননি, বয়সের ভারে বড় দুর্বল হয়ে গিয়েছিলেন এবং দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেছিলেন। তিনি সকালে লোকমুখে ছেলের নিরুদ্দেশের কথা শুনে ছেলের বাড়ীতে আসেন এবং অত্যন্ত দুঃখের সাথে বলতে থাকেন, আফসোস! আবূ বকর নিজেও চলে গেল এবং সব অর্থ-সম্পদ সংগে নিয়ে ছেলে-মেয়েদেরকে বিপদে ফেলে গেল। হযরত আসমা (রা) সংগে সংগে বলে উঠলেন, না দাদা, তিনি আমাদের জন্য অনেক অর্থ রেখে গেছেন।

একথা বলে আসমা (রা) বৃদ্ধকে সান্ত্বনা দানের জন্য একটি থলিতে পাথর ভরে মুখ বেঁধে সেখানে রাখেন যেখানে আবূ বকর (রা) তাঁর সঞ্চিত অর্থ রাখতেন। তারপর সেটি একখণ্ড কাপর দিয়ে ঢেয়কে দেন। এরপর তিনি দাদার হাত ধরে সেই অর্থভাণ্ডারের নিকট নিয়ে যান এবং তাঁর একটি হাত ধরে সেই পাথর ভর্তি থলের উপর আসে করে ঘোরাতে থাকেন। বৃদ্ধ ঝাণ্ডারের যথেষ্ট অর্থ জমা আছে মনে করে আশ্বস্ত হলেন। হযরত আসমা (রা) বলেছেন, আমি কেবল তাঁকে সান্ত্বনা দানের জন্য এমনটি করেছিলাম। আল্লাহর কসম! তিনি আমাদের জন্য কোন কিছুই রেখে যাননি।[আল-ফাতহুর রাব্বানী (শারহুল মুসনাদ)-২০/২৮২; সীরাতু ইবন হিশাম-১/৪৪৮; নিহায়াতুল আবির-১৬/৩৩২]

ফির‘আউনুল উম্মাহ্ আবূ জাহলের হাতের থাপ্পড়

সকাল বেলা যখন মক্কার অলি-গলিতে একথা ছড়িয়ে পড়লো যে, মুহাম্মাদ (সা) ও আবূ বকর (রা) রাতের অন্ধকারে মক্কা ছেড়ে চলে গেছেন তখন পৌত্তলিকদের যেন মাথা খারাপ হয়ে গেল। এই উম্মাতের ফির‘আউতুল্য আবূ জাহল ও মক্কার অন্যান্য পৌত্তলিক নেতৃবৃন্দ মক্কার উঁচু ও নীচু ভূমিতে অবস্থিত বানূ হাশিম ও তার শাখা গোত্রগুলোর বাড়ীঘর তন্ন তন্ন করে খোঁজাখুঁজি করতে লাগলো। অভিশপ্ত দুর্বৃত্ত আবূ জাহলের নেতৃত্বে কুরায়শদের একদল মানুষ আবূ বকরের (রা) বাড়ী ঘেরাও করে। দলটির নেতা আবূ জাহল এগিয়ে গিয়ে দরজায় টোকা দেয়। বাড়ীতে তখন আসমা’, তাঁর বোন ‘আয়িশা ও ‘আয়িশার (রা) মা উম্মুযয রূমান (রা) ছাড়া কেউ ছিলেন না। আসমা’ (রা) বলেন : আমি দরজা খুলে তাদের সামনে গেলাম। তারা বললো : আবূ বকরের মেয়ে, তোমার আব্বা কোথায়?

বললাম : আল্লাহর কসম! আমার আব্বা কোথায় তা আমি জানিনে। সাথে সাথে আবূ জাহল তার একটি হাত উঁচু করে। সে ছিল একজন নীচ প্রকৃতির দুষ্কর্মকারী। সে আমার গালে সজোরে এক থাপ্পড় বসিয়ে দেয়। আর তাতে আমার কানের দুলটি ছিটকে পড়ে।[তারীখু মদীনাতি দিমাশ্‌ক (তারাজিম আন-নিসা’)-প্র.৩]

আবূ জাহল যে কত বড় নীচ পাপাচারী ছিল তা এই ঘটনা দ্বারা কিছুটা অনুমান করা যায়। যে গৃহে এই ঘটনাটি ঘটেছিল তখন সেই গৃহে কোন পুরুষ ছিল না। আসমা’ (রা) তথন গর্ভবতী এবং তাঁর মহান স্বামী যুবায়র ইবনুল ‘আওয়াম (রা) তখন অনুপস্থিত। তিনি এ ঘটনার আগেই মদীনায় হিজরাত করেছেন।[বানাত আস-সাহাবা-৫৩] এই যুবায়ের (রা) ছিলেন তৎকালীন আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বীর অশ্বারোহী যোদ্ধা। তাঁর উপস্থিতিতে মক্কার কোন পাষণ্ডের এমন বুকের পাটা ছিল না যে, তাঁর স্ত্রীর দিকে চোখ উঁচু করে তাকায়, হাত উঠানো তো দূরের কথা।

হিজরাত ও মুহাজিরদের প্রথম সন্তান

হযরত নবী কারীম (সা) ও আবূ বকর সিদ্দীক (রা) মদীনা পৌঁছে নতুন স্থানের প্রাথমিক সমস্যা কাটিয়ে একটু স্থির হওয়ার পর সিদ্ধান্ত নেন যে, মক্কা থেকে মহিলাদের আনার ব্যবস্থা করতে হবে। উল্লেখ্য যে, হযরত আসমার স্বামী যুবায়র (রা) নবীর (সা) পূর্বেই মদীনায় পৌঁছে গেছেন। নবী (সা) যায়দ ইবন হারিছা (রা) ও স্বীয় দাস রাফি’কে মক্কায় পাঠালেন। আর এদিকে আবূ বকর (রা) এক ব্যক্তিকে পাঠালেন।

আবূ বকরের (রা) ছেলে ‘আবদুল্লাহ তাঁর মা, দুই বোন আসমা’ ও ‘আয়িশা এবং পরিবারের কয়েকজন মহিলাকে নিয়ে মদীনার পথ ধরেন। আসমা (রা) তখন আসন্ন প্রসবা মহিলা। মদীনার কুবা পল্লীতে পৌঁছার পর গর্ভস্থ সন্তান ‘আবদুল্লাহর জন্ম হয়।[তাবাকাত-৮/১২৩; উসুদুল গাবা-৫/৩৯২]

এ সম্পর্কে আসমার (রা) বর্ণনা এ রকম:

‘আমার তখন পূর্ণ গর্ভাবস্থা। এ অবস্থায় আমি মদীনায় পৌঁছে কুবায় ঠাঁই নিলা। তারপর আবদুল্লাহকে প্রসব করলাম। তাকে নিয়ে আমি রাসূলুল্লাহর (সা) কোলে রাখলাম। তিনি একটি খেজুর আনিয়ে চিবালেন এবং সেই থুথু তার মুখে দিলেন। এভাবে জন্মের পর রাসূলুল্লাহর (সা) থুথুই প্রথমে তার পেটে যায়।

রাসূল (সা) তার মঙ্গল ও কল্যাণ কামনা করে দু‘আও করেন। [সাহীহ আল-বুখারী-১/৫৫৫] সে ছিল মদীনার মুহাজিরদের ঘরে জন্ম নেওয়া প্রথম শিশু। মদীনার কোন মুহাজির দম্পতির কোন সন্তান না হওয়ায় লোকেরা বলাবলি করতো যে, ইহুদীরা তাদের জাদু করেছে তাই তাদের কোন সন্তান হবে না। শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে আবদুল্লাহ ভূমিষ্ঠ হলে মুহাজিরদের মধ্যে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। তারা তাকবীর ধ্বনি দিয়ে ইহুদীদের অপপ্রচারের প্রতিবাদ জানায়।[সাহীহ আল-বুখারী, হাদীছ নং-৩৯০৯, ৫৪৬৭; আত-তাবারী, তারীখ আল-উমাম ওয়াল মুলুক-২.১০; পরবর্তীকালে হযরত আবদুল্লাহ (রা) হাজ্জাজের বাহিনীর হাতে শহীদ হলে শামের অধিবসীরা সে খবর শুনে আনন্দে তাকবীর ধ্বনি দেয়। সে ধ্বনি শুনে প্রখ্যাত সাহাবী হযরত ‘আবদুল্লাহ ইবন ‘উমার (রা) প্রশ্ন করেন : এ তাকবীর কিসের জন্য? বলা হলো : শামের অধিবাসীরা ‘আবদুল্লাহর (রা) হত্যার খবর শুনে আনন্দে তাকবীর ধ্বনি দিচ্ছে। তিনি বললেন : যাঁরা তাঁর জন্মের কথা শুনে তাকবীর ধ্বনি দিয়েছিলেন তাঁরা এদের চেয়ে উত্তম যারা আজ তাঁর নিহত হওয়ার কথা শুনে তাকবীর দিচ্ছে। (আল-‘ইকদ আল-ফারীদ, ৪/৪১৯;ওয়াফাইয়াত আল-আ‘ইয়ান-৩/৭৩, ৭৫)] রাসূল (সা) সন্তানের নানা আবূ বকরকে (রা) নির্দেশ দেন তার দু‘কানে আযান দেওয়ার জন্য। তিনি আযান দেন। রাসূল (সা) শিশুর নাম রাখেন আবদুল্লাহ এবং কুনিয়াত বা ডাকমান রাখেন নানার ডাক নামে- আবূ বকর। পরবর্বীতে হযরত ‘আবদুল্লাহ ইবন যুবায়র (রা) একটু গর্বের সাথে বলতেন : (আরবী******) ‘আমি ময়ের পেটে থাকতেই হিজরাত করেছি।’ তিনি আরো বলতেন : আমার মা আমাকে পেটে নিয়ে হিজরাত করেছেন। তিনি যত ক্লান্তি ও ক্ষুধার কষ্ট সহ্য করেছেন তার সবই আমিও সহ্য করেছি।[আল-ইসাবা-৫/২২৯; নাসাবু কুরায়শ-২৩৭]

হযরত আসমা’ (রা) তাঁর এই সন্তান আবদুল্লাহকে অন্তর উজার করা স্নেহ-মমতা দিয়ে লালন-পালন করেন যাতে পরবর্তীকালে ইসলামের একজন সেরা সন্তান হতে পারে। আসমার (রা) স্বপ্ন সত্যে পরিণত হয়েছে। এ পৃথিবীতে সত্য ও সুন্দরের প্রতিষ্ঠায় যাঁর জীবন দান করে গেছেন তাঁদের সেই তালিকায় আসমার (রা) এই সন্তানও নিজের নামটি অন্তর্ভুক্ত করে যেতে সক্ষম হয়েছেন। তিনি শিশুকে হাতের উপর দোলাতেন, আর শুভ্র-উজ্জ্বল অসির সাথে তার তুলনা করে কবিতার পংক্তি আওড়াতেন। সেই কবিতার কয়েকটি চরণ নিম্নরূপ : [আনবাউ নুজাবা’ আল-আবনা’ -৮৫; আ’লাম আন-নিসা’ -১/৪৯; বানাত আস-সাহাবা-৫৫]

(আরবী*******)

‘পিতা রাসূলুল্লাহর (সা) হওয়রী এবং নানা আবূ বকর সিদ্দীকের মাঝখানে সে হবে ধারালো চকচকে তরবারির মত শ্বেত-শুভ্র।

তার সম্পর্কে এ আমার ধারণা। আর অনেক ধারণাই বাস্তবে রূপ নেয়। আল্লাহ মর্যাদার অধিকারী, ক্ষমাতা দানের অধিকারী।

তিনি তাঁকে এমন বক্তৃতা-ভাষণে পারদর্শী করবেন যে, সে বড় বাগ্মীদেরও অক্ষম করে দিবে এবং অসহায়-অক্ষমদের বিপদাপদ দূরীভূত করবে। যখন চোখের পুত্তলীর পাশে ভ্রূ গজাবে এবং বিচ্ছিন্ন ও দলবদ্ধভাবে ঘোড়া দৌড়াবে।’

হযরত যুবায়র ইবনুল ‘আওয়ামের (রা) ঔরসে এবং আসমার গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন : পুত্র আবদুল্লাহ, আল-মুনযির; ‘উরওয়াহ, ‘আসি, আল-মুহাজির এবং কন্যা খাদীজাতুল কুবরা, উম্মুল হাসান ও ‘আয়িশা। [হিলয়াতুল আওলিয়া’ -২/২৫৫।]

দৃঢ় ঈমান

ইসলামী জীবন গ্রহণ করার পর ঈমান তাঁর অন্তরে এমন দৃঢ়মূল হয় যে, শিরক ও কুফরীর সাথে বিন্দুমাত্র অপোষ করেননি। এমনকি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (সা) অসন্তুষ্টির করণ হতে পারে চিন্তা করে নিজের অতি নিকটের অমুসলিম আপনজনদের সাথেও সম্পর্ক ছিন্ন করেন। আসমার (রা) পিতা তাঁর মাকে তালাক দিলে সেই জাহিলী যুগেই তাঁদের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়। আসমার গোটা পরিবার ইসলামী পরিবারে পরিণত হলো। একদিন আসমার (রা) মা তাঁর মেয়েকে দেখার জন্য আসলে তিনি রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট জানতে চান, তাঁর এই মুশরিক মায়ের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখবেন কিনা? তখন এ আয়াত নাযিল হয় :[সূরা আল-মুমতাহিনা-৮] (আরবী********)

তখন রাসূল (সা) তাঁকে তাঁর মুশরিক মায়ের সাথে সদাচারণের নির্দেশ দিয়ে বলেন : হাঁ তোমার মায়ের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখ।[তাফসীর আল-কুরতুবী-১০/২৩৯; মুসনাদে আহমাদ-৬/৩৪৪, ৩৪৭, ৩৫৫] আমির ইবন ‘আবদিল্লাহ তাঁর পিতা ‘আবদুল্লাহ ইবন যুবায়রের (রা) সূত্র বর্ণনা করেছেন : একবার কুতাইলা বিন্‌ত ‘আবদিল ‘উয্‌যা কিছু কিসমিস, ঘি, পনির ইত্যাগি উপহার নিয়ে কন্যা আসমা‘র গৃহে আসলেন। আসমা (রা) তা গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানান। এমনকি তাঁকে ঘরে ঢুকতে দিলেন না। ‘আয়িশা (রা) বিষয়টি রাসূলকে (সা) অবহিত করে তাঁর মতামত জানতে চান। তখন নাযিল হয় সূরা আল-মুমতাহিনার উপরোক্ত আয়াতটি। তখন আসমা (রা) মাকে সাদরে গ্রহণ করে ঘরে নিয়ে বসান এবং তাঁর উপহার সামগ্রী গ্রহণ করেন।[মুসনাদে আহমাদ-৬/৩৪৪; দুররুল মানছূর -৮/১৩১]

হযরত আসমা (রা) ছিলেন অত্যন্ত বিনয়ী ও নিরহঙ্কারী মানুষ। সংসারে যাবতীয় কাজ নিজ হাতে করতে কোন লজ্জাবোধ করতেন না। হযরত আসমা(রা) নিজেই তাঁর স্বামী হযরত যুবায়েরের (রা) সংসারের আর্থিক অসচ্ছলতা ও দৈন্যদশা এবং সেই সংসারের যাবতীয় দায়িত্ব ও কর্তব্য নিজ হাতে সম্পন্ন করার কাহিনী আমাদেরকে এভাবে শুনিয়েছেন :

যুবায়র ইবনুল ‘আওয়ামের সংগে যখন আমার বিয়ে হয় তখন অর্থ-বিত্ত বলতে তাঁর কিছুই ছিল না। ছিল না কায়িক শ্রমের জন্য কোন দাস। ভীষণ হতদরিদ্র অভাবী মানুষ ছিলেন। থাকার মধ্যে ছিল শুধু একটি ঘোড়া ও একটি উট। আমি নিজেই তার রাখালী করতাম। মদীনার কেন্দ্রস্থল থেকে তিন ফারসাখ দূরে হযরত রাসূলে কারীম (সা) এক খণ্ড খেজুর বাগান যুবায়রকে দান করেছিলেন। সেখান থেকে খেজুরের বীটি কুড়িয়ে থলিতে ভরে মাথায় করে বাড়ী আনতাম। তারপর নিজ হাতে তা পিষে উট-ঘোড়াকে খাওয়াতাম। কূয়া থেকে বালতি ভরে পানি উঠিয়ে মশকে ভরে বাড়ীতে আনতাম। এছাড়া বাড়ীর যাবতীয় কাজ নিজ হাতে করতাম। যেহেতু আমি ভালো রুটি বানাতে পারতাম না, এ কারণে আচা চটকিয়ে দলা বানিয়ে রেখে দিতাম। আমাদের বাড়ীর পাশেই ছিলেন আনসারদের স্ত্রীরা। তাঁরা ছিলেন খুবই সরল ও সহজ প্রকৃতির। তাঁরা আমাদের ভীষণ ভালোবাসতেন। অন্যের কাজে সাহায্য করতে পারলে দারুণ খশী হতেন। তাঁরা আমার রুটি বানিয়ে সেঁকে দিতেন। প্রতিদিন আমাকে েএ সকল বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হতো।

প্রতিদিনের মতহ একদিন আমি বাগান থেকে খেজুরের বীচির বোঝা নিয়ে ঘরে ফিরছি, এমন সময় পথে রাসূলুল্লাহর (সা) সংগে দেখা। তাঁর সংগে তখন আরো কয়েকজন সাহাবী ছিলেন। রাসূল (সা) তাঁর উট বসিয়ে আমাকে তাঁর পিছনে বসার জন্য ডাকলেন। আমি আমার স্বামী যুবায়েরের মান-মর্যাদার কথা ভেবে লজ্জা পেলাম। তিনি আমার লজ্জা বুঝতে পেরে চলে গেলেন। আমি বাড়ৎী ফিরে একথা যুবায়রকে জানালাম। তিনি মন্তব্য করলেন, আল্লাহ জানেন তোমার এভাবে মাথায় করে বোঝা আনা রাসূলের (সা) সাথে তাঁর বাহনের পিঠে বসার চাইতে আমার নিকট বেশী পীড়াদায়ক। এ ঘটনার বেশ কিছুদিন পরে আমার পিতা আবূ বকর (রা) আমার জন্য একটি দাস পাঠান। সেই আমাকে ঘোড়ার রাখালী থেকে মুক্তি দেয় এবং সব বিপদ থেকে কিচুটা হলেও মুক্তি লাভ করি।[তাবাকাত-৮/২৫০; সিয়ারু আ‘লাম আন-নুবালা-২/২৯০; মুসনাদে আহমাদ-৬/৩৫২]

দারিদ্র ও অসচ্ছলতার কারণে সাংসারিক ব্যয় নির্বাহের ক্ষেত্রে দারুণ হিসেবী ছিলেন। প্রতিটি জিনিস প্রয়োজন মত মেপে মেপে খরচ করতেন। একথা রাসূল (সা) অবগত হয়ে তাঁকে এভাবে মেপে মেপে খরচ করতে নিষেধ করেন। তিনি বলেন, এভাবে মেপে খরচ করবে না। অন্যথায় আল্লাহ ততটুকু পরিমাণই দিবেন। এরপর তিনি এ অভ্যাস পরিত্যাগ করেন।

জীবনের এক পর্যায়ে হযরত আসমা’ (রা) প্রচুর অর্থ-বিত্তের মালিক হন। তবে এই প্রাচুর্য তাঁর সরল ও অনাড়ম্বর জীবনধারার উপর কোন রকম প্রবাব ফেলতে পারেনি। আমরণ মোটা কাপড় পরেছেন এবং শুকনো রুটি দ্বারা উদরপূর্তি করে একেবারে ভোগ-বিমুখভাবে জীবন কাটিয়েছেন। ইরাক বিজয়ের পর তাঁর ছেলে মুনযির যখন ঘরে ফিরলেন তখন উন্নতমানের পাতলা, মোলায়েম ও নকশা করা কিছু মহিলাদের পোশাক সংগে নিয়ে আসেন এবং সেগুলো মায়ের হাতে তুলে দেন। বয়সের কারণে তখন হযরত আসমা (রা) দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেছিলেন। তাই কাপড়গুলোর উপর হাত বুলিয়ে তার মান বুঝার চেষ্টা করেন। যখন বুঝতে পারেন এগুলো অতি উন্নত মানের তখন তা তিনতে অস্বীকৃতি জানান। মুনযির যখন মোটা কাপড় নিয়ে এলেন তখন তিনি তা গ্রহণ করেন এবং খুশী হন। তারপর বলেন : ছেলে! আমাকে মোটা কাপড়ই পরাবে।[তাবাকাত-৮/২৫০]

দানশীলতা

হযরত আসমার (রা) চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো দানশীলতা। আর এ গুণটি তিনি অর্জন করেন আল্লাহর প্রতি তাঁর দৃঢ় ঈমান ও পারিবারিক ঐতিহ্য থেকে। পিতা আবূ বকরের (রা) দানশীলতার গুণটি তাঁর তিন কন্যা- আসমা’, ‘আয়িশা ও উম্মু কুলছূম (রা) পূর্ণরূপে ধারণ করেন। দানশীলতার এ গুণটি তাঁদের সত্তায় পূর্ণমাত্রায় বিকশিত হয়। এমনকি তাঁদের সময়ে এ ক্ষেত্রে তাঁরা দৃষ্টান্তে পরিণত হন। হযরত ‘আবদুল্লাহ ইবন যুবায়র (রা) তাঁর মা ও খালার দানশীলতার কথা বলছেন এভাবে :[তারীখুল ইসলাম ওয়া তাবাকাত আল-মাশাহীর ওয়াল আ‘লাম-৩/১৩৫; সিয়ারু আ‘লাম আন-নুবালা-২/২৯২]  (আরবী********)

‘আমি আমার মা আসমা ও খালা ‘আয়িশা (রা) থেকে অধিক দানশীলা কোন নারী দেখিনি। তাঁদের দু‘জনের দান প্রকৃতির মধ্যে কিছু ভিন্নতা ছিল। খালা ‘আয়িশার স্বভাব ছিল প্রথমতঃ তিনি বিভিন্ন জিনিস একত্র করতেন। যখন দেখতেন যে যথেষ্ট  পরিমাণে জমা হয়ে গেছে তখন হঠাৎ করে একদিন তা সবই বিলিয়ে দিতেন। কিন্তু আমার মা আসমার (রা) স্বভাব ছিল ভিন্নরূপ। তিনি আগামীকাল পর্যন্ত কোন জিনিস নিজের কাছে জমা করে রাখতেন না।’

সম্ভবতঃ আসমা’ (রা) এই দানশীতার ক্ষেত্রে তাঁর প্রতি রাসূলুল্লাহর (সা) উপদেশ বাণীর অনুসরণ করতেন। তিনি আসমাকে কোন জিনিস জমা করে রাখতে এবং গুনে গুনে খরচ করতে নিষেধ করেন এবং বলেন তুমি যদি এমন কর তাহলে আল্লাহ তোমার প্রতিও এমন করবেন। তোমর রুযি-রিযিকের উৎস বন্ধ হয়ে যাবে। রাসূল (সা) বলেন: [ সাহীহ আল-বুখারী, ফিল হিবা (২৫৯০, ২৫৯১), ফিয যাকাত (১৪৩৩, ১৪৩৪)] (আরবী*******)

‘হে আসমা! তুমি হিসাব করো না। তাহলে আল্লাহও তোমাকে দানের ক্ষেত্রে হিসাব করবেন।’

আসমা’ (রা) বলেন : রাসূলুল্লাহর (সা) এই উপদেশ বাণীর পর থেকে আমি কী খরচ করলাম এবং কী আমার হতে এলো তা আর হিসাব করিনি। যা কিছুই আমি খরচ করেছি আল্লাহ আমাকে তা পূরণ করে দিয়েছেন।[তারীখু মাদীনাতি দিমাশ্‌ক (তারাজিম আন-নিসা’)-১৯; নিসা’ মিন ‘আসর আন-নুবুওয়াহ-৩৫৭]

তিনি তাঁর ছেলে-মেয়েদের এই বলে উপদেশ দিতেন যে, তোমরা ধন-সম্পদ অন্যের সাহায্য ও উপকারের জন্য দেওয়া হয়, জমা করার জন্য নয়। তুমি তোমার অর্থ-বিত্ত আল্লাহর বন্দাদের জন্য খরচ না কর এবং কৃপণতা কর তাহলে আল্লাহও তাঁর অনুগ্র থেকে তোমাকে বঞ্চিত করবেন। তুমি যা কিছু দান করবে অথবা খরচ করবে, প্রকৃতপক্ষে তাই হবে তোমার সঞ্চয়, এ সঞ্চয় কখনো কম হবে না, অথবা নষ্টও হবে না।[তারীখু মাদীনাতি দিমাশ্‌ক-১৬; তাবাকাত-৮/৩৫৭]

হযরত আসমা’ (রা) কখনো অসুস্ঞ হলে তাঁর মালিকানার সকল দাসকে মুক্ত করে দিতেন।[তাবাকাত-৮/২৮৩] উম্মুল মু‘মিনীন হযরত ‘আয়িশা (রা) মৃত্যুকালে এক খণ্ড ভূমি রেখে যান যা উত্তরাধিকার হিসেবে আসমা’ (রা) লাভ করেন। তিনি সেই ভূমিটুকু এক লাখ দিরহামে বিক্রি করেন এবং সকল অর্থ আত্মীয় ও পরিজনদের মধ্যে বিলি করে দেন।[সহীহ আল-বুখারী, বাবু হিবাতিল ওয়াহিদ লিল জামা‘আহ্।]

হযরত আসমার (রা) স্বামী হযরত যুবায়র (রা) ছিলেন অনেকটা রূঢ় প্রকৃতির মানুষ। এ কারণে আসমা’ (রা) একবার রাসূলকে (সা) জিজ্ঞেস করেন যে, আমি কি আমার স্বামীর সম্পদ থেকে অনুমতি ছাড়াই ফকীর-মিসকীনকে কিছু দান করতে পারি? বললেন : হাঁ, করতে পার।[মুসনাদ-৬/৩৫৩]

একবার হযরত আসমার (রা) মা মদীনায় তাঁর নিকট আসেন এবং কিছু অর্থ সাহায্য চান। তিনি তাঁর অভ্যাস মত রাসূলের (সা) নিকট চুটে যান এবং জিজ্ঞেস করেন, আমার মা একজন মুশরিক (পৌত্তলিক), আমার নিকট কিছু অর্থ সাহায্য চাচ্ছেন, আমি কি তাঁকে সাহায্য করতে পারি? রাসূল (সা) বললেন : তিনি তোমার মা।[সাহাবিয়াত-১৬০] অর্থাৎ তাঁকে তুমি সাহায্য করতে পার। মুহাম্মাদ ইবন আল-মুনকাদির (মৃ. ১৩০ হি. ) যিনি একজন বড় মাপের তাবি‘ঈ ছিলেন, বলেন : ‘আসমা’ ছিলেন একজন উদারপ্রাণ দানশীল স্বভাবের মহিলা।’[তাবাকাত-৮/৩৫৩]

শাশুড়ীর সাথে ভুল বোঝাবুঝি

হযরত আসমার (রা) শাশুড়ী ছিলেন রাসূলুল্লাহর (সা) ফুফু সাফিয়্যা বিন্‌ত ‘আবদিল মুত্তালিব (র)। তিনি একজন অন্যতম শ্রেষ্ঠ মহিলা কবি ছিলেন। ইসলামী জীবনে বীরত্ব ও সাহসিকতার জন্য খ্যাতিও অর্জন করেন। তবে স্বভাবে একটু রুক্ষতা ছিল। রেগে গেলে তা অনেকটা মাত্রা ছেড়ে যেত। এসব কারণে পুত্রবধূ আসমার (রা) সঙ্গে অনেক সময় ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হতো। আর তা নিয়ে মা ছেলের মধ্যেও মান-অভিমানের অবতারণা হতো। এ রকম একটি ঘটনা ইবন ‘আসাকির ‘উরওয়া ইবন আয-যুবায়রের সূত্রে বর্ণনা করেছেন। একবার আসমার কোন ব্যাপার নিয়ে সাফিয়্যা ও তাঁর ছেলে যুবায়রের মধ্যে ক্ষব্ধ কথাবার্তা হয়। আসমা-যুবায়রের ছোট্ট মেয়ে খাদীজা সব সময় তার দাদীর কাছে থাকতো। সে তার আব্বা-দাদীর কথা শোনে এবং তার মার কাছে গিয়ে বলে : মা, আপনি কেন দাদীকে বকেছেন? তিনি আব্বার নিকট অভিযোগহ করেছেন। কথাটি জানাজানি হয়ে গেল। সাফিয়্যা ছেলের উপর ভীষণ অসন্তুষ্ট হলেন এই ভেবে যে, তাঁর কতাটি ছেলে বউকে বলে দিয়েছে। তিনি এজন্য ছেলেকে তিরস্কার করেন। যুবায়র (রা) মাকে বললেন : মা, আমি তাকে বলিনি। এতে মা আরো ক্রুদ্ধ হলেন। ভাবলেন, ছেলে তাঁর নিকট সত্য গোপন করছে। আসলে যুবায়রও জানতেন না, আসমা’ বিষয়টি কার কাছ থেকে জেনেছেন। রাগের চোটে সাফিয়্যা (রা) তখন ছেলের প্রতি তিরস্কারমূলক বেশ কিছু শ্লোক উচ্চারণ করেন। অবশেষে বিষয়টি পরিষ্কার হলো। যুবায়র (রা) বললেন : মা, আসমাকে একথা বলেছে খাদীজা। সাফিয়্যা বললেন : তাই! যে যেন আর কখনো আমার ঘরে না আসে।[তারীখু মাদীনাতি দিমাশ্‌ক(তারাজিম আন-নিরসা’ ) পৃ. ১৭,১৮,] উল্লেখ্য যে, হযরত সাফিয়্যা (রা) আসমা-যুবয়রের (রা) সন্তানদেরকে খুবই আদর করতেন। ‘আবদুল্লাহ ইবন যুবায়রকে তো কোলে করে নাচাতেন, আর সুর করে কবিতা চরণ আবৃত্তি করতেন।[বানাত আস-সাহাবা-৬২, টীকা-১]

খোদাভীত ও জ্ঞান

আল্লাহর পথে সবকিছু বিলিয়ে দেওয়া, দানশীলতা, উন্নত নৈতিকতা যেমন তাঁর চরিত্রকে মাধুর্যমণ্ডিত করেছিল তেমনিভাবে জ্ঞান, খোদাভীতি, বুদ্ধিমত্তা, ফিকহ্‌ বিষয়ে পরদর্শিতা তাঁর সত্তাকে আরো মহিয়ান করে তোলে। রাসূলুল্লাহর (সা) হাদীছ বর্ণনা, জিহাদে অংশগ্রহণ এবং এ জাতীয় অন্যান্য কাজে তাঁর সমান অংশীদারিত্ব লক্ষ্য করা যায়। বিনীত ও বিনম্রভাবে ‘ইবাদাতে মশগুল থাকতেন এবং একাগ্রচিত্তে কুরআন তিলাওয়াত করতেন। বিশেষ কোন আয়াত পাঠের সময় বিগলিত চিত্তে বার বার তা আওড়াতে থাকতেন। তাঁর স্বামী বর্ণনা করেছেন, একদিন আমি আসমার (র) ঘরে ঢুকে দেখি সে নামাযে দাঁড়িয়ে এ আয়াদ [সূরা আত-তূর-২৭] (আরবী*****)

‘অতঃপর আমাদের প্রতি আল্লাহ অনুগ্রহ করেছেন এবং আমাদেরকে আগুনের শাস্তি থেকে রক্ষা করেছেন।’

পাঠ করলো। তারপর পাফ করলো আ‘উযুবিল্লাহ। আমি দাঁড়িয়ে থাকলাম, কিন্তু সে কাঁদছে আর আ‘উযুবিল্লাহ পাঠ করছে। দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আমি বাজারে গেলাম। কাজ সেরে আবার সেখানে ফিরে গিয়ে দেখলাম, তখনো সে কাঁদছে আর আ‘উযুবিল্লাহ পাঠ করছে।[হিলয়াতুল আওলিয়া-২/৫৫; আদ-দুররুল মানছূর-৭/৬৩৫]

ইবনুল জাওযী (রা) উল্লেখ করেছেন যে, সেকালে এমন একদল কুরআন পাঠক ও শ্রোতার আবির্ভাব ঘটে, যারা কুরআন পাঠ অথবা শোনার সময় অভিনব সব আচরণ করতো। যেমন : অচেতন হওয়া, পরিধেয় বস্ত্র টেনে ছিঁড়ে ফেলাা, মাথা-মুখে চড়-থাপ্পড় মারা ইত্যা। তারা মনে করতো এর মাধ্যমে তারা আল্লাহর পানাহ ও আশ্রয় কামনা করছে। আর তারা মনে করতো, সর্বাধিক পরিচ্ছন্ন অন্তঃকরণ ও সর্বাধিক সৎকর্মশীল রাসূলুল্লাহর (সা) সাহাবীগণ এমন করতেন এবং তারা কেবল তাঁদেরই অনুসরণ করছে।[আল-কুস্‌সাম ওয়াল-মুযাক্কিরীন-৪০] কূফার বিখ্যাত হাফিজ হুসাইন ইবন ‘আবদুর রহমান আস-সুলামী (মৃ. ১৩৬ হি. ) বলেন : একবার আমি আসমা‘ বিনত আবী বকরকে (রা) জিজ্ঞেস করলাম, কুরআন তিলাওয়াতের সময় রাসূলুল্লাহর (সা) সাহাবীগণ কেন করতেন? বললেন : আল্লাহ যেমন তাদের বর্ণনা দিয়েছেন যে, তাদের চোখ অশ্রুপূর্ণ এবং গাত্রত্বক রোমাঞ্চিত হয়। বললাম : এখানে এমন কিছু লোক আছে যাদের সামনে কুরআন পাঠ করলে অচেতন হয়ে পড়েঃ। হযরত আসমা (রা) বললেন : (আরবী******)

‘বিতারিত শয়তান থেকে আল্লাহর পানাহ্ চাই।’[আল-বাহর আল-মুহীত-৯/১৯৬; তারীখু মাদীনাতি দিমাশ্‌ক (তারাজিম আন-নিসা’-২০)]

মূলতঃ হযরত আসমা (রা) আল-কুরআনের দু‘টি আয়াতের দিকে ইঙ্গিত করেছেন যাতে কুরআন তিলাওয়াতের সময় সাহাবায়ে কিরামের অবস্থা চিত্রিত হয়েছে। সেই আয়াত দু‘টি হলো: [সূরা আল-মায়িদা-৮৩] (আরবী******)

‘রাসূলের প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে তা যখন তারা শোনে তখন তারা যে সত্য উপলব্ধি করে তার জন্য তুমি তাদের চোখ বিগলিত দেখবে।’

(আরবী*****************)

‘আল্লাহ অবতীর্ণ করেছেন উত্তম বাণী সম্বলিত কিতাব যা সুসামঞ্জস্যপূর্ণ এবং যা পুনঃ পুনঃ আবৃত্তি করা হয়। এতে, যারা তাদের প্রতিপালককে ভয় করে, তাদের গা রোমাঞ্চিত হয়, অতঃপর তাদের দেহমন বিনম্র হয়ে আল্লাহর স্মরণে ঝুঁকে পড়ে।’[সূরা আয-যুমার-২৩]

এই উম্মাতের সর্বাধিক খোদাভীরু ও পুণ্যবান মানুষ হলেন সাহাবায়ে কিরাম (রা)। তারা সরাসরি হযরত রাসূলে কারীমের (সা) নিকট থেকে ইসলামের সঠিক জ্ঞান রাভ করেন। সুতরাং তারা যা করেননি, ইবাদাতের নামে তা করা কোনভাবেই সঙ্গত নয়। একথাই হযরত আসমা’ (রা) ‘আ‘উযুবিল্লাহ’ পাঠের মাধ্যমে বুঝাতে চেয়েছেন। তিনি আরো বুঝাতে চেয়েছেন যে, ঐ সকল লোক যা করে তা মূলতঃ শয়তানের কাজ। সততা ও নিষ্ঠা ছিল হযরত আসমার (রা) স্বভাবগত। গোটা মানব সমাজের প্রতি ছিল তাঁর সহমর্মিতা। একবার হযরত রাসীলে কারীম (সা) সূর্য গ্রহণের নামায আদায় করছিলেন। নামায খুব দীর্য় ছিল। আসমা’ (রা) ভয় পেয়ে গেলেন এবং ক্লান্ত হয়ে এদিক ওদিক তাকাতে লাগলেন। হঠাৎ তাঁর অদূরে দাঁড়ানো দুই মহিলার উপর দৃষ্টি পড়লো। ওই দুই মহিলার একজন ছিল একটু স্থুলকায় এবং অন্যজন একটু হলকা-পাতলা ও দুর্বল। তাদের নামাযে দাঁড়িয়ে থাকা দেখে তিনি সাহস ও শক্তি পেলেন। তিনি সরে পড়ার সিদ্ধান্ত পাল্টালেন এবং মনে মনে নিজেকে বললেন, তাদের চেয়েও বেশী সময় আমার দাঁড়িযে থাকা উচিত।[মুসনাতে আহমাদ-৩/৩৪৯] যে কথা সেই কাজ। নামায শেষ হওয়া পর্যন্ত ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকলেন। নামাযও ছিল কয়েক ঘণ্টা দীর্ঘ। শক্তভাবে দাঁড়িয়ে থাকেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিজেকে সামাল দিতে পারেননি। জ্ঞান হারানোর উপক্রম হয় এবং মাথায় পানি ছিটানোর প্রয়োজন পড়ে।[সাহীহ আল-বুখারী-১/১৪৪]

সে যুগে হযরত আসমা (রা) বহুবিধ জ্ঞানের উৎসস্থল ছিলেন। তিনি স্বপ্নের একজন দক্ষ তা‘বীর বা ব্যাখ্যাকারিণীও ছিলেন। আল ওয়াকিদী বলেছেন :[তাহযীবুল আসমা’ ওয়াল লুগাত-২/৫৯৮]

(আরবী***************)

‘সা‘ঈদ ইবন আল-মুসায়্যিব (রহ) ছিলেন অন্যতম শ্রেষ্ঠ স্বপ্নের তা‘বীরকারী। তিনি এ জ্ঞান লাভ করেন আসমা’ বিনত আবী বকল থেকে। আর আসমা’ লাভ করেন তার পিতা আবূ বকর (রা) থেকে।’

হযরত আসমার (রা) বহু ভক্ত ও অনুসারী ছিলেন। ভক্তি ও শ্রদ্ধা সহকারে তাঁরা আসতেন তাঁর সাথে দেখা করতে। তাঁর পূতঃ  পবিত্রতার ব্যাপক প্রসিদ্ধি ছিল। মানুষ আসতো তাঁর দু‘আ নিতে। বিশেষ করে বিপদ-আপদের সময় মানুষ আসতো তাঁর দ্বারা দু‘আ করাতে। কখনো কোন জ্বরে আক্রান্ত নারী তাঁর নিকট এলে তিনি তার বুকের উপর পানি ছিটিয়ে দিয়ে বলতেন, রাসূল (সা) বলেছেন : জ্বর হল জাহান্নামের আগুন, আর তোমরা তা পানি দিয়ে ঠাণ্ডা কর।[সাহীহ মুসলিম, ফিস সালামি (২২১১); বুখারী, ফিত তিব্ব (৫৭২৪)]

উম্মুল মু‘মিনীন হযরত ‘আয়িশা (রা) ইনতিকালের সময় হযরত রাসূলে কারীমের (সা) একটি জোব্বা হযরত আসমাকে (রা) দিয়ে যান। আসমার (রা) বাড়ীর কেউ অসুস্থ হলে তিনি এই জোব্বা ধোওয়া পানি তাকে পান করাতেন। [মুসলিম, ফিল-লিবানি ওয়ায যীনাতি (২০৬৯); তাবাকাত-১/৪৫৪; মুসনাদ-৬/৩৪৮]

হযরত আসমা’ (রা) কায়েকবার হজ্জ করেন। প্রথম বার আদায় করেন হযরত রাসূলে কারীমের (সা) সঙ্গে।

হাদীছ স্মৃতিতে ধারণ ও বর্ণনা

হযরত আসমা’ (রা) রাসূলে কারীমের (সা) হাদীছ স্মৃতিতে ধারণ ও বর্ণনার ক্ষেত্রে সাহাবায়ে কিরামের (রা) কন্যাদের অনেককে অতিক্রম করে গেছেন। তবে আবূ বকরের (রা) পরিবারের মহিলাদের মধ্যে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছেন। এ ক্ষেত্রে হযরক ‘আয়িশা (রা) তাঁকে ডিঙ্গিয়ে গেছেন। যে সকল পুরুষ বা মহিলা সাহাবী থেকে এক শো’র কম হাদীছ বর্ণিত হয়েছে তাদেরকে “আসহাবুল ‘আশারা” বলা হয়।

[যে সকল মহিলা সাহাবীকে ‘আসহাবুল ‘আশরা’ –এর মধ্যে গণ্য করা হয় তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন :

১. আসমা বিনত ইয়াযীদ (রা)। বর্ণিত হাদীছের সংখ্যা-৮১

২. মায়মূনা বিনত আল-হারিছ, উম্মুল মু’মিনীন (রা) । বর্ণিত হাদীছের সংখ্যা-৭৬

৩. উম্মু হাবীবা, উম্মুল মু’মিনীন (রা)। বর্ণিত হাদীছের সংখ্যা-৬০

৪. আসমা’ বিন্‌ত ‘উমাইস (রা)। বর্ণিত হাদীছের সংখ্যা-৬৫

৫. আসমা’ বিন্‌ত আবী বকর (রা)। বর্ণিত হাদীছের সংখ্যা-৫৮

৬. উম্মু হানী বিন্‌ত আবী তালিব (রা)। বর্ণিত হাদীছের সংখ্যা-৪৬

৭. ফাতিমা বিন্‌ত কায়স (রা)। বর্ণিত হাদীছের সংখ্যা-৩৪

৮/ উম্মুল ফাদল বিন্‌ত আল-হারিছ (রা)। বর্ণিত হাদীছের সংখ্যা-৩০

৯. উম্মু কায় বিন্‌ত মিহসান (রা)। বর্ণিত হাদীছের সংখ্যা-২৪

১০. আর-রুবায়্যি‘ বিন্‌ত মু‘আওবিয (রা)। বর্ণিত হাদীছের সংখ্যা-২১

(বানাত আস-সাহাবা-প্র, ৬৫; টীকা-১]

তাঁর স্বামী যুবায়র (রা)ও এই শ্রেণীর বর্ণনাকারীদের অন্তর্গত। তবে তিনি তাঁর স্বামীর চেয়ে বিশটি হাদীছ বেশী বর্ণনা করেছেন। তিনি যেখানে ৫৮(আটান্ন) টি, মতান্তরে ৫৬টি হাদীছ বর্ণনা করেছে, সেখানে তাঁর স্বামীর বর্ণিত হাদছের সংখ্যা ৩৮ (আটত্রিশ)।

হযরত আসমার বর্ণিত হাদীছ সাহীহাইনসহ সুনান ও মুসনাদের বিভিন্ন গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে। ১৪ (চৌদ্দ)টি  হাদীছ সাহীহ বুখারী ও সাহীহ মুসলিমে সংকলিত হয়েছে। তাছাড়া ৪ (চার)টি বুখারী এবং ৪ (চার)টি মুসলিম এককভাবে সংকলন করেছেন।[আ‘লাম আন-নসা’ -১/৪৯; আল-ইসাবা-৪/২৩০ বানাত আস-সাহাবা-৬৫, ৬৬]

হযরত আসমা’ (রা) থেকে যে সকল মানুষ হাদীছ বর্ণনা করেছেন তাঁদে মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হলেন : তাঁর দুই ছেল- ‘আবদুল্লাহ ও‘উরওয়া, তাঁর দৌহিত্র ‘আবদুল্লাহ ইবন ‘উরওয়া, তাঁর আযাদকৃত দাস ‘আবদুল্লাহ ইবন কায়সান, ইবন ‘আব্বাস, মুহাম্মাদ ইবন আল-মুনকাদির, ওয়াহাব ইবন কায়সান ও আরো অনেকে। আর মহিলাদের মধ্যে : ফাতিমা বিন্‌ত শায়বা, উম্মু কুলছূম মাওলাতুল হাজাবা ও আরো অনেকে।[সিয়ারু আ‘লাম আন-নুবালা-২/২৯২; তাহযীব  আল-আসমা’ ওয়াল  লুগাত-২/৫৯৭; তাহযীব  আত-তাহযীব-১০/৪৫১]

হযরত আসমার (রা) মধ্যে কাব্য প্রতিভাও ছিল। তাছাড়া তিনি একজন বাগ্মী মহলা ছিলেন। স্বামী যুবায়র (রা) ও পুত্র আবদুল্লাহ (রা) শহাদাত বরণের পর তিনি যে মরসিয়া রচনা করেন তা বিভিন্ন গ্রন্থে দেখা যায়।[আ‘লাম আন-নিসা’ -১/৪৯]

তালাক

বিভিন্ন সীরাত গ্রন্থে হযরত যুবায়র (রা) কর্তৃক হযরত আসমা’কে (রা) তালাক দানের কথা সংক্ষেপে বর্ণিত হয়েছে। তবে কোন গ্রন্থে এর কোন কারণ উল্লেখ করা হয়নি। তবে ইবনুল আছীর সম্ভাব্য দু‘টি কারণের কথা বলেছেন। একটি এই যে, হযরত আসমা’ (রা) বার্ধক্যে পৌঁছে গিয়েছিলেন এবং বয়সের কারণে দৃষ্টিশক্তিও যেতে বসেছিল।[উসুদুল গাবা-৫/৩৯৩;] আর তাই হযরত যুবায়র (রা) তাঁকে দূরে সরিয়ে দিতে চান। দ্বিতীয়টি এই যে, যে কোন কারণেই হোক দু‘জনের সম্পর্কের মধ্যে তিক্ততার সৃষ্টি হয়। আর তা তালাক তথা সম্পর্ক ছিন্ন করার পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছে। প্রথম কারণটি কোনভাবেই যুক্তিগ্রাগহ্য নয়। হযরত  যুবায়র (রা) যে পর্যায়ের মানুষ তাতে কি একথা কল্পনা করা যায়  যে, বার্ধক্যের কারণে বহু সন্তানের জননী স্ত্রীকে ত্যাগ করবেন? তাও আবার যখন তিনি অন্ধ  হয়ে গেছেন? দ্বিতীয় যে কারণটির কথা বলা হয়েছে তা অবশ্য যুক্তিসঙ্গত। আ সে কারণে তালাক দেওয়া  সম্ভব। হযরত যুবায়েরের (রা) স্বভাব  ছিল একটু রুক্ষ ও কঠোর প্রকৃতির। ফলে পারস্পরিক সম্পর্কের অবনতি ঘটে এবং তা বিচ্ছেদ পর্যন্ত গড়ায়। ইবনুল আছীরের আরেকটি বর্ণনায় একথার সমর্থন পাওয়া যায়।  একবার কোন একটি কথার কারণে হযরত যুবায়র (রা) স্ত্রী হযরত  আসমার (রা)  উপর ভীষণ ক্ষেপে গেলেন। এমনকি তা মারপিট পর্যন্ত গড়ায়। আসমা’ (রা) ছেলে আবদুল্লাহকে (রা) ডাকলেন সাহায্যের জন্য। যুবায়র (রা) তাঁকে  আসতে দেখে বললেন, তুমি যদি এখানে আস তাহলে তোমার মাকে তালাক। ‘আবদুল্লাহ (রা) বললেন, আপনি আমার মাকে আপনার কসমের লক্ষ্যস্থলে পরিণত করলেন? তারপর জোর করে তিনি পিতার হাত থেকে মাকে ছাড়িয়ে আনেন। তারপর আসমা’ পৃথক হয়ে যান।[সিয়ারু আ‘লাম আন-নুবালা-২/২৯২; তারীখ আল-ইসলাম ওয়া তাবাকাত আল-মাসাহীর ওয়অল-আ‘লাম-৩/১৩৪] হিশাম ইবন ‘উরওয়াকে নিজের কাছে নিয়ে নে।[তাবাকাত -৮/২৫৩; উসুদুল গাবা-৫/৩৯৩] যাই হোক না কেন, তালাকের পর আসমা’ (রা) ছেলে আবদুল্লাহর (রা) নিকট চলে যান এবং সেখানেই অবস্থান করতে থাকেন।  হযরত ‘আবদুল্লাহ (রা) একজন বাধ্য ও অনুগত সন্তান হিসেবে আমরণ মায়ের সেবা করেন। মায়ের সন্তুষ্টিই ছিল তাঁর জীবনের একমাত্র লক্ষ্য।

হযরত যুবায়র (রা) যে হযরত আসমার (রা) সঙ্গে কঠোর আচরন করতেন সে কথা আরো কিছু বর্ণনায়  জানা যায়। যেমন আসমা’ (রা) একদিন তাঁর পিতা আবূ বকরের (রা) নিকট গিয়ে তাঁর প্রতি যুবায়রের (রা) কঠোর আচরণের অভিযোগ করলেন। আবূ বকর (রা) আসমার (রা) কথা শোনার পর প্রথমে যুবায়রের (রা) প্রশংসা করলেন এবং নানা বিষয়ে তাঁর যোগ্যতার সাক্ষ্য দিলেন। তারপর তাঁকে উপদেশ দিলেন :  আমার মেয়ে! ধৈর্য ধর।  একজন নারীর যদি একজন সৎ স্বামী থাকি এবং  সে যদি স্ত্রীর পূর্বে মারা যায়, আর স্ত্রী যদি দ্বিতীয় বিয়ে না করে তাহলে জান্নাতে তাদের আবার মিলন হবে।[আ‘লাম আন-নিসা’ -২/৪৮; বানাত আস-সাহাবা-৫৯]

বীরত্ব  ও সাহসিকতা এবং ধৈর্য ও দৃঢ়তা

প্রাচীন কাল থেকে আরব বীরত্ব ও সাহসিকতাও তাদের বিশেষ প্রকৃতি ও গুণ। এ কারণে হযত আসমা’ (রা) দানশীল হিসেবে যেমন খ্যাতি অর্জন করেছেন, তেমনি একজন সাহসী বীর মহিলা হিসেবেও প্রসিদ্ধি পেয়েছে। সা‘ঈদ ইবন আল-আসের (রা) সময় যখন মদীনার আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটে  এবং শহরে  ব্যাপকভাবে অরাজকতা ছড়িয়ে পড়ে তখন হযরত আসমা’ (রা) একটি সতীক্ষ্ণ খঞ্জর বালিশের নীচে রেখে ঘুমাতেন। লোকেরা এর কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, কোন চোর-বাটপাড় ও দুষ্কৃতিকারী যদি ঘরে ঢুকে যায় এবং আমার উপর হামলা করে তাহলে আমি তার পেট ফেড়ে ফেলবো।[নিসা’ হাওলার রাষূল-১৮৪] যুবায়রের (রা) সঙ্গে ছিলেন এবং বিখ্যাত ইয়ারমূক যুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেন।[বানাত আস-সাহাবা-৬৯।]

হযরত আসমার (রা) পুত্র ‘আবদুল্লাহর (রা) বয়স যখন পূর্ণ যৌবনকাল তখন উমাইয়্যা খলীফাদের বিরুদ্ধাচরণ করে হিজায, মিসর, ইরাক ও কুরাসানসহ সিরিয়ার বেশীর ভাগ অঞ্চলের লোকেরা তাঁকে খলীফা বলে মেনে নেয় এবং তার হাতে বাই‘আত (আনুগত্যের শপথ) করে। উমাইয়্যা খিলাফতের প্রতিষ্ঠাতা হযরত মু‘আবিয়া (রা) ইনতিকালের পূর্বে  তাঁর তাঁর  পুত্র ইয়াযীদকে খিলাফতের উত্তরাধিকারী মনোনীত করে ইসলামের ইতিহাসে প্রথম রাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা করে যান। কিন্তু ইয়াযীদের এভাবে রাজতান্ত্রিক পন্থায় ক্ষমতা গ্রহণ ও তাঁর অনৈসলামী জীবনধারা ইসলামী খিলাফতের বিভিন্ন অঞ্চলের জনসাধারণ মেনে নিতে পারেনি। হযরত আবদুল্লাহও (রা)  ইয়াযীদের বাই‘আত করতে অস্বীকার করেন। তিনি মক্কাকে ইসলামী খিলাপতের রাজধানী ঘোষণা দিয়ে সেখানে অবস্থান নেন। চতুর্দিক থেকে মানুষ দলে দলে এসে তাঁর হাতে বাই‘আত করতে থাকে। তিনি তাঁর নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে শাস কাজ পরিচালনা করতে থাকেন। যখন  আবদুল মালিক ইবন মারওয়অন খিলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করেন তখন তাঁর উযীর হাজ্জাজ ইবন ইউসুফ হযরত ‘আবদুল্লাহকে (রা) প্রতিহত করার সিদ্ধান্ত নেন।  তিনি বিশাল সমরশক্তি নিয়ে হিজরী ৭২ সনের ১লা যুলহিজ্জা মক্কা অবরোধ করেন। বাইরের সকল যোগাযোগ থেকে মক্কা সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যা। একাধারে ছয় মাস উভয়পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ চলে। দীর্ঘ অবরোধের ফলে মক্কার মানুষের জীবনধারা সংকীর্ণ হয়ে পড়ে। হযরত ‘আবদুল্লাহর (রা) সহযোগীদের সংখ্যা দিন দিন কমতে থাকে। তারা বিজয়ের কোন সম্ভাবনা না দেখে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে থাকে। তিনি তাঁর শেষ মুহূর্তের মুষ্টিমেয় কিছু অনুসারীদের নিয়ে কা‘বার হারাম শরীফে অবস্থান নেন। এখানে উমাইয়্যা সেনাবাহিনীর সাথে চুড়ান্ত সংঘরর্ষের কিছুক্ষণ পূর্বে তিনি মা আসমার (রা) সাথে শেষবারের মত সাক্ষাৎ করতে যান।  হযরত আসমা (রা)  তখন বার্ধক্যের ভারে জর্জরিত ও অন্ধ। হযরত আসমার (রা) ঘটনাবহুল জীবনের অনেক কথাই ইতিহাস ধরে রাখতে পারেনি। তবে মাতা-পুত্রের এই শেষ সাক্ষাতের সময় তিনি যে তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তা, চারিত্রিক  দৃঢ়তা, ঈমানী মজবুতী, চরম আত্মত্যাগ, আল্লাহ নির্ভরতা ও সত্যের প্রতি একনিষ্ঠতার পরিচয় দেন ইতিহাসে তা চিরদিন অম্লান হয়ে থাকবে।  মাতা-পুত্রের সেই  সংলাপটি ছিল নিম্নরূপ :

আবদুল্লাহ : মা, আস্‌-সালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লিহি ও বারাকাতুহু।

আসমা’ : ‘আবদুল্লাহ! ওয়া ‘আলাইকাস সালাম। হাজ্জাজ-বাহিনীর মিনজিনিক হারাম শরীফে অবস্থানরত তোমার  বাহিনীল উপর পাথর নিক্ষেপ করছে, মক্কার বাড়ী-ঘর প্রকম্পিত করে তুলছে, এমন চরম মুহূর্ত তোমার আগমন কি উদ্দেশ্য?

‘আবদুল্লাহ : উদ্দেশ্য আপনার সাথে পরামর্শ।

আসমা’ : পরামর্শ! কি বিষয়ে?

‘আবদুল্লাহ : হাজ্জাজের ভয়ে অথবা প্রলোভনে আমার সঙ্গীরা আমাকে বিপদের মধ্যে ফেলে চলে গেছে, এমন কি আমার সন্তান এবং আমার পরিবারের লোকেরাও আমাকে পরিত্যাগ করেছে। এখন আমার সাথ অল্প কিছু লোক আছে। তাদের ধৈর্য ও সাহস যত বেশীই হোক না কেন দু‘ এক ঘণ্টার বেশী কোন মতেই টিকে থাকতে পারবে না। এদিকে উমাইয়্যারা প্রস্তাব পাঠাচ্ছে, আমি যদি মালিক ইবন মারওয়ানকে খলীফা বলে স্বীকার করে নিই এবং অস্ত্র ত্যাগ করে তাঁর হাতে বাই‘আত হই তাহলে পার্থিব সুখ-সম্পদের যা আমি চাইবো তাই তারা দেবে- এমতাবস্থায় আপনি আমাকে কি পরামর্শ দেন?

আসমা’ (রা) একটু উচ্চস্বরে বলেন : ব্যাপারটি একান্তই তোমার নিজের। আর তুমি তোমার নিজের সম্পর্কে বেশী জান। যদি তোমার দৃঢ় প্রত্যয় থাকে যে, তুমি হকের উপর আছ এবং মানুষকে হকের দিকে আহ্বান করছো, তাহলে যারা তোমার পতাকাতলে অটল থেকে শাহাদাত বরণ করেছে, তাদের মত তুমিও অটল থাক। আর যদি তুমি দুনিয়ার সুখ-সম্পদের প্রত্যাশী হয়ে থাক, তাহলে তুমি একজন নিকৃষ্টতম মানুষ। তুমি নিজেকে এবং তোমার লোকদের ধ্বংস করছো। পুরুষের মত যুদ্ধ কর এবং জীবনের ভয়ে কোন অপমানকে সহ্য করো না। অবমাননাকর জীবনের চেয়ে সম্মানের সাথে তরবারির আঘাত খেয়ে মৃত্যুবরণ করা অনেক শ্রেয়! তুমি শহীদ হলে খশী হবো। আর যদি এই ক্ষণস্থায়ী দুনিয়অর প্রত্যাশী হও তাহলে তোমার চেয়ে নিকৃষ্ট মানুষ আর কে আছে? তুমি যদি এই ভেবে থাক যে, তুমি একা হয়ে গেছো এবং আত্মসমর্পন করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই তাহলে এই কর্মপদ্ধতি কোন সম্মানীয় ব্যক্তির নয়। তুমি কতদিন বেঁচে থাকবে? একটি সুনাম ও সুখ্যাতি নিয়ে মর। তাহলে আমি সান্ত্বনা খুঁজে পাব।

আবদুল্লাহ : তাহলে আজ আমি নিশ্চিত নিহত হবো।

আসমা’ : স্বেচ্ছায় হাজ্জাজের নিকট আত্মসমর্পণ করবে এবং বনী উমাইয়্যার ছোকরারা তোমার মুণ্ডু নিয়ে খেলা করবে, তা থেকে যুদ্ধ করে নিহত হওয়াই উত্তম।

আবদুল্লাহ : মা, আমি নিহত হতে ভয় পাচ্ছি না। আমার ভয় হচ্ছে, তারা আমাকে নানাভাবে শাস্তি দেবে। আমার হাত-পা কেটে, অঙ্গ-প্রতঙ্গ বিচ্ছিন্ন করে আমাকে বিকৃত করে ফেলবে।

আসমা’ : বেটা! নিহত হওয়ার পর মানুষের ভয়ের কিছু নেই। যবেহ করা ছাগলের চামড়া ছিলার সময় সে কষ্ট পায় না।

মায়ের একথা মুনে হযরত ‘আবদুল্লাহর (রা) মুখমণ্ডলের দীপ্তি আরো উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। তিনি বললেন : আমার কল্যাণময়ী মা, আপনার সুমহান মর্যাদা আরো কল্যাণময় হোক। এ সংকটময় মুহূর্তে আপনার মুখ থেকে কেবল একথাগুলো শোনার জন্য আমি আপনার খেদমতে হাজির হয়েছিলাম। আল্লাহ জানেন, আমি ভীত হইনি, আমি দুর্বল হইনি। তিনিই সাক্ষী, আমি যে জন্য সংগ্রাম করছি, তা কোন জাগতিক সুখ-সম্পদ ও মান-মর্যাদার প্রতি লোভ-লালসা ও ভালোবাসার কারণে নয়। বরং এ সংগ্রাম হারামকে হালাল ঘোষণা করার প্রতি আমার তীব্র ঘৃণা ও বিদ্বেষের কারণেই। আপনি যা পছন্দ করেছেন, আমি এখন সে কাজেই যাচ্ছি। আমি শহীদ হলে আমার জন্য কোন দুঃখ করবেন না এবং আপনার সবকিছুই আল্লাহর হাতে সোপর্দ করবেন।

আসমা’ : যদি তুমি অসত্য ও অন্যায়েল উপর নিহত হও তাহলে আমি ব্যথিত হবো।

আবদুল্লাহ : আম্মা! আপনি বিশ্বাস রাখুন, আপনার এ সন্তান কখনও অন্যায়, অশ্লীল ও অশালীন কাজ করেনি, আল্লাহর আইন লংঘন করেনি, কারো বিশ্বাস ভঙ্গ করেনি, কোন মুসলমান বা যিম্মীর উপর যুলুম করেনি এবং আল্লাহর রিযামন্দী অপেক্ষা উৎকৃষ্ট কোন কিছু এ দুনিয়ায় তার কাছে নেই। একথা দ্বারা নিজেকে পবিত্র ও নিষ্পাপ বলা আমার উদ্দেশ্য নয়। কারণ, আমার সম্পর্কে আল্লাহই বেশী ভালো জানেন। তারপর তিনি আকাশের দিকে মুখ উঠিয়ে অত্যন্ত বিনয়ের সাথে বলেন : ইলাহী, তুমি ভালো করেই জান যে, আমি আমার মাকে যা কিছু বলেছি তা কেবল তাঁকে সান্ত্বনা দানের জন্য। যাতে তিনি ামার এই অবস্থা দেখে কষ্ট না পান।

আসমা’ বললেন : – (আরবী****************)

‘সকল প্রশংসা সেই আল্লাহর যিনি তাঁর ও আমার পছন্দনীয় কাজের উপর তোমাকে অটল রেখেছেন।’ আমার ছেলে! আমি আশা করি তোমার ব্যাপারে আমার ধৈর্য হবে এক অতুলনীয় ধৈর্য। তুমি আমার সামনে নিহত হলে, তা হবে আমার ছওয়াবের উপলক্ষ্য। তুমি বিজয়ী হলে তা হবে আমার জন্য আনন্দের বিষয়। এখন আল্লাহর নাম নিয়ে সামনে এগিয়ে যাও। বৎস! তুমি একটু আমার কাছে এসো, আমি শেষবারের মত একটু তোমার শরীরের গন্ধ শুকি এবং তোমাকে একটু স্পর্শ করি। কারণ, এটাই তোমার ও আমার ইহজীবনের শেষ সাক্ষাৎ।

‘আবদুল্লাহ (রা) বাঁকা হয়ে মার হাত-পা চুমুতে চুমুতে ভরে দিতে লাগলেন, আর মা ছেলের মাথা, মুখ ও কাঁধে নিজের নাক ও মুখ ঠেকিয়ে শুকতে ও চুমু দিতে লাগলেন এবং তাঁর শরীরে নিজের দু‘টি হাতের স্নেহের পরশ বুলিতে দিলেন। বিদায় বেলা ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরতে গিয়ে একথা বলতে বলতে তাঁকে আবার দূরে ঠেলে দিলেন : আবদুল্লাহ! তুমি এ কী পরেছো?

-আম্মা, এ তো আমার বর্ম।

-বেটা, যারা শাহাদাতের অভিলাষী, এ তাদের পোশাক নয়।

-মা, আপনাকে খুশী করা ও আপনার হৃদয়ে প্রশান্তি দানের উদ্দেশ্যে আমি এ পোশাক পরেছি। [আসহাবে রাসূলের জীবন কথা-১/২১১-২১২]

-তুমি এটা খুলে ফেল। তোমার ব্যক্তিত্ব, তোমার সাহস এবং তোমার আক্রমণের পক্ষে উচিত কাজ হবে এনটিই। তাছাড়া এ হবে তোমার কর্মতৎপরতা, গতি ও চলাফেরার জন্যও সহজতর। এর পরিবর্তে তুমি লম্বা পাজামা পর। তাহলে তোমাকে মাটিতে ফেলে দেওয়া হলেও তোমার সতর অপ্রকাশিত থাকবে।

মায়ের কথামত ‘আবদুল্লাহ তাঁর বর্ম খুলে পাজামা পরলেন এবং একথা বলতে বলতে হারাম শরীফের দিকে যুদ্ধে যোগদানের উদ্দেশ্যে চলে গেলেন : মা, আমার জন্য দু‘আ করতে ভুলবেন না-আমার নিহত হওয়ার পূর্বে ও পরে উভয় অবস্থায়।

-আল্লাহর দরবারে দু‘আ করতে আমি কখনো ভুলবো না। কেউ অসত্যের উপর যুদ্ধ করে, কিন্তু তোমার এ যুদ্ধ সত্যের জন্য। তারপর তিনি দু‘টি হাত আকাশের দিকে তুলে দু‘আ করলেন : হে আল্লাহ, রাতের অন্ধকারে মানুষ যখন গভীর ঘুমে অচেতন থাকে তখন রাত জেগে জেগে তার দীর্ঘ ইবাদাত ও উচ্চকণ্ঠে কান্নার জন্য আপনি তার উপর রহম করুন। হে আল্লহ, রোযা অবস্থায় মক্কা ও মদীনাতে মধ্যাহ্নকালীন ক্ষুধা ও পিপাসার জন্য তার উপর দয়া করুন। হে আল্লাহ! পিতা-মাতার প্রতি সদাচরণের জন্য তার প্রতি আপনি করুণা বর্ষণ করুন। হে আল্লাহ, আমি তাকে আপনারই নিকট সোপর্দ করেছি। তার জন্য আপনি যে ফয়সালা করবেন তাতেই আমি রাযী। এর বিনিময়ে আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের প্রতিদান দান করুন।

মা হযরত আসমার (রা) কথাগুলো হযরত ‘আবদুল্লাহর (রা) অন্তরে প্রশান্তি বয়ে আনে। তিনি চলে যান এবং অত্যন্ত ধৈর্যসহকারে যুদ্ধ করে শহীদ হন। মৃত্যুর পূর্বে তাঁর মুখ থেকে নিম্নের চরণ দু‘টি উচ্চারিত হচ্ছিল : [হায়াতুস সাহাবা-১/৫৭৪; বানাত আস-সাহাবা-৭০] (আরবী***************)

আমার মা আসমা‘!  আমি তিনহত হলে আমার জন্য কাঁদবেন না। আমার আভিজাত্য ও আমার দীনদারী ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। আর অবশিষ্ট আছে একখানি ধারালো তরবারি যা দিয়ে আঘাত করতে করতে আমার ডান হাত দুর্বল হয়ে গেছে।’

সে দিন সূর্য অস্ত যাবার আগেই হযরত ‘আবদুল্লাহ (রা) তাঁর মহাপ্রভুর সাথে মিলিত হন। হত্যার পর হাজ্জাজ তার লাশ ঝুলিয়ে রেখেছিল। দাসীকে সংগে করে মা আসমা‘  (রা) এলন ছেলের লাশ দেখতে। দেখলেন, নীচের দিকে মুখ করে লাশ ঝুলানো রয়েছে। লাশের পাশে দাঁড়িয়ে অত্যন্ত শান্ত ও দৃঢ়ভাবে বললেন : ‘ইসলামের এ অশ্বারোহীর এখনো কি অশ্বের পিঠ থেকে নামার সময় হলো না?’ জনতার ভিড় কমানোর উদ্দেশ্যে তাঁকে সরিয়ে নেওয়ার জন্য হাজ্জাজ লোক পাঠায়। তিনি যেতে অস্বীকৃতি জানা। সে আবারো লোক মারফত বলে পাঠায়, এবান না এলে চুলের গোছা ধরে টেনে আনা হবে। হযরত আসমা (রা) হাজ্জাজের ভয়ে ভীত হলেন না। তার ধমকে মোটেই কান দিলেন না।

সত্য উচ্চারণ ছিল হযরত আসমার (রা) চরিত্রের উজ্জ্বলতম বৈশিষ্ট্য। হাজ্জাজের মত নরঘাতক অত্যাচারীর সামনে অত্যন্ত বলিষ্ঠ কণ্ঠে সত্য উচ্চারণ করেছেন। তার সামনা সামনি দাঁতভাঙ্গা জবাব দিয়ে তার অহঙ্কার চূর্ণ করে দিয়েছেন। হযরত ‘আবদুল্লাহর (রা) শাহাদাতের পর হাজ্জাজ হযরত আসমার (রা) নিকট এসে বলে : আপনার ছেলে আল্লাহর ঘরে ধর্ম বিরোধী কাজ করেছে ও নাস্তিকত প্রচার করেছে। তাই আল্লাহ তহাকে কঠিন শাস্তির স্বাদ গ্রহণ করিয়েছেন।

দৃঢ় কণ্ঠে আসমা‘ (রা) জবাব দেন : তুমি মিথ্যাবাদী, আমার ছেলে নাস্তিক ছিল না। সে ছিল সাওম পালনকারী, পিতামাতার অনুগত ও বাধ্য সন্তান। তবে আমি নবী কারীমের (রা) মুখ থেকে শুনেছি, ছাকীফ বংশে একজন মিথ্যাবাদী ভণ্ড এবং একজন যালিম পয়দা হবে। মিথ্যাবাদী (আল-মুখতার আছ-ছাকাফী)-কে তো আগেই দেখেছি। আর যালিম, সে তুমিই- যাকে আমি এখন দেখছি। হযরত আসমার (রা) একথা শুনে হাজ্জাজ ভীষণ উত্তেজিত হয় এবং বসা অবস্থা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে যায়। কিন্তু কোন কিছু বলার সাহস হারিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে।[সাহীহ মুসলিম, ফাদায়িল আস-সাহাবা, হাদীছ নং-২৫৪৫; তাবাকাত-৮/২৫৪; মুসনাদে আহমাদ-৬/৩৫১; সিয়ারু আ‘লাম আন-নুবালা-২/২৯৬]

অন্য একটি বর্ণনায় এসেছে। হাজ্জাজ আসমাকে (রা) লক্ষ্য করে বলে : বলুন তো আমি আল্লাহর দুশমন ‘আবদুল্লাহর সাথে কেমন ব্যবহার করেছি? আসমা’ জবাব দেন : তুমি তার দুনিয়া নষ্ট করেছো, আর সে নষ্ট করেছে তোমার আখিরাতহ। আমি শুনেছি তুমি নাকি তাকে ‘যাতুন নিতাকাইন’ তনয় বলে ঠাট্টা করেছো। আল্লাহর কসম, আমিই ‘যাতুন নিতাকাইন’। আমি একটি নিতাক দিয়ে রাসূলুল্লাহ (রা) ও আবূ বকরের (রা) খাবার বেঁধেছি। আরেকটি নিতাক আমার কোমরেই আছে।[তাবাকাত-৮/২৫৪; তারীখ আল-ইসলাম ওয়া তাবাকাত আল-মাশাহীর ওয়াল আ‘লাম-৩/১৩৬] একথাও বর্ণিত হয়েঝে যে, হাজ্জাজ আসমার (রা) নিকট এসে বলে : মা, আমীরুল মু‘মিনীন আপনার খোঁজখবর নেওয়ার জন্য আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন। আপনার কোন প্রয়োজন আছে কি? আসমা’ (রা) অত্যন্ত কঠোরভাবে বলেন : আমি তোমার মা নই। আমি রাস্তার মাথায় শূলীতে ঝোলানো ব্যক্তির মা। আমার কোন প্রয়োজন নেই।[সিয়ারু আ‘লাম আন-নুবালা-২/২৯৪]

হযরত ‘আবদুল্লাহর (রা) শাহাদাতের পর একদিন হযরত ‘আবদুল্লাহ ইবন ‘উমারকে (রা) বলা হলো : আসমা’ (রা) মসজিদের এক কোণে বসে আছেন। তিনি তাঁর দিকে একটু ঝুঁকে বললেন : এই প্রাণহীন দেহ কিছুই না। রূহ তো আল্লাহর নিকট পৌঁছে গেছে। আপনি আল্লাহকে ভয় করুন এবং ধৈর্য অবলম্বন করুন। আসমা’ বললেন : আমাকে তা করতে কিসে বারণ করেছে? নবী ইয়াহইয়া ইবন যাকারিয়ার (রা) মাথাও বনী ইসরাঈলের এক পতিতাকে উপহার দেওয়া হয়েছিল।[প্রগুক্ত-২/২৯৫; তাহযীব আল-আসমা’ ওয়াল লুগাত-২/৩৩০]

উল্লেখ্য যে, ফিলিস্তীনের শাসক হিরোডিয়ান তার ফুফু হিরোডাসকে বিয়ে করতে চাইলে ইয়াহইয়া বাধ সাথেন। কারণ, তাঁদের ধর্মে ফুফু-ভাতিজার বিয়ে সিদ্ধ ছিল না। কিন্তু কন্যা হিরোডাস ও তার মাস সম্মতি ছিল। তারা হিরোডিয়ানকে শর্ত দিল, যদি তুমি ইয়াহইয়ার মাথাটি কেটে একটি থালায় করে আমার সামনে আনতে পার তাহলে এ বিয়ে হবে। সে তাই করেছিল। হযরত আসমা’ (রা) উক্ত ঘটনার প্রতি ইঙ্গিত করেছেন।[সিয়ারু আ‘লাম আন-নুবালা’ -২/২৯৫; টীকা-১; কাসাসুল আম্বিয়া-৩৬৯]

হযরত আবদুল্লাহর লাশ কয়েকদিন যাবত ঝোলানো অবস্থায় থাকার সময় হযরত আসমা’ (রা) আল্লাহর নিকট দু‘আ করতেন এই বলে যে, হে আল্লাহ! আবদুল্লাহর গোসল দেওয়া ও কাফন-দাফনের ব্যবস্থার না করে যেন আমার মৃত্যু না হয়। লাশ নামানোর পর আসমা’ (রা) তা চেয়ে এনে অতিকষ্টে যমযমের পানি দিয়ে গোসল দেন।[যাদুল মা‘আদ-১/১৪০; তারীখ আল-ইসলাম ওয়া তাবাকাত আল-মাশাহীর ওয়াল আ‘লাম ১/৫০৩; আল-ফাকিহী বলেন : বরকত হিসেবে মক্কাবাসীরা তাদের মৃতদের যমযমের পানি দিয়ে গোসল করাতো। (নিসা’ মুবাশ্‌শারাত ফিল জান্নাহ-২৬৬] মাংস পঁচে-গলে গিয়েছিল। আসমা (রা) নিজের ছেলের এ অবস্থা দেখেও মোটেই ভেঙ্গে পড়েননি। ধৈর্যধারণ করে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করেন।

ইবন মুলাইকা বলেন : গোসলের দায়িত্ব যাদের উপর পড়েছিল তাদের মধ্যে আমিও ছিলাম। আমরা একটি অংগ ধরছিলাম, আর আমাদের হাতে সাথে চলে আসছিল। সেটি ধুয়ে আমরা কাফনের উপর রেখে আরেকটি অংগ ধরছিলাম। এভাবে আমরা তাঁর গোসল সম্পন্ন করি। তারপর তাঁর মা আসমা’ দাড়িয়ে জানাযার নামায পড়েন। মক্কার আল-মু‘আল্লাত গোরস্তানে তাঁকে দাফন করেন।[আ‘লাম আন-নিসা’ -১/৫২; বানাত আস-সাহাবা-৭১]

হযরত ‘আবদুল্লাহ ইবন যুবায়র (রা) হিজরী ৭৩ সনের জামাদি-উল-আওয়াল মাসের ১৭ তারিখ মঙ্গলবার শাহাদাত বরণ করেন। এর কয়েকদিন পরে হিজরী ৭৩ সনের মক্কায় হযরতহ আসম’ও (রা) ইহলোক ত্যাগ করেন। তখন তাঁর বয়স হয়েছিল একশো বছর। মুহাজির পুরুষ ও মহিলা সাহাবীদের মধ্যে তিনিই সর্বশেষে মৃত্যুবরণ করেন। সিয়ারু আ‘লাম আন-নুবালা-২/২৯৬; আ‘লাম আন-নিসা-১/৫২, ৫৩] এ দীর্ঘ জীবনে তাঁর একটি দাঁতও পড়েনি বা সামান্য বুদ্ধিভ্রষ্টতাও দেখা যায়নি। মক্কায় তাঁর ছেলে আবদুল্লাহর (রা) পাশেই তাঁকে দাফন করা হয়।[বানাত আস-সাহাবা-৭২]

মৃত্যুর পূ্র্বে তিনি এই বলে অসীয়াত করে যান যে, তোমরা আমার পরিধেয় বস্ত্র সুগন্ধি কাঠ জ্বালিয়ে তাতে সেঁক দেবে, তারপর আমার দেহে খোশবু লাগাবে। আমার কাফনের কাপড়ে কোন সুগন্ধি লাগাবে না, আগুন নিয়ে লাশের অনুসরণ করবে না এবং আমাকে রাতের বেলা দাফন করবে না।[তাহ্‌যীব-আল-আসমা’ ওয়াল ‍লুগাত-২/৫৯৮]

ইকরিমা ইবন আবী জাহল (রা)

মুসয়াব ইবন ’উমাইর (রা)

Leave a Reply