আবু হুরাইরা, এ নামটি জানে না মুসলিম জাতির মধ্যে এমন কেউ কি আছে? ইসলামপূর্ব জাহিলী যুগে লোকে তাঁকে ডাকতো- ‘আবদু শামস’ বলে। পরবর্তীকালে আল্লাহ তা’আলা যখন ইসলামের দিকে হিদায়াত দান করে তাঁর ওপর অনুগ্রহ করলেন এবং রাসূলুল্লাহর সা. সাথে সাক্ষাৎ দানে মাধ্যমে তাঁকে গৌরবান্বিত করলেন, রাসূল সা. তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘নাম কি?’ তিনি জবাব দিলেন, ‘আবদু শামস (অরুন দাস)।’
রাসূল সা. বললেন, ‘না আজ থেকে তোমার নাম আবদুর রহমান।’
আবু হুরাইরা রা. বললেন, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার পিতা-মাতা আপনার নামে কোরবান হোক। আমার নাম আজ থেকে আবদুর রহমান-ই হবে।’
‘আবু হুরাইরা’ তাঁর কুনিয়াত বা উপনাম। ছোট বেলায় একটি বিড়াল শাবকের সাথে তিনি সবসময় খেলতেন। তা দেখে সাথীরা তাঁর নাম দেন আবু হুরাইরা (বিড়াল শাবকওয়ালা)। আস্তে আস্তে এ নামেই তিনি সকলের মাঝে পরিচিত হন এবং তাঁর আসল নামটি ঢাকা পড়ে যায়। ইসলাম গ্রহণের পর রাসূলুল্লাহর সা. সাথে যখন তাঁর সম্পর্ক গভীর হয় তখন মাঝে মাঝে তিনি আদর করে ডাকতেন ‘আবু হিররিন’। তাই তিনি আবু হুরাইরার পরিবর্তে আবু হিররিন নামটিকেই প্রাধান্য দেন। তিনি বলতেনঃ আমার হাবীব আল্লাহর রাসূল আমাকে এ নামেই ডেকেছেন। তাছাড়া হিররুন পুং লিঙ্গ এবং হুরাইরা স্ত্রী লিঙ্গ।
আবু হুরাইরা ইসলামে দীক্ষিত হন প্রখ্যাত সাহাবী তুফায়িল ইবন আমর আদ-দাওসীর হাতে। ইসলাম গ্রহণের পর তিনি স্বীয় দাওস গোত্রের সাথেই অবস্থান করতে থাকেন। ষষ্ঠ হিজরী সনে তাঁর গোত্রের একটি প্রতিনিধিদলের সাথে তিনিও এলেন মদীনায় রাসূলুল্লাহর সা. সাথে সাক্ষাৎ করতে। আমর ইবনূর গালাস বলেন, মদীনায় তাঁর প্রথম আগমন হয় খাইবার বিজেয়র বছর সপ্তম হিজরীর মুহাররাম মাসে।
মদীনা আসার পর দাওস গোত্রের এ যুবক নিরবচ্ছিন্নভাবে রাসূলুল্লাহর সা. খিদমত ও সাহচর্য অবলম্বন করেন। রাত-দিন চব্বিশ ঘন্টা মসজিদেই অবস্থান করতে থাকেন। সব সময় রাসূলুল্লাহর সা. কাছ থেকে তালীম ও তারবিয়াত লাভ করতেন এবং তাঁরই ইমামতিতে নামায আদায় করতেন। রসালের সা. জীবদ্দশায় তাঁর স্ত্রী বা সন্তান সন্ততি ছিল না। একমাত্র তাঁর বৃদ্ধা মা ছিলেন। তখনও তিনি পৌত্তলিকতার ওপর অটল। আবু হুরাইরা স্নেহময়ী মাকে সর্বদা দাওয়াত দিতেন, আর তিনি অস্বীকার করতেন। এতে তিনি গভীর ব্যথা ও দুঃখ অনুভব করতেন। একদিন তিনি মাকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পতি ঈমান আনার আহ্বান জানালে তিনি নবী সা. সম্পর্কে এমন অশ্রাব্য কথা বলেন যাতে আবু হুরাইরা ভীষণ মর্মাহত হন। কাঁদতে কাঁদতে তখনই রাসূলুল্লাহর সা. খিদমতে হাজির হন। রাসূল সা. তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কাঁদছো কেন?’
তিনি বললেন, ‘আমি সব সময় আমার মাকে ইসলামের দাওয়াত দিই, আর তিনি অস্বীকার করেন। প্রতিদিনকার মত আজও আমি তাঁকে ইসলামের দাওয়াত দিলাম, তিনি আমাকে আপনার সম্পর্কে এমন কিছু কথা বললেন যে আমাকে ভীষণ পীড়া দিয়েছে। ইয়া রাসূলাল্লাহ, আপনি আবু হুরাইরার মায়ের অন্তরটি ইসলামের দিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য আল্লাহর দরবারে দু’আ করুন।’ রাসূল সা. দু’আ করলেন।
আবু হুরাইরা বলেন, ‘আমি রাসূলুল্লাহর সা. দরবার থেকে বাড়ীতে ফিরে গেলাম। দেখি ঘরের দরজাটি বন্ধ, তবে ভেতরে পানি পড়ার শব্দ শুনা যাচ্ছে। আমি ভেতরে প্রবেশ করতে যাব এমন সময় মা বললেন, ‘আবু হুরাইরা, একটু অপেক্ষা কর’ একথা বলে তিনি কাপড় ঠিকঠাক করে নিলেন। তারপর আমাকে ভেতরে ডাকলেন। আমি প্রবেশ করলাম। তখনই তিনি পাঠ করতে লাগলেন! ‘‘আশহাদু আন-লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসূলুহু।’’
আমি আবার রাসূলুল্লাহর সা. কাছে ফিরে গেলাম। আনন্দে তখন আমি কাঁদছি, যেমন কিছুক্ষণ আগে দুঃখে কেঁদেছিলাম। বললাম, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ, সুসংবাদ! মহান আল্লাহ আপনার দু’আ কবূল করেছেন, তিনি আবু হুরাইরার মাকে হিদায়াত দান করেছেন, আবু হুরাইরার মা ইসলাম গ্রহণ করেছেন।’
আবু হুরাইরা রাসূলকে সা. ভালোবাসতেন। সে ভালোবাসা ছিল গভীর। তিনি রাসূলের সা. দিকে এক দু’বার মাত্র তাকিয়ে পরিতৃপ্ত হতেন না। তিনি বলতেন, ‘রাসূল সা. অপেক্ষা অধিকতর সুন্দর ও দীপ্তিমান কোন কিছু আমি দেখিনি। তাঁর চেহারায় যেন সূর্যের কিরণ ঝলমল করতে থাকে।’
তিনি নবীর সা. সাহাবী হওয়ায় মর্যাদা লাভ করেছেন এবং তাঁর দ্বীনের অনুসারী হওয়ার গৌরব অর্জন করেছেন, এজন্য তিনি সব সময় মহান আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করতেন। বলতেন, ‘আবু হুরাইরাকে যিনি ইসলামের দিকে হিদায়াত দিয়েছেন, সকল প্রশংসা সেই মহান আল্লাহর। আর সকল প্রশংসা সেই আল্লাহর যিনি আবু হুরাইরাকে কুরআন শিক্ষা দিয়েছেন এবং নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর সাহচর্য দান করে অনুগ্রহ করেছেন। ‘
আবু হুরাইরা রাসূলুল্লাহর সা. প্রতি যেমন নিবেদিত ছিলেন, তেমনি ছিলেন জ্ঞানের প্রতিও কুরবান। জ্ঞান অর্জন ও জ্ঞানচর্চা তাঁর অভ্যাস ও প্রধান লক্ষ্যে পরিণত হয়েছিল। যায়িদ বিন সাবিত রা. বলেনঃ
একদিন আবু হুরাইরা, আমাদের এক বন্ধু ও আমি মসজিদে আল্লাহর কাছে দু’আ করছিলাম। এমন সময় রাসূলকে সা. আমরা দেখতে পেলাম। তিনি এগিয়ে এসে আমাদের মাঝখানে বসলেন আমরা সবাই চুপ করে গেলাম। তিনি বললেন, ‘তোমরা তোমাদের কাজ আবার শুরু কর।’ আমি ও আমার বন্ধুটি আবু হুরাইরার আগেই আল্লাহর কাছে দু’আ করলাম। রাসূল সা. আমাদের দু’আর সাথে সাথে আমীন বললেন। তারপর আবু হুরাইরা দু’আ করলেনঃ
‘হে আল্লাহ, আমি আপনার কাছে চাই, আমার দু’বন্ধু যা কিছু চেয়েছে। আর সেইসাথে চাই এমন জ্ঞান যা কখনও ভুলে না যাই।’ এবারও রাসূল সা. আমীন বললেন। আমরা দু’জনও বললাম, ‘আমরাও চাই ভুলে না যাই এমন জ্ঞান।’ রাসূল সা. বললেন, ‘দাওস গোত্রের এ লোকটি এক্ষেত্রে তোমাদের দু’জনকে হারিয়ে দিয়েছে।’
আবু হুরাইরা নিজের জন্য যেমন জ্ঞান ভালোবাসতেন, তেমনি অপরের জন্যও। ইতিহাসে এ সম্পর্কিত একটি চমকপ্রদ ঘটনার উল্লেখ আছে। একদিন তিনি মদীনার বাজারে গেলেন। সেখানে বেচা-কেনা, লেন-দেন ইত্যাদির মধ্যে মানুষের নিমগ্নতা দেখে বিস্মিত হলেন। থমকে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘ওহে মদীনাবাসী, তোমরা দারুণভাবে বঞ্চিত।’ লোকরা জিজ্ঞেস করলো, ‘আবু হুরাইরা, আপনি আমাদের বঞ্চনার কি দেখলেন?’
তিনি বললেন, রাসূলুল্লাহর সা. মীরাস (উত্তরাধিকার) বণ্টিত হচ্ছে, আর তোমরা এখানে বসে আছ? সেখানে গিয়ে তোমাদের নিজ নিজ অংশগুলি নিয়ে নাও না কেন?’
তারা বলল, ‘কোথায়?’
তিনি বললেন, ‘মসজিদে’।
লোকেরা মসজিদের দিকে ছুটে গেল। আবু হুরাইরা তাদের অপেক্ষায় সেখানে দাঁড়িয়ে। কিছুক্ষণ পর তারা ফিরে এসে বলল, ‘আবু হুরাইরা, আমরা তো মসজিদে গিয়েছি, ভেতরেও প্রবেশ করেছি, কিন্তু কোন কিছু বণ্টন হচ্ছে এমন তো দেখলাম না।’
তিনি বললেন, ‘মসজিদে তোমরা কাউকে দেখনি?’
তারা বলল, ‘অবশ্যই দেখেছি, কিছু লোক নামাযে দণ্ডায়মান, কিছু লোক কুরআন তিলাওয়াতে মশগুল এবং কিছু লোক হারাম-হালাল সম্পর্কে পরস্পর আলোচনারত।’
তিনি বললেন, ‘তোমাদের ধ্বংস হোক, এ-ই তো রাসূলুল্লাহর সা. মীরাস।’
আবু হুরাইরা মুসলিম উম্মাহর জন্য নবীর হাজার হাজার হাদীস স্মৃতিতে ধারণ করে সংরক্ষণ করে গেছেন। সহীহ বুখারীতে আবু হুরাইরা থেকে একটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহর সা. সাহাবীদের মধ্যে একমাত্র আবদুল্লাহ ইবন উমার ব্যতীত আর কেউ আমার থেকে বেশি হাদীস বর্ণনাকারী নেই। আর তাও এজন্য যে, তিনি হাদীস লিখতেন, আর আমি লিখতাম না।’
রাসূলুল্লাহ সা. থেকে এত বেশী হাদীস বর্ণনার ব্যাপারটি অনেকে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখতো। তাই তিনি বলেন, ‘তোমরা হয়তো মনে করছো আমি খুব বেশি হাদীস বর্ণনা করি। আমি ছিলাম রিক্তহস্ত, দরিদ্র, পেটে পাথর বেঁধে সর্বদা রাসূলুল্লাহর সা. সাহচর্যে কাটাতাম। আর মুহাজিররা ব্যস্ত থাকতো তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যে এবং আনসাররা তাদের ধন-সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণে।’ তিনি আরও বলেন, ‘‘একদিন আমি বললামঃ ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমি আপনার অনেক কথাই শুনি, কিন্তু তার অনেক কিছুই ভুলে যাই।’ একথা শুনে রাসুল সা. বললেন, ‘তোমার চাদরটি মেলে ধর।’ আমি মেলে ধরলাম। তারপর বললেনঃ তোমার বুকের সাথে লেপ্টে ধর। আমি লেপ্টে ধরলাম। এরপর থেকে আর কোন কথাই আমি ভুলিনি।’’ ইমাম বুখারী বলেনঃ আটশ’রও বেশী সাহাবী ও তাবেয়ী তাঁর নিকট থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন। সাহাবীদের মধ্যে যাঁরা তাঁর থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন তাদের মধ্যে ইবন আব্বাস, ইবন উমার, জাবির, আনাস, ওয়াসিলা রা. প্রমুখ বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
জ্ঞান অর্জনের প্রতি অতিরিক্ত মনোযোগ এবং রাসূলের সা. মজলিসে উপস্থিতির ব্যাপারে অত্যধিক গুরুত্ব প্রদানের কারণে জীবনে তিনি এত ক্ষুধা ও দারিদ্র সহ্য করেছেন যে তার সমকালীনদের মধ্যে কেউ তা করেননি। নিজের সম্পর্কে তিনি বলেছেনঃ
‘‘মাঝে মাঝে আমি এত ক্ষুধার্ত হয়ে পড়তাম যে, কষ্ট সহ্য করতে না পেরে রাসূলুল্লাহর কোন কোন সাহাবীর নিকট কুরআনের কোন একটি আয়াত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতাম অথচ আমি তা জানতাম। আমার উদ্দেশ্য হত, হয়ত তিনি আমার এ অবস্থা দেখতে পেয়ে আমাকে সঙ্গে করে তাঁর বাড়ীতে নিয়ে আহার করাবেন।
একদিন আমার ভীষণ ক্ষুধা পেল। ক্ষুধার যন্ত্রণায় আমি পেটে একটি পাথর বেঁধে নিলাম তারপর সাহাবীদের গমনাগমন পথে বসলাম। আবু বকরকে যেতে দেখে তাঁকে একটি আয়াত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম। মনে করেছিলাম, তিনি আমাকে তাঁর সাথে যেতে বলবেন। কিন্তু তিনি ডাকলেন না।
তারপর এলেন উমার ইবনুল খাত্তাব। তাঁকেও একটি আয়াত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম। তিনিও কিছু বললেন না। সবশেষে এলেন রাসূল সা.। তিনি আমার প্রচণ্ড ক্ষুধা অনুভব করলেন। বললেন, আবু হুরাইরা? বললাম লাব্বাইকা ইয়া রাসূলাল্লাহ একথা বলে পেছনে পেছনে আমি তাঁর বাড়ীতে গিয়ে ঢুকলাম। রাসূল সা. বাড়ীতে ঢুকে এক পেয়োলা দুধ দেখতে পেলেন। বাড়ীর লোকদের জিজ্ঞেস কররেনঃ ‘দুধ কোথা থেকে এসেছে?’
তাঁরা বললেন, ‘আপনার জন্য অমুক পাঠিয়েছে।’ রাসূল সা. বললেন, ‘আবু হুরাইরা তুমি আহলুস সুফফার নিকট গিয়ে তাদের একত্রিত কর।’ একথা বলার পর আমি খুবই মনক্ষুণ্ন হয়েছিলাম। আমি মনে মনে বলেছিলামঃ মাত্র এক পেয়ালা দুধ, আহলুস সুফফার এতগুলি লোকের কি হবে? আমি চাচ্ছিলাম, প্রথমে আমি পেট ভরে পান করি, তারপর তাদের কাছে যাই। যাইহোক, আমি আহলুস সুফফার কাছে গেলাম এবং তাদের ডেকে একত্র করলাম। তারা সমবেত হয়ে রাসূলুল্লাহর সা. কাছে বসলে তিনি বললেনঃ
আবু হুরাইরা, তুমি পেয়ালাটি নিয়ে তাদের হাতে দাও। আমি এক এক করে সবার হাতে দিলাম এবং তারা সবাই পান করে পরিতৃপ্ত হল। তারপর পেয়ালাটি হাতে নিয়ে আমি রাসূলুল্লাহর সা. কাছে ফিরে এলাম। তিনি মাথা উঁচু করে আমার দিকে চেয়ে মৃদু হেসে বললেনঃ
‘তুমি আর আমিই বাকী আছি।’ বললামঃ ‘সাদাকাতা ইয়া রাসূলুল্লাহ- সত্যই বলেছেন, হে আল্লাহর রাসূল।’ তিনি বললেন, ‘তুমি পান কর’। আমি পান করলাম। তিনি বললেন, ‘আরও পান কর।’ আমি আরও পান করলাম। এভাবে তিনি বার বার পান করতে বরলে, আর আমি বার বার পান করলাম। শেষে আমি বললা, ‘যিনি আপনাকে সত্য সহকারে পাঠিয়েছে, তাঁর শপথ, আমি আর পান করতে পারছিনে।’ অতঃপর রাসূল সা. পেয়ালাটি হাতে নিয়ে বাকীটুকু পান করলেন।
এত চরম দারিদ্র্য ও দুরবস্থার মধ্যে আবু হুরাইরাকে অবশ্য বেশি দিন থাকতে হয়নি। অল্প কালের মধ্যেই মুসলমানদের হাতে ধন ও ঐশ্বর্য আসে। চতুর্দিক থেকে প্রবহমান গতিতে গনিমাতের মাল মুসলমানদের হাতে আসতে থাকে। আবু হুরাইরা অর্থ, বাড়ী, ভূ-সম্পত্তি, স্ত্রী ও সন্তানাদি- সবকিছুর অধিকারী হন। কিন্তু এসব তাঁর মহান অন্তকরণের ওপর কোন প্রভাব ফেলতে পারেনি। তিনি তাঁর অতীত দিনের কথা একদিনের জন্যেও ভুলেননি। সবসময় তিনি বলতেনঃ
‘‘ইয়াতীম অবস্থায় বড় হয়েছি, রিক্ত হস্তে হিজরাত করেছি। পেটেভাতে, বুসরা বিনতু গাযওয়ানের মজদুরী খেটেছি। তারা যখন কোথাও তাঁবু ফেলত, তাদের নানা রকম ফুটফরমাশ পালন করতাম আর যখন তারা বাহনে আরোহন করত, তাদের উটগুলি তাড়িয়ে নিতাম। অবশেষে আল্লাহ তা’আলা বুসরাকে আমার স্ত্রী হিসাবে দান করেন। সকল প্রশংসা আল্লাহর যিনি তাঁর দ্বীনকে শক্তিশালী করেছেন এবং আবু হুরাইরাকে সে দ্বীনের একজন নেতা বানিয়ে দিয়েছেন।’’
দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমার রা. আবু হুরাইরাকে বাহরাইনের শাসক নিযুক্ত করেছিলেন। পরে তাঁকে অপসারণ করেন। তারপর আবার নিযুক্ত করতে চাইলে তিনি প্রত্যাখ্যান করেন এবং মদীনা ত্যাগ করে আকীক নামক স্থানে গিয়ে বসবাস করতে থাকেন।
হযরত মুয়াবিয়ার শাসনামলে আবু হুরাইরা একাধিকবার মদীনার শাসক নিযুক্ত হয়েছিলেন। তবে শাসন ক্ষমতা তাঁর স্বভাবগত মহত্ব, উদারতা ও অল্পেতুষ্টি ইত্যাদি গুণাবলীতে কোন পরিবর্তন সৃষ্টি করতে পারেনি।
আবু হুরাইরা তখন মদীনার শাসক। নিজ পরিবারের জন্য কাঠের বোঝা পিঠে চাপিয়ে মদীনার একটি রাস্তা দিয়ে তিনি চলছেন। পথে সা’লাবা ইবন মালিকের পাশ দিয়ে অতিক্রম করার সময় বললেন, ‘সা’লাবা, আমীরের জন্য পথটা একটু ছেড়ে দাও।’ সা’লাবা বললেন, ‘আল্লাহ আপনার ওপর রহম করুন। এত প্রশস্ত পথ দিয়েও আপনি যেতে পারছেন না?’ তিনি বললেন, ‘তোমাদের আমীর ও তার পিঠের বোঝাটির জন্য পথটা প্রশস্ত করে দাও।’
অগাধ জ্ঞান, সীমাহীন বিনয় ও উদারতার সাথে আবু হুরাইরার মধ্যে তাকওয়া ও আল্লাহপ্রীতির এক পরম সম্মিলন ঘটেছিল। তিনি দিনে রোযা রাখতেন, রাতের তিন ভাগের প্রথম ভাগ নামাযে অতিবাহিত করতেন। তারপর স্ত্রীকে ডেকে দিতেন। তিনি রাতের দ্বিতীয় ভাগ নামাযে কাটিয়ে তাঁদের কন্যাকে জাগিয়ে দিতেন। কন্যা রাতের বাকী অংশটুকু নামাযে দাঁড়িয়ে অতিবাহিত করতেন। এভাবে তাঁর বাড়ীতে সমগ্র রাতের মধ্যে ইবাদত কখনও বন্ধ হতো না।
ইকরিমা বলেন, আবু হুরাইরা প্রতিদিন বার হাজার বার তাসবীহ পাঠ করতেন। তিনি বলতেনঃ ‘আমি আমার প্রতিদিনের পাপের সমপরিমাণ তাসবিহ পাঠ করে থাকি।’
আবু হুরাইরার একটি নিগ্রো দাসী ছিল। একদিন তার আচরণে তিনি ও তাঁর পরিবারবর্গ খুবই ক্ষুব্ধ হলেন। তিনি তাকে প্রহার করতে উদ্যত হলেন। চাবুকটি উঠিয়ে আবার থেমে গেলেন। বললেন, ‘কিয়ামতের দিন যদি এর বদলার ভয় না করতাম তাহলে চাবুক মেরে তোমাকে কষ্ট দিতাম, যেমন তুমি আমাদের দিয়েছ। তবে তোমাকে আমি এমন একজনের কাছে বিক্রি করবো যিনি আমাকে তোমার ন্যায্য মূল্যই দেবেন। আর আমিও এ মূল্যেরই অধিকতর মুখাপেক্ষী। যাও আল্লাহর ওয়াস্তে তোমাকে আমি আযাদ করে দিলাম।’
আবু হুরাইরার মেয়ে একদিন বললেন, ‘আব্বা, অন্য মেয়েরা আমাকে লজ্জা দেয়। তারা বলে তোমার আব্বা তোমাকে সোনার গহনা বানিয়ে দেন না কেন?’
তিনি বললেন, ‘বেটি, তাদের তুমি বলো, আমার আব্বা জাহান্নামের লেলিহান শিখার ভয় করেন।’ মেয়েকে সোনার গহনা না দেওয়ার কারণ ধন-সম্পদের প্রতি তাঁর লালসা ও কৃপণতা নয়। তিনি তো আল্লাহর রাস্তায় খরচ করার ব্যাপারে সবসময় ছিলেন দরাজ-হস্ত। তাঁর দানশীলতা সম্পর্কে ইতিহাসে অনেক কথাই আছে। একদিন মারওয়ান ইবনুল হিকাম একশ’ দিনার আবু হুরাইরার কাছে পাঠালেন। কিন্তু পরের দিনই মারওয়ান আবার লোক পাঠিয়ে জানালেন, ‘আমার চাকরটি ভুলক্রমে দিনারগুলি আপনাকে দিয়ে এসেছে, ওগুলি আমি আপনাকে দিতে চাইনি, বরং অন্য এক ব্যক্তিকে দিতে চেয়েছিলাম’। একথা শুনে আবু হুরাইরা লজ্জা ও বিস্ময়ের সাথে বললেনঃ
‘আমি তো সেগুলি আল্লাহর রাস্তায় খরচ করে ফেলেছি। রাত পোহানো পর্যন্ত একটি দিনারও আমার কাছে ছিলনা। আগামীতে বাইতুল মাল থেকে যখন আমার ভাতা দেওয়া হবে, সেখান থেকে নিয়ে নেবেন।’ আসলে তাঁকে পরীক্ষার উদ্দেশ্যেই এমনটি করেছিলেন।
মা যতদিন জীবিত ছিলেন আবু হুরাইরা তাঁর সাথে সর্বদা সদাচরণ করেছেন। তিনি যখন বাড়ী থেকে বের হতেন, মায়ের ঘরের দরজায় গিয়ে বলতেন, ‘মা’ আস্সালামু আলাইকা ওয়া রাহমাতুল্লাহ ওয়া বারাকাতুহ।’
জবাবে মা বলতেন, ‘প্রিয় সন্তান, ওয়া আলাইকাস সালামু ওয়া রাহমাতুল্লাহ ওয়া বারাকাতুহ।’
সালাম বিনিময়ের পর আবু হুরাইরা বলতেন, ‘আল্লাহ আপনার ওপর দয়া ও অনুগ্রহ করুন, যেমন আপনি করেছেন ছোট্ট বেলায় আমার উপর।’ মা বলতেন, ‘বড় হয়ে আমার সাথে তুমি যে সদাচরণ করেছ তার বিনিময়ে আল্লাহ তোমার ওপর রহম করুন।’ বাড়ীতে প্রত্যাবর্তনের পর মাতা-পুত্রের মধ্যে এরূপ দু’আ ও সালাম বিনিময় হতো।
আবু হুরাইরা নিজে যেমন মুরুব্বিজনদের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতেন, তেমনি সকলকে তিনি উপদেশ দিতেন মাতাপিতার সাথে সদাচরণের, আত্মীয় স্বজনদের সাথে সুসম্পর্ক কায়েম রাখার। একদিন তিনি দেখতে পেলেন, দু’জন লোক রাস্তা দিয়ে পাশাপাশি হেঁটে যাচ্ছে। তাদের মধ্যে একজন অন্যজন থেকে অধিকতর বয়স্ক। কনিষ্ঠজনকে ডেকে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘সঙ্গের লোকটি তোমার কি হয়?’
সে বলল ‘আব্বা’।
তিনি বললেন, ‘তুমি কখনও তার নাম ধরে ডাকবে না, তাঁর আগে আগে চলবে না এবং তাঁর বসার আগে কোথাও বসবে না।’
অন্তিম রোগ শয্যায় তিনি আকুল হয়ে কাঁদছেন। জিজ্ঞেস করা হলো কাঁদছেন কেন? তিনি বললেন, ‘তোমাদের এ দুনিয়ার জন্য আমি কাঁদছি না। কাঁদছি, দীর্ঘ ভ্রমণ ও স্বল্প পাথেয়র কথা চিন্তা করে। যে রাস্তাটি জান্নাতে বা জাহান্নামে গিয়ে পৌঁছেছে, আমি এখন সে রাস্তার শেষ মাথায় এসে দাঁড়িয়েছি। জানিনে, আমি সেই দু’টি রাস্তার কোনটিতে যাব।’
অন্তিম রোগ শয্যায় তিনি শায়িত। মারওয়ান ইবনুল হিকাম তাঁকে দেখতে এলেন। বললেন, ‘আবু হুরাইরা, আল্লাহ আপনাকে শিফা দান করুন।’
উত্তরে তিনি বললেন, ‘আল্লাহ, আমি আপনার দিদার ভালবাসি, আপনিও আমার দিদার পছন্দ করুন এবং আমার জন্য তা তাড়াতাড়ি করুন।’
মারওয়ান তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করে বের হতে না হতেই তিনি শ্বেস নিঃস্বাস ত্যাগ করেন।
ঐতিহাসিক ওয়াকিদী বলেন, ‘ওয়ালিদ বিন উকবা’ আসরের নামাযের পর তাঁর জানাযার নামাযের ইমামতি করেন। হযরত ইবন উমার, আবু সাঈদ খুদরী রা. প্রমুখ সাহাবী তাঁর জানাযায় উপস্থিত ছিলেন।
ওয়ালিদ তাঁর মৃত্যুর খবর হযরত মুয়াবিয়ারকে অবহিত করলে তিনি তাঁকে লিখেন, তাঁর উত্তরাধিকারীদের খুজে বের করে দশ হাজার দিরহাম দাও এবং তাঁর প্রতিবেশীদের সাথে সদাচরণ কর। কারণ, উসমানের গৃহবন্দী অবস্থায় তিনি তাঁকে সাহায্য করেছিলেন।
আল্লাম ইবন হাজার আসকিলানী ‘আল ইসাবা’ গ্রন্থে আবু সুলাইমানের সূত্রে উল্লেখ করেছেন, আবু হুরাইরা আটাত্তর বছর জীবন লাভ করেছিলেন। রাসূলুল্লাহর সা. জীবন কালে তাঁর বয়স হয়েছিল তিরিশ বছরের কিছু বেশি। অনেকে মতে হিজরী ৫৫ হিজরীতে ইনতিকাল করেন; কিন্তু ওয়াকিদীর মতে তাঁর মৃত্যুসন ৫৯ হিজরী। তবে ইমাম বুখারীর মতে তাঁর মৃত্যুসন হিজরীর ৫৭।