পশ্চিমাদের ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিক ও পরিমন্ডল রয়েছে, বাস্তব জীবন থেকে ইসলামের দূরত্ব সৃষ্টির জন্য এই সবগুলোকে প্রয়োগ করা হয়। এই প্রপাগান্ডা কেবল এর ভাবমূর্তিকে খাটো করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং এর উদ্দেশ্য ছিল খিলাফতকে ধ্বংস করা, এর হুকুমসমূহকে অকার্যকর করা এবং ইসলামকে প্রাচীনকালের বিষয় হিসেবে উপস্থাপন করা। ইসলাম যাতে পুরো পৃথিবীকে আবারও নেতৃত্ব দিতে না পারে সেটাকে লক্ষ্য করেই এরূপ অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। তারা সার্বক্ষনিকভাবে ইসলামকে ভয় পায়। সে কারণে তাদের ষড়যন্ত্রও এক মুহুর্তের জন্য থেমে নেই কারণ যদি তাদের পায়ের নীচ থেকে মাটি সরে যায় এবং মুসলিমরা তাদের হারানো গৌরব ফিরে পায়।
পশ্চিমাদের দৃষ্টিতে মুসলিমরা এমন এক জাতি যারা ইসলাম দ্বারা বাঁচতে চায় এবং গোটা মানব জাতির জন্য সর্বাবস্থায় উপযোগী এই চিরন্তন দ্বীনের অধীনে ঐক্যবদ্ধ হতে তাদের হৃদয় সর্বদাই হতে মরিয়া হয়ে থাকে। তাদের কৌশলগত বিভিন্ন স্থানসমুহকে যদি তারা একটি একক রাষ্ট্রের অধীনস্থ করে কৌশলগত স্থানে পরিণত হয় তবে তারা বিভিন্ন মহাদেশকে কব্জা করবে এবং কতৃর্ত্ব নিয়ে পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। তারা সুপার পাওয়ার হওয়ার জন্য প্রয়োজনের তুলনায় বেশী সম্পদের অধিকারী যা তাদেরকে একটি নেতৃত্বদানকারী রাষ্ট্রে পরিণত করবে। তাদের জনসংখ্যা পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশ। শত্রুদের দুশ্চিন্তা এবং বিচলিত হওয়ার আরও কারণ হলো যদি আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা মুসলিমদের বিজয় দান করেন, তাহলে মুসলিমরা যে শুধু কাফিরদের ভূমি ও অন্যান্য সম্পদ দখল করে নিবে তা নয়, বরং তারা মানুষের হৃদয়কে দখল করে নিবে যার ফলে সব মানুষ কুফরীর অন্ধকার থেকে ইসলামের আলোকবর্তিকার দিকে প্রত্যাবর্তন করবে। কারণ মুসলিমরা মনে করে এ পৃথিবী এবং তার মধ্যকার সব কিছুর চেয়ে কাউকে ইসলামের ছায়াতলে নিয়ে আসা অধিকতর মূল্যবান।
আর এই কারণে ইসলামী শাসন এবং নিজ জাতি ও অন্যান্য জাতির উপর থেকে পশ্চিমাদের প্রভাব অপসারণে নিয়োজিত নিষ্ঠাবান ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অনেক ষড়যন্ত্র প্রত্যক্ষ করতে হয়েছে। আর ইসলামের ব্যাপারে তাদের ভীতি অনুযায়ী আনুপাতিক হারে তাদের ষড়যন্ত্রের মাত্রাও বেড়ে চলেছে।
ইসলাম আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা’র কতৃর্ক মনোনিত সত্য দ্বীন না হলে এতদিনে তা সম্পূর্ণ মুছে যেতো, বিলুপ্ত হতো এবং পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যেতো। তবে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা’র ইচ্ছাই প্রাধান্য পেয়েছে এবং তাঁর প্রতিশ্রুতিই কার্যকর। মুসলিমদের চরম অধঃপতনের সময়েও তারা তাদের দ্বীনের প্রতি অনুগত ছিল। তবে পশ্চিমারা মুসলিমদের ভ্রান্ত মানদন্ড গ্রহণ করা, চিন্তাকে ত্রুটিপূর্ণ করা ও মানসিকতাকে কলুষিত করতে সমর্থ্য হয়েছিল। আর এই কারণে পশ্চিমারা প্রথম ক্রুসেড থেকে অনুধাবন করতে পেরেছিল যে, মুসলিমদের হৃদয়ে ইসলাম খুব ভালভাবে প্রোথিত হয়েছে এবং সমূল উৎপাটনের যে কোন অপচেষ্টার চেয়ে তা অধিকতর শক্তিশালী। সে কারণে দ্বিতীয় পর্যায়ের ক্রুসেডের সময় তারা কৌশল পরিবর্তন করে, যার কুফল এখনও আমরা বয়ে বেড়াচ্ছি: যেখানে তারা মুসলিমদের দ্বীন থেকে বিচ্যুত করার পরিকল্পনা করে এবং তাদের চিন্তা, বিশ্বাস ও বুদ্ধিবৃত্তিক মানদন্ডের প্রসার ঘটাতে শুরু করে যাতে তাদের বস্তুগত সার্বিক নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠিত হয়। এজন্য প্রথমে তারা মুসলিমদের বুদ্ধিবৃত্তিক দাসত্বকে পাকাপোক্ত করলো এবং বস্তুগত নিয়ন্ত্রনের মাধ্যমে তা বজায় রাখলো। অতঃপর তারা এমন শাসকদের মুসলিমদের উপর ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করালো যারা দূষিত বুদ্ধিবৃত্তিক ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়া দ্বারা পরিবেষ্টিত ছিল। রাষ্ট্রকে এর সাথে সম্পৃক্ত করে নিজস্ব স্বার্থে তারা পুরো পৃথিবীকে একটি কোম্পানীর মত একমুখী করে তুললো যেন পশ্চিমারা অর্থলগ্নিকারী ও উৎপাদকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় এবং অন্য রাষ্ট্রগুলো শ্রমিক ও ভোক্তা শ্রেণীতে পরিণত হয়। এরপর তারা পুরো বিশ্বকে প্রচারমাধ্যমের নেটওয়ার্ক দ্বারা এমনভাবে আচ্ছাদিত করলো যেন অন্য রাষ্ট্রের প্রচারমাধ্যমগুলো এদের অধীনস্থ হয়ে থাকে। এসব প্রচেষ্টার পেছনে তাদের কামনা ছিল, তারা যা লিখবে আমরা তাই পড়বো, তারা যা বহন করবে আমরা তাই শুনবো, তারা যা প্রচার করবে আমরা তাই প্রত্যক্ষ করব এবং একমাত্র তাদের ইচ্ছেমতো সবকিছু আমরা অনুধাবন করবো ও কথা বলবো। এটা ছিল নব্য উন্নততর ঔপনিবেশবাদ। পুরনো ঔপনিবেশবাদের চেয়ে এটা ভয়ঙ্কর ও মারাত্নক। পুরনো ঔপনিবেশবাদ বাহ্যিকভাবে পদানত করতো। আর নব্য ঔপনিবেশবাদ কোন কিছুর তোয়াক্কা না করে একজনকে ভেতরে ও বাইরে থেকে সার্বিকভাবে গ্রাস করে ও চূড়ান্ত পদানত করে।
এমনকি আমাদের দ্বীনকে বুঝার ক্ষেত্রে পশ্চিমারা তাদের পছন্দমতো পদ্ধতিকে নির্ধারণ করলো। যে এই দৃষ্টিভঙ্গী বিচ্যুত হলো তার বিরুদ্ধে পশ্চিমারা তাদের মিডিয়া প্রপাগান্ডা করতে আঁটঘাঁট বেঁধে নেমে পড়লো। অর্থাৎ তারা ইসলামকে একটি অস্বাভাবিক পদ্ধতিতে ব্যাখ্যা করা শুরু করলো এবং এর ঐতিহ্য, নিয়মনীতি ও ঐক্যমতকে ভাঁঙ্গার চেষ্টা করলো। তারা ইসলামের সাথে চরমপন্থা, সন্ত্রাসবাদ, মৌলবাদ ও ধর্মান্ধতার লেবেল এটে দিলো। তারা দ্বীনকে মানবতার বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দেখানোর চেষ্টা করলো যে এটি অন্ধকারাচ্ছন্ন ও অন্ধকারের মধ্যেই থাকতে পছন্দ করে। এবং এটা আক্রমণাত্নক ও প্রকাশভঙ্গীর দিক থেকে বিদ্বেষভাবাপন্ন যা ঘৃণা ছড়ায়। মূল চিত্রকে বিকৃত করে ও সত্যকে গোপন করার পর বিভিন্ন শাসন দ্বারা তারা এটাকে আঘাত করলো এবং এমনভাবে আঘাত করলো যেন এটাই এর প্রাপ্য ছিল। লোকদের অজ্ঞতার উপর নির্ভর করে তারা এগুলো করলো এবং এতে সহায়তা করলো এমন কিছু বুদ্ধিজীবি যারা পশ্চিমাদের সবকিছুতেই গুণমুগ্ধ ছিল।
বর্তমানে উম্মাহ্’র জাগরণের কারণে দ্বীনের বিরুদ্ধে তাদের ষড়যন্ত্র কঠিন হয়ে পড়েছে। উম্মাহ্ আজ পশ্চিমাদের, এসব শাসকদের এবং তাদের তল্পীবাহক তথাকথিত উলামাদের একই চোখে দেখা শুরু করেছে; শয়তান হিসেবে এবং শাসকদের শয়তানের অনুসারী হিসেবে। আর এইসব তথাকথিত পন্ডিতেরা রাতারাতি এ অবস্থানে পৌঁছাতে পারতো না, যদি না তারা একই হারে শাসকদের সম্মুখে ইসলামের সম্মানকে বিকিয়ে দিত। এরা অধঃপতিত পন্ডিত। এই অধঃপতনের দিন যেদিন শেষ হবে সেদিন তাদেরও সমাপ্তি ঘটবে। সঠিক ইসলামী পূণর্জাগরণের ধারকগণ সাদামাটা পোশাকে আর্বিভূত হতে পারেন, কিন্তু তারা সৎ ও আল্লাহভীরু।
আজ আমরা এমন এক সময়ে বসবাস করছি যখন পশ্চিমারা ও শাসকগণ ইসলামী শাসন ফিরে আসার ভয়ে ভীত। তাই তারা সকল প্রকার ইসলামী আন্দোলনকে হুমকি হিসেবে গণ্য করে এবং এগুলোকে নিয়ন্ত্রিত রাখতে ও এগুলোর উপর সকল ধরনের দোষ চাপাতে মিডিয়াকে ব্যবহার করছে, প্রপাগান্ডা অব্যাহত রেখেছে এবং তাদের পোষ্য তথাকথিত উলামাদের ব্যবহার করছে। এবং শুধুমাত্র ইসলামী শাসনের দিকে আহ্বানকারী আন্দোলনসমূহকে তারা সন্ত্রাসী বা চরমপন্থী হিসেবে আখ্যায়িত করছে। কিছু মুসলিম চিন্তাবিদ, এবং কিছু জাতীয়তাবাদী ও দেশপ্রেমিক লেখক চরমপন্থা পরিত্যাগ করে উদারপন্থার দিকে আহ্বানের জন্য বক্তব্য প্রদান ও বই লিখেছেন। কেবলমাত্র পশ্চিমাদের সন্তুষ্টির জন্যই তারা এ অবস্থান নিয়েছেন। মুসলিম পন্ডিতরা যদি এতে অংশগ্রহণ না করতেন এবং পশ্চিমাদের অবস্থান বৈধ ও গ্রহণযোগ্য করে তোলার চেষ্টা না করতেন তবে আমরা তাদের কাজের দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নিতামনা। কেননা জনগণের কাছে এসব লোকদের কোন মূল্য নেই, বরং তারা তাদের কাছে শাসকদের মতোই। অনেক সময় তাদের এ আক্রমণ তাদের নিজেদের দিকেই ফিরে আসে। এমনকি উম্মাহ্ এসব পন্ডিত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং তাদের প্রতি পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে, কারণ তারা তাদের অবস্থানের পক্ষে প্রতিনিয়ত নিত্য নতুন অজুহাত দাঁড় করায়, এবং মনগড়া ফতোয়ার মাধ্যমে শারী’আহ্’র প্রতিষ্ঠিত মূলনীতির ব্যাত্যয় ঘটায়। তাদের ফতোয়া ইসলামের সাথে শুধু সাংঘর্ষিকই নয় বরং দালিলিকভাবে প্রমাণিত ও গ্রহণযোগ্য অকাট্য শারী’আহ্ দলিলকেও তারা সম্পূর্ণ পরিত্যাগ করেছে। এমনকি তাদের কিছু কিছু ফতোয়া এমন যার কারণে অসৎ কাজের আদেশ প্রদান করা হয় এবং সৎ কাজের নিষেধাষ্ণা দেয়া হয় (আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা আমাদের এই অনিষ্ট থেকে মুক্ত রাখুন!)। এসব আলেমাগণ আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা নন, বরং কেবলমাত্র শাসক ও তাদের প্রভূদের সন্তুষ্ট করার জন্য ইসলাম থেকে অনেক দূরে থেকে এসব চিন্তা উপস্থাপন করেন। যখন তারা মুসলিমদের জন্য উৎকন্ঠা প্রকাশ করেন এবং ইসলামী দাওয়াহ্ নিয়ে বক্তব্য উপস্থাপন করেন তখন উম্মাহ্ তাদের চিন্তার গলদ ধরে ফেলে এবং তাদের সমর্থকদের পথভ্রষ্টতা অনুধাবন করে।
এ ভূমিকার পর যে জিনিসটি অনুধাবন করা জরুরী, তা হলো ‘চরমপন্থা এবং উদারপন্থা’ বিষয়ক আলোচনার যৌক্তিকতা। আমরা ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গী থেকে বিষয়টিকে উপস্থাপনের চেষ্টা করবো যাতে মুসলিমরা কোন দ্বন্দ্ব ছাড়া সত্যকে উপলদ্ধি করতে পারে। কেননা শুধু আবেগ সত্যকে হৃদয়াঙ্গম করার জন্য যথেষ্ট নয়। পূর্বের মতো আমরা শারী’আহ্’র মূলনীতি অনুসারে এ বিষয়ে আলোকপাত করবো যাতে তা ইসলামী আক্বীদার ভিত্তিতে গড়ে উঠা বিশ্বাসের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হয়।
মানব জীবনের সামগ্রিক অবস্থাকে সুবিন্যস্ত করতে ইসলাম এসেছে। সুতরাং এতে ব্যক্তির সাথে ব্যক্তির সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা রয়েছে, যেমন: আখলাক বা চরিত্র, মা’তুমাত বা খাদ্যদ্রব্য এবং মালবুসাত বা পরিচ্ছদ। এতে ব্যক্তির সাথে সমাজের অন্যান্য ব্যক্তির সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা রয়েছে, যেমন: মু’আমালাত বা সামাজিক আচার ব্যবহার এবং উকুবাত বা শাস্তি। এবং এতে ব্যক্তির সাথে স্রষ্টার সম্পর্ক নিয়েও আলোচনা রয়েছে, যেমন: আক্বাইদ বা বিশ্বাস এবং ইবাদত বা উপাসনা। কেননা মানুষের যেকোন কাজের সমাধানের ক্ষেত্রে ইসলাম পূণার্ঙ্গ। এটি একটি সামগ্রিক চিন্তা যা থেকে মানব জীবনের সকল সমস্যা সমাধান পাওয়া যায়।
তাছাড়া ইসলামের গঠন পূণার্ঙ্গ ও সামগ্রিক যা একটি বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত এবং এ বিশ্বাস থেকে সকল চিন্তা ও সমাধান উৎসারিত হয়। আর তাই এর চিন্তা, বিশ্বাস এবং মাপকাঠি এর মৌলিক চিন্তার মতই একই প্রকৃতির। এর ব্যাখ্যা হিসেবে বলা যায়, আল্লাহ্’র উপর মুসলিমদের ঈমানের উপর ভিত্তি করে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত এবং তিনি হলেন আল খালিক বা স্রষ্টা, আল মুদাব্বির বা সববিষয়ের নিয়ন্ত্রণকারী। আর এ বিষয়ে মানুষ হলো দূর্বল, পরনির্ভরশীল, মুখাপেক্ষী, অভাবী ও সমাধান প্রদানের ক্ষেত্রে অক্ষম। সে কারণে তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা), রাসূল (সা)-কে এই শিক্ষা প্রদানের জন্য প্রেরণ করলেন যে, আল্লাহ্ হলেন আল মাবুদ বা উপাসনার জন্য একমাত্র যোগ্য সত্ত্বা এবং কীভাবে তাঁর উপাসনা করতে হবে এবং তাঁর ইবাদত পালন করা ও না করার সাথে কিভাবে আখিরাতের সওয়াব বা পুরষ্কার এবং ইক্বাদ বা শাস্তি জড়িত। এটি মুসলিমদের যেকোন কাজের জন্য একটি প্রক্রিয়া সুনির্ধারিত করে দেয় এবং তা হলো হালাল এবং হারাম। সে কারণে তার মন যথেচ্ছভাবে আচরণ করে না বা আইনপ্রণেতা বনে যায় না অথবা শারী’আহ্ বাণীর সাথে কোন মনগড়া আইনকে যুক্ত করে না। বরং শারী’আহ্ কী বলেছে সেটাকে হৃদয়াঙ্গম করার চেষ্টা করে মাত্র। শারী’আহ্ গ্রহণ করতে হবে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা’র পক্ষ থেকে, আর এখানে মানুষের কাজ হলো এগুলোকে গ্রহণ করার জন্য সঠিকভাবে বুঝা। বুঝার ক্ষেত্রে সঠিক বা ভুল হতে পারে। উভয়ক্ষেত্রে ইজতিহাদের সঠিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করলে সে পুরষ্কৃত হবে। ইসলাম মুসলিমদের দলিল প্রমাণের বিশুদ্ধতা নিশ্চিত হওয়ার উপর জোর দেয়। এজন্য ইল্ম আল হাদীস বা হাদীস সম্পর্কিত বিশেষ জ্ঞানের উত্থান হয়েছে এবং সর্বোপরী এ সচেতনতা থেকে উসূল আল ফিকহ্ উৎপত্তি লাভ করেছে। এর কিছু কিছু মূলনীতি ইতিমধ্যে সংরক্ষিত হয়েছে, যেমন: ‘আল্লাহ্ হলেন হাকিম বা বিচারক’, ‘শারী’আহ্ দলিলের গ্রহণযোগ্যতাই হলো কাজ বা যেকোন কিছুর ভিত্তি’, ‘শারী’আহ্ যাকে সুন্দর বলে তাই সুন্দর এবং যাকে কুৎসিত বলে তাই কুৎসিত’, ‘ভাল তাই যা আল্লাহকে সন্তুষ্ট করে এবং মন্দ তাই যা তাকে অসন্তুষ্ট করে।’ আমরা এটাও দেখতে পাই যে, মুসলিমদের বিশ্বাস অনুযায়ী সুখ হচ্ছে যা আল্লাহকে সন্তুষ্ট করে এবং প্রবৃত্তি ও জৈবিক চাহিদার প্রশান্তি হচ্ছে আল্লাহ্’র প্রতি বিশ্বাস ও তাঁর প্রদত্ত শারী’আহ্ অনুসরণের মধ্যে। এজন্য আমরা দেখতে পাই, সামগ্রিক কাঠামোগত দিক থেকে ইসলাম পরিপূর্ণ এবং এর সকল চিন্তা সুসামঞ্জস্যপূর্ণ ও একটি ভিত্তির উপর সুপ্রতিষ্ঠিত। আর এই ভিত্তি যা কিছুকে বৈধতা দেয় তাই গ্রহণযোগ্য, অন্যথায় নয়।
আদর্শ হিসেবে ইসলামের ক্ষেত্রে যা প্রযোজ্য পুজিবাদের ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য। কেননা এটি একটি আদর্শিক চিন্তা এবং এর বুদ্ধিবৃত্তিক গঠনও সুসামঞ্জস্যপূর্ণ। সুতরাং হয় একে পরিপূর্ণভাবে গ্রহণ করতে হবে, অন্যথায় পরিপূর্ণভাবে পরিত্যাগ করতে হবে। দ্বীনকে জীবন থেকে পৃথকীকরণের মৌলিক চিন্তা থেকে পুজিবাদের সমাধানসমূহ উৎসারিত এবং এর উপর ভিত্তি করে সমস্ত চিন্তা গঠিত হয়েছে। আপোষের ভিত্তি উপর প্রতিষ্ঠিত, দ্বীনকে জীবন থেকে পৃথকীকরণের এই মৌলিক চিন্তা মানুষকে তার নিজের প্রভু বানায়। নিজেকে নিজের প্রভূ বানাতে হলে এবং চার ধরনের স্বাধীনতার পথকে অবরুদ্ধ হওয়া থেকে মুক্ত হতে হলে, তার উপর অন্য কারো অভিভাবকত্বকে অস্বীকার করতে হবে। আর এভাবেই স্বাধীনতার চিন্তা জাগ্রত হয়, যা একটি বিশেষ অর্থ বহন করে। নিজেই নিজের প্রভূ বনে যাওয়ার অর্থ হলো কোনরকম বাহ্যিক হস্তক্ষেপ ছাড়া শুধুমাত্র নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গীর আলোকে কোন ধর্ম কিংবা অন্যকোন উৎস থেকে মৌলিক চাহিদাসমূহের নিরাপত্তার বিধি-বিধানসমূহ গ্রহণ করা। আর এভাবেই গণতন্ত্রের ধারণা ব্যুৎপত্তি লাভ করে। যে ব্যক্তি দ্বীনকে জীবন থেকে পৃথকীকরণের মৌলিক চিন্তাকে গ্রহণ করেছে সে সর্বোচ্চ পরিমাণে ইন্দ্রিয় সন্তুষ্টিকে সুখ বলে সংজ্ঞায়িত করবে। প্রবৃত্তি নিজেই আইন প্রণেতা হবার দরুণ স্বার্থ হাসিল করাই হয়ে পড়ে যেকোন কাজের লক্ষ্য।
যখন চিন্তা সুসামঞ্জস্যপূর্ণ হয়, তখন এটি অন্য কোন চিন্তার মিশ্রণকে সাধুবাদ জানায় না। শারী’আহ্ পরিভাষায় মিশ্রণ হলো শিরক, হয় এটা কুফর অথবা গুণাহ্।
গণতন্ত্র মানুষের শাসন আর ইসলাম হলো শারী’আহ্’র শাসন, তাই ইসলাম যেমন গণতন্ত্রকে গ্রহণ করে না, ঠিক একইভাবে পুঁজিবাদী চিন্তাও ইসলামকে গ্রহণ করে না কারণ তাহলে তা হবে গণতন্ত্র ও তা থেকে উদ্ভুত সব চিন্তাকে অবলুপ্ত করা। একারণে পশ্চিমারা ক্ষমতা গ্রহণের জন্য সামগ্রিক ইসলামের দিকে আহ্বানকারী ও আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়েছে। পশ্চিমাদের দৃষ্টিতে এধরনের আন্দোলন ভয়ঙ্কর যা তাদেরকে তাদের ভিত্তিমূল থেকে অপসারণ করবে। এই দৃষ্টিভঙ্গী থেকেই পশ্চিমারা এধরনের আন্দোলনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে, আগ্রাসন চালায়, চিরশত্রু মনে করে এবং বিভিন্ন লেবেল এটে দেয়। পশ্চিমাদের দৃষ্টিতে এরাই মৌলবাদী, কারণ এরা এমন একটি মূলনীতির উপর প্রতিষ্ঠিত যা তাদের অস্তিত্বকে স্বীকৃতি দিতে প্রস্তুত নয়, এরাই চরমপন্থী কেননা এরা তাদের সাথে আপোষ করতে চায় না, এরাই উগ্রপন্থী কেননা এরা তাদের আহ্বানকে সম্মান দেখায় না এবং তাদের অস্তিত্বকে বিবেচনা করেনা। যদি আমরা এ বিষয়টি নীরিক্ষা করি তবে দেখব যে তারা অন্যদেরকে যে কাজের লেবেল দিচ্ছে তারা নিজেরাই বরং সেসব কাজে লিপ্ত এবং এসব লেবেল তাদের নিজেদের উপরই প্রযোজ্য। পশ্চিমা দৃষ্টিভঙ্গীর বিচারে তারা মৌলবাদী, কেননা তারা একটি মূলনীতির উপর প্রতিষ্ঠিত যার উপর তাদের বিশ্বাস রয়েছে এবং এর বিপরীত অন্যকোন কিছুকে তারা এর উপর প্রাধান্য দিতে প্রস্তুতি নয়, যদিও মুখে তারা বলে গণতন্ত্রে জনগণের পছন্দ অনুসারে যে কেউ ক্ষমতায় আসতে পারে। তাছাড়া তারাই চরমপন্থী, সন্ত্রাসী, উগ্রপন্থী কারণ তারা রাজনৈতিক ইসলামের অস্তিত্বকে মেনে নেয় না, অথবা এর সাথে আলোচনায় বসে না, এমন কি এর সাধারণ বিষয়সমূহকে নিয়েও নয়। এভাবে কতবার পশ্চিমারা তাদের জীবনব্যবস্থাকে নিয়ে দ্বন্দে জড়াবে এবং অন্যের প্রতিকৃতিতে ঝাঁপ দিবে? এটা কী ধরনের গণতন্ত্র যে তারা নির্বাচন বাতিল করে দেয় যা কিনা তাদের দৃষ্টিতে জনগণের দৃষ্টিভঙ্গী প্রতিফলনের পথ এবং একনায়কন্ত্র কায়েম করে?
তাই আমরা যখন কোন চিন্তাকে সঠিক অথবা ভ্রান্ত এরূপ রায় দিব তখন এর ভিত্তিকে আলোচনায় আনতে হবে এবং এই ভিত্তি দিয়ে একে নিরীক্ষণ ও বিচার বিবেচনা করতে হবে। একটি আংশিক চিন্তাকে অন্য একটি চিন্তার ভিত্তি দিয়ে নিরীক্ষা করা সঠিক নয়। আমরা কখনো বলতে পারবো না যে, ইসলামে সুখ হলো ইন্দ্রিয়গত পরিতুষ্টি। অথবা বলতে পারবো না মুসলিমগণ পশ্চিমাদের মতো স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে। কারণ ইসলাম এসবের সাথে একাত্নবোধ করে না অথবা এসবকে গ্রহণ করে না। যে ব্যক্তি ইসলামকে ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করেছে সে অবশ্যই যা কিছু ইসলাম থেকে উদ্ভুত তাকেই গ্রহণ করবে এবং ইসলামকে পূর্ণাঙ্গরূপে গ্রহণ করবে। কেননা এর কিছু অংশ প্রত্যাখ্যান করা পুরোটাকে প্রত্যাখ্যান করার শামিল। তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেন,
“তবে কি তোমরা কিতাবের কিয়দংশ বিশ্বাস করো এবং কিয়দংশ অবিশ্বাস করো। যারা এরূপ করে, পার্থিব জীবনে দুর্গতি ছাড়া তাদের আর কোনই পথ নেই। কিয়ামতের দিন তাদেরকে কঠোরতম শাস্তির দিকে পৌঁছে দেয়া হবে।”
(সূরা বাক্বারা:৮৫)
এ দৃষ্টিভঙ্গী থেকে আমরা পশ্চিমাদের এই ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করতে পারি যে, ইসলাম একটি উদার দ্বীন এবং এটা কট্টরপন্থাকে অস্বীকার করে। কথাটি শুনতে মিষ্টি হলেও এতে পশ্চিমাদের কু অভিপ্রায় রয়েছে। কারণ তারা তাদের ভ্রান্ত চিন্তার উপর ভিত্তি করেই এসব মন্তব্য করে থাকে।
তাই তাতারুফ (কট্টরপন্থা), ঘুলুও (অতিরিক্ত), ইসরাফ (অতিরঞ্জিত করা) অথবা ইফরাত (অসংযম) এমন কিছু শব্দ যেগুলোর রয়েছে শারী’আহ্গত অর্থ। যদি একজন মুসলিম এর সাথে অমত পোষণ করে তবে সে গুণাহ্গার হবে। একইভাবে ই’তিদাল (উদারীকরণ), ইক্বতিসাদ (মধ্যপন্থা অবলম্বন), ইসতিকামাহ ( সোজা পথ) এবং ওয়াসাতিয়্যাহ (উদারীকরণ) শব্দসমূহেরও একই শারী’আহ্গত অর্থ রয়েছে এবং তা অনুযায়ী এগুলোকে মুসলিমদের গ্রহণ করতে হবে। একই কথা তাফরীত (অবহেলা) এবং তাসাহুল (উদাসীন্যতা) এর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। আমরা যখন এগুলো সম্পর্কে শারী’আহ্গত নিয়মনীতিসমূহ জানার চেষ্টা করবো তখন কখনওই পুজিবাদীদের বিশ্বাস ও মাপকাঠির ভিত্তিতে কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হবো না। কারণ তা হারাম। তাছাড়া তা পশ্চিমাদের এবং তাদের চিন্তাকে তুষ্ট করে, এবং ইসলাম ও ইসলামী চিন্তাসমূহের মূল্যায়নে ইসলাম ব্যাতীত অন্যকিছুকে ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করে।
অনেক শারী’আহ্ নিয়ম রয়েছে যেগুলোকে মুসলিমদের গ্রহণ করতে হবে। অন্যথায় পরিত্যাগ করলে সে গুণাহ্গার হবে। পশ্চিমারা এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গী পোষণকারীদের কট্টরপন্থী, মৌলবাদী ও সন্ত্রাসী বলে অভিহিত করে। আল্লাহ্’র রাস্তায় জিহাদ করা, খিলাফত প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করা, মা’রুফ এর আদেশ প্রদান করা ও মুনকারকে নিষেধ করা যেখানে শাসকরাও যুক্ত রয়েছেন, কুফরের বিরুদ্ধাচরণ করা, দাওয়াহ্’র দায়িত্ব বহন করা, গণতন্ত্রকে প্রত্যাখ্যান করা, সুদকে নিষিদ্ধ করা, নারীদের হিজাব পরিধান করা প্রভৃতি বাধ্যতামূক কাজকে অবশ্যই মুসলিমদের সম্পাদন করতে হবে। আমরা কি এগুলোকে পশ্চিমা নষ্ট ও ভ্রান্ত চিন্তা দ্বারা মূল্যায়ন করবো, যা এখনও পর্যন্ত তাদের নিজেদের জন্য কল্যাণ বয়ে আনতে পারেনি আর অন্যদের জন্য কল্যাণ বয়ে আনার চিন্তা তো সুদূর পরাহত? তাছাড়া মুসলিমগণ কি এমন কোন কিছুর পক্ষাবলম্বন করবে যে ব্যাপারে পশ্চিমারা অবস্থান নিয়েছে?
এজন্য কট্টরপন্থা বা উদারপন্থা বুঝার ক্ষেত্রে আমাদেরকে অবশ্যই পশ্চিমাদের চিন্তাকে পরিত্যাগ করতে হবে। দ্বীনের ব্যাপারে তাদের হস্তক্ষেপকে অবশ্যই প্রত্যাখ্যান করতে হবে। আর এ কারণেই শুরু থেকে এই আলোচনা শারী’আহ্’র ভিত্তিতে অগ্রসর হয়নি। কেননা এটি একটি রাজনৈতিক অবস্থান যাকে পশ্চিমাদের অনুকূলে উম্মাহ্’র ভেতরে সুরঙ্গ তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। এবং এই আলোচনার মাধ্যমে মুসলিমদের মনোবৃত্তির ভেতর পশ্চিমা ঔপনিবেশবাদী চিন্তার ধারবাহিকতা বলবৎ থাকে।
এখন আমরা একটি শারী’আহ্ দৃষ্টিভঙ্গী থেকে এ বিষয়ে ইসলাম কী বলে তা বুঝার চেষ্টা করবো যাতে তা দাওয়াহ্’র জন্য সুবিধাজনক হয় এবং আমাদেরকে আল্লাহ্’র আরও নিকটবর্তী করে।
আল মুগহালাহ (কট্টরপন্থা) অথবা ঘুলুহ (অতিরিক্ততা) হলো কোন কিছুকে বাড়িয়ে বলা বা অতিরঞ্জিত করা। দ্বীনের মধ্যে মুগহালাহ হলো হুকুমের সীমাকে অতিক্রম করার ক্ষেত্রে দৃঢ় থাকা বা অটল থাকা। একে ইফরাতও বলা হয়। মুগহালাহ-এর বিপরীত হল তাফরীত বা উদাসীনতা, যা ‘ফারাতাহ্’ শব্দ থেকে উদ্ভুত, ফারতানের ক্ষেত্রে, যার অর্থ হলো পেছনে পড়া, অপচয় করা এবং এর প্রতি শৈথিল্যতা প্রদর্শন করা। দ্বীনের ব্যাপারে তাফরীত অর্থ হলো এর হুকুম সম্পর্কে অবহেলা করা, এর হক্ক আদায় না করা এবং এ দায়িত্ব পালনে শৈথিল্যতা প্রদর্শন করা। এ থেকেই এ কথার উৎপত্তি হয়েছে যে, ‘লা ইফরাত ওয়া লা তাফরিত ফিল ইসলাম’ অর্থাৎ ইসলামে বাড়াবাড়ি কিংবা উদাসীনতা কোনটাই নাই।
ইক্বতিসাদ বা মধ্যপন্থা হলো তাওয়াস্সুত (মাঝখানে অবস্থান নেয়া), ই’তিদাল (উদারতা), রুশদ (প্রত্যক্ষতা), এবং ইসতিক্বামাহ (দৃঢ়পদতা)। দ্বীনের মধ্যে মু’তাদিল হলো সেই ব্যক্তি যে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা’র আদেশসমূহ মেনে চলে এবং এটা থেকে তাফরীত বা ইফরাতের দিকে বিচ্যুত হয় না। তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেন,
“তারা মধ্যপন্থা (ইক্বতিসাদ) অবলম্বনকারীদের অন্তর্গত, কিন্তু তাদের অনেকেই মন্দ কাজে লিপ্ত।”
(সূরা আল মা’’য়িদা: ৬৬)
এর তাফসীর হলো এটি একটি উম্মাহ্ মুতা’দিলা, যে তার প্রভূর আদেশ মেনে চলছে অর্থাৎ আল্লাহ্’র আদেশ মানার ক্ষেত্রে মধ্যপন্থা অবলম্বন করছে। আর ফাইওয়ুমি তার ‘আল মিসবাহ আল মুনির’ এ উল্লেখ করেন যে, “কাসাদাহ ফিল আমর কাসদান অর্থ হলো হুকুমের ক্ষেত্রে সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক দলিলটি অন্বেষণ করে মধ্যপন্থা অবলম্বন করা এবং সীমা অতিক্রম না করা।”
কেউ এই সংজ্ঞাকে নিরীক্ষা করলে বুঝবে যে, মুসলিমদের অবশ্যই আল্লাহ্ প্রদত্ত হুদুদ বা সীমাকে গ্রহণ করতে হবে এবং তা অতিক্রম করা যাবে না। তাকে আরও মু’তাদিলান হতে হবে অর্থাৎ হুকুম পালনের ক্ষেত্রে মুতাক্বিমান বা দৃঢ় হতে হবে। রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেন,
“বল, ‘আমি আল্লাহ্’র উপর ঈমান এনেছি এবং অতঃপর তাঁর পথের উপর ইসতাক্বিম বা দৃঢ় আছি।’’ [মুসলিম এবং অন্যান্য]; অর্থাৎ যা আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা নির্দেশ দিয়েছেন তা গ্রহণ করেছি এবং যা নিষেধ করেছেন তা থেকে বিরত থেকেছি। ‘ফাসতাক্বিম’ অর্থ হল ইত্ত্বাকী (আল্লাহ্’র ভয়) এবং বিষয়টি আরও পরিষ্কার করার জন্য আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন,
“সুতরাং আপনি এর প্রতিই দাওয়াহ্ দিন এবং হুকুম অনুযায়ী অবিচল থাকুন”।
(সূরা আশ শূরা: ১৫)
সুতরাং আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা হচ্ছেন সেই সত্ত্বা যিনি হুকুম করেন এবং মুসলিমগণ সে আদেশ গ্রহণ করেন ও মেনে চলেন। মুসলিমদের নিজের পক্ষে তাক্বওয়ার পথ ও সহজ সরল পথ সম্পর্কে জানা সম্ভব নয়। যদি সে নিজেকে অনুসরণ করে তাহলে সে তার প্রবৃত্তিকে অনুসরণ করলো। আর যে প্রবৃত্তিকে অনুসরণ করে সে পথভ্রষ্ট। আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা’র আদেশ মান্য করা ও এই সীমার মধ্যে নিজেকে গন্ডীভূত রাখা ছাড়া আর কোন ইসতিক্বমাহ নেই। এ সীমাকে অতিক্রমের কোন সুযোগ নেই। এক্ষেত্রে সামান্য বেশী বা সামান্য কম করার অবকাশ নাই। আর এটা বুঝতে হলে আমাদের আগের মতো মূল ভিত্তির দিকে ফেরত যেতে হবে।
মুসলিমরা আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা এবং ইসলাম প্রদত্ত সকল সমাধানের উপর বিশ্বাস স্থাপন করেছে যা মানুষের ফিতরাতের (বৈশিষ্ট্য) সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। কারণ স্রষ্টা হিসেবে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলাই মানুষের এই ফিতরাত সম্পর্কে সবচেয়ে বেশী অবগত, তিনিই এই বৈশিষ্ট্যকে সুসজ্জিত করেছেন এবং মানুষের কল্যাণের জন্য যা প্রয়োজন তাই করেছেন। একই সময়ে একজন মুসলিম বিশ্বাস করে, অন্য ধর্ম ও জীবনব্যবস্থা সমাধান হিসেবে আমাদের সামনে যা নিয়ে এসেছে তা সীমাবদ্ধ, ভ্রান্ত ও পথচ্যুত এবং এগুলো মানুষের জন্য দূর্ভোগ ব্যতিরেকে শান্তি বয়ে আনেনি। এর কারণ খুব সহজ, যেহেতু মানুষ স্বভাবতই অক্ষম, মুখাপেক্ষী, দূর্বল, সীমাবদ্ধ, যার মন মানুষের বাস্তবতার সবকিছুকে পরিগ্রহ করতে অক্ষম, তাই এগুলো যুৎসই সমাধানও প্রদান করতে পারে না; অথবা এসব ধর্মের উৎস স্রষ্টার পক্ষ থেকে হলেও, এগুলো ছিল নিদিষ্ট কিছু জাতির জন্য সবার জন্য এগুলো প্রযোজ্য নয়। তাছাড়া মানুষ এসবের সাথে ব্যাপক মিথ্যার মিশ্রণ ঘটিয়ে এগুলোকে পরিবর্তন করে ফেলেছে।
একারণে ঐশী বিধান হিসেবে ইসলাম অন্যান্য মতাদর্শ ও ধর্ম থেকে পৃথক, যা মানুষের সব বিষয়ে সমাধান এমনভাবে প্রদান করে যাতে উভয় জগতে সুখ নিশ্চিত হয়।
“এবং যে আমার স্মরণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবে, তার জীবিকা সংকীর্ণ হবে এবং আমি তাকে কেয়ামতের দিন অন্ধ অবস্থায় উত্থিত করবো। সে বলবে: হে আমার প্রতিপালক, আমাকে কেন অন্ধ অবস্থায় উত্থিত করলেন? আমি তো চক্ষুষ্মান ছিলাম। আল্লাহ্ বলবেন, এমনিভাবে তোমার কাছে আমার আয়াতসমূহ এসেছিল, অতঃপর তুমি সেগুলো ভুলে গিয়েছিলে। তেমনিভাবে আজ তোমাকে ভুলে যাব।”
(সূরা ত্বোয়া হা: ১২৪-১২৬);
সুতরাং যে ব্যক্তি এ দুনিয়াতে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার নির্দেশনা মেনে চলে না সে অন্ধ, সঠিক রাস্তা থেকে বিচ্যুত এবং সত্য প্রত্যাখ্যানকারী।
এছাড়া আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা নিজে দ্বীনকে রক্ষার দায়িত্ব নিয়েছেন এবং এগুলো বিলুপ্ত হওয়া ও পরিবর্তিত বা অসত্য পরিবেশনা থেকে রক্ষা করেছেন। তিনি সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন,
“নিশ্চয়ই, আমি নিজেই এই কুর’আন নাযিল করেছি এবং নিশ্চয়ই আমি নিজেই তা হেফাযত করবো।”
(সূরা হিজর: ৯)
তবে তা বুঝার ক্ষেত্রে কারও বিচ্যুতিকে তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) হেফাযতের ওয়াদা করেননি। কিতাবের সুরক্ষা ও বিশুদ্ধতা বজায় রাখা আমাদের জন্য আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার পক্ষ থেকে একটি দলিল। কেউ পথচ্যুত বা ধ্বংস হতে পারে। কিতাবের এমন ব্যাখ্যা দিতে পারে যা মূল অর্থের সাথে সাংঘর্ষিক, নতুন কিছু যুক্ত করতে পারে এবং অর্থকে অসংলগ্নও করতে পারে। কিন্তু এসবই হবে বুঝার ভুল, এর কোনকিছুই মূল কিতাবের বাণীসমূহের সাথে সম্পর্কিত নয়। তাই মুসলিমদের সত্যিকারের ঈমানদার হতে হবে যাতে শরী’আহ্’র হুকুমসমূহকে তারা ঠিকভাবে গ্রহণ করতে পারে, সর্বজ্ঞানী ও সর্বজ্ঞাত আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা’র আদেশের উপর দৃঢ় ও অবিচল থাকতে পারে এবং এক ইঞ্চিও পথভ্রষ্ট না হয়।
ইসলাম সব কিছু নির্ধারণ করে এবং মুসলিমগণ ইসলাম যা নির্ধারণ করে তার উপর বিশ্বাস স্থাপন করে। মানবজাতি নিজের জন্য আইন প্রণয়ন করতে পারে না। মানুষের বুদ্ধিমত্তা, অভিজ্ঞতার গভীরতা, ঈমানের শক্তিমত্তা এক্ষেত্রে বিবেচ্য বিষয় নয়। আইনের প্রক্রিয়ায় মানুষকে অবশ্যই আল্লাহ্ প্রদত্ত কিতাবের দ্বারস্ত হতেই হবে, যদি সে ব্যক্তিটি স্বয়ং আবু বকর সিদ্দিক হয়। খিলাফতের দায়িত্ব পালনকালে প্রথম বক্তৃতার সময় তিনি এটাই বুঝাতে চেয়েছিলেন, “আমাকে ততক্ষন পর্যন্ত আনুগত্য করো যতক্ষণ আমি তোমাদের ব্যাপারে আল্লাহ্’র আনুগত্য করি এবং আমি যদি আল্লাহকে না মানি তাহলে তোমাদের আনুগত্যের প্রতি আমার কোন অধিকার নেই। অবশ্যই আমি একজন নিছক অনুসরণকারী, কিন্তু নতুন কোন কিছুর উদ্ভাবক নই।”
এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেন,
“আনুগত্য করো কিন্তু নতুন কিছু বের করো না, আর তোমাদের যা যথেষ্ট তা সঠিক পরিমাণেই দেয়া হয়েছে।”
আর এ ধরনের চিন্তা কেবলমাত্র আমরা মুসলিমদের মাঝেই দেখতে পাই, অন্য কারও মধ্যে নয়। কারণ অন্যরা নিজেরাই নিজেদের সমস্যা সমাধান করে। এই কারণে ইসলাম মৌলিকভাবে অন্যদের চেয়ে আলাদা।
একইভাবে মুসলিমগণ অনুসরণ করতে বাধ্য এবং তাদের উদ্ভাবনের বদলে অনুসরণই করা উচিত।
আমরা যদি দ্বীন পালনের ক্ষেত্রে মুসলিমদের অবস্থার দিকে দৃষ্টিপাত করি তাহলে দেখতে পাব যে, মহানবী (সা) এর উপর এটা নাযিলের সময় হতে আজ পর্যন্ত কিছু কিছু মুসলিমের দ্বীনের প্রতি ভালবাসার সবকিছুকে ছাড়িয়ে গেছে। কেউ কেউ আবার দাবি করে যে তারা নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গী অনুসারে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা’কে সবচেয়ে শক্তভাবে ইবাদত করতে সক্ষম। তারা অন্যদের সঠিক ও নিয়ন্ত্রিত ইবাদতকে খাটো দৃষ্টিতে দেখে, কারণ তাদের ধারণা শারী’আহ্ তাদের কাছে যতটুকু দাবি করেছে তারা তার চেয়ে বেশী করতে সক্ষম। তারা ইবাদতের পরিমাণের দিক থেকে নিজেদেরকে বাড়াবাড়ির পর্যায়ে নিয়ে গেছে। তারা নফস বা প্রবৃত্তির বশবর্তী হয়ে দলিলের তোয়াক্কা না করে উপাসনার নতুন নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করেছে। বিষয়টি এমনভাবে সীমা অতিক্রম করেছে যেন তারা অন্যের উপর তা চাপিয়ে দিতে চায় এবং কেউ অনুসরণ না করলে তাকে তারা ইবাদতের ক্ষেত্রে কম যত্নশীল বলে আখ্যায়িত করে। আমরা দেখতে পাই, এরকম কঠোর ও অনমনীয় চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে এসব লোকেরা কথা ও কাজে শারী’আহ্ দলিলের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা ও তাঁর দ্বীনের প্রতি ভালবাসা থেকে এরূপ করলেও এটা হারাম। কারণ এর মাধ্যমে দ্বীনের পরিবর্তন সাধিত হয় এবং সর্বজ্ঞানী আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার কর্তৃক নির্ধারিত সীমাকে অতিক্রম করা হয়। সুতরাং, আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা হচ্ছেন এমন একজন সত্ত্বা যিনি আমাদের সৃষ্টি করেছেন এবং আমরা তার জ্ঞানের পরিসীমা সম্পর্কে অবগত নই এবং তার অপরিহার্যতার বাস্তবতা সম্পর্কেও আমরা ওয়াকিবহাল নই, বরং তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) সব কিছুকে পরিগ্রহ করে আছেন। যেহেতু আমরা আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার অনুগ্রহ কামনা করি সেহেতু তাঁর আদেশের উপর দৃঢ় ও প্রতিষ্ঠিত থাকাই এক্ষেত্রে এ উদ্দেশ্য হাসিলের একমাত্র পন্থা। তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) তাঁর জ্ঞানের প্রতি আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করেছেন,
“যিনি সৃষ্টি করেছেন, তিনি কি করে জানবেন না? তিনি সুক্ষ্মজ্ঞানী, সম্যক জ্ঞাত।”
(সূরা আল মূলক: ১৪)
বুখারী উল্লেখ করেন যে, আয়েশা (রা) বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) বিশেষ বিবেচনায় কিছু কাজ করতেন এবং কিছু লোক এক্ষেত্রে তাকে অনুসরণ করত না। নবী (সা) এ বিষয়ে জানতে পেরে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা’র প্রশংসাপূর্বক বলেন, “কিছু লোকের আমি যা করি তা পালন করার ক্ষেত্রে কী হল? আল্লাহ্’র কসম, আল্লাহ্ সম্পর্কে আমি সবচেয়ে বেশী জ্ঞান রাখি এবং তাঁকে ভয় করার ক্ষেত্রে আমি তাদের চেয়ে অগ্রগামী।” এখানে অতিরঞ্জিত করার ব্যাপারে সাবধান বাণী উচ্চারণ করা হয়েছে এবং ইসলাম থেকে বিনয়ের সাথে গ্রহণ করার জন্য আদেশ দেয়া হয়েছে।
বুখারী উল্লেখ করেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেছেন,
“দ্বীন সহজ। কারও দ্বীনের ব্যাপারে কঠিন হওয়া উচিত নয়, সুতরাং সঠিক পন্থা অবলম্বন কর এবং যথা সম্ভব এর নিকটবর্তী থাকার চেষ্টা কর, সুসংবাদ দাও, গুদওয়া’হ (ফজরের পরের সকাল) এর সঠিক ব্যবহার কর। দ্রুত বের হয়ে যাও এবং সন্ধ্যার মধ্যেই ফিরে আস। জুলজাহ (সন্ধ্যার প্রারম্ভিক সময়কাল) এর কিছু সময় ভ্রমণে ব্যয় কর।” আরেকটি বর্ণনায় এসেছে, “সঠিক পথের নিকটবর্তী হও, দ্রুত বের হয়ে যাও এবং সন্ধ্যার মধ্যেই ফিরে আস এবং রাতের প্রারম্ভিক কিছু সময়ের সদ্ব্যবহার কর। মধ্যপন্থা অবলম্বন কর, মধ্যপন্থা অবলম্বন কর, তাহলেই অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌছতে পারবে।”
যে শুভ ইচ্ছা কোন ব্যক্তিকে কঠোর হওয়া বা অতিরিক্ত করার প্রতি প্রবৃত্ত করে, আল বুখারী ও মুসলিম থেকে আনাস (রা) উদ্ভৃতি অনুযায়ী রাসূলুল্লাহ্ (সা) ইবাদতের আধিক্য ও তাদের কমের কারণে একদল লোকের দৃষ্টিভঙ্গী সম্পর্কে জানতে পারলেন। যারা বলল, ‘আমরা রাসূলুল্লাহ্ (সা) থেকে কতদূরে রয়েছি যে, আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা তার সব গোনাহ মাফ করে দিয়েছেন।’ সে কারণে তারা একত্রে শপথ নিল যে, রাতসমূহে তারা ক্বিয়াম করবে, সব দিন রোজা রাখবে এবং নারীদের সাথে কোনরূপ সম্পর্ক রাখবে না। রাসূল (সা) তাদের বললেন, “তোমরাই কি সেই ব্যক্তি যারা এরূপ বলেছ? অবশ্যই আমি তোমাদের চেয়ে আল্লাহকে অধিকতর ভয় করি এবং অধিকতর তাক্বওয়া প্রদর্শন করি। কিন্তু আমি রোজা রাখি এবং তা ভঙ্গ করি। আমি প্রার্থনা করি এবং রাতে ঘুমাই এবং নারীদের বিবাহ করি।” অতঃপর তিনি এই বলে হাদীসটি শেষ করলেন,
“যে আমার সুন্নাহ্ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল, সে আমার অন্তভুর্ক্ত নয়।”
এটা থেকে বুঝা যায় যে, আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা এমন কোন কিছু গ্রহণ করেন না যা তাঁর কাছ থেকে আসেনি। যা মানুষ সংযোগ করে বা উদ্ভাবন করে তা কখনওই আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা’র নৈকট্য অর্জনের পাথেয় হতে পারে না। আবু দাউদ তার সুনানে এক ব্যক্তি সম্পর্কে উল্লেখ করেন, যিনি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে জিজ্ঞেস করলেন, “হে আল্লাহ্’র রাসূল (সা)! কোন ব্যক্তি যদি সবদিন রোজা রাখে সেটা কেমন হবে?” প্রতুত্তরে রাসূল (সা) বলেন, “বিষয়টি অনেকটা এই রকম যে, সে কোন রোজা রাখেওনি বা ভঙ্গও করেনি।”
ইমাম আহমদ বর্ণনা করেন যে রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেন, একবার এক ব্যক্তি তাঁকে এসে বলল যে তার মা পায়ে হেঁটে হজ্জ্ব করার প্রতিজ্ঞা করেছে। তিনি (সা) বলেন,
“তাকে বাহন ব্যবহার করতে বলো, হাঁটার ব্যাপারে আল্লাহ্’র পক্ষ থেকে তার জন্য কোন নির্দেশ নেই।”
বুখারী ইবনে আব্বাস (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, “যখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) খুতবা দিচ্ছিলেন তখন তারা দেখল একটি লোক দাঁড়িয়ে আছে। রাসূল (সা) তার ব্যাপারে জানতে চাইলেন। তারা বলল, ‘আবু ইসরাইল নাদারাহ আল্লাহ্’র কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছেন যে, সে দাঁড়িয়ে থাকবে এবং বসবে না, সে কখনওই ছায়ায় বসে না, কথা বলে না এবং রোজা পালন করে। রাসুল (সা) বলেন, “তাকে কথা বলতে বল, ছায়ায় আশ্রয় নিতে বল, বসতে বল এবং রোজা পূর্ণ করতে বল।”
অতিরঞ্জিত করা মানুষকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায় এবং মুসলিম বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) এ ব্যাপারে বলেন,
“আল মুতানাত্তিনুন বা একগুয়ে লোক ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে।” তিনি এটা তিনবার বললেন। আহমেদ, আন নাসা’ঈ এবং ইবনে মাজাহ্ উল্লেখ করেন এবং ইবনে মাজাহ্’র ভাষায় করা হয় যে, “হে লোকেরা! ঘুলুহ বা দ্বীনের মধ্যে বাহুল্যতার ব্যাপারে সাবধান হও। অবশ্যই তোমাদের আগে যারা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে তারা ঘুলুহ বা বাহুল্যতার কারণেই হয়েছে।”
দ্বীনের ব্যাপারে অতিরঞ্জিতকারীদের মতো উদাসীনরাও একই দোষে দুষ্ট। এধরনের লোকেরা দ্বীনের মূলে বিশ্বাস স্থাপন করে কিন্তু দায়িত্ব পালনের বেলায় উদাসীন, ভয়াবহ বিভিন্ন গুণাহে্ লিপ্ত, মনে মনে ফন্দি এটেছে যে মৃত্যুর আগে অনুতপ্ত হয়ে গুণাহ্ মাফ করিয়ে নেবে। এমন যেন তারা গায়েব এবং আজল সম্পর্কে অবগত। এটা সুস্পষ্ট হারাম। সর্বোচ্চ আনুগত্যের সাথে মুসলিমদের অতি সত্তর পূর্ণাঙ্গভাবে ইসলাম গ্রহণ করা উচিত। অন্যথায় তাদেরকে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার সহজ সরল পথ থেকে বিচ্যুত ধরা হবে।
আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা এবং রাসূলুল্লাহ্ (সা), বাহুল্যতা ও অতিরঞ্জিত করার ব্যাপারে যেমন ব্যক্তিকে সতর্ক করেছেন ঠিক তেমনি দল, রাষ্ট্র ও উলামাদেরও সতর্ক করেছেন। আজকে আমরা, দাওয়াহ্বহনকারী এবং তাদের চিন্তাবিদ অনেকের মাঝে ইসলামের প্রতি ভালবাসা, দ্বীনের ভাবমূর্তিকে উজ্জল করতে অণুপ্রাণিত হয়ে দ্বীনকে সহজ ও কঠোরতা মুক্ত হিসেবে প্রমাণিত করার নিমিত্তে এ ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করতে দেখি। তারা সীমাকে অতিক্রম করে এবং রাসূলুল্লাহ্ (সা) এর প্রদর্শিত দৃঢ় পথ থেকে বিচ্যুত হয়, অনেক আহ্কামকে অবহেলা করে এবং এমন মতামত প্রদান করে যার সাথে ইসলামের দূরতম সম্পর্ক নেই। এসব কিছুই তারা করে সময় ও বাস্তবতার সাথে ইসলামের একাত্নতা পোষণ করানোর জন্য যতক্ষন না তারা এই পর্যায়ে চলে যায় যে তারা উম্মাহ্’র কাছে স্বীকৃত ও গৃহীত শারী’আহ্’র ষ্পষ্ট বাণীকে প্রত্যাখ্যান করে। গ্রন্থের দুরবর্তী ব্যাখ্যাকেও তারা উল্লেখ করে না। তারা এমন মতামত পোষণ করে যে, মুরতাদকে হত্যা করা হবে না, যদিও এ ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেন,
“যে দ্বীন পরিবর্তন করে, তাকে হত্যা কর।”
[বুখারী এবং আহমদ]
এ ব্যাপারে তাদের যুক্তি হলো, যে বাস্তবতা ও পরিপ্রেক্ষিতে রাসূলুল্লাহ্ (সা) এরূপ বলেছিলেন, সে বাস্তবতা বা পরিপ্রেক্ষিত এখন বিরাজ করছে না। এরূপ অবস্থানের কারণ হলো তারা ধর্মীয় স্বাধীনতায় ধ্বজাধারী পশ্চিমাদের সাথে সামঞ্জস্য রেখে দ্বীনকে ব্যাখ্যা করে। তারা এমন দৃষ্টিভঙ্গী পোষণ করে যে নারীরা ইমামতের (খিলাফত) দায়িত্ব পালন করতে পারবে যদিও এ ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর স্পষ্ট হাদীস রয়েছে, “নারীকে শাসক হিসেবে নিয়োগ দানকারীরা কখনোই সফল হবে না।” [বুখারী, আহমদ, তিরমিযী, নাসাঈ]
তারা বলে, এরূপ বলা হয়েছে কেবলমাত্র একটি বিশেষ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে, সার্বজনীনভাবে নয়। পশ্চিমাদের মতই ইসলাম নারীদের সম্মান করে এরূপ ভাবমূর্তি প্রদর্শনের জন্য তারা এটি বলে থাকে। এছাড়াও প্রচন্ড কঠিন আন্তর্জাতিক সম্পর্কের কারণে তারা সুদকে মেনে নেবার ব্যাপারে অনুমোদন দিয়েছে।
এসবই ইসলামের হক্বকে ভূলুন্ঠিত করেছে এবং দেখানোর চেষ্টা করছে যে ইসলাম মানবজীবনের সবকিছু নিয়ে সমাধান দিতে সক্ষম নয়। তাদের প্রদর্শিত দূর্বলতা ইসলামের নয় বরং তাদের নিজেদের। তাফরীত বা অবহেলার পেছনে যে ইস্যুসমূহ কাজ করে ইফরাত বা বাহুল্যতার পেছনে একই ইস্যুগুলো কাজ করে, অর্থাৎ দ্বীন সম্পর্কে মানুষের অজ্ঞতা। একারণে দ্বীনের মধ্যে এ দু’ধরনের লোক, যারা অবহেলা করে এবং বাহুল্যতা প্রদর্শন করে, তারা নিজেদের ধ্বংস করে ফেলছে। উভয়েই তাদের প্রবৃত্তি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। প্রথমটি হলো নিজের প্রবৃত্তিকে সন্তুষ্ট করা, দ্বিতীয়টি হলো মানুষকে সন্তুষ্ট করার পাঁয়তারা। কোথাও আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলাকে সন্তুষ্ট করার কোন প্রচেষ্টা নেই।
এই দু’টি অবস্থানের ভিত্তিতে বাহুল্যতা ও অবহেলাকে বর্জন করে আমরা আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার আদেশকে মেনে নিতে বাধ্য। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার বক্তব্য থেকে আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারি, যেখানে তিনি বলেছেন,
“যিনি সৃষ্টি করেছেন, তিনি কি করে জানবেন না? তিনি সুক্ষ্মজ্ঞানী, সম্যক জ্ঞাত।”
(সূরা আল মূলক: ১৪)
অন্য কথায়, আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা এই উম্মাহ্কে মানবজাতির জন্য স্বাক্ষীরূপে নির্ধারণ করেছেন, যেভাবে নবী (সা) তাঁর উম্মতের জন্য স্বাক্ষীরূপে নির্ধারিত হয়েছেন। এ কারণে এই উম্মাহ্ সর্বশ্রেষ্ঠ এবং সম্মানিত। মানবজাতির মাঝে এর অবস্থান পর্বতের চূড়ার মতই, যেখানে সে সর্বোচ্চ ও কেন্দ্রীয় অবস্থানে রয়েছে। আমরা পশ্চিমাদের মতো করে এই আয়াতকে ব্যাখ্যা করি না, যা আপোষের ভিত্তিতে সমাধানের উপর নির্ভর করে তৈরি হয়েছে। আগের আলোচনার ভিত্তিতে আমরা বলতে পারি যে, এটা হারাম। আক্বীদা আপোষের ভিত্তিতে গড়ে উঠতে পারে না। কেননা এটা নিজেই কুফর। একটি হলো ঈমান এবং অন্যটি কুফর, একটি আলো ও অন্যটি অন্ধকার, একটি সঠিক নির্দেশনা এবং অন্যটি ভুল। শরী’আহগত আইনের ক্ষেত্রে আমরা পূর্বেই প্রতিষ্ঠিত করেছি যে আল্লাহ্ ব্যতিত আর কোন আইন প্রণেতা, বিচারক নেই। আর কেউ নেই যে তার রায়কে উল্টাতে পারে। কারণ তিনিই হচ্ছেন সর্বশ্রেষ্ঠ বিচারক।
উদারপন্থা ও চরমপন্থার ব্যাপারে এটাই হলো পশ্চিমাদের উপলদ্ধি। আর বর্ণিত বিষয়গুলো হলো ইসলামের উপলদ্ধি। পশ্চিমাদের এ ধরনের অবস্থান নেয়ার পেছনে কারণ হলো তারা সত্যিকারের ইসলামকে তাদের অস্তিত্ব ও ঔপনিবেশবাদের জন্য ধ্বংসাত্নক মনে করে। সুতরাং এভাবে কী আমরা মুসলিমদের কাঁধের উপর দিয়ে পশ্চিমাদের হাতে সব ক্ষমতা তুলে দেব? পশ্চিমাদের সাহায্য করার অর্থ হলো যারা ইসলামের জন্য কাজ করে তাদের বিরুদ্ধে কাজ করা। আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন,
“সুতরাং আপনি এর প্রতিই দাওয়াহ্ দিন এবং হুকুম অনুযায়ী অবিচল থাকুন; আপনি তাদের খেয়ালখুশীর অনুসরণ করবেন না।”
(সূরা আশ শূরা: ১৫)
তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেন,
“অতএব, তুমি এবং তোমার সাথে যারা তওবা করেছে সবাই সোজা পথে চলে যাও, যেমন তোমায় হুকুম দেয়া হয়েছে এবং সীমালঙ্ঘন করবে না, তোমরা যা কিছু করছো, নিশ্চয় তিনি তার প্রতি দৃষ্টি রাখেন। আর পাপিষ্ঠদের প্রতি ঝুঁকবে না। নতুবা তোমাদেরকেও আগুন পাকড়াও করবে। আর আল্লাহ্ ব্যতীত তোমাদের কোন বন্ধু নাই। অতএব কোথাও সাহায্য পাবে না।”
(সূরা হুদ: ১১২-১১৩)
আমাদের হৃদয় এ দ্বীনের কল্যাণ চায় এবং এর বিজয় কামনা করে। দ্বীনের জন্য যাতে আমাদের হৃদয় ও মন খুলে যায় আল্লাহ্’র কাছে সে তাওফীক আমরা চাই। আমরা নিজেদের জন্য যে কল্যাণ চাই তা অন্যদের জন্যও কামনা করি। আমরা আল্লাহ্’র কাছে প্রার্থনা করি যাতে আমাদের উপদেশসমূহ বারিধারার মত সবার হৃদয় ও মনকে পূণর্জাগরিত করে এবং কেবলমাত্র আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলাই আমাদের সঠিক পথের দিশা দেখাতে পারেন।
সমাপ্ত