১৭তম অধ্যায়: ইসলাম গ্রহণের পরও কি রাসূলুল্লাহ্ (সা) নাজ্জাশীকে কুফর শাসনের অনুমোদন দিয়েছিলেন?

যারা ইসলামের দাওয়াহ্ সঠিকভাবে বহন করতে চায় এবং দলীয় কিংবা ব্যক্তি জীবনে একে প্রতিষ্ঠার জন্য আন্তরিকভাবে কাজ করে, তারা কুফর শাসনব্যবস্থা ধ্বংসের নামে কখনওই এতে অংশগ্রহণ করতে পারে না। কারণ কুফর ব্যবস্থা ও আইন-কানুনসমূহ বাস্তবায়নকারী কুফর শাসনব্যবস্থায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে তা কেবল শক্তিশালীই হয়, ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় না। কুফর শাসনব্যবস্থায় অংশগ্রহণের সমর্থনে যেসব দলিল পেশ করা হয় তা একধরনের আত্নপ্রবঞ্চণা, তারও আগে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা ও মুমিনদের সাথে প্রবঞ্চণার নামান্তরমাত্র। বিশেষত: যখন তা হয় অর্থ ও প্রামাণ্যতার দিক থেকে অকাট্য শারী’আহ্ দলিলের সাথে সাংঘর্ষিক।

অর্থ ও প্রামাণ্যতার দিক থেকে অকাট্য শারী’আহ্ দলিলের বিরোধীতার সমর্থনে শারী’আহ্’কে বিবেচনায় না এনে মনগড়া মাসলাহা (Interest) অবলম্বন করা একজন দাওয়াহ্ বহনকারীর জন্য অবশ্যই কঠিন পরীক্ষা ও ভয়াবহ গুণাহ্। অন্যকথায়, অর্থ ও প্রামাণ্যতার দিক থেকে অকাট্য শারী’আহ্ দলিল সর্বদা কুফর শাসনব্যবস্থায় অংশগ্রহণের সাথে সাংঘর্ষিক। অথচ তা সত্ত্বেও, আল্লাহ্ যা নাযিল করেছেন তা বাদ দিয়ে কুফর শাসনব্যবস্থায় অংশগ্রহণের সমর্থনে এমনকিছুর অবলম্বন করা যেখানে সুবহাত আদ-দলিল (দলিলের আভাস) নাই, তাও ভয়াবহ গুণাহে্র কাজ। এসব দলিল আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা যা নাযিল করেছেন তা দিয়ে শাসন করতে বাধ্য করে এবং যা তার পক্ষ থেকে নয় তা দিয়ে শাসন করার বিষয়টিকে নিষিদ্ধ করে।

তারা আন নাজ্জাশীর ঘটনাকে কুফর শাসনব্যবস্থায় অংশগ্রহণের দলিল হিসেবে উপস্থাপন করে, যার মৃত্যুর ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ্ (সা) সাহাবীদের কাছে ঘোষণা দিয়েছিলেন এবং তার সালাতুল জানাযাও আদায় করেছিলেন। তারা বলে যে, নাজ্জাশী রাসূলুল্লাহ্ (সা) এর সময়ে ইসলাম গ্রহণ করেছিল এবং পূর্বে যে শাসনব্যবস্থা দিয়ে শাসন করেছিল তা অব্যাহত রেখেছিল; অর্থাৎ সে শাসনব্যবস্থা ছিল অনৈসলামী। এর প্রমাণের জন্য তারা বুখারী শরীফে নাজ্জাশীর মৃত্যু ও জানাযার নামাযের ব্যাপারে বর্ণিত ছয়টি হাদীসকে তুলে ধরে। এদের তিনটি জাবির বিন আবদুল্লাহ আল আনসারী এবং অপর তিনটি আবু হুরাইরা (রা) কতৃর্ক বর্ণিত। যদিও এ ছয়টি হাদীস কুফর আইন কানুন দ্বারা পরিচালিত কুফর ব্যবস্থায় অংশগ্রহণের দলিল হতে পারেনা।

নীচের অনুচ্ছেদগুলোতে এ বিষয়ে আলোচনা করা হবে:

যখন বুখারী এ হাদীসগুলো বর্ণনা করেন তখন এদের পাঁচটিকে ‘বাব মাউত আন-নাজ্জাশী’ (নাজ্জাশীর মৃত্যু বিষয়ক অধ্যায়) এবং ষষ্ঠটিকে তিনি ‘বাব আল জানাইয়েয’ (জানাযার নামাজের অধ্যায়) এ স্থান দেন। এ ছয়টি হাদীসই নাজ্জাশীর মৃত্যু সম্পর্কিত, যেগুলোর মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ্ (সা) সাহাবীদের তার মৃত্যু সম্পর্কে অবগত করেছিলেন এবং বলেছিলেন যে, তিনি একজন ধার্মিক লোক ছিলেন এবং তাদের ভাই ও তাকে যাতে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা ক্ষমা করে দেন সেজন্য দো’আ করার নির্দেশ দেন এবং নবী (সা) এর সাথে জানাযার নামাজ পড়তে নির্দেশ দেন। এটা থেকে বুঝা যায় তিনি একজন মুসলিম ছিলেন।

ইবনে হাজার আল আসকালানী তার ‘ফাত উল বারী’ (সহীহ বুখারীর ব্যাখ্যা)-তে নাজ্জাশীর ইসলাম ধর্মে রূপান্তরিত হওয়া নিয়ে আলোচনা না করে বরং ‘আন নাজ্জাশীর মৃত্যু’ শিরোনামে বুখারীর বর্ণনার উপর মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, “এ ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ আছে যে আল বুখারী নাজ্জাশীর ইসলামে ধর্মান্তরিত হওয়ার বিষয়ে কিছু বর্ণনা করেছেন বরং তিনি তার মৃত্যু খবরটিই তুলে ধরেছেন। কারণ তার ইসলাম গ্রহণের বিষয়টির চেয়ে অত্যন্ত স্পষ্টভাবে মৃত্যুর বিষয়টিই উঠে এসেছে। সুতরাং বুখারী নাজ্জাশীর মৃত্যুর ঘটনাটি উল্লেখ করেছেন এজন্য যাতে তার জানাযার নামাজ আদায় করা থেকে বুঝা যায় যে, তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন।”

বুখারী বর্ণিত হাদীসের বর্ণনা থেকে বুঝা যায় যে রাসূলুল্লাহ্ (সা) ওহীর মাধ্যমে যেদিন নাজ্জাশী মারা যান সেদিন তার মৃত্যু ও ইসলাম গ্রহণের বিষয়টি অবগত হন। এ থেকে আরও বুঝা যায় সাহাবাগণ এ সম্পর্কে অবগত ছিলেন না যদি না রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাদের এ ব্যাপারে অবহিত করতেন। সে কারণে জাবির (রা) বর্ণিত হাদীসে উল্লেখ করা হয়,

“যখন নাজ্জাশী মারা গেল তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেন, ‘আজকে একজন ধার্মিক লোক মারা গেল। সুতরাং তোমাদের ভাই আসিমাহ এর জন্য দাঁড়াও এবং প্রার্থনা কর’।”

আবু হুরাইরা (রা) কতৃর্ক বর্ণিত হাদীসে উল্লেখ আছে,

“রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাদেরকে হাবাশার শাসক নাজ্জাশী যেদিন মারা যান সেদিন তার মৃত্যুর ব্যাপারে অবহিত করেন।” এ থেকেও বুঝা যায় যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) সাহাবীদেরকে যেদিন নাজ্জাশী মারা যায় সেদিন ওহীর মাধ্যমে তার মৃত্যু ও ইসলাম গ্রহণের বিষয়টি অবগত করেন।

জাবির বিন আবদুল্লাহ’র বর্ণনা অনুসারে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) সাহাবীদের বলেন,

“আজকে একজন ধার্মিক লোক মারা গেল।”

এবং

“দাঁড়াও এবং তোমাদের ভাই আসীমাহ্’র জন্য দোয়া করো।”

এ থেকে বুঝা যায় যে তারা ইসলাম গ্রহণের বিষয়টি জানতো না। যদি তারা এটা আগে জানতো তাহলে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর এভাবে বলার প্রয়োজন ছিল না যে,

“একজন ধার্মিক লোক”

“তোমাদের ভাই”

এর কারণ রাসূলুল্লাহ্ (সা) সাধারণত যখন কোন সাহাবী মারা যেত তখন তাদের জানাযার নামাজের জন্য এভাবে আহ্বান করতেন না।

এসব হাদীস থেকে বুঝা যায় যে, নাজ্জাশী তার মৃত্যুর সামান্য কিছুদিন আগে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু কবে করেছিলেন এ সম্পর্কে কোন ধারণা পাওয়া যায় না। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) ওহীর মাধ্যমে যেদিন নাজ্জাশী মারা যান সেদিন তার মৃত্যু ও ইসলাম গ্রহণের বিষয়টি অবগত হন। অন্য কোন সময় রাসূলুল্লাহ্ (সা) এ ব্যাপারে অবগত হয়েছেন, এ ব্যাপারে কোন অকাট্য দলিল নেই।

এই ছয়টি হাদীসে বর্ণনার মধ্যে এমন কোন ইঙ্গিত নেই যা থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হবে যে এই নাজ্জাশীই সেই নাজ্জাশী যার নিকট সাহাবীগণ হাবাশা বা ইথিওপিয়ায় হিজরত করেছিলেন। একইভাবে এরকমের কোন ইঙ্গিত নেই যে তিনি সেই নাজ্জাশী যার কাছে ইসলাম গ্রহণের জন্য রাসূলুল্লাহ্ (সা) চিঠি প্রেরণ করেছিলেন। এর কারণ হলো ’নাজ্জাশী’ শব্দটি কোন ব্যক্তির নামবাচক শব্দ নয়। বরং ইমাম নববীর ‘শরহে সহীহ মুসলিম’ এর দ্বিতীয় খন্ড এবং ইবনে হাজার আল ’আসকালানী-এর ’আল ইসাবা’এর তৃতীয় খন্ড অনুসারে এটি হলো যারা হাবাশা শাসন করতেন এরকম সবার লকব বা উপাধিসূচক একটি শব্দ।

সহীহ মুসলিমের দ্বাদশ খন্ডে ইমাম নববী মন্তব্য করেন যে হিজরতের ষষ্ঠ বছরের শেষের দিকে হুদাইবিয়ার অভিযান থেকে ফিরে রাসূলুল্লাহ্ (সা) যার কাছে ইসলাম গ্রহণের জন্য পত্র পাঠিয়েছিলেন আর যার জন্য জানাযার নামাজ পড়েছিলেন, তারা উভয়ই এক নাজ্জাশী নয়। এ ব্যাপারে হাদীসের ভাষ্য নিম্নরূপ:

“আনাস (রা) বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) কিসরা, কায়সার, নাজ্জাশী ও প্রত্যেক যালিম শাসকের নিকট আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার প্রতি ঈমান আনার জন্য পত্র প্রেরণ করেন। কিন্তু তিনি সে নাজ্জাশী ছিলেন না, যার জন্য রাসূলুল্লাহ্ (সা) জানাযার নামাজ আদায় করেন।”

সুতরাং এ হাদীস থেকে এটা প্রতীয়মান হয় যে, যার জন্য রাসূলুল্লাহ্ (সা) জানাযার নামায পড়েছিলেন, তার কাছে আশ্রয়ের জন্য সাহাবীগণ হিজরত করেননি এবং তিনি সে ব্যক্তিও নন যার কাছে হিজরতের ষষ্ঠ বছরে রাসূলুল্লাহ্ (সা) ইসলাম গ্রহণের জন্য পত্র প্রেরণ করেছিলেন। বরং যে নাজ্জাশীর জন্য জানাযার নামাজ পড়া হয়েছিল তিনি ক্ষমতায় আসেন নাজ্জাশীর (যার নিকট ইসলাম গ্রহণের জন্য রাসূলুল্লাহ্ (সা) আমর বিন উমাইয়া আদ-দামরির মাধ্যমে চিঠি পাঠিয়েছিলেন) মৃত্যুর পর। পত্র গ্রহণকারী নাজ্জাশী ইসলাম গ্রহণ করেননি। যদি করতেন তাহলে সাহাবীগণ রাসূলুল্লাহ্ (সা) এর মাধ্যমে এ বিষয়ে অবগত হতেন এবং তার জন্য জানাযা পড়তেন। জাফর বিন আবি তালিব এবং অন্যান্য হিজরতকারীগণ তাহলে এ বিষয়ে জানতে পারতেন। কারণ মক্কা বিজয়ের পর সপ্তম হিজরীতে তারা ফিরে আসেন অর্থাৎ চিঠি প্রেরণের পরের বছর। যদি তিনি ইসলাম গ্রহণ করতেন তাহলে তা হতো মুসলিমদের জন্য আনন্দের ও উদযাপনের একটি বিষয়, বিশেষ করে খায়বার বিজয়ের পর। অবশ্যই তিনি (সা) নাজ্জাশীর ইসলাম গ্রহণের বিষয়টি সাহাবাদের জানাতেন, শুধু জাফরের (রা) আগমনকে ঘিরে তার মন্তব্যকে সীমাবদ্ধ রাখতেন না;

“আমি জানি না কী আমাকে বেশী আনন্দ দিয়েছে; খায়বার বিজয় নাকি জা’ফরের আগমন।”
(সীরাত ইবনে হিশাম)

তিনি (সা) হয়তো যোগ করতেন, ‘নাকি নাজ্জাশীর ইসলাম গ্রহণ।’ কিন্তু তিনি (সা) হাদীসের মধ্যে নাজ্জাশীর নাম উল্লেখ করেননি যদিও অবস্থাপ্রেক্ষিতে তা জরুরী ছিল যদি নাজ্জাশী তাঁর (সা) দাওয়াহ্ কবুল ও  ইসলাম গ্রহণ করতেন।

যারা ধারনা করেন, যে নাজ্জাশীর কাছে মুসলিমগণ আশ্রয় গ্রহণের জন্য হিজরত করেছিলেন, যে নাজ্জাশীর কাছে রাসূল (সা) ষষ্ঠ হিজরীর শেষের দিকে চিঠি পাঠিয়েছিলেন এবং যার জন্য রাসূলুল্লাহ্ (সা) জানাযার নামাজ পড়েছিলেন, এই তিন নাজ্জাশী একই ব্যক্তি, তারা ভুল করছেন। কারণ তিনি (সা) হিজরতকারী সাহাবীদের (রা) উদ্দেশ্য করে নাজ্জাশীর ব্যাপারে মুল্যায়ন করে বলেছিলেন, “তিনি এমন একজন রাজা যার অধীনে কেউই অত্যাচারিত হয় না এবং তার ভূমি হলো ন্যায়ের ভূমি।” (ইবনে হিশাম); এবং যেসব মুসলিম সেখানে হিজরত করেছিলেন তারা সর্বোচ্চ সুরক্ষা ও নিরাপত্তা পেয়েছিলেন এবং নির্বিঘ্নে ইবাদত করতে পেরেছিলেন। তিনি তাদেরকে তার পরিষদবর্গের মতের বিরুদ্ধে গিয়ে কুরাইশদের দু’জন প্রতিনিধির কাছে সমর্পণ করেননি। তিনি তাদের উভয়পক্ষকে এ বলে প্রতিহত, সুরক্ষা প্রদান ও নিরাপত্তা বিধান করেছিলেন যে, ‘আপনারা আমার দেশে নিরাপদ এবং যারা আশ্রয়প্রাপ্তদের ক্ষতি করবে তারাই শাস্তির আওতায় আসবে।’ জাফরের উত্তরের কারণে তিনি এ ধরনের মন্তব্য করেছিলেন। যখন নাজ্জাশী সাহাবাদের প্রশ্ন করেছিলেন যে, মুহম্মদ (সা) তোমাদের জন্য কী নিয়ে এসেছে এবং প্রত্যুত্তরে জাফর (রা) বলেছিলেন, “অবশ্যই তিনি (সা) যা এনেছেন এবং ঈসা (আঃ) যা নিয়ে এসেছিলেন তা একই প্রদীপ থেকে উৎসারিত।”  জাফরের এ উত্তরের উপর মন্তব্য করা ছাড়াও দ্বিতীয় দিন তিনি ঈসার ব্যাপারে দৃষ্টিভঙ্গী জানতে চাওয়ার পর মাটি থেকে একটি লাঠি উঠিয়ে বললেন, ‘আল্লাহ্’র কসম ঈসা ইবনে মারিয়ম এর ব্যাপারে তোমরা এই লাঠির প্রস্থের চেয়ে একটুও বাড়িয়ে বলোনি।’ (সীরাত ইবনে হিশাম); এ ঘটনা থেকে তারা মনে করে যে, নাজ্জাশী ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন, যদিও তা রাসূলুল্লাহ্ (সা) এর কোন ভাষ্য দ্বারা সমর্থিত নয়। একইভাবে হিজরতকারীদের মধ্যে একজন রাসূলুল্লাহ্ (সা) এর বিবি উম্মে সালামাও ইসলাম ধর্ম গ্রহণের বিষয়টি নিশ্চিত করেননি। যখন তিনি নাজ্জাশী ও তার দেশে কী ঘটেছিল সে সম্পর্কে বর্ণনা করেন তখন উল্লেখ করেন যে, “যখন আমরা হাবাশার ভূমিতে প্রবেশ করি তখন আমরা নাজ্জাশীর মতো সর্বোত্তম প্রতিবেশীকে পেয়েছিলাম। আমরা দ্বীনের ব্যাপারে সেখানে নিরাপদ অনুভব করেছিলাম এবং কোনরূপ ক্ষতির সম্মুখীন না হয়ে আল্লাহ্’র উপাসনা করতে পারছিলাম এবং অপছন্দনীয় কোন কিছুই শুনতে পাইনি….” তিনি আরও বলেন, “যতক্ষণ না একজন লোক হাবাশায় এসে তার কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করলো ততক্ষণ আমরা এ অবস্থায় চলছিলাম।” তিনি বললেন, নাজ্জাশী যেভাবে আমাদের অধিকারগুলো দিয়েছিল সেভাবে যদি ঐ লোকটি যে তাকে পরাস্ত করতে চেয়েছিল আমাদের তা না দেয় এ ভয়টা ছাড়া অন্য কোন ভয় আমাদের আমাদের আচ্ছন্ন করেনি।  তিনি বলেন, “যখন আল্লাহ্ নাজ্জাশীকে তার শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধে বিজয় দান করলেন ও তার ভূমিকে আরও শক্তিশালী করলেন, আল্লাহ্’র কসম সে সময়ের মতো আনন্দিত আমরা আর কখনওই হইনি।” “নাজ্জাশী যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরে আসলেন এবং তখন নিজ দেশে তার কতৃর্ত্ব আরো বৃদ্ধি পেল এবং হাবাশার রাষ্ট্রীয় কর্মকান্ড আরও ভালভাবে পরিচালিত হতে লাগল। মক্কায় অবস্থানকালে রাসূলুল্লাহ্ (সা) এর কাছে পৌঁছার আগ পর্যন্ত আমরা নাজ্জাশীর কাছাকাছিই সবচেয়ে ভাল বাড়িতে ছিলাম।” (সীরাত ইবনে হিসাম); উম্মে সালামা বর্ণিত এ হাদীস প্রমাণ করে না যে, নাজ্জাশী ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন।

এটা হলো একটি দৃষ্টিকোণ থেকে। অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে, যারা বলে, যে নাজ্জাশীর জন্য রাসূলুল্লাহ্ (সা) প্রার্থনা করেছিলেন, যার কাছে মুহাজিরগণ আশ্রয় লাভ করেছিলেন এবং যার কাছে ইসলাম গ্রহণের জন্য পত্র পাঠানো হয়েছিল, তিনজনই একই ব্যক্তি তারা হয়তো সহীহ মুসলিমের আনাস বিন মালিক (রা) বর্ণিত নিম্নোক্ত হাদীসটির সাথে সুপরিচিত নয়:

“রাসূলুল্লাহ্ (সা) কিসরা, কায়সার, নাজ্জাশী ও প্রত্যেক যালিম শাসকের নিকট আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার প্রতি ঈমান আনার জন্য পত্র প্রেরণ করেন। কিন্তু তিনি সে নাজ্জাশী ছিলেন না, যার জন্য রাসূলুল্লাহ্ (সা) জানাযার নামাজ আদায় করেন।”

মুহাম্মদ হামিদুল্লাহ লিখিত ‘নবীর সময়কার রাজনৈতিক দলিলপত্র’ শীর্ষক বইয়ে উল্লেখিত দু’টি চিঠির বিষয়ে বলা হয়েছে যে, নাজ্জাশী রাসূলুল্লাহ্ (সা) কে একটি পত্র লিখেছিলেন যেখানে তার ইসলাম গ্রহণের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত ছিল এবং তিনি (সা) অনুমতি দিলে নাজ্জাশী রাসূল (সা) এর সাথে দেখা করতে প্রস্তত বলেও অবহিত করেন ও তিনি তার পুত্র আরহা বিন আল আসাম বিন আবহার-কে প্রেরণ করেন এবং চিঠিটি যখন প্রেরণ করা হয় যখন রাসুল (সা) মক্কায় অবস্থান করছিলেন।

দ্বিতীয় চিঠির ক্ষেত্রে উল্লেখ করা হয় যে, নাজ্জাশী হাবাশা ত্যাগকৃত সাহাবাদের কাছে মদীনায় অবস্থানরত রাসূলুল্লাহর জন্য পত্রটি দিয়ে দেন। এই দু’টি চিঠির ব্যাপারে গ্রহণযোগ্য কোনো হাদীস গ্রন্থে কোনো উল্লেখ নেই। ‘নবীর সময়কার রাজনৈতিক দলিলপত্র’ বইয়ের রচয়িতা উল্লেখ করেন যে, তিনি এহেন তথ্যাদি তাবারী, কালকাসান্দি, ইবনে কাসির এবং অন্যান্য ইতিহাস বই থেকে সংগ্রহ করেছেন। তিনি বলেননি যে, এগুলো কোন হাদীসের বই থেকে সংগ্রহ করেছেন। ইতিহাসের বইসমূহ অকাট্য নয়, কেননা এগুলোর ক্ষেত্রে হাদীসের মত বর্ণনার সূত্রসমূহ পরীক্ষিত নয়। তারা রাতের অন্ধকারে কাঠ সংগ্রহকারীর মতোই তথ্যসমূহ সংগ্রহ করে থাকে যেন সেই সংগ্রাহক গাছের ডাল নাকি সাপ সংগ্রহ করছে এ ব্যাপারে নিশ্চিত নয়। একারণে এ দু’টি চিঠির কোনো মূল্য নেই। এগুলো আনাস বিন মালিকের (রা) বর্ণিত হাদীস, নাজ্জাশীর ব্যাপারে উম্মে সালামার বক্তব্য ও হাবাশায় আশ্রয়রত মুহাজিরীনদের বক্তব্য, যাদের মধ্যে জাফর (রা) ছিলেন সর্বশেষ এবং তিনি বলেননি যে, নাজ্জাশী ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। যদিও জাফর হিজরতের সপ্তম বছরে বিভিন্ন শাসক নিকট পত্র প্রেরণ ও খায়বার বিজয়ের পর ফিরে এসেছিলেন। অতএব ঐ দু’টি চিঠি সঠিক হতে পারে না। উপরের সবকিছুর ভিত্তিতে এটা স্পষ্ট যে নাজ্জাশী ইসলাম গ্রহণ করেছিল ও যার জন্য রাসূলুল্লাহ্ (সা) জানাযার নামায আদায় করেছিলেন এবং যার কাছে মুহাজিরীনগণ হিজরত করেছিলেন তারা একই ব্যক্তি নয়। আবার তিনি সেই ব্যক্তিও নন যার কাছে রাসূলুল্লাহ্ (সা) ইসলাম গ্রহণের আমন্ত্রন জানিয়ে হিজরী ষষ্ঠ সালের শেষের ও সপ্তম সালের শুরুর দিকের মাঝামাঝি সময়ে আমরু বিন উমাইয়াহ আদ দামরি মারফত পত্র পাঠিয়েছিলেন। বরং যার জন্য জানাযার নামাজ পড়া হয়েছিল তিনি সে নাজ্জাশী যিনি ইসলাম গ্রহণের আহ্বান জানিয়ে রাসূলুল্লাহ্ (সা) এর নিকট হতে পত্রগ্রহণকারী নাজ্জাশীর মৃত্যুর পর সিংহাসনে আরোহণ করেন।

যে নাজ্জাশী ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন তিনি হিজরতের সপ্তম বছরে ক্ষমতা গ্রহণ করেন। এর কারণ হলো হুদাইবিয়ার অভিযাত্রা শেষ করে রাসূলুল্লাহ্ (সা) নাজ্জাশী সহ অন্যান্য শাসকদের কাছে তাঁর বার্তাবাহককে প্রেরণ করেন। এটা ছিল হিজরী ষষ্ঠ সালের শেষ মাস, অর্থাৎ জিলক্বদ। এ নাজ্জাশী সপ্তম বছরে মারা যান এবং এর মধ্যে ইসলাম গ্রহণকারী নাজ্জাশী ক্ষমতা গ্রহণ করেন এবং তার জন্যই রাসূল (সা) জানাযার নামাজ আদায় করেন। আর এই নাজ্জাশী মারা গিয়েছিলেন অষ্টম হিজরীতে মক্কা বিজয়ের পূর্বেই যা আল বায়হাকী তার ‘দালাইল আন নব্যুয়্যাত’-এ উল্লেখ করেন।

সুতরাং তার ক্ষমতা গ্রহণ, ইসলাম গ্রহণ এবং মৃত্যুবরণ, সবই একটি স্বল্প সময়ের মধ্যে সংঘটিত হয়েছিল। তিনি গোপনে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন এবং কেউ এ ব্যাপারে জ্ঞাত ছিল না, এমনকি রাসূলুল্লাহ্ (সা)ও নন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) তার ইসলাম গ্রহণ ও মৃত্যুর বিষয়টি তিনি যেদিন মারা যান সেদিনই ওহীর মাধ্যমে অবগত হন যা আমরা বুখারী কর্তৃক বর্ণিত নাজ্জাশীর মৃত্যু সংক্রান্ত ছয়টি হাদীস থেকে জানতে পারি। ইসলাম গ্রহণ ও মৃত্যুর মধ্যবতীর্ স্বল্প সময়ের মধ্যে তার পক্ষে ইসলামের আইন-কানুন সমূহ জানা সম্ভব ছিল না। ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ্ (সা) এর কাছে কোন ধারণা না থাকায় তিনি নাজ্জাশীর কর্তব্য সম্বন্ধে জানাতে পারেননি।

সেকারণে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা যা নাযিল করেছে তা অনুসারে শাসন না করে কুফর শাসনব্যবস্থায় অংশগ্রহণ করতে এটাকে দলিল হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না। সুতরাং তাদের যুক্তি অসার প্রমাণিত হলো।

Leave a Reply