২য় যুক্তি ও এর খন্ডন

তাদের মতে আল্লাহ ধাপে ধাপে মদ নিষিদ্ধ করেছেন।

তিনি (সুবহানাহু ওয়া তাআলা) বলেন:

“তারা তোমাকে মদ ও জুয়া সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। বলে দাও এতদুভয়ের মধ্যে রয়েছে মহাপাপ। আর মানুষের জন্যে উপকারিতাও রয়েছে, তবে এগুলোর পাপ উপকারিতা অপেক্ষা অনেক বড়।”
(আল-কুরআন ২:২১৯)

তিনি (সুবহানাহু ওয়া তাআলা) বলেন:

“হে ঈমানদারগণ তোমরা যখন নেশাগ্রস্ত থাক, তখন নামাজের ধারে কাছেও যেওনা, যতক্ষণ না বুঝতে সক্ষম হও যা কিছু তোমরা বলছ।”
(আল-কুরআন ৪:৪৩)

তিনি (সুবহানাহু ওয়া তাআলা) বলেন:

“হে মুমিনগণ! এই যে মদ, জুয়া, আল-আনসাব (দেব-দেবীর উদ্দেশ্যে উৎসর্গকৃত পশু), আল-আযলাম (ভাগ্য নির্ধারক শরসমূহ) এগুলো শয়তানের অপবিত্র কাজ ছাড়া অন্য কিছুনা। অতএব এগুলো থেকে বেঁচে থাক, যাতে তোমরা কল্যাণপ্রাপ্ত হও। শয়তান তো চায় মদ ও জুয়ার মাধ্যমে তোমাদের পরস্পরের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষ সঞ্চারিত করে দিতে এবং আল্লাহর স্মরণ ও সালাত থেকে তোমাদেরকে বিরত রাখতে। অতএব তোমরা এখনও কি নিবৃত্ত হবেনা ?”
(আল-কুরআন ৫:৯০-৯১)

ধাপে ধাপে ইসলামের বাস্তবায়ন পদ্ধতির ধারণায় যারা বিশ্বাসী তারা এসব আয়াতের প্রেক্ষিতে বলে থাকে যে শুরুতে মদ অনুমোদিত ছিল যা  প্রথম আয়াত থেকে প্রমাণিত। পরবর্তীতে এই অনুমোদনকে সীমিত করা হয় এই আয়াতের মাধ্যমে

হে ঈমানদারগণ তোমরা যখন নেশাগ্রস্ত থাক, তখন নামাজের ধারে কাছেও যেওনা।” (আল-কুরআন ৪:৪৩) এবং এই সীমিত অনুমোদনকে সর্বশেষে নিষিদ্ধ করা হয়।

আইনগত দৃষ্টি ভঙ্গি থেকে যদি কেউ এই আয়াতগুলো নিয়ে চিন্তা করে তাহলে মদ নিষিদ্ধ হওয়ার কোন ক্রমান্বয়িকতা দেখতে পাবেনা। বরং বাস্তবতা হচ্ছে নিষিদ্ধ হওয়ার পূর্বে মদের ব্যপারে কোন শর’ঈ হুকুমই ছিলনা। অন্যভাবে বলা যায় মদ্যপান তখন একটি অনুমোদিত বিষয় ছিল যদিও তখন মুসলিমরা মদ্যপান অব্যাহত রেখেছিল তৃতীয় আয়াত নযিল হওয়ার আগ পর্যন্ত। এই ধারণাটি উমর (রা) এর নিম্নেক্ত ঘটনাটির মাধ্যমেও সমর্থিত; তিনি বলেছিলেন: “হে আল্লাহ! তুমি মদের ব্যপারে আমাদেরকে স্পষ্ট ধারণা দাও কারণ তা আমাদের সম্পদ কেড়ে নেয় এবং মানসিকতাকে নষ্ট করে ফেলে।” জবাবে তখন এই আয়াত নাযিল হয়: 

“তারা তোমাকে মদ ও জুয়া সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে” (আল-কুরআন ২:২১৯) উমর(রা) দুআ করেছিলেন এবং তার কাছে এই আয়াত পাঠ করে শোনানো হয়েছিল। তিনি আবারো বললেন “হে আল্লাহ তুমি মদের ব্যপারে আমাদেরকে স্পষ্ট নির্দেশনা দাও।” জবাবে তখন এই আয়াত নাযিল হয়:

“হে ঈমানদারগণ তোমরা যখন নেশাগ্রস্ত থাক, তখন নামাজের ধারে কাছেও যেওনা, যতক্ষণ না বুঝতে সক্ষম হও যা কিছু তোমরা বলছ।” (আল-কুরআন ৪:৪৩) উমর (রা) দুআ করেছিলেন এবং তার কাছে এই আয়াত পাঠ করে শোনানো হয়েছিল। তিনি আবারো বললেন “হে আল্লাহ তুমি মদের ব্যাপারে আমাদেরকে স্পষ্ট নির্দেশনা দাও” জবাবে তখন এই আয়াত নাযিল হয়:

“হে মুমিনগণ! এই যে মদ, জুয়া, আল-আনসাব (দেব-দেবীর উদ্দেশ্যে উৎসর্গকৃত পশু), আল-আযলাম (ভাগ্য নির্ধারক শরসমূহ) এগুলো শয়তানের অপবিত্র কাজ ছাড়া অন্য কিছুনা। অতএব এগুলো থেকে বেঁচে থাক।”
(আল-কুরআন ৫:৯০)

অতএব উমর (রা) এভাবেই দুআ করে যেতে থাকলেন যতক্ষণ না নিম্নোক্ত আয়াত নাযিল হয়:

“অতএব, তোমরা এখনও কি নিবৃত্ত হবেনা?” (আল-কুরআন ৫:৯১) জবাবে উমর (রা) বললেন: “আমরা নিবৃত্ত হলাম! আমরা নিবৃত্ত হলাম!”  [আহমাদ , তিরমিযী, নাসাঈ, এবং আবু দাউদ থেকে বর্ণিত]

     উমর (রা) মদের ব্যাপারে স্পষ্ট নির্দেশনা দেয়ার জন্য আল্লাহর কাছে দু’আ করতে থাকলেন যা উপরে উল্লেখিত তৃতীয় আয়াত নাযিল হওয়ার আগ পর্যন্ত মুসলিমদের জন্য বৈধ ছিল। তিনি (রা) তাঁর (সুবহানাহু ওয়া তাআলা) কাছে প্রথম এবং দ্বিতীয় আয়াত নাযিল হওয়ার পরও দু’আ করা অব্যাহত রাখলেন যার মাধ্যমে এটা প্রমাণিত হয় যে, তৃতীয় আয়াত নাযিল হওয়ার আগ পর্যন্ত মদ্যপান মুবাহ (অনুমোদিত) ছিল।

দ্বিতীয় আয়াতের মূল বিষয়  ছিল সালাত, মদ্যপান নয়। অর্থাৎ এ আয়াতটি সালাতের সাথে সম্পর্কিত। কেউ যদি এই আয়াতের ফিক্হ ভালভাবে পর্যবেক্ষণ করে তাহলে দেখতে পাবে এখানে সালাতের সময় কাউকে মদ্যপান করতে নিষেধ করা হচ্ছেনা বরং নিষেধ করা হচ্ছে মদ্যপ অবস্থায় সালাত আদায় করতে যাতে মুসলিমরা বুঝতে পারে তারা কি তিলাওয়াত করছে। এই আয়াত নাযিল হওয়ার পরে কোন মুসলিমকে যদি দেখা যেত এমন অবস্থায় সালাত আদায় করছে যখন তার মুখ থেকে মদের গন্ধ আসছে অথবা সে তার সাথে মদের ভিস্তি (পানীয় বহনের জন্য ব্যবহৃত চামড়ার ব্যাগ) বহন করছে বা সে নির্দিষ্ট পরিমাণের মদ পান করেছে যা তার চিন্তাশক্তিকে প্রভাবিত করেনি তাহলে সেক্ষেত্রে দোষের কিছু ছিল না।

প্রথম আয়াতে আল্লাহ মদ্যপানকে তিরস্কার করেছেন কারণ তা ক্ষতিকর। দ্বিতীয় আয়াতে মদ্যপ অবস্থায় সালাত আদায় নিষিদ্ধ করা হয় এবং তৃতীয় আয়াতে মদ্যপান নিষিদ্ধ করা হয়। এই ঘটনাকে কোনভাবেই ক্রমান্বয়িক বলা যায় না কারণ সূরা আল মায়িদাহতে নাযিলকৃত আয়াতের মাধ্যমে মদ নিষিদ্ধ করার পরে রাসূল (সা) অথবা সাহাবা (রা) অথবা তাবিঈন অথবা অথবা তাদের পরবর্তীদেব মধ্যে কেউ কখনোই মদ্যপানকে অনুমোদন দেয় নি। মুসলিম উম্মাহর শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদগণদের মধ্যে এবং মুজাতাহিদীনের মধ্যেও কেউ কখনোই কোন ফিকহের কিতাবে মদ নিষিদ্ধ হওয়ার ক্ষেত্রে ক্রমান্বয়িকতার কথা বলেননি। যখন পূর্ণ উদ্যমে ইসলামের বিজয় চলছিল, নতুন নতুন ভূথণ্ড ইসলামের অধীনে আসছিল এবং লোকজন দলে দলে দ্বীনের মধ্যে দাখিল হচ্ছিল তখন বিজয়ী মুসলিমদের কেউই নওমুসলিমদের নতুন  ইসলামে আসার দিকে ভ্রম্নক্ষেপ করেননি অথবা তাদের মদ্যপানের ব্যপারেও নীরব থাকেননি। যেসব মুসলিম বিজিত ভূখন্ডে গিয়েছিলেন তারা নওমুসলিমদের জন্য সেসব ধাপ পার হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করেননি মদ্যপান নিষিদ্ধ করার ক্ষেত্রে যেসব ধাপ পার করা হয়েছিল। যদিও হয়তো সেক্ষেত্রে পরিস্থিতি অনুযায়ী  কারো কারো কাছে ক্রমান্বয়িকতা দরকারী ছিল বলে মনে হতে পারে, কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে তাদের কাছে এর কোন তাৎপর্যই ছিলনা। আমাদের প্রাথমিক যুগের ইমামদের কেউই এই ধাপে ধাপে বাস্তবায়ন ধারণার সাথে পরিচিত ছিলেননা বরং এটি হচ্ছে একটি নতুন আলোচনা যা দু:সহ বাস্তবতা এবং যন্ত্রণাদায়ক পরিস্থিতির কারণে কিছু তথাকথিত চিন্তাবিদ উদ্ভাবন করেছেন। তারা নির্দিষ্ট কিছু হুকুমের ক্ষেত্রে নয় বরং পুরো দ্বীনের জন্যই এই ধারণাটিকে একটি চিন্তার পদ্ধতি হিসেবে  প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। রাসূল (সা) যথার্থই বলেছেন:

“…তোমাদের মধ্যে যারা দীর্ঘজীবী হবে নিশ্চিতভাবেই তারা অনেক বিতর্ক দেখতে পাবে। নতুন উদ্ভাবিত বিষয় সম্পর্কে সতর্ক থাক কারণ প্রত্যেকটা নতুন বিষয়ই বিদআত এবং প্রত্যেকটা বিদআতই জাহান্নামের দিকে নিয়ে যায়…নিজেদেরকে আমার সুন্নাহর উপরে এবং সৎপথপ্রাপ্ত খলিফাদের সুন্নাহর উপরে রাখ, তাদেরকে শক্তভাবে আঁকড়ে ধর।”
[আবু দাউদ এবং আত-তিরমিযি থেকে বর্ণিত]

এখন প্রশ্ন হচ্ছে যারা ধাপে ধাপে বাস্তবানেরপক্ষে কথা  বলে তাদের জন্য কি এটা বৈধ হবে যে তারা ধাপে ধাপে আসা কোন হুকুমের সর্বশেষ হুকুমকে গ্রহণ না করে বরং পূর্বের কোন হুকুমকে গ্রহণ করতে পারবে?

নিশ্চিতভাবেই এর উত্তর হচ্ছে; ‘ না ’। কারণ শরীয়া মদ্যপানকে সুনির্দিষ্টভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। ফলে পূর্ববর্তী কোন হুকুম মেনে চলার অনুমোদন আমাদেরকে দেয়া হয়নি কারণ শরীআ’হ যা করতে নিষেধ করেছে আমাদেরকে তা অবশ্যই মানতে হবে। এটাই ছিল সালাফ (পূর্ববর্তীদের) এবং খালাফ (পরবর্তীদের) উভয় প্রজন্মের অবস্থান। মদের ব্যাপারেও একই হুকুম বিদ্যমান। এই হুকুমটি কখনো বিন্দুমাত্রও পরিবর্তিত হবেনা এবং যে মদ্যপান করবে তার অপরাধও কিছুমাত্র কমবেনা।

১ম যুক্তি ও এর খন্ডন

৩য় যুক্তি ও এর খণ্ডন

Leave a Reply