মানাত (বাস্তবতা) উপলদ্ধি

আহকাম বুঝবার জন্য ইসলামি পদ্ধতির ভিত্তি হল: সমস্যাকে গভীরভাবে উপলদ্ধি করা, এর মর্মোদ্ধার করা, সমস্যার সমাধানের জন্য প্রয়োজনীয় শরীয়া দলিল এবং সবশেষে এই শরীয়া দলিল থেকে হুকুম বের করে নিয়ে আসা।

সুতরাং পরিবর্তনের লক্ষ্যে কাজ করা একটি দলের উপস্থিতি এটি যে বাস্তবতায় আছে তার সাথে সম্পর্কযুক্ত। কেননা এ বাস্তবতার নিরীখেই দলটিকে ঐ বাস্তবতা পরিবর্তনের প্রয়োজনীয় শরীয়া হুকুম বের করতে হবে।

আর কোন বিষয়ের বাস্তবতা বুঝতে হলে একজনকে ঐ বিষয়টি গভীরভাবে অধ্যয়ন করতে হবে।

শরী’আহ বুঝতে হলে প্রথমেই এর উৎস সুনির্দিষ্ট করতে হবে এবং উসুল ও মূলনীতি গ্রহণ করতে হবে যার ভিত্তিতে হুকুসমূহ বের করে আনতে হবে। হুকুম আহরণের এই প্রক্রিয়া সম্পন্নের জন্য একজন মুজতাহিদ প্রয়োজন, যিনি যে কোন হুকুমকে তার বাস্তবতা অনুসারে প্রয়োগ করতে পারবেন এবং ইল্লাহ বা ঐশী কারণ অনুসারে কার্যকর করতে পারবেন।

সুতরাং একটি দল বা হিজবের উত্থান বাস্তবতার সাথে সম্পর্কযুক্ত। দলটি বাস্তবতা পরিবর্তনের লক্ষ্যে কাজ করে। সে কারণে এর চিন্তা ও পরিবর্তনের একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য থাকে। সে কারণে দলকে বাস্তবতা গভীরভাবে ও সুনির্দিষ্টভাবে উপলদ্ধি করতে হবে এবং যে সমস্যা সমাধান করা হবে তা খুঁজে বের করতে হবে। অগণিত সমস্যা রয়েছে। সেকারণে বিভিন্ন সমস্যার মধ্যকার পার্থক্য অনুধাবন করতে পারতে হবে। একজনকে যেমনি মূল সমস্যা বুঝতে হবে তেমনি মূল সমস্যা থেকে উদ্ভুত শাখা সমস্যাগুলোও বুঝবার মত সক্ষমতা থাকতে হবে। এর মাধ্যমে একটি সমস্যা ও এর আপাত উপস্থিতির মধ্যকার পার্থক্য প্রতীয়মান হবে অর্থাৎ অসুস্থতার মূল কারণ ও সেকারণে সৃষ্ট উপসর্গের মধ্যকার পার্থক্য বুঝা যাবে। মূল কারণ সনাক্ত হবার পর একজন এর প্রতিকারের জন্য প্রচেষ্টা চালাবে।

এখানে আমরা একজন অভিজ্ঞ ও দক্ষ ডাক্তারের সাথে তুলনা করতে পারি, যিনি রোগের মূল কারণ উপলদ্ধি না করে উদ্ভুত উপসর্গ দ্বারা প্রতারিত হন না। যেমন: কোন লোকের পেটের অসুখ আছে এবং একারণে প্রতিক্রিয়াস্বরূপ তার চামড়ায় ফুসকুড়ি সহ জ্বর হল। যদি সে ডাক্তার কেবলমাত্র চামড়ায় ফুসকুড়ি সহ জ্বরের চিকিৎসার জন্য ঔষধ প্রদান করেন কিন্তু পেটের অসুখের জন্য কোন ব্যবস্থা গ্রহণ না করেন, তাহলে এ চিকিৎসা নিশ্চিতভাবে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে যাচ্ছে। সে কারণে চিকিৎসককে প্রথমে মূল সমস্যার প্রতিবিধান করতে হবে, অর্থাৎ পেটের ব্যাধি। যদি তা করা হয় তাহলেই কেবলমাত্র উপসর্গসহ মূল অসুখের প্রতিকার করা হবে। মূল চিকিৎসার পরে ডাক্তার উদ্ভুত উপসর্গগুলোর জন্য প্রয়োজনে চিকিৎসার সিদ্ধান্ত নেবে। তবে স্বাভাবিকভাবে উদ্ভুত উপসর্গগুলো মূল সমস্যার সাথে সাথে উপশম হয়ে যাবার কথা। আর না হলে পরবতীর্তে এগুলো চিকিৎসা করা যাবে। যদি সেটার প্রয়োজন হয় তাহলে সেটা হবে একটি আংশিক কাজ।

একই কথা আমরা যে বাস্তবতায় বাস করি সেক্ষেত্রে প্রযোজ্য। আমরা জানি, বাস্তবে কিছু মৌলিক সমস্যা রয়েছে এবং এসব সমস্যা থেকে কিছু উদ্ভুত সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। একটি বড় মৌলিক সমস্যা যা আজকে উম্মাহকে ক্লিষ্ট করে তুলেছে তা হল মুসলিমদের জীবনে আল্লাহর সার্বভৌমত্বের অনুপস্থিতি। এটি থেকে অনেক উদ্ভুত সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে, যেমন: অবিচার থেকে উদ্ভুত দারিদ্রতা, অজ্ঞানতা, অনৈতিক কাজের বি¯তৃতি এবং অবৈধ সম্পর্কের প্রাধান্য। এর মূল কারণ সম্পর্কে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা পবিত্র কোরআনে বলেন, 

‘যে আমার স্মরণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে, তার জীবিকা সংকীর্ণ হবে।’
(সূরা ত্বোয়াহা: ১২৪)

এই আংশিক সমস্যাসমূহ মূল একটি সমস্যা বা বাস্তবতার কারণে সৃষ্টি হয়েছে। যদি এই বাস্তবতার পরিবর্তন না হয় তাহলে এক্ষেত্রে টেকসই ও মৌলিক পরিবর্তন সংঘটিত হবে না। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বর্ণিত কুপ্রভাব থেকে কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত বের হতে পারবে না যতক্ষণ না আল্লাহর আদেশ নিষেধের ভিত্তিতে ইসলামি আক্বীদাকে রাজনৈতিক মতবাদ হিসেবে গ্রহণ করে জীবনধারা পূণপ্রবর্তন হবে।

সুতরাং শিক্ষা, নৈতিকতা বা অর্থনৈতিক সংকট মৌলিক সমস্যা নয়। মুসলিমদের অধিকার পুণরুদ্ধার বা তাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থাকে শক্তিশালী করাও মৌলিক সমস্যা নয়। বরং আক্বীদা ও বাস্তবতার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে মৌলিক সমস্যা হল আল হাকিমিয়্যাহ বা সার্বভৌমত্ব। এই সার্বভৌমত্ব কেবলমাত্র আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার জন্য। সে কারণে আমাদেরকে ইসলামের সমাধানের উপর মুসলিমদের ভেতরে আত্নবিশ্বাস তৈরি করতে হবে। আমরা অবশ্যই তাদের হৃদয়ে হৃত আক্বীদা, আক্বীদা থেকে উদ্ভুত ব্যবস্থা জীবনে ফিরিয়ে আনবার জন্য সদিচ্ছা ফিরিয়ে আনবার জন্য প্রচেষ্টা চালাব যাতে করে তারা জান্নাত লাভ, জাহান্নামকে ভয় করে ও এর শাস্তি থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার চেষ্টা করে, ইসলামি আক্বীদার ভিত্তিতে মুসলিমদের বর্তমান করুণ অবস্থা তথা পুরো মানবতা সম্পর্কে সচেতন হয়।    

এ উপলদ্ধি থেকে দলটি মৌলিক সমস্যাকে সংজ্ঞায়িত করবে এবং সুনির্দিষ্টভাবে জানবে যখন এ রোগের চিকিৎসা হবে তখন সব উদ্ভুত উপসর্গ দূরীভূত হবে। সুতরাং বাস্তবতা সম্পর্কে সচেতনতার গুরুত্ব এখন সুস্পষ্ট। 

একে উসুলী চিন্তাবিদগন মানাত বলে থাকেন। শারীয়া প্রমাণাদি নিয়ে আসবার আগে মানাত বা বাস্তবতাকে গভীরভাবে নিরীক্ষণ করা বাধ্যতামূলক।

বাস্তবতা সম্পর্কে সচেতন হওয়া এবং তা বুঝা এর সাথে সংশ্লিষ্ট হুকুমের চেয়ে কঠিন। এর জন্য দরকার যথার্থতা। কারণ যদি আমরা বাস্তবতা বুঝতে ভুল করি এবং এই ভ্রান্তি মনের উপর কোন ছাপ ফেলে তাহলে স্বভাবতই আমরা এমন দলিল উপস্থাপন করব যা হৃদয়নিবেশিত ভাবরাশিতে থাকা চ্যুত বাস্তবতাকে উপস্থাপন করবে। কখনওই আসল বাস্তবতাকে নয়। অর্থাৎ আমরা এমন দলিল উপস্থাপন করব যা বাস্তবতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

বাস্তবতা বুঝার জন্য চিন্তার ব্যবহার অপরিহার্য। বাস্তবতাকে চিন্তার উৎস হিসেবে নির্ধারণ করা অনুমোদিত নয়। এমন কোন সমাধান গ্রহণ করা অনুমোদিত নয় যা বাস্তবতা থেকে উদ্ভুত। সেকারণে বাস্তবতাকে এর মত করেই বুঝতে হবে।

Leave a Reply