তারা দলিল হিসেবে আল্লাহর আইন বাস্তবায়ন না করলে ’অসৎ শাসক’দের বিরুদ্ধে রাসূলুল্লাহ (সা) এর অস্ত্রধারণ করবার নির্দেশনার কথা উল্লেখ করেন।
এ অবস্থার প্রতিক্রিয়ায় বলতে চাই যে, অমত পোষণ করলেনও এ ধরনের চিন্তা যারা পোষণ করে তাদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে এটুকু বলব যে, আলোচ্য হুকুমের মানাত (যে বাস্তবতার জন্য হুকুমটি এসেছে) বুঝতে পারলে হাদীসটি হৃদয়ঙ্গম করাও সহজতর হবে। এ হাদীসটি মূলত দার ঊল ইসলামের ইমাম এর বিষয়ে যাকে আইনগতভাবে শরঈ বায়া’আত দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ মুসলিমদের বায়া’আতের মাধ্যমে তিনি একজন ইমাম হয়েছেন। আর এই ইমাম যে ভূমিকে শাসন করেন তাকে দার ঊল ইসলাম বলা হয়। অর্থাৎ এ ভূমি ইসলাম দ্বারা শাসিত হয় এবং এর নিরাপত্তা কেবলমাত্র মুসলিমদের হাতেই ন্যস্ত। মুসলিমগণ তাকে অনুসরণ করতে বাধ্য। যদি সে শাসক আল্লাহ যা নাজিল করেছেন তা দিয়ে শাসন করবার ক্ষেত্রে সীমা অতিক্রম করেন এবং প্রকাশ্যে কুফর আইন দিয়ে জনগনকে পরিচালনা করতে থাকেন এমনকি যদি সেটি একটিও হুকুম হয় যে ব্যাপারে সুবহাত দলিলও বা শারী’য় দলিলের সাথে সাদৃশ্য খুজে পাওয়া না যায় তখন প্রয়োজনে মুসলিমদের অস্ত্র ধারণ করে তাকে উৎখাত করতে হবে। নিম্নে বর্ণিত এ হাদীসটি নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করলে আমাদের কাছে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। এটি বর্ণণা করেছেন আউফ বিন মালিক আল আসযা’য়ী, যিনি বলেন,
‘আমি রাসূলুল্লাহ (সা) কে বলতে শুনেছি, ‘শাসকদের মধ্যে তারাই সর্বশ্রেষ্ঠ যাদের তোমরা ভালবাস ও যারা তোমাদের ভালবাসে; যাদের জন্য তোমরা প্রার্থনা কর ও যারা তোমাদের জন্য প্রার্থনা করে এবং সবচেয়ে মন্দ শাসক হল তারাই যাদের তোমরা অভিশাপ দাও ও যারা তোমাদের অভিশাপ দেয়।’ তারা বললো, ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমরা কি তরবারীর বলে তাদেরকে অপসারন করব না?’ তিনি বললেন ‘না। যতক্ষন পর্যন্ত তারা তোমাদের মাঝে সালাত কায়েম রাখবে।”
(মুসলিম)
এখানে সালাত কায়েম করা বলতে পুরো শারীয়া বাস্তবায়নকেই বুঝায় ‘বাব তাসমিয়াতুল কুল বি ইসমিল জু’ঝা’ (একটি অংশ বুঝানোর মাধ্যমে পুরো জিনিসটিকে বুঝানো)।
দার উল কুফরের শাসকদের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ভিন্ন বাস্তবতা। সে শাসক মুসলিমদের ইমাম নয়। কারণ সে শরীয়া পদ্ধতি অনুসারে শাসক হিসেবে আসীন হয়নি। বাধ্যবাধকতা হওয়া সত্তেও সে কখনোই ইসলামী আইন তাদের জীবনে বাস্তবায়ন করবার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি প্রদান করেনি।
যখন আমরা বাস্তবতার দিকে তাকাই, তখন বুঝতে পারি এখন পরিবর্তনের প্রক্রিয়ায় অস্ত্র ধারণ করা যথেষ্ট নয়। এটা এখন কেবল শাসকদের পরিবর্তনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং তা ইসলাম দ্বারা শাসন করার বিষয়। সুতরাং কে এই দায়িত্ব পালন করবে? এর জন্য প্রয়োজন রাষ্ট্র পরিচালনায় দক্ষ ব্যক্তি ও একটি ইসলামী রাজনৈতিক মাধ্যম। ইসলাম দিয়ে শাসন করবার বিষয়টি এত সহজ নয় যে, এ দায়িত্ব কোন সেনাপ্রধান বহন করতে পারবেন, তিনি সামরিক দিক দিয়ে অত্যন্ত দক্ষ হলেও ও ইসলামের দিক দিয়ে আন্তরিক হলেও। এর জন্য দরকার অভিজ্ঞতা, উপলদ্ধি, উদ্বুদ্ধকরণ এবং স্বাতন্ত্রমন্ডিত শরীয়ার জ্ঞান।
কেবল রাসূলুল্লাহ (সা) এর পদ্ধতি নীচের সব কিছু নিশ্চিত করে:
- ইসলামী রাষ্ট্র বাস্তবায়নের আগে আসাধারণ মুসলিম রাজনীতিবিদ ও নেতৃত্ব সৃষ্টি করে, যাদের রয়েছে দীর্ঘদিনের দাওয়াতের অভিজ্ঞতা। যিনি কাফেরদের বিরুদ্ধে অপরাজেয় থাকবার জন্য কূটকৌশল ও সূক্ষ্ণ চিন্তার অধিকারী হয়ে উঠেন। তখন তিনি রাষ্ট্রটিকে রক্ষা করবার সক্ষমতা অর্জন করতে পারবেন ও বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্রের মধ্যে মর্যাদার দিক থেকে পথপ্রদর্শক ও পথপ্রদর্শিত, নব্যুয়তের আদলে খোলাফায়ে রাশেদীন হিসেবে পরিগণিত করতে পারবেন।
- এ পদ্ধতি আন্তরিক শাবাব তৈরি করে যারা রাষ্ট্র কায়েমের আগে দাওয়াতের বোঝা বহন করবে। দাওয়াতের ব্যাপারে ওয়াকিবহাল অন্যান্য মুসলিমদের সাথে নিয়ে এই ইসলামী রাজনৈতিক মাধ্যম (Islamic political medium) থেকে এমন লোক তৈরি করবে যাদের মধ্য থেকে ওয়ালী (গভর্ণর), আমীরুল জিহাদ, প্রতিনিধি এবং অন্য রাষ্ট্রে ইসলাম নিয়ে যাবে এমন দাওয়াত বহনকারী হবেন।
- এটা এমন জনপ্রিয় ভিত্তি তৈরি করবে যারা ইসলাম ও রাষ্ট্রকে গ্রহণ (embrace) করবে এবং রক্ষা করবে।
- এটা সুপ্রশিক্ষিত ক্ষমতাধর লোক তৈরি করবে। সাধারণ জনগন বিরুদ্ধাচরণ না করে তাদের সাথে থেকে শক্তি বৃদ্ধি করবে। কেননা তারা (জনগন) বুঝতে পারবে শাসক, শাসনযন্ত্র এবং যে ক্ষমতার উপর তারা (শাসক) নির্ভর করে তা তাদের (জনগন) জন্য একটি শক্তি এবং এ এমন এক দায়িত্ব যা ইসলাম প্রয়োগ ও দ্বীনকে বুলন্দ করবার জন্য আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার নির্দেশ।
তাছাড়া সশস্ত্র আন্দোলনের জন্য দরকার টাকা, অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ। এটা আন্দোলনের জন্য অতিরিক্ত বোঝা হয়ে যাবে যা অন্যদের উপর নির্ভরশীল হতে প্ররোচিত করবে। এটাই ব্যর্থতার প্রথম সোপান। মুসলিমগন এ পথে প্রচেষ্টা চালিয়েছে এবং নিজেদের অনেক ক্ষতিসাধন করেছে। এটা আর উল্লেখের প্রয়োজন নেই যে, ’চেষ্টা করে দেখা যাক’ (try out) একটি ভ্রমাত্বক অভিব্যক্তি।
যখন আমরা বলি অস্ত্রধারণ করা শরীয় পদ্ধতি নয়, তখন মোটেও সেইসব শাসকদের ছাড় দেয়া হয় না যারা মুসলিমদের তোয়াক্কা করে না। বরং আমরা দ্বীনের ভেতর কিছু আন্তরিক ভাইদের তাদের বর্তমান কাজকে পরিত্যাগ করতে বলি যাতে তাদের প্রচেষ্টাকে শরীয়া কাজে একীভূত করতে পারি। আমরা তাদের মক্কীযুগে কিছু সাহাবীর অস্ত্র ধারণ করা বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (সা) এর নিষেধাজ্ঞা মনে করিয়ে দিতে চাই, যখন তিনি (সা) বলেছিলেন,
‘আমি ক্ষমা করবার জন্য আদিষ্ট হয়েছি, সুতরাং যুদ্ধ করো না।’
(সীরাত ইবনে হিসাম)
এছাড়া আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা পবিত্র কোরআনে নাজিল করেন যে,
‘তুমি কি সেসব লোককে দেখনি, যাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল যে, তোমরা নিজেদের হাতকে সংযত রাখ, নামায কায়েম কর এবং যাকাত দিতে থাক? অতঃপর যখন তাদের প্রতি জেহাদের নির্দেশ দেয়া হল,…..।’
(সূরা নিসা: ৭৭)
একইভাবে আমরা আরও শক্তিশালী শরীয় দলিল দেখাতে পারব যার মাধ্যমে দৃঢ়ভাবে বলা সম্ভব যে, দাওয়াতের ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ (সা) এর পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। এর সাথে কোন কিছু যুক্ত করা, বাদ দেয়া, পরিবর্তন করা, সংশোধন দাওয়াত, দল ও ইসলামি উম্মাহের উপর কুপ্রভাব ফেলবে। নবী (সা) এর সুন্নাহকে পূর্ণাঙ্গ অনুসরণের জন্য এ কারণে শরী’আর সঠিক অধ্যয়ন ও রাসূলুল্লাহ (সা) এর পদ্ধতির আনুগত্য করার উপর আমরা গুরুত্ব আরোপ করতে চাই। এটা কেবলমাত্র আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার জন্য যিনি আমাদের সঠিক পথ দেখান।