শরীয় হুকুমসমূহ কী নিরীক্ষামূলক?

দ্বিতীয় প্রশ্নের ক্ষেত্রে:

কিছু লোক আছে যারা ইসলামি রাষ্ট্র বাস্তবায়নের কাজকে নিরীক্ষামূলক হিসেবে নিয়েছে এবং এ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিষয়টি নিরীক্ষামূলক পরিকল্পনা থেকে উদ্ভুত দাওয়াতের মাধ্যমে এগুবে বলে মনে করে। কিন্তু প্রশ্ন হল এ বিষয়ে এভাবে চূড়ান্ত কিছু বলা কী সমীচীন?

পদ্ধতিকে নিরীক্ষামূলক বিষয় হিসেবে উপস্থাপন করা অপাংক্তেয়। এর অর্থ ‘শারী’য় পদ্ধতি’ এর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

ইসলামে যে কোন কাজের পদ্ধতি শরীয় হুকুম দ্বারা স্বীকৃত যা এর দলিলের বিশুদ্ধতার উপর নির্ভর করে। দলটি শরীয়া গ্রহণে যেমনি বাধ্য তেমনি এইসব দলিল গ্রহণের ক্ষেত্রেও রয়েছে বাধ্যবাধকতা এবং প্রমাণিত কোন শরীয় হুকুম থেকে চ্যুত হওয়ার বিন্দুমাত্র সুযোগ তাদের নেই। সুতরাং এটা লক্ষ্যের সাথে সঙ্গতিপূণ নিরীক্ষামূলক (যদি পরীক্ষামূলকভাবে কার্যসম্পাদনের পর সাফল্য পাওয়া যায় তবে সেটাই পদ্ধতি এবং অন্যথায় অন্য কোন পদ্ধতি গ্রহণ করতে হবে) কোন বিষয় নয়।

শরীয় যে কোন হুকুমের ধারক হল শরীয় পদ্ধতি যা ইতোমধ্যে আলোচিত হয়েছে। এর উদ্দেশ্য হল লক্ষ্য অর্জন করা। আর তা হল ইসলামি জীবনধারা পূণপ্রবর্তন। এই হুকুম দলিলের শক্তিমত্তার উপর নির্ভর করে। এগুলো গ্রহণ ও আস্থাভাজন থাকবার মাধ্যমে একজন ব্যক্তি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার উপাসনা করে থাকে। ঐ ব্যক্তি ততক্ষণ পর্যন্ত এটাকে পরিবর্তন করতে পারবে না যতক্ষণ পর্যন্ত অন্য শক্তিশালী দলিল আছে বলে সুনিশ্চিত হওয়া যায়।

একজনকে অবশ্যই শরীয়াগত পদ্ধতিতে রাসূলুল্লাহ (সা) কে অনুসরণ করতে হবে। বর্তমান ধর্মনিরপেক্ষ ব্যবস্থা অনুযায়ী কাজ করা এবং  শরীয় পদ্ধতিতে কাজ করা কখনওই এক বিষয় নয়। ধর্মনিরপেক্ষ ব্যবস্থা থেকে নেয়া সমাধানে লোকজন যে কোন কাজকে সাফল্য বা ব্যর্থতা অথবা লক্ষ্য অর্জন হওয়া বা না হওয়ার ভিত্তিতে উপলদ্ধি করে থাকে।

গ্রহণের ক্ষেত্রে ধর্মনিরপেক্ষ ব্যবস্থা এমন যে, কোনটিই তাদের জন্য চূড়ান্ত সমাধান নয়। এর জন্য প্রয়োজন অবিরত পরিবর্তন ও বিবর্তন। যে কোন পদক্ষেপই তারা গ্রহণ করুক না কেন সেটা নিরীক্ষামূলক। অবশ্য পশ্চিমা সব আইনই নিরীক্ষামূলক। তাদের জন্য একটি পদক্ষেপ সঠিক বা ভুল তা যাচাইয়ের একমাত্র পদ্ধতি হল তা বাস্তবায়নের পর লক্ষ্য অর্জনে সাফল্য বা বিফলতার উপর। এ বাস্তবতা ইসলামের সাথে এ প্রকৃতির কারণেই সম্পূর্ণরূপে বৈসাদৃশ্যপূর্ণ। ইসলামের পদ্ধতি আল্লাহ প্রদত্ত যিনি আল আলীম (সবজান্তা) এবং আল খাবীর (সর্বসচেতন)। যতক্ষণ পর্যন্ত শরীয়া দলিলের উপর নির্ভর করে ততক্ষণ পর্যন্ত এটি নিভূর্ল ও পূর্ণাঙ্গ। এর নিভূর্লতা উৎসারিত হয় শরীয় দলিলের নিভূর্লতা এবং ইসতিদলাল (সংশে­ষণ) থেকে। কোনক্রমেই ফলাফলের উপর এটি নির্ভরশীল নয়। অতএব দলিলের প্রতি আনুগত্য হচ্ছে ভিত্তি, যে ভিত্তি থেকে কাজের মূল্যায়ন হয়। কাজের পদ্ধতির ক্ষেত্রে ফলাফল বলতে বুঝায় ক্ষমতা গ্রহণ ও ইসলাম প্রতিষ্ঠা। আর এ বিষয়টি সম্পর্কে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন, 

‘তোমাদের মধ্যে যারা বিশ্বাস স্থাপন করে ও সৎকর্ম করে, আল্লাহ্ তাদেরকে ওয়াদা দিয়েছেন যে, তাদেরকে অবশ্যই পৃথিবীতে শাসনকর্তৃত্ব দান করবেন। যেমন তিনি শাসনকতৃর্ত্ব দান করেছেন তাদের পূর্ববতীদেরকে এবং তিনি অবশ্যই সুদৃঢ় করবেন তাদের ধর্মকে, যা তিনি তাদের জন্যে পছন্দ করেছেন এবং তাদের ভয়-ভীতির পরিবর্তে অবশ্যই তাদেরকে শান্তি দান করবেন। তারা আমার এবাদত করবে এবং আমার সাথে কাউকে শরীক করবে না।’
(সূরা নূর: ৫৫)

‘হে বিশ্বাসীগণ। যদি তোমরা আল্লাহ্কে সাহায্য কর, আল্লাহ্ তোমাদেরকে সাহায্য করবেন এবং তোমাদের পা দৃঢ়প্রতিষ্ঠ করবেন।’
(সূরা মুহম্মদ: ৭)

যদি ফলাফল না পাওয়া যায়, তাহলে একজন কোনক্রমেই এ পদ্ধতিকে অবজ্ঞা করতে পারবে না বা এটিকে অন্য কোন কিছু দিয়ে প্রতিস্থাপন করতে পারবে না বা এটাকে ব্যর্থ ঘোষণা করতে পারবে না। বরং পদ্ধতির হুকুমটি আরও study and review  করে দেখা উচিত। কোন শরীয় হুকুমকে পরিত্যাগ করা যাবে না যদি না দলটি বুঝতে পারে তারা হুকুমটি বুঝতে ভুল করেছিল। যদি দলটি ভুল না পায় তাহলে ঐ বিশেষ হুকুমের ব্যাপারে তাদের নিজস্ব মতামতের উপর দৃঢ় থাকতে হবে এবং ততক্ষণ পর্যন্ত সবর করতে হবে যতক্ষণ না আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বিজয় দান করেন। অথবা বিষয়টি এমন হতে পারে যা ‘বিজয়ের বিলম্ব’ সুত্রের কারনে প্রলম্বিত হচ্ছে, যা থেকে নবীরা পর্যন্ত রেহাই পাননি। এ সম্পর্কে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন, 

‘এমনকি যখন পয়গম্বরগণ নৈরাশ্যে পতিত হয়ে যেতেন, এমনকি এরূপ ধারণা করতে শুরু করতেন যে, তাদের অনুমান বুঝি মিথ্যায় পরিণত হওয়ার উপক্রম হয়েছিল, তখন তাদের কাছে আমার সাহায্য পৌছে।’
(সূরা ইউসুফ: ১১০) 

অবশ্যই এ কাজটি ব্যাপক ক্লান্তিকর ও কষ্টকর ও ব্যাপক প্রচেষ্টা সাপেক্ষ। দলটি যে শাসকদের মুখোমুখি হচ্ছে তার চেয়ে দলটির ক্ষমতা অনেক কম। কাজের সাফল্য কখনওই সময়সাপেক্ষ নয় যে, একটি নির্দিষ্ট সময় পার হওয়ার পর সাফল্য না আসলে আমরা ধরে নেই যে এটা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। বরং এটি চিন্তার পরিশুদ্ধতা, চিন্তাধারণকারীদের দৃঢ়তা এবং জনগনের গ্রহণের সার্বজনীনতার সাথে সম্পর্কযুক্ত। যখন এই পূর্বশর্তগুলো পূরণ হবে তখন একজন ধরে নিতে পারে যে দলটি রাসূলুল্লাহ (সা) এর মত নুসরা অনুসন্ধানের মাধ্যমে বিজয়ী হবে। এ ব্যাপারে মূল্যায়ন হল যে, বিজয় কেবলমাত্র আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার পক্ষ থেকে আসে। দলটি মূল্যায়ন করবে হুকুম ও দলিলের শক্তিমত্তার সম্ভাব্যতার ব্যাপারে।        

যদি বিজয়ের শর্তসমূহ পূরণ করা যায়, তাহলে এটা আসবে। অন্যথায় এটা প্রলম্বিত হবে। বিজয় আসবার ক্ষেত্রে বিলম্ব বিফলতার নামান্তর নয়। হতে পারে যে, প্রস্তুতি ও তৎপরতার মাত্রা সন্তোষজনক নয় এবং তা বাড়াতে হবে। দল বা দলের শাবাবদের জন্য এ প্রলম্বন একটি পরীক্ষা হতে পারে যে, কেউ কি এ কারণে ভগ্নমনোরথ হয়ে পরিত্যাগ করে প্রতিশ্রুতি থেকে দূরে সরে এসেছে নাকি দৃঢ় থেকেছে? যে কোন পরিস্থিতিতে পূর্ণমূল্যায়ন করতে হবে। যদি পদ্ধতি পরিবর্তন করবার মত কোন যুক্তিসংগত কারণ দলটি খুজে না পায়, তাহলে কেবলমাত্র বিলম্বজনিত কারণে পদ্ধতি পরিবর্তন করা যাবে না। দলটিকে এর ধরন ও উপকরণকে বারংবার পরীক্ষা করে দেখতে হবে। আর অনুমোদিত এবং সর্বাপেক্ষা কার্যকরী ধরন ও উপকরণকে গ্রহণ করতে হবে। সুতরাং বিজয়ের বিলম্ব মানে বিফলতা নয়। তাছাড়া এমন কোন শরীয় বিধান নেই যে, একটি নির্দিষ্ট সময়কালের মধ্যে উদ্দেশ্য হাসিল করতে হবে।   

অবশ্যই পদ্ধতি সংশ্লিষ্ট হুকুম ও চিন্তার সঠিকতার বিষয়টিতে মনোযোগ নিবদ্ধ করতে হবে। এ চিন্তা দিয়েই শাবাবগন ও উম্মাহ প্রস্তত হবে। যদি দলটি এই চিন্তা ও হুকুমসমূহকে বিশুদ্ধ মনে করে সঠিক ধরন ও উপকরণকে গ্রহণ করে ধৈয্যের্র উপর দৃঢ় থাকে, তাহলে বিলম্বের জন্য চিন্তা ও হুকুম পরিবর্তন অনুমোদিত নয়।     

পরিবর্তনের বিষয়টি ব্যক্তি নয় উম্মাহর সাথে সম্পর্কযুক্ত। একজন ব্যক্তিকে পরিবর্তনের চেয়ে সমাজ পরিবর্তনের কৌশল অনেক জটিল। সুতরাং এর গতি শ-থ এবং সহজে অনুধাবন করা যায় না। তবে সে অনুধাবন করতে পারে যার রয়েছে দূরদৃষ্টিমূলক চিন্তা এবং সঠিক পৃষ্টপোষকতা। এর অর্থ এই নয় যে, যখন কোন ব্যক্তি লক্ষ্যটাকে মাথায় নিয়ে কাজ করবে তখন তার মনোবৃত্তি এই হবে যে, সে সাফল্য অর্জন করতে পারবে না অথবা সাফল্য অর্জিত হবে ভবিষ্যত প্রজন্মের হাতে। বরং তাদেরকে এই মনোবৃত্তি পোষণ করতে হবে যে, রাসূলুল্লাহ (সা) ও তার সাহাবী (রা) এর মত তাদের হাতেই ইনশাআল্লাহ খিলাফত প্রতিষ্ঠিত হবে এবং তারা এর সাক্ষী হবে। একজন ব্যক্তির জীবন সংক্ষিপ্ত বা দীর্ঘ হতে পারে। সুতরাং বিজয়ের প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন কেবলমাত্র একজন ব্যক্তির জন্য নয় বরং পুরো দলের জন্য। তারা সেই বিশ্বাসীদের দল যাদের পৃথিবীতে ইসতিখলাফ বা সাফল্যের ব্যাপারে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এ কাজের সময় একজন ব্যক্তিবিশেষের মৃত্যু হতে পারে, দলের আমীর মারা যেতে পারেন, কেউ কেউ এ পথ থেকে ছিটকে যেতে পারেন; কিন্তু প্রতিশ্রুতি ততক্ষণ পর্যন্ত বলবৎ থাকবে যতক্ষণ পর্যন্ত দলটি আল্লাহর নির্দেশ পালনে তৎপর থাকবে। বিজয় বিলম্বিত হোক বা না হোক, এ দলের কাছে বিজয়ের বিষয় আসবে। এ বিষয়ের জ্ঞানের ব্যাপারে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা ছাড়া আর কেউ দায়িত্বশীল নয়। কিন্তু দলটি কেবলমাত্র সঠিক পদ্ধতি গ্রহণের ব্যাপারে দায়িত্বশীল।

সুতরাং কারও বলা ঠিক হবে না শরীয় হুকুম এমন একটি নিরীক্ষামূলক বিষয় যে, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে লক্ষ্য অর্জনের বিষয়টি অনুভূত না হলে আমরা একে ব্যর্থতা বলে গন্য করব এবং অন্য একটি নিরীক্ষামূলক পদ্ধতি দ্বারা এটিকে প্রতিস্থাপন করব। যতক্ষণ পর্যন্ত শরীয় দলিল দ্বারা পদ্ধতিটি সুপ্রমাণিত থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত কেউ এ ধরনের কথা বলবার এখতিয়ার রাখেন না। তবে ধরন ও উপকরণের ক্ষেত্রে নিরীক্ষা চালানো সঠিক।

Leave a Reply