ইসলামে রয়েছে ফিকরাহ (চিন্তা) এবং তরীকা (পদ্ধতি)

যখন আমরা আল্লাহর হুকুমকে প্রতিষ্ঠিত করবার জন্য পদ্ধতির কথা চিন্তা করব তখন এ ব্যাপারে আল্লাহ প্রদত্ত শরীয়া নিয়মকানুন অনুসন্ধান করব যাতে মুসলিমগন পরম করুণাময়ের কাছ থেকে পূর্ণ সচেতনতা, নির্দেশনা ও হেদায়েতের মাধ্যমে অগ্রসর হতে পারবে। তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেন,

“বলে দিন: এই আমার পথ। আমি আল্লাহ দিকে বুঝে সুঝে দাওয়াত দেই— আমি এবং আমার অনুসারীরা” (সূরা ইউসুফ: ১১২)

এটা অবশ্যই বলা উচিত হবে না যে, ‘শরীয়ার প্রকৃতিই এমন যে, এটি যে কোন বিষয়ে একটি হুকুমকে আমাদের সম্মুখে পরিষ্কার ভাবে উপস্থাপন করে এবং তারপর তা কিভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে তা লোকদের মন, পরিস্থিতি কিংবা, স্বার্থরক্ষার জন্য যে পদ্ধতি সুবিধাজনক হয় তার উপর ছেড়ে দেয়।’ এ থেকে বুঝা যেতে পারে, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা ইসলামী রাষ্ট্র বাস্তবায়ন করাকে আমাদের জন্য ফরয করে দিয়েছেন। সুতরাং উম্মাহর প্রচেষ্টা ফরয বাস্তবায়নের দিকে থাকা উচিত। কিন্তু, তা বাস্তবায়নের পদ্ধতি মুসলমানদের উপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে; এমন দাবী করা কোন অবস্থাতেই ঠিক নয়। কারণ, শরীয়া কোন কিছুই মানুষের ইচ্ছার উপর ছেড়ে দেয়নি এবং তার পছন্দের বশবতীর্ করেনি। যদি করত তবে তা হত শরীয়া মূলনীতির সাথে সাংঘর্ষিক। এমন কোন শরীয়া নীতি নেই যেখানে একটি সমস্যার সমাধান উপস্থাপন করা হয়েছে কিন্তু, তা বাস্তবায়নের প্রয়োগযোগ্য পদ্ধতি পরিষ্কার ও পূর্ণাঙ্গভাবে উপস্থাপন করা হয়নি। বরং এইসব সমাধানসমূহ এমনভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে যাতে তা বাস্তবায়ন করা যায় ও জীবনের বাস্তবতায় প্রয়োগ করা যায়। সেকারণে ইসলামের হুকুমসমূহের যদি বাস্তব পদ্ধতি না থাকে তাহলে সেগুলো হবে কেবলমাত্র পুস্তকনির্ভর আদর্শ, লোকদের চিন্তা ও কল্পনার বিষয়বস্তু যেখানে লোকজন বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনার মাধ্যমে প্রবৃত্তিকে সন্তুষ্ট করবে এবং এটা ফলদায়ক হবে না।  

সেকারণে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা তার শরীয়ার মধ্যে লোকদের সমস্যার সমাধান দিয়েছেন। তিনি মানবজীবনের সাথে সম্পৃক্ত সব ধরনের সমস্যার সমাধানের জন্য ব্যবস্থা প্রদান করেছেন। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা ইসলামী আক্বীদা এবং তা থেকে উদ্ভুত ব্যবস্থার মাধ্যমে মানুষের সব প্রবৃত্তি ও জৈবিক চাহিদা পূরণ করেছেন। সুতরাং ইসলাম স্বচ্ছ ও সুস্পষ্ট। তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) এতেই থেমে থাকেননি, বরং তিনি শরীয় হুকুমগুলোকে বাস্তব ভাবে প্রয়োগ করবার জন্য এবং ইসলামকে অবাস্তব দর্শন বা মামুলী কিছু বিধিনিষেধ হিসেবে মনে না করবার জন্য অন্যান্য নীতিমালা নাজিল করেছেন। সেকারণে রাসূলুল্লাহ (সা) এমন একজন ব্যক্তি ছিলেন না যিনি কেবলমাত্র স্রষ্টার বার্তাবাহক, বরং তিনি একজন শাসক ও আল্লাহর হুকুমসমূহের বাস্তব প্রয়োগকারীও ছিলেন। রাসূলুল্লাহ (সা) কেবলমাত্র এ বিষয়টি পরিষ্কার করেননি যে, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলাকে শুধুমাত্র উপাসনা করতে হবে, বরং তিনি সেটা বাস্তবে প্রয়োগ করে দেখিয়েছেন। তিনি লোকদের আল্লাহর দিকে আহ্বান জানিয়েছেন এবং সাহাবীদের দলটিকে নিয়ে মক্কায় একটি ইসলামী রাষ্ট্র কায়েমের জন্য কাজ করেছেন। অবশেষে তিনি ঈমানের ভিত্তিতে সে রাষ্ট্রটি বাস্তবায়ন করতে সমর্থ হয়েছিলেন—যা ইসলামকে বাস্তবায়ন করেছিল এবং ইসলামি আক্বীদা ও ব্যবস্থার বিরুদ্ধে যারা গিয়েছিল তাদের শাস্তি দিয়েছিল। তিনি (সা) দাওয়াত ও জিহাদের মাধ্যমে ইসলামের প্রসার ঘটিয়েছেন। একারণে আমাদের কাছে ইসলামী রাষ্ট্রের জন্য নিয়মকানুন রয়েছে, কিভাবে তা প্রতিষ্ঠা করতে হবে সে ব্যাপারেও নির্দেশনা রয়েছে, রয়েছে উকুবাত (শাস্তি) এর হুকুম, জিহাদের হুকুম, সৎ কাজের আদেশ প্রদান ও অসৎ কাজের নিষেধ প্রদানের জন্য নিয়মকানুন রয়েছে। এসবই বাস্তব পদ্ধতিগত শরীয়া হুকুম যা শরীয়া দিয়েছে আক্বীদা ও ব্যবস্থাকে রক্ষা করবার জন্য, পরিচালনার জন্য, প্রসারের নিমিত্তে কাজ করবার জন্য এবং এগুলোকে শাশ্বত রূপ দিতে আহ্বান জানাবার জন্য।  

যদি এসব শরীয়া নীতিমালার মাধ্যমে আক্বীদা ও ব্যবস্থা বাস্তবায়ন, সংরক্ষণ ও প্রসারের ব্যবস্থা না থাকত তাহলে ইসলাম হত অবরুদ্ধ এবং এটি আমাদের কাছে পৌছাত না এবং প্রসারও লাভ করত না। এটা খ্রীস্টান ধর্মের মত নিছক নীতিকথা সর্বস্ব হত। যেমন: “তোমরা ব্যভীচার করো না এবং প্রতিবেশীর স্ত্রীর প্রতি লোভ করো না”। ইসলাম তখন অন্যান্য ব্যবহারিক চিন্তা দ্বারা ধ্বংস হয়ে যেত বা সমূলে উৎপাটিত হত এবং এটা দিয়ে এমন কিছু করা যেত না যা এর আওতাধীন নয়। অন্যান্য চমকপ্রদ চিন্তার মত এটাও ইতিহাসের পাতায় পুস্তকের গন্ডীর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকত, যেমনি আছে প্লেটোর “The Republic”।

উদাহরণস্বরূপ, যেহেতু যিনা ইসলামে হারাম, সেহেতু এর সাথে যুক্ত আরেকটি শরীয়া হুকুম এ অবৈধ সম্পর্ককে বাস্তবে প্রতিরোধ  করে, এবং তাহলো যিনাকারীকে শাস্তি প্রদানের হুকুম, আর এটি বাস্তবায়ন করবে ইসলামী রাষ্ট্র। সুতরাং শরীয়া যিনা সম্পর্কে হুকুম প্রদান করেছে, যেমন আল্লাহ বলেন,

‘আর ব্যভিচারের কাছেও যেয়ো না। নিশ্চয় এটা অশ্লীল কাজ এবং মন্দ পথ।’ (সূরা বনী ইসরাইল: ৩২) 

তাছাড়া তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) যিনাকারীর শাস্তি সম্পর্কেও সুস্পষ্ট হুকুম প্রদান করেন যখন তিনি বলেন,

‘ব্যভিচারিণী নারী ও ব্যভিচারী পুরুষ, তাদের প্রত্যেককে একশ করে বেত্রাঘাত কর।’ (সূরা আল নূর: ২)

তাছাড়া শরীয়া এই হুকুম (শাস্তি) বাস্তবায়নের জন্য দায়িত্বশীল কতৃপক্ষও সুনির্দিষ্ট করে দিয়েছে, যেমন রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন,

‘মুসলিমদের উপর হুদুদ বাস্তবায়ন যতটা সম্ভব কম করবার চেষ্টা করো। যদি তুমি তাকে কোনভাবে বাচিয়ে দিতে পার তবে তাই কর। একজন ইমামের পক্ষে শাস্তি প্রদানে ভুল করবার চেয়ে ক্ষমায় ভুল করা অনেক শ্রেয়।’ (তিরমিযী এবং আল হাকীম)

সুতরাং শরীয়া ইমামকে এ দায়িত্ব প্রদান করেছে।

একই কথা সালাতের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। শরীয়া এটা পরিষ্কার করেছে যে, সালাত ফরজ এবং কেউ তা পরিত্যাগ করলে কী শাস্তি হবে। এক্ষেত্রেও এই শাস্তি বাস্তবায়নের জন্য ইসলামী রাষ্ট্রকে দায়িত্ব দিয়েছে। এভাবে ইসলামের যে কোন হুকুমের পাশাপাশি তা বাস্তবায়নের পদ্ধতিও অন্য একটি হুকুমের মাধ্যমে পরিষ্কার করা হয়েছে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে ইমামকেই এ ব্যাপারে কতৃর্ত্ব প্রদান করা হয়েছে।  

পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে আমরা দেখতে পাই, ইসলামের রয়েছে একটি মৌলিক বিশ্বাস—যা হতে অন্যান্য শাখা বিশ্বাস ও চিন্তা সমূহ উৎসারিত হয়। তাছাড়া এমন চিন্তাসমূহ রয়েছে যা ভাল (খায়ের) ও মন্দকে (শর), হাসান (সুন্দর ও প্রশংসনীয়) এবং কুবহ (অসু্ন্দর ও নিন্দনীয়) কে, মারুফ ও মুনকারকে, হালাল (অনুমোদিত) ও হারামকে (নিষিদ্ধ) সুস্পষ্ট করে। এর ইবাদত (উপাসনা), মু’আমালাত (লেনদেন), মাতু’মাত (খাদ্যদ্রব্য), মালবুসাত (পরিচ্ছদ), আখলাক (নৈতিকতা)এর ব্যাপারে শরীয়া নীতিমালা রয়েছে। এগুলো সবই একটি ইসলামি ও মানবিক সমাজে বসবাসের জন্য অপরিহার্য। ইসলাম যে সমাজের দিকে মানুষকে আহ্বান করে তা সম্পর্কে এগুলো স্বচ্ছ ধারণা প্রদান করে। এইসব বিশ্বাস, চিন্তুা ও নিয়মকানুনকে আল ফিকরাহ আল ইসলামিয়া (ইসলামি চিন্তা) বলা হয়।    

শরীয়া নিয়মকানুন যা ইসলামী ফিকরাহকে পূর্ণতা দান করে ও তা প্রতিষ্ঠিত করে, রক্ষা করে ও প্রসার ঘটায় এগুলো হল: শাস্তির বিধান, জিহাদের বিধান, খিলাফতের বিধান, শরীয়ার যে বিধানের কারণে ইসলামি রাষ্ট্র বাস্তবায়িত হয় এবং মারুফ সম্পাদন ও মুনকার নিষিদ্ধ করবার বিধান। এসব সহায়ক শরীয়া বিধিবিধানকে আত তারিকা আল ইসলামিয়া (ইসলামি পদ্ধতি) বলা হয়।  

Leave a Reply