কুরআন ও সুন্নাহ দাওয়াতের ধারণাকে একে অপরকে সত্যের ব্যাপারে সতর্ক করা (তাওয়াসী) সাথে সর্ম্পকযুক্ত করেছে, সুসংবাদ প্রদান করা (তাবসীর), লোকদের সতর্ক করা (নসীহা) এবং তাদের স্মরণ করিয়ে দেয়া, আহলে কিতাবদের সাথে সর্বোত্তম পন্থায় বিতর্ক করা, আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা এবং দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করা। এছাড়াও আরও অনেক উদাহরণ রয়েছে।
তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেন,
‘কসম যুগের, নিশ্চয় মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত; কিন্তূ তারা নয়, যারা বিশ্বাস স্থাপন করে ও সৎকর্ম করে এবং পরস্পর তাকীদ দেয় সত্যের এবং তাকীদ দেয় সবরের।’ (সূরা আল আসর : ১-৩)
তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেন,
‘আমি আপনাকে সমগ্র মানবজাতির জন্যে সুসংবাদাতা ও সতর্ককারী রূপে পাঠিয়েছি; কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তা জানে না।’ (সূরা আস সাবা-২৮)
তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) আরও বলেন,
‘আমি সব পয়গম্বরকেই তাদের স্বজাতির ভাষাভাষী করেই প্রেরণ করেছি, যাতে তাদেরকে পরিষ্কার বোঝাতে পারে।’ (সূরা ইব্রাহিম-৪)
তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) আরও বলেন,
‘এটা (কুরআন) তো কেবল বিশ্বাবাসীদের জন্যে উপদেশ’ (সূরা আত তাকউইর: ২৭)
তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেন,
‘এটা আপনার ও আপনার সম্প্রদায়ের জন্যে উল্লেখিত থাকবে এবং শীঘ্রই আপনারা জিজ্ঞাসিত হবেন।’ (সূরা আয যুখরুফ:৪৪)
তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেন,
‘…………এবং তাদের সাথে বিতর্ক করুন পছন্দনীয় পন্থায়।’ (সুরা আন নাহল:১২৫)
তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেন,
‘আর তাদের সাথে যুদ্ধ করতে থাক যতক্ষণ না ফিতনা শেষ হয়ে যায়; এবং দ্বীন শুধুমাত্র আল্লাহ্ এর জন্য হয়ে যায়।’ (সূরা আল আনফাল-৩৯)
তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেন,
‘তিনি তাঁর রাসূলকে পথ নির্দেশ ও সত্যধর্ম নিয়ে প্রেরণ করেছেন, যাতে একে সব ধর্মের উপর প্রবল করে দেন যদিও মুশরিকরা তা অপছন্দ করে।’ (সুরা আস সফ: ৯)
রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন,
‘অবশ্যই দ্বীন হল নসীহা (উপদেশ)। তাঁকে জিজ্ঞেস করা হল, ‘কার প্রতি ইয়া রাসূলুল্লাহ’। তিনি বললেন, আল্লাহ, তার কিতাব, রাসুলের জন্য, মুসলিমদের নেতা এবং জনসাধারনের প্রতি। (মুত্তাফিকুন আলাইহি)
সুলায়মান বিন বুরাইদাহ তার বাবার বরাত দিয়ে বর্ণণা করেন যে, ‘যখন রাসূলুল্লাহ (সা) কাউকে কোন অভিযান বা সেনাবাহিনীর আমীর হিসেবে নিয়োগ দিতেন তখন তাকে আল্লাহভীতির কথা স্মরণ করিয়ে দিতেন এবং তার সাথের মুসলমানদের প্রতি সদয় হতে উপদেশ দিতেন। তিনি (সা) বলতেন: আল্লাহর জন্য তার নামে জিহাদ কর। আল্লাহর প্রতি অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে জিহাদ কর। যখন তুমি মুশরিকদের সাথে মিলিত হবে তাদের তিন পর্যায়ের কাজের প্রস্তাব দেবে। তারা যদি তিনটির কোন একটিকে গ্রহণ করে তাহলে সেটি মেনে নাও এবং তাদের কোন ক্ষতি করা থেকে বিরত থাক। তাদেরকে ইসলাম গ্রহণের জন্য আমন্ত্রন জানাও; যদি তারা প্রস্তাব গ্রহণ করে তাহলে মেনে নাও এবং তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা থেকে বিরত থাক…..।’ (মুসলিম)
রাসূলুল্লাহ (সা) আরও বলেন,
‘আল্লাহ যাতে তার মুখ উজ্জ্বল করে দেয় -যে আমার কথা শুনে, সেইরূপ স্মরণে রাখে, বুঝে এবং তা পৌঁছে দেয় । সেক্ষেত্রে কেউ ফকীহ না হয়েও ফিকহ (জ্ঞান) বহন করবে। আবার কেউ কেউ এমন কারও কাছে জ্ঞান বা ফিকহ বহন করে নিয়ে যাবে যে তার চেয়েও বড় ফকীহ।’ (তিরমিযী)
এইভাবে সংশ্লিষ্ট সব আয়াত ও হাদীস যুক্ত করে পুরো বিষয়টিকে উপস্থাপন করা হয়েছে -যেগুলোর উপজীব্য বিষয় হল দাওয়াত। প্রত্যেক মুসলিম সাধ্য অনুসারে দাওয়াত বহনের কাজ করতে হবে।
আমরা যদি দাওয়াত সংশ্লিষ্ট অন্য আয়াতসমূহের কথা চিন্তা না করে কেবলমাত্র ’ আমর বিল মা’রূফ এবং নাহি আ’নিল মুনকার ’ এর আয়াতের দিকে তাকাই তাহলে দেখব যে, ইসলামের এ শক্তিশালী ভিত্তির সাথে প্রত্যেকটি মুসলিম বিজড়িত। আমাদের অণুকরণীয় আদর্শ রাসূল (সা) এর সাথে সম্পৃক্ত একটি আয়াতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন,
‘……… তিনি তাদেরকে নির্দেশ দেন সৎকর্মের, বারণ করেন অসৎকর্ম থেকে; তাদের জন্য যাবতীয় পবিত্র বস্তূ হালাল ঘোষনা করেন ও নিষিদ্ধ করেন হারাম বস্তূসমূহ………’ (সূরা আ’রাফ-১৫৭)
এটা নব্যুয়তের সমাপ্তির কথা বলে। রাসূল (সা) এর মাধ্যমে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধের ব্যাপারে নির্দেশ দেন, সব ভাল (তাইয়্যিব) জিনিসের অনুমোদন ও অবৈধ (খাবিছ) জিনিষের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা দেন।
উম্মাহর সাথে সংশ্লিষ্ট আয়াতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন,
‘তোমরাই হলে সর্বোত্তম উম্মত, মানবজাতির কল্যানের জন্যেই তোমাদের উদ্ভব ঘটানো হয়েছে। তোমরা সৎকাজের নির্দেশ দান করবে ও অন্যায় কাজে বাধা দেবে এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে।’ (সূরা আল ইমরান-১১০)
এখানে উম্মাহ বলতে সব মুসলিম, ব্যক্তিগতভাবে, সামষ্টিক বা দলগতভাবে এবং কতৃত্বশীল লোক সবাইকে বুঝানো হয়েছে এবং সবাইকেই ’ আমর বিল মা’রূফ এবং নাহি আ’নিল মুনকার ’ এর ব্যাপারে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
ব্যক্তিপর্যায়ের সাথে সম্পৃক্ত একটি আয়াতে আল্লাহ বলেন,
‘আর ঈমানদার পুরুষ ও ঈমানদার নারী একে অপরের সহায়ক। তারা ভাল কাজের শিক্ষা দেয় এবং মন্দ থেকে বিরত রাখে।’ (সূরা আত তাওবা: ৭১)
ইমাম কুরতুবী বলেন, ‘আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা আমল বিন মারুফ ও নাহিয়ান মুনকার এর মাধ্যমে ঈমানদার ও মুনাফেকের মধ্যে পার্থক্য করে দিয়েছেন। অর্থাৎ ঈমানদারদের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল ’আমর বিল মা’রূফ এবং নাহি আ’নিল মুনকার ’ এবং এর প্রধান দিক হল ইসলামের দাওয়াত।’ (তাফসীর আল কুরতুবী ৪/১৪৭)
দলগত দাওয়াতের কাজের আয়াতসমূহে দলের কাজ সুস্পষ্ট করা হয়, যেমন:
‘আর তোমাদের মধ্যে এমন একটা দল থাকা উচিত যারা আহবান জানাবে সৎকর্মের প্রতি, নির্দেশ দেবে ভাল কাজের এবং বারণ করবে অন্যায় কাজ থেকে, আর তারাই হলো সফলকাম।’ (সূরা আল ইমরান:১০৪)
কর্তৃত্বশীল লোকদের সর্ম্পকে পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন,
‘তারা এমন লোক যাদেরকে আমি পৃথিবীতে কতৃত দান করলে তারা নামায কায়েম করবে, যাকাত দেবে এবং সৎকাজে আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করবে। প্রত্যেক কর্মের পরিণাম আল্লাহ্ এর এখতিয়ারভূক্ত।’ (সূরা আল হাজ্জ: ৪১)
কুরআন স্পষ্টভাবে বলেছে দাওয়াত ইসলামের প্রতি:
‘আর তোমাদের মধ্যে এমন একটা দল থাকা উচিত যারা আহবান জানাবে সৎকর্মের (ইসলামের) প্রতি…..’ (সূরা আল ইমরান:১০৪)
‘যে ব্যক্তি ইসলামের দিকে আহূত হয়েও আল্লাহ্ স¤পর্কে মিথ্যা বলে; তার চাইতে অধিক যালেম আর কে?’
(সূরা আস সফ: ৭)
‘আপনি তো তাদেরকে সোজা পথে দাওয়াত দিচেছন’ (সূরা মু’মিনুন: ৭৩
কুরআন স্পষ্টভাবে বলেছে এটি আল্লাহর প্রতি দাওয়াত
‘যে আল্লাহর দিকে দাওয়াত দেয়,……..তার কথা অপেক্ষা উত্তম কথা আর কার?’ (সূরা হা-মীম সিজদাহ: ৩৩)
‘বলে দিন: এই আমার পথ। আমি আল্লাহর দিকে বুঝে সুঝে দাওয়াত দেই- আমি এবং আমার অনুসারীরা।’
(সূরা ইউসুফ: ১০৮)
কুরআন স্পষ্টভাবে বলেছে এটি আল্লাহর নাযিলকৃত শাসনব্যবস্থার প্রতি দাওয়াত
‘তাদের মধ্যে শাসন করার জন্য যখন তাদেরকে আল্লাহ্ ও রাসূলের দিকে আহবান করা হয় তখন তাদের একদল মুখ ফিরিয়ে নেয়।’ (সূরা আন নূর: ২৪)
‘মুমিনদের বক্তব্য কেবল এ কথাই যখন তাদের মধ্যে শাসন করার জন্যে আল্লাহ্ ও তাঁর রসূলের দিকে তাদেরকে আহবান করা হয়, তখন তারা বলে: আমরা শুনলাম ও আদেশ মান্য করলাম।’ (সূরা আন নূর: ৫১)
‘…. আল্লাহর কিতাবের প্রতি তাদের আহবান করা হয়েছিল যাতে তাদের মধ্যে মীমাংসা করা যায়। অত:পর তাদের মধ্যে একদল তা অমান্য করে মুখ ফিরিয়ে নেয়।’ (সূরা আল ইমরান: ২৩)
’ আমর বিল মা’রূফ এবং নাহি আ’নিল মুনকার ’ হল ফরযে কিফায়া। কারও কারও জন্য এটি বাধ্যতামূলক। যারা এ দায়িত্ব পালন করবে তাদের জন্য রয়েছে পুরষ্কার এবং যারা তা পালন করবে না তারা ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হবার আগ পর্যন্ত এর দায়ভার বহন করবে। কেননা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা দাওয়াত বহন করাকে মুক্তির পথ হিসেবে বাধ্যতামূলক করেছেন এবং দাওয়াত ত্যাগ করার ফলাফল যন্ত্রনাদায়ক শাস্তি। তিনি সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন,
‘অত:পর যখন তারা সেসব বিষয় ভুলে গেল, যা তাদেরকে বুঝানো হয়েছিল, তখন আমি সেসব লোককে মুক্তি দান করলাম যারা মন্দ কাজ থেকে বারণ করত। আর পাকড়াও করলাম, গোনাহগারদেরকে নিকৃষ্ট আযাবের মাধ্যমে তাদের না-ফরমানীর দরুন।’ (সূরা আ’রাফ: ১৬৫)
ঈমান যেমনিভাবে মা’রুফ এর মুখ্য বিষয় ও ভিত্তি, তেমনিভাবে কুফর হল সবচেয়ে বড় মুনকার ও সব মুনকারের ভিত্তি। আনুগত্যের সব কাজ হল এ মুখ্য মা’রুফ থেকে উদ্ভুত মা’রুফাত। আর অবাধ্যতা হল মুখ্য মুনকার থেকে উদ্ভুত মুনকারাত। আল্লাহর আইন দ্বারা শাসন করা হল আনুগত্যের সবচেয়ে বড় স্বাক্ষর-যার মাধ্যমে ঈমান ও আনুগত্যের বিভিন্ন কাজ প্রকাশিত হয় এবং যার মাধ্যমে দাওয়াত বহন করা হয় ও ইসলামের প্রসার ঘটে। অন্যদিকে আল্লাহর আইন ছাড়া অন্য কিছু দিয়ে শাসন করা অবাধ্যতার চূড়ান্ত পর্যায়-যাতে মানুষের খেয়ালখুশী, প্রবৃত্তি ও পথভ্রষ্টতা প্রতিফলিত হয়।
এই ফরযিয়াত বাস্তবায়নের জন্য একত্র হওয়া ফরয। দ্বীন সর্ম্পকে প্রত্যেক সচেতন মুসলমানের জানা উচিত, সে যখন কোন আয়াত বা হাদীস পাঠ করে-তা শুধু নিজের জন্য নয় বরং সব মুসলিমের জন্য । এমনকি রাসূলের প্রতি জারিকৃত যে কোন নির্দেশও পুরো উম্মাহ’র জন্য প্রযোজ্য হবে যদি তাকে সুনির্দিষ্ট করা হয়েছে এমন প্রমাণ না থাকে। যখন আল্লাহ তাকে (সা) ঈমান, ইবাদত এবং নাযিলকৃত আয়াতসমূহ দিয়ে শাসনের ব্যাপারে কোন নির্দেশ দেন তখন এগুলো সকলের জন্যও প্রযোজ্য।