বেশ কিছুদিন যাবৎ ঢাকা চট্টগ্রাম সহ সারাদেশের প্রধান প্রধান জনবহুল সড়কগুলোর রাস্তার পাশে বিলবোর্ডগুলোতে একটি বিজ্ঞাপন প্রায়ই দেখা যাচ্ছে। আর সেই বিজ্ঞাপনটি হল- “এক অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ”। যা কিনা বাংলাদেশের ইতিহাসে পুর্বে আর কখনোই দেখা যায়নি এবং মিডিয়ায় বিভিন্ন নেতা কর্মীদের বক্তব্যে প্রায়ই শোনা যাচ্ছে যে-“উন্নয়নের জোয়ারে ভাসছে বাংলাদেশ”। সত্যি কথা বলতে গেলে বর্তমান সরকার “উন্নয়নের জোয়ার” নামক শব্দটি ব্যপকভাবেই জনগণের কাছে পৌছাতে পেরেছেন। সরকার মুলত জনগণকে যা বোঝাতে চাচ্ছেন তা হল- “চারিদিকে শুধু উন্নয়ন আর উন্নয়ন হচ্ছে যা কিনা শুধু বর্তমান সরকারের জন্যই সম্ভব হয়েছে এবং যদি বর্তমান সরকার ক্ষমতায় না থাকতো, তাহলে এতো দ্রুত গতিতে বাংলাদেশ উন্নতি লাভ করতে পারতোনা। তাই বাংলাদেশের এই অপ্রতিরোধ্য উন্নয়ন যা কিনা আগে কখনো হয়নি, তার ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখতে হলে জনগণকে অবশ্যই বর্তমান সরকারকে ক্ষমতায় রাখা উচিৎ।”
আসুন দেখা যাক, উন্নয়নের জোয়ার বলতে সরকার কী বোঝাতে চেয়েছে?-
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় পূর্ববর্তী সরকার ও বর্তমান সরকারের উন্নয়ের মুল মাপকাঠি হল বৈষয়িক উৎপাদন-প্রবৃদ্ধি, এর একটি উদাহরণ হতে পারে রাস্তাঘাট, ব্রিজ ও ফ্লাইওভার নির্মান। তাই যে সরকার এগুলো যত বেশি নির্মান করেছেন, সে তত বেশি উন্নতি করেছেন বলে মনে করা হয়। যদিও এই ব্যবস্থায় আইনশৃঙ্খলার অবনতি, দুর্নীতি (উদাহরণসরূপ, speed money) ও ভোট জালিয়াতি উন্নয়নের অন্তরায় নয়। তাই পুর্ববর্তী সরকারদের সাথে বর্তমান সরকারের উন্নয়নের পার্থক্য করলে একটা দিকে সরকার এগিয়ে, আর তা হল ফ্লাইওভার নির্মাণ। বর্তমানে ঢাকা ও চট্টগ্রামের প্রধান প্রধান ব্যস্ত সড়কগুলোতে ব্যপকভাবে ফ্লাইওভার নির্মান কাজ শুরু হয়েছে। ফ্লাইওভার নির্মানের কাজ চলার কারনে ব্যাপকভাবে যানযট সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে রাস্তার জ্যামে আটকানো জনগন জ্যাম বাধার কারণ খুজতে গিয়ে দেখেন যে ফ্লাইওভার নির্মানকাজ চলছে, অর্থাৎ সরকার উন্নয়ন করছে। এভাবে ঢাকা ও চট্টগ্রামের ব্যাস্ত সড়কগুলোতে প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ মানুষ দেখছে যে সরকার উন্নয়ন করছে।
কিছুদিন আগের খবরের কাগজগুলোর দিকে ফিরে তাকালে আমরা দেখতে পাব যে ১ ঘন্টার বৃষ্টিতে ঢাকা ও চট্টগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলো তলিয়ে গিয়েছিল, যেটাকে ছোটখাট জোয়ার বলা যেতে পারে। শিশু রাজন হত্যার মত নৃশংস ও জঘন্য হত্যাকাণ্ড, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী RAB কর্তৃক নারায়নগঞ্জে ৭ খুন, সংসদ সদস্যের ছেলের গুলিতে রিক্সাচালক নিহত হওয়া, শিক্ষাব্যবস্থায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের ধারা অব্যাহত থাকা ও মেডিকেল ভর্তিচ্ছু ছাত্রছাত্রীদেরকে পুলিশ বাহিনী দ্বারা আহত করিয়ে মেডিকেলে ভর্তি করানো, সরকার দলীয় সংসদ সদস্যের মুখে নবী-রাসূলের অবমাননা (যা জনগণ আগে কখনো দেখেনি), বিশ্বে তেলের দাম নিন্মমুখী হওয়ার পরও বাংলাদেশে উর্ধমুখী থাকা, উত্তরোত্তর প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের বেতন বৃদ্ধি করা ও পাশাপাশি দ্রব্যমুল্যের দাম বৃদ্ধি পাওয়া, মায়ের গর্ভাবস্থায় থাকা অবস্থায় শিশু গুলিবিদ্ধ হওয়া ইত্যাদি ঘটনাগুলো ঘটেছে।
এটা মোটামুটি সকলেই অবগত যে, বাংলাদেশের প্রচলিত শাসন ব্যবস্থায় সকল সরকারই তাদের ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে। তাই বর্তমান সরকারও এর ব্যতিক্রম নয় এবং সেটারই ধারাবাহিকতার প্রতিচ্ছবি ছিল বর্তমান সরকারের ক্ষমতায় আসার সেই তথাকথিত নির্বাচন। সে গণতান্ত্রিক ভোগবাদী সমাজ ব্যবস্থার ফলে সৃষ্ট ভোগবাদী প্রবণতারই বহিঃপ্রকাশ করছে। সরকার ভাল করেই জানে যে, তার জনসম্মতি এখন প্রায় শুন্যের কোটায়। ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য যে কোন ধরণের গণবিপ্লবকে দমিয়ে রাখা হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ বিষয়। তাই জনমনের ক্ষোভ ও আসন্ন যে কোন আন্দোলনের সম্ভাবনাকে দমিয়ে রাখার জন্য সরকার ব্যপকভাবে তার মেকি উন্নয়নের প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। মোট কথা, সরকার তার কু-কর্মকে ঢাকার জন্য মেকি উন্নয়ের ছাতা মেলে ধরেছে। তাই সরকারের উন্নয়নের জোয়ারের অন্তরালে মুলত রয়েছে ক্ষমতা ধরে রাখার প্রয়াস।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা হচ্ছে এমন একটি ব্যবস্থা যেখানে ক্ষমতায় থাকা শাসকবর্গ নিজের প্রয়োজনমত আইন তৈরি করতে পারে ও প্রশাসনকে নিজের প্রয়োজনে ব্যবহার করতে পারে। তাই ক্ষমতার পালাবদলে প্রতিটি সরকারই তাদের বিরোধী দলকে দমন করতে বিচার ব্যবস্থায় দলীয়করন, আইন সংযোজন ও পরিবর্তন করে থাকে। এখানে আল্লাহ এবং জনগণ কারো কাছেই শাসকের কোন জবাবদিহীতার ভয় থাকেনা। কাগজে-কলমে জনগণের কাছে যে জবাবদিহিতার কথা বলা হয় এ ব্যবস্থায়, ধর্মরিপেক্ষ তাকওয়াহীন পরিবেশের কারণে তা কাগজে-কলমেই রয়ে যায়, বাস্তবতায় প্রবেশ করে না। ফলে এই ব্যবস্থা তার প্রতিটি শাসককেই ক্ষমতালোভী ও স্বেচ্ছাচারী করে তুলে।
তাই, মানবজাতির জন্য গণতন্ত্র নামক এমন জবাবদিহীতাবিহীন স্বেচ্ছাচারী শাসন ব্যবস্থা কখনোই কাম্য নয়। খিলাফতই হচ্ছে একমাত্র ব্যবস্থা যেখানে শাসক আল্লাহ ও জনগণ উভয়ের কাছেই জবাবদিহীতার ভয়ে ভীত থাকে। খিলাফত ব্যবস্থায় সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক আল্লাহ এবং আইন আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) কর্তৃক নির্দিষ্ট হওয়ায় শাসকের সেচ্ছাচারী ও ক্ষমতালোভী হওয়ার কোন সুযোগ নেই। খিলাফতের সোনালী ইতিহাসও আমাদেরকে তাই বলে। খলীফা হযরত ওমর (রা) তার স্বীয় পুত্রকে মদ্যপানের অভিযোগে শাস্তি দিয়েছিলেন এবং তিনি (রা) এমন আল্লাহভীরু আর দায়িত্বশীল ছিলেন যে, তিনি বলতেন,
“ফুরাত নদীর তীরে (মদীনা থেকে ইরাকের এই নদীর দূরত্ব অনেক) একটি খচ্চরও যদি পা পিছলে পরে (মরে যায়), তবে আমার আশংকা কিয়ামতের দিন আল্লাহ্ তা’আলা আমাকে জিজ্ঞেস করবেন”
সুলতান সালাউদ্দিন আইয়্যুবির মৃত্যুকালে তার কাছে সম্পদ বলতে ছিল শুধু ১ দিরহাম হতে কিছুটা বেশি। খিলাফত ব্যবস্থায় আল্লাহর হুকুম বস্তবায়ন ও তার সন্তুষ্টি অর্জনই মুখ্য উদ্দেশ্য হওয়ায় শাসকদের না থাকে সম্পদ আহরণের লোভ এবং না থাকে ক্ষমতা ধরে রাখার চেষ্টা। তাছাড়া খিলাফতই হচ্ছে মহান আল্লাহ কর্তৃক একমাত্র মনোনীত শাসন ব্যবস্থা।
রাসূল (সা) বলেন:- “বনী ইসরাইলকে শাসন করতেন নবীগণ। যখন এক নবী মৃত্যুবরণ করতেন তখন তাঁর স্থলে অন্য নবী আসতেন, কিন্তু আমার পর আর কোনও নবী নেই। শীঘ্রই অনেক সংখ্যক খলীফা আসবেন“। তাঁরা (রা) জিজ্ঞেস করলেন তখন আপনি আমাদের কী করতে আদেশ করেন? তিনি (সা) বললেন, “তোমরা একজনের পর একজনের বাই’য়াত পূর্ণ করবে, তাদের হক আদায় করবে। অবশ্যই আল্লাহ্ (সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালা) তাদেরকে তাদের উপর অর্পিত দায়িত্বের ব্যাপারে জবাবদিহি করবেন“।’
এই মহাবিশ্বের সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) (যার জ্ঞানের পরিধি অসীম) নিজেই যেখানে খিলাফত ব্যবস্থাকে মানবজাতির জন্য মনোনীত করেছেন সেখানে অন্য কোন ব্যবস্থার অধীনস্থ থাকা কোন মানুষের জন্যই কাম্য নয়। তাই মানব জাতির কল্যাণ ও আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষে প্রতিটি মানুষকেই প্রচলিত সকল ব্যবস্থাকে পরিত্যাগ করে খিলাফত ব্যবস্থাকে মনেপ্রাণে ধারণ করা ও তা প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করা উচিৎ।
কুদরত উল্লাহ