ধনতান্ত্রিক অর্থনীতির আরকটি প্রবঞ্চনাপূর্ণ উপাখ্যান হচ্ছে ভারচ্যুয়াল অর্থনীতি। সম্পদ ও আয়ের সুষম বণ্টনের যে হটকারি প্রস্তাবনা ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থা উপস্থাপন করে, ভারচ্যুয়াল অর্থনীতির পক্ষেও তারা সেই প্রস্তাবনাকেই বর্ধিত করে। তারা মনে করে ব্যবসায়ে লগ্নিকৃত পুঁজিকে (ইকুইটি এবং ঋণ) যদি লেনদেনের জন্য উন্মুক্ত করা হয় তবে উদ্বৃত্ত পুঁজি যথাযথ খাতে প্রবাহিত হবে এবং জাতীয় আয়ের ন্যায্য বণ্টন নিশিচত হবে। দ্বিতীয় আরেকটি ধারনা হচ্ছে বাজারের সব ধরনের গতিপ্রকৃতি অনুমান-পটুতার ভিত্তিতে লাভ অর্জন করার অধিকার সবার আছে। সুতরাং পুঁজি লেনদেনের তারল্য এবং নানা বিশিষ্টের আর্থিকপত্র (Financial Instrument) সৃষ্টির মাধ্যমে বিনিয়োগকারীর যেকোনো অনুমানকে বাস্তবে রূপ দেবার বন্দোবস্ত থাকতে হবে যা বাজারকে পরিণত এবং পূর্ণবিকশিত (Market Completeness) করবে। অধিকন্তু, বিনিয়োগকারীগন তাদের ঝুঁকি গ্রহণের রুচি (Risk Appetite) অনুপাতে বিনিয়োগ ঝুড়ি (Investment Portfolio) কে সাজাতে পারবে এবং যেকোনো সময় তাতে পরিবর্তন ও সামঞ্জস্য বিধান করতে পারবে।
উপরের চিন্তা থেকে ব্যবসা থেকে পুঁজির চুক্তিকে পৃথক করে তা বাজারজাত করা হয়। পুঁজির ধরন অনুসারে চুক্তিগুলোকে নানা নামে অভিহিত করা হয়। যেমন চুক্তির প্রকৃতি মালিকানা (ইকুইটি) হলে তাকে বলা হয় শেয়ার এবং চুক্তির প্রকৃতি ঋণ হলে তাকে বলা হয় বন্ড, ডিবেঞ্চার ইত্যাদি। যদি চুক্তির প্রকৃতি মালিকানা ও ঋণের বৈশিষ্ট্য মিশ্রিত হয় এবং মালিকানার বৈশিষ্ট্য অধিক প্রকাশ্য হয় তবে তাকে বলা হয় প্রতি-ইকুইটি (Quasi Equity), যেমন প্রেফারড শেয়ার। অপরপক্ষে ঋণের বৈশিষ্ট্য যদি অধিক প্রকাশ্য হয় তবে তাকে বলা হয় প্রতি-ঋণ (Quasi Debt), যেমন কনভার্টিবল বন্ড, পার্টিসিপেটরি বন্ড ইত্যাদি।
চুক্তিকে বাজারজাতযোগ্য করার জন্য চুক্তির প্রকৃতিতে কিছু মৌলিক পরিবর্তন আনা হয়। যেমন, কোম্পানির দায়কে সীমিত করা যাতে চুক্তিকারী ব্যক্তির (আরও সঠিকভাবে চুক্তি ক্রয়কারীর) দায় চুক্তি-মুল্যের অতিরিক্ত না হয়। দায় সীমিত থাকার কারণে চুক্তি ক্রয়কারিকে সেই কোম্পানির দায়ের ভার নিতে হয়না। যেকারনে চুক্তির বাজার তারল্য বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। দ্বিতীয়ত কোম্পানিকে একটি স্বতন্ত্র কৃত্রিম ব্যক্তিসত্ত্বা হিসেবে আইনগত ভিত্তি দেয়া হয়। যেকারনে পুঁজি সরবরাহের চুক্তিগুলো হয় নৈর্ব্যক্তিক। অর্থাৎ চুক্তি হয় নৈর্ব্যক্তিক কোম্পানির সংগে পুঁজির, পুঁজি বিনিয়োগকারীর সংগে নয়। সুতরাং চুক্তি হস্তান্তরের ক্ষেত্রে চুক্তির ক্রেতা এবং বিক্রেতার পরিচিতি বা সংযোগের কোন প্রয়োজন পরে না। যেকারনে চুক্তিটি চুক্তির স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য হারিয়ে একটি সাধারণ ভোগ্যপণ্যে রূপান্তরিত হয়। চুক্তির এই নৈর্ব্যক্তিকরণ চুক্তিপণ্যের বাজার তারল্য বহুগুণ বৃদ্ধি করে। ইন্টারনেটের ব্যবহার ব্যপক বিস্তৃতি লাভ করায় এই চুক্তিপন্যের লেনদেন তারল্য আরেক দফা বৃদ্ধি করেছে।
পরবর্তী পর্যায়ে মূল চুক্তিকে অন্তরালে রেখে চুক্তিটি ক্রয় বা বিক্রয়ের ‘প্রতিশ্রুতি’ কেনাবেচা করার বাজার সুবিধা সৃষ্টি করা হয়। অর্থাৎ এই পর্যায়ে এসে চুক্তির ‘প্রতিশ্রুতি’কে চুক্তি থেকে বিচ্ছিন্ন করে পণ্যের চরিত্র দেয়া হয় এবং তা বাজারজাত করার মাধ্যমে তারল্য বৃদ্ধি করা হয়। আরও খানিকটা অগ্রসর হয়ে প্রতিশ্রুতি ক্রয়-বিক্রয়ের ‘প্রতিশ্রুতি’কেও বাজারজাত করা হয়। এই আর্থিকপত্রগুলো মূলত বাজারের ভবিষ্যৎ গতিপ্রকৃতির উপর একধরনের বাজি (Bet)। এই প্রতিশ্রুতি বাজারের প্রধান কয়েকটি আর্থিকপত্র হচ্ছে অপশন, ফিউচার, সোয়াপ ইত্যাদি। সামগ্রিকভাবে এই পত্রগুলোর বাজারকে বলা হয় Derivatives Market. ডেরিভেটিভস মার্কেটের আর্থিকপত্রগুলো ক্রয় করতে যেহেতু পূর্ণ মূল্য পরিশোধ করতে হয়না তাই বাজার তারল্য বিপুল পরিমাণে বৃদ্ধি পায়।
ব্যবসা থেকে পুঁজিকে বিচ্ছিন্ন করার মাধ্যমে সৃষ্ট এই মেকি অর্থনীতিই হচ্ছে ভারচ্যুয়াল অর্থনীতি। ভারচ্যুয়াল অর্থনীতির প্রক্রিয়াটি আরও জটিল আকার ধারন করে যখন এই আর্থিকপত্র ঋণ নিয়ে ক্রয় করা হয় অথবা ধার করে বিক্রি করা হয়।
চুক্তিপত্রের (শেয়ার, বন্ড ইত্যাদি) মূল্য নির্ধারণে কোম্পানির ভবিষ্যৎ সম্ভাব্য আয়কে বিবেচনায় নেয়া হয়। সম্ভাব্য আয় অবশ্যই অনিশ্চিত। স্বাভাবিকভাবেই চুক্তিগুলোর মূল্য বিনিয়োগকারীদের উপলব্ধি এবং অনুমানের উপর নির্ভরশীল। অর্থাৎ মূল্য এবং উপযোগিতা Speculative. সুনির্দিষ্ট কোন মূল্য না থাকার কারণে চুক্তিপত্রের চাহিদা ও যোগান বিনিয়োগকারীদের ধারনার উপর নির্ধারণ হয়। সুতরাং মূল্য নির্ধারণে বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ-আচরণ (Investment Behavior) একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এই বিনিয়োগ আচরণের উপস্থিতির কারণে আর্থিকপত্রের মূল্য কোম্পানির ভবিষ্যৎ আয়ের চেয়েও বাজারের গতিধারার (Market Trend) উপর অধিক নির্ভর করে। অর্থাৎ বিনিয়োগকারীর লোভ, গুজব, অযৌক্তিক প্রত্যাশা চুক্তিপত্রের মূল্য নির্ধারণে অধিক ভূমিকা রাখে। ডেরিভেটিভস মার্কেটের আর্থিকপত্রগুলোর মূল্য নির্ভর করে চুক্তিপত্রের অনুমিত মুল্যের গতিধারার অনুমানের উপর!
উপরের এই সবকিছুর যোগফল হিসেবে সৃষ্টি হয় একটি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, অসার, স্ফীত, এবং বিকারগ্রস্থ অর্থনীতি যেখানে পৃথিবীর প্রকৃত উৎপাদনের কয়েকগুণ লেনদেন হয়! শতশত বিনিয়োগকারী এবং মার্কেট অপারেটর যৌক্তিক চেতনা হারিয়ে মোহাবিষ্টের মত এই অযৌক্তিক কর্মকাণ্ডে ব্যাপৃত হয়। চুক্তিকে বাজারজাত করার কারণে সেখানে সবারই অংশগ্রহন করা সুগম হয়। যে ব্যক্তি কোনদিন টেক্সটাইল ব্যবসা করার কথা চিন্তাও করেনা সেও স্কোয়ার টেক্সটাইলের একটি শেয়ার কিনে। কারণ শেয়ার কেনা আর প্রকৃত ব্যবসায়ী বিবেচনায় পুঁজি লগ্নি করা এক বিষয় নয়। সুতরাং ভারচ্যুয়াল অর্থনীতি যথাযথ খাতে পুঁজি প্রবাহ ঘটায় এই দাবীটি অশুদ্ধ।
যোগের দ্বিতীয় ফল হচ্ছে পুঁজিবাজারে একটি সার্বক্ষণিক উত্থান-পতন বা অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি। এই উত্থান-পতনের প্রক্রিয়ায় দরিদ্র ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীগনকে প্রায়ই তাদের সর্বস্ব হারাতে দেখা যায়। বাজারের চরিত্র সম্বন্ধে অজ্ঞ সাধারণ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদেরকে প্রলুব্ধ করে এখানে টেনে আনা হয়। তারা সরল বিশ্বাসে মৌমাছির মত ভারচ্যুয়াল মধুর পেয়ালায় আছড়ে পড়ে। পুঁজির বিনিয়োগ এবং উত্তোলনের মাধ্যমে বৃহৎ বিনিয়োগকারীগন বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। পুঁজির ক্ষমতাবলে বাজার থেকে তারা তাদের লাভ তুলে নিতে সক্ষম হয়। অপরপক্ষে ক্ষুদ্র পুঁজিগুলো খড়কুটোর মত বৃহৎ পুঁজির স্রোতে হারিয়ে যায়। এভাবেই দরিদ্ররা লুণ্ঠিত হয় এবং সম্পদ বৃহৎ পুঁজিপতিদের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়। একারনেই আমরা প্রায়শই সাধারণ বিনিয়োগকারীদের নিঃস্ব হতে দেখলেও বৃহৎ বিদেশী বা প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের খুব কমই নিঃস্ব হতে দেখি। শেয়ার কেনা প্রকৃত ব্যবসায়ে পুঁজি লগ্নির অনুরূপ না হওয়ায় জাতীয় আয়ের যে বণ্টনের কথা বলা হয় তা ভ্রান্ত। পুঁজিবাজারের এই উত্থান-পতন পণ্যবাজারকেও দারুনভাবে প্রভাবিত করে। দেখা যায় পুঁজিবাজার যখন চাঙ্গা থাকে তখন ভোক্তারা তাদের বর্তমান ভোগ হ্রাস করে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করে যা পণ্যবাজারের প্রান্তিক ব্যবসায়ীদেরকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। আবার পুঁজিবাজারের পতন দ্রুত ঘটার কারণে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা দ্রুত পুঁজি হারায়, ফলে পণ্যবাজারে আরেক দফা মন্দা সৃষ্টি করে। সুতরাং পুঁজিবাজার অর্থনীতিকে প্রাণবন্ত করে এ দাবীটি বাস্তবতা বিবর্জিত।
যোগের তৃতীয় ফল হচ্ছে প্রকৃত বিনিয়োগ হ্রাস। পুঁজিবাজার কিছু বৃহৎ কর্পোরেটকে পুঁজি সংগ্রহে সাহায্য করলেও তা রাষ্ট্রের সার্বিক বিনিয়োগকে বৃদ্ধি করেনা। অর্থাৎ শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করার সুযোগ সৃষ্টি এবং সরকারীভাবে এখানে বিনিয়োগে উদ্বুদ্ধ করার কারণে জনসাধারণ তাদের উদ্বৃত্ত পুঁজি প্রকৃত ব্যবসায়ে বিনিয়োগ না করে পুঁজিবাজারে প্রবাহিত করে, যা শুধুমাত্র গুটিকয়েক পুঁজিপতিকে তাদের মূলধন বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। কিন্তু এই প্রক্রিয়ায় ব্যপক ব্যক্তি উদ্যোগ এবং নতুন ব্যবসা সৃষ্টির তাড়না হ্রাস পায়। সুতরাং অর্থনৈতিক সম্পদ তার পূর্ণমাত্রায় ব্যবহৃত হতে পারেনা।
উপরের আলোচনা থেকে এটা বলা যায় যে ভারচ্যুয়াল অর্থনীতি আমাদের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন নয় বরং মুষ্টিমেয় ধনীর হাতে সম্পদকে কেন্দ্রীভূত করার একটি হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে। প্রকারন্তরে এই প্রক্রিয়া একটি শক্তিশালী, স্বনির্ভর ও কাম্য অর্থব্যবস্থা সৃষ্টির একটি বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। সর্বোপরি এটি একটি বাস্তবতা বিবর্জিত প্রহসনমূলক অনুশীলন যা মানুষের কোন মৌলিক অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান দেয়না।
ইসলাম এই অন্যায্য ভারচ্যুয়াল অর্থনীতির অবসান ঘটিয়ে একটি শক্তিশালী ও কল্যাণকর অর্থনীতি গড়ে তুলবে যাতে তার অভ্যন্তরীণ সম্পদের সুস্ঠ ও সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত হয়। জনসাধারণ প্রকৃত ব্যবসায়ে সম্পৃক্ত হবার কারণে সার্বিক অর্থনীতিতে ভারসাম্যপূর্ণ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে। ভারচ্যুয়াল অর্থনীতি সৃষ্টির উৎস সমূহ বিলুপ্তির মাধ্যমে ইসলাম এই কাজগুলো সম্পাদন করবে। অর্থাৎ ইসলাম সীমিত দায় কোম্পানি নিষিদ্ধ করে অসীম দায়ের অংশীদারি কারবারকে অনুমোদন দিবে। ব্যবসাকে নৈর্ব্যক্তিক সত্ত্বা হিসেবে কোন আইনি ভিত্তি দিবেনা, ফলে অংশীদারি কারবারের পুঁজিকে ব্যবসা থেকে পৃথক করা যাবেনা।
ইসলাম বর্তমান ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার নিষ্পেষণ থেকে মানবতাকে অচিরেই মুক্ত করবে ইনশা’আল্লাহ।
মাহমুদ সাদিক