আরব বসন্ত – স্বপ্ন থেকে অরাজকতা

এখন থেকে দীর্ঘ চার বছর পূর্বে তিউনিশিয়ার এক বাজারে মুহাম্মদ বুয়াজিজী’র আত্মাহুতির মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যের মোবারক, গাদ্দাফী, বেন আলী, বাশার আল আসাদ ও আব্দুল্লাহ সালেহদের মতো ফেরাউন সমতূল্য যে সমস্ত অত্যাচারী আর জালিম শাসকদের বিরুদ্ধে স্বত:স্ফূর্ত আন্দোলন শুরু হয়েছিল, আরব বসন্ত খ্যাত যে আন্দোলনের মাধ্যমে আরবের নির্যাতিত জনগণ পরিবর্তনের আশার আলো দেখেছিল, আজ সে আন্দোলন সিরিয়া, মিশর, ইয়েমেন, তিউনিসিয়া কিংবা লিবিয়াতে সীমাহীন অরাজকতা, গৃহযুদ্ধ আর বিশৃঙ্খলায় পর্যবসিত হয়েছে; আর সেইসাথে, প্রতিটি দেশেই আন্দোলন পূর্ববর্তী শাসনব্যবস্থা দাপটের সাথে টিকে আছে। যে আন্দোলনের খাতিরে মানুষ জালিম শাসকের রক্তচক্ষু, ঘাতকের বুলেট কিংবা সামরিক হস্তক্ষেপ এ সবকিছুকে উপেক্ষা করে রাস্তায় নেমেছিল এবং সত্যিকার পরিবর্তনের আশায় দ্বিধাহীন চিত্তে তাদের জীবন উৎসর্গ করেছিল, সে আন্দোলন আজ নৈরাশ্যের ঘন আঁধারে ডুবে যাবার উপক্রম হয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষক আদনান খান এ করুন পরিণতির মূলকারণ হিসাবে চারটি বিষয়কে চিহ্নিত করেছেন:

প্রথমত: যে সব দেশে বিপ্লবী সরকারগুলো সফলতার সাথে যুগ যুগ ধরে ক্ষমতার মসনদ আঁকড়ে থাকা স্বৈরশাসকদের সফল ভাবে ক্ষমতা থেকে ছুঁড়ে ফেলেছে, ক্ষমতার মসনদ অধিষ্ঠিত হবার পর তারা নিজেরাও তাদের পূর্ববর্তীদের মতোই নিজেদের অযোগ্য আর প্রাগমেটিক প্রমাণ করেছে। তিউনিশিয়া ও মিশর এ দুটো দেশেই এন-নাহদা ও মুসলিম ব্রাদারহুড তাদের দেশের জনগণকে ইসলামী শাসনের স্বপ্ন দেখিয়েছে আর ইসলামকে বিক্রি করেই তারা নির্বাচনে জয় লাভ করেছে; কিন্তু ক্ষমতার যাবার সাথে সাথে তারা পশ্চিমাদের রাজীখুশী করতে সকলক্ষেত্রে একই সাথে পরিপূর্ণ ভাবে ইসলামকে বাস্তবায়ন না করে, পর্যায়ক্রমে (গ্রাজুয়ালিজম) ইসলাম বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করেছে। দু:খজনক হলেও সত্য যে, এ দলগুলো নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়ী হবার পরেও এবং সংসদীয় ও প্রেসিডেন্সিয়াল ইলেকশনে জনগণের সর্বাত্মক সমর্থন লাভ করার পরেও সত্যিকার ভাবে ইসলাম বাস্তবায়ন করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। বস্তুত: জনগণের সাথে তারা তাদের কৃত অঙ্গীকার পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। এখানে মনে রাখতে হবে যে, যে নির্বাচনে তারা জয় লাভ করেছে সে নির্বাচন পূর্ব থেকেই ক্রটিপূর্ণ। কারণ, এ নির্বাচন গণতান্ত্রিক বা সংসদীয় পন্থায় নির্বাচন, যেখানে মুসলিম উম্মাহ’র দূর্ভোগের প্রধানতম কারণ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সকল উপাদান ও কাঠামো বিদ্যমান আছে। বস্তুত: এদেশগুলোর মুসলিম জনগোষ্ঠী শাসনব্যবস্থা পরিবর্তন না করে, বেন আলী বা মোবারকের মতো স্বৈরশাসকদের পরিবর্তন করে উদার গণতান্ত্রিক ইসলামী দলগুলোকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করেছে, যারা তাদের উপর দূর্নীতিগ্রস্থ ও নষ্ট-ভ্রষ্ট একই ধর্মনিরপেক্ষ ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করেছে।

দ্বিতীয়ত: মধ্যপ্রাচ্য এ পৃথিবীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্থান হবার কারণে, আর্ন্তজাতিক শক্তিগুলো এ অঞ্চলকে সবসময় তাদের নিজেদের নিয়ন্ত্রনে রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়েছে। আর এজন্যই আন্দোলনের শুরু থেকেই আমেরিকা, ফ্রান্স এবং ব্রিটেন আন্দোলনে নাক গলিয়ে এটি নিশ্চিত করার চেষ্টা করেছে যে, শাসকের চেহারা পরিবর্তিত হলেও যেন তাদের অনুমোদিত শাসনব্যবস্থা যেন একই থাকে। মধ্যপ্রাচ্যে অনেক আন্দোলনরত দল মনে করে যে, তারা গণতন্ত্র, উদার ব্যক্তিস্বাধীনতা কিংবা ধর্মনিরপেক্ষতার মতো পশ্চিমা মূল্যবোধকে সমর্থন করলেই পশ্চিমা বিশ্ব স্বৈরাচারী শাসকদের ‍উৎখাতে তাদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসবে। কিন্তু, তারা এটা বুঝতে ব্যর্থ হয় যে, মুসলিম বিশ্বের রাজনীতিতে বিদেশীদের অনুপ্রবেশের সুযোগেই, মার্কিন যু্ক্তরাষ্ট্র মিশরের সেনাবাহিনীর মাধ্যমে ইসরাইলের সাথে মিশরের কৃত চুক্তি বজায় রেখে এ অঞ্চলে মার্কিন স্বার্থরক্ষা করছে। আর, মুরসী মিশরে আভ্যন্তরীন শৃঙ্খলা রক্ষায় ব্যর্থ হলে তাকে পরিত্যাগ করে, “গণতন্ত্রকে সুসংহত” করার উছিলায় সিসি’র সামরিক অভ্যূত্থানকে যুক্তিযুক্ত বলে অভিহিত করেছে। একইভাবে, লিবিয়াতেও ফ্রান্স ও ব্রিটেন মধ্যবর্তী ও স্থায়ী সরকার গঠনে একযোগে কাজ করেছে, যে সরকারের মধ্যে বেশীর ভাগ কর্মকর্তাই গাদ্দাফী আমলের। বস্তুত: মধ্রপ্রাচ্যের রাজনৈতিক শ্রেণীর সাথে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের যে সুসসর্ম্পক তার পেছনে ঐতিহাসিক যোগসূত্র রয়েছে, যার মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠী শুধু এ অঞ্চলের পররাষ্টনীতিকেই নিয়ন্ত্রিন করেনি, বরং এদেশগুলোর বিভিন্ন আভ্যন্তরীন সংগঠন, রাজনৈতিক দল, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কিংবা সুশীলসমাজ সবার উপরেই তাদের ব্যাপক প্রভাব বিদ্যমান রয়েছে।

তৃতীয়ত: এ আন্দোলনে জনগণের জন্য ছিল না কোন নীলনকশা, সুদূরপ্রসারী চিন্তা কিংবা শাসককে জবাবদিহিতা করার সঠিক আর সুচিন্তিত কোন পন্থা। বস্তুত: লিবিয়া আর সিরিয়াতে দীর্ঘকাল ব্যাপী কোন বিরোধীদলের অস্তিত্বই ছিল না। আর, মিশর আর ইয়েমেনে যা ছিল, তা শুধুমাত্র নামসর্বস্ব। যার ফলে, যখন জনগণ স্বৈরাচারী সরকারকে উৎখাত করতে সমর্থ হয়েছে, এর পরবর্তী পন্থা কি হবে তা নিয়ে তারা সমস্যায় পতিত হয়েছে এবং পরবর্তীতে, একই শাসনব্যবস্থার মাধ্যমে তারা পরিবর্তন আনার চেষ্টা করেছে, যে শাসনব্যবস্থা নিজেই তাদের দূর্ভোগের মূল কারণ। এ থেকে প্রমাণ হয় যে, যদিও জনসমর্থন পরিবর্তনের পক্ষে কাজ করেছে, কিন্তু এ পরিবর্তনের প্রকৃতি ও গঠন সম্পর্কে জনমনে সুষ্পষ্ট কোন ধারণা না থাকায় বাস্তবে তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে।

চতুর্থত: অনেক দেশেই স্বৈরশাসককে উৎখাত করার পর পরই আন্দোলনরত দলগুলো একে অন্যের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে, যা দেশগুলোকে অনেকক্ষেত্রে গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দিয়েছে। লিবিয়াতে অরাজকতা আর স্বশস্ত্র বাহিনীগুলোর সহিংসতা শেকড় গেড়ে বসেছে, যা তাদের তেল ক্ষেত্রগুলোকে হুমকীর সম্মুখীন করেছে। দেশের সহিংসতা অব্যাহত ভাবে বৃদ্ধির ফলে সমগ্র দেশের অর্থনীতি ধীরে ধীরে স্থবির হয়ে পড়ছে। সিরিয়াতে পশ্চিমারা মধ্যপন্থী বিদ্রোহী দলগুলোকে সমর্থন করায়, ইসলামপন্থী বিদ্রোহীদের সাথে মডারেট দলগুলোর সংঘর্ষ চলছে। এর মধ্যে আইএসআইএস এর উপস্থিতি পুরো পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলেছে। ইয়েমেনে হাউতিরা সালেহ সরকারকে উৎখাত করার পর নতুন হাদি সরকার তাদেরকে পূর্বের সরকারের মতো আবারও বঞ্চিত করায় আবারও তারা বর্তমান সরকারকে উৎখাত করে ইয়েমেনের রাজধানী সানা দখল করে নিয়েছে। বর্তমানে দেশটি উত্তর আর দক্ষিণ দু’ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। উত্তর অংশ রয়েছে হাউতিদের দখলে আর দক্ষিণ অংশ রয়েছে পূর্ববর্তী সরকারের দখলে।

উপরোক্ত আলোচনা থেকে এটা স্পষ্ট যে, মধ্যপ্রাচ্যের এ দেশগুলোতে আরব বসন্ত নামক আন্দোলন গত চার বছরে ক্রমবর্ধমান সহিংসতা, নিরাপত্তাহীনতা, অর্থনৈতিক স্থবিরতা আর ভয়াবহ অরাজকতা ছাড়া আর কিছুই সৃষ্টি করতে পারেনি; উপরন্ত জনগণের এত ত্যাগ আর তিতিক্ষার পরও পূর্বের শাসনব্যবস্থা আগের মতোই শেকড় গেড়ে আছে। আসলে, এ অঞ্চলগুলোতে সত্যিকার পরিবর্তন আনতে হলে এ আন্দোলনকে সঠিক আর সুচিন্তিত পথে পরিচায় করতে হবে, জনগণকে পরিবর্তনের বিষয়ে সঠিক দিকনিদের্শনা দিতে হবে। আর সর্বোপরি, খিলাফত ধ্বংসের পর পশ্চিমা বিশ্ব যে পুঁজিবাদী শাসনব্যবস্থা আর ধর্মনিরপেক্ষ মূ্ল্যেবোধের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্য সহ সমগ্র মুসলিম বিশ্বে তাদের স্বার্থরক্ষায় এইসব যালিম, নিষ্ঠুর আর স্বৈরশাসক তৈরী করেছে সেই পুঁজিবাদী জীবনব্যবস্থার শেকড় মুসলিম বিশ্ব থেকে সমূলে উৎপাটন করে আবারও নবুয়্যতের আদলে খিলাফত ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।

ফাহমিদা মুন্নী
(আদনান খানের বিশ্লেষণ অবলম্বনে)

Leave a Reply