সমাজে প্রচলিত ভুল চিন্তা:
- গণতান্ত্রিক নির্বাচন ইসলাম প্রতিষ্ঠার গ্রহণযোগ্য ও বৈধ পদ্ধতি।
- কিছু লোক মনে করে জিহাদ বা অস্ত্র ধারণ করা ইসলাম প্রতিষ্ঠার আরেকটি পদ্ধতি।
নুসরাহ এর বিষয়টি জানার পর কিছু লোক যা বলতে পারে:
- নুসরাহের মাধ্যমে সামরিক বাহিনীকে উস্কে দিয়ে গনতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করা হবে।
- নুসরাহ ক্ষমতা পরিবর্তনের অসাংবিধানিক পদ্ধতি।
- নুসরাহ অনুসন্ধানের মাধ্যমে সামরিক শাসনের রাস্তাকে সুগম করা হচ্ছে।
যুক্তিখন্ডন:
১. নির্বাচন কোন ব্যবস্থা নয়, বরং নেতা নির্বাচনের একটি উপায় মাত্র। পৃথিবীর ইতিহাসে কোন ব্যবস্থাই নির্বাচনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত বা প্রতিস্থাপিত হয়নি। যেমন: মদীনাতে ইসলাম, ইউরোপে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র, রাশিয়া বা চীনে সমাজতন্ত্র নির্বাচনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। বরং মদীনাতে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আউস ও খাজরাজ গোত্রের সামরিক সক্ষমতা সম্পন্ন নেতৃবৃন্দ কতৃক রাসূলুল্লাহ (সা) কে নুসরাহ প্রদানের মাধ্যমে, সাধারণ জনগন ও দার্শনিকদের সাথে শাসক ও যাজকসম্প্রদায়ের শত শত বছরের রক্তক্ষয়ী সংঘাতের মাধ্যমে ইউরোপে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয় এবং অত্যাচারী জারদের বিরুদ্ধে সংঘটিত বলশেভিক বিপ্লবের মাধ্যমে রাশিয়াতে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। আর গণতন্ত্র হল পুঁজিবাদী জীবনাদর্শের শাসনতন্ত্র যেখানে মানুষ সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক বা আইন প্রণয়নকারী বা বিধানদাতা-যা ইসলামের সাথে পুরোপুরি সাংঘর্ষিক। কেননা ইসলামে সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক বা আইনপ্রণেতা বা বিধানদাতা এই মহাবিশ্বের স্রষ্টা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা {‘আল্লাহ্ ছাড়া আর কারও বিধান দেবার ক্ষমতা নেই।’(সূরা ইউসুফ:৪০)}। গনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচন সে ব্যবস্থাকে অব্যাহত রাখার একটি উপায় মাত্র। সুতরাং গনতান্ত্রিক নির্বাচনের মাধ্যমে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করার প্রচেষ্টা হারাম কোন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ফরজ একটি ইবাদত পালন করার নামান্তর মাত্র। আর ইসলামে হারাম কোন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কোন ইবাদত সুসম্পন্ন করা হারাম। যেমন কেউ চুরির মাধ্যমে অর্জিত সম্পদ দান করলে তা আল্লাহ’র কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। আর ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনাদর্শ হওয়ায় ইসলাম প্রতিষ্ঠার পদ্ধতি অন্য কোন ব্যবস্থা থেকে নেয়ার প্রয়োজন নেই। রাসূলুল্লাহ (সা) এর সুন্নাহকে(পদ্ধতিকে) অনুসরণ করে নুসরাহ অর্জনের মাধ্যমে সর্বপ্রথম ইসলামিক/খিলাফত রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে ইনশাআল্লাহ এবং অবশ্যই প্রথম খলিফা নির্বাচনের মাধ্যমে আসবেন না। কিন্তু পরবর্তী খলিফাগণ নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নির্বাচিত হতে পারেন যেমনটি হয়েছিল আজ থেকে ১৪০০ বছর আগে উসমান (রা)কে খলিফা নির্বাচনের ক্ষেত্রে।
২. বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় কে আসীন হবে তা আমেরিকা, ভারত, ব্রিটেন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সমঝোতার মাধ্যমে নির্ধারিত হয়। আর গনতান্ত্রিক ব্যবস্থার এ নির্বাচন একটি আইওয়াশ ও প্রতারণা মাত্র। সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মোজেনা ও ভারতীয় রাষ্ট্রদূত পঙ্কজ শরণসহ সাম্রাজ্যবাদী অন্যান্য রাষ্ট্রসমূহের বিভিন্ন প্রতিনিধিদের জোর তৎপরতা ও দৌড়ঝাপ দেখলে এ কথার প্রমাণ পাওয়া যায়। হাসিনা অসংখ্যবার তার বক্তব্যে বলেছে যে, ২০০১ সালে গ্যাস বিক্রি না করায় সে ক্ষমতায় যেতে পারেনি। অর্থাৎ গ্যাস বিক্রি বা দেশের সম্পদ লুটপাটের সুযোগ করে দেয়ার সাথে ক্ষমতায় যাওয়া না যাওয়ার সর্ম্পক রয়েছে। সে একবারও বলেনি জগগন তাকে ভোট দেয়নি বলে ক্ষমতায় আসতে পারেনি। তাহলে ২০০১ সালে কী খালেদা গ্যাস বিক্রিসহ দেশের সম্পদ লুট করার লাইসেন্স দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল? ২০০৮ সালে হাসিনা কী এ ধরনের মুচলেকা ও দাসখতের বিনিময়ে ক্ষমতায় এসেছে? সুতরাং হাসিনা খালেদার সুতার নাটাই দেশের বাইরে থাকায় প্রতি পাঁচ বছর পর পর গনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যেদিন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় সেদিনটি হাসিনা খালেদার জন্য হলেও কখনওই সাধারণ জনগনের জন্য উৎসবের দিন নয়, বরং এটি পুরো জাতিকে আহাম্মক বা বোকা বা প্রতারণা করার জন্য একটি নিকৃষ্ট কালো দিবস।
৩. জিহাদ বা অস্ত্র ধারণ করার মাধ্যমে ইসলামিক রাষ্ট্র বা খিলাফত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা শরী’আহ সম্মত নয়। কেননা মদীনাতে প্রথম ইসলামিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে অস্ত্র ধারণ করার কোন নজির সীরাতে বা কুরআন ও সুন্নাহতে নেই। আমরা মক্কীযুগে কিছু সাহাবীর অস্ত্র ধারণ করা বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (সা) এর নিষেধাজ্ঞা মনে করিয়ে দিতে চাই, যখন তিনি (সা) বলেছিলেন,
‘আমি ক্ষমা করবার জন্য আদিষ্ট হয়েছি, সুতরাং যুদ্ধ করো না।’ (সীরাত ইবনে হিসাম)
এছাড়া আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা পবিত্র কোরআনে নাজিল করেন যে,
‘তুমি কি সেসব লোককে দেখনি, যাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল যে, তোমরা নিজেদের হাতকে সংযত রাখ, নামায কায়েম কর এবং যাকাত দিতে থাক? অতঃপর যখন তাদের প্রতি জিহাদের নির্দেশ দেয়া হল,…..।’ (সূরা নিসা:৭৭)
৪. নির্যাতিত ও বার বার প্রত্যাখাত হওযার পরও রাসূলুল্লাহ (সা) কখনও আবু বকর, কখনও পালকপুত্র জায়েদ, কখনও আলী (রা) কে সাথে নিয়ে তায়েফের বনু সাকিফ, ইয়েমেনের বনু কিন্দা ছাড়াও বনু শা’সা, বনু নাজির, বনু বিকাহ, বনু কা’বসহ প্রভৃতি গোত্রের সামরিক সক্ষমতা সম্পন্ন গোত্রপ্রধানদের কাছে আল্লাহ’র নির্দেশে নুসরাহ অনুসন্ধান করেছিলেন। নির্যাতিত ও প্রত্যাখাত হওয়ার পরও এ কাজ নিবিড়ভাবে অব্যাহত রাখায় এটি সুন্নাহ বা পদ্ধতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, কেবলমাত্র দাড়ি রাখা, লম্বা জুব্বা পড়া, মিসওয়াক করা, টুপি পড়াই রাসূল (সা) এর সুন্নাহ বা পদ্ধতি নয়, খিলাফত প্রতিষ্ঠার জন্য নুসরাহ অনুসন্ধান করাও তাঁর (সা) সুন্নাহ বা পদ্ধতি।
৫. নির্বাচিত সরকার বলতে জনসমর্থিত সরকার বা নেতৃবৃন্দ বা শাসককে বুঝানো হয়। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, আমাদের নবী (সা)-সহ প্রত্যেক নবী (আ) আল্লাহ’র নির্দেশে তৎকালীণ সময়কার স্বীকৃত বা তথাকথিত জনসমর্থিত শাসকদেরকে উৎখাত করে আল্লাহ’র শাসন কায়েম করেছিলেন। যেমন: ইব্রাহিম (আ) নমরুদকে, মুসা (আ) ফেরাউনকে এবং মুহম্মদ (সা) মদীনার জনসমর্থিত ভাবি শাসক আবদুল্লাহ বিন উবাই ও মক্কার জনসমর্থিত শাসকগোষ্ঠী আবু জাহল, আবু লাহাব, ওয়ালিদ বিন মুগীরাহ, উতবাহ, শাইবাকে উৎখাত করে আল্লাহ’র দ্বীন কায়েম করেছিলেন। তাদেরকে উৎখাত করার যে কারণ ছিল এখনকার তথাকথিত নির্বাচিত শাসকদের ইতিহাসের ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলে দেয়ার পেছনেও একই কারণ বিদ্যমান। অর্থাৎ হাসিনা খালেদাসহ মুসলিম বিশ্বের বর্তমানকালের যে কোন শাসকই নমরুদ, ফেরাউন, আবদুল্লাহ বিন উবাই, আবু জাহল, আবু লাহাব, ওয়ালিদ বিন মুগীরাহ, উতবাহ, শাইবার মত ইসলাম ব্যতিত অন্য কোন ব্যবস্থা দিয়ে মুসলিমদের শাসন করছে। পবিত্র কোরআন অনুসারে এসব শাসকগণ কুফরী করছে, জুলুম করছে ও ফিসক করছে। সেকারণে সামরিকবাহিনীর সহায়তা নিয়ে এইসব জালিম ও ফাসেক শাসকদের উৎখাত করে খিলাফত প্রতিষ্ঠা করা একটি ফরজ দায়িত্ব এবং রাসূলুল্লাহ (সা) এর পদ্ধতি বা সুন্নাহ।
৬. কুফরী সংবিধানের মাধ্যমে মানুষকে আইন তৈরির ক্ষমতা দেয়ায় শাসকগণ নিজের সুবিধামত আইন প্রণয়ন করে শিরক, জুলুম ও কুফরীকে প্রতিষ্ঠিত করে এবং এটি কুরআন, সুন্নাহ তথা ইসলামের সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক। এ সংবিধান অনুসারে ইসলাম দিয়ে জনগনকে শাসন করা ও সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, আর্ন্তজাতিক জীবনসহ সামগ্রিকভাবে ইসলাম পালন করা অসাংবিধানিক। স্বভাবতই এ কারণে নুসরাহ অনুসন্ধান করাও অসাংবিধানিক হবে। কীভাবে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হবে তা জানার জন্য কেন আমরা মানবরচিত কুফরী সংবিধানের শরণাপন্ন হব? বরং এর জন্য আমাদেরকে কুরআন ও সুন্নাহ’র শরণাপন্ন হতে হবে।
৭. খিলাফত প্রতিষ্ঠিত হলে সামরিকবাহিনী রাজনৈতিক কতৃপক্ষের নির্দেশে আমীরুল জিহাদের অধীনে পরিচালিত হবে। পৃথিবীর কোন আদর্শিক রাষ্ট্রে(খিলাফত রাষ্ট্র, পুজিবাদী রাষ্ট্র যেমন: আমেরিকা, বৃটেন, ফ্রান্স ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন) সামরিক বাহিনী রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেনি। বরং সামরিক বাহিনী রাজনৈতিক কতৃপক্ষের অধীনে পরিচালিত হয়েছে। সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রসমূহ(আমেরিকা, বৃটেন, ফ্রান্স) অধঃপতিত মুসলিম রাষ্ট্রসমূহে উপনিবেশবাদ বা নব্য উপনিবেশবাদ বজায় রাখার জন্য সেসব দেশের সামরিক বাহিনীকে ক্যু এর মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করতে উৎসাহিত করে ও প্রত্যক্ষ মদদ দেয়। বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও অতি সম্প্রতি মিশরে ঘটে যাওয়া তথাকথিত সফল সামরিক অভ্যূত্থানসমূহ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা অন্যান্য সাম্রাজ্যবাদীদের পক্ষে সংঘটিত হয়েছে। নুসরাহ অনুসন্ধান করার উদ্দেশ্য সামরিক বাহিনীকে শাসন ক্ষমতা দখল করার জন্য উৎসাহিত করা নয়, বরং এর উদ্দেশ্য হল কুফর, জালিম ও ফাসেক গনতান্ত্রিক শাসকদের(হাসিনা, খালেদা) অপসারণ করে নিষ্ঠাবান ইসলামিক রাজনৈতিক শক্তিকে রাষ্ট্রক্ষমতা অর্জনে বস্তুগত সহায়তা প্রদান করা। যে মুসলিম সামরিক অফিসারগণ এ কাজে সহায়তা করবেন তাদের জন্য রয়েছে সা’দ বিন মু’আজ (রা) এর মত দুনিয়ার সম্মান ও গৌরব এবং পরাক্রমশালী আল্লাহ’র সন্তুষ্টি ও মহাপুরষ্কার।
রাফীম আহমেদ