চালের বাজারে অস্থিরতা: পুঁজিবাদী শাসনব্যবস্থা এর জন্য দায়ী

সম্প্রতি চালে বাজার আবার অস্থির হয়ে ওঠেছে। পাইকারী থেকে শুরু করে খুচরা বাজারে এর প্রভাব চোখে পড়ার মতো। খুচরা বাজারে প্রতি কেজিতে ২-৩ টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ সরকারের খাদ্য মন্ত্রণালয় শ্রীলংকাতে টন প্রতি ৪৫০ ডলার দরে ৫০ হাজার টন চাল রপ্তানি ঘোষণা করেছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি তার চট্টগ্রামে ফ্লাইওভার উদ্ধোধনের ভাষনে এ রপ্তানির বিষয়টি গর্ব করে উল্লেখও করেছেন। উল্লেখ্য ২০১৩-১৪ অর্থবছরে জুলাই- সেপ্টেম্বরে তুলনায় ২০১৪-১৫ অর্থবছরে একই সময়ে চালের আমদানিও বেড়েছে। ৪৫০ ডলার দরে রপ্তানিযোগ্য চালের উৎপাদন খরচ পড়বে ৪৩৬ ডলার এবং লাভ হবে ১৪ ডলার। অর্থাৎ প্রতিকেজি চালের মূল্য হবে ৩৩টাকা। এই সরকারের তথাকথিত মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে লোক দেখানোর জন্য সরকার তড়িগড়ি করে রপ্তানি খাতে নাম লিখিয়েছে। সাধারণত জনগণের চাহিদা পূরণের পর যেসব দ্রব্য বা পণ্য উদ্বৃত্ত থাকে তা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য রপ্তানি করা হয়ে থাকে। আর আমদানি তখনই হয় যখন কোনো পণ্য বা দ্রব্যের ঘাটতি থাকে। কিন্তু আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে, বাংলাদেশ একই সাথে চাল যেমন রপ্তানি করছে তেমনি চাল আমদানিও করছে। একই পণ্য একই সাথে রপ্তানি ও আমদানি করা সত্যিই রহস্যজনক! এই আমদানি-রপ্তানির দোলাচলের প্রভাব চালের বাজারে সর্বত্র দৃশ্যমান। আবার রপ্তানি করে ১৪ ডলার আয় দিয়ে আমদানি মূল্য কতটুকু মেটানো সম্ভব তাও প্রশ্নবিদ্ধ। এই সরকারের মন্ত্রি-প্রতিমন্ত্রি থেকে শুরু করে সরকারের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তারা চালের আমদানি-রপ্তানির আলো আঁধারির খেলা থেকে অনেক টাকা লুটপাট করতে চায়।

সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকারের একজন রাজনীতিবিদ (মাহবুবুল আলম হানিফ) নির্বাচনি ব্যয় প্রসঙ্গে বলেন, “নির্বাচন কমিশন কর্তৃক নির্ধারিত ২৫ লাখ টাকা দিয়ে নির্বাচনি ব্যয় বহন করা সম্ভব নয়। দেশের মধ্যবিত্তরা রাজনীতি করতে পারছে না এই কারণে। তাই রাজনীতিবিদদের রাজনীতির পাশাপাশি ব্যবসা করতে হবে।” উক্ত এ ব্যক্তির কথা থেকে বুঝতে পারা যায় তারা দেশের প্রতিনিধি হতে চায় জনগণের সেবক হওয়ার জন্য নয়; বরং শোষক হওয়ার জন্য। নির্বাচনি ব্যয় মেটাতে হলে ক্ষমতায় বসে লুটপাট না করলে নির্বাচনি ব্যয় মেটানো সম্ভব নয়। চালের আমদানি-রপ্তানি সেই ধরনের-ই একটা বিষয় যেখান থেকে তারা অনেক টাকা লুটপাট করে নিতে চায়। যেহেতু পুঁজিবাদী ব্যবস্থা সাধারন জনগণের স্বার্থ রক্ষা না করে শুধুমাত্র মুষ্টিমেয় ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষা করে তাই শাসকগণ জনগণের খাদ্যের চাহিদার দিকে লক্ষ্য না রেখে দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ীদের খাদ্য পণ্য রপ্তানির আবাধ স্বাধীনতা প্রদান করে যা দেশে খাদ্যপ্যনের অপ্রতুলতা তৈরি করে যা বাজারকে অস্থিতিশীল করে তোলে। এর জন্য দায়ী পুঁজিবাদী শাসন তথা এর অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। মানুষের তৈরী এই শাসনব্যবস্থা মূলত এইসব দুর্নীতিবাজ শাসক ও ব্যবসায়ী তৈরীর কারখানা।

পুঁজিবাদী অর্থনীতির অন্যতম প্রবক্তা অ্যাডাম স্মিথ তার বিখ্যাত An Inquiry into the Nature and Causes of the Wealth of Nations (1776) গ্রন্থে বলেন, “প্রতিটি ব্যক্তি… গণমানুষের স্বার্থ রক্ষার কোন ইচ্ছা পোষণ করেনা এবং সে জানেও না যে সে গণমানুষের স্বার্থ হাসিলে কতটুকু সহায়তা করছে। ব্যক্তি শুধুমাত্র নিজের লাভ নিয়ে সদাব্যস্ত। একটি অদৃশ্য হাতের কল্যাণে সে গণমানুষের স্বার্থের পক্ষে ভূমিকা রাখে যা ব্যক্তি কখনোই স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে করে না, করার ইচ্ছাও পোষণ করেনা”।

পুঁজিবাদী ব্যবস্থা যেহেতু শুধু মাত্র “বস্তুগত লাভ ও স্বার্থকে” সকল কাজের ভিত্তি ধরে এগোয় যার ফলে ঘুষ-দুর্নীতি, দলবাজি, জোচ্চুরি ইত্যাদি নিত্য দিনের ব্যপার হয়ে দাঁড়ায়। শাসক থেকে পিয়ন সকলে দুর্নীতিবাজ হয়ে যায়। ঘুষ-দুর্নীতি যে জাতির প্রতিদিনের কর্ম সে দেশে দ্রব্যমূল্যের দাম বাড়বে এটাই স্বাভাবিক এবং জাতির কাজই হয়ে যাবে কিভাবে কিভাবে আই এম এফ বা ওয়ার্ল্ড ব্যাংকে খুশি করা যায়। কারণ রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন ‘………যে জায়গায় ঘুষের লেনদেন হয় সে জায়গায় আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা অন্য জাতির ভয় চাপিয়ে দেন।” [মুসনাদে ইমাম আহমাদ] অর্থাৎ আমরা আল্লাহর দেয়া রাষ্ট্র খিলাফত রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত না করি তাহলে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা আমাদেরকে ইহকালে যেমন শাস্তি দিবেন (যেমন মার্কিন-ভারতের দালাল যালিম শাসককে চাপিয়ে দেওয়া) তেমনি পরকালেও পকড়াও করবেন জাহান্নামের আগুন দিয়ে। তাই আমাদেরকে পুঁজিবাদী শাসনব্যবস্থাকে বর্জন করে খিলাফত রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্টা করতে হবে।

খিলাফত রাষ্ট্র ব্যবস্থা যেভাবে এই সমস্যার সমাধান করবে:

প্রথমত, খাদ্য যেহেতু জনগণের মৌলিক চাহিদার একটি তাই খিলাফত রাষ্ট্র জনগণের চাহিদা পূরণের দিকে সর্বাধিক নজর রাখবে। রাসূল (সা) বলেন,

বাস করার জন্য একটি গৃহ, আব্রু রক্ষার জন্য এক টুকরা কাপড়, আর খাওয়ার জন্য এক টুকরা রুটি ও একটু পানি এসবের চেয়ে অধিকতর জরুরী কোন অধিকার আদম সন্তানের থাকতে পারে না।” [তিরমিযী]

তাই খলীফাকে অবশ্যই জনগণের খাদ্যের চাহিদা পূরণ করতে হবে ব্যবসায়ীদের স্বার্থ নয় । জনগণের খাদ্যের চাহিদা পূরন হলে সে অবশিষ্ট অংশ রপ্তানি করতে ব্যসায়ীদের অনুমতি দিতে পারবে।

দ্বিতীয়ত, ইসলামী রাষ্ট্র সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মত ব্যবসায়ীদের ব্যবসা করার অধিকার কেড়ে নেয় না আর অন্যদিকে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের মত যে কোন উপায়ে মুনাফা করার জন্য সবকিছু ব্যবসায়ীদের উপর ছেড়ে দেয়না। খিলাফত সরকার প্রথমেই ব্যবসায়ী সমাজের মধ্যে ইসলামী মূল্যবোধ সুপ্রতিষ্ঠিত করবে। সৎ ব্যবসায়ী কেয়ামতের দিন আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের আরশের ছায়ায় স্থান লাভ করবেন বলে রাসূল (সা) ঘোষণা করেছেন। ইসলামী রাষ্ট্র বস্তুগত লাভ নয় বরং আল্লাহর সন্তুষ্টি ও অসন্তুষ্টিকে সকল কাজের ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করবে এবং জনগণকে এর উপর সবসময় সচেতন রাখবে এবং তাকওয়া ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা বাস্তবায়নের ল্যক্ষে কাজ করবে।

তৃতীয়ত, খিলাফত রাষ্ট্র সর্বপরি জনগণের কল্যাণের জন্য অনবরত কাজ করে যাবে। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন, “এমন আমীর যার উপর মুসলিমদের শাসনভার অর্পিত হয় অথচ এরপর সে তাদের কল্যাণ সাধনে চেষ্টা না করে বা তাদের মঙ্গল কামনা না করে; আল্লাহ তাকে তাদের সাথে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন না”। [মুসলিম]

দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রনে ইসলামী অর্থনীতির অনান্য সমাধান সমূহ:

১। ইসলামের সমাধান জিনিসপত্রের সরবরাহকে কেন্দ্র করে আবর্তিত। সম্পদের সুষ্ঠু বিতরণকে ইসলাম মূল অর্থনৈতিক সমস্যা হিসেবে দেখে। তাই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেছেন,

“যেন সম্পদ তোমাদের বিত্তশালীদের মধ্যে আবর্তিত না হয়” [সূরা হাশর: ৭]

তাই খিলাফত রাষ্ট্র সম্পদের সুষ্ট বিতরণের লক্ষ্যে কাজ করে যাবে।

২। খিলাফত রাষ্ট্রব্যবস্থায় কোনো ভূমি অনাবাদী রাখা যাবে না। এর কারণ উৎপাদন সবসময় সচল রাখা খিলাফত রাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য। উৎপাদন যত বেশি বাড়বে জনগণের চাহিদা তত বেশি পূরণ করা সম্ভব হবে। বাংলাদেশের ভূমি যেহেতু উর্বর তাই এখানে অনাবাদী জমিগুলোকে আবাদী করার মাধ্যমে জনগণের চাহিদা মেটানো সম্ভব।

৩। খিলাফত রাষ্ট্র ব্যবস্থার মুদ্রানীতি হবে স্বর্ণ এবং রৌপ্য। এই মুদ্রানীতিতে দ্রব্যমূল্যের দাম যেমন নিয়ন্ত্রণ করা যাবে তেমনি জনগণের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ানো যাবে। এভাবে খিলাফত রাষ্ট্র চালের দাম নিয়ন্ত্রণ করে জনগণের চাহিদা নিশ্চিত করবে।

Leave a Reply