ব্যক্তিপর্যায় এবং প্রকাশ্য গণসংযোগের গুরুত্বের বিষয়টি রাসূলুল্লাহ্ (সা) কর্তৃক অনুসৃত পদ্ধতি থেকে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাই এই দুই পর্যায়ের গণসংযোগকে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা কর্তৃক পুরষ্কৃত মহান ইবাদত হিসেবে গণ্য করা হয়। আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা তাঁর পবিত্র গ্রন্থে নুহ (আ)-এর ঘটনা উল্লেখ করেন: যেখানে আমরা দেখি, তিনি (আ) তার জাতি হতে প্রাপ্ত সাড়ার ব্যাপারে তার রবের কাছে নালিশ জানান, এবং ৯৫০ বছরের এই দীর্ঘ সময়জুড়ে তিনি (আ) কী পরিমাণ ধৈর্য্যসহকারে তার জাতির কাছে দাওয়াহ্ পৌঁছে দেন। জাতির কাছে পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যাসহ, সুস্পষ্টরূপে বক্তব্য উপস্থাপন এবং সরল-সঠিকপথের দিকে আহ্বানের পরই কেবল তিনি (আ) আল্লাহ্’র নিকট অভিযোগ জানান। আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা আরও উল্লেখ করেন, কিভাবে নুহ (আ) তার জাতির কাছে ব্যক্তি ও সামষ্টিক পর্যায়ে একনিষ্টভাবে দাওয়াহ্ পৌঁছে দেন,
(ثُمَّ إِنِّي دَعَوْتُهُمْ جِهَارًا * ثُمَّ إِنِّي أَعْلَنْتُ لَهُمْ وَأَسْرَرْتُ لَهُمْ إِسْرَارًا)
“অতঃপর নিশ্চয়ই আমি তাদেরকে প্রকাশ্যে দাওয়াহ্ দিয়েছি, অতঃপর নিশ্চয়ই আমি ঘোষণা সহকারে প্রচার করেছি এবং গোপনে চুপিসারে বলেছি” [সূরা নুহ: ৮-৯]।
এই গণসংযোগ যে কি পরিমাণ গুরুত্ব ও কঠোর পরিশ্রমের সাথে করা হয়েছিল তা নুহ (আ)-এর সাক্ষ্য হতে অত্যন্ত পরিষ্কার,
(رَبِّ إِنِّى دَعَوْتُ قَوْمِى لَيْلاً وَنَهَاراً)
“সে বলল: হে আমার রব! নিশ্চয়ই, আমি আমার সম্প্রদায়কে দিবা-রাত্রি দাওয়াহ্ পৌঁছে দিয়েছি,” [সূরা নুহ্: ৫]
অর্থাৎ ‘আমি দিবা-রাত্রি দাওয়াহ্ পৌঁছে দেয়া বন্ধ করিনি, তোমার আদেশ-নিষেধ পৌঁছেছি এবং তোমার আনুগত্য করেছি।’
তাছাড়া, তিনি (আ) জনগণের কাছ থেকে প্রাপ্ত সাড়াকে যথাযথভাবে পর্যবেক্ষণ করে এই গণসংযোগটি পরিচালনা করেন, এমনকি কঠোরভাবে প্রত্যাখ্যাত হলেও। নুহ (আ) ঘোষণা দেন,
(وَإِنِّى كُلَّمَا دَعَوْتُهُمْ لِتَغْفِرَ لَهُمْ جَعَلُواْ أَصَـبِعَهُمْ فِى ءَاذَنِهِمْ وَاسْتَغْشَوْاْ ثِيَابَهُمْ)
“এবং নিশ্চয়ই, আমি যতবারই তাদেরকে দাওয়াহ্ দিয়েছি যাতে আপনি তাদেরকে ক্ষমা করে দেন, ততবারই তারা কানে আঙ্গুলি দিয়েছে, মুখমন্ডল বস্ত্রাবৃত করেছে” [সূরা নুহ: ৭]
অর্থাৎ, ‘আমার বক্তব্য যাতে না শুনতে পায় এজন্য তারা তাদের কানসমূহ বন্ধ করে দিয়েছে।’ রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর দাওয়াহ্ প্রত্যাখ্যানকারী কুরাইশ গোত্রের কাফিরদের ব্যাপারেও আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা একই বর্ণনা দেন,
(وَقَالَ الَّذِينَ كَفَرُواْ لاَ تَسْمَعُواْ لِهَـذَا الْقُرْءَانِ وَالْغَوْاْ فِيهِ لَعَلَّكُمْ تَغْلِبُونَ)
“আর কাফিররা বলে: “তোমরা এ কুর’আন শ্রবণ করো না, এবং এর তিলাওয়াতের সময় হট্টগোল সৃষ্টি কর যাতে তোমরা জয়ী হও“।” [সূরা ফুস্সিলাত : ২৬]
(وَاسْتَغْشَوْاْ ثِيَابَهُمْ) “তারা তাদের বস্ত্র দ্বারা তাদেরকে বস্ত্রাবৃত করে রাখতো,” ইবনে আব্বাস হতে ইবনে যারির সংকলন করেছেন যে তিনি বলেন, “তিনি (সা) যাতে তাদেরকে চিনতে না পারেন এজন্য তারা তাঁর (সা) নিকট হতে বিভিন্ন ছলচাতুরির মাধ্যমে নিজেদেরকে লুকিয়ে রাখতো।” সা’ঈদ বিন যুবায়ের এবং আস-সুদ্দি উভয়ে বলেছেন, “তারা তাদের মাথা ঢেকে রেখেছিল যাতে তারা রাসূল (সাঃ)-এর বক্তব্য শুনতে না পায়”। আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বিষয়টিকে আরও ব্যাখ্যা করে বলেন (وَأَصَرُّواْ) “এবং তারা এ বিষয়ে একগুয়েমি করেছে,” অর্থাৎ তারা পূর্বের কুফর এবং আল্লাহ্’র সাথে শিরক রত অবস্থা চলমান রেখেছিল। এবং তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেন,
(وَاسْتَكْبَرُواْ اسْتِكْبَاراً)
“…এবং তারা চরম ঔদ্ধত্য প্রদর্শনে নিজেদেরকে নিমগ্ন রেখেছে” [সূরা নুহ: ৭]
অর্থাৎ, তারা সত্য অনুসরণ এবং সত্যের কাছে আত্নসমর্পন থেকে নিজেদেরকে দূরে সরিয়ে নিয়েছিল।
পর্যাপ্ত পর্যবেক্ষণের পর পরবর্তী গণসংযোগের জন্য পর্যাপ্ত চিন্তা প্রয়োগ করা প্রয়োজন। দাওয়াহ্’র ফলাফল নিরুৎসাহব্যাঞ্জক এবং বিপরীত হলেও বিশ্বাসীরা এতে হতাশ কিংবা বিচলিত হন না। ব্যক্তি ও সামষ্টিক পর্যায়ের দাওয়াহ্ বন্ধ করেন না। বরং, কিভাবে দাওয়াহ্ বহন করলে তা জনগণের নিকট সহজে বোধগোম্য হবে, জনগণ তা সাদরে গ্রহণ করবে এবং জীবনের উদ্দেশ্যের সাথে গভীরভাবে সম্পর্কিত করবে, সে বিষয়ের উপর চিন্তারোপ করেন। আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বক্তব্যে আমরা দেখতে পাই যে নুহ (আঃ) উৎসাহব্যাঞ্জক যুক্তি দ্বারা তার জাতিকে আহ্বান করেছেন,
(وَيُمْدِدْكُمْ بِأَمْوَلٍ وَبَنِينَ وَيَجْعَل لَّكُمْ جَنَّـتٍ وَيَجْعَل لَّكُمْ أَنْهَاراً)
“তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি বাড়িয়ে দিবেন, তোমাদের জন্যে উদ্যান স্থাপন করবেন এবং তোমাদের জন্যে নদীনালা প্রবাহিত করবেন” [সূরা নূহ্: ১২]
অর্থাৎ, ‘যদি তোমরা অনুতপ্ত হও এবং আল্লাহ্’র নিকট ক্ষমা প্রার্থনা এবং তাঁর আনুগত্য কর, তবে তিনি তোমাদের রিযক বাড়িয়ে দিবেন এবং আসমান হতে মেঘমালা বর্ষণ করবেন। তিনি পৃথিবীর উপর রহমত বর্ষণ করবেন এবং জমীনে ফসল জন্মাবেন। অর্থাৎ তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) তাদেরকে আরও সম্পদ, আরও সন্তান, আরও গবাদীপশু এবং বিভিন্ন ফলমূলসমৃদ্ধ বাগান দিবেন। এসব বাগানের ভিতর দিয়ে নদী বইয়ে দিবেন।’ এটাই হচ্ছে উৎসাহব্যাঞ্জক দাওয়াহ্ প্রদানের নমূনা। অতঃপর ভীতিপ্রদর্শনের মাধ্যমে তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) একে ভারসাম্যপূর্ণ করেছেন। তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেন,
(مَّا لَكُمْ لاَ تَرْجُونَ لِلَّهِ وَقَاراً)
“তোমাদের কী হল যে তোমরা আল্লাহ্’র শ্রেষ্ঠত্বের আশা করছ না?” [সুরা নূহ্ :১৩]
অর্থাৎ তিনি মহামহিম। ইবনে আব্বাস, মুজাহিদ এবং আত-দাহ্হাক হতে বর্ণিত। ইবনে আব্বাস বলেন, “আল্লাহ্’র বিরাটত্ব-বিশালতাকে যেভাবে অনুধাবন করা উচিত সেভাবে তোমরা অনুধাবন করছো না। অর্থাৎ তোমরা তাঁর শাস্তি ও ক্রোধকে ভয় করছো না।”
আমাদের প্রাণপ্রিয় রাসূল (সা) ব্যক্তিপর্যায় এবং প্রকাশ্যে মানুষকে দাওয়াহ্ দিয়েছেন। তাই আমরা দেখতে পাই শুরুতে রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাঁর স্বাভাবিক পরিচিত গন্ডির মধ্যে দাওয়াহ্ করেন। প্রথমে তিনি (সা) তাঁর স্ত্রী খাদিজা (রা)-কে দাওয়াহ্ করেন এবং তিনি (রা) তা গ্রহণ করেন। তারপর তিনি (সা) তাঁর চাচাতো ভাই আলী (রা.)-কে দাওয়াহ্ করেন এবং তিনি (রা) তা গ্রহণ করেন। তারপর তিনি (সা) তাঁর দাস যায়িদ (রা)-কে দাওয়াহ্ করেন এবং তিনি (রা) তা গ্রহণ করেন। এবং অতঃপর তিনি (সা) তাঁর বন্ধু আবু বকর (রা)-কে দাওয়াহ্ করেন এবং তিনিও (রা) তা গ্রহণ করেন। তিনি (সা) ব্যক্তিগত পর্যায়ে দাওয়াহ্ অব্যাহত রেখেছিলেন, কিছু লোক ঈমান এনেছিল এবং কিছু প্রত্যাখ্যান করেছিল। অতঃপর ইসলামগ্রহণকারীর সংখ্যা দিন দিন বাড়তে থাকে, যতক্ষন না এটা কুরাইশদের মধ্যে আলোচনার বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়। রাসূলুল্লাহ্ (সা) বাড়ি বাড়ি গিয়ে লোকদের সাথে দেখা করতেন এবং বলতেন তাদেরকে আল্লাহ্’র পক্ষ থেকে এই আদেশ দেয়া হয়েছে যে তারা শুধুমাত্র তাঁর ইবাদত করবে এবং তাঁর সাথে কাউকে শরিক করবে না।
ব্যক্তিপর্যায়ের গণসংযোগের জন্য রাসূলুল্লাহ্ (সা) পরিচিতজনদের গন্ডির বাইরেও দাওয়াহ্ করেছেন। তারপর আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা’র নিম্নোক্ত আয়াত নাযিলের পর তিনি (সা) সমাজের বৃহত্তর পরিসরে সামষ্টিক পর্যায়ে প্রকাশ্য দাওয়াহ্ শুরু করেন:
(فَاصْدَعْ بِمَا تُؤْمَرُ وَأَعْرِضْ عَنِ الْمُشْرِكِينَ)
“অতএব আপনি প্রকাশ্যে শুনিয়ে দিন যা আপনাকে আদেশ করা হয়; এবং মুশরিকদের পরোয়া করবেন না।” [আল-হিজর: ৯৪];
তিনি (সা) কুরাইশদের সাফা পাহাড়ে ডেকে প্রকাশ্যে এবং জনসম্মুখে ইসলামের দাওয়াহ্ পৌঁছে দেন এবং বলেন তিনি আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা কর্তৃক মনোনীত রাসূল এবং তাদেরকে তাঁর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে। এবং তিনি (সা) ব্যক্তিপর্যায়ের পাশাপাশি প্রকাশ্যে বিভিন্ন গোষ্ঠির কাছে ইসলামের দাওয়াহ্ পৌঁছে দিয়েছেন। তাঁর প্রকাশ্য গণসংযোগ ছিল খুবই বলিষ্ঠ এবং গতিশীল। তিনি প্রকাশ্যে কুরাইশদের বিরোধিতা করেছেন; তাদের দেব-দেবী, বিশ্বাস এবং চিন্তাসমূহের ভ্রান্তি, দূষণ এবং ত্রুটিসমূহকে উন্মোচিত করেছেন। তিনি যেভাবে সমাজে বিদ্যমান সকল ভ্রান্ত বিশ্বাস এবং চিন্তাগুলোকে আক্রমন করেছেন, ঠিক একইভাবে তিনি জীবন সম্পর্কিত অন্যান্য চিন্তাসমূহকেও প্রকাশ্যে আক্রমন করেছেন। সুদগ্রহণ, কন্যা সন্তানকে হত্যা, মাপে কম দেয়া, যিনাহ্ সহ সকল কুফর জীবনযাপনকে আক্রমন করে সেই সময়ে কুর’আনের আয়াতগুলো নাযিল হয়। এবং পাশাপাশি কুরাইশ সর্দার, এবং তাদের পূর্বপুুরুষ ও তাদের চিন্তাকে আক্রমন ও অপদস্থ করে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) এবং সাহাবীগণদের বিরুদ্ধে তাদের ষড়যন্ত্রকে উন্মোচন করে বহু আয়াত নাযিল হয়। শুধুমাত্র নাযিলকৃত ইসলামের বাণীর উপর গভীর বিশ্বাসই ছিল তাঁর একমাত্র অস্ত্র, তাই ব্যক্তিপর্যায়ে তিনি আর কোন উপায়-উপকরণ কিংবা সাহায্য কিংবা অস্ত্রের আশ্রয় নেননি। বিপরীত এবং আক্রমাত্নক প্রতিক্রিয়া পেয়েও তিনি এতে অটল ছিলেন।
সাহাবীগণ (রা) কর্তৃক সম্পাদিত ব্যক্তিপর্যায় এবং প্রকাশ্য গণসংযোগগুলোকে রাসূলুল্লাহ্ (সা) নিজে তদারকি করেছেন। আবু বকর (রা)-এর ব্যক্তিপর্যায়ের দাওয়াহ্’কে তিনি তদারকি করেছেন। আবু বকর (রা) ছিলেন তার পরিচিতজনদের নিকট উচ্চ চরিত্রের অধিকারী, তারা তার সঙ্গ পছন্দ করতেন এবং বিভিন্ন বিষয়ে তার কাছে পরামর্শ চাইতেন। তিনি (রা) তার প্রভাব খাটিয়ে উসমান বিন আফ্ফান, পাশাপাশি যুবায়ের ইবনে আল-আওয়াম, আব্দুর রহমান ইবনে আওফ, সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাস এবং তালহা ইবনে ওবায়দুল্লাহ্ প্রমূখকে ইসলাম গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করেন। আবু বকর (রা) তাদেরকে রাসূলুল্লাহ্ (সা) নিকট হাজির করান এবং তারা প্রত্যেকে তাদের ঈমান আনয়নকে নিশ্চিত করেন এবং নামায আদায় করেন।
এবং রাসূলুল্লাহ্ (সা) প্রকাশ্য গণসংযোগকেও অত্যন্ত গুরুত্ব এবং যত্নসহ তদারকি করেছেন। মুসা’ব (রা)-কে তিনি (সা) মদীনাতে প্রেরণ করেন এবং একবছরের মধ্যে তিনি (রা) একে প্রথম ইসলামী রাষ্ট্রের ক্ষেত্রভুমি হিসেবে প্রস্তুত করতে সক্ষম হন। কারণ সেখানে ইসলামগ্রহণকারীর সংখ্যা কম হলেও আল্লাহ্’র রাসূল (সা)-এর মাত্র একজন সাহাবীর (মুসা’ব বিন উমায়ের) বলিষ্ঠ প্রকাশ্য গণসংযোগ সমাজের প্রচলিত চিন্তা ও আবেগকে রূপান্তরিত করে মদীনার সমাজব্যবস্থার মধ্যে পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম হয়। মুসা’ব বিন উমায়ের (রা.) একাই মদিনাকে পরিবর্তন করে ফেলেন, মদিনায় প্রচলিত চিন্তা ও আবেগকে রূপান্তর ঘটিয়ে ফেলেন। মদিনার বৃহত্তর জনগোষ্ঠী এমনভাবে ইসলাম গ্রহণ করে যা ঐ সমাজের সামষ্টিক চিন্তাজগতের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলতে সক্ষম হয়, এবং রাতারাতি তাদের চিন্তা ও আবেগসমূহের মধ্যে আমূল পরিবর্তন ঘটে। এ থেকে এটাই প্রতিয়মান হয় যে ইসলামগ্রহণকারীগণ যখন প্রকাশ্য গণসংযোগে বলিষ্ঠ এবং পারদর্শী হয় তখন সমাজের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মধ্যে ব্যাপক সাড়া জাগানো প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হতে বাধ্য। তাছাড়া এ থেকে এটাও প্রতিয়মান হয় যে, যদি নতুন কোন চিন্তা ও আবেগ দ্বারা সমাজের বিদ্যমান পারস্পরিক সম্পর্কগুলো প্রভাবিত হয়, তবে ঐ চিন্তার বাহকের সংখ্যা যতই ক্ষুদ্র হোক না কেন তা অভীষ্ট সমাজ পরিবর্তনের লক্ষ্যে পৌঁছে যাবে। মদীনার লোকেরা সমাজে বিদ্যমান চিন্তাসমূহের ক্রটি অনুধাবন করেছিল এবং তারা বিকল্প চিন্তা ও জীবনব্যবস্থার অনুসন্ধান করছিল। আর এজন্যই ইসলামের দাওয়াহ্’র প্রতি ব্যাপক সমর্থন পেতে মুসা’ব ইবনে উমায়েরকে বেশী সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়নি, তিনি প্রকাশ্যে মদীনার জনগণকে ইসলামের দিকে আহ্বান করেন এবং ইসলামের চিন্তা ও বিধি-বিধানসমূহের শিক্ষা দেয়া শুরু করেন। তিনি মদিনার জনগণের কাছ থেকে দ্রুত ইতিবাচক সাড়া এবং ইসলামের গ্রহণের ব্যাপারে স্বতঃস্ফূর্ততা দেখতে পান। ইসলামী বিধি-বিধানসমূহ শিক্ষালাভ এবং জানার ব্যাপারে তাদের ব্যাপক আগ্রহ দেখে তিনি উৎফুল্ল হন। চোখের সামনে মুসলিমদের দ্রুত সংখ্যা বৃদ্ধি এবং ইসলামের প্রসার দেখে আরও অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি দাওয়াহ্’র প্রচেষ্টাকে বহুগুণে বাড়িয়ে দেন।
রাসূলুল্লাহ্ (সা) তীক্ষ্নদৃষ্টি দিয়ে প্রকাশ্য গণসংযোগের প্রতিক্রিয়া এবং ফলাফলগুলো পর্যবেক্ষন করছিলেন। হজ্বের মৌসুমের প্রাক্কালে মুসা’ব (রা) মক্কায় ফিরে আসলে রাসুলুল্লাহ্ (সা) তার কাছ থেকে মদীনার সার্বিক অবস্থার খোঁজ-খবর নেন। সেখানকার মুসলিম ও তাদের ক্রমবর্ধমান শক্তি, ইসলাম ও এর দ্রুত প্রসারসহ মদীনার সার্বিক অবস্থার তথ্য নেন। তাছাড়া সেখানকার জনগণের মধ্যে শুধুমাত্র আল্লাহ্’র রাসূল (সা)-কে নিয়ে আলোচনা কতটুকু, এবং ইসলাম সমাজের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু কিনা এসব বিষয়েরও তথ্য নেন। মুসা’ব (রা.) মুসলিমদের সামর্থ্য এবং রুঁখে দাড়ানো শক্তি যা ইসলামকে মদিনার আধিপত্যশীল শক্তিতে রূপান্তর করেছে, সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে অবগত করেন। তিনি আরও জানান যে দাওয়াহ্ এবং আল্লাহ্’র দ্বীনকে রক্ষার ব্যাপারে কিছু মুসলিমের বিশ্বাস এবং দৃঢ়সংকল্প পূর্বের যেকোন সময়ের তুলনায় বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে।
…তাই একইভাবে দাওয়াহ্ বহনকারীগণদের অবশ্যই ব্যাপক গণসংযোগে লিপ্ত হতে হবে। এবং এই গণসংযোগকে শুধুমাত্র ব্যক্তিপর্যায়ের গন্ডির মধ্যে বিদ্যমান কিছু ব্যক্তি কিংবা গোষ্ঠী কিংবা জমায়েতের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না। বরং জনমত এবং জনসচেতনতাকে আরও পাকাপোক্ত এবং শক্তিশালী করতে একে সামষ্টিক পর্যায়ের প্রকাশ্য গণসংযোগের দিকে ধাবিত করতে হবে। মুসলিমদেরকে বাজার, মসজিদ কিংবা রাজপথ, প্রকাশ্য গণসংযোগের প্রত্যেকটি সুযোগকে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে হবে। তাদেরকে কর্মস্থল এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আলোচনা সভার আয়োজন করতে হবে। মুসলিমদের সমসাময়িক এবং চলমান বিভিন্ন বিষয়ের ব্যাপারে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ফোরাম এবং সমাবেশে তাদের বক্তব্য অবশ্যই অত্যন্ত সুস্পষ্ট হতে হবে। প্রকাশ্য গণসংযোগ গতানুগতিক ও গঁধবাঁধা নয়, বরং অবশ্যই বলিষ্ঠ ও সুপরিকল্পিত হতে হবে। জনগণের প্রতিক্রিয়াকে খুবই যত্নসহকারে পর্যালোচনাকেও এর মধ্যে অন্তর্ভূক্ত করতে হবে এবং এতে জনগণের কাছে কি কি বিষয় সুস্পষ্ট এবং কি কি বিষয় অস্পষ্ট তা বেরিয়ে আসবে। পাশাপাশি এসব বিষয়ে যুক্তিগুলো এবং যুক্তিগুলোর সাথে ইসলামের দৃঢ় ও সুস্পষ্ট সংযোগ স্থাপনের ব্যাপারে যথেষ্ট প্রস্তুতি থাকতে হবে। প্রকাশ্য গণসংযোগের সর্বোচ্চ ফলাফল পাওয়ার জন্য প্রয়োজনে উপযুক্ত স্থান-কাল নির্বাচন করতে হবে। জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতা যাই হোক না কেন এই বলিষ্ঠ এবং কার্যকরী প্রকাশ্য গণসংযোগের ফলে শুরুতেই জনগণের কাছ থেকে ব্যাপক উৎসাহব্যাঞ্জক সাড়া দাওয়াহ্ বহনকারীর মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনার সৃষ্টি করে। এই বলিষ্ঠ গণসংযোগ তাকে দাওয়াহ্ বহনের দক্ষতাকে আরও বৃদ্ধির লক্ষ্যে আরও জ্ঞান অন্বেষণে বাধ্য করবে, কারণ জনগণ তখন তার কাছে অতিগুরুত্বপূর্ণ সমস্যাগুলোর সমাধান চাইবে। এবং সর্বোপরী, ফলাফল এবং পুরষ্কার একমাত্র আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা’র হাতে এই উদ্দেশ্যকে মাথায় রেখে এবং অর্জিত জ্ঞানের প্রতি পূর্ণ আস্থা রেখে এই গণসংযোগ পরিচালনা করতে হবে। ইন্শা’আল্লাহ্, এসব প্রস্তুতি গণসচেতনতাকে আরও গতিশীল করে শক্তিশালী অবস্থানে পৌঁছাতে সাহায্য করবে।
খিলাফতের ট্রেন তার সর্বশেষ গন্তব্যের দিকে দ্রম্নত ছুটে আসছে এবং ইসলামী উম্মাহ্ এবং উম্মাহ্’র বিরুদ্ধে অবস্থানকারী উভয় গোষ্ঠীই এর উপস্থিতি টের পাচ্ছে। সুতরাং, মুসলিমদের উচিত এই গতিকে আরও বাড়িয়ে দেয়া এবং খিলাফতের প্রত্যাবর্তনের পূর্বে সমাজের জনমত ও জনসচেতনতাকে আরও যতটুকু সম্ভব শক্তিশালী করে নেয়া, কারণ তা সন্নিকটে, ইন্শা’আল্লাহ্। নিশ্চয়ই হতাশার পরেই রয়েছে আশার আলো, এবং দুঃখের পর সুসংবাদ, এবং কষ্টের পর স্বস্তি, এবং দূর্ভোগের পর আরাম, এবং তা হবে দীর্ঘস্থায়ী।
(وَيَوْمَئِذٍ يَفْرَحُ الْمُؤْمِنُونَ * بِنَصْرِ اللَّهِ يَنْصُرُ مَنْ يَشَاءُ وَهُوَ الْعَزِيزُ الرَّحِيم)
“এবং সেদিন মু’মিনগণ আল্লাহ্ প্রদত্ত বিজয় দ্বারা আনন্দিত হবে। তিনি যাকে ইচ্ছা তাকে বিজয় দান করেন, এবং তিনি পরাক্রমশালী, পরম করুণাময়। ” [সূরা আর-রূম: ৪-৫]