মুসলিম উম্মাহর অধঃপতনের মূল কারণ চিন্তার অধঃপতন

মুসলিম উম্মাহ্ বর্তমানে যে পশ্চাদপদতা ও লাঞ্ছনার গহ্বরে পতিত তা থেকে উম্মাহ্কে উদ্ধার করা এবং উম্মাহকে কুফরী চিন্তা, কুফরী ব্যবস্থা, কুফরী বিধি-বিধান, কুফর দেশসমূহের আধিপত্য ও প্রভাব-প্রতিপত্তি থেকে মুক্ত করা কেবল মাত্র তখনই সম্ভব হবে যখন উম্মাহর চিন্তার বর্তমান অধঃপতনকে পরিবর্তন করে উন্নত চিন্তার বিকাশ ঘটানো যাবে আর এটা করার উপায় হচ্ছে যে চিন্তাগুলো মুসলিম উম্মাহ্কে অপদস্থতার এই চরম অবস্থা পর্যন্ত এনে পৌঁছিয়েছে সেগুলোকে চিহ্নিত করে ইসলামী চিন্তা দ্বারা সেগুলোর পরিবর্তন ঘটানো।

বস্তুতঃ উম্মাহর বর্তমান অবস্থার কারণ হচ্ছে ইসলামকে বুঝে তার বিধি-বিধানকে মান্য করার ক্ষেত্রে ধারাবাহিক অবহেলা এবং দুর্বলতা, যা অনেক আগে থেকে শুরু হয়ে আজও চলছে। এই চিন্তাগত অধঃপতনের দরুন উম্মাহ্‘র মাঝে বহু নতুন বিষয়ের উদ্ভব ঘটেছে, যার প্রধান প্রধান কিছু বিষয় নিচে উল্লেখ করা হলো।

ক. হিন্দু, পারসিক এবং গ্রীক দর্শনের অনুপ্রবেশের পর ইসলাম আর এসব দর্শনের মাঝে পূর্ণ বৈপরিত্য থাকা সত্বেও কেউ কেউ ইসলামকে এগুলোর সাথে মিলানোর চেষ্টা করেছেন।

খ. ইসলামের দুশমনরা ইসলামের দুর্নাম করা এবং মুসলমানদেরকে ইসলাম থেকে দূরে রাখার জন্য ইসলামের নামে মুসলমানদের মাঝে এমন কিছু বিধি-বিধান ও চিন্তার অনুপ্রবেশ ঘটাতে সক্ষম হয়েছে, যা আদৌ ইসলামী নয়।

গ. ইসলামের উপলব্ধি এবং এর বিধি-বিধানগুলো কার্যকর করার ক্ষেত্রে আরবী ভাষার প্রতি অবহেলা প্রদর্শনের ক্রমবর্ধমান ধারাবাহিকতার এক পর্যায়ে হিজরী সপ্তম শতাব্দীতে একে ইসলাম থেকে পৃথক করে দেওয়া হয়েছে; যদিও আল্লাহ্‌র দ্বীনকে তার মূল ভাষা থেকে বিচ্ছিন্ন করে অন্য কোন ভাষা দিয়ে পুরোপুরি উপলব্ধি করা অসম্ভব। তাছাড়া নতুন নতুন পরিস্থিতিতে ইজতিহাদের মাধ্যমে মাসআলা ইস্তিম্বাত করা এবং সে আলোকে ফাতওয়া প্রদানের জন্য আরবী ভাষার নাহু-সরফ, আদাব, বালাগাত-ফাসাহাত (ব্যাকরণ, সাহিত্য ও অলংকার) ইত্যাদি বিষয়ের সুগভীর জ্ঞান থাকা অত্যাবশ্যক।

ঘ. খৃষ্টীয় সতের শতাব্দী হতে পশ্চিমা কুফর দেশগুলো মুসলমানদের উপর মিশনারী, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক আগ্রাসন চালাতে শুরু করে। তাদের এই আগ্রাসনের উদ্দেশ্য ছিল উম্মাহর মধ্যে ইসলামের বুঝ এর ব্যাপারে বিকৃতি ঘটিয়ে মুসলমানদেরকে ইসলাম থেকে বিচ্ছিন্ন করার মাধ্যমে ইসলামকে ধ্বংস করা।

এহেন পরিস্থিতিতে মুসলমানদেরকে জাগ্রত করার জন্য বিভিন্ন ভাবে প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে। ইসলামী-অনৈসলামী বহু আন্দোলনের জন্ম হয়েছে। কিন্তু বাস্তবিক অর্থে সবই অকৃতকার্য রয়ে গেছে। না মুসলমানদেরকে জাগ্রত করা সম্ভব হয়েছে, না অধঃপতন ও জিল্লতীর পথ রোধ করা গেছে। ইসলাম দ্বারা মুসলমানদেরকে জাগ্রত করার এসব চেষ্টা ও আন্দোলন সফল না হওয়ার পিছনে অনেক কারন রয়েছে, যেমন-

(১) অনেক ক্ষেত্রেই এমন হয়েছে যে, যাঁরা মুসলমানদেরকে জাগ্রত করার সুকঠিন দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন, তারা নিজেরাই ইসলামিক চিন্তাকে যথাযথ গভীরতায় অনুধাবন করেননি। এটা এ জন্য হয়েছে যে, তাঁরা প্রায়শই কিছু আচ্ছন্নকারী বিষয় দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। তাঁরা মুসলিম উম্মাহ্কে জাগ্রত করার মাধ্যম হিসাবে সুনির্দিষ্ট কোন চিন্তা ও পদ্ধতির কথা বলেননি; বরং মোটা দাগে ইসলামের দিকে আহ্বান করেছেন। মুসলমানদের বাস্তব সমস্যাবলীর ইসলামিক সমাধান এবং ঐ সমাধানগুলোর প্রায়োগিক দিক নিয়ে তারা সুগভীর আলোচনা করেননি। এসব সমাধানগুলো তাঁদের নিজেদেও চিন্তার মাঝেও স্বচ্ছভাবে ছিলনা। ফলে বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে পারিপার্শিক অনৈসলামিক বাস্তবতাই তাদের চিন্তার ভিত্তি হিসাবে কাজ করেছে। শুধু তাই নয়, বাস্তবতার সাথে ইসলামকে মিলানোর জন্য কেউ কেউ ইসলামের এমনসব ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেছেন, যা নুসূস তথা কুরআন ও হাদীস দ্বারা অনুমোদিত নয় এবং যা রাসূল (সা) ও সাহাবায়ে কিরাম থেকে বর্ণিত হয়ে আসা মূল ব্যাখ্যার পরিপন্থী। মোট কথা অনৈসলামিক বাস্তবতাকে ইসলাম দ্বারা পরিবর্তন করার বিষয়টিকে মুখ্য হিসাবে দেখার পরিবর্তে প্রচলিত বাস্তবতার সাথে ইসলামকে মিলিয়ে ও মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। এজন্যই ব্যক্তিস্বাধীনতা, গণতন্ত্র, পুঁজিবাদ, জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র ইত্যাদির সাথে ইসলামের পরিপূর্ণ বৈপরিত্য থাকা সত্বেও তাঁদের কেউ কেউ এগুলোকে ইসলামী বলে গণ্য করেছেন এবং মানুষকে এগুলোর প্রতি আহ্বান করেছেন।

(২) ইসলামী চিন্তা ও আহকাম বাস্তবায়নের সঠিক ও সুনির্দিষ্ট পন্থা অবলম্বন করার পরিবর্তে আপাতঃ ফলদায়ক কিছু করাকেই তাদের কেউ কেউ ইসলাম বাস্তবায়নের পথ মনে করেছেন। আর ইসলামী পুণঃর্জাগরণের উপায় হিসাবে শুধুমাত্র মসজিদ নির্মাণ, বই পত্র প্রকাশ, দাতব্য ও সমাজ-সেবা মূলক প্রতিষ্ঠান খোলা, চরিত্র গঠন ও ব্যক্তির সংশোধনকেই মনে করেছেন যথেষ্ট। অন্য দিকে সমাজ নষ্ট হওয়া কিংবা সমাজের উপর প্রাধান্য বিস্তারকারী কুফর চিন্তা, কুফর ব্যবস্থা ও কুফর বিধি-বিধানের প্রাবল্য সম্পর্কে তারা ছিলেন অনেকটাই অমনোযোগী। তাদের ধারনা ছিল ব্যক্তির সংশোধন দ্বারাই সমাজ সংশোধন হয়ে যাবে। অথচ সমাজ সংশোধন করার কার্যকর উপায় হচ্ছে ব্যক্তির সংশোধনের পাশাপাশি সমাজের চিন্তাধারা, অনুভূতি এবং ব্যবস্থাদিরও সংশোধন করা । আর ব্যক্তির সংশোধনও অনেকাংশে সমাজ সংশোধন দ্বারাই সম্ভব। কারন সমাজ শুধুমাত্র কতিপয় ব্যক্তির সমষ্টিরই নাম নয়, বরং সমাজ হচ্ছে ব্যক্তি ও কতিপয় সম্পর্কের সমষ্টির নাম। অর্থাৎ সমাজ বলা হয়, ব্যক্তি, চিন্তা, অনুভূতি এবং শাসন ব্যবস্থার সমষ্টিকে। তাই সমাজ পরিবর্তন করতে হলে এ সবগুলোকেই পরিবর্তন করতে হবে। রাসূলুল্লাহ (সা) জাহেলী সমাজকে ইসলামী সমাজে পরিবর্তন করার জন্য এ কাজগুলোই করেছেন। তিনি (সা) সমাজে বিদ্যমান আকীদা (বিশ্বাস) কে পরিবর্তন করে ইসলামী আকীদায় পরিনত করেছেন। জাহেলী চিন্তা-ভাবনা, ধ্যান-ধারণা এবং প্রথাগুলোকে তিনি ইসলামী চিন্তা- ভাবনা, ইসলামী ধ্যান-ধারণা এবং ইসলামী আচরণ দ্বারা পরিবর্তন করে দিয়েছেন। এভাবেই আল্লাহ্‌র রাসূল (সা) মানুষের আবেগ-অনুভুতি তগুলোকে জাহেলী চিন্তা, জাহেলী বিশ্বাস এবং জাহেলী প্রথা থেকে বিচ্ছিন্ন করে ইসলামী আকীদা এবং ইসলামী চিন্তা ও আহকামের সাথে সম্পৃক্ত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। আর এ পথেই আল্লাহ্‌ সুবহানাহু তা‘আলা তাঁর রাসূলকে মদীনার সমাজ ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনার মর্যাদায় ভূষিত করেছেন। যখন উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মদীনাবাসী ইসলামী আকীদার সাথে সংশ্লিষ্ট হয়েছেন এবং তাঁরা ইসলামী চিন্তা, ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি এবং ইসলামী আহকামকে আপন করে নিয়েছেন, তখনই তিনি (সা) এবং তাঁর সাহাবীগণ “বাই‘আতে‘আকাবায়ে ছানিয়ার” (আকাবার দ্বিতীয় বাই‘আত) পর মদীনায় হিজরত করেছেন এবং সেখানে ইসলামী বিধি-বিধান সমূহ রাষ্ট্রীয়ভাবে কার্যকর করার পদক্ষেপ নিয়েছেন। এভাবেই মদীনায় একটি ইসলামী সমাজ কায়েম হয়েছিল।

(৩) কেউ কেউ মনে করেছেন মুসলিম জনগনের উপর শক্তি প্রয়োগ করে ইসলামের পুর্ণজাগরণ সম্ভব। তাই তারা অস্ত্র তুলে নিয়েছেন। কিন্তু তারা “দারুল কুফর” এবং “দারুল ইসলামের” মাঝে পার্থক্য করতে সক্ষম হননি। তারা এটাও উপলব্ধি করেননি যে, দারুল কুফর এবং দারুল ইসলামে দাওয়াত এবং অন্যায়ের প্রতিবাদ করার ক্ষেত্রে কী ধরনের ভিন্নতা থাকা উচিত? আজকে আমরা যে সব দেশে বসবাস করছি, এগুলোও নীতিগতভাবে দারুল কুফর। কারন এখানে মুসলমানদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলেও কাফেরদের চিন্তা, বিধি-বিধান ও কুফরী শাসন ব্যবস্থাই কার্যকর। এ অবস্থাটি হযরত মুহাম্মদ (সা) এর নবুয়্যত প্রাপ্তির সময়ের মক্কা শরীফের অবস্থার সাথে অনেকাংশেই সামঞ্জস্যপূর্ণ। অতএব, এখানের দাওয়াতের ধরনও হবে সেসময়ের মতই। অর্থাৎ এক্ষেত্রে রাসূল (সা) এর মক্কী জীবনের সুন্নাহ্ অনুযায়ী ইসলাম প্রতিষ্ঠার কর্মসূচীগুলো শুধু দাওয়াত ও রাজনৈতিক কার্যক্রমের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে, কোনরূপ সশস্ত্র তৎপরতার রূপ লাভ করবেনা। কারণ তখনকার কাজের উদ্দেশ্য এটা ছিলনা যে, শুধুমাত্র এমন কোন শাসককে হটানো যে ইসলামী রাষ্ট্রে কুফর আইন চালু করেছে কিংবা সে নিজে ইসলাম থেকে বের হয়ে গেছে (যাকে শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে অপসারণ করলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে) বরং উদ্দেশ্য ছিল একটি দারুল কুফরকে তার সমস্ত চিন্তা ও ব্যবস্থাদিসহ পুরোপুরি পরিবর্তন করা। আর এই পরিবর্তন সম্ভব সে দেশের বা সে সমাজের ব্যাপক জনগণের মধ্যে বিদ্যমান চিন্তা, অনুভূতি এবং প্রচলিত রাষ্ট্রকাঠামোকে পুরোপুরি পরিবর্তনের মাধ্যমে। রাসূল (সা) মক্কায় সে উদ্দেশ্যেই কাজ করেছিলেন। অপরদিকে দারুল ইসলামের বিষয়টি ভিন্ন। দারুল ইসলাম হচ্ছে এমন ভূমি যেখানে আল্লাহ্‌র অবতীর্ন আহ্কাম দ্বারা রাষ্ট্র পরিচালিত হয়ে আসছে। কিন্তু কোন শাসক যদি ক্ষমতায় এসে সরাসরি স্পষ্ট কুফরী বিধান দ্বারা প্রকাশ্যে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে শুরু করে, তাহলে তার বিরোধিতা করা মুসলমানদের জন্য ফরয। মুসলমানরা তাকে চ্যালেঞ্জ করবে, যেন সে পুনরায় ইসলামের দিকে ফিরে আসে। যদি সে ফিরে না আসে, তাহলে তার বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করা উম্মাহ্‘র উপর ফরয হয়ে যাবে এবং এর মাধ্যমে তাকে পুনরায় আল্লাহ্‌র নাযিলকৃত বিধান চালু করার জন্য বাধ্য করা হবে। যেমন হযরত উবাদাহ বিন সামিত (রা)-বর্ণিত এক হাদীসে আছে,

“এবং (আমরা রাসূল (সা) এর সাথে এ বাই’আতও করেছি যে) আমরা ‘উলূল আমরের’ সাথে ততক্ষন পর্যন্ত বিবাদ করবনা, যতক্ষন না সে প্রকাশ্য কুফুরীতে লিপ্ত হয়; (রাসূল সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন) এমন কুফুরী যে বিষয়ে তোমাদের কাছে আল্লাহর পক্ষ থেকে আগত কোন শক্তিশালী প্রমান রয়েছে।”

ইমাম মুসলিম (রহ) হযরত আ’উফ ইবনে মালিক (রা) এর সূত্রে বর্ণনা করেন,

“বলা হলো হে আল্লাহর রাসূল! আমরা কি তরবারী দ্বারা তাদেরকে অপসারণ করবো না ? তিনি বললেন ‘না! যতক্ষন পর্যন্ত তারা তোমাদের মাঝে সালাত কায়েম রাখবে।

সালাত কয়েম রাখার কথা বলে এখানে ইসলামী আহ্কাম মোতাবেক শাসন পরিচালনার প্রতি ইংগিত করা হয়েছে (দ্বীনের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ রুকন উল্লেখ করে সম্পূর্ণ দ্বীনকে বুঝানোর মূলনীতি অনুযায়ী)।’ এই দু’টি হাদীস আমাদেরকে দারুল ইসলামে শাসকদেরকে চ্যালেঞ্জ করা এবং তাদেরকে স্পষ্ট কুফরী থেকে বিরত রাখার জন্য কিভাবে কখন অস্ত্র ধরা বা শক্তি প্রয়োগ করা যাবে, তার পন্থা শিখিয়ে দিয়েছে।

Leave a Reply